সেদিন সকাল থেকেই তেড়ে বৃষ্টি পড়ছে। তখন ক্লাস নাইন কী টেন, সবে সেকেন্ড কী থার্ড পিরিয়ড চলছে। বেজায় বদমেজাজি স্যার ততোধিক নীরসভাবে ভৌতবিজ্ঞানের কীসব হাবিজাবি বস্তুর জাড্যধর্মর চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছেন বোর্ডে। কে কী বুঝছে তার ঠিক নেই, শুধু ক্লাসের ফার্স্ট-বয় নারদের মত মাথা দোলাচ্ছে, আর বিড়বিড় করে বলছে— ‘ঠিক, ঠিক…’। বাকিদের নিরন্তর উসখুস। কখন ক্লাসটা শেষ হয় তার অপেক্ষায় হাপিত্যেশ করে বসে থাকা। সব মিলিয়ে এমন একটা দিন, যেদিন আমরা সব্বাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতাম— ইসস, যদি একদিনের জন্য শিক্ষামন্ত্রী হতাম, আগে শালা এই পরীক্ষার হ্যাপাটাকে বিদেয় করতুম! কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! স্যার সেই ঘ্যানঘ্যান করেই যাচ্ছেন। অগত্যা তার থেকে মুক্তি পেতে ভাবলুম টিফিন খাওয়া যাক। বর্ষার দিনে স্কুল আসার বোনাসস্বরূপ বেশ খাসা চাউমিন পাওয়া গেছে টিফিনে। সবে সেই চাউমিনের খানিকটা মুখে চালান করেছি, বোধহয় টিফিন বক্স খোলার টুকটাক আওয়াজ বা বন্ধুদের ‘একা একা খাচ্ছিস! আমাকে একটু দে!’-এর ফিসফাসে স্যারের পড়ানোয় ব্যাঘাত। সঙ্গে সঙ্গেই খ্যাঁকখ্যাঁকে গলায় চিৎকার— ‘লাস্টের আগের বেঞ্চ! এত কথা কীসের? বাঁ-দিক থেকে তিন নম্বর, উঠে দাঁড়া!’ আর কী করা, মুখে চাউমিন নিয়েই উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই স্যারের আবার তোপ— ‘পড়া না শুনে আমার ক্লাসে গল্প হচ্ছে?’ জবাবে কী বলি ভেবে পাই না। বাংলা মিডিয়ামের ছাত্র, rhetorical question-এর মর্মার্থও অত বুঝতাম না। ক্যাবলার মত মাথা চুলকাতে দেখে স্যারের পরের বোমা— ‘কীরকম পড়া শুনছিলি দেখি! বল তো, আমি যদি একটা তিন-পায়া চেয়ারে বসি তাহলে উল্টে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, কিন্তু একটা চার-পায়া চেয়ারে বসলে উল্টে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম কেন?’
খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েই দুম করেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল— ‘স্যার আপনার পায়া ভারি, তাই!…’ সারা ক্লাস হো হো করে হেসে উঠল। যাক, অবশেষে একটা অন্তত কমিক রিলিফ পাওয়া গেল! ফলস্বরূপ, বাকি ক্লাসটা আমি ক্লাসরুমের বাইরে…
তিন-পেয়ে আর চার-পেয়েদের মধ্যে এই গেরো দেখতাম সর্বত্রই! তখন সদ্য সদ্য মফস্বলে অটোরিকশা রাস্তায় নেমেছে। মানে তখনও অটোওয়ালারা ‘খুচরো পয়সা থাকলে তবেই অটোতে উঠুন’ বা ‘অত মোটা হলে চলবে কাকু, চেপে বসুন, ওখানে আরামসে ৪ জন বসতে পারে! নাহলে দুজনের ভাড়া দিতে হবে’-এর মত আপনার জীবনের নিদান শোনানোর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে ওঠেনি। উফফ, তাদের তখন কী ছটফটানি রাস্তায়! একটু ফাঁক পেয়েছে কী পায়নি, অমনি বোঁ করে সেখানে অটোটার আধখানা ঢুকিয়ে দিল। ব্যস, এবার ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা। পাঁচ মিনিটের জ্যাম বেড়ে পনেরো মিনিট। স্কুল-অফিসের টাইমে চূড়ান্ত বিভ্রান্তি। বাস ড্রাইভারদের থেকে অটোওয়ালাদের দিকে ধেয়ে আসা বাছাই করা দু’অক্ষর চার-অক্ষরের খিস্তি, ‘শালা! আমাদের ভাত মেরে দিল এই পোলট্রির ডিমগুলো!’-মার্কা হা-হুতাশ। মাঝখান থেকে স্কুলমুখী ডেঁপো ছেলেদের পোয়া বারো! খিস্তির অভিধান হুহু করে বাড়ল…
আবার তিন-পেয়েদের নিজেদের মধ্যে চরম খেয়োখেয়ি। মানুষে টানা রিকশারা অটো দেখলেই রাগে গরগর করে, আবার অটোওয়ালারা রিকশাওয়ালাদের দেখলেই খানিকটা ভেঙিয়ে চলে যেত। সে কি বিশ্রী হাল, বিদদমান দুই গোষ্ঠী যেন ইস্টবেঙ্গল আর ব্যাঙ্গালোর এফ সি! একদলের আছে ‘উহু বাবা, আমরাই একটা সময় ঝড়-জল-বৃষ্টিতে জলকাদা ঠেঙিয়ে মানুষ বয়ে বয়ে এনেছি! নেতা-মুরুব্বি থেকে পুরোহিত, সবার ভরসা ছিলাম আমরাই’-মার্কা ঠুনকো বুলির ঢক্কানিনাদ। অন্যদিকে অটোরিকশা হল ব্যাঙ্গালোর এফ সি, যাকে বলে তরুণ তুর্কি! কোনও ঐতিহ্যর ভারি বস্তা বওয়ার বালাই নেই, শুধু যাত্রী নিয়ে সাঁই-সাঁই বেগে ছুটে চলেছে…
পাড়ায় একটা তিন-পেয়ে কুকুর ছিল, কোনও এক সময়ে একটা গাড়ির তলায় একটা পা খুইয়েছিল। তখনও কুকুর-বেড়ালদের কান টেনে, দাঁত খিঁচিয়ে থাকা ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেদার শেয়ার করে ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর!’-মার্কা ব্যানার বুকে সেঁটে ‘সোশ্যাল’ পশুপ্রেমী প্রমাণ করার আপ্রাণ হিড়িক ছিল না। তবে পাড়ার কাকিমা-জ্যেঠিমাদের দেখতাম সেই তিন-পেয়েটার প্রতি একটু পক্ষপাত ছিল। মানে, খাবারের উচ্ছিষ্টের একটা ভাগ আলাদা করে সরিয়ে রাখত। সেই দেখে বাকি চারপেয়েদের (কুকুর আর বেড়াল) কী গোঁসা! নিজেদের খাবার ফেলে খালি তিন-পেয়েটার খাবার ছিনিয়ে নেবার ধান্দা…
স্কুল পেরিয়ে কলেজের গণ্ডিতে প্রবেশ করে আলাপ হল এক ‘বিপ্লবী’ দাদার সঙ্গে! একদিন ক্যান্টিনে ধরে বিস্তর চা, সিগারেট ধ্বংস করে সেই বিপ্লবী দাদা বোঝাল চতুর্থ পায়ার মর্ম। মানে ‘তিন-পেয়ে’ ভারতীয় সংবিধানে কেন চতুর্থ পায়া হিসাবে সংবাদমাধ্যমকে জুতে দেওয়া হয়েছে। ওই আর কী! নড়বড়ে তিন-পেয়ে চেয়ারকে স্থিতিশীল করতে এই চার-নম্বর পায়ের অবতারণা! তা সে ভাল কথা। স্কুলে পড়তে রচনায় আসত ‘জনজীবনে গণমাধ্যমের ভূমিকা’। ১০-এ ৮-৯ পাওয়ার তাড়নায় আমরা খানিকটা না বুঝেই বাছা-বাছা জ্ঞানতত্ত্বের বাণী পরীক্ষার খাতায় উগরে দিতাম আর কী। পরে তলিয়ে দেখলাম তাই তো! ২০০৭-এর নন্দীগ্রাম বা তার পরের সিঙ্গুর কিংবা আগের তাহেলকা কেলেঙ্কারির সময় খবরের কাগজগুলো তথ্য-তত্ত্ব-নির্ভর সমালোচনায় ভরে থাকত…
কিন্তু হায় রে, চার-নম্বর পায়াটা নড়বড়ে হলে কী যে বিপত্তি হয়! ধরুন, বিয়েবাড়িতে খেতে বসেছেন। পাতে গরম লুচি দিয়ে গেছে, সঙ্গে ছোলার ডাল, ডাঁটাওয়ালা লম্বা বেগুনভাজার ফালি। সঙ্গে কানে কানে কেউ বলে গেল শোনা গেছে গুজবে যে— ‘হিং দেওয়া আলুর দম আসছে!’ সবই তোফা ছিল, কিন্তু রসনাতৃপ্তির সেই মহান যজ্ঞে তাল কাটল একটা ছোট্ট ব্যাপারে! দেখা গেল আপনার টেবিলের একটা পায়া নড়বড়ে। খিদের তাড়নায় বসার সময় টের পাননি! ফলত পাতের একপাশে দেওয়া ছোলার ডাল, আলুর দমের ঝোল ছোটাছুটি শুরু করল সারা পাত জুড়ে! আপনার সাধের ফুলকো লুচি গেল চটকে…
একই হাল এই সংবিধানের চতুর্থ পায়ার! পাছে ‘সকলের থেকে পিছিয়ে পড়েন’ সেই ভয়ে সকালে উঠে চা নিয়ে আপনি বসলেন খবরের কাগজের সামনে! ভাবছেন জগতে কী কোথায় হচ্ছে তার সুলুক-সন্ধান পাবেন।
ওমা! একগাদা বিজ্ঞাপনের গুঁতো সামলে প্রথমেই আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠল— ‘মেদহীন লাস্যে শরতের বৃষ্টিতে একমুঠো উষ্ণতা ছড়ালেন অমুক অভিনেত্রী’। আপনি তো ফুল ভ্যাবাচ্যাকা! এ শালা নায়িকা নিয়ে গসিপ নাকি নতুন এ সি-র বিজ্ঞাপন— সেটা ভাবতে ভাবতেই আপনার সাধের চা জুড়িয়ে জল!
আপনি ভাবলেন আর একটু এগিয়ে দেখি, হয়তো কাজের খবর ঠিক মিলবে! কিন্তু হায় রে হরি, সামনে এগিয়ে দেখলেন ফুল তিন-কোর্সের সার্কাস! কোন নেতা তার বান্ধবীকে নিয়ে হুড়ুমতাল উদ্বাহু নেত্ত করছেন— সেটাও প্রাইম টাইম নিউজ! সঙ্গে ফাউস্বরূপ একছটাক কেচ্ছা ‘ওরা কি ইতিমধ্যেই চুপিসারে বিয়ে করেছেন সক্কলের খাওয়া বঞ্চিত করে?’ এছাড়াও কোন অভিনেতা কাকে চুমু খেল, কাকে কত ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে জড়িয়ে ধরল, কোন অভিনেত্রীর সদ্যোজাত সন্তানের নাকটা কোন প্রতিবেশীর মত দেখতে, কোন (অভি) নেতা-নেত্রী কাপল পুজোর কলকাতার ভ্যাপসা গরম আর মশার কামড়ের থেকে বাঁচতে মরিশাস বা মলদ্বীপে ‘উষ্ণতা’ ছড়াচ্ছেন, কোন নেতার পরের ক্লাউন-মার্কা ভিডিওতে কোমর দুলিয়ে নাচার জন্য কত লক্ষ মামণি অতি উদগ্রীব, কোন অভিনেতার সুপুত্র ড্রাগ-কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে জেলে বসে ক’বালতি চোখের জল ফেলল, ক’বার ফ্যাচ ফ্যাচ করে নাক মুছল, ক’চামচ পাস্তা মুখে তুলল— তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ!
আর সামনে যদি আইপিএল বা ভোট গোছের কিছু থাকে, তাহলে আর ঠেকায় কে! সক্কাল থেকে শুধু ব্রেকিং নিউজ। এই কোন বড়দা লাল জার্সি খুলে টুক করে নীল জার্সি গলিয়ে নিচ্ছে বা টিকিটের লোভ দেখিয়ে কোন রাঘববোয়ালকে কোন পার্টি তুলে নিচ্ছে। নিদেনপক্ষে বেপাড়ার জ্যাঠামশাই এ’পাড়ায় এসে আম-পাব্লিকের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নেবার জন্য পাড়ায়-পাড়ায় পাত পেড়ে ‘চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়’-সহযোগে দুপুরের খাবার সাঁটাচ্ছেন আর ‘হামি বাঙ্গালা ভালভাসে’ বলে হেদিয়ে পড়ছেন। চালটা বাঁশকাঠি ছিল নাকি মিনিকিট, ডালে কী ফোড়ন দেওয়া হয়েছিল, পোস্তর বড়াটার ব্যাসার্ধ ঠিক কতটা ছিল, শেষপাতে চাটনিটা কাঁচা আমের ছিল নাকি আমড়ার— সংবিধানের চতুর্থ পায়া একনিষ্ঠভাবে আপনাকে দিনরাত এই খবর গিলিয়ে যাবে।
আগে মফস্বলে বা শহরে শীতকালে সার্কাস পার্টি তাঁবু ফেলত মাঠে, ‘অলিম্পিক সার্কাস’ বা ‘রাশিয়ান সার্কাস’। দু-চার টাকার বিনিময়ে দু’পেয়ে চারপেয়েদের খেল দেখাত। কিন্তু এখন সার্কাস দেখতে হলে আর আপনাকে হাঁ করে শীতকালের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না! সক্কাল-সক্কাল আপনার সামনে রোজ সেই সার্কাস হাজির করেছে মাননীয় (স্ত্রী-লিঙ্গ ব্যবহার করলে পলিটিক্যাল কেস খেতে পারি, তাই পুং-লিঙ্গই ব্যবহার করলুম!) ‘চতুর্থ’ পায়া…
কী বললেন— ‘পরিত্রাণ কীসে?’ না না, ফোন ঘুরিয়ে দাদা-দিদি কাউকে বলেই কিছু কাজ দেবে না! আপাতত অপেক্ষা উদয়ন পণ্ডিতের মত একঝাঁক ছুতোরের। যে এসে এই বেঁকে যাওয়া চতুর্থ পায়াটাকে মেরামত করবে। ওই যাতে আপনি সুস্থভাবে সাধের ‘লুচি-ছোলার ডাল’ খেতে পারেন আর কী…