Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

নীরবে চলে গেল জাতীয় সম্প্রচার দিবস

চিরকালের মত থেমে গেছে আওয়াজ, ধুলো পড়েছে সর্বাঙ্গে, আজ তার ওপর হাত রাখে না কেউ। বাঙালির জীবন থেকে অন্যান্য অনেক কিছুর মতই হারিয়ে গেছে রেডিও। তাই জাতীয় সম্প্রচার দিবসের মুহূর্তেও অবহেলায় পড়ে রইল মালদা জেলার কালিয়াচকের অন্তর্গত বাঙ্গিটোলা হাইস্কুলের গ্রন্থাগারে রাখা ১৯৩৯ সালের মারফি কোম্পানির রেডিও সেট।

রেডিও বিষয়ে উৎসাহী সংগ্রাহকদের মতে, এই রেডিও সেটটি মালদা জেলার একটি অন্যতম প্রাচীন রেডিও সেট। ইতিহাস বলে, ১৯২৭ সালের ২৩ জুলাই ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি নামে তৎকালীন বোম্বাই প্রেসিডেন্সির একটি প্রাইভেট সংস্থা ভারতবর্ষের মাটিতে প্রথম রেডিও সম্প্রচার শুরু করে। তখন ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনাধীন। রেডিওর আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা দেখে ১৯৩৬ সালের ৮ জুন অল ইন্ডিয়া রেডিও নামে সরকারিভাবে বেতার সম্প্রচারের কাজ আরম্ভ হয়। ১৯৩৮ পরবর্তী সময় থেকে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া আকাশবাণী নামেই সারা ভারতবর্ষব্যাপী পরিচিত হয় রেডিও সম্প্রচার। জনমানসে রেডিও সম্প্রচারের প্রভাবকে স্মরণীয় রাখতে ২৩ জুলাই জাতীয় সম্প্রচার দিবস হিসাবে পালিত হয়।

বাঙ্গিটোলা স্কুল লাইব্রেরিতে রক্ষিত এই প্রাচীন রেডিও সেটটি সেই প্রাচীন যুগের ইতিহাস বহন করছে। রেডিওর ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিক ছবি দেখে অনুমানে জানিয়েছেন, এই মডেলটি ১৯৩৯ সালে তৈরি এ-৪৬ ভালভ-টিউব রেডিও। সরাসরি ইলেকট্রিকের মাধ্যমে রেডিওটি চলত। অ্যান্টেনার মাধ্যমে বেতার তরঙ্গকে ধরা হত। রেডিও সেটটি কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল, না বিদ্যালয় থেকেই আলাদাভাবে কেনা হয়েছিল তা সম্পর্কে কোনও পরিষ্কার তথ্য পাওয়া যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাঙ্গিটোলা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৭ সালে। ফলে এই রেডিওটি অনায়াসে ৮০ বছরেরও বেশি পুরনো।

বাঙ্গিটোলা গ্রামের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা শিক্ষক মলয়কুমার ঝা বলেন, “বাঙ্গিটোলা একসময় একটি সমৃদ্ধ গ্রাম ছিল। একসময় বাড়িতে রেডিও থাকা সমৃদ্ধির লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হত। এখন সব কিছুই হারিয়ে গেছে। তবুও আমাদেরই গ্রামে এমন একটি প্রাচীন রেডিও সেট আছে জানতে পেরে ভাল লাগছে।”

বাঙ্গিটোলা স্কুল লাইব্রেরিতে রক্ষিত এই প্রাচীন রেডিও সেটটি।

মালদা শহরে রেডিও ও প্রাচীন গ্রামোফোন রেকর্ডের সংগ্রাহক পার্থ বসু বলেন, “১৯৭২ সালের মারফি এ-৪৮৪ মডেলটি আমার বাড়িতেই আছে। আমরা ছোটবেলা থেকে মারফি এবং ফিলিপসের রেডিও শুনেই বড় হয়েছি। দু-এক বছর আগেও মহালয়ার ভোরে আমি এই রেডিওতেই মহিষাসুরমর্দিনী শুনেছি। সময়ের পরিবর্তনে আজ রেডিও হারিয়ে গেলেও ভালভ-টিউব লাগানো মারফি রেডিওর অ্যান্টিক ভ্যালু আছে। অবশ্যই এই প্রাচীন রেডিওটিকে সংরক্ষণ করা দরকার।”

আরেক সংগ্রাহক শুভদীপ চক্রবর্তী বলেন, “মারফি কোম্পানির পুরনো রেডিও আমিও সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছিলাম। বিশেষত ভালভ-টিউব লাগানো রেডিও। কিন্তু রথবাড়ির দু-একটি দোকান এবং দু’নম্বর গভর্নমেন্ট কলোনির ধীরেন দাস মহাশয় ছাড়া এই রেডিওগুলি সারানোর কাজ কেউই করতে পারেন না। ফলে মূল্যবান জেনেও এগুলি ব্যবহার বা কেনার ভরসা পাই না।”

বাঙ্গিটোলা হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক সৌমিত্র সেনগুপ্ত বলেন, “এই স্কুলের ঐতিহ্যবাহী লাইব্রেরির মত এই প্রাচীন রেডিও সেটটিও স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। আমরা একে সযত্নে রক্ষা করব।”

২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অনুরাগ বসু পরিচালিত ‘বরফি’ সিনেমাতেও মারফি রেডিও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছিল। একটি বোবা শিশুর নাম ‘বরফি’ যা আসলে ‘মারফি’-র অপভ্রংশ! প্রিয় রেডিওর গান শুনিয়ে তাকে কথা শেখানোর চেষ্টা করছিলেন মা, ইলেকট্রিক শক খেয়ে মায়ের মৃত্যু ঘটে। মাতৃহীন শিশুটি কথাহীন বড় হয়ে ওঠে, তার বুকের ভিতরে ফল্গুস্রোতের মত সুর, ঠিক পুরনো অকেজো মারফি রেডিওর মত।

তবুও সময় এগোয়, স্মৃতি এগোয়… পড়ে থাকে খয়রাতের পাণ্ডুলিপি, লাখেরাজ, ব্রহ্মোত্তর। পূর্ণ সন্ধ্যা ঘনিয়ে ওঠার আগেই বাঙ্গিটোলা স্কুলের সামনের চণ্ডীমণ্ডপ পেরিয়ে স্মৃতিরা ঘুরেফিরে বেড়ায় এ গ্রামের পিচ খামচানো রাস্তায়। তিরাশি বছর ধরে কেটে গেল এই পাশাপাশি বসবাস। অথচ তিরাশি বছর ধরে যেন থাকাই হল না কোথাওই। কোথাও বাজল না পিয়ানো, কোথাও ঘনিয়ে ওঠেনি দ্বিজেন মুখার্জির কম্বুকণ্ঠে ভাঙাতরীর গান। রথবাড়ির সেই রেডিও দোকান উঠে গেছে কোনকালে। তবু যেসব রেডিও সারানো হল না, যেসব সেরে ওঠা রেডিও তাদের মালিকেরা বাড়ি নিয়ে গেল না তাদের মধ্যে থেকেও গুমগুম করে উঠল গান। তাদের সুর নেই, বাণী নেই শুধু হারিয়ে যাওয়াটুকু আছে। সেই কবে মুক্তকেশী পূজার মেলায় গেয়ে গিয়েছিলেন পূর্ণদাস বাউল, সেই সময়ের রেডিও আর্টিস্ট… সেই হারানো সুরও যেন ঢুকে পড়ল এই মারফি রেডিওর মধ্যে। তিরাশি বছর ধরে সে বাস করেছে পুরনো লাইব্রেরি ঘরের দমবন্ধ করা অন্ধকারে; তিরাশি বছর শুধু কেটে গেল ভাঙাতরীর…

চিত্র: লেখক
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

সন্দীপ মজুমদার

মামলায় জয়ী হয়ে থোড় কুঁচি দিয়ে কালীর আরাধনা করেন জমিদার-গিন্নি

রূপনারায়ণ মজুমদারের হাত ধরেই মা মহাকালীপুজো শুরু হয়। যেহেতু জমিদার-গিন্নি পুজোর উপকরণ হিসাবে কলা-থোড় কুঁচোর কথা মুখে এনেছিলেন, তাই পুজোর অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে সেদিন দেবীকে থোড় কুঁচোও উৎসর্গ করা হয়েছিল। আজ ১৬৯ বছর পরেও সেই রীতির কোনও পরিবর্তন হয়নি। এখনও মজুমদার বাড়ির কালী পুজোয় অন্যান্য সকল উপকরণের সঙ্গে মা মহাকালীকে থোড় কুঁচানো দেওয়া হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বরিশাল শ্মশান-দীপালি

সমগ্র উপমহাদেশে বরিশাল শ্মশান একটি বিশেষ কারণে অনন্য। এই শ্মশানের বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিবছর কার্তিকী অমাবস্যায়, (যাকে শাস্ত্রে ‘অশ্বযুজা’ মাস বলে) সেখানকার এই শ্মশানে যে কালীপুজো হয়, সেখানকার পুজোর আগের দিন ভূতচতুর্দশীর রাতে লক্ষ লোকের সমাবেশ হয়। উদ্দেশ্য, ওখানে যাঁদের দাহ করা হয়েছে, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। সমগ্র শ্মশান জুড়ে কয়েক হাজার মঠ বা স্মৃতিসৌধ আছে, মুসলমানদের যেমন আছে বনানী বা অন্য বহু গোরস্তানে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বৌদ্ধসম্প্রদায়ের প্রবারণা ও কঠিন চীবরদান উৎসব

বিশ্বের বহু দেশেই এই উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। স্পেন ও ফ্রান্স-সহ ইয়োরোপীয় দেশে চীনা, জাপানি, বাঙালি বৌদ্ধরা পালন করেন যেমন, তেমনই বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি থেকে কুয়াকাটা-কলাপাড়া এই উৎসবে মেতে ওঠে। ইওরোপীয়দের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েকবছর আগে দালাই লামা যেবার শিলিগুড়িতে তাঁর বার্ষিক অনুষ্ঠান করলেন, সেবার প্যারিস থেকে আগত বেশ কিছু ফরাসির সঙ্গে আলাপ হয়, যাঁরা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত। তাঁদের কাছেই শুনেছিলাম, ফ্রান্সে বহু মানুষ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিচ্ছেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপুজো: অতীত দিনের স্মৃতি

মহালয়া দিয়ে হত পুজোর প্রকৃত সূচনা। শরতের ভোররাতে আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত এই অনুষ্ঠানটির শ্রোতা অন্তহীন, এবং এখনও তা সমান জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও অনুষ্ঠানটির শ্রোতা অগণিত। আমাদের শৈশবে বাড়ি বাড়ি রেডিও ছিল না, টিভি তো আসেইনি। বাড়ির পাশে মাঠে মাইক থাকত, আর প্রায় তিনশো গজ দূরের এক বাড়িতে মাউথপিস রাখা থাকত। সেখান থেকে ভেসে আসত মহালয়ার গান, ভাষ্য।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপূজা, মূর্তিপূজা: দেশে দেশে

আসলে বাঙালি নিরন্তর এক অনুসন্ধানী, ব্যতিক্রমী, অভিনব-চিন্তক, ক্রমবিকাশপ্রিয় ও অন্তিমে রহস্যময় জাতি। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমান আস্তিক নাস্তিকে মিলিত এই জাতি সঙ্ঘারাম আর মিনার, ধ্বজা ও ওংকার, জগমোহন-মিরহাব-স্তূপ-ভস্মাচ্ছাদিত এক জাতি, নিজ মুদ্রাদোষে নয়, মু্দ্রাগুণে আলাদা।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শারদোৎসব: বাংলাদেশে

দুর্গাপুজো কেবল ভক্তের জন্য-ই নয়, ভাল লাগাদের জন্যও। যে ভাল লাগা থেকে ভাই গিরীশচন্দ্র সেন কোরানশরীফ বাংলায় অনুবাদ করেন, অদ্বৈত আচার্য যবন হরিদাসের উচ্ছিষ্ট নিজহাতে পরিষ্কার করেন, স্বামী বিবেকানন্দ মুসলিম-তনয়াকে কুমারীপুজো করেন! দুর্গা বাঙালির কাছে, ধর্মনির্বিশেষে আগ্রহের, যেহেতু এই দেবী পরিবারসহ আসেন, আর সঙ্গে নিয়ে আসেন কাশফুল আর শিউলি। তাই তো সনাতন রামপ্রসাদ, খ্রিস্টান মাইকেল, ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ এবং মুসলমান কাজী নজরুল দুর্গাকে নিয়ে কলম না ধরে পারেননি!

Read More »