Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ছোটগল্প : ললাট লিপি

মহেন্দ্র ছাত্র হিসেবে ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। ক্লাসে প্রথম স্থান বাঁধা। কিন্তু, তার একটা উদ্ভট রোগ ছিল। রেলগাড়ির ছবি দেখলেই তার মন চঞ্চল হয়ে উঠত। ঠাকুর্দার হাত ধরে সকাল-বিকেল কাছের রেলস্টেশনে ছুটত ট্রেন দেখতে। লাইন ধরে ট্রেনের আসা যাওয়া আপ ট্রেন-ডাউন ট্রেন— নিত্যদিন দেখা চাইই চাই। ট্রেনের কামরা আর প্যান্টোগ্রাফ দেখতে দেখতে শিশুটি একদিন গুনতে শুরু করেছিল। সেই ছিল সংখ্যার সাথে তার প্রথম সখ্য।
স্কুলে ভর্তি হবার পর আর ট্রেন দেখতে যাওয়া হত না। পড়াশুনার চাপ যত বাড়তে লাগল, অবকাশ গেল কমে।
ক্লাস সিক্সে উঠলে মহেনকে বাড়ি থেকে দূরের স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হল। সে স্কুলে যেতে আসতে ট্রেনে চাপতে হত। একদিন যে মহেন অবাক চোখে চলন্ত ট্রেনের আসা-যাওয়া দেখত, সে নিজেই হয়ে গেল সেই ট্রেনের নিত্যযাত্রী।
সময় কখনও থেমে থাকে না। একটার পর একটা ক্লাসের গণ্ডি পেরিয়ে মহেন্দ্র এসে দাঁড়াল মাধ্যমিক পরীক্ষার দোরগোড়ায়। পড়াশুনার চাপে নাভিশ্বাস উঠল— অন্য কোনওদিকে তাকাবার জো নেই। তার পরিশ্রম বিফলে গেল না, পরীক্ষার ফল ভালই হল। তাতে পড়ার চাপ কিন্তু কমল না, আরও বেড়ে গেল। অন্য কোনওকিছু নিয়েই তখন আর মাথা ঘামানোর অবকাশ রইল না। অবশেষে উচ্চমাধ্যমিকেও সে কৃতিত্বের ছাপ রাখল।
মহেন্দ্রকে নিয়ে বাড়ির সবার স্বপ্ন বোনার পালা শুরু হয়ে গেল— বাবা ভাবেন “মহেন আমার ডাক্তার হবে”, মা বলেন “না, আমার সোনা ইঞ্জিনিয়র হবে”, পিসি চান পণ্ডিত হয়ে সে অধ্যাপনা করুক, দাদা চান উকিল হোক।
মহেন বলে বসল, “না, ওর কোনওটাই নয়। আমি রেলগাড়ির ড্রাইভার হতে চাই।”
সে কী! সর্বনাশ! এত কিছু থাকতে এত খাটাখাটুনি পড়াশুনো করে… বাবা গম্ভীর হন, মার চোখে জল আসে, পিসির বদন বিরস হয় দাদা মুখ ফেরান।
বাবা কত করে বোঝান, মা কত কাকুতিমিনতি প্যানপ্যান করেন— মহেন্দ্র টলে না। তার এক কথা— “আমি রেলগাড়িই চালাব।”
শেষে সকলের অসন্তোষ ও ক্ষোভের মধ্যে নবিশ হিসাবে নাম লেখানো আর কপালক্রমে কারখানায় প্রবেশ। প্রথমে কাঁচড়াপাড়ায়, তারপর লিলুয়া, জামালপুর শেষপর্যন্ত চিত্তরঞ্জন। ডিজেল মেসিন ইউনিট, ইলেক্ট্রিক্যাল মেসিন ইউনিট, ক্যানাডিয়ান জায়ান্ট ইঞ্জিন সবার সাথে পরিচয় শুধু নয়, অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ।
ক্ষুব্ধ বাবা প্রকাশ্যে বললেন— “কাজ কোনওটাই খারাপ নয়। প্রকৃত কর্মী যেখানেই কাজ করুক ঠিক দাগ রাখতে পারে। ওর পথ ও বেছে নিয়েছে সেখানেই সার্থক হোক।”
দু’টি দীর্ঘ বছর ধরে শিক্ষানবিশির পর ড্রাইভারের সহকারী হয়ে সান্টিং ইঞ্জিনে চড়ে বসা মহেনের কাছে এক স্মরণীয় ঘটনা। অনেক ইয়ার্ডে সহকারী হিসাবে কাজ করে শেষে এসে পড়ল চিৎপুর ইয়ার্ডে। এখানেই সে পেল প্রথম ড্রাইভারের দায়িত্ব। প্রথম প্রথম কম সংখ্যক ওয়াগন নিয়ে স্বল্প দূরত্বের যাতায়াতে হাত দুরস্ত হল। তারপর এক রাত্রে তার দায়িত্বে এল যাত্রীগাড়ি চালাবার ভার। শিয়ালদহ থেকে ডানকুনি। প্রথম প্যাসেঞ্জার ট্রেন শেষরাতে ছাড়ে। যাত্রী সংখ্যা কম— যাঁরা ওঠেন তাঁদের অধিকাংশই দক্ষিণেশ্বরে নেমে যান— প্রায় খালি গাড়ি বালীঘাট, বালী হল্ট, রাজচন্দ্রপুর হয়ে ডানকুনি পৌঁছে যায় প্রায় ৪৫ মিনিটে। ওই গাড়ি দশমিনিট বাদে ফিরে আসে শিয়ালদা ছ’টার মধ্যেই।
এই শুরু। দুই-তিন মাসের মধ্যেই শহরতলির গাড়িগুলি চালাবার দায়িত্ব পেয়ে গেল। প্রথম প্রথম ভয়ে ভয়ে চালানো শুরু করলেও কয়েকদিনেই অনেকটা দুরস্ত হয়ে গেল। সেদিন এক লেভেল ক্রসিং-এ একখানা লরি খারাপ হয়ে যাওয়ায় একটু অসতর্ক হলেই ঘটতে পারত এক দুর্ঘটনা— কিন্তু দূর থেকেই লাইনের ওপর লরি দাঁড়ানো দেখে মহেন্দ্র গতি হ্রাস করে এবং দশ মিটার দূরে গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। লরির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে— আর স্টার্ট নিচ্ছে না। মহেন্দ্র নেমে যাত্রীদের ডাকলে— “আপনারা একটু আসুন না— আমরা লরিটাকে ঠেলে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিই।” জন পনের যাত্রী ঝপাঝপ নেমে পড়লেন, ঠেলে নিয়ে লরিটাকে লাইন থেকে সরিয়ে দিয়ে এসে আবার গাড়িতে চাপলেন। গাড়ি চালু করে মহেন্দ্র ভাবল ফোরম্যান বর্ধনের উপদেশ। পঞ্চাশোর্ধ্ব শক্ত সবল ভদ্রলোক শিক্ষা দেবার সময় বলেছিলেল, “বাপু তুমি ডিগ্রি পাশ করে এ লাইনে এসেছ, টিকে থাকলে অনেক দূর যাবে, কিন্তু এই বুড়োর একটা কথা মনে রেখো আর নিয়ম করে পালন কোরো— উপকার হবে। চোখ, কান আর মাথা এই তিনটিকে দু্রস্ত করে তবেই যন্ত্র ছোবে।”
মি. বর্ধনের উপদেশ যে কত দামি সে ইতিমধ্যেই তার প্রমাণ পেয়েছে।
দিন চারপাঁচ আগে সে একখানা ডাউন গাড়ি চালিয়ে আসছিল। সকাল সবে হয়েছে। লোকজন খুব বেশি তখনও বেরোয়নি। দু’চারজন সবে খেতের কাজে মাঠে চলেছে। দু’টি বাচ্চা ছেলে একপাল ছাগল নিয়ে চলেছে চরাতে— গাড়ির শব্দ পেয়ে বাচ্চাদু’টি ছুটে লাইন পেরিয়ে গেল। সামনে পেছনে ছাগলের পাল, লাফাতে লাফাতে লাইন পার হচ্ছে। মহেন কেন জানি একটু বেখেয়াল হয়েছিল, চটকা ভেঙে হুইসেল বাজিয়ে দিয়েও কিন্তু পুরোপুরি সামলাতে পারল না। দুটি ছাগল চাপা পড়ল। মনে পড়ে গেল শ্রীবর্ধনের কথা “চোখ, কান, মাথা দুরস্ত করে যন্ত্র ছোঁবে।” পরের স্টেশনে নেমে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে কানমলে আবার গাড়ি নিয়ে ফিরে আসে।
দিন কাটে গতানুগতিকতায়। একঘেয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়া আর গাড়ি চালিয়ে ফিরে আসা। কিন্তু মহেন্দ্র মোটেই একঘেয়েমিতে ভোগে না। গাড়িতে সে যখনি চড়ে পরম মমতায় ঝাড়পোছ করে যন্ত্রগুলোকে নিজের অঙ্গের মতো সযত্নে দেখভাল করে। পরীক্ষা করবার সময় তীক্ষ্ণ শ্রবণ প্রয়োগে অনুধাবন করবার চেষ্টা করে কোনও বিজাতীয় শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে কিনা। সেরকম কিছু হলেই সে মেকানিক ডেকে নির্দেশ দেয় কোনও বিশেষ অংশ পরীক্ষা করতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার রোগনির্ণয় সত্য বলে ধরা পড়ে। মেকানিক যন্ত্র সারাই করে হেসে বলে, আপনি সত্যিই বড় ইঞ্জিনিয়র— ডাক্তার হলে আপনি প্রচুর রোগীর উপশম করতে পারতেন। শুনে মহেন্দ্র হাসে। মনে করে গুরু বর্ধনের কথা— সমস্ত অন্তর দিয়ে তাঁকে প্রণাম জানায়। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সে বর্ধনের ভদ্রেশ্বরের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। তাঁর সঙ্গে সারাটা দিন কাটায় নানা কথা আলোচনা করে। পৃথিবীর তাবৎ বিষয় সম্বন্ধে কথা হলেও বেশিরভাগ সময় কাটে ইঞ্জিন এবং চালনা বিষয়ে। তার আন্তরিকতায় বর্ধন মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবেন এমন সনিষ্ঠ কর্মী পাওয়া কত দুর্লভ।
কর্মরত অবস্থাতেই বর্ধনসাহেব ভদ্রেশ্বরের উপান্তে বিঘেখানেক জমি কিনে রেখেছিলেন। অবসর গ্রহণের পর ছোট্ট একটা বাড়ি করে সেখানেই বাস করছেন। দুই ছেলে এক মেয়ে তাঁর। বড় ছেলে পাড়ি দিয়েছে জার্মানি। সেখানেই ডেরা বেঁধেছে— দেশে ফিরবে বলে মনে হয় না। স্ত্রী গত হয়েছেন অবসরের পরপরই। নতুন বাড়িতে তাঁর বেশিদিন বাস করা সম্ভব হয়নি। ছোটছেলে রেলের স্টেশনমাস্টার। যখন যেখানে বদলি হয় কোয়ার্টার পায়। সল্টলেকে জমি পেয়েছে, একটু একটু করে বাড়ি করছে। সে ভদ্রেশ্বরের ভদ্রাসন বিশেষ পছন্দ করে না। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। শ্বশুরবাড়িতে স্বচ্ছন্দে আছে। মাঝে মাঝে একমাত্র সেই মেয়েই দু’টি ছেলে নিয়ে এসে বাপের কাছে দিন কয়েক থেকে যায়।
মৃতদার বর্ধন সাহেব তাঁর রক্ষক, সেবক, পালক হিসাবে নিরুকে নিয়ে ভদ্রেশ্বরের বাড়িতে থাকেন। নিরু, নিরাপদ অজগ্রামের স্বজন, বান্ধব পরিজনহীন এক নিরালম্ব মহাপুরুষ— ভদ্রেশ্বরের একচ্ছত্র শাসক। তার শাসনে আর ব্যবস্থাপনায় বর্ধন সাহেব নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগে দিন কাটান। মাঝে মাঝে মেয়ের আগমনে কিছু পরিমাণ তরঙ্গ ওঠে অন্যথায় শান্ত স্রোতস্বতী। সপ্তাহে একদিন তো বটেই, কখনও আরও বেশিবার এসে হাজির হয় মহেন্দ্র কিন্তু তাতে সংসারের কোনও বৈচিত্র্য ঘটে না। মহেন্দ্র যেন এ সংসারের একটি অঙ্গ হয়ে গেছে। সে এলে বর্ধন সাহেব একটু উজ্জ্বল হন, নিরু একটু উচ্ছল হয়, এই পর্যন্তই।
মহেন্দ্র এসে সোজা বাড়ির পেছনদিকের বাগানে চলে যায়। সাহেব সেখানেই গাছগাছালির পরিচর্যা করেন। কারও ডাল ছাঁটা, কারওবা শুকনো পাতা খুলে নেওয়া, ঝরাপাতাগুলো খুঁটে খুঁটে তুলে নিয়ে টুকরিতে জড়ো করা, আগাছাগুলোকে উচ্ছেদ করা এইসব নিয়েই তিনি ব্যস্ত থাকেন। মহেন্দ্র তাঁর সঙ্গে তাঁর কাজে হাত লাগায়। ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক কথার মাঝেই নিরাপদ দু’খানা চেয়ার আর একটা বেতের চৌপায়া এনে পেতে দেয়। এনে রাখে চা আর জলখাবার। দু’জনে হাত ধুয়ে এসে বসেন।
দুই মূর্তির আর্বিভাব হঠাৎ। পচা আর ভজা। দুই ভাই। উত্তর সীমায় যাদের বাড়ি সেই বাড়ির দুই ছেলে বয়স আট আর ছয়। প্রতিদিনই তারা সকালে তাদের দাদুর কাছে পড়তে আসে। আজও এসেছে। দাদু দুই ভাইকে মাখন-রুটি তুলে দিলেন। মহেনও নিজের রেকাব থেকে দুই ভাইকে দু’টুকরো রুটি দিল। নিরাপদ চৌপায়া পরিষ্কার করে দিলে দু’ভাই ওখানেই পড়তে শুরু করল। বর্ধন কাজ করতে করতেই শুনতে লাগলেন, মাঝে মাঝে ভুল করলে শুধরে দিলেন।
পড়াশুনার পর ওদের বললেন চান করে খেয়ে তৈরি হয়ে আসতে। বৃদ্ধ ওদের রেললাইন পার হওয়া পর্যন্ত এগিয়ে দেন আবার ছুটির সময় হলে লেভেল ক্রসিংয়ে গিয়ে অপেক্ষা করেন। স্কুল ছুটি হলে ওদের সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে আসেন। গরিব ঘরের ছেলে দু’টি। ওদের বাপ রিকশা চালায়, মা ঝিয়ের কাজ করে। ওই ছেলেদু’টিই বাগানের সঙ্গে বর্ধন সাহেবের অবসরের অবলম্বন।
সেদিন ভোরে মহেন্দ্র গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে— কোলফিল্ড এক্সপ্রেস। প্রথম থামবে বর্ধমান। তার আগে আর থামা নেই তবে নজর সবসময় তীক্ষ্ণ রাখতে হবে। অবশ্য ওই সময়ে পথের বিঘ্ন বিশেষ থাকে না। তবুও গাড়িতে উঠলেই বর্ধনের উপদেশ তার মনে জাগে, মনে মনেই তাঁকে শ্রদ্ধা প্রণাম জানায়।
ওকি, দৃষ্টিবিভ্রম নাকি। সামনের আলোর তীব্রতা বৃদ্ধি করে মনে হল তাই তো লাইনের ওপরে জন দুই লোক যেন কিছু একটা করছে। তীব্রস্বরে ভোঁ বাজিয়ে গাড়ির গতি কমিয়ে দিল— ক্রমে বিশ-পঁচিশ গজ দূরে গাড়িটা থেমে গেল। গাড়ির আলো দেখেই লাইনের ওপর যারা ছিল তারা পালিয়েছে।
গাড়ি থামলে যাত্রীরা সব হৈ হৈ করে উঠল। কিছু সংখ্যক যাত্রী উৎসাহে গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভার আর সহাতিয়ার মেকানিকের সঙ্গে এগিয়ে গেল ঘটনার জায়গায়, লোকগুলো ডানদিকের একটা ফিসপ্লেট খুলে ফেলে পাশে রেখেছে, বাঁদিকের ফিসপ্লেট খোলবার চেষ্টা করছিল, পুরো খুলতে পারেনি।
যাত্রীরা যারা এসেছিল তারা হতভম্ব। মেকানিক আর ড্রাইভার মিলে দুটো ফিসপ্লেটই আবার যথাযথ লাগিয়ে দিয়ে ফিরে এল গাড়িতে। যাত্রীরাও কলরব করতে করতে ফিরলেন। বোঝাই এক্সপ্রেস গাড়ি বড় বাঁচা বেঁচে গেছে, শুধু ড্রাইভারের সতর্কতায়।
বর্ধমানে গাড়ি থামলে যাত্রীদের একদল দৌড়ে গিয়ে গার্ডের সঙ্গে স্টেশনমাস্টারের কাছে বিবরণ লিপিবদ্ধ করাল আর একদল অকুণ্ঠ সাদর অভিনন্দন জানাতে এল ড্রাইভারকে। মহেন্দ্র সবিনয়ে তাদের জানাল সে তো অন্যায় কিছু করেনি— চালক হিসাবে তার যা করণীয় মাত্র তাই সে করেছে। আর কিছু তো তার করবার ছিল না।
যাত্রীরা আরও হৃষ্ট মনে হাজারো তারিফ করে গেলেন। স্টেশনমাস্টার এসে চালকের সমর্থনসূচক স্বাক্ষর নিয়ে গাড়ি ছাড়বার আদেশ দিলেন।
পরদিন সকালে বর্ধন সাহেব প্রাতঃকৃত্য সেরে এসে টেবিলে বসলেন। কাগজে চোখ বুলিয়ে বাগানে যাবেন দৈনন্দিন কাজে। কাগজে চোখ দিয়ে একমুহূর্ত থমকে গেলেন, তারপর হাঁকলেন, “নিরু, নিরাপদ।” কদাচিৎ তাঁর উচ্চকণ্ঠ শোনা যায়। ব্যস্তপায়ে নিরাপদ এসে হাজির— “বাবু, আমাকে ডাকছেন কেন— চা বানাচ্ছি।”
বর্ধন সাহেব বললেন, “না রে, চা পরে মহেন এলে বাগানেই খাব— মহেনকে আসতে দে।”
“দাদাবাবুর তো আজ আসার দিন নয়— তিনি কি খবর পাঠিয়েছেন?”
“না রে, খবর পাঠিয়েছে কাগজে, এই দেখ!”
পাতা জোড়া হেডলাইনে বড় বড় হরফে ছাপা “চালকের সাহস ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে বেঁচে গেল কোলফিল্ড এক্সপ্রেস”। তার নিচে বিশদ বিবরণ। জেনারেল ম্যানেজারের অভিনন্দন, পুরস্কার ঘোষণা আর যাত্রী সংগঠনের সম্বর্ধনাসভা আয়োজনের কথা। পড়তে পড়তেই হঠাৎ নিরাপদ ছুটে চলে গেল। বিস্মিত বর্ধন চোখ তুলে দেখলেন দরজা খুলে মহেন্দ্র ঢুকছে। বৃদ্ধ উঠলেন, দু’পা এগিয়ে যেতেই মহেন এসে তাঁর প্রসারিত করতল দু’টিতে মুখ রেখে গভীর স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। করতল মুক্ত করে তিনি মহেনের মাথায়, পিঠে হস্তমার্জন করে অকৃত্রিম স্নেহের প্রলেপ বুলিয়ে দিলেন।
অকস্মাৎ তালভঙ্গ— “দাদাবাবু, জল খান।” গ্লাস বাড়িয়ে নিরু হাজির। তার দিকে সতৃষ্ণ চোখে তাকিয়ে মহেন জলের গ্লাস নিয়ে এক নিশ্বাসে গ্লাস খালি করে আর একটা তৃপ্তির শ্বাস ফেলল। হেসে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কী করে জানলে যে আমি এক বুক পিপাসা নিয়ে এই সকালে এসে হাজির হব?”
নিরু হেসে বলল, “বাঃ তুমি কেলোর কীর্তি করবে— আমরা জানতে পারব না? চলো এবার বাগানে চলো চা খাবার নিয়ে আসি।”
বর্ধন সাহেব বললেন— “চলো বাগানে গিয়ে কাজের সঙ্গে সঙ্গে তোমার কাহিনি বিশদ শুনব।”
খেতে খেতে মহেন ঘটনাটার বিবরণ দিল— চারটি শ্রোতা নীরবে শুনে গেল। বিবরণ শেষ করে মহেন বলল “কাগজগুলো বড্ড বাড়াবাড়ি করে। করণীয় করার মধ্যে এত ঢাক বাজাবার কী আছে?”
বর্ধন সাহেব হেসে বললেন, “মহেন তুমি যে পরিবেশে জন্মেছ, বড় হয়েছ তার অলঙ্ঘ প্রভাব তোমার উপর পড়েছে। ছেলেবেলায় পড়েছিলে— ‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ং বিনয়াৎ যাতি পাত্রতাম’। এই বিনয় হচ্ছে একটি পরম গুণ, নিষ্ঠার মতোই। তুমি সবিনয়ে নিষ্ঠাভরে শিক্ষকদের কাছে পঠনপাঠন করেছ— অনায়াসে পরীক্ষার বাধাগুলি টপকে গেছ। বিনীতভাবে সনিষ্ঠ প্রত্যয়ে আমার কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেছ তাই আজ তুমি দক্ষ চালকের যোগ্যতা অর্জন করেছ। যাক, কবে কোথায় তোমায় সম্বর্ধনা দেবে জানিও। ইচ্ছে, আমরাও হাজির থাকি।” মহেন হেসে বললে “আমি নিশ্চয়ই এসে জানিয়ে যাব, কিন্তু সে হয়তো বাহুল্য হবে। আমার আগেই হয়তো কাগজ মারফৎ আপনারা জেনে যাবেন।”
সারাটা দিন বর্ধন সাহেবর ওখানে কাটিয়ে রাতের খাওয়া সেরে মহেন ফিরে গেল তার মেসে। সকালে আবার তাকে গাড়ি নিয়ে বেরোতে হবে।
সেদিন মহেন এক্সপ্রেস ট্রেন নিয়ে বেরিয়েছে। বিকাল থেকেই আকাশে ঘনঘোর, মাঝে মাঝে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে কিছুক্ষণ বাদে বাদেই। যথানিয়মে মহেন সামনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে স্বাভাবিকভাবেই ট্রেন চালাচ্ছে। হঠাৎ ইঞ্জিনের আলোতে কেমন একটা অস্বাভাবিক অবস্থা নজরে এল, নিশ্চয় করবার জন্যে আলোর রশ্মি তীব্র করে অজ্ঞাতসারেই থামাবার হাতল চাপল। ততক্ষণে দেখা গেল একটি বালক একটা রঙিন কাপড় উড়িয়ে গাড়ির দিকে ছুটে আসছে। মহেন গাড়ি একেবারেই থামিয়ে দিল। লাফ দিয়ে নেমে বালকটির নিকট গেল। বালকটি তখন কাঁপছে, বুক ফাটিয়ে হাঁপাচ্ছে। মহেন তাকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁপুনি বন্ধ করল— ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করল কী ব্যাপার। ছেলেটির কাছে জানা গেল সামনে লাইন ভাঙা— গাড়ি যেতে পারবে না, দুর্ঘটনা ঘটবে। তার বাপ গেটম্যান, জ্বরে অচৈতন্য। সে গেট বন্ধ করতে গিয়ে দেখে রেলের পাটি খোলা— তাই সে ছুটে এসেছে গাড়ি থামাবার জন্যে।
ততক্ষণে সহকারী, গার্ড সমেত কিছু উদ্যোগী যাত্রীও গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। তারা কিছুটা দূরে গিয়ে দেখল সত্যই একটা পাটি খোলা— গাড়ি এগোলেই নির্ঘাত দুর্ঘটনা ঘটত। ছেলেটির কোনও বিচার বিবেচনা ছিল না, ছিল না প্রাণের ভয়— লক্ষ্য শুধু একটাই ছিল যে করেই হোক গাড়ি থামাতেই হবে। আর কোনওকিছুই তার ভাববার অবকাশ ছিল না। বাবার লাল নিশানটি উড়িয়ে প্রাণপণে ছুটেছে সে গাড়ি থামাবার জন্যে।
অগ্রবর্তী স্টেশনটি অপেক্ষাকৃত কাছে হওয়াতে একদল সেখানে গিয়ে খবর দিল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে— মেরামত না হলে চলতে পারবে না। অবিলম্বে মেরামতের ব্যবস্থা করা হোক।
ছেলেটির নাম সুখেন। সে ততক্ষণে খাবার বগিতে গিয়ে রীতিমতো বীর বনে গেছে। যাত্রীরা সবাই ভিড় করে তার কাছ থেকে বিবরণ চাইছেন। মহেন অনেক কসরৎ করে তাকে আড়াল করে যাত্রীদের কৌতূহল মেটাল। গাড়িতে একজন ডাক্তার ছিলেন, তিনি নেমে গিয়ে গেটম্যানকে দেখে ব্যবস্থাপত্র দিলেন। কপালক্রমে গাড়িতে কিছু মেডিক্যাল প্রতিনিধি ছিলেন, তাদের কাছে দরকারি ওষুধও পাওয়া গেল।
পরদিন খবরের কাগজে এই বীরবালক সুখেনের সমাচার সারাদেশে প্রচার হল।
পনের দিন পর হাওড়ার রবীন্দ্র সদনে মহেনের সম্বর্ধনা সভার আয়োজন হল। আয়োজক যাত্রী সংগঠন। পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার উপস্থিত হয়ে মহেন্দ্রকে পুরস্কৃত করবেন।
বর্ধন সাহেবকে খবর দিতে গেলে তিনি হেসে বললেন “আমরা তোমার আগেই জেনেছি। তুমি ঠিকই বলেছিলে। তা সেই ছেলেটিও থাকবে তো সেই— সেই সুখেন?”
—“হ্যাঁ, সে তার বাবার সঙ্গে আসবে।”
রবীন্দ্র সদনের সভায় যাত্রী সংঘের সভাপতি সকলকে স্বাগত জানিয়ে মহেন্দ্র এবং সুখেনের সাহসী কাজের বিবরণ দিয়ে বললেন— “এদের কাজের মূল্যায়ন বড় দুরূহ, আমরা যাত্রীদের পক্ষ থেকে এদের জানাই অজস্র সাধুবাদ।”
জেনারেল ম্যানেজার বললেন “আমাদের পরিবারে এমনি অনেক কর্তব্যপরায়ণ কর্মী আছেন যাদের সঙ্গে আমাদের আজও পরিচয় হয়নি। কিন্তু যাদের পরিচয় আমরা পেয়েছি তাদের যদি যথাযোগ্য সমাদর করতে আমরা ব্যর্থ হই তবে তা হবে ঘোরতর ত্রুটি। আমি এদের মর্যাদা হিসাবে মহেন্দ্রকে পঞ্চাশ হাজার এবং সুখেন্দুকে দশ হাজার টাকার চেক উপহার দিচ্ছি।”
উপস্থিত সকল সভাজন হাততালি দিয়ে বিপুল সমর্থন জানাল। যাত্রী সংঘের সম্পাদক একখানি মানপত্র ও দশ হাজার আর পাঁচ হাজার টাকার চেক দিলেন।
সভাপতি আমন্ত্রণ জানালেন “এবার মহেন্দ্র আমাদের কিছু বলবেন।”
মহেন্দ্র বিব্রত মুখে উঠে দাঁড়িয়ে জানাল তাকে যে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে তার প্রকৃত অধিকারী তার গুরু বর্ধন সাহেব যার কাছে সে কাজ শিখেছে। প্রকৃতপক্ষে মহেন্দ্র তার কর্তব্যই করেছে মাত্র। কিন্তু বালক সুখেন যে ঘোর দুর্যোগ অগ্রাহ্য করে গাড়ি বাঁচাবার জন্যে যা করেছে তার কোনও তুলনা নেই। সভাপতি, তার ডান দিকে বসা জেনারেল ম্যানেজার, বাম দিকে বসা বর্ধন সাহেব এবং সমাগত সভাজনের কাছে মহেন্দ্রর বিনীত প্রার্থনা তারা দয়া করে অনুমতি দিন বর্ধন সাহেব, যাত্রী সংঘের সভাপতি, ও সম্পাদক এই তিন জনকে নিয়ে একটি ট্রাস্ট করে তাদের হাতে ষাট হাজার টাকার তহবিল তৈরি হোক যার একমাত্র উদ্দেশ্য সুখেনের উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
জেনারেল ম্যানেজার বললেন— “সাধু প্রস্তাব। সুখেনকে রেল থেকে মাসে পঞ্চাশ টাকা জলপানি দেওয়া হবে।” সভাপতি বললেন “আমি অভিভূত— কেমন করে মনোভাব প্রকাশ করব জানি না। মহেন্দ্র দীর্ঘজীবী হোন— তার দৃষ্টান্তে আরও মানুষকে অনুপ্রাণিত করুন।”
পরদিন সমস্ত খবরের কাগজে এই সম্বর্ধনার বিবরণ প্রকাশিত হল। আজকাল নিরাপদ নিয়মিত কাগজ পড়ে। খবর পড়ে সে উৎসাহে বর্ধন সাহেবকে জিজ্ঞাসা করে দাদাবাবু আজ আসবেন কিনা। বর্ধন সাহেব হেসে বলেন, “গাড়ি নিয়ে না বেরতে হলে নিশ্চয় আসবে।” নিরাপদ উল্লসিত স্বরে বলে— “তাহলে কিন্তু বাবু আজ মুরগি আনব।”
বর্ধন বলেন, “না, ও তো মাংস অপছন্দ করে। বরং ও এসে গেলে জলখাবার দিয়ে গঙ্গার টাটকা ইলিশ যদি পাও তাই এনো।”
নিরাপদ সোৎসাহে বলে— “তাই ভাল, ভাতে আর ভাপা ইলিশে খুব ভাল হবে।”
দূরে দেখা গেল মহেন আসছে। নিরাপদ ত্বরিত পদে মহানসে প্রস্থান করল।
ইতিমধ্যে পচা আর ভজা যথারীতি হাজির। জলযোগের পরে তারা পড়তে গেল। বর্ধন আর মহেন যথানিয়মে গাছের পরিচর্যায় নিযুক্ত হলেন।
নিরাপদ এসে বললে— “বাবু, বাজারে যাচ্ছি।” বর্ধন সাহেব বললেন, “তা যাও তবে মনে করে দাদাবাবু বিকেলে যখন যাবে গাছ থেকে ক’টি কচি দেখে শশা দিয়ে দিয়ো।”
ঘণ্টা তিনেক বাদে বর্ধন সাহেব পচা-ভজাকে স্কুলে দিয়ে এসে বসেছেন এমন সময় বর্ধন সাহেবের চুঁচুড়া থেকে মেয়ে এসে হাজির দুই ছেলে সঙ্গে করে। স্বভাবমতই সাহেব হাঁক পাড়েন, “নিরু!” নিরাপদ হন্তদন্ত হয়ে আসে, চোখ পাকিয়ে বলে “আরে, কী কাণ্ড দিদিমণি খোকারা ভাল তো সব।”
ততক্ষণে খোকাদু’টি দাদামশায়ের দুই বগলে দু’জন স্থান নিয়েছে। সাহেব বললেন, “হ্যাঁরে বুড়ি তোদের খবর সব ভাল তো?” ভাল নাম শুভা, বাপ আদর করে ডাকেন বুড়ি বলে।
নিরু বাধা দিয়ে বলে, “দাঁড়ান বাবু, আগে ওরা কী খাবে জেনে নি।”
শুভা বলে “জল খাবার খেয়ে বেরিয়েছি। চা দাও আর তারপর চান করে দুটো ভাত কী জুটবে না?” নিরাপদ জিভ কেটে বলে “এমা ছি ছি, আমার রান্না তৈরি। বলো তো ভাত বেড়ে দি। দাঁড়াও চা আনছি।”
বর্ধন জিজ্ঞাসা করলেন “তোদের খবর বল, শ্রীমান কোথায়?”
শুভা জবাব দিল— “আমাদের আর কীসের খবর। খবর তো তোমাদের— সব কাগজের পাতা জোড়া খবর পড়েই তোমার শ্রীমান আমাদের আসতে বললেন। তিনি হয়তো বিকেল নাগাদ এসে পড়বেন। তা তোমার বীরপুত্র কোথায়— তিনি আসেননি?”
—“মহেন তো বাগানে কী সব করছে, এসে পড়বে।”
—“এখন তো তুমি তোমার মহেনকে নিয়েই মেতে আছ— আমরা সব ভেসে গেছি”— ছদ্ম অভিমানে বলল শুভা।
—“কেন, পচা ভজা আর নিরাপদকে বাদ দিলি কেন? ওরা তো মহেনের থেকেও বেশি বেশি কাছে”— মৃদু হেসে বললেন বর্ধন সাহেব। তিনকাপ চা নিয়ে নিরাপদ আর তার পেছন পেছন হাসিমুখে মহেন এল। আলনায় ঝোলানো জামার পকেট থেকে দুটো ক্যাডবেরি চকোলেট বের করে মহেন ধরিয়ে দিল টম আর বিলের হাতে। চকোলেট পেয়ে তারা জড়িয়ে ধরল মহেনকে।
চায়ে চুমুক দিয়ে শুভা বলল— “তোমার এত দস্যুপনা কিন্তু ভাল নয় মহেন।”
—“ভাল নাইই হোক হাজার মানুষের জীবন তো বাঁচল— সেটা দেখবে তো।”
নিরু হাঁকডাক শুরু করল— “স্নান খাওয়া করতে হবে তো।”
টাটকা গঙ্গার ইলিশ ভাতে আর ভাপা ভোজটা ভালই জমল।
বিকেলে বর্ধন সাহেবের জামাই শৈলেন এসে যাওয়াতে আসর আরও একবার জমল। তবু খাওয়াদাওয়া সেরে সন্ধ্যার পরেই সবাই ফিরে গেল।
নদীর স্রোতের জোয়ারভাটা আছে— আছে উজান আর ভাটি কিন্তু সময়ের স্রোত একমুখী। শুধুই ভাটি। সে আর ফেরে না। জলস্রোত যেমন ভূমির পরিবর্তন ঘটায় কালস্রোতও অবিরত পরিবর্তন ঘটিয়ে চলে। নদী যে মৃত্তিকা গ্রহণ করে তাকে আবার অন্যস্থানে ফিরিয়ে দেয় কিন্তু কালস্রোতের তেমন কিছু আছে কিনা আমরা জানি না।
বর্ধন সাহেবের সমস্ত মাথা সাদা হয়ে গেছে। অবসর নেবার পর দাড়ি রেখেছিলেন সেগুলিও সব সাদা। মেদহীন গৌরকান্তি দীর্ঘ ঋজু দেহকাণ্ড দেখে মনে হয় ঋষি, তপোবনবাসী তপস্বী।
পচা ভজাও বড় হয়েছে। ভালভাবে ক্লাসে উঠছে। নিরাপদর চালচলন অপেক্ষাকৃত মন্থর হয়েছে, আর সবই বাহ্যদৃষ্টিতে গতানুগতিক।
সেদিন বিকেলে স্কুল ছুটির সময় অভ্যাসবশতই বর্ধন সাহেব লেভেল ক্রসিংয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, যদিও এখন আর প্রয়োজন হয় না। গেট বন্ধ, কোনও গাড়ি আসছে। দু’টি ছেলে কথা বলতে বলতে এসে গেটের পাশ দিয়ে লাইনে উঠে পড়ল, তারা নিজেদের নিয়েই গভীরভাবে মত্ত, বাইরের কোনও কিছুর দিকে খেয়ালও নেই, পরোয়াও নেই। ট্রেন এসে পড়েছে, কয়েক সেকেন্ড মাত্র সময়। বর্ধন সাহেব ঝাঁপিয়ে পড়ে দু’হাতের প্রচণ্ড ধাক্কায় ছেলেদু’টিকে ছিটকে দিলেন, আছাড় খেয়ে হাত পা হয়তো ভাঙল কী কাটল, কিন্তু তারা প্রাণে বেঁচে গেল। তারা বেঁচে গেল বটে কিন্তু বর্ধন সাহেব নিজেকে বাঁচাতে পারলেন না। প্রাণপণে ব্রেক করা সত্ত্বেও ইঞ্জিন বিকট আওয়াজ করে যখন থামল সাহেবের দেহ তখন পিণ্ডাকার।
ইঞ্জিন থামতেই ড্রাইভার ঝাঁপিয়ে পড়ল, ছুটে গিয়ে ইঞ্জিনের নীচে থেকে পিণ্ডাকার দেহকাণ্ড বুকে করে বের করে আনল। মৃতদেহ লাইনের পাশে শুইয়ে দিয়ে সহকারীকে বলল “তুমি গাড়ি নিয়ে যাও, আমি আর যেতে পারব না।”
ততক্ষণে লোকজন অনেক জড়ো হয়েছে। বর্ধন সাহেব আর ড্রাইভারও সকলের কাছেই সুপরিচিত— সে মহেন্দ্র।
মহেন্দ্র রক্তাক্ত গতপ্রাণ বর্ধন সাহেবের দেহ বহন করে নিয়ে গেল তাঁর বাড়িতে। সে আর যেতে পারবে না। সৎকার না হওয়া পর্যন্ত তাকে থাকতেই হবে।
খবর পেয়ে ছোটছেলে আর মেয়েজামাই ছুটে এল শেষকৃত্য করতে। পুলিশও এল বটে তবে তারা শবানুগমন করেই ফিরে গেল।
কেউ খেয়ালও করল না কখন কোন ফাঁকে মহেন্দ্র হারিয়ে গেল।
বহুকাল বাদে খবর পাওয়া গেল মহেন্দ্র হিমালয়ের শিখরে শিখরে পায়ে হেঁটে পরিভ্রমণ করছে।

১৮/০৭/১৯৯৮

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »
শুভদীপ রায়চৌধুরী

শুভদীপ রায়চৌধুরীর দুটি কবিতা

অন্ধকারের তুমি,/ নরম পুঁইমাচার নিচে সবজেটে বহুরূপী/ তোমাকে আলোর কণার ভেতর গড়িয়ে যেতে দেখব বলে/ আমি এই পাগলের পৃথিবী ছেড়েছি/ টিলাপায়ে বাস করি/ নাম, সমুদ্রসম্ভব।/ পাতার ইমারত আছে, আছে/ কিছু দৈনন্দিন কাজ/ মাছ ধরার নাম করে/ বালসাভেলায় অনেকদূর যাওয়া/ যতদূর ভেসে গেলে ঢেউয়ের চুম্বন থেকে/ ছোবলটুকু আলাদা করাই যায় না

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | দ্বিতীয় পর্ব

সকালে চিড়ে নারকেল-কোরা আর গুড় খেয়ে আমি সাইকেলে চেপে ছুটিয়ে দিলাম— আট মাইল রাস্তা ঠেঙিয়ে যখন পৌঁছালাম— তখন গণগণে রোদ্দুর তেষ্টায় গলা কাঠ। ঘন্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে একটা বাড়ি দেখে সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম যদি একটু জল খাওয়া যায়। বাড়ির বারান্দায় একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি বসেছিলেন— তার কাছে উদ্দিষ্ট ঠিকানার কথা প্রশ্ন করতেই তিনি উঠে এসে আমার হাত ধরে আমাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে একটা পাটি পেতে বসতে দিলেন। আমি আবার জল চাইলে বললেন, “দাদাঠাকুর ব্যস্ত হবেন না— ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন।”

Read More »