র বা র্ট অ লে ন বা ট লা র
অনুবাদ : মানবসাধন বিশ্বাস
গত রাতে হো চি মিন আমার কাছে আবার এসে হাজির। তার সারা হাতে কনফেকশনার সুগারের মিহি গুঁড়ো। এ আমার কাছে নিশ্চয়ই তাজ্জব হওয়ার মতো ব্যাপারই বটে। পর্দা তোলা জানলার আবছা আলোয় এই প্রথম তাকে আমার বিছানার পাশে দেখলাম। বড় মেয়ে ওরকম আলোর জন্যে পর্দা তুলে রাখে। মনে হয় এই কারণে যে, সকালে আবার সূর্য উঠেছে— একথা যেন আমি না ভুলি। আমি একজন অতি বৃদ্ধ মানুষ। মনে হয়, মেয়ের ভয়, কোনও একদিন সকালে আমি হয়তো বেঁচে থাকাই ভুলে যেতে পারি। এ ভীষণ বোকা বোকা চিন্তা। একদিন রাতে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে তার ঘরে চলে যেতে পারি, তার ঘরের জানলার পর্দাও তুলে রাখতে পারি; সকালের সূর্যটা সেই দেখুক না। তার বয়েস এখন চৌষট্টি, সুতরাং তাকে তার নিজের জন্যেই উদ্বিঘ্ন হওয়া উচিত। ভুলে যাওয়া রোগে আমি মরতেই পারি না।
তবে জেগে ওঠার পর দেখলাম রাস্তা থেকে যে আলো আসছিল, হো-কে চেনার পক্ষে সেটাই যথেষ্ট ছিল। সে আমায় বলল, ‘ডাও, পুরনো বন্ধু আমার, শুনলাম তোমাকে দেখতে আসার এখনি সময়।’ সে যে আসছে, এমন শুভ বার্তা ওই প্রথম রাতেই পেয়েছি। এমনকি তার হাত আমার নজরে আসার আগে থেকেই বার্তাটা খুব জোরালো ছিল। তাকে আমি কিছু বলিনি, বিছানার পাশের টেবিলের দিকে হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে নিয়েছিলাম; দেখতে চাইছিলাম, সে চলে গেল কি না। সে যায়নি। সে আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছিল। জানলার প্রতিফলনে আমি সত্যিই তাকে দেখলাম। কেননা, যেমনটি তাকে আগে দেখেছি, সে তখনও হো চি মিন হয়ে ওঠেনি। সেটা ছিল ১৯১৭। সে ছিল নুয়েন আই কুয়োক। আমরা দুজনেই তখন নবীন যুবক, দাড়িগোঁফ রাখতাম না কেউই। খুব ভাল বন্ধু ছিলাম আমরা। লন্ডনের কার্লটন হোটেলে কাজ করতাম। আমি ডিশ ধোয়ার কাজ করতাম, সে ছিল স্বনামধন্য শেফ এস্কোফিয়ের অধীনে প্যাস্ট্রির কারিগর। দারুণ অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলাম আমরা। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একসঙ্গে জীবনে সেই প্রথম বরফ পড়া দেখেছি। ওটা ছিল হোটেলের কাজে ঢুকে পড়ার আগের কথা। বেলচা চালিয়ে রাস্তায় জমে যাওয়া বরফ তুলেছি। হো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জোরালো একটা দম ছেড়ে নিজেই হেসে ফেলত, তার শরীরের ভেতরে কিছু ঢুকল কিনা সেটাই তলিয়ে দেখার চেষ্টা করত। এ যেন কোনও মন্ত্রপড়া হাড় ছুড়ে ভবিষ্যৎ গোনার চেষ্টা।
সেই প্রথম রাতে সে আমার নিউ অরলিয়েন্সের বাড়িতে এল। প্রথমে না হলেও শেষে বুঝেছি, একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে যে জিনিসটা, সেটা আসলে কী। তাকে বললাম, ‘তোমার সারা হাতে সুগার।’
সে বিমর্ষমনে তার হাতের সুগারের গুঁড়োর দিকে চেয়ে রইল।
আমি ঠিক এই চেহারাতেই গত সপ্তাহে তাকে স্বাগত জানিয়েছি। এবার আমার পরিবারের লোকজন আর বন্ধুবান্ধব যে ক’জন এখনও জীবিত, তাদের সঙ্গে শেষ দেখাসাক্ষাতের সময় হয়েছে। ভিয়েতনামে আমাদের এই হল রীতি। কেউ অতি বৃদ্ধ হয়ে গেলে সপ্তাহদুয়েক সময় জীবনের কাছের মানুষদের স্বাগত জানানোর জন্যে রাখা হয়। এর সাহায্যে জীবনের দেনাপাওনার অনুভব ভাগ করে নেওয়া যায়, বা বলা যায় নিজেদের মধ্যে পরস্পরকে বোঝার সুযোগ মেলে, কিংবা এককথায়, শেষবিদায় জানানো যায়। এটাই হল শেষবিদায়ের একটা আনুষ্ঠানিক দস্তুর। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে, একেবারে শেষের সেই অসুস্থতায় শুয়ে পড়ার আগেই এটা করণীয়। আমি তো মোটামুটি একশো বছর বাঁচলাম। কেবলই মনে হচ্ছিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আরও আগেই ওদের ডেকে নেওয়া উচিত ছিল। শেষমেশ এখন একেবারে বেজুত শরীরেই দিন কাটছে। আমার বড়মেয়েকে বলেছি, এখনি সেই সময়।
ওরা এখন আমায় বিমর্ষমুখে চেয়ে দেখে, অন্তত ওদের কেউ কেউ। সাধারণত এদের মাথা তেমন খেলে না, বা অনেকেই অবিশ্বস্ত। তবে হো-কে দেখলাম, সে সেরকম একেবারেই নয়। সে কমবুদ্ধির লোক নয়, অবিশ্বস্ত মানুষও নয়। সে তার হাত ভাল করে দেখতে লাগল। তারপর বলল, ‘এসব সেই প্যাস্ট্রির সুগন্ধি কনফেকশনার সুগারের গ্লেজ— ওস্তাদের সেই গ্লেজ।’
তার কণ্ঠস্বরে একচিলতে পেলব আকুলতা লক্ষ্য করলাম। আমার মনে হল, সে হয়তো কোনও সাহায্যের জন্যেই আমার কাছে এসেছে। তাকে বললাম, ‘মনে করতে পারছি না। আমি তো শুধু ডিশ ধুতাম।’ মুখের কথা ফুরোতে না ফুরোতেই মাথায় এল, ঠিক হল না, আমি বোকার মতো ভেবে বসেছি; আমার সঙ্গে সুগারের গ্লেজ নিয়ে কথা বলতে সে এখানে আসেনি।
হো কিন্তু আমাকে মোটেই সেরকম বোকাহদ্দ ভাবেনি। আমার দিকে চেয়ে সে মাথা নাড়ল। ‘সব ঠিক আছে’, সে বলল, ‘এখন সেই তাপাঙ্কের কথাও মনে পড়ল— দুশো তিরিশ ডিগ্রি। এই তাপে সুগার ‘বড় সুতো’-র দশা থেকে শেষ অব্দি ‘অর্ব্’ দশায় এলে চলে আসে গ্লেজ। আমার বেশ মনে আছে, এ বিষয়ে ওস্তাদ খুব হুঁশিয়ার ছিলেন; এখনও মনে আছে।’ যাই হোক, তার চোখ দেখেই আমি বুঝে নিলাম, এ বাদে আরও অনেককিছুই ছিল, যা এখনও তার কাছে অজানা রয়ে গেছে। আমার মুখের দিকে তার স্থিরদৃষ্টি একেবারেই সরল না, তবে তারই মধ্যে তার চোখ অল্পস্বল্প এদিকওদিক সরে যায়নি, তেমন নয়। তার মধ্যে একটা চিত্তচাঞ্চল্য ফুটে উঠেছে। এ শুধু আমিই দেখতে পেলাম, কেননা যখন সারা দুনিয়ার কেউ তাকে চিনত না, সেই তখন থেকেই আমি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম।
আজ আমি প্রায় একশো বছরের একজন বৃদ্ধ হলেও মানুষের মুখ এখনও বেশ পড়তে পারি, আর সেটা এখন বরং আরও বেশি করেই পারি। আমি আজকাল আমার লিভিংরুমে একটা আরামের গদিআঁটা চেয়ারে বসে থাকি, দর্শনার্থীদের স্বাগত জানাই এখানেই। আমি আগ্রহের সঙ্গেই চাইছিলাম সবাই আসুক। যারা কমবুদ্ধির, যাদের বিশ্বাস করা চলে না, তারাও। ওদের এইভাবে বর্ণনা করার দোষে দোষী হলেও আমার মতো রগচটা বয়োবৃদ্ধ একজন মানুষকে মাফ করে দেওয়াই যায়। আমি চাই, সবাই শান্তিতে মিলেমিশে থাকুক। এক একটা ভিয়েতনামি পরিবার রক্তসম্পর্কের সুতোয় একে অপরকে একসঙ্গে বেঁধে রাখে। এ যেন অজস্র কাগজের লন্ঠনের গ্রামের সদর চত্বর ঘিরে ভিড় করে থাকা। এই লন্ঠনগুলোয় সবাই আলো জ্বেলে দেয় একসঙ্গে। এইভাবেই এটা আমাদের সংস্কৃতিতে বহমান। তবে যে সমস্ত লোকজন আজ বহুদিন হল এই আমেরিকায় বসবাস করছে, এখানে তারাই শুধু আসছে আমায় দেখতে। তাদের মুখ দেখেই বেশ বুঝতে পারছিলাম, হালে খুব অদ্ভুত কিছু ঘটনা এখানে ঘটে চলেছে।
আজকের চেয়ে অদ্ভুত সকাল আগে কোনওদিন দেখিনি। আমি বসেছিলাম গদির চেয়ারে। সেখানে আমার পরিবারের অনেক সদস্যের চারজনও ছিল : আমার জামাই থ্যাং, ভিয়েতনাম রিপাবলিক আর্মির একজন প্রাক্তন কর্নেল এবং আমার অবিশ্বস্ত মানুষদের একজন। সে আমার কাস্ত্রো কনভার্টিবল কোচে বসেছিল। তার ছোটছেলে লোই, পরে এল, মাত্র কয়েক মিনিট আগে। সেও গা ফেলে দিল সেই কোচে। সবচেয়ে ছোট হলেও, এক দশকেরও বেশি আগে দেশ যখন কমিউনিস্টদের হাতে চলে যায়, তখন সে তার বাবার অধীনে লেফটেন্যান্টের কাজ করেছে। আমার মেয়ে ল্যাম থ্যাংয়ের স্ত্রী, সে ওদের পেছনে পায়চারি করছিল। বসতে বললেও সে বসল না। আমার বড়মেয়ে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে সবেমাত্র আমার ঘর থেকে ফিরে এল, আমার ঘরের পর্দা তুলে রেখে এল। আমি সকালে উঠে সেটা নামিয়ে দিয়েছিলাম।
থ্যাং আমার দিকে বিষন্নচোখে চাইল। আমি এ জিনিসের সঙ্গে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ওই মুহূর্তে হয়তো সে ধরেও নিল, আমি খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছি। আমায় দূরের মানুষ ভাবছিল ওরা। ওদের চলতে থাকা ছোট ছোট টুকরো কথা কানে নেওয়াও বন্ধ রেখেছিলাম। চোখ আধবোজা করে রাখছিলাম। তা হলেও, সবাইকেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। রীতিমতো সজাগ ছিলাম। দেখলাম থ্যাংয়ের মুখে কোনও চাঞ্চল্য নেই, যদিও তার চোখ দ্রুত চলাফেরা করছিল। মনে হল, সে আসন্ন কোনও ঝঞ্ঝাটের মুখোমুখি হওয়ার জন্যে নিজেকে তৈরি রাখছে। আমি কিন্তু ওদের মুখ দেখে বরাবর এমন জিনিস আরও অনেক বেশি বিশদে পড়তে পারি, ওদের চোখেমুখে তেমন ফুটে না উঠলেও বেশ টের পাই। তাই যখন তারা দেখল, এই ঘরে আমার উপস্থিতি না থাকারই সামিল, তাদের চোখ ধীরে ধীরে চলতে থাকল, দ্রুত নয়। ছেলের দিকে ঝুঁকে পড়ে তার সঙ্গে সেই খুনের ঘটনাটা নিয়ে কথা বলতে লাগল সে।
আমাদের এটা বোঝা উচিত যে, আমাদের এই নিউ অরলিয়েন্সেই মিস্টার নুয়েন বিচ লে-কে গত সপ্তাহে গুলি করে খুন করা হয়েছে। নিউ অরলিয়েন্সে বহু ভিয়েতনামির বাস। তাদেরই একজন মিস্টার লে। উনি আমাদের জন্যে একটা ছোট খবরের কাগজ চালাতেন। সম্প্রতি ভদ্রলোক বড়সড় একটা ভুল কাজ করে ফেলেছিলেন। এ কাজ আমেরিকায় বসে করা উচিত হয়নি। তিনি লিখেছিলেন, ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট সরকারের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে তাদের আলোচনা শুরু করার এটাই প্রশস্ত সময়। আমাদের দেশটা যারা নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের সঙ্গে মিলে কাজ করাই সমীচীন ছিল। তিনি বলেছিলেন, তিনি এখনও প্রজাতন্ত্রী ভিয়েতনামের একজন নিবেদিত দেশপ্রেমিক। তাঁর ওপর আমার অবশ্যই বিশ্বাস ছিল। এ বিষয়ে কেউ কোনও বয়স্ক মানুষের মতামত চাইলে বলতাম, মিস্টার লে একেবারে সঠিক ছিলেন। এটুকু বলতে আমার একটুও ভয় নেই।
কিন্তু এই গত সপ্তাহে ভদ্রলোককে গুলি করে হত্যা করা হল। তাঁর বয়েস হয়েছিল পঁয়তাল্লিশ বছর। তাঁর স্ত্রী ও তিনটি বাচ্চার পরিবার। শেভ্রলেই পিক-আপ ট্রাকের হুইলের পেছনে বসেছিলেন তিনি। সেই অবস্থাতেই তাঁকে গুলি করা হয়। ঘটনাক্রম যা শুনলাম, তা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। ভদ্রলোক খুন হলেন তাঁর নিজের শেভ্রলেইয়ের মধ্যেই— যেটা পুরোদস্তুর আমেরিকান গাড়ি। এ গাড়ি আমরা সাইগনেও দেখেছি। সাইগনে শেভ্রলেই গাড়ির মালিকেরা একচেটিয়া সবাই আমেরিকান, যেমন ফরাসিদের ক্ষেত্রে শিথোয়েন।
নতুন সংস্কৃতিকে বিশ্বাস করে, আত্মস্থ করে, হয়তো আরও এককদম এগিয়েছিলেন মিস্টার লে। তিনি শেভ্রলেই শুধু কেনেননি, কিনেছিলেন আরও একটা জাঁদরেল শেভ্রলেই পিক-আপ ট্রাক, যা তাঁকে শুধুমাত্র একজন পাক্কা আমেরিকান নয়, তিনি হয়ে গিয়েছিলেন লুইসিয়ানারই একজন স্থানীয় মানুষ। লুইসিয়ানায় পিক-আপ ট্রাকের ছড়াছড়ি। যাই হোক, তিনি তা’বলে পেছনের জানালার বন্দুকের তাক বা গান-র্যাক, যেটা স্থানীয় হওয়ার আরও এক নমুনা, সে জিনিসটা কিন্তু কেনেননি। কিনলে হয়তো ভালই হত। কেননা পেছনের জানলা দিয়েই তাঁকে গুলি করা হয়। কেউ তাঁর ট্রাকের বেডে লুকিয়ে ছিল। শেভ্রলেইয়ের পেছনের ওই বেড থেকেই তাঁকে গুলি করে খুন করা হয়েছে। খবরের কাগজের অফিসে একটি ফোনকলে ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট বিরোধী জাতীয় পুনর্গঠন পার্টির এক অজ্ঞাতপরিচয় প্রতিনিধি এই কাজের কারণ জানিয়ে দিয়েছিল।
আমার জামাই থ্যাং তার ছোটছেলেকে বলছিল, ‘খুনের অস্ত্রপাতি কিছু নেই।’ তখন যেটা খেয়াল করলাম তা হল, কথাগুলো বলতে বলতে সে ভ্রূ তুলছিল। মনে হল, ছেলেকে কথাটার আড়ালে লুকোনো বার্তাটা বুঝে নিতে বলছিল সে। সে কথাটা আবার বলল। এবার আর একটু ধীরে। মনে হল, একটা কোডের মত কিছু : ‘খুনের অস্ত্রপাতি কিছু নেই।’ নাতি একবার মাথা নাড়ল চটজলদি। এরপরেই আমার মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বেশ জোরের সঙ্গে গলা উঁচিয়ে বলল, ‘সাংঘাতিক খবর, মিস্টার লে মারা গেছেন।’ সে তার স্বামী আর ছেলেকে হাল্কা ঠেলা দিতেই দুজনই খুব দ্রুত আমার দিকে ফিরে সোজাসুজি আমায় একঝলক দেখে নিল, তারপর চিৎকার করে উঠল, ‘হ্যাঁ, সাংঘাতিক!’
আমি বধির নই। ফের চোখ বুজে রইলাম, যথেষ্ট দেখেছি। ওদের জোরালো কথাবার্তা আমাকে জাগিয়ে রাখতে পারেনি, বরং প্রায় পুরোপুরি ঘুম পাড়িয়ে দিল। আমি চাইছিলাম, ওরা নিজেরাই ভেবেচিন্তে বুঝে নিক। আমি ওদের কোনওক্রমেই ঠকাতে চাইনি, যদিও এরই মধ্যে আমার পরিবারের এই সদস্যদের বেশ কটুকাটব্যও করেছি। আমি একজন হোওয়া হাও বৌদ্ধ। সেই হিসেবে সমস্ত জীবকুলের মধ্যে একটা সম্প্রীতির সম্পর্কে বিশ্বাস রাখি, বিশেষ করে আমাদের ভিয়েতনামি পরিবারের সমস্ত সদস্যের মধ্যে।
আমাদের সেই প্রথম সাক্ষাতে এস্কোফিয়ে’র গ্লেজের জন্যে প্রয়োজনীয় তাপাঙ্ক নিয়ে হো আমায় নিশ্চিন্ত করেছিল। সে বলেছিল, ‘ডাও, পুরনো বন্ধু আমার, প্যারিসে যা বেছে নিয়েছিলে, আজও কি তুমি সেই একই পথে হাঁটছ?’
সে আমার ধর্ম নিয়েই কথাটা বলেছিল। এ হল সেই প্যারিসের কথা, যেখানে আমি বৌদ্ধ মত গ্রহণ করলাম, সেই সঙ্গে হো’কেও হতাশ করেছি। ১৯১৮-র শুরুর দিকে আমরা ফ্রান্সে গিয়েছিলাম। তুমুল যুদ্ধ চলছে তখনও। আমরা শহরের সতেরো নম্বর আইডিসমোঁ এলাকার হতদরিদ্রতম অংশের একটা হতদরিদ্রতম রাস্তায় থাকতাম। নয় নম্বর ইম্পাস কম্পোয়া এলাকার এক অন্ধগলিতে, প্রায় ভেঙেপড়া সব পোড়োবাড়ির পাড়ায়। আমাদেরটা বাদে প্রায় সবক’টাই মালখানা হিসেবে ভাড়া দেওয়া হত। গলির রাস্তায় খোয়া আর ছাতের টুকরো টুকরো ভাঙা টালি যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকত। সেখানেই কুয়োক আর আমি দুজনে একটা করে ঘুপচি ঘরে থাকতাম। একটা করে লোহার খাটিয়া, আর বসার জন্যে একটা মালপত্র রাখার কাঠের পেটি। চর্বির মোমবাতির আলোয় ঘর থেকে বন্ধু কুয়োককে দেখতাম। ঘোর কালো একটা স্যুট, মাথায় চাপানো একটা বাউলার টুপি পরে থাকত সে। এই পোশাকে তাকে বড় বোকা বোকা লাগত। কোনও মন্তব্য করিনি, তবে হয়তো নিজেই সেটা বুঝত। সে বারে বারে বসত, টুপি রাখত আর অতি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ত, নিঃশব্দে রাগ চেপে যেত। এটা ছিল আমাদের একসঙ্গে থাকার প্রায় শেষের দিক, কেননা এর পর থেকেই আমি নিয়ম করে প্রতিদিন একজন বৌদ্ধ মহন্তের সঙ্গে দেখা করতে শুরু করেছি। তিনি আমায় বাবার ধর্মমতে ফিরিয়ে আনছিলেন। আমি বাবার কাছ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম, পাড়ি দিয়েছিলাম সমুদ্রে। এই সমুদ্রেই নুয়েন আই কুয়োকের সঙ্গে আমার পরিচয়। আমরা দুজনে চলে গেলাম লন্ডনে, তারপর প্যারিস। প্যারিসের তুইলো’য় একজন ভিয়েতনামি মহন্তের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তাঁর মারফতেই বাবা বারেবারে আমায় ফিরে আসতে বলছিলেন।
অন্যদিকে, তাকে এই কুয়োক সম্বোধনের শুরু পুরনো দিন থেকে নয়, তার ভবিষ্যৎ থেকে। সে কালো স্যুট আর বাউলার টুপি ভাড়ায় নিয়েছিল। পরের কয়েক সপ্তাহে ভার্সাইয়ে কাটিয়েছিল। সে ভার্সাইয়ের প্রাসাদের আরশিমোড়া করিডরে ঘোরাঘুরি করত উড্রো উইলসনের দর্শন লাভের চেষ্টায়। পশ্চিমের দুনিয়ার কাছে ইন্দো-চিন নিয়ে তার কিছু আর্জি ছিল। সাধারণ কিছু জিনিস, যেমন সমান অধিকার, জমায়েতের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদি। তার মনে হয়েছিল এই জরুরি বিষয়গুলো উইলসন নিশ্চয়ই বুঝবেন, কেননা সেগুলো তাঁর নিজস্ব চোদ্দ-দফা নীতির মধ্যেই ছিল। এমনকি স্বাধীনতার কথা তোলার ইচ্ছেও ছিল না কুয়োকের। সে চাইছিল, ফরাসি পার্লামেন্টে কয়েকজন ভিয়েতনামি প্রতিনিধি থাকুক। ওটুকুই ছিল তার আর্জি। কিন্তু ওই বাউলার টুপিই তার মেজাজ বিগড়ে দিল। জলে ভাসন্ত মোমবাতির ধাঁধাঁলো আলোয় সে পিছলে ছিটকে পড়ে গিয়েছিল। হাতদুটো বাউলার টুপি আঁকড়ে ছিল তখনও। অন্ধকারের আড়ালে তাকে বিড়বিড় করতে শুনেছিলাম। ভার্সাইয়ের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে তখনি আমার মনে হয়েছিল, এটা হয়তো একটা অশুভ সংকেত হতে পারে। পরে দেখা গেল, সে উইলসনকে পায়নি, লয়েড জর্জকেও পায়নি, এমনকি ক্লেমসোঁ-কেও পেল না শেষঅব্দি। আর যেভাবেই হোক, তার টুপি ঘিরে যে হতাশা, সেটাই আমায় বিমর্ষ করে তুলেছিল। সেই বিমর্ষতা আজও আছে। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে আমি তাকে বললাম, ‘হো কাকা, সব ঠিক আছে।’
সে তখনও আমার পাশেই ছিল। এ অবস্থায় যা আশা করা যায়, সেরকমভাবে জেগে ওঠার মতো কিছু ঘটেনি। এটি তেমন কোনও স্বপ্ন নয়, যার শেষ প্যারিসের ওই বাউলার-কাণ্ডে আর আমার জেগে উঠে দেখা যে, হো নেই। হো তখনও আমার বিছানার পাশে, যদিও আমার ধরাছোঁয়ার নাগালের বাইরে, তবে আমার আরও কাছে সরে আসেনি। তার মুখের এককোণে একটা মৃদু হাসি লেগে ছিল, সে হাসি পরিহাসে ভরা। যেন সেদিনের সেই রাতের কথাই সে ভাবছিল, যেদিন সে ভাড়ায় নেওয়া পোশাকটা পরে দেখছিল। সে বলল, ‘তোমার মনে আছে, প্যারিসে কীভাবে কাজ করেছি?’
আমি এ নিয়ে ভেবেছি, আমার বেশ মনে পড়ছিল। লা ভি অভ্রিয়া দৈনিক কাগজে ছাপা হল তার বিজ্ঞাপনের শব্দগুলো : ‘‘পরিবারের স্মৃতি আজীবন ধরে রাখতে আগ্রহী থাকলে অবশ্যই চলে আসুন ‘নুয়েন আই কুয়োক’স-এ, আপনাদের ফটোগুলোর সংস্কার করিয়ে নিন।’’ প্যারিসে এই ছিল তার কাজ। সে তার অতি সূক্ষ্ম হাতের কাজে ফটো সংস্কার করত। লন্ডনে থাকার সময়ে সেই নিপুণ সূক্ষ্মতাকে খোদ ওস্তাদ এস্কোফিয়েও প্রশংসা করতেন। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, মনে পড়ছে।’
হো গম্ভীরমুখে ঘাড় নাড়ল। ‘আমি রঙে ফরাসিদের গালদুটো সলজ্জ করে তুলতাম।’
আমি বললাম, ‘সুন্দর একটা ফ্রেমে সুন্দর প্রতিকৃতি মাত্র চল্লিশ ফ্র্যাঙ্ক।’
‘না, পঁয়তাল্লিশ’, হো বলল।
আমি তার যে প্রশ্নটার জবাব দিইনি, সেটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। ঘরের এককোণে প্রার্থনার টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ‘আমি একই রাস্তায় আছি।’
আমায় খানিক দেখে নিয়ে সে বলল, ‘নিদেনপক্ষে হোওয়া হাও তো হয়েছ তুমি।’
সাদামাঠা টেবিল দেখেই হয়তো সে কথাটা বলল। ওটায় শুধু একটা লাল কাপড় বিছানো ছিল; তার ওপর চারটে চীনা অক্ষর : বাও সন কাই হুওং। এটাই হোওয়া হাওদের বক্তব্য। আমরা একজন মহন্তের শিক্ষা অনুসরণ করি। তিনি অন্য সব বুদ্ধপন্থিদের খেয়ালখুশির আচার অনুষ্ঠানের বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের এলাহি সব প্যাগোডা আর নানান রেয়াজরীতির কোনও প্রয়োজন নেই। হোওয়া হাও বিশ্বাস করে যে, চেতনসত্তা রক্ষা করা অত্যন্ত সহজ। আর আনন্দ অনুভূতির রহস্যটা বোঝাও তেমনই সহজ। ওই চারটে অক্ষরের অর্থ হল— ‘একটা অদ্ভুত পাহাড় থেকে ভেসে আসা একটা মিষ্টি গন্ধ।’
আমি বন্ধু কুয়োকের রসবোধকে বরাবরই ভালবাসতাম। তাই আমি বললাম, ‘বরাবরই নির্দ্বিধায় পশ্চিমীদের মুখ লজ্জারাঙা করে দিলে। এ তুমিই পারো।’
সে আমার দিকে চেয়ে রইল, কিন্তু হাসেনি। আমি অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু আরও অবাক হলাম এইজন্যে যে, আমার এই ছোট্ট রসিকতা তাকে তার হাতদুটোর কথা মনে করিয়ে দিল। সে তার হাতটা তুলে ভাল করে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। তারপর বলল, ‘গরম করার পরে, গ্লেজের জন্যে ওপরটায় কী ছিল?’
আমি বললাম, ‘পুরনো বন্ধু আমার, এবার আমায় চিন্তায় ফেললে তুমি।’
কিন্তু মনে হল না হো কথাটা শুনতে পেল। সে দূরে সরে যেতে লাগল, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বেশ বুঝতে পারলাম, সে সত্যিই ছিল। কেননা সে আমার নজরের বাইরে অদৃশ্য হয়ে যায়নি। সে দরজা খুলল, বাইরে গিয়ে পেছনে জোরালো ক্লিক শব্দে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
আমি বেল বাজিয়ে মেয়েকে ডাকলাম। এই পোরসিলেন বেল মেয়েই আমায় দিয়েছিল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে, সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে হো-এর প্রয়োজনীয় যথেষ্ট সময় হিসেব করে নিয়েছিলাম। সেইমতো তার চলে যাওয়ার পরে আমি বেল বাজাতেই মেয়ে ঘরে এল। তার পায়ে একটা হাল্কা চটি ছিল।
‘কী হল তোমার, বাবা?’ ধৈর্যনিষ্ঠ গলায় মেয়ে জানতে চাইল। বড় ভাল মেয়ে আমার। সে ভিয়েতনামি পরিবারগুলোর ব্যাপারগুলো বেশ বুঝতে পারে। বুদ্ধিমান মেয়ে সে।
আমি বললাম, ‘দরজার হাতলটা ছুঁয়ে দেখ।’
সে নির্দ্বিধায় তাই করল। আমি বলতে পারি, ঠিক যেমনটা চেয়েছিলাম, তেমন করেই সুন্দরভাবে সে সেটা করল। আমার এত ভাল লাগল, আমার ইচ্ছে হল উঠে গিয়ে তাকে আদর করে জড়িয়ে ধরি। তবে বড়ই বিধ্বস্ত ছিলাম, শরীর চলছিল না।
‘দেখলাম। এবার?’ সে হাতল ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘চটচট করছে কিছু?’
সে আবার হাতল ছুঁয়ে দেখল। ‘হ্যাঁ, তবে খুব হাল্কা’, সে বলল, ‘পরিষ্কার করে দিতে বলছ?’
‘থাক এখন, সকালে করিস।’ আমি বললাম।
মেয়ে হাসল। সে খানিক এগিয়ে এসে আমার কপালে চুমো দিল। তার গা থেকে ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধ ছড়াচ্ছিল। তরতাজা মিষ্টি গন্ধ তার বিছানার চাদরেও। সেখানে দেখলাম, যারা আমার আগেই বিদেহীদের দুনিয়ার চলে গেছে, তারা এসেছে। আমি তাদের জন্যে আকুল অপেক্ষায় ছিলাম। গ্রামের স্কোয়ারের খোলা চত্বরে আমি এদের সবাইকে একসঙ্গে কাছে পেতে চেয়েছি। সেখানে আমার স্ত্রীও আসবে ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধ নিয়ে, সঙ্গে আমাদের নিজেদের শরীরের ভিজে ঘামও। ১৯৬৮-র তুমুল লড়াইয়ের ঠিক পরেপরেই সেই রাতে শেষ পর্যন্ত যখন ঘরের জানালা খুলতে পারলাম, তখনও দিগন্তের কিনারায় বোমার আকাশফাটানো আওয়াজ শুনেছি। হিমেল বাতাসের চিহ্নটুকু নেই, শুধু শুকনো মরসুমের রুক্ষতা আর আর্দ্রতার মাঝামাঝি এসে সময়ের থেমে যাওয়া এক গুরুগম্ভীর স্থবিরত্ব দেখেছি। গোটা সাইগন ভরে গিয়েছিল আলকাতরা আর মোটরসাইকেলের মারাত্মক বিষবাষ্পের আর সাংঘাতিক কর্ডাইট বিস্ফোরকের গন্ধে। আমি জানলা খুলে স্ত্রীর দিকে চাইতেই দেখি আমাদের ঘর এমন এক আশ্চর্য সুন্দর সুগন্ধে ভরে উঠল, যা তাকে উঠে বসতে বাধ্য করল, কারণ সে নিজেও ততক্ষণে তা বুঝতে পেরেছে। এই গন্ধের সঙ্গে ফুলের কোনও সম্পর্ক নেই, তবু এই গন্ধ আমাদের মনে করিয়ে দিল, ফুল সবসময়ই তৈরি থাকে একসময় ধুলোর ওপর ঝরে পড়ার জন্যে। কিন্তু এই গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছিল এক মণিরত্ন পাথর; মনে হল যেন মরকতের একটা সবুজ পাহাড় সহসা তার নিজের গন্ধ খুঁজে পেল। আমি ঘরে স্ত্রীর কাছে ফিরে এলাম। ইতিমধ্যেই আমরা বুড়ো হয়ে গেছি, ইতিমধ্যেই আমাদের সন্তানদের, তাদের সন্তানদের, যাদের আমরা কবরের নিচে শুইয়ে দিয়েছি, যাদের জন্যে প্রার্থনা করেছি, ওই অদ্ভুত পাহাড়ের কোলে আমাদের গ্রামের স্কোয়ারের খোলা চত্বরে তারা সবাই আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমি যখন বিছানার কাছে এলাম, সে তার রেশমি গাউন তুলে নিয়ে পাশে ছুড়ে দিল। তার গা-ঘেঁষে বসে দেখি, আমাদের ঘামের গন্ধও ওই রাতটায় সুবাসিত। আমি স্কোয়ারে তার সঙ্গেও থাকতে চাই। তার সঙ্গে চাই বাকি সবাইকেও, যাদের কবরে শুইয়ে দিয়েছি। সেই হকচকিয়ে যাওয়া কচিকাঁচাদের বিষণ্ণ বিপন্ন বিস্ফারিত চোখ, ছোট ছোট অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, ধুলোমলিন মুখের ক্লান্ত পরিশ্রান্ত নাকাল হয়ে যাওয়া মানুষগুলো, আর চিন্তাকুল বৃদ্ধেরা, যারা আমাদের আগে চলে গেছে, যারা ইতিমধ্যেই সব রহস্য জেনে ফেলেছে। হোয়ের হাতের গ্লেজের সেই গন্ধ আমায় মনে করিয়ে দিল অন্যদের কথাও, যাদের আমি স্কোয়ারের খোলা চত্বরে দেখতে চাই। জাহাজের সেই মানুষগুলো, আমাদের পাশের গ্রামের সেই ভিয়েতনামি ছেলেটা, যে বেচারি ভারত মহাসাগরে জ্বরে ভুগে মারা গিয়েছিল। ডাকারের কিছু স্থানীয় মানুষ, ঔপনিবেশিক অফিসারগুলো, যাদের নোঙর বাঁধার কাজে জবরদস্তি ওই হাঙরসংকুল জলে নামিয়ে দিয়ে সাঁতরে আমাদের জাহাজের দিকে আসতে বাধ্য করেছিল, যাদের দুজনকে আমাদের সকলের চোখের সামনেই মারা যেতে দেখেছি, ফরাসিরা যার জন্যে কোনওরকম দুঃখপ্রকাশ করেনি, আমি তাদেরও চাই। ঘটনাটা হোকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। যারা আমাদের স্কোয়ারে ইতিমধ্যেই জড়ো হয়েছে, তাদের মধ্যে আমি সেই ফরাসিকেও চাই, যে লোকটি হো’কে প্রথমবার ‘মঁসিয়ে’ বলে সম্বোধন করেছিল। মার্সেইয়ের জাহাজঘাটার সেই লোকটি, যার কথা হো আমাদের একসঙ্গে কাটানোর ক’টি বছরে, আর মাত্র দুবার বলেছে, তাকেও আমি চাই। আর, হোকে তো অতি অবশ্যই। সে কি এখনই স্কোয়ারের মাঠে পৌঁছে গেছে? সে কি এখন আমার অপেক্ষায়? গ্লেজ ফন্ডেন্ট গরম করছে? আমার মেয়ে টান টান করে আমার চাদরটা বিছিয়ে আমায় মুড়ে দিল। তার গায়ের ল্যাভেন্ডারের গন্ধটা এখনও দিব্বি সতেজ।
‘সে এই ঘরেই ছিল।’ দরজার চটচটে হওয়ার কারণ বোঝাতে আমি মেয়েকে বললাম।
‘কে ছিল?’
আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল তখন। তাকে আর কিছু বলতে পারলাম না। হয়তো সে কোনওভাবে এসব বুঝতেও পারত না। সে চালাকচতুর মেয়ে, তবুও।’
হোয়ের পুনরাগমন দেখব বলে পরের দিন রাতে আমি আলো জ্বেলে রেখেছিলাম। তবে ঝিমোতে ঝিমোতে এক সময় চোখে ঘুম চলে এল। হোই আমায় জাগিয়ে দিল। সে ঘরের এক কোণ থেকে চেয়ার টেনে নিল। সে বলল, ‘ডাও, প্রিয় বন্ধু আমার, ওঠো।’
অবশ্যই আমি জেগে গেলাম। হো নিজেই আমার কাছে এসে বসেছিল। তার উচ্চারণ করা প্রতিটি শব্দই আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। ‘আমি জেগে আছি’, আমি বললাম, ‘হতভাগ্য মানুষগুলোর কথা ভাবছিলাম। ওরা সাঁতরে আমাদের জাহাজের দিকে আসছিল।’
‘যাদের সেবা করেছি, তারা ইতিমধ্যেই আমাদের মধ্যে এসে গিয়েছে’, হো বলল, ‘আমি ভুলে যাওয়ার আগেই তারা এসেছে।’ বলেই সে তার হাতদুটো ওপরে তুলল। তার হাত তখনও সেই সুগারে ভরে ছিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওটা মার্বেল স্ল্যাব ছিল?’ স্মৃতিশক্তি আমার ছিলই এবং এই এতগুলো বছর পরেও, আশ্চর্যজনকভাবে এখনও পরিষ্কার। প্যারিসে হোয়ের সেই ভিজিটিং কার্ডটার কথা মনে রাখার মতো।
বিভ্রান্তি নিয়ে হো আবার সেই একই কথা বলল, ‘হ্যাঁ, একটা মার্বেল স্ল্যাব।’
‘যার ওপরে রেখে তুমি গরম সুগার ঢালতে।’
‘ঠিক তাই।’ হোয়ের মিষ্টি গন্ধে ভরা হাত আমার সামনে এলেও আমায় কিন্তু স্পর্শ করেনি। চাদরের তলা থেকে হাত বের করে তার সেই হাত দুটোকে নিজের হাতে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হো একরকম লাফিয়েই উঠল, ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। ‘নিশ্চয়ই। মার্বেল স্ল্যাব, সেটায় অল্পস্বল্প তেল দেওয়া ছিল। সুগার ঠান্ডা করতে দিতে হবে মাঝামাঝি তাপে। তারপর স্প্যাচুলা দিয়ে সবদিকে ঘুরিয়ে প্রলেপ দিয়ে যেতে হবে সাবধানে, সব অংশে— দেখতে হবে, যেন শক্ত দলা পাকিয়ে না যায়।’
আমি বললাম, ‘আমার স্ত্রীকে দেখলে?’
হো দূরের কোণটায় পায়চারি করছিল। আমার কথা শুনে দূর থেকে আমার দিকে ফিরে সে বলল, ‘দুঃখিত বন্ধু, আমি তাকে চিনি না।’
এই জবাবে সে আমার মুখে নিশ্চয়ই একটা বেজার ভাব ফুটে উঠতে দেখেছিল। সে বসে পড়ল, তার মুখখানা আমার কাছে নিয়ে সে বলল, ‘বন্ধু, আমি দুঃখিত। আরও অনেক অনেক মানুষ বাকি আছে, আমায় অতি অবশ্যই তাদের খুঁজে বের করতে হবে।’
‘তুমি কি আমার ওপর খুব বিরক্ত?’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার রাস্তায় হাঁটিনি বলে?’
সে মোলায়েম করে উত্তর দিল, ‘বিষয়টা ভীষণ জটিল। তুমি ভেবেছিলে, যা তোমার করার ছিল, করেছ। তুমি তো জানো, কারুর পছন্দ নিয়ে কোনও কৈফিয়ত তলবের অবস্থানে এখন আর আমি নেই।’
‘শান্তিতে আছ ভাই? তুমি এখন কোথায়?’ গ্লেজের প্রস্তুতপ্রণালী নিয়ে তার খুঁতখুঁতে চিন্তিত মুখ আগে দেখেছি। হোয়ের কাছে সেটাই জানতে চেয়েছিলাম। আশা করেছিলাম মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে এটা শুধুই ছোটখাটো একটা সাময়িক মুশকিলের অবস্থা, যেমন অতিথিদের কাছে একজন ভাল রাঁধুনির স্বাভাবিক প্রত্যাশা থাকে যেন তার রান্নার প্রতিটি পদ শেষ পর্যন্ত সব দিক থেকে রুচিকর ও সুস্বাদু হয়ে ওঠে।
‘কিন্তু ভাই’, হো বলে উঠল, ‘আমি শান্তিতে নেই।’
‘কেন? ওখানে কি মঁসিয়ে এস্কোফিয়ে এসেছেন?’
‘না, তাঁকে দেখিনি, ওনার সঙ্গে এর সরাসরি কোনও যোগ নেই।’
‘তাহলে ব্যপারটা কী?’
‘জানি না।’
‘দেশ তো জয় করলে তোমরাই। এ তুমি জানো, নাকি জানো না?’
হো অবিশ্বাসীর মত ঘাড় ঝাঁকাল।
আজ সকালে যখন আমার জামাই আর নাতির মুখে কিছু জিনিস দেখতে লাগলাম, তখন হোয়ের এই কাঁধ ঝাঁকানোটা আমার মনে রাখা উচিত ছিল। মনে হল আমার ভেতরে কিছু একটা আমায় চঞ্চল করে তুলেছে— একটা সন্দেহের তোলপাড়। আমি চুপচাপ চোখ বুজে রইলাম, মাথাটা একপাশে হেলিয়ে— এমনভাবে যেন আমি গভীর ঘুমে ডুবে আছি। ওদের আরও কিছু বলার সাহস দিলাম।
মেয়ে বলল, ‘এটা কথা বলার জায়গা নয়।’
ওরা তার কথায় আমল দিল না। ‘সেকী?’ লোই তার বাবাকে বলল। লোপাট হয়ে যাওয়া খুনের সেই অস্ত্র নিয়েই তারা কথা বলছিল।
থ্যাং বলল, ‘বেশিকিছু না জানাই সবচেয়ে ভাল।’
পরক্ষণেই সবাই চুপচাপ হয়ে গেল।
তারপর হো বলল, ‘ওরা সব আহম্মকের হদ্দ। তবে আমি কিন্তু নিজেকে আর রেগে উঠতে দিইনি।’
আমি শোয়ার ঘরে চোখ খুললাম। দেখি, আলো নেভানো। হো নিভিয়ে দিয়েছিল। সে বুঝেছিল ওই আলো আমার ভাল লাগবে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আহম্মক কারা?’
‘দেশ থেকে জাপানিদের তাড়ানোর জন্যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছি। ওদের মধ্যেও আমার অনেক ভাল বন্ধু ছিল। ওদের সালেম সিগারেট খেয়ে দেখেছি, দারুণ। কিন্তু উপনিবেশবাদীরা নিজেরাও ওদের রেয়াত করেনি। নিজেদের ইতিহাস কি তারা জানে না?’
‘তুমি কি আমেরিকানদের কথা বলছ?’
‘লাখো লাখো আত্মা আমার সঙ্গে। তারা আমাদের দেশের নওজোয়ান। তাদের সবার পরনে কালো স্যুট, মাথায় বাউলার টুপি। আয়নায় তারা এক কোটি, দশ কোটি হয়ে যায়।’
‘কুয়োক, বন্ধু আমার, আমি আমার পথ বেছে নিয়েছি, যে পন্থায় সম্প্রীতি থাকে।’
আমার মধ্যে সম্প্রীতির আকুলতা থাকলেও আজ সকালে আমার কান যা শুনেছে, তা উড়িয়ে দিতে পারিনি। থ্যাং লোইকে বলছিল, কাজ হাসিলের পর অস্ত্র গায়েব হয়েছে। থ্যাং আর লোই দু’জনেই খুনেদের চিনত। এই দুজনই তাদের সমর্থক ছিল। হতে পারে, এই খুনে তারাও অংশ নিয়েছে। বাপ-বেটা দু’জনেই এয়ার বোর্ন রেঞ্জার ছিল। অনেকবার আমাদের লোকজনদের এই নির্বাসন নিয়ে রাগী রাগী ঝাঁঝালো কথাবার্তা শুনেছি ওদের মুখে। ওরা বলল, আমেরিকানদের বিশ্বাস করে আমরা ভুলই করেছি। ওই সীমাহীন দুর্নীতিগ্রস্ত থিউকে খতম করে দিলেই বরং ভাল হত। যা করণীয় ছিল, তা করতেই হত। এসব আলোচনা ওরা আমার সামনেই করছিল। লক্ষ্য করেছি, কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে ওরা ঘাড় ঘুরিয়ে আড়চোখে আমায় দেখে নিচ্ছিল; আমার দিকে ফিরে ক্ষমা চেয়ে নিল তারা। ‘দাদু, আমরা দুঃখিত; পুরনো দিনগুলো মাঝেমাঝেই পুরনো রাগ বয়ে আনে। যাক, আমরা খুশি, আমাদের পরিবারপরিজনেরা একটা নতুন জীবন পেয়েছে।’
কথাটা শুনে আমি সায় দিয়ে হাত নাড়ালাম। পরিবারের শান্তি ফিরে আসায় আমি খুশি। আমি মুখ ঘুরিয়ে সামনের ডগউড গাছের কিংবা হাইওয়ের ওপারের কফি-খেত থেকে ভেসে আসা গন্ধ পেলাম। এ সবই একেবারে নতুন গন্ধ হয়ে আমাদের পরিবারে থিতু হয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে একটা দুর্বলতা আমার ওপর চেপে বসেছে। অন্যেরা সবাই চলে যাবে, হয়তো আমার এক মেয়ে আমার কাছে আসবে, কোনও কথা না বলে, একেবারে নিঃশব্দে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে। ওদের কেউ জানতেও চাইবে না, কেন আমার চোখে জল। আমার প্রথম ছেলে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরেই তার পিচ্ছিল শরীরটা হাতে তুলে নেওয়ার সময়ে আমি সেই ক্ষরিত গাঢ় রক্তের গন্ধ পেয়েছিলাম। তখনও সামনের স্কোয়ারের ফাঁকা চত্বর থেকে উড়ে আসা ধুলোয় গন্ধ ছিল। পাহাড়টার মাথার ওপর দিয়ে ওপারের দক্ষিণ চীন সাগরের বয়ে আসা গন্ধও ছিল সেদিন। মায়ের পেটে আমার ছেলের যে একান্ত ব্যক্তিগত সমুদ্রের মাংসল নিভৃতবাসে প্রবাহিত রক্তের যে স্রোতধারা যুগিয়ে তাকে জীবনে এনেছিল আমার স্ত্রী, আমার ভালবাসার নারী, সেই রক্ত আর মাংসের গন্ধও পেয়েছি আমি। ছেলের সে জীবন অদৃশ্য হয়ে গেল। এবার মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে সে অশক্ত পায়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালে আমি নত হয়ে তাকে স্বাগত জানাব, নাকি সে এতদিনে একজন নওজোয়ান হয়ে উঠেছে?
নিস্তব্ধতা ধীরে ধীরে আমাকে প্রায় খাঁটি ঘুমে, দুশ্চিন্তাভরা ঘুমের ঘোরে নিয়ে যাওয়ার পরে নাতি তার বাবাকে বলল, ‘এ না জানলে আমি একটা কাপুরুষ।’
শুনে থ্যাং হাসতে হাসতে বলল, ‘তুই তো দেখিয়ে দিলি, তুই কাপুরুষ নোস।’
আমি চাইছিলাম তারা ঘুমিয়ে পড়ুক। ঘুমের মধ্যে জীবনটাকে স্বপ্নের মধ্যে কোথাও ডুবিয়ে নেব। আমি স্বপ্নে গ্রামের খোলা স্কোয়ারের চত্বরটাই দেখতে চাই। মনে হচ্ছিল, আমার বড় বেশি বাঁচা হয়ে গেছে। মেয়ে বলছিল, ‘তোমরা দুজনেই পাগল হয়ে গেলে নাকি?’ তারপরেই সে তার গলার আওয়াজ বদলে ফেলল, মনে হল শব্দগুলো স্পষ্ট করে বলার প্রয়োজনে। ‘দাদুকে ঘুমোতে দে তোরা।’
হো এবার তৃতীয়বারের জন্যে এল আজ রাতে। আমি তার পরামর্শ চাইলাম। তার হাতে তখনও মিহি চিনির গুঁড়ো ভরে ছিল। তার চিন্তাও খুব একটা সুস্থিত ছিল, বলা যাবে না, মোটামুটি আগের দুটো রাতের মতোই ছিল। অন্ধকারের মধ্যে সে আমায় বলল, ‘চিনির প্রলেপ দেওয়ার মধ্যে এখনও কিছু গোলমাল আছে।’ উঠে পড়ার জন্যে আমি গায়ের চাদর সরিয়ে রেখে পা ঝুলিয়ে দিলাম। সে থামানোর চেষ্টা করেনি। তবে সন্তর্পণে নিজেকে ছায়াঘন অন্ধকারে আড়াল করে নিল।
‘আমি তোমার সঙ্গে একটু পায়চারি করতে চাই। ঠিক যেমনটি আমরা প্যারিসে করতাম— আমাদের সেই একচিলতে ঘুপচি ঘরে। আমরা মার্ক্স নিয়ে বুদ্ধ নিয়ে কথা বলতাম। এবার চলো, দু’জনে সেভাবেই একটু হাঁটি।’ আমি বললাম।
‘খুব ভাল কথা। হয়তো এতে আমাদের স্মরণ করার সুবিধেই হবে।’
আমি চটিতে পা গলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। হো-র ছায়া আমার পাস দিয়ে এগোতে থাকল। রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট থেকে উপচে পড়া আলো আর দরজার কাছের জমে থাকা আঁধারের মধ্যে দিয়ে। আমি তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম, তার হাতের চিনির গুঁড়োর ঘ্রাণ নিতে নিতে। প্রথমে আমার আগে, পরে আমাকে ছাড়িয়ে সে হাঁটছিল। আমি অন্ধকারে যেতেই দেখি সে নেই। আমি ঘুরে যেতেই থেমে গেলাম। দেখলাম, হো জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে। আমি বললাম, ‘আমি বিশ্বাস করি, আমার জামাই আর নাতি দু’জনেই এই মানুষ খুনের ঘটনায় জড়িত। এই হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক।’
হো যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল, আলোর বিপরীতে কালো ছায়া হয়ে। সে কিছু বলল না। ঘরের অন্য কোণ থেকে তার হাতের গন্ধ পেলাম না। লোইয়ের মাথাটা আমার কাঁধের ওপরে রেখেছিল, তাই টক গন্ধটা পেলাম। সে তখন দুধের শিশু। আমার জিম্মায় তাকে দিয়ে আমার মেয়ে ল্যাম তখন আমাদের ব্যালকনির জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ছেলের মাথাটা আমার দিকে ঘুরতে আমিও তার দিকে ঘুরলাম। ওর মুখ থেকে মায়ের দুধের গন্ধ পাচ্ছিলাম। তার নিশ্বাস থেকে টক গন্ধ আসছিল। আত্মাদের জন্যে নিবেদিত ধোঁয়া থেকে সুগন্ধ ছড়িয়ে ঘরে জুঁইফুলের ধুপ জ্বলছিল। ছেলেটা আমার কাঁধে নিশ্বাস ফেলছিল। আমি মুখ সরিয়ে তার সেই গন্ধটা এড়াতে চাইছিলাম। থ্যাং ঘরে ছিল। সে চটপট তীক্ষ্ণ নজরে তার স্ত্রীকে খুঁজে এনে ছেলেকে নেওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠল।
এসময় হো বলল, ‘তোমার কাজকর্মে রাজনীতি বলে কিছু ছিল না।’
‘সত্যিই তাই?’
‘নিশ্চয়ই।’
আমি বললাম, ‘বন্ধু, তুমি যেখানে আছ, সেখানে রাজনীতি আছে?’
সে যে কাছাকাছি চলে এল, সেটা লক্ষ্য করিনি। কিন্তু আমার মনে হল, তার হাতে লেগে থাকা সুগারের সুবাস আর একটু যেন বেড়ে গেল, তারপর খুব বেড়ে গেল। বুঝতে পারলাম হো আমার একেবারে কাছে চলে এসেছে, কিন্তু দেখতে পাইনি। সে আমার খুব কাছাকাছি আসতে সেই গন্ধটা আরও চড়া, আরও মিষ্টি লাগল। মনে হল, ভেতর থেকে আমার ফুসফুসে ভরে উঠল সেই গন্ধ; হো যেন একেবারে আমার শরীরের মধ্যে দিয়ে চলে গেল। আমার পেছনে দরজা খোলার শব্দ হল, তারপর আলতো শব্দে সেটা বন্ধ করে সে চলে গেল।
সারা ঘর ঘুরে আমি বিছানার কাছে গেলাম। একটু ঘুরে বসতে গিয়ে দেখি জানালার মুখোমুখি বসেছি। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের বিচ্ছুরিত আলো জানলার কাচে এসে দূর আকাশের তারা নোভার মতো ঝিলিক দিয়ে উঠছিল। আমি দু-এক পা এগিয়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, সেই প্রতিফলিত আলোয় হাত ছোঁয়ালাম। ভাবতে চেষ্টা করছিলাম, কোনও তারা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ফেটে পড়ার মুহূর্তে সেরকমই তীব্র কোনও গন্ধ ছড়িয়ে দেয় কিনা, গ্যাস আর ধুলোর সেই তীব্র পোড়া গন্ধ। পর্দা নামিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। মনে হল, বেশ সহজভাবেই কাজটা করতে পেরেছি। এখন আমি ঘুমের অপেক্ষায় শুয়ে আছি। অবশ্যই হো সঠিক ছিল। তবে নাতির সম্বন্ধে আর একটি কথাও আমি বলব না। হয়তো আমরা আবার যখন একসঙ্গে মিলব, তখন হোয়ের মতো আমিও চঞ্চল হয়ে উঠতে পারি। সেটাও ঠিক আছে। সে আর আমি আবার একসঙ্গে হব, হয়তো একে অন্যের সাহায্যে হাতও বাড়িয়ে দেব। এবার বেশ বুঝতে পারলাম, আসলে ঠিক কোন জিনিসটা তার স্মরণে ছিল না : সে তার তৈরি জিনিসের চকচকে বাহারি চেহারা দেওয়ার কাজে গ্লেজ ফন্ডেন্টের জায়গায় কনফেকশনার সুগার ব্যবহার করেছিল, তার উচিত ছিল পাউডার্ড সুগার ব্যবহার করা। তখন আমি শুধু ডিশ ধোয়ার কাজ করতাম। কিন্তু শেফ মঁশিয়ে এস্কোফিয়ে যা বলতেন, মন দিয়ে শুনতাম, সবকিছু তলিয়ে বুঝতে চেয়েছি। তুমি তো জানতে বন্ধু, কত বিবিধ রকমের গন্ধে তাঁর রান্নাঘর ভরে থাকত। প্রত্যেকটাই আলাদা করে সযত্নে মাথায় রাখতে হয়, নইলে তুমি বরাবরের জন্যেই অসম্পূর্ণ।
চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
***
লেখক পরিচিতি
সমসময়ের ইংরেজি সাহিতের স্বনামধন্য লেখক রবার্ট অলেন বাটলারের (১৯৪৫- ) জন্ম আমেরিকার ইলিনয় রাজ্যের গ্রানাইট সিটিতে। শিক্ষা আমেরিকার নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। অধ্যাপকের সন্তান এই অসামান্য লেখক সেনাবাহিনীর কর্মী, ইস্পাত কারখানার শ্রমিক, ট্যাক্সি ড্রাইভার, স্কুলের বদলি শিক্ষক ইত্যাদি নানা বিচিত্র পেশায় কাজ করেন। ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সৃজনশীল সাহিত্যের অধ্যাপক পদে বৃত হওয়ার আগে তিনি একটি প্রকাশনা সংস্থায় প্রধান সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেন। ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর অনন্য অবদানের স্বীকৃতিতে তাঁকে ১৯৯৩ সালের সাহিত্যে বিশ্বখ্যাত পুলিৎজার পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। বাটলার মূলত একজন ঔপন্যাসিক, তবে একজন অগ্রগণ্য ছোটগল্প লেখক হিসেবেও তিনি বিশেষ সমাদৃত।
তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে ‘দ্য আলিস অফ ইডেন’ (১৯৮১), ‘সান ডগস’ (১৯৮২), ’কান্ট্রিমেন অফ বোনস’ (১৯৮৩), ‘অন ডিসট্যান্ট গ্রাউন্ড’ (১৯৮৫), ‘ওয়াবাশ’ (১৯৮৭), ‘দ্য ডিউস’ (১৯৮৯), ‘দ্য ডিপ গ্রিন সি’ (১৯৯৭), ‘মিস্টার স্পেসম্যান’ (২০০০), ‘হেল’ (২০০৯), ‘আ স্মল হোটেল’ (২০১১), ‘ফেয়ার ওয়ার্নিং’ (২০১২), ‘দ্য হট কান্ট্রি’ (২০১২), ‘দ্য স্টার অফ ইস্তানবুল’ (২০১৩), ‘দ্য এম্পায়ার অফ নাইট’ (২০১৪), ‘পারফিউম বিভার’ (২০১৬), ‘প্যারিস ইন দ্য ডার্ক’ (২০১৮), ‘লেইট সিটি’ (২০২১), এবং ছোটগল্প সংকলনগ্রন্থ ‘আ গুড সেন্ট ফ্রম আ স্ট্রেইঞ্জ মাউন্টেইন’ (১৯৯২), ‘সালেম’ (১৯৯৪), ‘ট্যাবলয়েড ড্রিমস’ (১৯৯৬), ‘হ্যাড আ গুড টাইম: স্টোরিজ ফ্রম অ্যামেরিকান পোস্টকার্ডস’ (২০০৪), ‘সিভিয়ার্যাটন্স’ (২০০৬), ‘উইজি স্টোরিজ’ (২০১০), ‘দ্য ট্রিপ ব্যাক’ (১৯৯১) প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
বেশ ভালো সাবলীল অনুবাদ। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ।