Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

আঁতের কথা : স্বাধীনতা, দেশভাগ ও আমি

ম ল য় চ ন্দ ন  মু খো পা ধ‍্যা য়

||বেদনার আমরা সন্তান||

আমার জন্ম স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের কলকাতা শহরে। শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা এই শহরেই। ১৯৫১-তে জন্মেছি বলে আক্ষরিক অর্থে আমি উদ্বাস্তু নই। তবে উদ্বাস্তু-পরিবারেই জন্ম আমার। আমাদের দেশ ছিল বরিশাল। আমার বাবা যদিও চাকরিসূত্রে ১৯২৬ সাল থেকেই কলকাতায় থাকতেন, মা, ঠাকুমা, তিন ভাই বরিশাল শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকত। ছিল এক বোনও, মাত্র চার বছর বয়সে তখনকার দিনের দুরারোগ‍্য টাইফয়েড রোগে মৃত‍্যু হয় তার। গ্রামের বাড়ি ছিল কীর্তনখোলা নদীর ওপারে কাউয়ার চর ছাড়িয়ে মাইল চারেক দূরে হিজলতলা। শুনেছি, সেখানে একদা আমাদের ছিল বাহাত্তর জনের বিশাল যৌথ পরিবার। বাবা বরিশালের ঐতিহ্যবাহী ব্রজমোহন কলেজের ছাত্র ছিলেন। আমার জ‍্যেষ্ঠাগ্রজ পড়তেন বি এম স্কুলে। কলকাতায় এসে চেতলা বয়েজ থেকে ম‍্যাট্রিক দেন।

আমি উদ্বাস্তু নই, কিন্তু শৈশব থেকে উদ্বাস্তুজীবন দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। দেখেছি উদ্বাস্তুর কান্না, জীবনসংগ্রাম। ক্লেশ। হাহাকার। অশ্রুর পদাবলি। এবং প্রতিকূলতাকে অনুকূলতায় ফিরিয়ে আনা। এসব নিয়েই বর্তমান লেখাটি।

বেদনার প্রাথমিক আঘাত হচ্ছে নদী-খালবিল-আদিগন্ত প্রান্তরের পরিবর্তে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এনে ফেলা হল নদীহীন স্থানে। প্রত‍্যেক পরিবারের জন‍্য নির্দিষ্ট হল তিন-চার কী বড়জোর দশকাঠা জমি, যার পরিমাণটি যুগপৎ হাস‍্যকর ও রোদন-উদ্রেককারী পূর্ববঙ্গবাসীর কাছে। কেননা যার কিছুই ছিল না, পুব বাংলায় তার অন্তত দু-চার বিঘে জমি ছিল।

সেদেশে মানুষকে কিনে খেতে হত খুব কম জিনিসই। গোয়ালভরা গোরু আর গোলাভরা ধান হয়তো সবার ছিল না, কিন্তু তেল নুন লকড়ির আকাল নিতান্ত দুর্ভিক্ষের সময় ছাড়া দেখা যায়নি। উদ্বাস্তুদের কিনতে হচ্ছে সব, এ যে কী অর্থনৈতিক সঙ্কট!

একটা উদাহরণ দিই। আমাদের মামাবাড়ি ছিল জলাবাড়িতে, যেটি এখন পড়েছে ঝালকাঠি জেলায়। পেল্লায় তাদের রাজসিকতা, বাসগৃহ নাট‍্যশালা নিজেদের পাঠশালা নিয়ে। দোল-দুর্গোৎসবে খরচ হত বেশুমার। জায়গাজমি অঢেল। কেবল নারকেল গাছই ছিল কয়েকশো। সেই মামাদের পয়সা দিয়ে নারকেল কিনে খেতে হয়েছে। এ যে কোন গভীর ট্র‍্যাজেডি, ভুক্তভোগী ছাড়া তা কেউ বুঝবে না। আমরা পেয়েছিলাম সাড়ে তিন কাঠা জমি, মামারা, হায়, এক কাঠা!

দুঃসহ রূপকথা এসব, চাক্ষুষ করেছি বছরের পর বছর। প্রত‍্যেক উদ্বাস্তুর মর্মবেদনা যদি লিপিবদ্ধ হত, ধরণী এক কোটিবার দ্বিধাবিভক্ত হত। এমন হয়েছে পাঞ্জাবে, গুজরাতে, রাজস্থানে। অন‍্যদিকে পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানে যারা গেছেন উদ্বাস্তু হয়ে, তাদেরও রয়েছে বেদনার স্বতন্ত্র ইতিহাস।

দেশের বাড়িতে, পূর্ববঙ্গে, সবারই কিছু চাষের জমি ছিল, ছিল গোরুবলদ, পুকুর। এখন সেসবের বালাই নেই। নেই, তবে আছেও। এখানেও কেউ কেউ গোরুছাগল পুষত, সামান্য জমিতেও ফলফুল ফলাত।

এখানে একটি কথা বলে নিই। আমরা যে জায়গায় ছিলাম ও আছি, তা হল জবরদখল কলোনি। পূর্ববঙ্গ থেকে আগত মানুষজন পাঁচভাবে থিতু হয় ভারতে।

এক, পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি স্থানে, যেমন দমদম, অশোকনগর-হাবরা, ধুবুলিয়া, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে আন্দামান, দণ্ডকারণ‍্য (মধ‍্যপ্রদেশ), মানা (ওড়িশা) ইত‍্যাদি স্থানে, এবং দিল্লিতে একদল পুনর্বাসিত হন।

দুই, সামান্য কিছু লোকের হয় ঘরবাড়ি ছিল ভারতের কোথাও না কোথাও। তারা সেখানে ওঠেন।

তিন, একদল মানুষ পূর্ববঙ্গে তাদের ঘরবাড়ি পশ্চিমবঙ্গের লোকজনের সঙ্গে বিনিময় করেন।

চার, কেউ কেউ ঘরভাড়া নিয়ে থাকতেন।

পাঁচ, জবরদখল। কোনও মুসলমান-অধ‍্যুষিত জায়গা থাকলে ভয়ভীতির মাধ‍্যমে তাদের হটিয়ে দিয়ে তাদের জমিজিরেতে উদ্বাস্তুদের বসানোর দায়িত্ব নিতেন উদ্বাস্তুদের নিজেদের মধ‍্য থেকেই গড়ে ওঠা নেতারা।

এইভাবে অন‍্যের জমিজায়গা থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা রীতিমতো বেআইনি। সরকারের উচিত ছিল ব‍্যবস্থা নেওয়ার। মাঝেমাঝে পুলিশ দিয়ে হটাবার চেষ্টাও করত সরকার। কিন্তু সত‍্যি কথা বলতে কী, তা ওপর ওপর। সরকারও নিজ ঔদাসীন্যের মাধ‍্যম এ-কাজ সমর্থন করে গেছে মনে হয়। ও-অঞ্চলে বেশ কিছু ধনাঢ‍্য ব‍্যক্তির প্রাসাদ ছিল। সরকার সেসব ঘরবাড়িগুলো জবরদখল হতে দেয়নি। তাছাড়া এসময় কমিউনিস্ট নেতারা উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজে সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। পুলিশি হামলা তারা রোধ করতেন। সঙ্গে নিতেন জবরদখলকারীদের। ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে এমন দৃশ‍্য সেলুলয়েড-ধৃত হয়ে আছে। কমিউনিস্টদের এ-হেন ভূমিকার জন‍্য তারা কলোনিসমূহে অত‍্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, যার প্রভাব পড়েছিল একের পর এক সাধারণ নির্বাচনগুলিতে। পরবর্তীকালে উদ্বাস্তুদের দখলীকৃত জমিকে বৈধতা দিতেও কমিউনিস্টদের সদর্থক ভূমিকার কথা অনস্বীকার্য। এর ফলে উদ্বাস্তুরা এখন তাদের দখলীকৃত জমির বৈধ মালিক। তারা এখন নিজেদের জমিজায়গা বিক্রি করার অধিকারও পেয়েছেন।

কিন্তু এ হল মুদ্রার এক পিঠ। যারা তাদের জমি হারালেন, সেইসব হতভাগ‍্য মুসলমানদের (তারা অধিকাংশই মূলত কৃষিজীবী।) খবর কী? দেশভাগের দায় এইভাবে তাদের বইতে হবে কেন? তারা গেলেনই বা কোথায়? এসব প্রশ্নের জবাব নেই। কেবল ওখানকার কয়েকটি পুরনো মসজিদ, প্রাচীন গাছপালা, পুকুর আর দু-চারটি পোক্ত মাটির ঘর (এখন আর নেই। সেগুলো ভেঙে ফেলে পাকাবাড়ি তৈরি হয়েছে বহুকাল), এইসব তাদের অতীত অস্তিত্বের সাক্ষ‍্য দেয়। আর মুখে মুখে বহুদিন ধরে ফিরত অঞ্চলটির প্রাচীন নাম, মীনাপাড়া। এখন আর সে নামটাও শোনা যায় না।

প্রসঙ্গত জানানো যাক, এই মুসলমান মানুষজন এখানে বসতি গড়ে তোলেন কীভাবে। এরা আসলে দক্ষিণ ভারতীয়। কর্নাটকে টিপু সুলতানের ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে মৃত‍্যু হলে টিপুর বংশধরদের কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। সঙ্গে প্রচুর পাত্রমিত্র লোকলস্কর ঝি-চাকর। টালিগঞ্জের বিশাল অঞ্চল জুড়ে এদের বসতি ছিল। এখনও বেশ কয়েক হাজার মুসলমান এখানে বাস করেন। এদের একটি অংশকে উৎখাত হতে হয়েছিল।

এদের জমিতে যে আম কাঁঠাল পেয়ারা বেল নারকেল কুল জামরুল, যে কদম বকফুল তাল বট অশ্বত্থ নিম সুপুরি, সেগুলি সব উদ্বাস্তদের মালিকানায় যায়।

||নতুন ইহুদি||

উনিশশো সাতচল্লিশের স্বাধীনতার পাশাপাশি সমান্তরালভাবে আরও একটি নাম উচ্চারিত হয় : দেশভাগ। স্বদেশত‍্যাগী মানুষজন স্বাধীনতা না বলে দেশভাগের নামটিই বেশি করে বলেন। দেশভাগ আমাদের ভাষায় বেশ কিছু নতুন শব্দের জন্ম দিয়ে গেছে, যা আমরা আগে বলতাম না। যেমন রোয়েদাদ। যেমন সীমান্ত, পাসপোর্ট-ভিসা, দাঙ্গা, এক্সোডাস, উদ্বাস্তু বা বাস্তুহারা, এরকম আরও। নিমাই ঘোষ দেশভাগ নিয়ে ছবি বানালেন ১৯৫১-তে, যাতে ঋত্বিক ঘটক অভিনয় করেছিলেন। ‘ছিন্নমূল’। এই নামটিও দেশভাগোচিত উপার্জন। ইহুদি নামটিও।

ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, নতুন উপনিবেশকে পুরনোর সঙ্গে মেলানোর কী আপ্রাণ প্রয়াস মানুষের! বারো মাসে তেরো পার্বণ ছিল তাদের, নতুন দেশে এসে সেগুলো বজায় রাখার যত্নপরতা। তাই শীতকালে নগরসংকীর্তন বেরোত, বর্ষায় সময়মতো বৃষ্টি না হলে মেঘারানিকে বরণ। কীভাবে? মেয়েবউরা কুলা নিয়ে বাড়ি বাড়ি যেতেন। কুলায় থাকত কলসির জল। মেয়েরা সমস্বরে গান গেয়ে শেষে সেই জল গৃহস্থের চালে ঢেলে দিতেন ছদ্ম বৃষ্টিপাতের প্রকল্পে। ছিল বাৎসরিক মনসা-কালী-শীতলাপুজো। বসন্ত-কলেরার মহামারী ঠেকাতে। যদিও এসবের ভয়াবহতা আর প্রাবল‍্য তখন আর ততটা ছিল না, তবুও অতীতে গ্রাম-গ্রামান্তরে যে মহামারী চাক্ষুষ করেছিল মানুষ, তার ভীতি এসব দেবী-আরাধনার মূলে। বয়স্কাদের সমবেতকণ্ঠে শীতলার গান শুনতাম। এখন আর সে-গান গাওয়ার কেউ নেই। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল পাঠ হত বহু বাড়িতে। শ্রাবণ-সংক্রান্তিতে মনসাপুজো। কেউ কেউ পাঁঠাবলি দিত। ভাদ্র-সংক্রান্তিতে প্রায় ঘরেই বিশ্বকর্মা পুজো। গৃহস্থের ঘরে, ঘরদোর সাফসুতরো করে। বিশ্বকর্মার ব্রতকথা শোনাতেন বাড়ির প্রবীণা একজন কেউ।

সবই পূর্ববঙ্গের উত্তরাধিকার। যেমন ঘরে ঘরে প্রত‍্যেক বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পুথি পড়া হয়, ‘বসন্ত পূর্ণিমা নিশি নির্মল আকাশ/ মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয়বাতাস।/ লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ/ কহিতেছে কত কথা সুখে আলাপন—।’ পুথিটি এতই জনপ্রিয় ছিল যে এর থেকে নির্বাচিত কয়েকটি চরণ ভারতের বিখ‍্যাত ইউনাইটেড ব‍্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া উদ্ধৃতি হিসেবে ব‍্যবহার করে সাইনবোর্ডের মাধ‍্যমে সারা কলকাতা শহর ছেয়ে দিয়েছিল, ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার স্থাপি সব ঘরে ঘরে/ রাখিও তণ্ডুল তাহে একমুষ্টি করে।/ সঞ্চয়ের পন্থা ইহা জানিও সকলে,/ অসময়ে উপকার পাবে এর ফলে।’

ছিল শনি-সত‍্যনারায়ণের পুজো। সে-উপলক্ষ্যে ফলপ্রসাদ তো ছিলই, বিতরিত হত শিরনি, বাঙাল ভাষায় যাকে বলা হত সিন্নি। মাঝেমাঝেই এর ওর তার বাড়িতে কীর্তনের আসর বসত। সেখানে আবার ছিল হরির লুট। বাতাসা উঁচুতে ছোড়া হত, আর আমরা শিশু-কিশোরের দল তাই নিয়ে কাড়াকাড়ি। এই নিয়ে ছড়া ছিল, ‘পোলাপানে জিতিয়া নিল, ঠইগ্গা গেল বুড়া’। তা বুড়োরা তো ঠকবেই, এ আর নতুন কথা কী?

পরিত‍্যক্ত পুকুর ছিল কয়েকটি। চাষের জন‍্য দরকার হত বলেই কারা যেন কবে খনন করেছিল। পাড়ার ছেলেমেয়েরা সন্তরণপটু হয়ে উঠল সেইসব পুকুরের দৌলতে। অল্পস্বল্প মাছও মিলত। বাসন মাজা, কাপড় কাচা, সবই চলত সে-পুকুরে। বর্ষাকালে পুকুর উপচে জল চলে আসত গৃহস্থের উঠোনে, ঘরেও এমনকি। মাটির মেঝে, হোগলাপাতার বেড়া। নিতান্তই কষ্টের মধ‍্য দিয়ে দিনযাপন। টালির ছাদ, যা দিয়ে প্রতি বর্ষায় জল পড়ে বসবাস অসহ করে তুলত। তবু আনন্দ জাগে! ঘরের মেঝেতে ভুঁইফোড়, আঃ, দেখে সে কী আনন্দ!

||সেইসব দিনরাত্রি||

কলোনির জীবন দেখেছি আমি। তার ভাল ও মন্দ, দুই-ই। তীব্র জীবনসংগ্রামের মধ‍্য দিয়ে যেতে যেতেও মানবিকতা হারায়নি মানুষ, নিজেদের ক্লেশ, তবু তার মধ‍্যে আশ্রয় দিয়েছে আত্মীয়স্বজনকে, আধাপেট খেয়েও বঞ্চিত করেনি স্বজনকে।

আমি যেখানে থাকতাম (এখনও থাকি, তবে এখন তার ভূ-বৈচিত্র্য পুরোপুরি পালটে গেছে), সেখানে প্রায় প্রত‍্যেক বাড়িতেই বড়বড় গাছপালা আছে, আম, পেয়ারা, বেল ইত‍্যাদি। গাছগুলো আগে থেকেই ছিল, আগেকার বাসিন্দারা লাগিয়েছিলেন। আমাদের বাড়িতেই তো ছিল চারটে বিরাট বিরাট পেয়ারাগাছ, যেজন‍্য আমাদের বাড়ি পেয়ারাওয়ালা বাড়ি বলে চিহ্নিত ছিল। আর ছিল জোড়া বেলগাছ, আমগাছ দুটো, কলার ঝাড়। পরে মা দুটো নারকেলগাছ লাগায়। গত প্রায় ষাট বছরে কত যে নারকেল হয়েছে গাছদুটিতে! একটি গাছ বাজ পড়ে মরে গেছে অবিশ‍্যি।

পুব বাংলা থেকে আগত উদ্বাস্তুরা প্রায়শই তাদের দেশের বাড়ির আম জাম কাঁঠাল নারকেল সুপুরির স্মৃতিরোমন্থন করেন। আর আমরা যাদের লাগানো পেয়ারা বেল কলা খাই, কোনও অজ্ঞাতবাসে থেকে তারাও সেসব গাছের কথা ভেবে স্মৃতিভারানত হন! হায়, এরই নাম দেশভাগ! ধন‍্য ব্রিটিশ, ধন‍্য তোমার ‘Divide and rule’!

পূর্ববঙ্গ নয়, যেন তার বনসাই। নদী খাল বিল ধানখেত নেই, কিন্তু ওই যে একটুকরো পুকুর, মল্লিকাদিদের উঠোনময় টম‍্যাটোর চাষ, রবিদার উঠোন জুড়ে ডালিয়া, যা চালান যেত নিউ মার্কেটে, আর প্রতি বাড়িতেই কিছু না কিছু সবজি চাষ, তাই বা কম কীসে? গাছপালা ছিল মেলা, আর তাতে টিয়া ঘুঘু ময়না প‍্যাঁচা এসে বসত। পায়রা পুষত কেউ কেউ, টিয়া, খরগোশ, বেজি, বেড়াল, কুকুর। পাড়ার গোপালদাকে দেখেছি গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করতে।

ডাহুক দেখেছি পুকুরে। গৃহস্থ হাঁস ছেড়ে দিত পুকুরে। মাঝেমধ‍্যে শেয়ালের উৎপাত, কারও হাঁস, কারও বা বেড়ালছানা শেয়ালের পেটে।

শেয়াল বলতেই মনে পড়ে গল্ফ ক্লাবের কথা। চারদিকে অশ্বিনীনগর আজাদগড় সমাজগড় গান্ধী কলোনি, এরই কাছে দি রয়াল ক‍্যালকাটা গল্ফ ক্লাব, ভারতসেরা। প্রতিবছর টুর্নামেন্টে বিশ্বসেরারা যোগ দিতেন। কলোনিবাসীরা দলবলসহ যেতাম। সাহেব, বিশেষ করে অঢেল নির্ভেজাল মেমসাহেব দেখার মহালগন! গায়ে দামি সেন্টের খুশবু, মুখে তাদের সিগারেট। কিংসাইজ! ফিলটার টিপড! খেলোয়াড়দের মধ‍্যে পাঞ্জাবি অশোক সিনহা আর নেপালি কী ছেত্রীকে চ‍্যাম্পিয়ন হতে দেখতাম পালাক্রমে। প্রায়শ ২৫-এ ডিসেম্বর ফাইনাল খেলা হত। খেলা দেখতে গিয়ে বিশাল মাঠটি পরিক্রমা করতে হত। তা হোক। মেম দেখার নেশায় ওটা তুচ্ছ। একবার ওই গল্ফ ক্লাব মাঠে শীতের দুপুরে রোদ পোহাতে গেছি, দেখি গল্ফ-ব‍্যাট হাতে, কে, না গারফিল্ড সোবার্স! টেস্ট খেলতে এসেছিলেন। অফ ডে ছিল সেদিন, তাই গল্ফ খেলতে আসা।

গল্ফ মাঠ ছিল আমাদের মর্নিং ওয়াক, দৌড়নো, ফুটবল খেলার জায়গা। রোজ ভোরে আশপাশের একাধিক কলোনিবাসী মানুষজন প্রাতর্ভ্রমণে আসতেন এখানে। কাছাকাছি বাড়ির যারা গোরু-ছাগল পুষত, তাদের গৃহপালিত পশুদের এখানে নিয়ে আসত ঘাস খাওয়াতে। কর্তৃপক্ষ বাদ সাধত না এতে। ক্লাবের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত প্রসারিত ছিল সরু পায়েচলা পথ, মাটির। পথটি ছিল কলকাতা কর্পোরেশনের। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত সে-পথের শেষেই বামদিকে গোরস্তান, পরিত‍্যক্ত। আরও কিছুদূর এগিয়ে গেলে পাঁচ হাজারের ওপর কর্মী নিয়ে বিশাল ঊষা কোম্পানি। যাদের তৈরি ফ‍্যান ভারতে বিক্রি হত তো বটেই, রপ্তানি হত বিশ্বের বহু দেশে। বছর কুড়ি ধরে সে কোম্পানি বন্ধ। গল্ফ ক্লাবের ওই সরু সরকারি রাস্তা দিয়ে সাইকেল চড়ে কত লোককেই না ঊষায় যেতে দেখতাম! এখন পুরো গলফ ক্লাবটাই বাইরের লোকের কাছে একেবারে নিষিদ্ধ অঞ্চল। গোড়া থেকেই সুবিশাল মাঠটি কংক্রিটের বেড়া দিয়ে ঘেরা, যা বেশ অভিনব মনে হত আমাদের কাছে : দুঘণ্টার ওপর সময় লাগে যে পাঁচিল পরিক্রমা করতে, আটফুট কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে তার নির্মাণ!

গল্ফ ক্লাবের অর্ধেকটা নিয়ে পরে গল্ফগ্রিন আবাসিক এলাকা ও কলকাতা দূরদর্শনকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়।

আমাদের কলোনিবাসীর সঙ্গে গল্ফক্লাবের অজস্র স্মৃতি। সকালে সূর্যোদয় দেখতাম, বিশাল কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া গাছের তলায় বসে বন্ধুদের নিয়ে গল্প করতাম, গ্রীষ্মের দুপরে গরমের ছুটি কাটত ওখানকার বিশাল বিশাল আমকাঁঠাল গাছের তলায়। বিচ্ছু ছেলের দল আমকে বড় হতে দিত না কদাপি।

মজার ব‍্যাপার হল, খেলাধুলো হত, পুকুরে মাছ ধরা হত, অগাধ অবাধ জায়গা, ছেলেমেয়েরা কিন্তু প্রেম করতে যেত না কখনও। কেননা একে তো ওখানে কোনও আড়াল-আবডাল নেই, তায় যারা যায় ওখানে, সবাই সবাইকে চেনে।

সাতের দশকে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সাক্ষী থেকেছে গল্ফ ক্লাব। কংগ্রেসের অত‍্যাচারপর্ব, এমার্জেন্সির বকলমে। কংগ্রেসের গুন্ডাবাহিনী সি পি এম আর নকশালদের নিষ্ঠুরভাবে হত‍্যা করার জন‍্য এইখানে নিয়ে আসত। তখন জায়গাটার নামে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে উঠত, প্রাতর্ভ্রমণ তো স্বপ্নের-ও অগোচর। সেসব দিন-ও ক-বে কেটে গেছে।

একবার রটল, সোনার হরিণ দেখা গেছে গল্ফ ক্লাব মাঠে। বন‍্যাধারার মতো লোক ছুটল অফিসকাছারি ফেলে, রান্না ফেলে, পড়াশুনো ফেলে। তন্নতন্ন করে চিরুনি-তল্লাসি চালিয়েও দেখা মিলল না স্বর্ণমৃগের। যখন তাবুত ফিরল তাদের, সূর্য মধ‍্যগগনে। ফিরে এল সব আহাম্মকের বাহিনী।

গল্ফক্লাব নিয়ে ভূতের গল্প-ও কম ডালপালা মেলেনি। তা ছিল আবার ওখানকার এক পাহারাদারকে কেন্দ্র করে। আত্মহত‍্যা করেছিল সে কী কারণে যেন। অনেকেই তাঁর বিদেহী আত্মাকে দেখা শুরু করল। বহুদিন পর্যন্ত চলেছিল সেই দেখা। তারপর আস্তে আস্তে, যেমন হয় আর কী, স্তিমিত হয়ে গেল।

আত্মীয়স্বজন এলে অবধারিতভাবে তাদের দেখিয়ে আনা হত গল্ফ ক্লাব, যেমন দেখিয়ে আনা হত কাছেপিঠের রানিকুঠি ও খানিক দূরের লেক।

এবার সেই রানিকুঠির গল্প।

||রানিকুঠি, বি ও আর ক‍্যাম্প||

টালিগঞ্জের যে অঞ্চলে আমাদের কলোনিগুলি গড়ে উঠেছে,— নেতাজিনগর, গান্ধী কলোনি, আজাদগড়, নেহরু কলোনি ইত‍্যাদি, তার কাছাকাছি-ই ছিল বেশ বনেদি অঞ্চল। এটা ছিল সিনেমাপাড়া, দুই অর্থে। এক, একাধিক স্টুডিও ছিল এখানে, ইন্দ্রপুরী, নিউ থিয়েটার্স, ইস্ট ইন্ডিয়া, রাধা স্টুডিও, কালী স্টুডিও ইত‍্যাদি। দুই, স্টুডিওর সূত্রেই বহু অভিনেতা-অভিনেত্রী এখানে বাড়ি করেছিলেন,— কানন দেবী, ছবি বিশ্বাস, বসন্ত চৌধুরী প্রমুখ। ছিল কিছু অবাঙালির বাগানবাড়ি। সবচেয়ে অভিজাত ছিল ময়ূরভঞ্জের রানির বাড়ি। বিশাল প্রাসাদ। লাগোয়া বিশালতর দিঘি। সে-প্রাসাদ পরবর্তীকালে ভারত সরকার কিনে নেয়। যখন কলোনির পত্তন হয়, ১৯৪৮/৪৯ নাগাদ, ওটা ছিল ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তর। পরে টেলিফোন অফিস। এখনও তাই। ময়ূরভঞ্জ ব্রিটিশ আমলে দেশীয় রাজ‍্য ছিল। পরে স্বাধীন ভারতবর্ষে যোগ দেয়।

যাই হোক, লালরঙের প্রাসাদটির ভেতরে ঢোকা যেত না, তবে দূর থেকে দেখে চোখের তৃষ্ণা মেটানো যেত যথেষ্ট। আর নিকটস্থ দিঘিটি কিন্তু বরাবরই সাধারণ মানুষের জন‍্য উন্মুক্ত ছিল। স্থানীয় লোকের সন্তরণশিক্ষা ওখান থেকেই। মাছ ছাড়া হত। দক্ষিণার বিনিময়ে ছিপ দিয়ে মাছ ধরা যেত। বছরে দুচারজনের সলিলসমাধিও হত,— দিঘির বাৎসরিক খাজনা বা টোল।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল দুর্গাপ্রতিমার ভাসান। অঞ্চলের কম করে শতাধিক বারোয়ারি ও বাড়ির প্রতিমার বিসর্জন, সে একটা দেখার মতন ব‍্যাপার। শুধু কি বিসর্জন? বিসর্জনকে কেন্দ্র করে বিকিকিনির হাট বসত। আখ থেকে চপ, গণেশমূর্তি থেকে (বিসর্জনফেরতা লোকজন আখ আর গণেশমূর্তি নিয়ে বাড়ি ফিরত), বই, সব পাওয়া যেত সেদিন। ছিল ফার্স্ট এইডের ব‍্যবস্থা, পুলিশপ্রহরা, পকেটমার ও ইভটিজার ঠেকাতে। স্বভাবতই পকেটমার ও ইভটাজার-ও ছিল। সেই ট্র‍্যাডিশন বজায় আছে আজ-ও।

ক্লাবে ক্লাবে রেষারেষি, কাদের প্রতিমার বিসর্জন আগে হবে, এই নিয়ে ইগোর লড়াই। লড়ুয়েরা সব বিকেল থেকেই তৈরি। সন্ধ‍্যায় তারা মাদকসেবনে বসে যেত। পুরোপুরি সুস্থাবস্থায় তো অনর্থক মারামারিতে জড়িয়ে পড়া সম্ভব নয়। তারপর প্রতিমা ঘিরে বিটকেল নাচ। সহসা দমাদম ইটের আঘাতে বিসর্জনের জন‍্য সাময়িক আলোর বাতিগুলো ভাঙা। মারামারির শুভসূচনা। কে কাকে থামায়? কয়েকজন জখম। বয়স্করা কষ্টে থামাতেন সে-মারামারি। খুব বেশি বেগ পেতে হত না, কেননা সিধুপান-ই তাদের দ্রুত রণক্লান্ত করে তুলত। অতঃপর দ্বিধা, সংশয় ও শঙ্কা কাটিয়ে দেবী দুর্গা সপরিবারে বিসর্জিতা হতেন।

||কলোনিবাসীর সংস্কৃতিচর্চা||

শত দুঃখকষ্ট অভাব-বেদনার মধ‍্য দিয়ে নতুন জীবন শুরু করলেও কলোনিবাসীর কারুবাসনা ছিল অপরিসীম। এখানকার বেশ কিছু মানুষ আগে থেকেই শিল্পচর্চা করতেন। আমাদের পাড়ার গোঁসাইবাবু ভাল বেহালা বাজাতেন। তার শ‍্যালক তিনুদা ছিলেন সেতারশিল্পী। নারায়ণদা গিটার বাজাতেন। কীর্তন ও ভক্তিগীতি গাইতেন গোপালদা। প্রতিবছর তিনি পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাত্রাপালা উপস্থাপন করতেন,— নৌকাবিলাস, মাথুর, শ্রীচৈতন‍্য। তিনি নিজে গান-ও লিখতেন। হারমোনিয়াম, তবলা, কর্তাল বা কাঁসর বাজানোর লোকের অভাব ছিল না। হারানদাদের ছিল ত্রিনাথ (আমরা বলতাম ‘তেন্নাথ’)-এর দল, শ্মশানযাত্রায় হরিধ্বনিসহযোগে যোগ দিতেও একটি দল গড়ে উঠেছিল। পাড়ার বেশ কিছু মেয়ে গান জানতেন, গীতাদি, ডিগাদি, অনিতাদি। অনিতাদি তো সঙ্গীত পরিবেশনের সূত্রে দেশবিদেশেও যেতেন। উৎপল দত্তের পি. এল. টি.-তে ছিলেন। মস্কো-বার্লিন গেছেন গ্রুপের সঙ্গে। আকাশবাণী কলকাতা ও দূরদর্শনের নিয়মিত শিল্পী তিনি। আনন্দ হয় ভেবে, ছোটবেলায় পাড়াতে ক্রিকেট খেলতাম যখন, অনিতাদি স্বেচ্ছায় আমাদের রান টুকবার দায়িত্ব নিতেন।

কেবল যাত্রাপালা নয়, প্রতিবছর সাড়ম্বরে নাটক-ও অভিনীত হত। পাড়ার তরুণ রমেশদার উদ‍্যোগে নিতাইদা, লখাইদা, তপন-মনিয়া-সলিল-ব্রিটিশদা, আমার মেজদা অরুণ ছিলেন অভিনয়ে। পাড়ায় যাত্রার সময় মেয়েরা যোগ দিলেও, নাটকে অভিনয়ের জন‍্য কিন্তু শ‍্যামলীদি-টুকুদি-কৃষ্ণাদিদের পাওয়া যেত না। মনে হয় গোপালদার অধ‍্যক্ষতা ছিল বলে মেয়েদের বাড়ি থেকে আপত্তি উঠত না। মেয়েদের আনতে হত অর্থের বিনিময়ে। সেসময় অর্থের প্রয়োজনে মধ‍্যবিত্ত উদ্বাস্তু পরিবারের মেয়েরা পাড়ায় পাড়ায় ক্লাবনাটক, অফিসনাটকে অভিনয় করতেন। সংসারের হাল যেভাবে ধরা যায়। বহু মেয়ে সরকারি হরিণঘাটার দুধ বিক্রির বুথে দুধপরিবেশন করে আয় করতেন। টিউশনি করেও কেউ কেউ। সে বড় সংগ্রামবহুল দিন গেছে মানুষের। মধ‍্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা সংসারের আর্থিক দায়িত্ব তুলে নিতে চাকরির জন‍্য বাইরে যাচ্ছেন, এটা ব‍্যাপকভাবে দেখা যেতে লাগল এই সময় থেকে। যার প্রতিফলন দেখি ঋত্বিকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ আর সত‍্যজিতের ‘মহানগর’-এ। নিতান্ত দুস্থ পরিবারের মেয়েরা বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করতেন। তবে উদ্বাস্তু পরিবারে ঝি-চাকর রাখা সেসময়ে বিলাসিতা ছিল।

নাটকপ্রসঙ্গে আরও কিছু কথা। অপেক্ষাকৃত বড়দের-ও একটা নাটকের দল ছিল, যে-দলে বিরাজদা, বুদ্ধদা, জনার্দনদা, সোনাইদা, বাসুদা, হরিদাসদা ছিলেন। তবে এক-আধটির বেশি নাটক করেননি তারা। একটা মজার ব‍্যাপার দেখতাম প্রত‍্যেক নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার সময়। বলা নেই কওয়া নেই, বি. ও. আর.-ক‍্যাম্পবাসী রতাদা সন্ধে থেকে এসে উপস্থিত। কারও মেকআপ ঠিক করে দিচ্ছেন, কাউকে বলে দিচ্ছেন মোক্ষম সংলাপটি ঠিক কীভাবে বললে দর্শকের ক্ল‍্যাপ অবধারিত, আবার কাউকে নার্ভাস হতে মানা করছেন : ডায়ালগ ভুলে গেলে সমস‍্যা নেই। যে-নাটকই অভিনীত হোক, সেসব গুলে খেয়েছেন তিনি। আমি প্রম্পটার আছি কী করতে? সংলাপ না, বদলে ‘ডায়লগ’ কথাটি বলতে রতাদা ভালবাসতেন খুব। এমন নাটক-অন্ত প্রাণ জীবনে খুব কম দেখেছি।

নাটকের পরদিন সকালেও রতাদার একটা মহান ভূমিকা ছিল। অমূল‍্যদার মুদিদোকানের সামনেটা ঘিরে গতরাতের অভিনেতাদের জটলায় নাট‍্যাভিনয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেন তিনি। কে নিজের বদলে অন‍্যের সংলাপ বলে ফেলেছে, বারবার প্রম্পট করা সত্ত্বেও কে হাবার মতো চুপ করে থেকে দর্শকের হাসি কুড়িয়েছে, কে নিজে থেকে সংলাপ বলে পরিস্থিতি সামলেছে, একেবারে ঝানু সমালোচকের মতো আলোচনা করে সেই-যে চলে যেতেন রতাদা, ফের আসতেন পরবর্তী নাট‍্যসন্ধ‍্যায়, ছ’-সাতমাস পর। কত জায়গাতেই যে যেতে হত রতাদাকে! একদিনের বেশি সময় দিতে পারেন?

কেবল রতাদা নন, ছিলেন মন্টুদা, মন্টু ব্রহ্ম। তিনি উৎপল দত্তের গ্রুপে নাটকে অভিনয় করতেন বলে সবাই খুব সমীহ করত তাকে। নাটককে কাটছাঁট করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ‍্যে নিয়ে আসায় দক্ষ ছিলেন তিনি, তা সে নাটক গঙ্গাপদ বসুর ‘অংশীদার’-ই হোক, বা রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’। আর মহড়ার সময় অভিনয় শেখানো মন্টুদার যেন নৈতিক দায়িত্ব ছিল। পঙ্গুকে দিয়েও গিরিলঙ্ঘন করাতে পারতেন তিনি। ছিলেন ধৈর্যের অবতার। অভিনয় না পারলে বারবার দেখিয়ে দিতেন ক্লান্তিহীনভাবে। রতাদা আর মন্টুদার কথা নাটকের ইতিহাসে স্থান পাবে না কোনওদিন। যেমন স্থান পাবে না কৃষ্ণাদি-সোমাদির মতো অভাবতাড়িত অভিনেত্রীদের কথা, যারা অর্থের বিনিময়ে অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। আমার এই ক্ষুদ্র লেখার মাধ‍্যমে তাদের শ্রদ্ধা জানাই।

পাড়ায় নাটক ও যাত্রা হত যেমন, খেলাধুলো-ও পিছিয়ে ছিল না। আমাদের পাড়ায় মাঝারি আকারের একটি মাঠ ছিল। ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, ব‍্যাডমিন্টনের আসর বসত শীত-গ্রীষ্ম পালা করে। ছিল হাডুডু আর দেশীয় খেলা দাড়িয়াবান্দা। ১৯৬৫/৬৬ নাগাদ যখন আন্তর্জাতিক স্কুল ক্রিকেট চালু হয়, আমাদের পাড়ার বাবলু (ভাল নাম দীপঙ্কর সরকার) দু-দুবার ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিল, একবার ইংল‍্যান্ডের সঙ্গে বিলেত গিয়ে, আর একবার অস্ট্রেলিয়ানদের সঙ্গে সেদেশে। সে-দলেই গাভাসকার-বিশ্বনাথেরা খেলেছিলেন। বাবলু ছিল অলরাউন্ডার। বাঙালি বলে টেস্টে সুযোগ পায়নি কোনওদিন, রঞ্জিতেই আটকে ছিল সারাজীবন! বাবলুর বন্ধু ছিলাম বলে যৌবনে মাঝেমাঝে মাটিতে পা পড়ত না আমার।

মূল যে সত‍্য, তা হল উদ্বাস্তুজীবনের প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে অতখানি যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। এর মূল‍্যায়ন-ও ইতিহাস করেনি।

প্রথম ডিভিশনে ফুটবল খেলতেন ছোটমনুদা, মোহনবাগানে। DEAF AND DUMB CLUB ছিল, ক্রিকেটের। সেখানে পাড়ার মূক ছেলে রথীনদা খেলতেন। সেকেন্ড ডিভিশন ক্লাব ছিল সেটা। একবার অলিম্পিকে হাডুডু অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। শুনেছি, আমাদের পাড়ার গোপালদা, বিধুভূষণ চক্রবর্তী ও অমূল‍্য সমাদ্দারের যোগ দেবার কথা ছিল তাতে। খেলাটি অলিম্পিকে স্থান পায়নি শেষতক।

ইনডোর গেম কম ছিল না। তাস, লুডো, ক‍্যারম তো ছিল-ই, আমাদের ঠিক পাশেই দারোগাবাড়িতে রোজ পাশাখেলার আড্ডা বসত। আর ছিল কড়ি খেলা, ষোলোগুটি বাঘচাল, এমনি দেশজ খেলা। দাবা খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। আমার বড়দা খেলতেন বলে আমাদের বাড়িতে তার চল ছিল। নান্টু আর বাবলাদের বাড়িতে ছিল। ওদের বাবা-রা খেলতেন। নান্টু-বাবলা আমার বাল‍্যবন্ধু। নান্টুর সঙ্গে দাবা খেলতাম খুব। আশ্চর্য, দাবায় বাবলার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না।

নান্টু-বাবলার নাম এল যখন, আমাদের ওইসময়কার কিছু ঘটনার কথা না লিখলেই নয়। এ-ও নিপাট কলোনিজীবনের- ই আখ‍্যান।

আমরা একবার সিগারেট খাব ঠিক করলাম। কিন্তু কোথায় বসে এই চূড়ান্ত দুঃসাহসিক কাজটি করা যায়? সিগারেট কেনাটা অবিশ‍্যি সমস‍্যা নয়, কেননা বাবলাকে বাবার জন‍্য রোজ-ই সিগারেট কিনে আনতে হয়। কিন্তু ধূমপান করবটা কোথায় বসে? কারও বাড়িতে? অসম্ভব। দূরে, রাস্তায় যেতে যেতে? পাগল! বড়রা, এমনকি বিশ্বাসঘাতক ছোটরাও কেউ দেখে ফেললেই চিত্তির। অতএব চলো জঙ্গলে।

তা জঙ্গল কি এখানে? রানিকুঠির কাছে, পরে যেখানে প্রাকৃতিক তেল পাওয়ার সম্ভাবনা দেখে খোড়াখুড়ি হয়েছিল, পরে কিছু না মেলায় পরিণত হল সরকারি আবাসনে, জঙ্গুলে জায়গা যদিও, তবু তার ত্রিসীমানায় যাওয়ার হিম্মত ছিল না কারও, দুর্গন্ধের দরুন। মরা কুকুরবেড়াল ওইখানে ফেলে দিয়ে আসত লোকে, আর তার-ই বদবু-তে চারপাশ দিয়ে হাঁটাচলা দায় ছিল। অতএব ক‍্যানসেল সেটা।

তাহলে বাঘাযতীন রেললাইন ছাড়িয়ে (তখনও বাঘাযতীন রেলস্টেশন দূরঅস্ত্) হোগলা-ভ‍্যারেন্ডার বন। যাতায়াতে দুঘণ্টা, একটি সিগারেট খেয়ে আসতে। সেটা-ই করা হয়েছিল, যদিও ধূমপানের মধ‍্যপথে এক প্রবীণ কোথা থেকে এসে উদয় হলেন! অতএব অর্ধসমাপ্ত সিগারেট দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে লাগাও দৌড়!

মূল‍্যবোধের যুগ সেটা। গুরুজন কেউ ডাকলে ‘কী’ বলে উত্তর না দিয়ে ‘আজ্ঞে’ বলতে শেখানো হত, বয়স্ক অতিথি এলে পা ছুঁয়ে প্রণাম করার সহবত শিক্ষা দিতেন অভিভাবকেরা। আমাদের-ওদের বলে কিছু ছিল না। বড়রা যদি কেউ দেখতেন, তাদের বাড়ির ছোট ছেলেটির সঙ্গে ঘোর দুপুরে মাঠে টহল দিচ্ছি, দুজনকেই ধরে এনে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিতেন, কদাপি আমাকে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন না। আমাদের বাড়ির উৎসবে পাড়াসুদ্ধু যোগ দিত, আর তাদের বাড়ির উৎসবেও আমি। কাদের বাড়ির অনুষ্ঠান, সেটা মালুম হত না সহসা। কারও বাড়িতে বিয়ে। সে-বাড়িতে আমার সমবয়সী ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে আমিও সকাল থেকে মেতে আছি। দুপুরে তার সঙ্গেই পাতপেড়ে বসে গেলাম। এটাই ছিল দস্তুর। বিয়েতে কারও বাড়ির আত্মীয় উপচে পড়লে তারা আমাদের বাড়িতে রাতে শোবে, এটা অবধারিত, স্বতঃস্ফূর্ত। এটা বাঙ্গালদের সংস্কৃতি।

আরও আছে। পাশের বাড়ির ভদ্রলোক ব‍্যবসায়ী বলে অফিসযাত্রী স্বামীর স্ত্রীদের মতো সাতসকালে উঠে রান্না করার ধকল নেই তার। কিন্তু তার ছেলে সকালে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যায় যখন, প্রতিবেশী সেই অফিসযাত্রীর বউয়ের বাড়ি থেকে অন্নব‍্যঞ্জন এনে তা খাইয়ে ইন্টারভিউ দিতে পাঠায় তাকে। কারও বাড়ি ইলিশ এলে প্রতিবেশী ভাগ পায়। পিঠে-পায়েস হলে পায়। এই যূথবদ্ধতা কলোনিজীবনের জীয়নকাঠি। এক বাড়ির শিশুসন্তান প্রায়শ পাড়ার এর ওর তার বাড়িতে দিনরাত থাকে, খায়, স্নান করে, ঘুমোয়। এমনকি প্রতিবেশীদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও যাওয়া-আসা চলত। প্রথমে প্রতিবেশীর সঙ্গে, পরে একা একা-ই। বৃহত্তর বেদনাকে এইভাবে ছোটখাটো আনন্দ-উপচারে ভরিয়ে নিয়ে সব দুঃখ ভোলার বাসনা ছিল কলোনির মানুষের।

এমন-ও হয়েছে, প্রতিবেশী প্রতিবেশীর অসুখবিসুখে রাত জেগেছে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে, ওষুধ খাওয়ানো, পথ‍্য তৈরিতে হাত বাড়িয়েছে। কারও অসুখ হলে প্রতিবেশীরা খবর নিতে আসত। মৃত‍্যু হলে শ্মশানযাত্রী হত। এই অন্তরঙ্গতা-ঘনিষ্ঠতা-আত্মীয়তাবোধ কলোনিজীবনের বৈশিষ্ট্য ছিল। এখন অবিশ‍্যি তা বিলুপ্তির পথে। বিশেষ করে বাইরের বহু মানুষ এখানে ভাড়াটে হিসেবে এসে এখানকার জনবিন‍্যাস যেমন পালটে ফেলেছে বিগত তিরিশ-চল্লিশ বছরে, তেমনি পালটে দিয়েছে মানুষে-মানুষে নিবিড় সৌহার্দ্যবন্ধন। এখন পারস্পরিক সম্পর্কে কৃত্রিমতা চলে এসেছে। ধনী-দরিদ্রের ভেদরেখা তৈরি হয়েছে, একদা যা কল্পনা-ও করা যেত না। একে আমি প্রগতি বলতে রাজি নই। প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে খবরের কাগজ চেয়ে এনে পড়া, অঙ্কে বা অন‍্যবিষয়ে দুর্বল ছেলেমেয়েকে পাঠদানবিষয়ে সাহায‍্য করা, সামাজিক মানুষ হিসেবে এটাই তো কাম‍্য। সেই কাম‍্যটাই এখন আর নেই। এমনকি রোজ স্কুলশেষে বইখাতা কোনওভাবে বাড়িতে রেখে দিয়েই মাঠে চলে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে খেলা, মারামারি আর আড্ডা, এসব এখন উধাও : ইঁদুর-দৌড়ের যুগ না এটা?

||ক্লাব, গ্রন্থাগার, কোচিং সেন্টার||

জীবনে কেবল দিনযাপনের গ্লানি নয়, দরকার আরও অধিক রসদ। পাড়ার বয়স্করা তাই অচিরেই ক্লাবের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। অঢেল জায়গা ছিল না। তবু তার মধ‍্যেই দশ বাই বারো পরিসরে গড়ে উঠল ক্লাব। নাম দেওয়া হল ‘মিলনমুক্তি’। কার নামকরণ, এটা আর জানার উপায় নেই এতদিন পর, তবে বয়স্কদের মুখে শুনেছি, ক্লাবের উদ্বোধনের দিন বর্ষীয়ান একজন ব‍্যাখ‍্যা করে বলেছিলেন, ‘যেখানে মিলন, সেখানেই প্রকৃত মুক্তি আমাদের। তাই এই নাম।’ নামটি অভিনব নিঃসন্দেহে, সে-আমলের বিচারে। আমাদের পাড়াতেই না কেবল, চারপাশের অন‍্যান‍্য কলোনিগুলিতেও তরুণ সংঘ, নবারুণ, নেতাজী জাতীয় সেবাদল, আজাদগড় ক্লাব, নেতাজী সংঘ, হিমাচল সংঘ, এসব নামের ক্লাব গড়ে উঠেছিল।

আমাদের ক্লাবে ফুটবল আর ভলিবল খেলা হত। হত হাডুডু। শীতকালে ক্লাবসংলগ্ন মাঠে হাই জাম্প লং জাম্প, দেশি নানারকম খেলার আসর বসত। ছিল ব‍্যাডমিন্টন। ইনডোর গেম বলতে ক‍্যারম। গোড়ায় তাসটাস ছিল না। পর্র একটু-আধটু।

যেদিন ড্রাম-ফ্লুট-তাসা ইত‍্যাদি এনে ব‍্যান্ডপার্টি তৈরি হল, আমাদের আনন্দ ধরে না! অচিরেই পাড়ার বেশ কয়েকজন সভ‍্য এসব বাজাতে রপ্ত হয়ে উঠল। আবার এ-ও আশ্চর্যের, তাদের সমবয়সীরা কেউ কেউ তা ধরেও দেখল না। আসলে স্বভাবত সুরবোধ না থাকলে বাদ‍্যযন্ত্র তার কাছে আবেদনহীন। বিশেষ বিশেষ দিনে, যেমন নেতাজির জন্মদিন, পনেরোই আগস্ট স্বাধীনতাদিবসের সময় ব‍্যান্ডপার্টি চমৎকার বাজনা বাজিয়ে মুগ্ধ করত দর্শক-শ্রোতাদের।

দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনে ব‍্যান্ডপার্টি যেত না, তবে মাঠে বসে দেবী দুর্গা ও তার সহচর-সহচরীদের বাজনা শুনিয়ে বিসর্জনের পথে রওনা করিয়ে দিত।

এইখানে দুর্গাপুজো নিয়ে আরও খানিকটা বলে নিই। পুজোর তিনমাস আগে থেকেই আজকের ভাষায় যাকে বলে কাউন্টডাউন, তা শুরু হয়ে যেত। বন্ধুবান্ধবদের মধ‍্যে আলোচনা, পুজো আসছে। নতুন ঘট কিনে আনতাম পয়সা জমানোর জন‍্য,— পুজোয় খরচ করতে হবে না! আমার এক বন্ধু আর আমি এক-ই ঘটে পয়সা জমাতাম। ঘটনাটা বন্ধুত্বের নিবিড়তা আর সে-সময়কার সরল মানুষের জীবনযাপনের দৈবী মাহাত্ম‍্যকে তুলে ধরে,— যে যতই ঘটে ফেলুক, সেই অর্থে আমাদের দুজনের সমানাধিকার!

এর ওর তার বাড়িতে পুজোর জামাকাপড় কেনা হচ্ছে। আমরা সবাই দেখে আসতে যাচ্ছি অভিভাবকদের সঙ্গে। কোনওবার পুজোয় উঠেছে নাইলনের শাড়ি, কোনওবার কাঞ্জিভরম, হাকোবা, সিনেমার নামে ‘সঙ্গম’, ‘মণিহার’। বাচ্চা মেয়েদের ফ্রক, পাক দিয়ে নাচলেই গোল বৃত্তাকার দেখায়, কী যে সুন্দর! নাম ‘হলিডে অন আইস’! সেসময় ওই নামের হলিউড-ফিল্মের নায়িকার পোশাক ছিল ওটা। কিশোরীরা মাথায় দিত ‘স‍্যরি ম‍্যাডাম’ নামীয় প্লাস্টিকের মোহন প্রসাধনী। সেটাও ওই-নামের সন্ধ‍্যা-বিশ্বজিৎ অভিনীত ছবিতে সন্ধ‍্যা রায়ের শিরোভূষণ ছিল বলে বাজারে আসে।

বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই যে অন‍্যের কেনা পোশাক দেখে আসা, এর মধ‍্য দিয়েই পুজো শুরু হয়ে যেত। তখন পাড়ায় কারও আর্থিক অবস্থা এমন ছিল না যে একটার বেশি জামাপ‍্যান্ট পেত কেউ, বা বউ-ঝিরা একাধিক শাড়ি। কিন্তু আনন্দের পরিমাণ তাতে সমুদ্রপ্রতিম হতে বাধা ছিল না। অনেককে আবার নিকট-আত্মীয়কে জামাকাপড় দিতে হত, তাদের কিনে পরবার আর্থিক সামর্থ‍্য ছিল না বলে। একবার পুজোর আগে আমার এক মাসতুতো দিদি আমাদের বাড়িতে এসে কিছুদিন রইলেন। যাবার সময় তিনি একটা জামা কিনে দিলেন আমাকে। সেই প্রথম পুজোয় দুটো জামা হল আমার। অবিস্মরণীয় স্মৃতি যা আজ।

‘পুজোয় চাই নতুন জুতো’— বাটা কোম্পানি দৈনিক পত্রিকায় এক পৃষ্ঠাব‍্যাপী বিজ্ঞাপন দিত, তাদের প্রকাশিত ছেলেবুড়ো পুরুষ-মহিলাদের জুতো আর স‍্যান্ডেলের ছবি-সহ। দেখে পছন্দসই জুতো কিনে দেবার আবদার করতাম মায়ের কাছে। আবদার মঞ্জুর। কিন্তু নতুন জুতো পরে প্রথমদিন প্রতিমা দেখতে গিয়েই আমার আর আমার মতো বোকা নতুন জুতো-পরিয়েদের নাজেহাল অবস্থা! ফোস্কা! অতএব বাকি ক’দিন লেঙচে লেঙচে ঠাকুর দেখে বেড়ানো।

তখন আমাদের প্রতিমাদর্শনের পরিধি কালীঘাটের ‘সঙ্ঘশ্রী’ পর্যন্ত। ওখানকার প্রতিমার ছবি বিক্রি হত, অন‍্য কোনও প্রতিমার হত না। অতএব কেনা চাই।

আর-একটা জিনিস দেখে অবাক লাগত। আমরা জানতাম, আমরা শহরের লোক। কিন্তু যখন কালীঘাটের আশেপাশে দেখতাম তেইশ পল্লী বা ছত্রিশ পল্লীর পুজো, অবাক হতাম। আসলে ওই জায়গাগুলো অতীতে গ্রাম ছিল, তার-ই প্রমাণ ওরকম নামকরণে। এখনও তেইশ পল্লীর পুজো ওই নামেই বিজ্ঞাপিত।

পুজো দেখতে বেরিয়ে পেটপুজো করব না? আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল পুজোয় আমাদের বাজারে কালুদার যে চা-ঘুগনি-আলুর দম-ওমলেটের দোকান, সেখানে গিয়ে ডবল ডিমের ওমলেট, কোন্ অজ্ঞাত কারণে তাকে মামলেট বলতাম জানি না— খাব। তখন মুরগির ডিম প্রায় অজ্ঞাত। হংসডিম্ব। পেল্লায় সাইজের হত, আমাদের বয়সের বিচারে। আরও বড় হয়ে যখন উচ্চাকাঙ্ক্ষা আকাশস্পর্শী, তখন ধ‍্যান ছিল মোগলাই পরোটা খাওয়ার। ব‍্যস, উচ্চাকাঙ্ক্ষার সীমা শেষ। শীতকালে ফুলকপির সিঙারা আর নলেনগুড়ের সন্দেশ, গরমে বড়া আর চিঙড়িমাছ দিয়ে পান্তাভাত, মাঝেমধ‍্যে বাড়িতে লুচি বা পরোটা, এর বেশি আয়োজন ছিল না জীবনে। শীতে পিঠে ছিল এন্তার, তৎসহ পায়েস। আর দুর্গাপুজোয়? বাড়িতে? অষ্টমী আর দশমীতে খাসি আর পোলাও মাস্ট। অন‍্যদিন মাছ। পিঠে। পায়েস।

বাড়ির সবাই তো খেতাম-ই, আইসো জন বইসো জনরাও তার ভাগ পেত।

তখন অঞ্জলি দেবার অত ঘটা ছিল না। অষ্টমীর দিন পুজোমণ্ডপে সামান‍্যসংখ‍্যক মহিলা অঞ্জলি দিতেন। পুরুষদের দিতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। তবে দশমীর বিকেলে এয়োস্ত্রীরা অবধারিতভাবে প্রতিমাকে বিদায় জানাতে প্রতিমার কপালে সিঁদুর পরাতেন, পানপাতা দিয়ে বড় আদরে দেবী দুর্গার মুখ মুছিয়ে দিতেন। মুখে ধরতেন নাড়ু ও অন‍্য মিষ্টি। সে বড় মরমী দৃশ‍্য, চোখে জল এসে যেত। আর তারপর মহিলারা একে অপরকে সিঁদুরে রঞ্জিত করতেন সিঁথি ও কপাল। একে বলা হয় সিঁদুরখেলা।

ছোটরা, ছাত্রছাত্রী যারা, সরস্বতীর পায়ে বই ঠেকাত। এইবার প্রতিমা বিসর্জনের জন‍্য প্রস্তুত। একসময় একাধিক কলোনির পুজো একজায়গায় হত, কেন না আলাদা করে পুজোর সামর্থ‍্য ছিল না। পরে সামর্থ‍্য হলে আলাদা পুজো শুরু হয়।

দুর্গাবিসর্জনের পর বিসর্জনকারীরা ও পাড়ার সব নারীপুরুষ, পুরুষরাই বেশি, পুজোমণ্ডপে সমবেত হত শান্তিজল নেবার জন‍্য। ‘প্রশস্তিবন্দনা’ বলা হত অনুষ্ঠানটিকে। পুরোহিত মন্ত্র পড়ে শান্তিজল ছেটানোর পরে পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন, মিষ্টিমুখ। পুজোকর্তৃপক্ষ-ই মিষ্টিমুখ করাতেন সমবেত সবাইকে। অতঃপর ম্লানমুখে সকলের গৃহে ফিরে আসবার পালা।

বারোয়ারি পুজোর এইসব দিনগুলোতেই সবচেয়ে বেশি কাতরতা দেখা যেত কলোনিবাসীদের মধ‍্যে। প্রত্যেকের মনে হাহাকার ফেলে আসা জন্মভিটের জন‍্য। কত স্মৃতি সেখানকার পুজোর! বহু মানুষ চাকরি, ব‍্যবসা বা পড়াশুনোর জন‍্য প্রবাসে থাকতেন। পুজোতে বাড়ি ফেরা, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব পাড়াপ্রতিবেশীদের সঙ্গে মধুর দিনযাপন যে চিরতরে বন্ধ তাদের! বৎসরান্তে দেশে যাওয়া নেই আর, বাড়ির লোকের নেই তাদের জন‍্য উৎকণ্ঠিত অপেক্ষা।

||মায়ের মুখে মামাবাড়ির দুর্গা||

পুজো নিয়ে কত যে বর্ণনা শুনেছি! মামাবাড়িতে পাঠশালা, নাট‍্যশালা, চণ্ডীমণ্ডপ ছিল। পুজোর আগে থেকে মেয়ে-জামাইরা ছেলেমেয়ে নিয়ে এসে জড় হতেন। বয়স্ক পুরুষেরা অভিনয় করতেন। আমার বাবা অত‍্যন্ত রূপবান বিধায় নারীচরিত্রে অভিনয় ছিল অবধারিত। এই নিয়ে একবার এক মজার কাণ্ড। সেবার সুলতানা রিজিয়ার চরিত্রে বাবা। বাবার রূপ ও সাজসজ্জায় বিমোহিত দর্শকের অনেকের-ই বিভ্রম ঘটে,— এ বুঝি সত‍্যি-ই অভিনেত্রী। একজনের মনোবাসনা জানা গিয়েছিল, রিজিয়াকে অপহরণ করবে সে! কীভাবে প্রতিনিবৃত্ত হল সে, ইতিহাস সে-বাবদে নীরব!

মামাবাড়িতে শতশত লোকের পাত পড়ত পুজোয়। প্রতিমা তৈরি হত চণ্ডীমণ্ডপে,— একমেটে, দোমেটে। প্রতিমায় রং করা। গর্জন আনা। রাত জেগে মা, মাসিরা ব‍্যস্ত থাকত নাড়ু-মুড়ি-চিড়ে-খইয়ের মোয়া তৈরিতে। সেইসব দিন, বনাম সাড়ে তিন কাঠা জমির বাড়িতে পুজোয় অন‍্যের মণ্ডপে অঞ্জলি দিতে যাওয়া,— কী যে বৈপরীত্য! কেউ কেউ দেশের বাড়ির ঐতিহ্য বজায় রেখে স্বল্প আয়োজনে বাড়িতেই দুর্গাপুজোর আয়োজন করতেন। এখনও সেই ধারা বজায় রেখে দিয়েছেন, দেশ ছেড়ে আসার এতদিন পর। পুরুষানুক্রমে।

এই করে তো দশমী কাটল। পরদিন ঘুম থেকে উঠেই আমাদের মতো কিশোরদের পবিত্র কর্তব্য ছিল প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গুরুজনদের প্রণাম করে আসা। পরিবর্তে তাদের বাড়ি থেকে মিষ্টিপ্রাপ্তি। মিষ্টি আর কিছুই না,— বাতাসা, নকুলদানা, কদমা, আর কপালে থাকলে কোনও কোনও বাড়ি থেকে নাড়ু (বাঙালরা বলত, লাড়ু)। আর-একটা ব‍্যাপার। আমরা যারা ব্রাহ্মণ, নিম্নবর্ণের কারও বাড়ি গেলে (কায়স্থ, নমঃশূদ্র ইত‍্যাদি) গুরুজনদের প্রণাম করা নিষেধ ছিল। জাতপাতের কড়া অনুশাসন বাঙালদের বৈশিষ্ট‍্য, যা ঘটিদের মধ‍্যে অত প্রবল ছিল না। ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণে বিয়ে তুমুল সমালোচনার বিষয় ছিল। নিয়মটা শিথিল হয়েছে এখন, তবে পুরোপুরি যায়নি, যাওয়া কাম‍্য ছিল। জাতপাতের অনুশাসনে কত গান্ধর্বসম্পর্ককেই না বিধুর পরিসমাপ্ত হতে দেখেছি!

বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিষ্টি পাচ্ছি। তো এত কদমা নাড়ু কি খাওয়া যায়? ঠোঙা নিয়ে যেতাম, তাইতে চালান করে দিয়ে বাড়ি ফিরতাম। দৈবানুগ্রহে যদি কারও বাড়ি থেকে একটি রসগোল্লা বা নিদেন লাড্ডু লাভ হত, দিনটিকে ও মিষ্টিদাতাকে মনে মনে অভিনন্দন জানাতাম। বিজয়া করতে গিয়ে রসগোল্লাপ্রাপ্তি, মনে হত আকাশে আজ চারটে সূর্য উঠেছে কম করে! কী অল্পেই না পরিপূর্ণ আর কৃতকৃতার্থ ছিল জীবন!

দুর্গাবিসর্জনের পর থেকেই লক্ষ্মীপুজোর কালগণনা শুরু হয়ে যেত। বিসর্জনের চার কি পাঁচদিনের মাথায় যে পূর্ণিমা আসত, সে-দিনটিতেই হত লক্ষ্মীপুজো। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো বলা হয় তাকে। ওই-রাতে লক্ষ্মী আকাশপরিক্রমা করেন আর দেখেন, কো জাগরী,— কে জেগে আছ? সারারাত ধরে নির্ঘুম থেকে লক্ষ্মীর উপাসনা করে যে ভক্ত, লক্ষ্মী তাকে ধনধান‍্যে সমৃদ্ধ করেন।

কোজাগরী পূর্ণিমায় বাঙালদের লক্ষ্মীপুজো প্রশস্ত, ঘটিদের কিন্তু নয়। তারা কালীপুজোর রাতে করে অলক্ষ্মীপুজো। অলক্ষ্মীকে দূরে হটানোর আরাধনা। একে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো-ও বলা হয়। হিন্দু বাঙালির মধ‍্যেই অঞ্চলভেদে কত নিয়মকানুনের ফারাক!

লক্ষ্মীপুজো বাঙালদের একটি না, বছরে তিনটি। আষাঢ় মাসের পূর্ণিমায়, আর পৌষ সংক্রান্তিতে। আমাদের বাড়িতে হত। তবে বাঙাল হলেও সব জেলার মানুষ বছরে তিনবার লক্ষ্মীপুজো করত না।

আরও একটি ব্রাহ্মণ‍্যবাদের নিদর্শন আছে লক্ষ্মীপুজোকে কেন্দ্র করে। ব্রাহ্মণবাড়ির লোকদের-ই অধিকার ছিল লক্ষ্মীকে আমিষ রান্না করে খাওয়ানোর। খিচুড়ি, পায়েস, ডাল তরকারি ইলিশ পরিবেশিত হত। মজার ব‍্যাপার, স্ত্রী দেবতাদের আমিষ খেতে দেওয়া হলেও পুরুষ দেবতা, যেমন শ্রীকৃষ্ণ বা শিবপুজোয় মাছটাছ চলবে না একেবারেই!

লক্ষ্মীপুজোয় ইলিশমাছ মাস্ট। তার পর থেকে পয়লা মাঘ পর্যন্ত বাঙালবাড়িতে ইলিশমাছ ঢোকা নিষেধ। এখন বাংলাদেশে বছরে দু-তিনবার ইলিশমাছ ধরার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা, এটা তার-ই অনুরূপ। নিয়মটা কোনও না কোনওভাবে আগেই চালু ছিল?

||পাঠাগার||

ওই যে ‘মিলনমুক্তি’ ক্লাবের কথা বলেছি, তারা পাঠাগার-ও তৈরি করেছিল। সরকারি কোনও সাহায‍্য পাওয়া যায়নি। প্রত‍্যেকে এজন‍্য কিছু অর্থসাহায‍্য করত, বই দান-ও করেছে অনেকে। আমাদের অঞ্চলে সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো পাঠাগার ছিল গান্ধী কলোনির ‘নেতাজী জাতীয় সেবাদল পাঠাগার’ ও নেতাজিনগরের ‘নেতাজী সংঘ’-এর পাঠাগার। তাছাড়া কিঞ্চিৎ পরে গড়ে ওঠা বাঁশদ্রোণীর ‘শক্তি সংঘ পাঠাগার’, পদ্মপুকুরের একটি লাইব্রেরি।

বছর তিরিশ আগে আমাদের পাড়ার পাঠাগারটিকেও বৃহদায়তন করে তোলা হয়েছে। কলোনিবাসীর বইপড়ার ইচ্ছে, অথচ কিনে পড়বার সামর্থ‍্যের অভাব যাদের (এমন মানুষের সংখ‍্যাই বেশি ছিল), লাইব্রেরি তাদের পাঠস্পৃহাকে সফল করেছিল। কত নতুন নতুন লেখকদের সঙ্গেই না পরিচয় এসময়, তাদের লেখা পাঠের মাধ‍্যমে!

তাছাড়া আরও একটি উদ‍্যোগ নেয় আমার দাদা ও তাদের সমবয়সীরা মিলে। কোচিং সেন্টার। ছাত্রছাত্রীদের সামর্থ‍্য ছিল না প্রাইভেট টিউটর রাখার। তাই দাদারা মিলে ব‍্যবস্থা করলেন ফ্রি কোচিং সেন্টারের, পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন‍্য। ক্লাস হত বুদ্ধদাদের বাড়ির লম্বা টানা বারান্দায়। কতজন-ই না উপকৃত হয়েছিল এর ফলে! তখনও বিদ‍্যুৎ আসেনি পাড়ায়। ছাত্রছাত্রীদের বলা হত হ‍্যারিকেন নিয়ে আসতে। পরস্পর সহযোগিতার মাধ‍্যমে হাস‍্যমুখে অদৃষ্টকে পরিহাস করার নাম-ই তো কলোনিজীবন। যদিও আশপাশের অনেকে আমাদের উড়ে এসে জুড়ে বসা বলে বিদ্রূপ করতেন। তবু এসব উপেক্ষা করে নেতাজিনগর স্কুল থেকে ম‍্যাট্রিকে পঞ্চম (কাঞ্চন ভট্টাচার্য), আর আমাদের স্কুল গান্ধী কলোনি মাধ‍্যমিক, এখন উচ্চমাধ‍্যমিক থেকে সপ্তম (চুনীলাল দত্ত) হতে পেরেছিলেন স্রেফ মেধা আর আপ্রাণ অনুশীলনের বশে। কলোনিবাসীর গর্ব এরা। হাজার প্রতিকূলতা ভেদ করে এখান থেকে ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, উকিল, অধ‍্যাপক ও আমলা বেরিয়েছেন, হয়েছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রছাত্রী ও খেলোয়াড়, সঙ্গীতশিল্পী। কেউ কেউ লেখক, গবেষক, সফল ব‍্যবসায়ী।

||কিশলয়||

এটি ছিল মাসিক দেওয়াল-পত্রিকা। ছোট ছেলেমেয়েদের লেখা ও চিত্রচর্চায় উৎসাহ দিতে প্রতিমাসে বেরোত। আর্টপেপারে হাতে লেখা, শোভনরূপে অলঙ্কৃত পত্রিকাটি আমাদের পাড়ার প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ের দেয়ালে টাঙানো থাকত কাঠের শো-কেসে। যাতায়াতকারীরা পড়ত। লেখকদের সামনে পেলে বাহবা দিত।

পরে বেরোয় মোটা বাঁধানো একটি পত্রিকা, অন‍্য নামে। শ’দুয়েক পৃষ্ঠা, বহুলোকের হাতে অলঙ্কৃত। নানারঙের কাগজে। বেশ জমকালো ব‍্যাপার ছিল সেটা। ওইখানেই আমার লেখা প্রথম প্রকাশিত হয়। লেখকদের মধ‍্যে সর্বকনিষ্ঠ। নামের নিচে বিজ্ঞাপিত ছিল— ‘বয়স বারো বছর।’ অর্থাৎ ১৯৬৩ সালের ঘটনা। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। ওটা ছিল ছোটগল্প। নাম ‘লোভী’। আমার লেখা ছাপার অক্ষরে বেরোয় তার ঠিক পরের বছর। স্কুল ম‍্যাগাজিন ‘কুড়ি’-তে। সেটি ছিল একটি নাটিকা।

সেসময়, ওই এগারো-বারো বছর বয়সেই, গল্পের পর গল্প লিখতাম, কবিতার পর কবিতা। সেসবের অনেকগুলোই রয়ে গেছে আমার কাছে। পড়ি, আর কিশোর আমাকে বাহবা দিই। অন‍্য কোনও কারণে নয়, ওই বয়সে কারুবাসনা- জাগা ছেলেটির পিঠ চাপড়ানো উচিত কি না? মনে আছে, ১৯৬২- তে ভারত-চীন যুদ্ধের সময় দেশপ্রেমিক আমি লিখেছিলাম একান্ত বরিশালের ডায়ালেক্টে, ‘হঠাৎ চৌ এন লাই-র কী হইলো ব‍্যাপার?/ গ্রীষ্মকালেতে থাকে গায়ে দিয়া র‍্যাপার!/ তা থাউক, কিন্তু ভাই ও কী কাম করো?—/ জাতিসাপের ল‍্যাজ দিয়া কান চুলকাইয়া মরো!’

মেজদা-ছোড়দা আর তার বন্ধুরা মিলে পত্রিকা বের করে এসময়,— ‘উৎস’। লেখক মূলত নিজেরাই, তবে মাঝে মাঝে বিখ‍্যাত লেখকদের লেখা-ও ছাপা হত। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গল্প বেরিয়েছিল একবার, ‘ফুল কেনার মজা’। ডাক্তার অনুতোষ দত্ত, চক্ষুবিশেষজ্ঞ, লিখেছিলেন ‘টেরিলিনের বিপদ’। সঙ্গীতবিদ ভি কে আর ভি রাও-এর প্রবন্ধ-ও ছিল একবার। ১৯৪৭-এ খালিহাতে আট ও সাড়ে ছ’বছর বয়সে মেজদা-ছোড়দার বাস্তুচ‍্যুত হয়ে কলকাতায় চলে আসা, আর ১৯৬০-৬১-তে পত্রিকাপ্রকাশ,— মেজদা বি এ, ছোড়দা প্রি ইউনিভার্সিটির ছাত্র, কিঞ্চিৎ কৃতিত্বের তো বটেই।

লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কেউ কেউ। তবে সময়টা যেহেতু ছিল সংগ্রামের, তাই লেখাপড়া শেষ করে যেনতেনপ্রকারেণ একটা চাকরি যোগাড় করাটাই মানুষের প্রাথমিক লক্ষ‍্য ছিল বলে লেখকজীবনকে বঞ্চিত রেখেছিলেন তারা। তবুও নাটক লিখেছেন দু-তিন জন, প্রবন্ধ, গল্প-ও। ছোটদের দিয়ে নাট‍্যাভিনয় করাতেন রমেশদা। ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। রমেশদার পরিচালনায় ‘ডাকঘর’ নাটকে আমার বরাতে জুটল ঠাকুরদা-চরিত্রে অভিনয়। চরিত্রটিকে বোঝার বয়স নয় তখন। তবু ফুটিয়ে তুলেছিলাম। সেই থেকে পাড়ায় বিখ‍্যাত হয়ে গেলাম ‘ঠাকুরদা’ নামে। ছোটবড়মাঝারি, সব বয়সীরাই ওইনামে ডাকত আমাকে, ডেকেছে দীর্ঘদিন।

নাম আরও একটা ছিল আমার,— আপেল। সে-নামের উৎস হল : তখন কারও বাড়িতে বাথরুমটুম পাকা করতে হলে (গোটা বাড়ি পাকা করার কথা কলোনিজীবনের প্রথম বিশ বছরে অকল্পনীয় ছিল) পাড়ার কচিকাঁচারা মাঠ থেকে ইট বয়ে নিয়ে এসে গৃহস্থবাড়ির উঠোনে এনে ফেলত। স্বেচ্ছাশ্রম। ‘সকলের তরে সকলে আমরা’, এই নীতিতে। তো একবার তাই করতে গিয়ে আমার গালদুটি লাল হয়ে উঠেছে। সাধনাদি, সে-বাড়ির মেয়ে, করুণাবশত আমার গাল তার শাড়ি দিয়ে মোছাতে মোছাতে তার দাদাকে বললেন, ‘গালটা একেবারে পাকা আপেলের মতো হয়ে উঠেছে!’ ব‍্যস, সেই থেকে আমি ‘আপেল’ নামে অভিহিত। বলা বাহুল‍্য, স্বেচ্ছাশ্রমের মজুরি-ও মিলত, সেদিন রাতে শ্রমদানকারীদের হালুয়া-লুচিতে আপ‍্যায়িত করা।

নামকরণের ব‍্যাপারে আরও কিছু লিখি। পাড়ার ছেলেপেলেরা মজা করে এক-একজনকে এক-একটি নাম দিত। সেই দেওয়ার মধ‍্যে কখনও কখনও রসবোধের পরিচয় ছিল। পাড়ার একটি ছেলে ক্ষিপ্রবেগে গাছে উঠতে পারত বলে তার নাম দেওয়া হল ‘মারুতি’,— কি না বানর! আর-একজন একের কথা আরকে লাগাত। তার নাম যে অচিরেই ‘নারদ’ হবে, তাতে আর সন্দেহ কী?

কোনও কোনও ছেলে, একটু বখাটে তারা, পিতৃনামে ডাকত ছেলেকে। আবার নাম বিকৃত করেও ডাকা হত। কারও বাবার নাম হয়তো শচীন, তার ছেলেকে শচীন নয়, ডাকা হত ‘শকুনি’ বলে। কিছু কিছু গালাগালিও আমরা এইপর্বে রপ্ত করি। তবে সমাজ যেহেতু ভব‍্যতার একটা অদৃশ‍্য বাঁধনে বাঁধা ছিল, তাই উচ্ছৃঙ্খলতা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়নি সেসময়। নারী-পুরুষ ঘটিত অসামাজিক কাজ খুব কম হতে দেখেছি। প্রেম? হ‍্যাঁ, অবশ‍্যই হত। তবে একে তো সীমিত আকারে, তায় পরিণতি পাওয়ার আগেই ট্র‍্যাজেডি নেমে আসত। প্রথমত বাড়ি থেকে মেয়েটির বিয়ে ঠিক হওয়ায়, কিংবা পরিবারের আপত্তিতে, অথবা— জীবনে কত অথবা-ই যে রয়েছে! আবার এর মধ‍্যেও দুঃসাহসী প্রেম, পালিয়ে বিয়ে করা, গান্ধর্বসঞ্জাত প্রাক-বৈবাহিক সন্তানধারণ, তা-ও হয়েছে। এখানে কলোনি-অকলোনির ভেদ নেই।

তবে বিয়ে বা অন‍্যান‍্য উৎসব-অনুষ্ঠানে, বা শ্রাদ্ধকাজে প্রতিবেশীদের সাহায‍্য-সাহচর্য ছিল আন্তরিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। দুঃসময়ে টাকা-পয়সা ধার দেওয়া, আপদে-বিপদে এগিয়ে আসা, এসব ছিল সাধারণ ঘটনা। আবার বাড়ির সীমানা নিয়ে ঝগড়া, বিবাদ, পরস্পরকে গালাগাল, এসব-ও হতে দেখেছি। পরিবারে একজনের রোজগার, তাতে ভাই-ভাইয়ের বউ পর্যন্ত প্রতিপালিত হয়েছে। পারিবারিক সম্পর্ক অর্থনীতিতে বহুদিন পর্যন্ত নাক গলাতে দেয়নি। ক্রমে এই ব‍্যবস্থা ভেঙে পড়তে থাকে। সাতের দশক থেকে। পরিবার পৃথগন্ন হলে সেটা ছিল পরিবারটির পক্ষে নিতান্ত লজ্জার। বহুদিন পর্যন্ত পাড়াপ্রতিবেশীর কাছে মুখ দেখানো দুষ্কর হত। পরে মূল‍্যবোধের অবক্ষয় জিনিসটিকে সহজ করে দেয়।

মনে আছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে যে এককোটির মতো মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়, তাদের মধ‍্যে কারও কারও আত্মীয়ের বাড়ি আমাদের পাড়ায় থাকায় সে-সব বাড়িতে এসে যারা উঠেছিলেন, তাদের আশ্রয় দিতে কুণ্ঠিত হননি আত্মীয়েরা। হয়তো স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব ছিল, কিন্তু একসঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন বিধিলিপি।

যৌথ পরিবারের আদর্শটা কাজ করত সবার মনেই। আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে গেল তা। এক ঘরে তিন-চারটি হাঁড়ি, ভাইয়ে-ভাইয়ে মুখ দেখাদেখি বন্ধ, জায়ে-জায়ে নিয়ত ঝগড়া, ঈর্ষা, মাৎষর্য এসে স্থান নিল পারস্পরিক যূথবদ্ধ জীবনের, যার মধ‍্যে ছিল অনাবিল আনন্দ ও সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার রসদ।

মনে পড়ছে একটি ঘটনা। পরিবারে এক ভাইয়ের ওপেন হার্ট সার্জারি হবে। টাকার দরকার, দরকার রক্ত, রোগীকে নিয়ে ভেলোরে যাওয়া। মুহূর্তে বাড়িতে রণসজ্জা। ভাইয়েরা তো বটেই, টাকা-পয়সা দিতে এগিয়ে এলেন নিকট ও দূরের আত্মীয়স্বজন। ভাইয়েরা চাকরি ফেলে ছুটলেন ভেলোর। রক্ত দিলেন, সুস্থ করে আনলেন সহোদরকে। এর মধ‍্যে আবার এক ভাই কালীকে মানত করেছিলেন, ভাই বেঁচে উঠলে সোনার চোখ গড়ে কালীপুজো করবেন প্রতি বছর। জোড়া বলি দেবেন। করে আসছিলেন-ও। এর মধ‍্যেই পৃথগন্ন হতে হল তাদের। মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। তবু সেই বড়ভাই মানতরক্ষা করে চলেছিলেন। কালীর প্রসাদ গ্রহণ করতেন না সেই ভাই, যার জীবনরক্ষার্থে এই মানত! জীবন উপন‍্যাসের চেয়েও আশ্চর্যের!

‘আবাদ করে, বিবাদ করে, সুবাদ করে তারা’, পড়েছিলাম যতীন্দ্রমোহন বাগচীর একটি কবিতায়। বিবাদ তাই কলোনিজীবনেও দেখা যেত না তা নয়। শ‍্যালক-ভগ্নীপতি বছরের পর বছর তুচ্ছ কারণে মামলা লড়ছেন, শঠ উকিল অন‍্যকে ঠকিয়ে জমি বেদখল করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন, মাকে খেতে দিচ্ছে না ছেলে, স্ত্রীর সঙ্গে দুর্ব‍্যবহার স্বামীর, এসব-ও ছিল। ছিল বউয়ের পাল্লায় পড়ে মাতৃসম পিসিমাকে কাশীতে পাঠানো, অন্ধ কাকিমাকে ভিখারিণীর মতো দেখা, ভাইয়ের সম্পত্তি বিক্রি করে তাকে পথে বসিয়ে গাড়ি-বাড়ি হাঁকানো। মুদ্রার এক পিঠ এটা।

অন‍্যপিঠে দেখেছি প্রায় নিরন্ন হয়েও একাধিক আত্মীয়ের ভরণপোষণ, নিজে কষ্ট করে ভাইদের সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে রাখা, পরিবারের কথা ভেবে বিয়ে না করে নিজের রোজগারে সংসার প্রতিপালন, (ছেলে ও মেয়ে, উভয়কে দেখেছি), গয়না বিক্রি করে ছেলেকে মা ব‍্যবসা করে দিচ্ছেন, ভাইকে রাত জেগে পড়ানো, আরও কত মানবিক চিত্র! কাঁচাঘর পাকা হচ্ছে কী কঠোর চেষ্টায়! একবার এক বাড়িতে বিদ‍্যুৎ আনা হবে। পরিবারের সবাই আলোচনায় বসলেন। অভিভাবকের ঘোষণা, বিদ‍্যুৎ আনতে গেলে এবছর পুজোয় জামাকাপড় হবে না কারও, রাজি? একটু ইতস্তত করে সবাই বাধ‍্য হল রাজি হতে, বাড়িতে ইলেকট্রিসিটির শুভাগমন ঘটবে, তার স্বার্থে। মনে আছে, তিন-চার ভাইবোনের সংসার। সবাই যে সমান পুষ্টিকর আহার্য পাবে, তেমন আর্থিক অবস্থা ছিল না বলে যে সেবছর মাধ‍্যমিক দেবে, কেবল তার জন‍্যই বরাদ্দ হল রোজ হাফ বয়েল ডিম আর দুধ। দুধটা অবিশ‍্যি একটা সময় পর্যন্ত বিনে পয়সায় কলোনিবাসীরা পেত কলম্বো প‍্যাক্ট অনুযায়ী। অস্ট্রেলিয়া থেকে ড্রামে করে উৎকৃষ্ট গুঁড়ো দুধ আসত। বহুদিন খেয়েছি। জলে গুলে পরিবেশিত হত। ছাত্র-প্রতি আড়াইশো (তখনকার হিসেবে এক পোয়া)। আমরা পেতাম তিন পোয়া।

||বড় হওয়া||

কলোনিজীবনে শৈশব কেটেছে, কৈশোর, তারপর যৌবন-ও। আমার পরিবর্তন যেমন, কলোনির পরিবর্তনটাও দেখছিলাম, দিনে দিনে কেমন পাল্টচ্ছে মানুষ, তার পরিবেশ, হালচাল, আদবকায়দা, সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, জীবনধারা।

খড়ম পরতাম আমরা। আবালবৃদ্ধবনিতা। কাঠের এই পাদুকা এখন একেবারেই দেখা যায় না। চলার সময় যে খটাস খটাস আওয়াজ হত, মজা পেতাম তাতে। স্কুলে কোনও ইউনিফর্ম ছিল না। আমাদের হেডমাস্টারের যুক্তি ছিল, সবাই তা পরতে পারবে না। সেজন‍্যই। চটি বা বুটজুতো থাকলেও স্কুলে যেতে ওসব আবশ‍্যিক বলে বিবেচিত হত না। পরলাম পরলাম, না পরলাম তা-ই সই। লেখার জন‍্য দোয়াত ডুবিয়ে নিবের কলম। পরে ঝর্নাকলমে উঠি। রাফ খাতা ছিল, তামাটে রঙের। পেনসিল দিয়ে অঙ্ক অভ‍্যেস করতাম ওতে। সাদা খাতায় ফাইনাল অঙ্ক কষা। কাগজ কিনে এনে সেলাই করে ব‍্যবহার করাটাই ছিল দস্তুর। তবে কখনও কখনও উট-আঁকা খাতা কিনেও লিখেছি। বাঁধানো খাতা ব‍্যবহার করেছি খুব কম। মনে পড়ছে না স্কুলজীবনে কেউ করতাম বলে।

খাতা ছিল চার ধরনের। রুল টানা, সাদা (অঙ্ক করার), চারটে করে লাইনের, যা ইংরেজি হাতের লেখা প্র‍্যাকটিসের জন‍্য লাগত, আর তুলনায় বড় ড্রয়িং-এর একটু মোটা সাদা খাতা। নোটবই না কিনলে টেক্সট বই বিক্রি করত না বইয়ের দোকানি। টেক্সট বই আট আনা তো নোটবই চার টাকা। বই কিনলে মলাট ফ্রি। এখন তা ভাবাটাও পাপ। স্কুলের মাইনে পাঁচ থেকে ছ-টাকা। আমাদের আগে যারা পড়ত, উদ্বাস্তু বলে মাইনে তো লাগতই না, উপরন্তু মাসে মাসে পাঁচটাকা করে স্টাইপেন্ড পেত। আমার মেজদা ও ছোড়দা পেয়েছে। ১৯৬১ থেকে স্টাইপেন্ড উঠে যায় বলে আমি আর পাইনি। সেসময় আমি ফাইভের। তবে প্রাইমারি, অর্থাৎ ফোর পর্যন্ত অবৈতনিক ছিল সব স্কুল। স্কুলে লাইব্রেরি থাকলেও বই কী কারণে যেন ইস‍্যু হত না। জীবনে একবারই বই এনে পড়েছিলাম স্কুল থেকে। আর আশা করতাম, ফের হয়তো বই দেওয়া শুরু হবে। যে সাতবছর স্কুলটিতে পড়েছি, গান্ধী কলোনী উচ্চমাধ‍্যমিক বিদ‍্যালয়, আশা আর পূরণ হয়নি। আমার পরবর্তী প্রজন্মের-ও না। জানি না, তারা আদৌ আশা করেছিল কিনা।

তখনকার সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থায় খুব কম ছেলেমেয়ের-ই প্রাইভেট টিউটর ছিল। তাছাড়া প্রত‍্যেক শিক্ষক এত যত্ন করে পড়াতেন, প্রাইভেট টিচারের প্রয়োজন-ই হত না। তবে মেধাহীন কিছু ছেলেমেয়ে তো থাকতই সব যুগে। চিন্তিত অভিভাবকেরা তাদের জন‍্য রাখতেন। আর রাখতেন কোনও ছাত্রের কোনও কারণে কোনও বিষয়ে, বিশেষ করে ইংরেজি আর অঙ্কে দুর্বলতা থাকলে। সবলতা থাকলেও রাখতেন। আমার বাবা মেজদার জন‍্য ম‍্যাট্রিকের আগে ইংরেজির শিক্ষক রেখেছিলেন, মেজদার তুখোড় ইংরেজি-জ্ঞানকে আরও প্রখর করতে। সুফল ফলেছিল।

পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাইভেট টিউটর রাখার চল বাড়তে থাকে। এসময় কোচিংপ্রথার-ও সূত্রপাত। শিক্ষকরা এমনকি পঞ্চাশ-ষাটজনকে নিয়ে পড়াতেন। এতে ব‍্যবসায়িক দিক ছাড়া অন‍্য কোনও উদ্দেশ‍্য সফল হত বলে মনে হয় না। আমি কখনও নিজের থেকেই এসব জায়গায় পড়ার উৎসাহ বোধ করিনি। তবে ক্লাস টেনে উঠে একজনকে অনুরোধ করেছিলাম, আমাকে প্রাইভেটে ইংরেজি পড়াতে। তিনি ঘোর বিদ্বেষী এতে। আমার আগ্রহাতিশয‍্যে রাজি হয়েছিলেন। আমার দেখাদেখি আমার আরও দুজন বন্ধু নাছোড়বান্দা হয়ে তাঁকে ধরায় তাদের-ও পড়াতে রাজি হন। এই আদর্শনিষ্ঠ শিক্ষক পরে কখনও আর কাউকে প্রাইভেট পড়াননি। আড়াইশো টাকার বেতন, স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে। বাড়িভাড়া দিতে হত। তবু এই আদর্শ, এই কৃচ্ছ্রসাধন! মাথা নত হয়ে এল তাঁর কথা লিখতে গিয়ে। তাঁর নাম ছিল বিজয় পাল। মেয়ে ডাক্তার হয়েছিল।

এগারো ক্লাসে উঠতে আমি কাকার কাছে ইংরেজি পড়তাম, উনি ছিলেন একটি স্কুলের হেডমাস্টার। ইংরেজিতে ওস্তাদ। ইংরেজি ব‍্যাকরণ বই ছিল তাঁর। একা-ই পড়তাম। পাগলা ডাকতেন বাবা, বাবার পিঠোপিঠি। মামাতো ভাই। নাম প্রিয়লাল চট্টোপাধ্যায়।

তারপর এল র‍্যাট রেস। বাংলা-মাধ‍্যম স্কুলগুলো ছাত্র-ছাত্রীর অভাবে ধুঁকতে শুরু করল। আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হল ইংরেজি-মাধ‍্যম ছাড়া গতি নেই ভবিষ্যৎ-প্রজন্মের। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ব‍্যয় হতে লাগল। স্কুলের বিপুল মাইনে, বিপুলতর টাকা দিয়ে প্রত‍্যেক বিষয়ে প্রাইভেট টিউটর। সুফল কি আদৌ ফলছে? প্রবল এক ব‍্যবসার মধ‍্যে নতজানু আজকের অভিভাবককুল। এটা মোটামুটিভাবে বিশ শতকের আটের দশক থেকে শুরু হয়েছে। খেলাধুলো বন্ধ হয়ে গেছে ছাত্রছাত্রীদের, স্বাভাবিক মেলামেশা বন্ধ, আত্মীয়-সমাগম বন্ধ। এক কৃত্রিম জীবনে অভ‍্যস্ত করা হচ্ছে নতুন প্রজন্মকে। হাতে মোবাইল-আয়ুধ, যার ক্ষতিকরতা সীমাহীন। এসব অবিশ‍্যি অন‍্য প্রসঙ্গ।

শিক্ষাব‍্যবস্থা পুঁজিবাদের করাল গ্রাসে পড়লেও বাংলা-মাধ‍্যম স্কুলগুলো আজ-ও ধুঁকতে-ধুঁকতে টিঁকে আছে। তবে মৌলিক পরিবর্তন যেটা, তা হল, ইংরেজি বা বাংলা-মাধ‍্যম স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা শতকরা একশোভাগ প্রাইভেট টিউশনি-নির্ভর হয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে লোপ পেয়েছে শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা। তাঁরা স্বভাবতই ক্লাসে পাঠদানে কুণ্ঠিত ও অনীহ। পুরো শিক্ষা-ব‍্যবস্থাটা এখন অর্থনির্ভর। শিক্ষার বড় দুঃসময় এখন। এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট না পড়ে উপায় নেই। এটা কলোনিবাসীর-ই সমস‍্যা তা নয়, সমস‍্যাটি সার্বিক।

কলোনিজীবনে পরিবর্তন আসতে থাকে আটের দশক থেকে। ততদিনে কলোনিবাসী তাদের দেশত‍্যাগের বেদনা, নতুন স্থানে নতুন পরিবেশে এসে নিজেদের মানিয়ে নিতে পেরেছে। নতুন প্রজন্ম লেখাপড়া করে চাকরিবাকরিতে যোগ দিয়েছে। ব‍্যবসাতেও কেউ কেউ নিবিষ্ট, উৎসাহী ও কৃতী। কাঁচা ঘরদোর পাকা হচ্ছে একটু একটু করে। ঘরে ঘরে ইলেকট্রিসিটি (ছয়ের দশকের শেষ থেকে এর সূত্রপাত। তার আগে ছিল কেরোসিনের যুগ।), ফ‍্যান, টিউব লাইট। তখন বাল্ব ও টিউব লাইট দিয়ে কোনও একটি পরিবারের অর্থশক্তি পরিমাপ করা যেত। ফ্রিজ আসতে শুরু করেছে কোনও কোনও বাড়িতে, তবে এয়ার কন্ডিশনার আসা শুরু হয়নি। আট ও নয়ের দশকে প্রাইভেট কার ছিল মাত্র দুটি পরিবারের। রান্নার জন‍্য ছিল কাঠ, কয়লা, ঘুঁটে, কয়লার গুঁড়ো আর গোবর ও মাটি-সহযোগে গৃহিনীদের হাতে তৈরি গুল, পরে মেশিনে তৈরি হত যা। ছিল কেরোসিন-স্টোভ, বাচ্চাদের দুধ ইত‍্যাদি গরম করার জন‍্য স্পিরিট স্টোভ। বিজলি ছিল না। বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো বা এরকম উৎসবানুষ্ঠানে ঘর অলোকিত করত হ‍্যাজাক। পাড়ায় যাত্রা হত হ‍্যাজাক জ্বালিয়ে। মাঝেমাঝেই সেটাকে ওপর থেকে নামিয়ে এনে দম দিয়ে চালু রাখতে হত। দম দিতেন হয়তো কোনও অভিনেতা-ই। দর্শকদের বাড়তি মজা। হ‍্যাজাক ছাড়াও গ‍্যাসের বাতি ছিল অনুষ্ঠানগৃহ আলোকিত করার জন‍্য। খড়মকে হটিয়ে অবির্ভূত হল হাওয়াই চপ্পল। কাপড়চোপড় কাচার জন‍্য ছিল গোলাকার সাবান, আমরা বলতাম বার সোপ। ছয়ের দশকে ডিটারজেন্ট সাবান এল। এল শ‍্যাম্পু। টুথ পাউডারের একচেটিয়া রাজত্ব ঘুচল টুথপেস্ট এসে। সিগারেটপ্রেমীদের জন‍্য ফিল্টার টিপড। ছিল পাউরুটি, এলো স্লাইসড রুটি।

এ-প্রসঙ্গে একটি কথা। ছোটবেলায় নানান স্বাদের বিস্কুট খেতাম, স্থানীয় কারিগরদের তৈরি। তারা ছিলেন মুসলমান। বিস্কুটের কারখানায় কাজ করতেন। ১৯৬৪-তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের অনেকেই অঞ্চল ছেড়ে চলে যান; কেউ কেউ পাকিস্তানে। ফলে অমন স্বাদের বিস্কুট তৈরি বন্ধ-ই হয়ে গেল। চিরতরে।

গৃহিণীদের আটপৌরে শাড়ি বিক্রেতারা ফেরি করতে বেরত। মনে আছে, ছ’টাকা-সাড়ে ছ’টাকা ছিল সেসব শাড়ির দাম। আর ব্লাউজের কাপড় একটাকা ছ’আনা মিটার। জিনিসপত্রের দাম, ছয়ের দশকে যা ছিল, তাতে আমরা কল্পলোকে বাস করতাম বলেই মনে হয় এখন। ইলিশ দু-আড়াই টাকা সের (কেজির চেয়ে সামান‍্য কম), পাঁঠার মাংস-ও তাই। সরষের তেল দুটাকা, চিনিও তদনুরূপ। উৎকৃষ্ট চালের মণ (এখনকার সাড়ে সাঁইত্রিশ কেজি) ছিল ষোল টাকা। এক টাকায় সোয়া লিটার দুধ। খবরের কাগজ দশ পয়সা। কলার ডজন চার আনা। হাঁসের ডিম টাকায় আটটি। রসগোল্লাও তাই। দু-পয়সায় (এখনকার তিন পয়সা) এক ঠোঙা মুড়ি, ওপরে ছড়ানো চানাচুর আর সর্ষের তেল মিলত। সিনেমার টিকিট সাঁইত্রিশ পয়সা দিয়ে শুরু, আর তিনটাকাতে শেষ। মুর্গির মাংস মিলত না সহসা।

একটি স্মৃতি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমি। ১৯৬৭/৬৮। যাদবপুরে গাঙ্গুরামের মিষ্টির দোকান ছিল একটা। এখনও আছে। সেখানকার বিখ‍্যাত দইয়ের কেজি ছিল পাঁচটাকা চল্লিশ পয়সা। একশোগ্রাম দই খেয়ে পঞ্চান্ন পয়সা দিলে এক পয়সা ফেরত পাওয়া যেত, ভাবা যায়! ইউনিভার্সিটিতে রাখালদার ক‍্যান্টিনে ঢাউস সাইজের প্লেটে যে ভর্তি সর পাওয়া যেত, দুশো গ্রামের বেশি ওজন, পঁচাত্তর পয়সায় খেতাম। তিন-চার টাকায় পেঙ্গুইনের ক্লাসিক্স, চার-পাঁচ টাকায় পূজাবার্ষিকী, সাড়ে পাঁচ আনায় (এখনকার পঁয়ত্রিশ পয়সা) কালীঘাটের মন্দিরে প‍্যাঁড়া-নিবেদন করে বাড়ি নিয়ে আসা, বাস-ট্রামের ন‍্যূনতম ভাড়া দশ পয়সা, এসব দেখেছি।

সস্তা সস্তা করছি বটে, তবে অন‍্য অনেক কিছুর মতো দাম বস্তুটাও আপাত। দু-আড়াই টাকার ইলিশ কিনে খাওয়ার সামর্থ‍্য কি তখন ছিল সবার? সাতষট্টিতে নকশালদের দেওয়াললিখন পুলিশদের প্রতি, ‘পুলিশ তুমি যতোই মারো, মাইনে তোমার একশো বারো’। এখন ভাবি, আমাদের পাড়াতে যে চার-পাঁচজন পুলিশে চাকরি করতেন সেসময়, ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে, মেয়ের বিয়ের জন‍্য টাকা জমিয়ে ইলিশ কিনতে পারতেন বছরে ক’দিন? বা তাদের চেয়েও খারাপ অবস্থা যাদের,— ঘরামি (দু-তিন টাকা দৈনিক মজুরি, তা-ও মাসে বিশ-বাইশদিন কাজ জুটত মেরেকেটে), বা নাপিত, মিস্ত্রি, তারা তো রেশনের চাল (তিরিশ পয়সা কেজি) ছাড়া ভাল চাল জোটাতে পারেনি! তখন সোনার ভরি (দশ গ্রামের একটু বেশি) ছিল নব্বই-একশো-একশো বিশ। ক’জন পারত কিনতে? আমাদের হেডমাস্টারমশাই একবার ক্লাসে বলেছিলেন, ১৯৬৫/৬৬ হবে, যে জনপ্রতি একশো টাকা আয় না হলে ভদ্রভাবে জীবনযাপন সম্ভব নয়। সেই বিচারে সংখ‍্যাগরিষ্ঠের জীবন-ই ছিল অসচ্ছল।

||রবীন্দ্রনাথ : কিছু অবিনশ্বর স্মৃতি||

আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথ আশৈশব লগ্ন। ১৯৬১-তে তাঁর জন্মশতবর্ষে সারা ভারতে ও বিশ্বে যেমন, তেমনই আমাদের কলোনিজীবনের ক্ষুদ্র বিন্দুতেও তাঁকে আপন করে পাওয়ার শুভলগ্ন এসেছিল। এমনিতে বছরভর আমরা নেতাজির জন্মজয়ন্তী পালন করতাম, পালিত হত পয়লা বৈশাখ আর স্বাধীনতা দিবস, পরে নজরুল জয়ন্তীও। কিন্তু রবীন্দ্রশতবর্ষ বেশ সাড়ম্বরেই এল। এই উপলক্ষ্যে আমার জ‍্যেষ্ঠ ভ্রাতা বাড়িতে রেডিও কিনে আনলেন। উদ্দেশ‍্য, বছরভর রবীন্দ্রনাথের গান ও তাঁর নাটক, তাঁকে নিয়ে কথিকা ইত‍্যাদি বাড়ির সবাই মিলে শোনা। সেইসূত্রেই দশ বছরের আমি সুচিত্রা মিত্র, কণিকা-হেমন্ত-দেবব্রত-রাজেশ্বরী-শান্তিদেব-সুমিত্রা সেনের রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত হই। শুনি ‘ডাকঘর’, ‘রক্তকরবী’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘শ‍্যামা’, রবীন্দ্র-কবিতার আবৃত্তি। পাড়ার নাট‍্যপ্রিয় যুবকেরা মহড়া দিল ‘রক্তকরবী’-র, কিন্তু কী কারণে শেষপর্যন্ত হয়নি সে-নাটক। তবে আরও বয়স্ক একদল লোক ব‍্যঙ্গনাটক পরিবেশন করেন কবিকে নিয়ে। নাটকটির নাম ‘এমন-ও দিন আসতে পারে’। ভবিষ্যতে কবিকে নিয়ে ব‍্যবসা ফাঁদবে লোকে, এই নিয়ে নাটক। খুব উপভোগ‍্য হয়েছিল।

‘রক্তকরবী’ দেখেছিলাম সেবার নেতাজিনগরে। স্মৃতিধার্য হয়ে আছে এখনও। নন্দিনীর ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন কণিকাদি, যাঁর স্বামী ছিলেন রাজনৈতিক নেতা মনোজ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়। আর দেখেছি ‘মুক্তধারা’, করেছিল নেতাজিনগর স্কুলের ছেলেরা।

আমাদের পরিবারটি ছিল সংস্কৃতিমনা। তাই রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে বেশ কিছু পত্রপত্রিকা ও স্মারকগ্রন্থ ঘরে এসেছিল। দশ-এগারো বছরের কিশোর আমি সবটা বুঝতে না পারলেও কিছু কিছু পড়ে ফেলতাম। সঙ্গগুণ! যেমন ‘দেশ’ পত্রিকার রবীন্দ্রশতবর্ষ সংখ‍্যা। কলিকাতা কর্পোরেশনের পত্রিকা ‘পুরশ্রী’-র রবীন্দ্রসংখ‍্যা, ‘বিশ্বভারতী’ পত্রিকা, এইসব। তাছাড়া ‘কালপুরুষ’,— রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত কবিতা, কবি বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়। চারুচন্দ্র চক্রবর্তীর (?) সম্পাদনায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রঙ্গরসিকতার একটি বই। ‘সৃজনী’ নামে একটি সঙ্কলন। রেডিওতে নারায়ণ গঙ্গোপাধ‍্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথিকা শুনেছি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। বঙ্গ সাহিত‍্য সম্মেলন হত তখন। মেজদা যেত। তার কাছে গল্প শুনতাম। অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে যে কার্ড, তাতে সত‍্যজিৎ রায়ের অসাধারণ স্কেচ। অবশ‍্যই রবীন্দ্রনাথের। সেটা মকসো করতাম।

আমার জীবনে রবীন্দ্র-শতবার্ষিকীর সবচেয়ে বড় ঘটনা বাড়িতে রবীন্দ্র রচনাবলি আসা। যদিও সেটা ঘটেছিল ১৯৬৪/৬৫ নাগাদ। এটার একটা ইতিহাস আছে।

রবীন্দ্রশতবার্ষিকীতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, সুলভ মূল‍্যে, মাত্র পঁচাত্তর টাকায় পনেরো খণ্ডে তাঁর রচনাবলি বের করবে। বিশ্বভারতী যেটা বের করেছিল, তার দাম তখন পাঁচ-ছ’শোর কম ছিল না। লটারি করে বিক্রি করা হবে। একলাখ কপি ছাপা হবে। অর্ধেক যাবে পূর্ববঙ্গে। কিন্তু রচনাবলি ছাপতে ছাপতে ১৯৬৫। এর মধ‍্যে বাধল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। তাই পঞ্চাশ হাজার কপি আর পাঠানো হল না। এবার কী হবে?

হত না কিছুই, কেননা আবার লটারি করলেও অনায়াসে বিক্রি হয়ে যেত। কিন্তু এবার সরকার আবেদনপত্র চাইলেন : কেন রচনাবলি চাই। আমার বড়দা করে দিলেন আবেদন। বাড়িতে তিনজন স্কুল ও কলেজের ছাত্র, তাই দরকার। আবেদন মঞ্জুর হল। যেদিন রাইটার্স থেকে বড়দা রচনাবলি আনতে যাবেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন আমি পনেরোয় পড়েছি সবে। ওই যে রবীন্দ্রনাথের বৈভবের সাক্ষাৎ পাওয়া, তার ঘোর প্রায় ষাট বছর হতে চলল, এখনও কাটেনি। ফেরার পথে ট‍্যাক্সি ঘুরিয়ে ন‍্যাশনাল লাইব্রেরিও দেখিয়ে আনলেন বড়দা। সুন্দরের দিকে, প্রজ্ঞা ও সারস্বতের দিকে দৃষ্টি উন্মোচন করে দিয়েছিলেন বলেই বই ও মনীষাকে আত্মলগ্ন করার বাসনা জন্মাতে পেরেছে। কলোনিতে জন্মে বিশ্বকে জানবার আকুতি জাগিয়ে দিয়েছিলেন বড়দা। তেমনি মেজদা-ছোড়দার ভূমিকাও ছিল। মেজদা কবিতাপ্রিয়। সুভাষ-সুকান্ত-মণীন্দ্র রায় উপহার দিতেন আমাকে। আর ছোড়দা কিনে আনত ‘সন্দেশ’, ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’, ‘শুকতারা’।

কলোনিজীবন বনাম অ-কলোনি, একটা চোরা সাম্প্রদায়িকতা ছিল। আমাদের চতুষ্পার্শ্বে ঘটি, অর্থাৎ কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গীয় মানুষজন প্রায় ছিলই না। তবে অফিস-কাছারিতে যারা কাজ করতেন, তারা তাদের সাক্ষাৎ পেতেন। পেতেন এমনকি ভারতের অন‍্যান‍্য প্রদেশের লোকজনের-ও নিত‍্য সাহচর্য। আমার বড়দা সাউথ ইস্টার্ন রেলে চাকরি করতেন। সেখানে তার সহকর্মী ছিলেন শঙ্করণ, চেন্নাইয়ের, তামিলভাষী। আমাদের বাড়িতেও এসেছিলেন, খেয়েছেন বাঙালি খাবার। জ‍্যোৎস্নাবাবুরা ঘটি ও বেজায় ধনী। আমাদের নিকট-প্রতিবেশী। খ্রিস্টান। মিশতেন আমাদের গুরুজনদের সঙ্গে, তবে দূরত্ব বজায় রেখে। আরও এক প্রতিবেশী সপরিবার সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি। সে-বাড়ির দুই মেয়ে যখন একসঙ্গে স্কুলে যেত, বয়স-নির্বিশেষে থমকে যেত পথচারীর দল। ওদের ভাই, হীরা, সৌন্দর্যে পাল্লা দিতে পারত টালিগঞ্জ-মুম্বাই-হলিউডের নায়ককে। তারা চলাফেরার পথে, এবং তাদের বাবার, ভুলেও ফিরে তাকানোর তাগিদ দেখিনি আমাদের হতভাগা উদ্বাস্তুদের দিকে।

কিছু দূরে বেশ কয়েকটি পেল্লায় প্রাসাদ ছিল। নিয়মিত থাকতেন না কেউ সেখানে। তারা উচ্চবিত্ত। মাঝেমাঝে গাড়ি করে আসতেন। একটি বাড়ি ছিল চিত্তরঞ্জন দাশের আত্মীয়, সম্ভবত জ্ঞাতিভাই, ভারতের প্রধান বিচারপতি, বিশ্বভারতীর উপাচার্য সুধীরঞ্জন দাশের। আর-একটি কবি-অধ‍্যাপক সুধীন্দ্রনাথ দত্তদের। বাড়িটির নাম ‘অবাচী’। শর্মিলা ঠাকুরদের-ও একটি বাড়ি ছিল। যেহেতু স্টুডিওপাড়া, তাই ছবি বিশ্বাস, কানন দেবী, বসন্ত চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায় প্রমুখের বাড়িও ছিল। আর ছিল রাজ্জাকদের সাধারণ গৃহ, কলকাতায় অভিনয়জীবন শুরু করে সফল হতে না পেরে বাংলাদেশে এসে নিজ প্রতিভায় অতি-বিখ‍্যাত ‘নায়করাজ’ রূপে খ‍্যাত হন যিনি।

এই নক্ষত্রপরিমণ্ডলের সঙ্গে কলোনিবাসীর সুদূর যোগ-ও ছিল না। ক্বচিৎ-কদাচিৎ দেখতাম তাদের, ব‍্যস, ওই পর্যন্ত। আমার তো কেবল কানন দেবীকে দেখার স্মৃতি আছে তা-ও মা এবং মেজদার সঙ্গে বেলুড়ে দুর্গাপুজো দেখতে গিয়ে। চিনতাম না আমি। মেজদা চিনিয়ে দেয়। আর দেখেছি হেমন্তকে একবার। ইন্দ্রপুরীতে ঢোকার মুখে উত্তম, গাড়িতে।

আমাদের অঞ্চলে ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র আউটডোর শ‍্যুটিং হয়। আজাদগড়ের একটি বাড়িতে। আমি তখন নিতান্তই ছোট। আমার দাদারা দেখেছিল শ‍্যুটিং। গল্প শুনেছি তাদের মুখে।

কলোনির চারদিকে ছিল কিছু বিখ‍্যাত স্থান। যেমন বিশাল ক‍্যালকাটা রয়াল গল্ফ ক্লাব। সেটার অর্ধাংশ নিয়ে পরে গল্ফগ্রিন আবাসন আর কলকাতা দূরদর্শন কেন্দ্র হয়েছে। ওল্ড হোম। ময়ূরভঞ্জের রানির প্রাসাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তৈরি বি. ও. আর. (British Other Rank) ক‍্যাম্প। বেশ কয়েকটি স্টুডিও,— রাধা, ইস্ট ইন্ডিয়া, ইন্দ্রপুরী, টেকনিশিয়ান। এসব স্টুডিয়োতে একস্ট্রা শিল্পী যোগাতেন আমাদের পাড়ার মধুদা। এজন‍্য আমরা কী সম্ভ্রমের চোখেই না দেখতাম তাকে! পাড়ার দু-একজন তার দৌলতে সিনেমায় একস্ট্রার ভূমিকায় নেমেছিলেন। একস্ট্রাদের মুখে কোনও সংলাপ থাকে না। একটা সংলাপ থাকলেই তিনি একস্ট্রা থেকে শিল্পী পদবীতে আরূঢ় হন। পাড়ার মন্টুদা আর ফুল্টুদা সংলাপ বলার সুবাদে আর্টিস্টের পর্যায়ে উঠে গিয়েছিলেন। তা অবিশ‍্যি ওরা উৎপল দত্তের গ্রুপে অভিনয় করতেন বলে : উৎপল দত্ত-পরিচালিত চলচ্চিত্রে।

||দ্বৈত ভাষা||

আমরা ঘরে ব‍্যবহার করতাম বিশুদ্ধ বাঙ্গালভাষা। নিজেদের মধ‍্যে এ-ভাষা ব‍্যবহার না করে কদাপি থাকতে পারতাম না। অন‍্যদিকে বইপত্র পড়তাম যাকে বলে মান‍্য চলিত, কখনও কখনও সাধু ভাষায়। অতএব দুটিতেই রপ্ত ছিলাম।

কলোনির মানুষ এক এক জেলা থেকে আগত,— খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালি। আমাদের ছোট্ট কলোনিতে ওই তিন জেলার মানুষ-ই বেশি। বরিশালের লোকজন আবার তাদের মধ‍্যে সবচেয়ে বেশি। অন‍্য জেলার মানুষ প্রায় নেই বললেই চলে,— দু-তিন ঘর কুমিল্লা, বা চাঁদপুর অথবা ফরিদপুর, ঢাকা। আমাদের ভাষা-ব‍্যবহারে খুব একটা পার্থক‍্য দেখা যেত না। নোয়াখালির লোকজনের ভাষায় গরমিল লক্ষ্য করতাম, এই যা। আর তাতে অভ‍্যস্ত-ও হয়ে গিয়েছিলাম। এক এক জেলার ভাষার মধ‍্যেও স্তর-স্তরান্তর আছে, আছে ভদ্রশ্রেণি আর তথাকথিত ব্রাত‍্যের ভাষার, শব্দব‍্যবহারের পার্থক‍্য, পুরুষ ও নারীর ব‍্যবহৃত শব্দ ও বাগধারার তফাত।

বাড়ি থেকে একটু দূরে গেলেই বাজার। সেখানকার অধিকাংশ দোকানদার, মুদির, মিষ্টির, মাছের,— ঢাকা জেলার। আশ্চর্য লাগে এখন, তখন বিচার করে দেখিনি, ব‍্যবসায়ীদের প্রায় সবাই ঢাকাইয়া। বরিশাল-খুলনা শূন‍্য। অন্তত আমাদের পাড়ায়। নাপিত, ঘরামি, বিয়েবাড়ির রাঁধুনি, পুরোহিত আছে বরিশালীয়া। ধোপা অবাঙালি। মেথর-ও। গোয়ালাদের-ও কেউ কেউ। বাঙ্গালরাও এখানে এসে গোয়ালার পেশায় নিযুক্ত হয়। তবে তারা ঘোষ পদবির নয়। সম্ভবত এদেশে গোপালন তাদের নবলব্ধ পেশা। উৎপাদনশীল ব‍্যবসার সঙ্গে গোয়ালা বাদে সামান‍্যই ছিলেন। রবিদা নিজের ছোট্ট জমিতে শীতকালে ডালিয়ার চাষ করতেন। এক বৃদ্ধা ডালের বড়ি আর মুড়ি, চিঁড়ের মোয়া তৈরি করে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতেন। সেটাও তো উৎপাদনশীল ব‍্যবসা, তাই না? আর কাগজের ঠোঙা বানানো? সাইকেলে করে নিউ মার্কেটের বাঁধা দোকানে বিক্রি করতেন। হারানদা ছিলেন দর্জি। সুখাদারা তিন ভাই ‘থ্রি ব্রাদার্স’ নামে দর্জির দোকান করে তুমুল জনপ্রিয় হন। কারও ছিল চা-ঘুগনি-আলুর দমের দোকান, কারও মিষ্টির, কারও বা কামারশালা। সোনার দোকান-ও ছিল, তবে সোনা বিক্রির চেয়ে সেখানে বন্ধকী কারবার-ই রমরমিয়ে চলত। দশকর্মভাণ্ডার প্রত‍্যেকটি বাজারে অবধারিতভাবে থাকবেই। বিয়ে-পৈতে-অন্নপ্রাশন-শ্রাদ্ধ ও বিবিধ পুজোর যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস তো সেখানে মিলতোই, মিলত পুজো করার বই, যষ্টিমধু, ত্রিফলা বা চিরতার মতো শরীররক্ষার কবিরাজী দাওয়াই। ঝাঁটা-পোড়লের খোসা-সৈন্ধব লবণ-পয়সা জমাবার ঘট, কী নেই সেখানে? বর ও বধূর টোপর থেকে শুরু করে (টোপর লাগে অন্নপ্রাশন হচ্ছে যে শিশুর, তার-ও) পৈতের সময় বস্ত্র গেরুয়া করার মেটে রং, হাতেখড়ির খাগের কলম, সব পাওয়া যেত সেখানে। দশকর্ম নয়, ভাণ্ডারটি ছিল শতকর্মের প্রতি দায়বদ্ধ।

এত সব ছিল, বাজারে বইয়ের দোকান কিন্তু ছিল না। আমাদের মতো বইপ্রেমীদের আকাঙ্ক্ষা মেটাতে এক মনোহারি দোকান কিছু বই রাখত। সেখান থেকে মিলত মূলত স্বপনকুমারের ডিটেকটিভ বই। তা-ই সই। তবে ফেরিওয়ালারা বই নিয়ে আসত বটে। লক্ষ্মীর পাঁচালী, শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম, নিত‍্যকর্মপদ্ধতির সঙ্গে হঠাৎ করে আনত ঠাকুরমার ঝুলি অথবা রূপকথার বই। আমার তো আনন্দের সীমা থাকত না। মায়ের প্রশ্রয় ছিল খুব, চাইলেই বই কেনার টাকা মুহূর্তে মঞ্জুর হয়ে যেত।

বাজারের পর আরও খানিক দূরে স্কুল। সেখানে নানা জেলার মানুষের সমাগম। একটু একটু সমস‍্যা হত প্রথম প্রথম তা বুঝতে। বিশেষ করে আমাদের হেডমাস্টার আর ক্লাসটিচার দুজনেই ছিলেন চট্টগ্রামের। সামান‍্যই বুঝতাম তাঁদের কথা। ঢাকা থেকে যশোর, এমনকি আসাম থেকে আগত ছাত্রের ভাষাতেও অভ‍্যস্ত হয়ে উঠলাম। দেশভাগ আমাদের ভাষাবিদ করে তুলেছিল বটে!

কথোপকথনের ভাষা আর বইয়ের ভাষায় কখনও দ্বন্দ্ব বাধেনি। স্কুলেও মূলত বাঙ্গাল বলতাম। তবে বাঙ্গাল হয়েও বন্ধুদের কেউ কেউ যখন মান‍্য চলিতে কথা বলত, তাদের সঙ্গে ওই ভাষা ব‍্যবহারে অসুবিধে হত না। কখনও কখনও যে গুলিয়ে যেত না, তা কিন্তু নয়। তবে বিদ‍্যালয়-শেষে যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, ভাষাব‍্যবহারে একবিন্দু জড়তাও রইল না।

রইল না বলছি বটে, রইল-ও। আমরা বলতাম সঅত‍্যজিৎ। এক বান্ধবী উচ্চারণের ভুল শুধরে দিয়ে ‘সোত্তজিৎ’ উচ্চারণ করতে শেখায়। মোম নয়, মোমবাতি। পাচ, উঁহু, হবে না। হবে পাঁচ। এসব শেখা বাকি ছিল তখনও। অনেককেই দেখতাম, নিজেদের বাঙ্গাল উচ্চারণের বলয় থেকে একেবারেই বেরিয়ে আসতে পারতেন না। কেউ কেউ এটাকে তাদের গর্বিত উত্তরাধিকার মনে করতেন। আবার কেউ একেবারেই অক্ষম ছিলেন মান‍্য চলিত বলায়। অনেকে আবার জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলতেন। তবে আশ্চর্যের কথা, ১৯৪৭ থেকে সাত-সাতটি দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, এখনও আমাদের অঞ্চলে নিজেদের মধ‍্যে মূলত বাঙ্গাল ভাষা-ই ব‍্যবহৃত হয়। যাদের তিনপুরুষ কলকাতায় বাস করছে, অহরহ বাঙ্গাল বলছে তারা! দিল্লিবাসী বা বর্ধমান-হরিয়ানা-শিলচর, যেখানকার বাসিন্দা-ই হোন, বাঙ্গালে-বাঙ্গালে মোলাকাত হলে বাঙ্গাল ছাড়া গীত নাই!

পেশার কথা আর-একটু বলা যাক। ছয়ের দশক থেকে আটের দশক পর্যন্ত সরকারি চাকরি মোটামুটি সুলভ ছিল। মধ‍্যবিত্ত-নিম্নমধ‍্যবিত্ত উদ্বাস্তু পরিবারের ছেলেমেয়েরা বি এ পাশ করে ব‍্যাঙ্ক, রেলওয়ে, স্কুলে চাকরি পেলে নিজেকে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত মনে করত। ক্বচিৎ কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিভাবক ছেলেকে এঞ্জিনিয়ার বানাতে চাইত। মেধাবী হলেও মেয়েদের অভিভাবকেরা তাদের এঞ্জিনিয়ার করতে উৎসাহ দেননি,— মেয়ের বিয়ে হবে, সংসার করবে, এই ধারণা থেকে। গান শেখানোতে উৎসাহ দিতেন, বিয়ের যোগ‍্যতা হিসেবে গান গাইতে জানা মেয়ের চাহিদা ছিল বলে। খুব কম মেয়ের-ই বাসনা ছিল চাকরি করার। সাতের দশক পর্যন্ত অনার্স পড়ত খুব কম ছেলেমেয়ে। তারপর পরিবর্তন আসতে থাকে অর্থনৈতিক কারণে। ১৯৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধ, ১৯৬৫-র ভারত-পাক লড়াই দেশের অর্থনীতির ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। ১৯৬৬-তে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেশে মুদ্রার মূল‍্যহ্রাসে (De-valuation of money) করতে বাধ‍্য হন।

ডাক্তার, সি. এ. বা ম‍্যানেজমেন্ট পড়ার প্রকৃত চল হয়েছে নয়ের দশক থেকে। উচ্চশিক্ষার জন‍্য বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা-ও ওই সময় থেকে।

দুস্থ পরিবারের দু-একজন মহিলাকে ঝিয়ের কাজ করতে দেখেছি। তবে আমাদের পাড়ায় যে একশো পরিবারের বাস ছিল, সেখানে কেবল একজন মহিলাকেই দেখতাম এই পেশায়। মুটেগিরিতেও নিয়োজিত দেখেছি একজনকেই। অতএব বোঝা যাচ্ছে, অতিরিক্ত দারিদ্র‍্যপীড়িত তেমন কেউ আমাদের পাড়ায় ছিলেন না। তবে হ‍্যাঁ, সত‍্যের খাতিরে বলতেই হবে, অন্তত দুজন মহিলার বারাঙ্গনাবৃত্তি ছিল। এ নিয়ে সমাজ কোনও শোরগোল তোলেনি, ভাবলে একটু অবাক-ই লাগে।

||বর্ণাশ্রম||

পূর্ববঙ্গের মানুষ পশ্চিমবঙ্গীয়দের তুলনায় জাতপাত বামুন-কায়েত বিচারে অনেক বেশি কট্টরপন্থী। ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণে বিয়েশাদি একেবারে অকল্পনীয়। যার রেশ কলোনিজীবনেও দেখা গেছে। আমাদের পাড়ার এক ডাকসাইটে সুন্দরী, ওই যাকে বলে ডানাকাটা পরী; তাকে ভাল লেগেছিল অনুরূপ রূপবান এক ছেলের মা-র। ইচ্ছে প্রবল, ওই মেয়েকে পুত্রবধূ করে আনেন। কিন্তু মেয়েটি যেহেতু কায়স্থ পরিবারের, তাই মায়ের ইচ্ছেটি মনেই রয়ে গেল। পাড়ায় ছেলেমেয়েদের মধ‍্যে গান্ধর্বসম্পর্ক তৈরি হয়নি তা নয়, তবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই তা সবর্ণে। সাতের দশকে এসে এই গোঁড়ামি কেটে যেতে থাকে, যখন এক কায়স্থ পুরুষ ভালবেসে এক ব্রাহ্মণকন‍্যার পাণিগ্রহণে সমর্থ হয়। তবে তা কুসংস্কারের ওপরে ওঠার জন‍্য, না কি মেয়েটি পিতৃহীন ও নিতান্ত দরিদ্র বলে, নির্ণয় করা যাবে না। তবে যে মা অন‍্য বর্ণের বলে পুত্রবধূ করে ঘরে আনতে চাননি কায়স্থ বিধায়, তার-ই কনিষ্ঠ পুত্রটি যখন এক কায়স্থ কন‍্যার প্রেমে পড়ল, তাকে ঘরে আনতে দ্বিধা করেননি। ততদিনে তার মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে গেছে।

পাড়ায় কারও বাড়িতে ব্রাহ্মণ কেউ নিমন্ত্রিত হয়ে গেলে তাদের কাউকে কাউকে আলাদা জায়গায় বসিয়ে আহার্য পরিবেশন করতে হত। বিয়ে-পৈতে-অন্নপ্রাশন-শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে বিধবাদের জন‍্য আলাদা করে রান্না করতে হত। সে-রান্নার দায়িত্বে থাকতেন নিমন্ত্রিতদের মধ‍্যে কোনও বিধবা, অথবা নিমন্ত্রণকর্তার আত্মীয় কেউ। বিধবাদের মধ‍্যে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণের স্বতন্ত্র আসন, দূরত্ব বজায় রেখে। অন‍্যান‍্য নিমন্ত্রিতরা নৈশাহারী থাকলেও (অন্নপ্রাশন, পৈতে বা শ্রদ্ধানুষ্ঠানের খাওয়াদাওয়া অবিশ‍্যি অধিকাংশ সময়ে দিনের বেলাতেই হত) বিধবাদের আহার নির্দিষ্ট হত দিনে। কেননা সূর্যাস্তের পরে তাদের অন্নভোজন নিষেধ!

জাতপাতের ব‍্যাপারটা কলোনিজীবনে এত প্রবল ছিল যে, সাধারণত অব্রাহ্মণের বাড়িতে কোনও উচ্ছিষ্ট দ্রব‍্য (ভাত-মাছমাংস-পায়েস। পিঠে খাওয়া কিন্তু বৈধ!) ব্রাহ্মণের আহার করা চলত না। অব্রাহ্মণরা ব্রাহ্মণের বাড়িতে খাওয়ার অধিকারী ছিল, তবে ব্রাহ্মণের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে।

একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। জনৈকের বাড়িতে অন্নপ্রাশন। মেঝেতে লম্বা চাদর পেতে খেতে দেওয়া হয়েছে। দেখা গেল, বামুনদের আসনের শেষ প্রান্তে একজন কায়েত উপবিষ্ট, দশ-বারোজনের ব‍্যবধানে। অমনি উঠে গেলেন সেই বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণপ্রবর।

আর-একটি ঘটনা। এটি আরও অবিস্মরণীয়। একজনের বাড়ির বিবাহানুষ্ঠানের ম‍্যারাপ পড়েছে প্রতিবেশীর বাড়িতে, যা সচরাচর হত। খাওয়াদাওয়া শেষ হতে চলেছে, কিন্তু সে-বাড়ির জনা ছয়েক সদস‍্যের কেউ-ই খেতে আসছেন না দেখে অনুষ্ঠানবাড়ির গৃহকর্তা তাদের ডাকতে গিয়ে দেখেন (তার মনে হয়েছিল, কোনও কারণে অভিমানবশত খেতে আসছেন না তাদের কেউ) বাড়ির গৃহিণী রান্নায় ব‍্যস্ত। নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করে রান্না! আশ্চর্য! জানা গেল, নিমন্ত্রণবাড়ির উঠোনে রান্না হচ্ছিল যখন, সেখানে রান্নার বামুন কিছু চুরিটুরি যাতে করতে না পারে, সেজন‍্য পাহারায় যিনি ছিলেন, (এমন রেওয়াজ ছিল সে-সময়, প্রাক্-ক‍্যাটারিং যুগে) তিনি কায়েত। নিশ্চয়ই তার ছোঁয়া এড়িয়ে রান্না হতে পারেনি। অতএব— শত অনুরোধেও সে-বাড়ির কেউ খেতে এলেন না। অথচ তাদের উঠোনে প‍্যান্ডেল বেঁধে নিমন্ত্রিতদের আপ‍্যায়িত করা হয়েছিল! নিমন্ত্রণকর্তার অপরাধবোধ তখন তুঙ্গে। অথচ তিনি নিরুপায়। আজকের দিনে এসব একেবারেই ভাবা যায় না। অথবা কোথাও কোথাও হয়তো এর রেশ থেকেও যেতে পারে।

আমাদের অশ্বিনীনগর কলোনি বহরে নিতান্তই ছোট, পাশের আজাদগড়, গান্ধী কলোনি, নেতাজিনগরের চেয়ে। মাত্র একশো পরিবার নিয়ে। অন‍্যগুলো পাঁচ-সাতশো, এমনকি হাজারের ওপর পরিবার নিয়ে। অবিশ‍্যি টালিগঞ্জে আমাদের কলোনির চেয়েও ছোট কলোনি আছে। যেমন নিঃস্ব কলোনি বা নেহরু কলোনি।

যাই হোক, অশ্বিনীনগরে ব্রাহ্মণ-পরিবারের সংখ‍্যা কিন্তু কম নয়, একশো পরিবারের মধ‍্যে বত্রিশের ওপর। এদের মধ‍্যে মাত্র চার-পাঁচটি পরিবার শিক্ষিত ছিল। চাকরি করতেন সে-পরিবারের এক বা একাধিক ব‍্যক্তি। বাকিদের প্রায় সবাই সেই অর্থে স্কুলের গণ্ডি না-পেরনোর দলে। মূলত পুরোহিতের পেশা ছিল তাদের। এ-পেশায় সারাবছর পরিবার নিয়ে চলা কঠিন। তাই তারা বিচিত্র পেশায় নিযুক্ত থাকতেন। যে ব্রাহ্মণ খেতে না বসে উঠে গিয়েছিলেন, তাকেই দেখেছি সেই ব্রাত‍্যগৃহে টিউবওয়েল বসাচ্ছেন, অর্থাৎ দাস‍্যবৃত্তি! অদ্ভুত আয়রনি! তিন-চারটি পরিবারের লোক কালীঘাটের পাণ্ডা ছিলেন। তাতে কোনওমতে সারাবছর খেয়ে-পরে থাকতে পারতেন। সাতচল্লিশের আগে পূর্ববঙ্গে এরা আরাম-আয়েসে পায়ের ওপর পা তুলে, তাস-পাশা খেলে, পরনিন্দা পরচর্চা করে অনায়াস জীবন কাটিয়েছেন। দু-দশ বিঘে জমি, দু-চারটে পুকুর, পালিত গোরু-ছাগলে দিন মন্দ কাটত না। সহসা দেশভাগ তাদের অভিভূত করে ফেলল। বিদ‍্যার্জন করেননি বলে চাকরির যোগ‍্যতাহীন। ব‍্যবসা-বাণিজ‍্য করার পুঁজি ও উদ‍্যোগের অভাব, একেবারে নাজেহাল অবস্থা। ছেলের পড়াশুনো, মেয়ের বিয়ে দিতে যে কী পরিমাণ ক্লেশ পেতে হয়েছে! একবস্ত্রে থাকতে হয়েছে বছরের পর বছর। বিসর্জন দিতে হয়েছে পুষ্টিকর আহার। বিনোদন বলতে কিছু ছিল না তাদের।

||ভোটরঙ্গ ও কলোনিজীবন||

যথারীতি সারা রাজ‍্যের মতো কলকাতায়, টালিগঞ্জের এই কলোনি-অধ‍্যুষিত অঞ্চলেও ভোটের দামামা বেজে উঠল। অন‍্য অঞ্চলের কথা জানা নেই, ছ-বছরের আমি কিছু কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম ভোট উপলক্ষ্যে। নেতাদের বক্তৃতা শোনার সুযোগ তেমন হয়নি। স্লোগান শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ‘ভোট দেবেন কীসে, কাস্তে ধানের শীষে’। কলোনিতে কংগ্রেসের চেয়েও বিরোধী বামপন্থী রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা বেশি ছিল। মনে আছে, কংগ্রেসের আশা ঘোষ এবং আর এস পি-র হরিদাস মিত্র নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন সেবার। কংগ্রেসের জয় হলেও আমাদের অঞ্চলে হরিদাসবাবুই জেতেন।

মাইকের প্রচলন তখন খুব একটা ছিল না। পাড়ায় পাড়ায় চুঙ্গা দিয়ে ঘোষণা দেওয়া হত,— কবে কোথায় জনসভা, কারা আসবেন, এইসব। আজাদগড় মাঠের জনসভায় সাধন গুপ্তের বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলাম মনে আছে। ব‍্যারিস্টার, দৃষ্টিহীন। বক্তৃতার বুঝিনি কিছুই।

খবরের কাগজে লাল রং দিয়ে লেখা স্লোগান টাঙানো হত বাড়ির বেড়ায়। টিনের পাত কেটে অক্ষর তৈরি করে রং স্প্রে করেও দ্রুত এ-কাজ সারা হত। ভোটের দিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভলান্টিয়ার আমরা। কী করতাম থোড়াই মালুম। তবে তিন-চারটে করে থিন এরারুট বিস্কুট জুটত সেদিন। রাস্তায় লোকজনের সদা-ব‍্যস্ততা, ক‍্যাডারদের সাইকেলে যাতায়াত, বেশ উত্তেজনার আগুন পোয়ানো হত। অশ্বিনীনগরে তখন ভোটকেন্দ্র ছিল না, ছিল গান্ধী কলোনি স্কুলে। এক চক্কর সেখানে ঘুরে আসা। সেই প্রথম ‘কমরেড’ শব্দটির সঙ্গে পরিচয়। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানের সঙ্গেও। অনেকে আবার ‘ইনক্লাব’ উচ্চারণ না করে স্বস্তি পেত না। শুনলাম কংগ্রেসের ভলান্টিয়ারদের লুচি-মাংস পরিবেশিত হয়েছে। কী যে আফসোস তাইতে!

এক-একবার নির্বাচন আসে, রাজনীতি ক্রমশ ঘোরালো হয়, রাজনৈতিক বিদ্বেষ বাড়ে, হিংসা বাড়ে, খুনখারাপি চালু হয়। ১৯৬৭ থেকে ‘৭৫ পর্যন্ত এক চরম অবক্ষয় নেমে আসে দেশের ও রাজ‍্যের সর্বত্র। আর ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’ অতএব অবক্ষয়ের ছাপ পড়তে শুরু করল কলোনিগুলিতেও। গুন্ডারাজ কায়েম হল টালিগঞ্জ অঞ্চল জুড়ে। এ-দলের ক‍্যাডার খুন হচ্ছে ও-দলের হাতে, ও-দলের ক‍্যাডার এ-দলের হাতে। দুই দলের বন্ধু-ই মারা গেছে আমার।

অবস্থা চূড়ান্ত বিন্দুতে পৌঁছল ১৯৭৫-এ সহসা দেশব‍্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ‍্যমে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফকরউদ্দীন আলী আহমেদ এই অধ‍্যাদেশটি জারি করেন। এর পরিপ্রেক্ষিত ছিল সে-বছরের ১২-ই জুন এলাহাবাদের রায়, যাতে ইন্দিরার বিগত নির্বাচনে জয়লাভ অবৈধ ঘোষিত হয়েছিল। একুশমাস ব‍্যাপী স্থায়ী এই জরুরি অবস্থা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ‍্যায়। এর আগেও দুবার জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল দেশে, ১৯৬২-তে চীন-ভারত যুদ্ধের সময়, এবং ১৯৭১-এর পাক-ভারত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু এবারে সংবিধানের ৩৫২ ধারা প্রয়োগের মাধ‍্যমে যা করা হল, তা মাত্রাগতভাবেই আলাদা। নকশালবাড়ি আন্দোলন দমন করতে কয়েক বছর আগে কেন্দ্রের নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ‍্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় যে নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছিলেন অসংখ‍্য মেধাবী নকশাল ছাত্রের ওপর অত‍্যাচার, দমনপীড়ন ও হত‍্যাযজ্ঞ চালিয়ে (মনে আছে, ঠিক এই সময়েই সিদ্ধার্থশঙ্করের মা, অর্থাৎ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মেয়ে অপর্ণা রায়ের গাওয়া একটি গানের রেকর্ড তাপুনরায় বাজারে আসে, যে গানের গীতিকার স্বয়ং দেশবন্ধু! মর্মভেদী সে-গানটি হল,— ‘দাও দাও প্রাণের নিধি প্রাণের মাঝে এনে দাও’।), তা ছিল তুলনারহিত। খুব কম ‘প্রাণের নিধি’ হারায়নি তখন কলোনিবাসী।

সেদিন থেকে আজ, ভোট, ভোটে কারচুপি, রিগিং, বুথ দখল, বহু জিনিস-ই দেখা গেল। যা ছিল কাস্তে ধানের শীষ, পরে সেটাই হল কাস্তে হাতুড়ি তারা (সেইসঙ্গে স্লোগান পালটে গিয়ে হল ‘ভোট পাবে কারা/ কাস্তে হাতুড়ি তারা’)। কংগ্রেসের প্রতীকচিহ্ন ছিল জোড়া বলদ, পালটে হল হাত। শিল্পীদের আঁকার মেহনত বাঁচল।

প্রসঙ্গান্তর করে দুর্গাপুজোর অন‍্য ধরনের স্মৃতিচারণ সেরে নিই। এখন থিমপুজোর ছড়াছড়ি। ১৯৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধ নতুন এক দুর্গামূর্তি গড়তে প্রেরণা দিয়েছিল বিজয়গড় কলোনির মানুষদের। দুর্গা রূপায়িত হলেন ‘ভারতমাতা’-য়। ভাবনাটা অবিশ‍্যি বঙ্গভঙ্গের সময়কার। সে-সময়ে অবনীন্দ্রনাথ এই নামে ছবি আঁকেন। তবে এবারে তার সঙ্গে যুক্ত হল অসুররূপী ড্রাগন, ভারতমাতা যাকে বধ করছেন। ড্রাগন গোটা চীনের প্রতীক। সেই ভাবনায় নির্মিত মূর্তি অদ‍্যাপি তৈরি হয়ে পূজিত হয়ে আসছে।

চীনের সঙ্গে যুদ্ধ দেশে এবং আমাদের ক্ষুদ্র পাড়ায় আনল নতুন করে দেশাত্মবোধের জোয়ার। তখন দূরদর্শনের যুগ নয়। বেতারে প্রতিদিন দেশাত্মবোধক গানের বন‍্যা বয়ে যেতে লাগল। এসময় দেশাত্মবোধক রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড-ও বেরোয় প্রচুর। ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা’ শুনছি হেমন্তের কণ্ঠে, শুনছি সুচিত্রার ‘সার্থক জনম আমার’, পঙ্কজকুমার মল্লিকের ‘নাই নাই ভয়’। নতুন এক অনুষ্ঠান চালু করে আকাশবাণী কলকাতা, নতুন গীতিকারদের রচিত দেশাত্মবোধক গানের। এখনও প্রতিদিন তার ক্ষীণ ধারা বহমান।

যুদ্ধের প্রসঙ্গে ১৯৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের এক স্মৃতি ভাসে। স্কুলে ক্লাস করছি, হঠাৎ শুনি, রানিকুঠিতে এক পাকিস্তানি গুপ্তচর ধরা পড়েছে। গুপ্তচর, গোয়েন্দা, এসব বইতেই পড়া ছিল, চাক্ষুষ করার কথা ছিল কল্পনাতীত। অমনি ক্লাস বাদ দিয়ে ছুট ছুট ছুট! গিয়ে কেবল আমাদের মতো কৌতূহলীদের-ই দেখতে পেলাম। গুপ্তচরকে বন্দি করে স্থানান্তরিত করা হয়ে গেছে ততক্ষণে। ঘটনাটা ঘটেছিল ঠিক-ই। রানিকুঠিতে যে রানির প্রাসাদ, সেটি পরে ভারতীয় বায়ুসেনার (Indian Air Force)-এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান দপ্তর হয়। এখন আবার সেটা টেলিফোন অফিস। সেটির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সেই স্পাই-মহোদয় ছবি আঁকছিলেন নাকি। গুপ্তচর দেখার সমীপবর্তী হয়েছিলাম, সেই সান্ত্বনা নিয়ে অবশেষে ফিরে আসা।

দুর্গাপুজোর আরও দু-একটা স্মৃতি। পুজোর আগে একবার মেদিনীপুরে ভয়াবহ বন‍্যা হয়েছিল। সালটা মনে পড়ছে না। ১৯৬০, ’৬১ বা ’৬২ হবে হয়তো। সেখান থেকে বন‍্যাপীড়িত বহু মানুষ কলকাতায় এসেছিলেন অর্থ ও অন‍্যান‍্য সাহায‍্যের প্রত‍্যাশায়। আমাদের কলোনিতেও। মনে আছে তাদের গলায় গান, ‘হায় গো বিধি দারুণ লীলা, বন‍্যায় ভাসিছে মোদের দেশ’! সেবার আমাদের পুজো-প‍্যান্ডেলে বন‍্যার্তদের সাহায‍্যের জন‍্য জনগণের প্রতি আবেদন জানানো হয়েছিল। পোস্টার লেখা হয়, ‘পূজার আনন্দে বন‍্যার্তদের ভুলিবেন না’।

পুজোর আর এক অমূল‍্য স্মৃতি। একাত্তরের দুর্গাপুজোর। সেবার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সে-যুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশকে সর্বাঙ্গীন সহযোগিতার কথা সবাই জানি। পুজো-প‍্যান্ডেলে বহু স্থানেই ইন্দিরা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাঁধানো ছবি টাঙিয়ে রাখা হয়েছিল। কলোনিবাসীর বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এমন-ই গভীর ছিল।

নির্বাচনের সবচেয়ে উজ্জ্বল স্মৃতি ১৯৭৭-এ পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের বিপুল জয় এবং সে-উপলক্ষ্যে বিজয়গড় মাঠে বিজয়-উৎসব (উৎসব আরও অনেক জায়গাতেই হয়েছিল), এবং সেখানে নাম্বুদিরিপাদের আগমন। এই সেই নাম্বুদিরিপাদ, যিনি ১৯৫৭-তে কেরালায় ভারতের মধ‍্যে প্রথম কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে সেই গণতান্ত্রিক সরকারকে অন‍্যায়ভাবে ভেঙে দেওয়া হয়। সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় আমাদের কলোনিতে এসেও পৌঁছেছিল মনে আছে। আমরা স্কুলে স্ট্রাইক পালন করেছিলাম।

এত জনসমাগম বিজয়গড় আগে দেখেনি। মাছি গলার স্থান ছিল না, থিকথিকে ভিড় এমন-ই ছিল। অনায়াসে পদপিষ্ট হয়ে মারা যেতে পারত মানুষ। নাম্বুদিরিপাদকে রাস্তা উজিয়ে মঞ্চে তোলা হয়েছিলো কাঠের পিঁড়িতে বসিয়ে। তাঁর ইংরেজিতে দেওয়া বক্তৃতার তাৎক্ষণিক বাংলা অনুবাদ করে শোনাচ্ছিলেন নেতাজিনগর কলেজের প্রিন্সিপাল পীযূষ দাশগুপ্ত, কার্ল মার্ক্সের ‘দাস ক‍্যাপিটাল’-এর বাংলা অনুবাদ পেয়েছি যাঁর হাত দিয়ে। মঞ্চে অন‍্যান‍্যদের মধ‍্যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উপস্থিতির কথা স্মরণ আছে। তাঁর বক্তৃতাও ছিল মর্মস্পর্শী।

সত‍্যি কথা বলতে, সেবার পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের শাসনক্ষমতায় আসা রাজ‍্যবাসী তথা কলোনিবাসীর কাছে পরম আশীর্বাদের মতো মনে হয়েছিল। যথার্থ প্রগতিশীল সরকার হিসেবে তাদের কাজকর্ম-ও শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে উদ্বাস্তুসমস‍্যার সমাধানে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ এই প্রথম নেওয়া হয় তাদের তরফ থেকে। দখলীকৃত জমির বৈধতা দেওয়া হয়। জমির মালিকানার দলিল দেওয়া হয়। ইচ্ছে করলে যে-কেউ জমি বন্ধক রেখে ব‍্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেবার সুবিধে ভোগ করে। জমি হস্তান্তরের সুযোগ-ও রাখা হয়।

কলোনিবাসীরা দেশভাগের ফলে জমিজিরেত ছেড়ে বাস্তুচ‍্যুত হয়ে বঞ্চনার শিকার হয়েছিল বহু বছর। পাঞ্জাবিরা যে সুযোগ-সুবিধে পেয়েছিল, চাষের জমি, কৃষিঋণ, সব তাদের ভাগ‍্যেই জুটেছিল। উদ্বাস্তুদের দাবি আদায়ে সক্রিয় ছিল বাম দলগুলো, বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া। এর ফলেই পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুমাত্রেই বাম রাজনীতির সমর্থক হয়ে ওঠেন। ১৯৭৭-এ বামেদের ক্ষমতায় আসা সে-কারণেই সম্ভব হয়েছিল।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত‍্য হল, বামফ্রন্ট ক্রমশ সাধারণ মানুষের স্বার্থের বাইরে গিয়ে কাজ করতে থাকে। তাদের আমলে একের পর এক কারখানা, পাটকল বন্ধ হতে থাকে। উদ্বাস্তুরাও আর তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল রইলেন না। চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনের পতন ঘটে এইভাবে, ২০১১ সালে।

বাম শাসন, সিপিএম দলের সঙ্গে উদ্বাস্তুজীবন ওতপ্রোত। রাজ‍্যে বা কেন্দ্রে যে দল-ই শাসনক্ষমতায় আসুক না কেন, কলোনিবাসীর বৃহত্তর অংশ সর্বদাই বামপন্থীদের সঙ্গে থেকেছেন। আর সমাজে একজন বামপন্থায় বিশ্বাসী মানুষ সম্মান পেতেন প্রচুর। মহিলা হলে তো আরও। মিটিং-মিছিলে যোগ দেওয়া, পার্টিতে সামান্য পরিমাণে হলেও অর্থসাহায‍্য, এসব ছিল কলোনিবাসীদের পবিত্রকৃত‍্য। নেতারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের দুঃখদুর্দশায় পাশে এসে দাঁড়াতেন, তাদের সমস‍্যা বোঝায় আগ্রহী ছিলেন। আমাদের উদ্বাস্তুজীবনে নিরঞ্জন সেন, প্রশান্ত শূর, মনোজ ব‍্যানার্জিকে কাছাকাছি পেতাম। প্রথম দুজন ছিলেন বিধায়ক ও মন্ত্রী। কখনও সাধারণ মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে দেখিনি এঁদের। নিজেরাও বাস্তুচ‍্যুত বলে সম্ভব হয়েছিল এমনটা। বরিশালের ভূমিপুত্র নিরঞ্জন সেন জেল খেটেছেন বহুবার। তার মধ‍্যে ১৯২৫-এ মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে যেমন, তেমনই আন্দামানের সেলুলার জেলেও। এই মানুষটি কী সহজভাবেই না মিশতেন আমাদের সঙ্গে! প্রশান্ত শূরকে দেখেছি দিন নেই রাত নেই ব‍্যথিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে।

প্রশান্ত শূরকে নিয়ে এখানে একটু বিস্তৃত লেখা এ-কারণেই জরুরি যে, তাঁর অবদান ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুরা পায়ের তলায় মাটি-ই খুঁজে পেতেন না। যৌবনবয়সে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ায় পিতা রায়সাহেব নগেন্দ্রকুমার শূর তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি। আইন পাশ করলেও কোনোদিন আইন-ব‍্যবসায়ে যোগ দেননি। জেল খেটেছেন, হয়েছেন কলিকাতা কর্পোরেশনের প্রথম কমিউনিস্ট মেয়র। এ-পদে চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ফজলুল হক, বিধানচন্দ্র রায় একদা অধিষ্ঠিত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা-নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে ১৯৬৮ , ‘৭৭, ‘৮২, ‘৮৭, ’৯১-তে জয়লাভ করেন। হন নগরোন্নয়ন মন্ত্রী। তাঁর আমলেই কলকাতা শহরের রূপ পাল্টাতে শুরু করে। শিয়ালদহের উড়ালপুল কংগ্রেসের প্রবল বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়ে বাস্তবায়িত করে তোলেন। দশ-দশটি বছর তিনি রাজ‍্যের স্বাস্থ‍্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। এ-সময় একদিকে তিনি গ্রামীণ স্বাস্থ‍্যকেন্দ্রগুলির উন্নতিবিধানে মনোযোগী হন যেমন, তেমনই স্বাস্থ‍্যগবেষণায় গুরুত্ব আরোপ করেন। ছিলেন উদ্বাস্তু পুনর্বাসন মন্ত্রী। মন্ত্রী হওয়ার আগে-পরে উদ্বাস্তু-সমস‍্যা নিয়েই ভেবে গেছেন আজীবন, সমস‍্যার সমাধান খুঁজেছেন। বার্ধক‍্যজনিত কারণে পঁচাশি বছর বয়সে মৃত‍্যু ঘটে তাঁর। ২০০৮-এর ২৯-এ ফেব্রুয়ারিতে। তাঁর পিতা দেশভাগের পরেও উদ্বাস্তু হতে চাননি বলে পূর্ববঙ্গে, স্বভূমিতেই রয়ে যান। ট্র‍্যাজেডি এখানেই, যে প্রশান্ত শূর ছিলেন উদ্বাস্তুত্রাতা, তাঁর পিতার মৃত‍্যু হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে, অনুদ্বাস্তু জীবন বেছে নেন বলে! প্রশান্ত শূর নিজের দেহ মেডিক‍্যাল ছাত্রছাত্রীর প্রয়োজনে কাজে লাগানোর জন‍্য দান করে গেছেন। তাঁর পূর্বসূরি মেয়র, অপিচ মুখ‍্যমন্ত্রী, উপরন্তু ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়-ও যা পারেননি! এই হিসেবে তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা জানাতেই হয় : স্বাস্থ‍্যমন্ত্রী তো এমন-ই আদর্শ রেখে যাবেন! এবছর তাঁর জন্ম শতবর্ষ। জানি না তাঁকে যথার্থভাবে স্মরণ করা হয়েছিল কিনা। তিনি জন্মেছিলেন ১৯২৩-এর পয়লা জানুয়ারি।

||সেইসব দিনরাত্রি||

কলোনিতে টিউবওয়েলের জল রান্না ও স্নান-খাওয়া, বাসনকোসন মাজা, কাপড়কাচায় ব‍্যবহৃত হত। পূর্ববঙ্গবাসীদের জীবনে অভিনব ছিল এটি, কেননা পূর্ববঙ্গে পুকুরের জলেই সারা হত এসব। এর ফলে দূষিত জলে কলেরা ও অন‍্যান‍্য জলবাহিত রোগে বহু মানুষের মৃত‍্যু-ও সেখানে। মড়কে জনপদ উজাড় হয়ে যাওয়ার কথা লোকমুখে ও গল্প-উপন‍্যাসে পড়েছি আমরা। এই নতুনদেশে এসে জলের দূষণ এড়ানো গেলেও জলে নেমে সাঁতার কেটে স্নান না করতে পারার কষ্ট ছিল তাদের। আশেপাশের জলাশয়ে সেই ইচ্ছে পূরণ করার চেষ্টা ছিল। রানিকুঠির বিশাল দিঘি, লায়েলকার দিঘি, গল্ফ ক্লাবের পুকুরগুলি ছিল সন্তরণ-স্নানের যোগ‍্য জায়গা। কাপড়চোপড় কাচার জন‍্য যেহেতু প্রচুর জলের দরকার হয়, সেজন‍্য দেখতাম, গল্ফ ক্লাবের কাছে শীতলাতলা-সংলগ্ন পুকুরটিতে বাড়ির মহিলারা গিয়ে কাপড় কেচে আনতেন। ওটি ছিল বারোয়ারি পুকুর। কলোনিবাসীরা পূর্ববঙ্গীয় বলে তরুণ ও বয়স্ক নারী-পুরুষের সাঁতারে পারঙ্গমতা ছিল। মা যখন আমাকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে যেত, দেখতাম, কী অনায়াসে মা গঙ্গায় সাঁতার কেটে নাইছে! হায়, সাঁতার শেখা হয়নি আমার কোনওদিন! আমার জন্ম যে দেশভাগ-পরবর্তী কলকাতায়!

টিউবওয়েল দু-ধরনের। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ঘরোয়া প্রয়োজনে যে জলের কল, তা দু-তিনটে পাইপের। আর প্রতি পাড়ায় বারো-চোদ্দোটা পাইপের যে কল, তাকে বলা হয় ডিপ টিউবওয়েল (জনতার ভাষায় ‘টিউবয়েল’!)। সে-জল ব‍্যবহৃত হত রান্না ও পানের জন‍্য। কলসি করে সে-জল মহিলারা নিয়ে আসতেন। কোনও কোনও পাড়ায় ডিপ টিউবওয়েলে মুসুরডাল সিদ্ধ হতে চাইত না। তাই অন‍্য পাড়া থেকে আগত গিন্নিদের কাছে অবধারিত প্রশ্ন ছিল, তাদের কলের জলে মুসুর ডাল সিদ্ধ হয় কি না। জল আনতে সচ্ছল পরিবারে ভারী রাখা হত। তারা সাধারণত উড়িষ‍্যাবাসী। কাঁধে টিন নিয়ে (এর আগের যুগে নগর কলকাতায় উত্তর ভারতের লোকজন পশুর চামড়ায় তৈরি মশকে জল সরবরাহ করতেন। আমাদের এখানে তার চল ছিল না। ষোলো কেজি সরষের তেল ধরে, এমন দুটি টিনের পাত্রে জল বয়ে আনতেন ভারীরা। এখন টিনের পাত্রের বদলে ব‍্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিকের পাত্র। দুই পাত্র=এক ভার। অনেকের বাড়িতে দিনে দু-ভার বা তার-ও বেশি জল লাগত। আধা ভার-ও (এক টিন) নিত কেউ।

এই সূত্রে ভারীর মতো অন‍্য কয়েকটি পেশাজীবীর কথা বলে নিই। খবরের কাগজ বিক্রেতা, শীতের মরশুমে খেজুর গুড়, অন‍্য সময়ে তালের, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঝাঁটা বিক্রির লোক ছিল যেমন, তেমনই ছিল নারকেল পেড়ে নারকেল গাছের পাতা সাফসুতরো করে দেওয়ার লোক (পুব বাংলার মানুষ নারকেল-অন্ত প্রাণ। তাদের রান্নায় নারকেল,— বড়া ভাজা, চিংড়িতে, থোড়ে, মুগ ডাল-ছোলার ডালে, কোথায় নয়? মুসুর ডালের সঙ্গে কাগজি লেবু আর নারকেল দিয়ে দিব্বি খেয়ে নিয়ে ঢেঁকুর তোলায় ওস্তাদ তারা। আছে নাড়ু, নারকেল-দুধের পায়েস, নারকেল আর গুড় অথবা চিনি মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে দিয়ে পাটিসাপটার পুর, এমন শত রান্নায় নারকেলের ব‍্যাপ্ত ব‍্যবহার। শীতকালে নারকেল আর খেজুর গুড়-সহ চিতই পিঠে না খেলে তার বাঙ্গাল নাম-ই বৃথা! মুড়ির সঙ্গে নারকেল যেমন স্বাদু আহার্য, তেমনি চিঁড়ের সঙ্গে-ও। আছে নারকেলের জল, নরম অংশ, যাকে বলে ল‍্যাওয়া, নারকেলের ফোঁফরা), গাছের বাড়বৃদ্ধি হলে তা কেটে ফেলার জন‍্য লোক, উঠোনকে ঘাস ও আগাছামুক্ত করার লোক, পুরনো খবরের কাগজ বিক্রেতা, পুরনো জামাকাপড়ের বদলে প্লাস্টিকের বালতি বিক্রেতা, যারা আবার মূলত গুজরাতি মহিলা। সেইরকম উত্তর ভারত থেকে আসা কিছু চানাচুর বিক্রেতাকে দেখতাম অসম্ভব পরিষ্কার সাদা পোশাক পরে আসতেন। সুদূর আফগানিস্তান থেকে আসতেন যারা, যেখানকার লোক-ই হোক, আমরা বলতাম কাবুলিওয়ালা, (যেমন রাজস্থান-বাসীদের আমরা ‘মারোয়াড়ি’ বলতে অভ‍্যস্ত, বা উত্তর ভারতীয়দের ‘হিন্দুস্থানী’) সংক্ষেপে কাবুলি, হিং আর পেস্তা, আখরোট নিয়ে। পরে তারা সুদের ব‍্যবসায়ে নামে। কাশ্মীর থেকে শাল নিয়ে আসত একদল, যাদের দৌলতে ঘরে ঘরে কাশ্মীরি শালের ব‍্যবহার শুরু হয়। এদের ব‍্যবসার পদ্ধতি ছিল অভিনব। মাত্র পাঁচ বা দশ টাকা দিয়েও শাল কেনা চলত। বাকিটা চার-ছ’মাসের কিস্তিতে, ওদের দেশে ফিরে যাওয়ার আগে। আশ্চর্য, এদের টাকা কখনও কেউ মারেনি।

ছিল বানর ও ভালুক নিয়ে খেলা দেখাতে আসার লোক। সাপুড়েরা সাপ খেলা দেখিয়ে যেত। ভয়-ভীতি-আতঙ্ক নিয়েও সে-খেলা দেখতে ছাড়ত না কেউ।

কলোনির মানুষ গোড়ায় কাঁচা পায়খানা ব‍্যবহার করত। দুমাস-তিনমাস অন্তর তা পরিষ্কার করতে হত বলে মেথরের দরকার হত। দেখতাম, এই নিদারুণ কাজ তারা কেমন অবলীলায় করে। আরও আশ্চর্য, উত্তর ভারত থেকে আগত এরা মৃত ছাগলের মাংস খেত। আমাদের প্রতিবেশী একজনের ছাগল মারা যেতে এদের খবর দেওয়া হয়। এরা এসে ছাগলটি নিয়ে যাওয়ার সময় প্রশ্ন করে জেনেছিলাম। মানুষের কী অদ্ভুত জীবন! একদল মানুষকে আসলে অবমানব করে রেখেছি সমাজের প্রতিভূ ও শোষক, সুবিধেভোগী শ্রেণী!

পরবর্তীতে বাংলাদেশে এসে একটি তথ‍্য জেনেছি। এখানেও বরাবর মেথর-ধাঙড়ের কাজ করে এসেছে উত্তর ভারত থেকে আসা এসব মানুষ। দেশভাগের ফলে তাদের আসাও বন্ধ হয়ে গেল। বাঙালি হিন্দু বা মুসলমানদের মধ‍্যে এই পেশা অকল্পনীয়। তাই নেহরুর সঙ্গে চুক্তিক্রমে আয়ুব খাঁ নাকি বেশ কিছু মেথরকে এদেশে আনিয়েছিলেন। গরজ বড় বালাই! ঢাকায় এরকম একজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমার। ওদের নিজস্ব মহল্লা আছে। পুজো-আচ্চা হয় নিজেদের পদ্ধতিমতো। এখন সেখানে সহস্র লোকের বাস। বাংলাদেশের অন‍্যান‍্য স্থানেও আছে। এখন বাংলা-ই ওদের মাতৃভাষা। তবে সামাজিক আচার, বিয়েশাদি এখনও ওদের মতো করেই হয়।

||কত অজানারে||

কলোনির মানুষ কথায় কথায় প্রবাদ ব‍্যবহার করত। বাঙ্গালদের এটি একটি প্রবণতা, পশ্চিমবঙ্গীয়দের নেই। হরহামেশা সবার মুখে প্রবাদ-প্রবচন শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, নিজেও লাগসই ব‍্যবহার করেছি। এরকম কতগুলি প্রবাদের তালিকা পেশ করছি।
১. আটকিলে মাসিমা, ফসকিলে কিছু না।
২. যারে দিয়া রামার মা, তারে তুমি চেনলা না।
৩. মায়ের দিয়া (থেকে) বেশি মায়া, তার নাম রাক্ষসিয়া মায়া।
৪. বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলেন পরিচীয়তে।
৫. কোথায় রানি রাসমণি, আর কোথায় পেল্লাইদয়ার মা!
৬. আলস‍্য বাঁচিয়া থাকলে দুঃখের অভাব হয় না।
৭. ঢেঁকির লক্ষ্যে নবান্ন।
৮. একমাস রোজা স্বীকার, একদিন একাদশী না (এটি মুসলমানদের প্রতি ব‍্যঙ্গ। তারা রোজা রাখেন, অর্থাৎ একবেলা, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপোস থাকেন। হিন্দুদের একাদশী পালনের মতো তা চব্বিশ ঘণ্টা প্রলম্বিত নয়। অর্থাৎ চব্বিশ ঘণ্টার উপবাসটাই যেন যথাযথ উপবাস। অন‍্য ধর্মকে যতটা যেভাবে হেয় করা যায় আর কী!)।
৯. কার গোরু, কে দেয় ধোঁয়া!
১০. তে মাথারডে পরামর্শ লবা (বৃদ্ধ ব‍্যক্তির দুই হাঁটুকে দুটি মাথার সঙ্গে কল্পনা করা হচ্ছে। প্রকৃত মস্তিষ্ক+ দুই হাঁটুতে, অর্থাৎ তিন মাথা)।
১১. বিয়া করিয়া ব‍্যাভার (উপহারাদি) পাইলা কী? কল্কি হারাইছি (নিহিতার্থ : এক বৃদ্ধ বিয়ে করে ঘরে ফিরে এলে প্রতিবেশী তাকে শুধোয়, বিয়েতে কী কী উপহার জুটল। উপহার তো জোটেইনি, বরং তার ব‍্যবহৃত তামাক খাওয়ার কল্কেটাই চুরি গেছে!)।
১২. পিতৃপুরুষের সোগা নাই, উদ্ধার করিয়া পাদে। (সোগা= পাছা। অস‍্যার্থ, নিজের তো নেই-ই, বংশানুক্রমে পাছাহীন! তবু পাদ দেবার শখ। তাই অন‍্যের পাছা ধার করে শখ পূরণ করার বাসনা! অপূর্ব ব‍্যঙ্গ নিঃসন্দেহে।)।

এরকম আরও আছে। এগুলো বাঙ্গালদের নিজস্ব ব‍্যবহৃত জিনিস, জেমস লং বা সুশীল দে-তে লভ‍্য নয়। সরস বাক‍্য ব‍্যবহার, বাক‍্যের মধ‍্যে বিচিত্র তৎসম শব্দের প্রয়োগ, এসব বাঙ্গালদের বাচন-বৈশিষ্ট্য।

আবার নিতান্ত আঞ্চলিক শব্দ-ও ছিল। যেমন হাইৎনা= বারান্দা। ওসসার ঘর= রান্নাঘর। লম্ফ= ল‍্যাম্প। ড‍্যানা= হাত (উদাহরণ— পোলাডার ড‍্যানা ধরিয়া টান দিছে)। লাকড়ি= কাঠ। লাকড়িঘর= কাঠ আর কয়লা রাখার স্থান। এটা বরিশালের লোক ব‍্যবহার করত না, শুনেছি নোয়াখালির লোকদের মুখে। হুড়ুম= মুড়ি। এটি ইতরজনের মুখে উচ্চারিত হত। সোগা= পাছা। চুবি দেওয়া= লুকিয়ে দেখা। নরলি= গলা। হুনিয়ারি (বুদ্ধি)= সূক্ষ্ম বুদ্ধি। জামাই= বর। অবিয়াতো= অবিবাহিত। পিডুয়া= পিঠের দিক। কোলের মাছ= পেটির মাছ। হাডর= ঝামেলা। লজ্জৎ (করে খাওয়া)= তৃপ্তি। ছ‍্যাপ= থুথু। উবাডু (হয়ে বসা)= হাঁটু মুড়ে। মেকুর= বেড়াল। খাড়া ঝিলকি= বিদ‍্যুৎচমক। চক্ষু উলটাইছে= মারা গেছে। সলিট (চুড়ি)= নিখাদ সোনার (Solid থেকে)। জাগ-পরি= রাত জেগে (রোগীকে) পাহারা দেওয়া। স‍্যাবা= প্রণাম। ইচা মাছ= চিংড়ি। পশুতি ভাত= সকালে জল দিয়ে রেখে রাতে যে-ভাত খাওয়া হয়। রাতে ভিজিয়ে পরদিন যে-ভাত খায়, তাকে বলে পান্তা ভাত। উজাগর= রাত জাগা (সাধারণত রোগীর জন‍্য)। শব্দটিকে জীবনানন্দ মান‍্যতা দিয়ে গেছেন, ‘নীল মৃত‍্যু উজাগর’ লিখে। ‘তুতারের বাজি’ শব্দটা পেয়েছি, কিন্তু এ-যাবৎ অর্থোদ্ধার করতে পারিনি এর। মিডুয়াম সুর= মিঠে গলায় বলা। রামরাজ‍্যের চৌকোনা ব‍্যার (বেড়) দেওয়া= অযথা বাড়াবাড়ি করা। ভোদাই= বোকা। (শব্দটির একটি অশ্লীল অর্থ-ও আছে। তবে সেই অর্থে ব‍্যবহার হয় না। এরকম ‘শালা’ শব্দ-ও প্রকৃতপ্রস্তাবে অশ্লীল। কিন্তু সর্বদা শব্দটি, বা অনুরূপ অপশব্দ ‘বাঞ্চোৎ’ ব‍্যবহারে প্রায়শ অশ্লীলতার ইঙ্গিত থাকে না। গুরুজনদের সামনে লঘুজনরা ‘শালা’-কে বাঁকিয়ে বলে দুই কুল রক্ষা করে,— ‘সাটি’। হাডিবিডি= ব‍্যাকুল হয়ে অনুরোধ। হাবিজাবি= যা তা। বেক্কুরা দেওয়া= ম্রিয়মাণ হয়ে পড়া। বাত্তি বা বাতি= লেবুর ভেতরকার বর্জ্য অংশ।

‘খাই লই একত্তর, সপপন দেহি জুদা’। এই প্রবচনটিতে ‘জুদা’, এই শব্দটি কীভাবে জুড়ে এসে বসেছে যেন।

অতিথি বিদায় নেবার সময় ‘আসি’ বললে তার উত্তরে গৃহকর্তা বলবেন, ‘যাওন নাই। আসো যাইয়া’। রাতে সাপ উচ্চারণে ট‍্যাবু। বলতে হবে ‘লতা’। তেমনি দোকানদারকে রাতে খয়ের চাইলে বেচবে না। খদ্দেরকে ‘পানের তিতা’ চাইতে হবে। কারও বসন্ত হলে বলা হবে ‘মায়ের দয়া’। এ-রোগটি দেবী শীতলার এক্তিয়ারে। বছরে একবার শীতলা ও তাঁর সমান ভয়ংকরী দুই দেবী কালী ও মনসার পুজো হত পাড়ায়। শ্রাবণ সংক্রান্তির মনসাপুজোর বাইরে এটা, লক্ষ্মীপুজো-পরবর্তী অমাবস‍্যার কালীপুজো অতিরিক্ত। বছরে বেশ কয়েকটি কালীপুজোর বিধান আছে। রটন্তী কালীপুজো। এই রটন্তী কালীর আরাধনা অমাবস‍্যায় না, চতুর্দশীতে। ‘রটন্তী’, কিনা রটিত। কী রটেছিল এই কালীকে নিয়ে? একদা রাধা কৃষ্ণ-অভিসারে গেলে তার দুই ননদ জটিলা-কুটিলা ভাইকে খবর দেয়। ভাই আয়ান কুঞ্জগৃহে এসে দেখেন, তার দয়িতা রাধা তার প্রিয় দেবী কালীর ধ‍্যানে তন্ময়। আপ্লুত আয়ান স্ত্রীর এই কালীভক্তি রটিয়ে বেড়ালেন। এইভাবে কৃষ্ণে-কালীতে মিলিয়ে দিলেন পুরাণকার। আজ-ও দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির সহ বহু মন্দিরেই মাঘমাসের চতুর্দশী তিথিতে রটন্তী কালীপুজো হয় কালী ও শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি সামনে রেখে।

তেমনি আছে পৌষ-কালীর পুজো, অর্ধকালীর পুজো, ফলহারিণী কালীপুজো, দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, সিদ্ধ-কাম‍্যা-গুহ‍্য-চামুণ্ডা। আছে দশহাতের মহাকালী। রক্ষাকালী আবার দুর্গার মতোই সিংহবাহনা।

কালীপ্রসঙ্গ এ-পর্যন্তই।

||ধর ধর ওই চোর ওই চোর||

একটা সমাজে চোর থাকবে না, তা কি হয় কখনও? চোর, উন্মাদ, ভবঘুরে, মাতাল, সাধু, জড়বুদ্ধি, সারা বিশ্বে, ভারতে, বঙ্গে, এবং কলোনিতেও।

আপাতত চোরদের কথা লেখা যাক। পেশাদার আর শৌখিন, চোরের এই দুই ভাগ। দুই কিসিমের চোর-ই আমাদের পাড়ায় ছিল। পেশাদার চোর নিজের পাড়ায় কখনও চুরি করত না। আর ধরা পড়ে হাজতবাস করতে হত বলে মাঝেমাঝেই দেখতাম না তাদের। অ-পেশাদারদের দেখতাম। ধরা পড়ত তারাও। তবে প্রতিবেশী বলে কথা! চড়চাপড় মেরে, অভিভাবকদের ডেকে এনে তাদের হাতে সোপর্দ করে দেওয়া হত তাদের।

আমাদের পাড়ার পেশাদার চোর ধরা পড়ত অন‍্য পাড়ায়, আর অন‍্য পাড়ার চোর আমাদের পাড়ায়। ছোটবেলায় এরকম দুজন চোরকে ধরার পর কী কঠিন শাস্তি দিয়েছিল পাড়ার লোক, তা চাক্ষুষ করে স্তম্ভিত হয়ে গেছি।

একবার ভোরবেলা বাড়ির লোকের হৈহট্টগোল শুনে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বিশেষ খবরটি শুনলাম, চোর ধরা পড়েছে পাড়ায়। দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এলাম। চোরকে সে-মুহূর্তে আমাদের রাস্তার গলি দিয়ে নিকটস্থ মাঠে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। খালি গা, কোঁকড়ানো চুল, মারের চোটে তখন-ই নেশাগ্রস্তের মতো টলছে সে। যারা ধরে নিয়ে আসছে চোরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে, কিল চড় ঘুষি চালিয়ে যাচ্ছে সমানে। তারপর তাকে মাঠে যে ক্লাব, সেখানকার এক খুঁটিতে জবরদস্ত করে বাঁধা হল। এরকমভাবে বাঁধবার প্রক্রিয়া একদল লোকের জানা থাকে, অথবা সদ‍্য আবিষ্কৃত হয়। আর সক্কালবেলা যে কেউ কাউকে শারীরিক বলপ্রয়োগে নিবেদিতপ্রাণ হতে পারে, ওইদিন ওরকম দৃশ‍্য না দেখলে ধারণাও করতে পারতাম না। নিতান্ত গোবেচারা যে, সে-ও মৃদু দু-চারটে কিল মারতে ছাড়েনি। অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব মানুষের!

যাই হোক, চোরের ভাগ‍্য ভাল, পাড়ার কিছু বিবেচক মানুষের হস্তক্ষেপে চোরের ওপর নির্যাতন বন্ধ হয়। পুলিশে খবর দিলে পুলিশ এসে তাকে থানায় ধরে নিয়ে যায়।

পরে যে চোরকে ধরা হয়েছিল, এ-ঘটনার বছর ছয়-সাত বাদে, তার ওপর অত‍্যাচার করা হয়েছিল নিষ্ঠুরতমভাবে। প্রাথমিকপর্বে জুতোর মালা পরিয়ে দেওয়া হল তাকে। তারপর যথেচ্ছ প্রহার, দাঁত খসে পড়ল তাতে কয়েকটা। তাতেও অতৃপ্ত জনতা হাতুড়ি দিয়ে আঙুলগুলো থেঁতলে দিয়েছিল তার। এ-কাজ করেছিলেন আমাদের পাড়ারেই এক পুলিশ-চাকুরে। শেষে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন বাদে সেই চোরকে দেখেছি, গড়িয়ার ব্রিজে ভিক্ষে করছে। এমন নিষ্ঠুরতার কি প্রয়োজন ছিল?

আমাদের পাড়ার এক ছিঁচকে চোরকে চোর না বলে চৌরশিল্পী বলা উচিত। আমাদের কাছে পয়সা চেয়ে নিয়ে মুহূর্তে হাপিস করে দিত। কারও বাড়ির লক্ষ্মীর ঘট চুরি করছে আজ, তো কাল কাপড় কিংবা জুতো, দিনমানে, ঘরে ঢুকে, গৃহস্থের অন‍্যমনস্কতার সুযোগে। শুনেছি বিয়ের রাতে শ্বশুরের রিস্ট ওয়াচ আর পাঞ্জাবির সোনার বোতাম-ও চুরি করেছিল। ধ্রুপদী ও আত্মপর-নিরপেক্ষ চোর, নিঃসন্দেহে।

পাড়ায় মহিলা-চোর ছিল দুজন। ধরা পড়লে মারধোর দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হত। এবং তারা চুরি করত আবার, আবার, আবার!

ব‍্যর্থ চোর-ও ছিল, ব্রিফলেস ব‍্যারিস্টার যেমন। চোরের বদনাম নিয়েই জীবন কাটল তার, চুরিতে সাফল‍্য আসেনি একবারও।

চুরি হয়েছিল আমাদের বাড়িতে একবার। ভয়াবহ চুরি। বড়দার বিয়ে হয়েছে এক বছর-ও হয়নি। দাদা তখন রেলের চাকরি-সূত্রে পুরুলিয়ায়। চোর এসে আলমারি থেকে বউদির গয়না থেকে শুরু করে বাসনকোসন, শাড়ি, জামা, হেন জিনিস নেই চুরি করেনি। কাঁচা বাড়ি। সিঁদ কেটে ঢুকেছিল চোর। ওরকম চুরি পাড়ায় আর কারও হয়নি। তবে কমবেশি চার-পাঁচটা সিঁদ কেটে চুরির ঘটনা ঘটেছিল পাড়ায়।

আমাদের মতো ছোট্ট পাড়ায় নারী-পুরুষ মিলিয়ে জনা-সাতেক চোর ছিল। অবশ‍্যই চোরসমৃদ্ধ, চৌরগৌরবে গৌরবান্বিত পাড়া!

চোর নিয়ে নাটক অভিনয় করেছে পাড়ার নাট‍্যামোদীরা। ‘ক্ষুধা’। গঙ্গাপদ বসুর লেখা। ইতি চৌরপর্ব সমাপ্ত।

ভবঘুরেও দেখা গেছে কলোনিতে। প্রত‍্যক্ষ ও পরোক্ষ ভবঘুরে। বস্তুত দেশ হারিয়ে, ভিটেমাটি থেকে চিরকালের মতো উচ্ছিন্ন হয়ে অগণিত মানুষের কত বিচিত্র রকমের মানসিক বৈক্লব‍্য ও স্থিতপ্রজ্ঞার হানি ঘটেছিল, তার কোনও খবর নেওয়া হয়নি। অথচ গবেষণা করলে এ নিয়ে প্রচুর কৌতূহলকর তথ‍্য মিলতে পারত। সাদাত হোসেন মান্টোর সুবিখ‍্যাত গল্প ‘টোবা টেক সিং’-এ ধরা আছে যেমন।

যাই হোক, দেশভাগ ও স্বদেশচ‍্যুতি অনেকের মনে যেমন নতুন করে বেঁচে ওঠার আকাঙ্ক্ষা উসকে দিয়েছিল, কোনও কোনও মানুষকে করে ফেলেছিল চিরতরে হতোদ‍্যম আর ভাবলেশহীন, কিংকর্তব‍্যবিমূঢ়, অসাড়, জরদ্গব ও নিষ্ক্রিয়। দেখেছি, এদের মধ‍্যে একজন, সামর্থ‍্য থাকলেও না কায়িক না মানসিক, কোনও পরিশ্রম করতেন না। কাজের মধ‍্যে কেবল ঘরে বসে দিনাতিপাত, অথবা এর ওর তার বাড়ি চক্কর দিয়ে আসা। দিনের পর দিন নিরুত্তাপ কর্মলেশহীন জীবন কাটিয়ে গেলেন। স্ত্রী ছিল, ছিল দুই মেয়ে তিন ছেলে। ছেলেরা ব‍্যবসা করত। ইচ্ছে করলে তাদের সহকারী হতে পারতেন, সে মেধা তার ছিল। কিন্তু সংসারে কুটো গাছটিও নাড়েননি। বাজার-হাট করা, নাতি-নাতনিকে আদর করা বা তাদের নিয়ে একটু ঘুরতে বেরনো, না কেউ কদাপি দেখেনি। এমনকি নিমন্ত্রিত হয়ে উৎসব-বাড়িতেও যেতেন না তিনি। বলতেন, এসব তার ভাল লাগে না। স্বাস্থ‍্যবান সুপুরুষ এই মানুষটি উদ্বাস্তুজীবনটা পার করলেন কোনও কিছু ভাল না লাগার বৈভবে। এদের দেখলে দেশভাগের গভীর মর্মবেদনাটা প্রত‍্যক্ষ করা যায়।

আর এক ভবঘুরে মাঝেমাঝেই নিরুদ্দেশযাত্রা করতেন। কেউ জানত না, কোথায় তার এই নিয়মিত ও সাময়িক অজ্ঞাতবাস। ঘরবাড়ি ছিল তার, আপন ভাইয়ের গৃহে সসম্মান স্থান ছিল, ছিল ভাতৃবধূর শ্রদ্ধেয় ও শালীন পরিচর্যা। কিন্তু নিজের মুদ্রাগুণে আলাদা ছিলেন তিনি। পাড়ায় ফিরে এলেও কদাপি স্বগৃহে,— ভাইয়ের গৃহটি স্বগৃহ-ই তো তার-ও, থাকতেন না। থাকতেন আমাদের পাড়ায় যে শীতলাখোলা, তার এক কোণে। তার মুখে কথা শুনিনি, শোনেনি কেউ, শুধু বাঁশি শুনেছি। হ‍্যাঁ, সম্বল বলতে তার ছিল একটি ঝোলা ব‍্যাগ, আর সেই ব‍্যাগে তিন-চারটে বাঁশি। দিনে বাজাতেন না। রাতে, গভীর রাতে। সারারাত। যেহেতু শীতলামন্দিরটি আমাদের বাড়ির খুব কাছে, তাই ঘুম থেকে উঠে, আধা-ঘুমের মধ‍্যে, অথবা নিদ্রাকে ঘুম পাড়িয়ে, শুনতাম তার বংশীধ্বনি। নৈশ আকাশকে যেন ধৌত করে দিত তার বাঁশির সুর, আমার মতো সারা পাড়া মগ্ন হয়ে শুনত সে-সুরলহরী, আপ্লুত, বেদনার্ত, বিহ্বল হয়ে, কখনও বা হ্লাদিত, ইন্দ্রিয়রুদ্ধ, সুরলোকবাসী হয়ে। এ যেন অন‍্য এক হ‍্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা, যার মরমী বেণুরব মধ‍্যযামিনীকে ভরিয়ে তুলতো অপরূপ মধুময়তায়। কেউ কখনও আপন্ন হয়নি সেই বাঁশির শব্দে, নিদ্রা ব‍্যাহত হচ্ছে বলে তাকে নিবৃত্ত করতে প্রয়াস পায়নি কেউ। বরং সেই বাঁশির সুর যেন মিউজিক থেরাপির মতোই নিরাময় ও শান্ত নিদ্রা নিশ্চিত করত সবার। জানি না, পাড়ার কত নববিবাহিত দম্পতি সেই আবহসঙ্গীতে হিয়ায় হিয়ায় জড়াতেন নিজেদের, কত বেসুরো কানকে সঠিক পরিচর্যা দিয়েছে সেই সঙ্গীত।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Amitabha Ray
Amitabha Ray
10 months ago

চমৎকার স্মৃতিচারণ।
একটি সংশোধনী প্রস্তাব। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাঁরা বাধ্য হয়ে পশ্চিম বঙ্গে চলে আসেন তাঁরা প্রকৃত অর্থে উদ্বাস্তু নন। বাস্তুহারা। উদ্বাস্তুদের জন্য কিছু আন্তর্জাতিক বিধি আছে। ভারত ভাগের পর যার সুবিধা পেয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা মানুষের জন্য উদ্বাস্তু বিধি মেনে সমস্ত সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। শুধুমাত্র সিন্ধ প্রদেশের বাস্তুচ্যুতদের জন্য গুজরাটের কান্ডলায় গড়ে ওঠে গান্ধীগ্রাম শহর। পাঞ্জাবের বাস্তুচ্যুতদের জন্য দিল্লির বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলা হয় নতুন নতুন জনপদ। পাশাপাশি বহু আন্দোলন-তদ্বিরের ফলে দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক এলাকায় ১৯৬০-এর দশকের শেষভাগে গড়ে ওঠা বাঙালি বাস্তুহারাদের মহল্লার সরকারি নাম ঈস্ট পাকিস্তান ডিসপ্লেসড কলোনি বা সংক্ষেপে ইপিডিপি কলোনি।
সংশোধন সম্ভব হলে ভালো লাগবে। তবে এই স্মৃতিচারণটির প্রভূত প্রচার প্রয়োজন।

Recent Posts

সুজিত বসু

সুজিত বসুর দুটি কবিতা

তারার আলো লাগে না ভাল, বিজলীবাতি ঘরে/ জ্বালাই তাই অন্তহীন, একলা দিন কাটে/ চেতনা সব হয় নীরব, বেদনা ঝরে পড়ে/ যজ্ঞবেদী সাজানো থাকে, জ্বলে না তাতে ধূপ/ রাখে না পদচিহ্ন কেউ ঘরের চৌকাঠে/ শরীরে ভয়, নারীরা নয় এখন অপরূপ/ তারারা সব নিঝুম ঘুমে, চাঁদের নেই দেখা/ অর্ধমৃত, কাটাই শীত ও গ্রীষ্ম একা একা

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বিশ্বকর্মার ব্রতকথা

বিশ্বকর্মা পুজোতেও কেউ কেউ বিশ্বকর্মার ব্রত পালন করে থাকেন। এমনিতে বিশ্বকর্মা যেহেতু স্থাপত্য ও কারিগরির দেবতা, তাই কলকারখানাতেই এই দেবতার পুজো হয়ে থাকে। সেখানে ব্রতকথার স্থান নেই। আবার কোন অলৌকিক কারণে এবং কবে থেকে যে এদিন ঘুড়িখেলার চল হয়েছে জানা নেই। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শহর ও গ্রামের আকাশ ছেয়ে যায় নানা রঙের ও নানা আকৃতির ঘুড়িতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার কখনও বাংলাদেশে পা রাখেননি!

ভাবতে অবাক লাগে, ‘৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ উত্তমকুমারকে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। টালিগঞ্জের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করেছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে। অন্যদিকে ববিতা, অলিভিয়া ও আরও কেউ কেউ টলিউডের ছবিতে কাজ করেছেন। ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার ও পরে গৌতম ঘোষ ছবি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশে এসে, কিন্তু উত্তমকুমারকে আহ্বান করার অবকাশ হয়নি এখানকার ছবি-করিয়েদের।

Read More »
নন্দিনী কর চন্দ

স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্দরমহলে: কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি

বিস্মৃতির অতলে প্রায় তলিয়ে যাওয়া এমন কয়েকজন মহিলা কবির কথা আলোচনা করব, যাঁরা তাঁদের কাব্যপ্রতিভার দ্যুতিতে বাংলা কাব্যের ধারাকে উজ্জ্বল ও বেগবান করে তুলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষ্ণকামিনী দাসী, মোক্ষদায়িনী দেবী, প্রসন্নময়ী দেবী, লজ্জাবতী বসু, জগন্মোহিনী দেবী, গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী, হিরণ্ময়ী দেবী, অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্ত, সুরবালা ঘোষ প্রমুখ।

Read More »
মোহাম্মদ কাজী মামুন

বালকেরা অচেনা থাকে : এক অবিস্মরণীয় পাঠ অভিজ্ঞতা

ঘাসফুল নদী থেকে প্রকাশিত ‘বালকেরা অচেনা থাকে’ গল্পগ্রন্থটি যতই এগোনো হয়, একটা অনুতাপ ভর করতে থাকে পাঠকের মনে— কেন আগে সন্ধান পায়নি এই অমূল্য রত্নসম্ভারের! হ্যাঁ, রত্নসম্ভারই, কারণ একটা-দুটো নয়, প্রায় দশটি রত্ন, তাও নানা জাতের— লুকিয়ে ছিল গল্পগ্রন্থটির অনাবিষ্কৃত খনিতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাইশে শ্রাবণ ও বৃক্ষরোপণ উৎসবের শতবর্ষ

কবির প্রয়াণের পরের বছর থেকেই আশ্রমবাসী বাইশে শ্রাবণকে বৃক্ষরোপণ উৎসব বলে স্থির করেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই দিনটিই এ-উৎসবের স্থায়ী তারিখ। বাইশের ভোর থেকেই প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় উৎসব। সকালে কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা বিচিত্রভাবে একটি পালকি চিত্রিত করেন ছবি এঁকে, ফুল, লতাপাতায়। মঙ্গলধ্বনি দিতে দিতে এর পর পালকির ভিতরে টবের মধ্যে একটি চারাগাছকে স্থাপন করা হয়। অতঃপর শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গীত-পরিবেশন-সহ আশ্রম-পরিক্রমা।

Read More »