‘কুত্তার হালে ঘুমাবি, আর রাজার হালে খাবি!’
ওস্তাদের কথাটা মনে পড়তেই হাতটা চলে গিয়েছিল পেটের ওপর, যদিও খিদেটা চিতিয়ে উঠেনি তখনও। ট্রাফিকের দণ্ডটা নড়ে উঠতে সেই হাতটাই পেট থেকে গিয়ারের ওপর গিয়ে পড়ল সপাটে। তবে এই মুহূর্তটিতে কেবিনে উপবিষ্ট কাউকে যতটা ক্ষিপ্র দেখা যায়, পারলে যেন রকেটের গতিতে ছোটে, তার ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না তার চোখে-মুখে— বরং ডান হাতের তর্জনীকে ভেঙে ঠোঁটের নীচের অংশটা ঘষে নিল কিছুক্ষণ, তারপর ঘাড়টা হালকা ঘুরিয়ে তাকাল পেছনে— শত শত গাড়ি দাঁড়িয়ে, নতমুখে, নিঃশব্দে! ‘মুনি ঋষির বাচ্চা বেবাক হালায়!’ বলেই অ্যাকসিলেটরে পা’টা চেপে ধরল যখন, ঠোঁটের কোণটাও নড়ে উঠল সাথে সাথে। জ্যাক ট্রাকের দানবীয় শরীরটা এরপর যতই পাখা ঝাপটাল, বিন্দুর মত ফুটে উঠা হাসিটা ততই ছড়িয়ে পড়তে লাগল, সেখানে এক অলৌকিক বাদশাহী শান।
সিটি কর্পোরেশনের আলোকোজ্জ্বল রাত। আর সে রাতেরই বিশাল বুকটা সে বিদীর্ণ করে চলে আপার-ডিপার ইন্ডিকেটরে, সামনের ও পেছনের চৌদ্দটা লাইটকে জ্বালিয়ে যেতে থাকে ক্ষণে ক্ষণে। তবে আজ ছুটোছুটিটা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে যেন। টানা দৌড়ের ওপর থাকলে গা’টা গরম থাকে, তখন আর কোনওদিকে হুঁশ থাকে না জ্যাকের, গপগপ করে গিলতে শুরু করে তেল, মুহূর্তেই সাবাড় করে ফেলে এত বড় ট্যাংকটা! কিছুদূর পর হালকা ব্রেক কষে জন্তুটাকে লাইনে নিয়ে এল সে।
সন্ধেয় পাম্প থেকে পেট ভর্তি করে আনার পর থেকেই সময়টা ভাল যাচ্ছে না জ্যাকের। দিলকুশার ট্রিপটা বিশ্রী রকমের পেরেশানিতে ফেলে দিয়েছিল আজ। ‘ডাব্বাডা কোনাইচ্চা কইরা উডাইবি, হের পর পাতাইল্লা কইরা হালাইবি! আংটা দিয়া আটকাইয়া মাপমত কইরা নিবি মালগুলান’, ওস্তাদের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনেছিল, কিন্তু রাস্তা না পেলে কী করতে পারে, এতটুকুন রাস্তা, তাও ভরতি ছিল চৌদ্দ রকম যানবাহন দিয়ে! এরপর তো কাজলায় গা খালি করতে গিয়ে শুরু হল আরেক কাহিনি। ট্রাকের দেয়াল কামড়ে পড়েছিল জঞ্জালগুলো! শেষমেশ অ্যাক্সিলেটরে খানিকটা ছুটিয়ে কড়া ব্রেক কষতে হয় তাকে। তাতেই প্রবল একটা ঝাঁকুনি খেতে শুরু করে ট্রাকটা, আর বালুকারাশির মত ঝুরঝুর করে পড়তে শুরু করে বদমাশগুলি!
মতিঝিলের পথটা ধরার পর থেকে অবশ্য নির্ঝঞ্ঝাট নিরুপদ্রব সময় পার করছে জ্যাক। হঠাৎ প্রায় স্থির তেলের কাঁটাটার দিকে চোখ পড়তেই আমোদের জেল্লা উঠে মারুফের চাবকানো মুখটাতে, এতটা পথ পেরিয়েও তেমন শক্তিক্ষয় করেনি জ্যাক! তেলের দাম বৃদ্ধির খবরে অবশ্য বণিক সমিতি নিরুত্তাপ একটা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল; বৃদ্ধির হার নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট ছিল না তারা, শুধু লসের অংকটাই যে কিঞ্চিৎ নামাতে পারত। কিন্তু মারুফের অত হিসেব-নিকেশে কাজ ছিল না; সে তো শুধু মাসটা শেষ হলেই বেঁচে যাওয়া স্লিপগুলো পাম্পের মালিকের হাতে দেবে, আর প্রতিটা স্লিপে গেল মাসের থেকে অনেকগুলো করে টাকা বেশি পাবে!
দেহটা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল পিঠের সিংহাসনটাতে, কিন্তু তেলের কাঁটার সাথে সঙ্গত করতেই কিনা, গাড়িটি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। সিগনাল বাতি নেই, তাও এই জ্যাম! ‘রাস্তায় নামলেই পাব্লিকের নাটকের আল্লাদ উডে… পাংখা গজান আরম্ভ করে…’, বিড়বিড় করতে থাকে মারুফ গায়ের ক্যাটক্যাটে হলদে গেঞ্জিটা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে। গেঞ্জিটা বুক পর্যন্ত উঠাতেই বেরিয়ে পড়ে রোমশ শরীরটা, একরত্তি মাংস বাড়তি নেই কোথাও, হাড্ডিগুলো গড়েপিটে উঠেছে সেখানে বাইশটি বছর ধরে, তেল-মশলার কারুকাজ ছাড়াই। কিন্তু এই শরীরটারই চাকায় চাকায় বেজে চলে রাজপ্রাসাদী তান, যখন একমনে আল্লা-খোদা করে যেতে থাকে তার পিছনে দণ্ডায়মান একদল নিরীহ ও নিপীড়িত যান! সঙ্গীতটা আরও সুমধুর হয়ে উঠে, যখন সে বড় রাস্তা ছেড়ে গলিতে ঢুকে পড়ে। তখন জায়গার অভাবে তার জ্যাকটাকে সাইড দিতে চেয়েও ব্যর্থ হয়ে মরাকান্না জুড়ে দেয় আগের থেকেও নিরীহ ও নিপীড়িত কিছু যান। মারুফ আপনমনে হেসে উঠে! এমন কোনও প্রাণী আছে যে রাস্তার বুকে চরে বেড়াবে আর তাকে সমীহ করবে না? তাকে নিয়ে রাস্তার সবার দুশ্চিন্তা, অথচ কারও মুখে রা পর্যন্ত নেই! পুলিশের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, এমনকি মন্ত্রী-মিনিস্টারের গাড়িকে গুনতে চায় না পাব্লিক আজকাল! কিন্তু তাকে কেউ কিছু বলে না, গালাগালির তুবড়িও ছুটে আসে না। কী করবে, মানুষ যে ময়লা সহ্য করতে পারে না; টিয়ার গ্যাস, গুলি হজম হলেও ময়লা হজম হতে চায় না তাদের! বাসার পায়খানাটার মতই ঘেন্না একে তাদের!
‘পাব্লিকের পেড ফুইলা ঢোল পিডানের টাইম হইয়া গেছে, তাও সার্জেন্ট হালার পো’র হুঁশ নাই’— দমবন্ধ রাস্তাটায় আটকে পড়া মানুষগুলির যেন জন্য মায়া লাগতে শুরু করে মারুফের। অথচ অসময়ের আর বেরসিক জ্যামগুলো সবচেয়ে ক্ষতি করে তারই, স্লিপের সমীকরণটিকে পুরো মিলিয়ে দেয় তার সুপারভাইজারের কাছে, একটুও ফাঁকফোকর রাখতে দেয় না। তেল থেকে টাকা বাঁচানো সহজ কাজ না, সিটি কর্পোরেশনের গাড়িটা নিয়ে ওঁৎ পেতে থাকতে হয় সারাটা রাত, যদি কোনও কোনা-কাঞ্চি মিলে, যদি তেল না খেয়েই পার করে দেয়া যায় এই তিলোত্তমা শহরটার রাত। যখন শার্দুলের মত জ্বলন্ত চোখে কাঁপিয়ে চলে রাতের রাস্তার পাঁজরগুলো, তখন কিন্তু তার মনেই থাকে না যে, সে একজন ভাড়াটে মাত্র, সিটি কর্পোরেশনের কাগজপত্রে তার নামের টিকিটিও নেই। যার অধীনে ড্রাইভারের ঠিকা কাজ করে মারুফ, সেই ‘মালিক’ নিজেও একজন ড্রাইভার, কিন্তু তার আছে এক সহি নিয়োগপত্র, স্বয়ং সিটি কর্পোরেশনের ইস্যুকৃত। ফিক্সড বেতন ছাড়াও তেলের উপরি আয়ের ভাগ সময়মত পৌঁছে দিতে হয় সেই মালিকের পকেটে। সিটি কর্পোরেশনের এই গুরুত্বপূর্ণ চাকুরিজীবীর জন্য নাকি সম্প্রতি একখানা ফ্লাটও বরাদ্দ হয়েছে! হঠাৎ মালিকের দশাসই শরীরখানা ভেসে উঠে মারুফের চোখের সামনে! নির্ঘাৎ নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে শালা তেলতেলে শরীরখানা বিছানায় পেতে দিয়ে!
খিদেটা একটু একটু করে বাড়ছিল। জ্যামটা ছোটানোর পর মতিঝিল পৌঁছুতে অবশ্য একমিনিটের বেশি লাগেনি। সুবেশী এ পাড়াটা, যেখানে বাস করে শহরের সব থেকে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান নাগরিকেরা, সবসময়ই যেন একটি মৌ মৌ ঘ্রাণ ছিটিয়ে আমন্ত্রণ জানাতে থাকে মারুফকে। সময় নষ্ট না করে একটি গিয়ার ফেলে ব্রেকটা চেপে ধরে সে আর তারপরেই সুইচ টিপে ফর্ক লিফটের চার যোগানে লক করে ফেলে মাঝারি আকারের ডাব্বাটা। ফলমূল ও সবজির গলিত দেহ, মাছ-মুরগির ছিন্নভিন্ন লাশ, আর বোতল ও ক্যানের মহামারিতে জ্যাকের পেয়ালা আজ যেন উপচে পড়ছে। এলাকাটাতে কমিউনিটি সেন্টারের ছড়াছড়ি, আর তারা জ্যাকের ভাণ্ডার ভরে দিতে আগেও কার্পণ্য করেনি। কিন্তু একটা মৃদু টেনশন ধীরে ধীরে দলা পাকাতে থাকে মারুফের কপালটাতে, স্ফীত রগগুলো যার সাক্ষী হয়ে দ্রুতলয়ে নাচতে থাকে! আজ আবার কোনও গণ্ডগোল হবে না তো কাজলায়?
খালি গাড়িটা সে দুই নাম্বার গিয়ারে ফেলে চালিয়ে এসেছিল, কিন্তু এখন লোড গাড়ি পেয়ে সে ক্লাচে পাড়া দিয়ে একনম্বর গিয়ারে চলতে শুরু করে। কাজলায় নেমে মালগুলি যখন ওজনমেশিনে রেকর্ড করতে থাকে, মারুফের উদ্বিগ্ন চোখজোড়া স্কোরটা পড়ে নিতে উদগ্রীব হয়ে পড়ে। ওজনপর্ব শেষ হয়ে গেলে কিছুটা সময় সে ল্যান্ডফিলের ধার ঘেঁষে হালকা চালে চড়াতে থাকে জ্যাককে আর চতুর্দিকে কড়া নজর রাখতে থাকে। এরপর একটা সময় সে আস্তে করে কেটে পড়ে জায়গাটা থেকে, সবার অলক্ষ্যে, আবর্জনাগুলো আনলোড না করেই। সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক হচ্ছিল, তবু কাজলার সীমানাটা যত পেরিয়ে যেতে থাকে, টেনশনটা বাড়তে থাকে। ল্যান্ডফিলের দৃষ্টিসীমার পুরো বাইরে এসে একটা নির্জন জায়গায় গাড়িটা থামায় মারুফ; এরপর জ্যাকের ইস্পাত-শরীরটার প্রান্তদেশ একঝটকায় তুলে ফেলতেই হুড়মুড় করে গড়িয়ে পড়ে বেশ কিছু বর্জ্য। আশেপাশের রাস্তাগুলোয় আরও কিছুটা সময়ের জন্য এলোপাথাড়ি ছুটিয়ে ফের যখন ওজনঘরে ঢোকায় সে জ্যাককে, ততক্ষণে ফুটোফাটা দিয়ে মেদ চুইয়ে নতুন করে সেজে উঠেছে জ্যাক ট্রাক, আগেরটি বলে চেনার একটুও সুযোগ নেই! ওজনযন্ত্রও ভিন্ন একটা স্কোর প্রদান করে সঙ্গত করে যায় মারুফের পরিকল্পনার সাথে।
মতিঝিলের দ্বিতীয় ডাব্বাটার পথে খালি জ্যাককে নিয়ে চলতে চলতে বন্ধুদের সাথে হিসাবটা মিলিয়ে নিতে থাকে মারুফ। তার ওয়ার্ডে মোট ডাব্বা চব্বিশটা, তারা ছয়জনে মিলে ভাগ করে নেয় ডাব্বাগুলির পরিপূর্ণ হিস্যা। ডাস্টবিনগুলি মাঝেমধ্যেই একদম বর্জ্যহীন অবস্থায় পড়ে থাকে। তবে হিসাবের খাতায় শূন্য থাকে না তারা। কোন দিনে কোন ডাব্বাটা খালি আছে, নিজেদের মধ্যে খবর করে নেয় মারুফরা, আর খালি ডাব্বার জন্যও ওজন করা হয় তেলের স্লিপের আশায়। একজন ড্রাইভার তার গাড়িটা ওজন করানোর পর বাইরে নিয়ে গিয়ে একটু-আধটু ময়লা ফেলে দিয়ে, ফের ওজন করাতে এলে সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট অফিসারের তা ধরার উপায় থাকে না; দিনের জন্য বরাদ্দ চব্বিশটা ডাব্বার হিসেব বুঝে পেলেই সে খুশি।
হঠাৎ একটি গাড়ি সাঁই সাঁই করে পাশ কাটাতে চাইল জ্যাককে, সাইড দেবে কিনা দোনামনা করছিল মারুফ! ‘বাহাদুরটা কে? দেখতে হইতেছে…’, স্বগতোক্তি করে ঘাড়টা খানিক কাত করল সে— একটা সস্তা প্লাস্টিক, আর তার মধ্যে রুমাল চাপা দিয়ে বসা একটি ছেলে, তার বয়সী হবে, মাথায় একটা সোনালি পাগড়ি, একজন নারী ও একজন পুরুষ তার দুপাশে এমন একটা ভঙ্গিতে বসে আছে যেন মাঝের লোকটি শিশু, আর তাদের দায়িত্ব হচ্ছে তাকে আগলে রাখা, যেকোনও বিপদ থেকে রক্ষা করা! অন্যদিকে, সামনে ড্রাইভারের সিটের পাশে একজন মুরব্বিকে দেখা যাচ্ছে যে প্রবল নিরাসক্ত একটা ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে, পেছনে কোনও বোমা ফাটলেও সে তাকাবে না মনে হচ্ছে। তার মানে হল, ছেলেটির রুমাল চাপার কারণ মারুফের গাড়ি না; বরং ব্যাটা একটা নকশাকাটা নওশা, বউ আনতে যাচ্ছে, আর সেজন্যই এত তর্জনগর্জন! ঠোঁটের কোণে গজিয়ে উঠা মিচকে হাসির রেখাটা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই নওশাকে সাইড দিয়ে দেয় সে! গাড়িটি যে ভাড়া করা তা চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কোনও ফুলসাজও নেই! এককালে তারও এমন নওশা সাজার খুব ইচ্ছে হত, সেও এমন এক গাড়ি ভাড়া করে বিয়েতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখত, এমন একটি ময়লার গাড়িকে তখন তাদের গাড়িটিও সাইড না দিয়ে উল্কাবেগে ছুটত! অবশ্য তাকে সিটি কর্পোরেশানের বৈধ লাইসেন্সধারী ড্রাইভার হতে হত সেই ইচ্ছেপূরণে, তার মালিকের মত!
হঠাৎ একটা আর্তনাদ মারুফকে বিয়ের আসর থেকে বের করে দিল। পড়িমরি করে ছুটে এসে দেখতে পেল, বড়সড় এক গর্তে পড়ে সামনের চাকাটি কিছুক্ষণ পরপর কঁকিয়ে উঠছে আর কাঁপিয়ে দিচ্ছে জ্যাকের সব হাড়গোড়! এমনিতেই মারগুঁতো খাওয়া শরীর জ্যাকের, তার ওপর একটানা ঘর্ষণে ক্ষয়ে গেছে তার ইঞ্জিন। অনেকদিন ধরেই লুব্রিকেন্টের যোগান নেই, তাই অল্প খেলেই গরম হয়ে উঠে জন্তুটা ইদানীং! মারুফ গর্তটার দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ, অন্ধকারে ঘাপটি মেরে ছিল সে পিচের সাথে, একটুও বুঝতে দেয়নি! ভাগ্যিস হালকা চালে এসেছিল, না হলে সে তার জ্যাকের সাথেই দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে থাকত গর্তটার গর্ভপাত ঘটিয়ে! পতন ঘটত তার রাজত্বের!
খিদেটা চড়ে উঠছিল; পথিমধ্যে হালকা কিছু খেয়ে নেয়ার পরিকল্পনা থাকলেও পরে তা বাতিল করে দিয়েছিল মারুফ। সব কাজ শেষ করে পাড়ার হোটেলটাতে সে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়বে আজ। মতিঝিলের দ্বিতীয় ডাব্বাটার গায়ে সেঁটে রয়েছে এখন জ্যাক। এই এলাকাটার চারপাশে হাসপাতালের ছড়াছড়ি, আর তাই এই ভাগাড়ে মেলে অনেক মূল্যবান বস্তু। উচ্ছিষ্ট সিরিঞ্জ, কনটেইনার, কেনোলা, সিলিন্ডার, ঔষুধের বাক্স ইত্যাদির জন্য মার্কেট আছে রীতিমত! সন্ধে থেকে এই ডাব্বাটার আশাতেই মনটা সব থেকে উচাটন থাকে মারুফের! কিন্তু অন্যান্য দিনের মত আজও বড় কোনও গুপ্তধন ছাড়াই ফিরতে হয় তাকে। মাঝপথে জ্যাকের শরীরটা ঝাঁকিয়ে-ঝুঁকিয়ে কিছুটা খালি করে নেয় সে, যাতে কিছুটা কম তেল খুইয়ে দৌঁড়তে পারে সে! যতটুকু তেল বাঁচাতে পারে, ততটুকুই তার আয়, এর বাইরে এক কানাকড়িও তার নয়। আয়টা পুরোই ফাঁকির ওপর, কিন্তু এটা ছাড়া তার কোনও অস্তিত্বও তো নেই! ‘পুরুষ হইয়া জন্মাইছি, আমরা হইলাম টাকার মেশিন। যতক্ষণ টাকা আছে, ততক্ষণ সবেতে ভাল।’ আবার ওস্তাদের কথা মনে পড়ে যায় মারুফের আর দমকা এক হাসিতে মুখের ডাব্বাটা আন্দোলিত হতে শুরু করে!
দিন শেষে চার-পাঁচটে তেলের স্লিপ করে তার অর্ধেক বাঁচাতে পারে সে। আয়ের পুরোটাই তুলে দেয় সে খালার হাতে, যে তাকে নিয়ে এসেছিল নিজের কাছে যখন সবে বারোয় পা দিয়েছে। একদিন যখন পেটে ‘বিষ বেদনা’ নিয়ে তার মা ভর্তি হল হাসপাতালে, এবং রাত না ফুরোতেই চোখ বুজে ফেলল, তার বাবা ডাক্তারের কলার ধরে নাকি টানাটানি করেছিল কিছুক্ষণ। এরপর তার বাবার মাথা ঠান্ডা করতে যারা বলে-কয়ে নতুন মেয়েমানুষ নিয়ে এল ঘরে, সেই দলে তার খালাও ছিল। একদিন সেই খালাই তাদের বাড়িতে এসে এমন এক কাইজায় লিপ্ত হল সেই নতুন মেয়েমানুষটির সাথে যে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা ছাড়িয়ে রাত পার হয়ে গেল, তবু তার শিখা নিভল না। এরপর সূর্যের আলো ভাল করে না ফুটতেই খালার হাত ধরে মারুফ যখন উঠে এল তার স্যাঁতসেঁতে উঠোনটিতে, আর চোখের সামনে কঙ্কালসার একপাল ছানাপোনাকে ছুটে বেড়াতে দেখল, তখন খালাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে হয়নি, তার নিজেরই মনে হয়েছে, তাকে কাজে নেমে পড়তে হবে যত শীঘ্র সম্ভব। তারপর যতই দিন গড়িয়েছে, খালার সংসার খরচটা আরও বড় হয়েছে আর ফর্কলিফটের ব্লেডটার মতই বেঁকে গেছে মারুফের শরীরটা। খালা চেয়ে চেয়ে দেখেছেন আর মাঝেমধ্যে হাতটা ধরে কেঁদেছেন, ‘এতটুকুন আবাতিডা আমার! হাড়-মাংস সব কয়লা কইরা ফালাইতেছে ভাইবোনগুলার জন্য!’
মতিঝিলের দ্বিতীয় ডাব্বার ওয়েটলিফটিংয়ের টোকেন সংগ্রহের পর মারুফ এখন ধানমন্ডির পথে রয়েছে, শহরের অভিজাত এলাকা। এখান থেকেই মেলে সবচেয়ে বেশি আবর্জনা, আর সেগুলোকে ধারণ করতে যেয়ে ফুরিয়ে যায় জ্যাকের অবশিষ্ট সব তেল। মারুফের রুটগুলির মধ্যে এটিই সব থেকে লম্বা; সীমানা বহির্ভূত এই ডাব্বাটিতে কর্মী-সংকটের কারণে অস্থায়ী দায়িত্ব পেয়েছে সে। আজ জ্যাককে ডাব্বাটার বিশাল গহ্বরের কাছে ভিড়িয়ে খুশি হয়ে পড়ল মারুফ, প্রতিদিনের মত উপচে যায়নি বজ্জাত আবর্জনাগুলি, তার তিন টনি জ্যাকটা তুলনামূলক কম তেলেই চলতে পারবে বাকি পথটা, যদিও বিল করবে সে পুরো ট্যাংকেরই। ফর্ক লিফট দিয়ে যখন পেঁচিয়ে ধরছিল মালগুলি, ভূরি ভূরি কনডোম, মদের বোতলের চোখে পড়ল। এই ডাব্বাটার নিয়মিত অতিথি এরা, দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে গেছে!
ধানমন্ডির ধনদৌলত পিঠে চাপিয়ে যখন রাস্তার মোড়টা ঘুরতে গেল মারুফ, স্মার্টফোন হাতে এক ১৫ ফুট লম্বা রূপসী চোখের সামনে এসে দাঁড়াল। রাতের নির্জনতা জ্যাকের হেডলাইট পুরো হরণ করে নিয়েছে ততক্ষণে, কেঁপে কেঁপে উঠছে তার লোহার শরীর। স্মার্টফোনটি রূপসীর দুই স্তনের মাঝে চাপা পড়ে হাঁসফাঁস করছিল, তার ঢেকে যাওয়া শরীরটা থেকে শুধু ব্র্যান্ডের নামটি কোনওমতে পড়তে পারা যাচ্ছিল! ময়লার ডাব্বাটা থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না সাইনবোর্ডটা। আর সে মারুফের সাইড আটকে বেয়াড়ার মত দাঁড়িয়ে ছিল, শরীর জুড়ে তার হাজার ওয়াটের হাজারো বাতি! নড়ার শক্তি হারিয়ে জ্যামের ওই গাড়িগুলির মতই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল মারুফকে অনেকটা মুহূর্ত, নতমুখে, নিঃশব্দে!
খিদেয় পেটটা চোঁ চোঁ করছিল, আর সাথে মাথাটাও সঙ্গত করছিল ভয়ানক চক্কর দিয়ে। এই অবস্থাতেই জ্যাককে ঘা মেরে মেরে এগিয়ে নিচ্ছিল মারুফ, কাজলায় রাতের শেষ ওজনপরীক্ষাটি করাতে। হঠাৎ সিগনালবাতির লাল পেয়ালা পর্দা নামিয়ে দিল। সামান্য কিছু পথচারী, জনা দশেকের বেশি হবে না, তারাও আটকে পড়ল একই সাথে। যদিও খুব পরিচিত দৃশ্য, কিন্তু ঘটনাটির আকস্মিকতা আর মানুষগুলোর ব্যগ্রতা দেখে হেসে ফেলল সে। সবাই মুখ ঢেকে ফেলেছে ইতিমধ্যে, কেউ মাস্কে, কেউ রুমাল বা টিস্যুতে; আরে কেউ কেউ খালি হাতের আঙুলেই চাপা দিতে শুরু করেছে মুখ ও নাকের রন্ধ্রগুলো। কখনও এমনও হয়েছে, হয়তো খালি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, তাও আশেপাশের সব মুখ হুড়মুড় করে মাস্কের তলায় বন্দি হয়েছে। একবার তো ফাঁকা রাস্তায় দুটো মানুষ একে অপরকে ঠ্যাঙাচ্ছিল, কিন্তু তার গন্ধ পেতেই থেমে গেল। আর-একবার দিনের আলোতে এক পুলিশকে ঠোঙা ধরিয়ে দিচ্ছিল কেউ, তো সেই পুলিশও যেন তার গাড়িটাকে দেখে থমকে গেল! পাওয়ার! পাওয়ার! সিটি কর্পোরেশানের গাড়ির পাওয়ার!
এই পাওয়ারই তাকে লোভী করে তুলেছিল, আর নিয়ে গিয়েছিল সবুর ভাইয়ের ডেরায়। বছর দুয়েক আগের ঘটনা, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছিল, আর ভাই তাদের পাড়া থেকে কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছিল। উঠতি পুলাপানের একটা বড়সড় দল যোগাড় করে সে গিয়েছিল ভাইয়ের কাছে; কথা দিয়েছিল, ভাইকে জিতিয়েই তবে ঘরে ফিরবে। কোনও কিছু মুখ ফুটে চায়নি সে, কিন্তু চাকরিটা পার্মানেন্ট করা দরকার ছিল, অন্যের বদলা আর কত! স্থায়ী ড্রাইভারের চাকরিটা হয়ে গেলেই সে ঘরে বউ আনবে; নওশা সেজে যখন সে রাস্তা দিয়ে যাবে, ব্যান্ড পার্টির ঝংকার শুনে দুই ধারের দালানগুলো থেকে বউ-ঝিরা উঁকি মারতে শুরু করবে!
সবুর ভাইকে আগে যখন স্থায়ী চাকরির কথাটা পাড়ত, প্রতিবারই পালটা প্রশ্ন আসত ভাইয়ের কাছ থেকে, ‘ক্ষমতায় না থাকলে, পদে না থাকলে, প্রশাসন কেন কথা শুনতে যাবে?’ তো এবার ভাইকে পদে বসাতে রাতের ঘুম হারাম করে দিল মারুফ। কিন্তু রাতভর নতুন টাকার কড়কড়ে গন্ধ শোঁকানোর পরেও পরদিন দুপুরে যখন খবর আসে, আবহাওয়া সুবিধার না, তখন মারুফরা মৃদু হৈচৈ করে আসে সেন্টারে; বেশি না, মাত্র গোটা দশেক বোমাকে কাজে লাগানো হয়। তারপর দৃশ্যগুলো ঘটতে থাকে পরিকল্পনামাফিক, মহিলারা দৌড়তে শুরু করে পার্স, ভ্যানিটি ব্যাগ সব ফেলে, নিরাপত্তারক্ষীরাও ছুটতে থাকে তাদের সাথে সাথে, অন্যদিকে, ক্যামেরাম্যানরাও তাদের শিকারের পিছু ধাওয়া করতে থাকে রুদ্ধশ্বাসে, আর এসব কিছুর ফাঁকে ব্যালট বাক্সগুলো ভরে দিতে থাকে মারুফরা কোনও বাধা-বিপত্তি ছাড়াই।
বিজয়ের বাসররাত পার করার পর মেলাইয়াও অতিক্রান্ত হতে শুরু করেছিল। অথচ সবুর ভাই সিটি কর্পোরেশনের কাজ নিয়ে এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে একদমই দেখা মিলছিল না। এরপর একদিন অনেকটা মরিয়া হয়েই মারুফ তার কয়েকটি বন্ধুকে নিয়ে ভোর থেকে দাঁড়িয়ে রইল নেতার বাড়ির সদর দরজায়। অবশেষে দুপুরের দিকে নেতার হৃদয় বিগলিত হয়, আর বাসায় ঢোকার সাথে সাথে চা-বিস্কুটও আসে তাদের জন্য। খেতে খেতে একসময় তারা দেখতে পায় নেতা আবির্ভূত হয়েছেন। কিছুক্ষণ কোনও কথা হয় না, নিঃশব্দে মুখ চাওয়া-চাওয়ি চলতে থাকে। একসময় অবশ্য নেতা নিজে থেকেই নীরবতা ভাঙেন, ‘এত অস্থির হইছস্ ক্যান? পার্মানেন্ট চাকরির লাইগা বায়োডাটা লাগে, অভিজ্ঞতা লাগে… তারপর না ধরাধরি!’ মারুফ চায়ের চুমুকটা শেষ করতে পারে না, খুব বেশি লিকার ছিল চা’টাতে, একটা বিস্বাদ গলায় আটকে তড়পাতে থাকে যেন!
মারুফের মতই ঘরটিতে উপস্থিত কেউই বিশ্বাস করেনি নেতার কথা, কারণ কে না জানে যে, সিটি কর্পোরেশনে একটা স্থায়ী চাকরির জন্য বায়োডাটার চেয়ে একটা তিন-চার লাখ টাকার খাম বেশি জরুরি। কিছুটা সময় অতিবাহিত হলে সবুর ভাই মারুফের কিছুটা ঘনিষ্ঠ হন আর তার মাথায় মৃদু হাত বোলাতে শুরু করেন, ‘চিন্তা করিস না, ডাব্বা দুইডা বাড়ায় দিমু নে, মাথা ঠান্ডা কইরা বাড়ি যা এহন!’ মারুফ এরপর পুরো নিস্তব্ধ হয়ে যায় যেন, একটা অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে নেতার দিকে; সেই দৃষ্টিতে বিস্ময়, হতাশা, ক্রোধ না অন্যকিছু ছিল, তার নির্ধারণ করা সবুর ভাইয়ের পক্ষেও সম্ভব হয় না। একটা সময় অবশ্য একটা হাড়হিম করা চিৎকার বেরিয়ে পড়ে তার মধ্য থেকে যার আওয়াজ নেতার বাড়িঘরের কঠিন পাঁচিল পেরিয়ে রাস্তার কোনও এক পথিকের কানেও আঘাত হানতে থাকে, ‘টালটিবালটি ছাড়েন, গদিতে বওনের লগে লগেই ডাব্বা দেহাইতে শুরু করছেন মানুষরে? লইয়েন, কত ডাব্বা দেখবার চান, দেহামুনে!’ এরপর দরজার সামনে গড়ে উঠা স্যান্ডলের বিশাল পাহাড়টা ছাড়িয়ে যখন বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে পড়ে মারুফরা, সেই থমকে যাওয়া পথিককে আর দেখতে পায় না তারা, বরং অন্দরের কিছু কথা পিছু নিতে থাকে তাদের, যার মধ্যে এটিও ছিল, ‘পায়ের জিনিস পায়েই রাখতে হয়, কমিশনার সাহেব! মাথায় উডাইছেন তো…!’
খিদেটা দানবের আকার ধারণ করেছিল। কাজলার পেটে রাতের শেষ মালগুলি নিক্ষেপ করে যখন বেরিয়ে আসছিল মারুফ, আগুনের লেলিহান শিখায় পুরো এলাকাটা দিন হয়ে গেছে। আবর্জনার আগ্নেয়গিরিকে পেছনে ফেলে সে তীব্র গতিতে ছুটতে থাকে এরিয়া ম্যানেজারের ডেরার দিকে, সেখানে জ্যাককে জমা করে কাপ্তান বাজারের হোটেলটিতে বসার জন্য সবগুলো স্নায়ু একযোগে চাপ দিচ্ছে। কাজ শেষে ঘুমোবার তাড়ায় জ্যাকও দৌড়চ্ছে সিটি কর্পোরেশনের রাস্তাগুলোর বুকে শক্ত কামড় বসিয়ে, আর সদ্যই বিশুদ্ধ করা রাস্তাগুলো ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছে। শহরের সব ময়লা চাপা পড়ছে এখন কাজলার বিশাল মাঠে, তার কিছু দাহ করা হচ্ছে, কিছুকে দেয়া হচ্ছে কবর। ঠিক যেমন করে অন্ধকারটাকে চাপা দিতে প্রবল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত এখন রাস্তার ধারের আলোকজ্জ্বল বাড়িঘরগুলো। সেই যুদ্ধে যেন ইন্ধন যোগাতে ছুটে আসছে কোথা থেকে ফুরফুরে হাওয়ার বেশ লম্বাচওড়া একটা বাহিনী।
জ্যাককে ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে মারুফ, মাত্রই মিনিট বিশেকের পথ। কিন্তু পায়ের পাতা ভারি হয়ে আসছে তার, মাতালের মত জড়িয়ে যাচ্ছে সে রাস্তার সাথে! হঠাৎ একটা পেট-বোতল পায়ের কাছে এসে পড়ে তার, কেউ সফট ড্রিংকসে চুমুক শেষে ছুড়ে দিয়েছে নিশ্চিত। নিক্ষেপকারীকে খুঁজে না পেলেও কয়েক গজ সামনেই একটি মাঝারি আকারের ওয়েস্ট বিন দেখতে পেল। বোতলটা কালই সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা-কর্মীদের হাতে করে ওখানে পৌঁছে যাবে। কিন্তু বোতলটা এতটা সময় পড়ে থাকবে, আর একে একে পথচারীদের পায়ে পিষ্ট হয়ে চ্যাপ্টা হতে থাকবে, তার মানে হয় না! বাঁ-পায়ের এক জোরালো শটে মারুফ বোতলটাকে তার বন্দরে পৌঁছে দেয়। এটি পরে অন্য সঙ্গীসাথিদের সাথে মিশে গিয়ে কাজলার বর্জ্যসাগরে ভাসতে থাকবে, একসময় পুনঃপ্রজনন প্রক্রিয়ায় নতুন জন্ম নিয়ে শোভা পাবে কারখানার সুদৃশ্য সব কার্টুনে, তারপর আবার অনেক হাত ঘুরে আবার কোনও রাস্তার কোণে পড়ে থাকবে এমনি করে কাজলার পথ চেয়ে চেয়ে! বোতলেরও রয়েছে জীবনচক্র, মানুষেরই মত, আপনমনে হেসে উঠে মারুফ!
ওই তো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে হোটেলটাকে, রাস্তার মাথা আলোকিত করে আছে, এরও সামনে অনেকগুলো লাইট, জ্যাকের মতই। কিন্তু কোনটা হেডলাইট, কোনটা ইন্ডিকেটর, আর কোনটা আপার-ডিপার বোঝার উপায় নেই! আর দু’তিন মিনিট হাঁটতে হবে বড়জোর! আজ এখানে সে মুখ, পেট সব ডুবিয়ে দেবে, পুরোই রাজার হালে! হঠাৎ তার চোখ মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ডাস্টবিনের মতই দেখতে একটি বস্তুর সাথে! আগাগোড়া ন্যাংটা একটা লোক উল্টো দিক থেকে হেঁটে আসছিল, মারুফকে দেখে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত থেমে গেল, আর ওভাবেই রইল তাকে অতিক্রম করে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। কিছুদূর যেতেই একটি কুকুরও মারুফকে দেখে ঘেউ ঘেউ করতে করতে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেও একচুলও নড়ল না জায়গাটা থেকে। আরে, ভারি মজা তো! তার গাড়িটার মতই তাকে সবাই সাইড দিয়ে দিচ্ছে যে আজ!
খাবার হোটেলটার একদম কাছে এসে পড়েছে সে, আর মাত্র কয়েক কদম। হঠাৎ মারুফের নাকটা ঝাপ্টা দিয়ে উঠল! কোথা থেকে একটা বিশ্রী গন্ধ বেরুচ্ছে ভুসভুস করে! কেমন একটা পচাগলা লাশের গন্ধ! হোটেলটা থেকে সরে পড়ে সে, কিন্তু তবু যায় না গন্ধটা। বরং যতই এগোতে থাকে, আরও বাড়তে থাকে! একটা সময় মনে হল, তার দেহ থেকেই আসছে গন্ধটা, শহরটার সমস্ত ময়লা যেন গায়ে মেখে নিয়েছে সে আজ! সহ্য করতে না পেরে গায়ের গেঞ্জিটাকে রুমাল বানিয়ে মুখ চাপা দেয় সে। একটা বেরসিক বাতাস পিছু নিয়েছিল রুমালটার; যতই সে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিল, মারুফ আরও শক্ত করে চেপে ধরছিল রুমালটাকে! একটা লাজুকরাঙা ভঙ্গি খেলে যেতে থাকে তার চোখে-মুখে, সেই ভাড়া করা গাড়িটার নওশাটার মত! রঙিন ফোয়ারারা নাচতে থাকে সেখানে অলৌকিক সব বুদবুদ তৈরি করে, যখন সে মাথাটা নীচু করে পাড়ি দিতে থাকে সিটি কর্পোরেশনের নগ্ন রাস্তাটা!
নষ্ট বিবেকের পচাগলা গন্ধ!
ধন্যবাদ ভাই
ভালো লাগল। ইন্টারেস্টিং প্লট। গল্পের বুনোট চমৎকার। তবে মাঝে মাঝে কিছুটা সংলাপ থাকলে আরও মনোগ্রাহী হত।
অনেক ধন্যবাদ, দেবাশীষদা!
আপনার লেখার বিষয়বৈচিত্র
মুগ্ধ করে। বরাবরের মতোই গল্পের প্লট ও বিন্যাস ভালো লাগল। আনন্দপাঠ।
অনেক ধন্যবাদ, রুবানা আপা
অত্যন্ত বলিষ্ঠ কলম।
অনেক অনেক ধন্যবাদ, রুমিদি!