Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

কোথাও ফেরার থাকে না

নির্মল হালদার লিখেছিলেন:
‘আমার কাছে কোনদিন কিছুই ছিল না
আজও কিছু নেই, শুধু
পথে পথে ঘুরে বেড়াই
ঘুরতে ঘুরতে তার কাছে গেলে সে আমাকে দেয়
মুঠোভরা আমলকী।’

রিমঝিম আমলকী দেয়নি। চৈত্র মাসের এক তপ্ত দুপুরে শালবনের ভেতর রিমঝিম আমাকে এগিয়ে দিল অদ্ভুত এক ঘষামাজার জিনিস। এই দিয়ে কী করব? রিমঝিম তার উত্তর দিল শিশুর ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে, ‘পরিসসকার’।

বউনি হয়ে গেল রিমঝিমের, চলে গেল শালবনের গভীরে। আমি হাতে একটা শব্দ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম: ‘পরিসসকার’। আর একটা নাম ‘রিমঝিম’।

অদূরে, বনের পুকুরডাঙা গ্রামে বাড়ি। বয়স খুব বেশি হলে পাঁচ বছর। ওকে বলতে ইচ্ছে হল, আমি কাল বাড়ি চলে যাচ্ছি রিমঝিম। অনায়াসে বলা যেত। কিছুই বুঝত না হয়তো। তবে বোঝানোর কী প্রয়োজন আমার? আমি তো শুধু বলতে চাইছিলাম, ‘কাল আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি, রিমঝিম।’

রাতের বেলা খেতে গেলাম একটা ঝুপড়িতে। আলু-পটলের তরকারি ফুরিয়ে গেছে আজ। দেরি হয়েছে, তাই শুধু সোয়াবিন। ভাত ঠান্ডা হয়ে গেছে। ডিম ভাজার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে দূর থেকে। মাথা নীচু করে একমনে খেতে শুরু করলাম। মনের ভেতর এক অদ্ভুত প্রশ্ন কেমন পুড়িয়ে চলেছে। কেন যা কিছু এত প্রিয় লাগে তা সবচেয়ে দ্রুত ফুরিয়ে যায়। শৈশব। প্রিয় মানুষ। ভাল লাগার এক একটি জায়গা।

বসন্তের মাতাল হাওয়া পাঞ্জাবির ভেতর থেকে শরীরকে স্নিগ্ধ করে যাচ্ছে। সন্ধে থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। তালতোড়ের অন্ধকারে বসেছিলাম সন্ধের রেলগাড়ি দেখব বলে। দূর থেকে রেলগাড়ির আলো এবং তার ভেতরে কত অপরিচিত মানুষ। কোথায় তাদের বাড়ি? কী নাম? সৃষ্টিকর্তা তাদের কখনও জানাবেন না যে আজ এই যাত্রাপথে দুটি চোখ তাদের লিখে নিচ্ছে ভেতরে। তাদের মুখ, বসার ভঙ্গি এমনকী তাদের ভেতরের আনন্দ, বিষাদটুকু।

ঝুপড়ির দিদি এসে আর একটু ভাত ঢেলে দিলেন পাতে। গরম ভাত। বললেন, ‘পরিসসকার করে খাব্বে।’ ‘পরিসসকার’। মনে পড়ল রিমঝিমের কথা। সে এখন হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ বউনিতে সে আমাকে একটি শব্দ দিয়ে গেছে, ‘পরিসসকার’।
ঝুপড়ির বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের দিদিকে বলতে ইচ্ছে হল, ‘কাল আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি, দিদি।’ বলা হল না। টাকা মিটিয়ে নীরবে নেমে এলাম বনের রাস্তায়।

খালপাড়ের একটা বাড়িতে মৃত্যু এসে দাঁড়িয়েছে সকাল সকাল। চারিদিকে থমথমে মুখ। সকাল থেকে এই পথে অনেকবার যাতায়াত করেছি। প্রত্যেকবার একটি মুখের কাছে দুটো চোখ আটকে গেছে। একটি তেরো-চোদ্দো বছরের মেয়ে। কালো মুখের ওপর অপূর্ব দুটি চোখ, গভীর। গলার কাছে কী ভীষণ একটা কষ্ট যেন দলা পাকিয়ে আছে। চোখদুটি আশ্চর্য নির্লিপ্ত।

তাকে লক্ষ করি। প্রতিবার সেই মৃত্যুর পটভূমিতে বারবার তার ওপরেই চোখ আটকে যায়। একটি তেরো-চোদ্দো বছরের ছিপছিপে মেয়ে। দুচোখ দিয়ে সামনে মৃত্যুর ফেলে যাওয়া পরিবেশকে দেখছে। চারিদিকে কান্নার পরিবেশের মধ্যে তার সেই তেরো-চোদ্দো বছরের শরীর। বনের পথের মত। যে পথে প্রতিদিন রাতের বেলা যাই একটা কিছুর সন্ধানে।

মনে হল সেই সকলের মাঝে গিয়ে বসি। তাদের শোকের মাঝে গিয়ে। আগুন জ্বালিয়ে কোনওক্রমে যা রান্না করেছেন তারা শুধু পেট ভরিয়ে রাখার জন্য, মনে হল গিয়ে খাই। হাতে লেগে থাকুক সেই এঁটো। বলি, সেই তেরো-চোদ্দো বছর বয়সী মেয়েটিকে, ‘কাল বাড়ি ফিরে যাচ্ছি, মেয়ে।’ বলা হল না। কাউকে কখনও বলা হয়ে ওঠে না বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা।

মৃত্যুর সাদা কাপড়ের মত জ্যোৎস্নায় এক বনভূমি থেকে পার হয়ে যেতে থাকি অন্য বনভূমি। এক প্রবাস থেকে অন্য প্রবাস। আর সকলকে বলতে চাই, ‘কাল বাড়ি ফিরে যাচ্ছি,ফিরে যাচ্ছি গো।’
কোথাও ফেরা হয় না আমার। শুধু পথের পর পথ। রিমিঝিমের অস্পষ্ট উচ্চারণে একটা শব্দ কেমন শরীরের ভেতর লেগে থাকে অথবা অপমানিত হয়। ‘পরিসসকার’।

অতিরিক্ত ভাতটুকু গরম ছিল। রিমঝিম হাতে ঘষামাজার জিনিস ধরিয়ে দিয়ে বউনি করল। এক শরীর মৃত্যু নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল একটি তেরো-চোদ্দো বছরের মেয়ে।
এদিকে কবি নির্মল হালদার লিখলেন:
‘আমার কাছে কোনদিন কিছুই ছিল না
আজও কিছু নেই, শুধু
পথে পথে ঘুরে বেড়াই
ঘুরতে ঘুরতে তার কাছে গেলে সে আমাকে দেয়
মুঠোভরা আমলকী।’

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
4 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »