চিরকালের মত থেমে গেছে আওয়াজ, ধুলো পড়েছে সর্বাঙ্গে, আজ তার ওপর হাত রাখে না কেউ। বাঙালির জীবন থেকে অন্যান্য অনেক কিছুর মতই হারিয়ে গেছে রেডিও। তাই জাতীয় সম্প্রচার দিবসের মুহূর্তেও অবহেলায় পড়ে রইল মালদা জেলার কালিয়াচকের অন্তর্গত বাঙ্গিটোলা হাইস্কুলের গ্রন্থাগারে রাখা ১৯৩৯ সালের মারফি কোম্পানির রেডিও সেট।
রেডিও বিষয়ে উৎসাহী সংগ্রাহকদের মতে, এই রেডিও সেটটি মালদা জেলার একটি অন্যতম প্রাচীন রেডিও সেট। ইতিহাস বলে, ১৯২৭ সালের ২৩ জুলাই ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি নামে তৎকালীন বোম্বাই প্রেসিডেন্সির একটি প্রাইভেট সংস্থা ভারতবর্ষের মাটিতে প্রথম রেডিও সম্প্রচার শুরু করে। তখন ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনাধীন। রেডিওর আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা দেখে ১৯৩৬ সালের ৮ জুন অল ইন্ডিয়া রেডিও নামে সরকারিভাবে বেতার সম্প্রচারের কাজ আরম্ভ হয়। ১৯৩৮ পরবর্তী সময় থেকে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া আকাশবাণী নামেই সারা ভারতবর্ষব্যাপী পরিচিত হয় রেডিও সম্প্রচার। জনমানসে রেডিও সম্প্রচারের প্রভাবকে স্মরণীয় রাখতে ২৩ জুলাই জাতীয় সম্প্রচার দিবস হিসাবে পালিত হয়।
বাঙ্গিটোলা স্কুল লাইব্রেরিতে রক্ষিত এই প্রাচীন রেডিও সেটটি সেই প্রাচীন যুগের ইতিহাস বহন করছে। রেডিওর ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিক ছবি দেখে অনুমানে জানিয়েছেন, এই মডেলটি ১৯৩৯ সালে তৈরি এ-৪৬ ভালভ-টিউব রেডিও। সরাসরি ইলেকট্রিকের মাধ্যমে রেডিওটি চলত। অ্যান্টেনার মাধ্যমে বেতার তরঙ্গকে ধরা হত। রেডিও সেটটি কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল, না বিদ্যালয় থেকেই আলাদাভাবে কেনা হয়েছিল তা সম্পর্কে কোনও পরিষ্কার তথ্য পাওয়া যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাঙ্গিটোলা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৭ সালে। ফলে এই রেডিওটি অনায়াসে ৮০ বছরেরও বেশি পুরনো।
বাঙ্গিটোলা গ্রামের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা শিক্ষক মলয়কুমার ঝা বলেন, “বাঙ্গিটোলা একসময় একটি সমৃদ্ধ গ্রাম ছিল। একসময় বাড়িতে রেডিও থাকা সমৃদ্ধির লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হত। এখন সব কিছুই হারিয়ে গেছে। তবুও আমাদেরই গ্রামে এমন একটি প্রাচীন রেডিও সেট আছে জানতে পেরে ভাল লাগছে।”
মালদা শহরে রেডিও ও প্রাচীন গ্রামোফোন রেকর্ডের সংগ্রাহক পার্থ বসু বলেন, “১৯৭২ সালের মারফি এ-৪৮৪ মডেলটি আমার বাড়িতেই আছে। আমরা ছোটবেলা থেকে মারফি এবং ফিলিপসের রেডিও শুনেই বড় হয়েছি। দু-এক বছর আগেও মহালয়ার ভোরে আমি এই রেডিওতেই মহিষাসুরমর্দিনী শুনেছি। সময়ের পরিবর্তনে আজ রেডিও হারিয়ে গেলেও ভালভ-টিউব লাগানো মারফি রেডিওর অ্যান্টিক ভ্যালু আছে। অবশ্যই এই প্রাচীন রেডিওটিকে সংরক্ষণ করা দরকার।”
আরেক সংগ্রাহক শুভদীপ চক্রবর্তী বলেন, “মারফি কোম্পানির পুরনো রেডিও আমিও সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছিলাম। বিশেষত ভালভ-টিউব লাগানো রেডিও। কিন্তু রথবাড়ির দু-একটি দোকান এবং দু’নম্বর গভর্নমেন্ট কলোনির ধীরেন দাস মহাশয় ছাড়া এই রেডিওগুলি সারানোর কাজ কেউই করতে পারেন না। ফলে মূল্যবান জেনেও এগুলি ব্যবহার বা কেনার ভরসা পাই না।”
বাঙ্গিটোলা হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক সৌমিত্র সেনগুপ্ত বলেন, “এই স্কুলের ঐতিহ্যবাহী লাইব্রেরির মত এই প্রাচীন রেডিও সেটটিও স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। আমরা একে সযত্নে রক্ষা করব।”
২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অনুরাগ বসু পরিচালিত ‘বরফি’ সিনেমাতেও মারফি রেডিও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছিল। একটি বোবা শিশুর নাম ‘বরফি’ যা আসলে ‘মারফি’-র অপভ্রংশ! প্রিয় রেডিওর গান শুনিয়ে তাকে কথা শেখানোর চেষ্টা করছিলেন মা, ইলেকট্রিক শক খেয়ে মায়ের মৃত্যু ঘটে। মাতৃহীন শিশুটি কথাহীন বড় হয়ে ওঠে, তার বুকের ভিতরে ফল্গুস্রোতের মত সুর, ঠিক পুরনো অকেজো মারফি রেডিওর মত।
তবুও সময় এগোয়, স্মৃতি এগোয়… পড়ে থাকে খয়রাতের পাণ্ডুলিপি, লাখেরাজ, ব্রহ্মোত্তর। পূর্ণ সন্ধ্যা ঘনিয়ে ওঠার আগেই বাঙ্গিটোলা স্কুলের সামনের চণ্ডীমণ্ডপ পেরিয়ে স্মৃতিরা ঘুরেফিরে বেড়ায় এ গ্রামের পিচ খামচানো রাস্তায়। তিরাশি বছর ধরে কেটে গেল এই পাশাপাশি বসবাস। অথচ তিরাশি বছর ধরে যেন থাকাই হল না কোথাওই। কোথাও বাজল না পিয়ানো, কোথাও ঘনিয়ে ওঠেনি দ্বিজেন মুখার্জির কম্বুকণ্ঠে ভাঙাতরীর গান। রথবাড়ির সেই রেডিও দোকান উঠে গেছে কোনকালে। তবু যেসব রেডিও সারানো হল না, যেসব সেরে ওঠা রেডিও তাদের মালিকেরা বাড়ি নিয়ে গেল না তাদের মধ্যে থেকেও গুমগুম করে উঠল গান। তাদের সুর নেই, বাণী নেই শুধু হারিয়ে যাওয়াটুকু আছে। সেই কবে মুক্তকেশী পূজার মেলায় গেয়ে গিয়েছিলেন পূর্ণদাস বাউল, সেই সময়ের রেডিও আর্টিস্ট… সেই হারানো সুরও যেন ঢুকে পড়ল এই মারফি রেডিওর মধ্যে। তিরাশি বছর ধরে সে বাস করেছে পুরনো লাইব্রেরি ঘরের দমবন্ধ করা অন্ধকারে; তিরাশি বছর শুধু কেটে গেল ভাঙাতরীর…