প্রাক্ কথা : দুই ভাতৃসূর্যলোক
সত্যজিৎ রায় (০২. ০৫. ১৮২১—২৩. ০৪. ১৯৯২) এবং ঋত্বিককুমার ঘটক (০৪. ১১. ১৯২৫—০৬. ০২. ১৯৭৬) ভারতীয় চলচ্চিত্রজগতে দুই ভ্রাতৃসূর্যলোক। শিল্পের নানান শাখায় বিচরণ ছিল তাঁদের,— সাহিত্য, সঙ্গীত, পত্রিকা সম্পাদনা, ছবি আঁকা। তবে মূলত চলচ্চিত্রকার হিসেবেই দেশে ও বিদেশে সুবিখ্যাত তাঁরা। ঋত্বিক তাঁর এবং অন্যের ছবিতে অভিনয়-ও করেছেন, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ-এর মতো শিল্পীর কাছে সেতার শিখেছেন, নাটকের পর নাটক লিখেছেন (তাঁর লেখা মৌলিক ও অনুবাদ-নাটক মিলিয়ে বারোটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, এবং প্রকাশিত হয়েছে সেগুলি)। সত্যজিৎ নাটক লেখেননি। সামান্য একটু অভিনয় ও নিজ সিনেমায় স্বরক্ষেপণ থাকলেও কোনও নাটক বা চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়নি সত্যজিৎকে। বা পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ঋত্বিক যেমন পড়িয়েছেন, সত্যজিৎ দেশেবিদেশের কোনও প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেননি। দুজনেই অন্যের ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন। সত্যজিৎ হিন্দি-উর্দু ভাষায় ছবি করেছেন, ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’। ঋত্বিক বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় ছবি করেননি। তবে বিখ্যাত পরিচালক বিমল রায়ের ‘মধুমতী’ হিন্দি চলচ্চিত্রের কাহিনিকার ছিলেন ঋত্বিক। প্রথমজীবনে ‘অভিধারা’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন ঋত্বিক, রাজশাহী কলেজে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে পড়ার সময়। পরবর্তীতে কিছুদিনের জন্য একটি নাট্যপত্রিকার সম্পাদক-ও হন। অন্যদিকে সত্যজিৎ দীর্ঘদিন ধরে উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমার রায় বাহিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকার হাল ধরে ১৯৬১ থেকে আজীবন তা সম্পাদনা করে গিয়েছেন। সহসম্পাদক-রূপে পেয়েছিলেন লীলা মজুমদার আর নলিনী দাশকে। পত্রিকাটি তাঁর প্রয়াণের পরেও তাঁর পুত্র সন্দীপ রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
সত্যজিতের লেখকসত্তার ব্যাপ্তি বিশাল। ফেলুদাকে নিয়ে বহু গোয়েন্দাকাহিনি, প্রোফেসর শঙ্কুকে নিয়ে সায়েন্স ফিকশন, তারিণীখুড়োকে নিয়ে আজগুবি গল্প তো আছেই, তার বাইরে তাঁর শতাধিক মৌলিক ছোটগল্প আছে। লিয়রের লিমেরিক-অনুবাদ, মোল্লা নাসিরউদ্দীনের গল্পকে বাংলাভাষায় পরিবেশন বাংলা সাহিত্যে তাঁর অন্যতম অবদান। ইংরেজি ও বাংলায় চলচ্চিত্র নিয়ে বেশ কয়েকটি বই রয়েছে তাঁর। অন্যদিকে ছোটগল্পের একটি সংকলন আছে ঋত্বিকের-ও, যাঁর গল্পের সংখ্যা সত্যজিতের চেয়ে নগণ্য,— গোটা কুড়ি। প্রবন্ধগ্রন্থ আছে ঋত্বিকের-ও। এবং তা যথেষ্টই গভীর। ছবি-আঁকিয়ে হিসেবে তাঁর বিশেষ পরিচিতি না থাকলেও তিনি যে ছবি আঁকতেন, তার প্রমাণ ‘আমি, চলচ্চিত্র ও অন্যান্য’ প্রবন্ধসংকলনের প্রথম সংস্করণে করা তাঁর প্রচ্ছদটি। তাঁর ‘কোমলগান্ধার’ চলচ্চিত্রের ভিত্তি তাঁর-ই লেখা ওই নামীয় উপন্যাস।
সত্যজিৎ সরাসরি কখনও রাজনীতি করেননি। ঋত্বিক সভ্য হিসেবে যুক্ত ছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। পার্টির ম্যানিফেস্টো-ও লেখেন তিনি। পরে তাঁর সদস্যপদ চলে যায় আদর্শগত বিরোধিতার কারণে।
ঋত্বিক : প্রস্তুতিপর্ব
১৯৫২-তে ঋত্বিকের প্রথম ছবি ‘নাগরিক’ মুক্তি পেয়েছিল সামান্য ক’দিনের জন্য, হাওড়ার একটি হলে। তখন তাঁর বয়স সাতাশ। একেবারে বালক-বীরের বেশে বিশ্বজয়ের মতো ব্যাপার! তবে এর আগেই তারাশঙ্করের উপন্যাস অবলম্বনে তিনি ‘বেদেনী’ ছবিটি তৈরি করেন। দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা, ছবির অনেকটা অংশ চলচ্চিত্রায়িত হলেও ক্যামেরার গণ্ডগোলে ছবি ওঠেনি বলে ছবির কাজ পরিত্যক্ত হয়। আমাদের মনে পড়বে ফ্লাহাটির ‘Nanook of the North’-এ অনুরূপ ঘটনার কথা। ‘বেদেনী’ ১৯৫১ সালের ঘটনা। এক-ই সময়ে তিনি নিমাই ঘোষ পরিচালিত ‘ছিন্নমূল’-এর সহ-পরিচালক ছিলেন, এবং সে-ছবিতে তিনি অভিনয়-ও করেন।
সর্বপ্রথম নাটকে তাঁকে অভিনেতা হিসেবে পাই। বলা যেতে পারে, রাজশাহী কলেজে ছাত্র থাকাকালীন তাঁর অভিনয়ের সূত্রপাত। তাঁর সমসাময়িক কুমার রায়, যিনি পরবর্তীকালের এক বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব, শম্ভু মিত্রের সঙ্গে কলকাতার দিশারি গ্রুপ থিয়েটার ‘বহুরূপী’-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, অভিনেতা-প্রাবন্ধিক-অধ্যাপক-পরিচালক এসময় ঋত্বিকের নাট্যসঙ্গী ছিলেন। ঋত্বিক এরপর কলকাতা এলেন এমএ পড়তে, ইংরেজি নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন অসম্পূর্ণ রেখে তিনি আইপিটিএ এবং তার সহযোগী সংস্থা গণনাট্য সংঘে যোগ দিলেন। এখানে তিনি নাট্যকার ও অভিনেতা। এই পর্বে তাঁর লেখা নাটক ‘কালো সায়র’ (১৯৪৮, যখন তিনি ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র)। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ঋত্বিক অনুবাদ করছেন ব্রেখট-এর নাটক, গোগোলের। নবান্ন নাটকের দ্বিতীয় পর্বে তাঁকে অভিনেতারূপে পাই। তাঁর লেখা ‘জ্বালা’ নাটক মঞ্চে ও বেতারে অভিনীত হয়। উৎপল দত্ত সহযোগে মঞ্চায়িত করেন রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’। রঘুপতির ভূমিকায় ঋত্বিক।
প্রসঙ্গত, ঋত্বিকের পিতা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুরেশচন্দ্র ঘটক-ও ছিলেন কবি ও নাট্যকার। ঋত্বিকের অগ্রজ মনীশ ঘটক বিখ্যাত কবি, প্রাবন্ধিক, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। আর এক ভাই সুধীশ ঘটক ছিলেন টেলিভিশন-বিশেষজ্ঞ। ঋত্বিকের গড়ে ওঠার পেছনে তাঁর অবদান ছিল। মনীশ-কন্যা মহাশ্বেতা বরেণ্য সাহিত্যিক। তাঁর পুত্র নবারুণকেও বিশিষ্ট লেখকরূপে পাই। মহাশ্বেতার স্বামী বিজন ভট্টাচার্য নট-নাট্যকার, চলচ্চিত্র ও মঞ্চাভিনেতা। পরিবারটি বাঙালি সংস্কৃতিকে প্রভূত ঐশ্বর্যশালী করে গেছে।
আমরা দেখছি, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন শিল্পমাধ্যম নাটক দিয়ে ঋত্বিকের নন্দনলোকে যাত্রা শুরু। নাটক তিনি শেষজীবন পর্যন্ত চালিয়ে গেছেন। নাটক থেকে তিনি এলেন পৃথিবীর সবচেয়ে নবীন নন্দনমাধ্যম বলে আখ্যায়িত সিনেমায়। নাটক থেকে চলচ্চিত্রে আসার পেছনে তাঁর যুক্তি ছিল, নাটকের চেয়ে অনেক দ্রুত দর্শকের কাছে পৌঁছনো যায় সিনেমার মাধ্যমে। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভাষায় লিখেছেন, তিনি সিনেমার প্রেমে পড়েননি। যেদিন দেখবেন, অন্য কোনও মাধ্যম চলচ্চিত্রের চেয়েও দ্রুততরতায় দর্শকের মর্মে পৌঁছতে পারে, সেদিন সিনেমাকে ‘লাথি মেরে’ তিনি বেরিয়ে যাবেন।
প্রথমে ছোটগল্প, মধ্যপর্বে নাটক, আর অন্তিমে চলচ্চিত্র, এই হল ঋত্বিকের সারস্বত পথপরিক্রমা। তবে নাটক থেকে ফিল্মে আসবার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট এবং অনুঘটক আছে, কলকাতার চলচ্চিত্র আন্দোলন। আমরা সেটা একটু ছুঁয়ে দেখব এবার।
তার আগে আমরা চলচ্চিত্র-অভিনেতা ঋত্বিকের সালতামামি সেরে রাখতে চাই। নিজের পরিচালনায় ‘নাগরিক’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ আর ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-তে অভিনয় করেছেন তিনি। করেছেন অন্যের পরিচালিত একাধিক ছবিতে, ‘ছিন্নমূল’, ‘কুমারী মন’, ‘তথাপি’ ছাড়াও আরও কয়েকটিতে।
চলচ্চিত্রে নিউ ওয়েভ ও ঋত্বিক
ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ১৯৪৭ সাল একটি মাইলফলক। স্বাধীনতার এই বছরটিতেই গড়ে ওঠে ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’, যার উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, হিরণকুমার সান্যাল, রাধামোহন ভট্টাচার্য, বংশীচন্দ্র গুপ্ত, রাম হালদার, চারুপ্রকাশ ঘোষ প্রমুখ। ১৯৪৭-এর ৫-ই অক্টোবর সোসাইটির যাত্রা শুরু। এটিই প্রকৃত অর্থে ভারতে প্রথম চলচ্চিত্র আন্দোলনের পথিকৃৎ। ১৯৩৯-এ ‘Ameteur Film Society in India’, বা ‘Bombay Film Society’ (১৯৪৩) ছিল কেবল সাহেবদের পৃষ্ঠপোষিত। তিরিশের দশকে কবিতা সরকার উত্তর-ভারতে যে ফিল্মক্লাব গড়েছিলেন, তা ছিল আবার মুষ্টিমেয় অভিজাতদের জন্য, এবং সেখানে মূলত বাণিজ্যিক ছবির কদর ছিল। সত্যজিৎদের সোসাইটি একদিকে বিদেশি ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের দুয়ার উন্মুক্ত করে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে নান্দনিক সিনেমার বোধ তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
অবিলম্বে মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সোসাইটির উদ্যোগে ১৯৫২-তে কলকাতায় যে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে প্রদর্শিত বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জাপানি চলচ্চিত্র ঋত্বিক তথা সে-সময়কার তরুণ চলচ্চিত্র-পরিচালনার স্বপ্ন দেখা সত্যজিৎ-মৃণাল-হরিসাধন দাশগুপ্তদের প্রভাবিত করে। সোসাইটির মুখপত্র ‘চলচ্চিত্র’-তে ঋত্বিক লিখতেন-ও।
একথা বললে অত্যুক্তি হবে না, বিশ শতকের দুইয়ের দশকে ফ্রান্সে সিনেমা নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছিল, যার সফল প্রসূন ত্রুফো, রোভার, আদ্রে বাজাঁ, রিভেত ও অন্যান্যরা, ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির উদ্যোগ এক-ই ভাবে বেশ কয়েকজন প্রথিতযশা ও আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র পরিচালকের জন্ম দেয়। ‘Cahiers du Cinema’ আর ‘Positive’-এর মতো পত্রিকা ঋত্বিকদের কাছে বেদপাঠের মতো হয়ে দাঁড়ায়। এঁরা পরবর্তীকালে ইতালির ‘New Realism’ দ্বারাও প্রভাবিত হন।
ঋত্বিক ততদিনে চলচ্চিত্রে অভিনয় ও পরিচালনার পাঠ (‘ছিন্নমূল’ ছবিতে নিমাই ঘোষের সহকারী) নিয়ে ফেলেছেন। সোসাইটি তাঁকে দিল বাড়তি উদ্যম। আর দেশভাগের পীড়া তাঁর বুকের চিরস্থায়ী ক্ষত হয়ে তাঁকে লগ্নি করল এর সামূহিক বেদনাকে সেলুলয়েডে ধরে রাখতে, তাঁর একের পর এক ছবিতে।
হলিউডের খ্যাতিমান পরিচালক জাঁ রেনোয়া তখন কলকাতায়, তাঁর প্রথম, এবং এক-ই সঙ্গে ভারতবর্ষে নির্মিত প্রথম রঙিন ছবি ‘The River’-এর লোকেশন দেখে বেড়াচ্ছেন। সঙ্গী সত্যজিৎ। এসময় রেনোয়া প্রায়শই দেখতেন, লোকাল ট্রেনের ছাদে অসংখ্য যাত্রী। সত্যজিতের কাছে প্রশ্ন করে জেনেছিলেন তিনি, যাত্রীরা পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শরণার্থী। রেনোয়া বলেছিলেন, একদিন এদের নিয়ে ছবি হবে। ঋত্বিক ভবিষ্যৎবক্তা রেনোয়ার বাক্যটির যথার্থ উত্তর।
মাসের পর মাস বন্ধু মৃণাল সেনের সঙ্গে দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটে এক চায়ের দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিচ্ছেন, বিড়ি পোড়াচ্ছেন দেদার, চা পান চলছে বেশুমার, আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করে যাচ্ছেন ছবি করবেন। এবং করলেন। সদ্য স্বাধীন দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের বেকারত্ব, বিধুরতা ও ক্ষোভের মিশ্রিত জীবন, আর তার মধ্যেই আশাবরী রাগ ও গান্ধর্বের গাঢ় সমাচার। ছবিটি হাওড়ার একটি হলে প্রদর্শিত-ও হল। কিন্তু নিয়তিতাড়িত ঋত্বিক! তাই মাত্র ছ’দিনের মাথায় ছবিটিকে হল থেকে তুলে নেওয়া হল বাণিজ্যিক কোনও গোলযোগের দরুণ। বিধি বাম! নইলে এ ছবিটিকেই শিরোপা দেওয়া যেত ভারতে নবতরঙ্গের ভগীরথ হিসেবে। স্বয়ং সত্যজিৎ রায়-ও একথা বলেছেন। ছবিটি তিনি দেখেছিলেন মুক্তির আগেই, যেমন ঋত্বিক ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছিলেন মুক্তির আগে, টেকনিশিয়ানে। সত্যজিৎ ছবির দু-একটি দৃশ্যে তাঁর মুগ্ধতার কথাও জানিয়েছিলেন।
আমাদের যুক্তিমতে, ছ’দিনের জন্য হলেও ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছিল তো! আর ছবির প্রবীণতা তো নির্ভর করে সেন্সরের দিনক্ষণ মেপে, তাই না? তাহলে ‘নাগরিক’ (১৯৫২), বা তার-ও আগে নির্মিত ও প্রদর্শিত নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’-কে তো নতুন ধারার চলচ্চিত্রের পুরোধা বলতে হয়!
পরের ছবি করার জন্য ঋত্বিককে ছ-ছ’টি বছর অপেক্ষায় থাকতে হল। ১৯৫৮-র তেইশে মে মুক্তি পায় ‘অযান্ত্রিক’। সময়ের থেকে বহু এগিয়ে থাকা ছবি। অতএব বাণিজ্যসফল হতে পারেনি। তবে জর্জ শাদুল ছবিটি সম্পর্কে যা মন্তব্য করেছেন, ছবিটি নিয়ে অসংখ্য সদুক্তির মধ্যে এটিকে গ্রহণ করতে পারি, ‘ছবি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি লক্ষ্য করেছিলাম, ছবিটি মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে’।
১৯৫৮ থেকে ’৬১, এই সময়ের মধ্যে ‘অযান্ত্রিক’ ছাড়াও ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ (মুক্তি ১৯৫৮), ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (মুক্তির তারিখ ১৪. ০৪. ১৯৬০), আর ‘কোমল গান্ধার’ (১৩. ০৩. ১৯৬১-তে মুক্তিপ্রাপ্ত), এই চারটি ছবি নির্মাণ করলেন ঋত্বিক। পবন অনুকূলে। শেষের ছবিটির প্রযোজক-ও ঋত্বিক। আর তারপর থেকেই আবার ঘনান্ধকার! পরের ছবি ‘সুবর্ণরেখা’ তৈরি হল দীর্ঘ চার বছর পর, আর তার পরের ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ১৯৭৩-এ, ও সর্বশেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ তাঁর মৃত্যুর পরে প্রদর্শিত হয়, ১৯৭৭ সালে।
মাত্রই আটটি ছবি তাঁর। তাছাড়া আছে কয়েকটি তথ্যচিত্র। যেমন ‘The Life of the Adivasi’ (১৯৫৫), ‘Places of Historical Interest in Bihar’ (১৯৫৫), ‘Scissors’ (১৯৬২), ‘ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান’ (১৯৬৩), ‘Fear’ (১৯৬৫), ‘Rendesvour’ (১৯৬৫), ‘Civil Defence’ (১৯৬৭), ‘Scientists of Tomorrow’ (১৯৬৭), ‘ইয়ে কওন’ (১৯৭০), ‘আমার লেনিন’ (১৯৭০), ‘পুরুলিয়ার ছৌ’ (১৯৭০), ‘দুর্বারগতি পদ্মা’ (১৯৭১), ‘রামকিঙ্কর’ (১৯৭৫, অসম্পূর্ণ। ঋত্বিকের পুত্র ঋতবান ছবিটি শেষ করেন)।
ঋত্বিক একাধিক পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি শুরু করেও শেষ করতে পারেননি। এগুলির মধ্যে ‘কত অজানারে’ (১৯৫৯), ‘বগলার বঙ্গদর্শন’ (১৯৫৪), এবং ‘রঙের গোলাম’ (১৯৬৮) অন্যতম। ভিয়েতনাম নিয়েও একটি তথ্যচিত্র বানাবেন সাধ ছিল তাঁর, তৈরি করবেন রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’, বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ নিয়ে ছবি। হয়নি। সে কি সবটাই নিজ মুদ্রাদোষে? হিন্দি ছবির পরিচালক শক্তি সামন্ত তাঁকে দিয়ে বিভূতিভূষণের ‘নিমন্ত্রণ’ ছবিটির (বাংলায় এটি করেন তরুণ মজুমদার) হিন্দিরূপ দেওয়ানোর পরিকল্পনা করেন। রূপায়িত হয়নি। শেষে শক্তি-ই করেছিলেন ছবিটি।
নিজজীবনে তাঁর মূল্যায়ন দেখে যেতে পারেননি ঋত্বিক। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, তাঁর শিল্পীসত্তাকে মর্যাদা দিচ্ছেন দেশিবিদেশি চলচ্চিত্র-বোদ্ধারা। কর্ণের মতোই তিনি বীর প্রতিপন্ন হচ্ছেন দিনের পর দিন।