Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

জন্মদিন

২০১৯-এর জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মাথায় গৌরব হঠাৎ আবিষ্কার করল, সে চন্দ্রাণীর জন্মদিন বেমালুম ভুলে গেছে। আকস্মিক এই জুনমাসীয় যোগাযোগ, তবুও, আপ্রাণ চেষ্টা করে দেখল যে, তার চন্দ্রাণীর জন্মদিন মনে নেই। সে কোনওমতেই তার বিগত প্রেমিকার জন্মতারিখ মনে করতে পারছে না। স্পষ্টই মনে আসছে, জুন মাস, জন্মসাল ১৯৭২ কী ৭৩ হবে হয়তো, কিন্তু, তারিখ, না… কিছুতেই মনে পড়ছে না।
আকস্মিক, তবু, এবছর জুন মাসেই মনে পড়ল এটা। এই আকস্মিকতার কোনও তাৎপর্য নেই, থাকতে পারে না। জুলাই, আগস্ট বা ডিসেম্বরেও একথা মনে পড়তে পারত, এতে কিছুই যায় আসে না। বড় কথা হল, দুই দশকেরও বেশি অতিক্রান্ত, সময়ের পলি অনেক কিছুই স্বাভাবিক নিয়মে, অব্যর্থ, ঢেকে দিতে পারল, এমনকী প্রথম প্রেমিকার জন্মদিন।
স্বাভাবিক, অত্যন্ত স্বাভাবিক এটা। ভুলে যাওয়ার নিজস্ব একটা প্রক্রিয়া থাকে, এতে কাউকে দায়ী করা চলে না। তবুও, সবটুকু, ভুলতে পারা গেল কি? এই যে আকস্মিক মনে পড়ে যাচ্ছে জুন মাস, জন্মমাস মনে রয়ে যাচ্ছে কারুর, অথচ দিন মনে নেই, একেই বা কী বলা যায়? আংশিক বিস্মৃতি? অর্থাৎ, লোপ হতে হতে স্মৃতি একটা ছাপ রেখে যাচ্ছে, যেমন ভাটাতে সমুদ্র সরে গিয়ে বালিতে ঢেউদাগ রেখে যায়?
এই আংশিক স্মৃতি ও বিস্মৃতির অবাধ দোলাচল কিয়দংশে অস্বস্তিকর। কেননা খুঁতখুঁত করছে, কবে যে জন্মদিন চন্দ্রাণীর, কিছুতেই মনে পড়ছে না। বস্তুত আজ আর কোনও লৌকিক কী ব্যবহারিক কাজে লাগবে না এই তথ্য, তবুও জানা থাকলে অস্বস্তিটা অন্তত যেত।
যেন একটা গর্হিত কাজ করে ফেলেছে, বা অমার্জনীয়, দিন ভুলে গিয়ে মাস মনে রাখার এই বেআক্কেলে অপরাধ। এমন আংশিক নির্দোষ অস্বস্তি তাকে আচ্ছন্ন করে রাখল সারাটা দিন, এমনকী পরের দিন ভাবনাটা ফের এল। সন্ধের দিকে সে অতএব দেবায়নকে ফোন করল।
একথা-ওকথার পরেই গৌরব সরাসরি ফোনে প্রশ্ন ছুড়ে দিল, ‘দেবু, তোর থিটাকে এখনও মনে আছে?’
—’থিটা?’ একটু থেমে দেবু হা হা হাসল ফোনে, ‘ওটা আমার প্রথম খাওয়া কেস।’
—’তা, তোর কতটুকু মনে আছে থিটাকে?’
—’আরে কেসটা তো জমেইনি। কিছু হয়নি তেমন।’
—’ওর ভাল নাম কী ছিল রে?’
—’শ্রাবস্তী।’
—’পদবি?’
—’দাঁড়া, বলছি, হুঁ, লাহিড়ী।’
—’ওর জন্মদিন কবে ছিল?’
—’যা শালা। মনে নেই তো। মনে হয় আমি তখনও জানতাম না।’
—’সত্যিই জানতিস না?’
—’আমার শালা কারুর জন্মদিন মনে থাকে না। বউ, ছেলে, কারুর না, সিরিয়াসলি। জন্মদিনের আগে আগে বউ রিমাইন্ডার দেয়।’
—’কিন্তু, তুই ওকে পুরোটা তো ভুলিসওনি।’
—’প্রথম কেস। সেজন্যই। ভেবে দ্যাখ, প্রথম সব কিছুই ভালমতন মনে থাকে। ফার্স্ট কিস, ফার্স্ট মাস্টারবেশন, ফার্স্ট ইন্টারকোর্স— সব।’
এর পরেই দেবু ফোন রেখে দেয়।
কিন্তু, পরের দুটো দিন এই অস্বস্তি রয়েই গেল। কোনও লজিক্যাল পদ্ধতিতে এর নির্ণয় সম্ভব নয়, একটি নিছক তথ্য। সম্ভবত জুনের দ্বিতীয়, কিংবা তৃতীয় সপ্তাহে চন্দ্রাণীর জন্মদিনের অবস্থান, তা ১০ বা ১২ জুনের আগে কিছুতেই নয়। অন্যদিকে ২৮ বা ২৯, এতটা দেরিতে নয়। এতটা বলা যাচ্ছে কীভাবে? না, স্থির বলা যাচ্ছে না। নিছক অনুমান, ততোধিক ভিত্তিহীন স্মৃতিনির্ভর। কিন্তু, স্মৃতি কিছু ধরতে পারছে কি? চারটি অপশন দিয়ে যদি একটি মাল্টিপল চয়েস প্রশ্ন দেওয়া হয়, যার চারটিই জুনমাসসম্বলিত, সেক্ষেত্রেও নিশ্চিত ব্যর্থ হবে গৌরব। ভাবতে ভাবতে পর্যায়ক্রমে ১৫, ১৭, ১৮ থেকে শুরু করে ২৬ অবধি মনে হল, এর যে কোনও একটিই চন্দ্রাণীর জন্মদিন হলে সে অন্তত অবাক হবে না। সম্ভাবনাতত্ত্ব লাগিয়ে বিচার-বিবেচনা করেও স্থিরভাবে জন্মদিনটি বের করা কি সম্ভব?
একটা সহজ রাস্তা ছিল। হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুকে দুজনের কমন পরিচিত কাউকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা। কিন্তু, অন্যের জন্মদিন কেউ অকারণে মনে রাখে না। দ্বিতীয়ত, ডিগনিটি খোয়া যায়। পুরনো প্রেম উথলে উঠেছে, এমন একটা হাস্যকর ও ভুল অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হয়।
কবে জন্মদিন, কবে, কবে, কবে?
চন্দ্রাণী কি এখন বিদেশে? ফেরেনি আজও? ধুর তাতে তার কী?
কিন্তু, জন্মদিনটা কবে?
এবছর, আশ্চর্য, এখনও মনসুন আসেনি। অর্থাৎ, চন্দ্রাণীর জন্মদিনের সঙ্গে মনসুন আসার, বৃষ্টিকালের সম্পর্ক ছিল, থাকবে হয়তো। কিন্তু, কিছুতেই এই দুটোকে রিলেট করে কোনও স্মৃতি আসছে না। তাদের বিচ্ছেদের পর দুই দশকে কত মনসুন গেছে, এসেছে, তাতে তার কি কিছু এসে গেছে? তার হৃদয়ে কোনও নস্টালজিয়া নেই, আজও। তবে বিস্মৃত জন্মদিন কুরে কুরে খায় কেন?
এর একটা আশু বিহিত হওয়া প্রয়োজন, অন্তত অস্বস্তিটুকু যাওয়া একান্ত দরকার। একটা আদ্যন্ত অগুরুত্বপূর্ণ তথ্য, নিছক তথ্যই তো, জেনে গেলে আপাতত শান্তি।

চন্দ্রাণীর সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়েছিল ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ। তখন তারা কলেজে, একই ক্যাম্পাসে। দুজন, ভিন্ন হস্টেলে। কালচারাল ফেস্টের সূত্রে পূর্বে হালকা আলাপটুকু মাত্র ছিল। সেখান থেকে ঘনিষ্ঠতা কোনও স্বাভাবিক নিয়মে হয়নি। গৌরবের থার্ড ইয়ারের মাঝামাঝি একসময় মনে হচ্ছিল, তার কাউকে দরকার। কাউকে, অর্থাৎ, একান্ত এক মানবী, যে সমসাময়িকা। এই মনে হওয়াটা, বস্তুত, তার আর পাঁচটা সাময়িক খাপছাড়া খেয়ালের মত। সেই সময়ে গৌরব নিতান্ত অনাবশ্যক, অথচ এক বুঁদ হওয়া জীবন কাটাচ্ছে। উদ্দেশ্যহীন ছাত্র রাজনীতি, দু-চারটে কবিতা বানিয়ে তোলা, পাঠ্য সিলেবাসে অনাসক্তি, একধরনের অগভীর সাময়িকতার ছন্নছাড়া চর্চা ছাড়া কী-ই বা বলা চলে একে? এই সেই সময়, যখন, তার জীবনের কোনও অভিমুখ ও গন্তব্য ছিল না। তবুও, কাউকে যেন তার প্রয়োজন হয়ে পড়ছিল।
সেই তার সাক্ষাৎ মিলল কলেজের ইউনিয়নের ফ্রেশার্স ওয়েলকামের সন্ধেয়। অনুষ্ঠানটি কন্ডাক্ট করছিল শাড়িপরিহিতা দ্বিতীয় বর্ষের, দৃশ্যত লাজুক, চন্দ্রাণী। স্টেজের আলো তার ওপরেই অধিকাংশ সময়ে পড়ছিল সেই সন্ধ্যায়।
প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে যখন আপাতগন্তব্যহীন গৌরব অন্য এক সন্ধেয় অবশেষে চন্দ্রাণীর সম্মুখীন হয়, চন্দ্রাণী সরাসরিই গৌরবের অভিপ্রায় জানতে চায়।
ঠিক এই সময়ে আচমকা এই প্রশ্নে গৌরব কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সে কিছুটা বেশি সঙ্গ চাইছিল স্ব-নির্বাচিত সেই প্রথমার, কিন্তু, চন্দ্রাণীর বোল্ড অ্যাপ্রোচ তাকে কার্যত হতচকিত করে দেয়। তার ধারণা ছিল চন্দ্রাণী ট্র্যাডিশনাল এবং লাজুক। তার এই ধারণায় তেমন কোনও ভ্রান্তি ছিল না। পক্ষান্তরে, তার নিজের সম্পর্কে ধারণা ছিল, যে, সে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রত্যক্ষ কারবারি, এবং, নিজস্ব যাপিত জীবনের মূল সূত্রগুলি যেন তার অবিরত চর্চায় নিতান্ত করায়ত্ত। তার নিজের কথায় ধোঁয়াশা ছিল, আবছা ও অবান্তর কিছুই বলছিল সে। কিন্তু, আবার, চন্দ্রাণীর স্পষ্ট প্রশ্নই ছিল, গৌরব কী চায়, তা খোলসা করে, সমূহ কাব্যময়তা এড়িয়েই সরাসরি বলুক। গৌরব এই সময়ে আত্মবিশ্বাসের অভাব বোধ করে, যদিও বাহ্যত এই ঘাটতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য সে যথেষ্ট যত্নবান ছিল। প্রকৃত প্রস্তাবে, ডিরেক্ট বা সরাসরি প্রশ্নের, ইনডিরেক্ট বা পাশ এড়ানো উত্তর অনেক সময়েই উত্তরদাতাকে হাস্যকর ও দুর্বল করে তোলে। এবং চন্দ্রাণীও তাই বলেছিল, ‘তুমি খুব হাস্যকর কথা বলছ।’ অপমানিত ও মরিয়া গৌরব তখন বলে, ‘আমি তোকে জানতে চাই। বুঝতে চাই।’ নির্বিকার চন্দ্রাণীর আবার ও অব্যবহিত, ‘কেন? মরতে আমিই কেন?’-র জবাবে খড়কুটো আঁকড়ানো গৌরব, ‘আমি তোর ব্যাপারে আগ্রহী’— এইটুকু কোনওমতে বললে তাদের প্রথম দিনের অমীমাংসিত ও বিফল সান্ধ্য সেশন শেষ হয়।
কার্যত ফাঁপরে পড়ে যাওয়া গৌরব পরবর্তী সন্ধেয় পুনরায় যুক্তির চাইতে আবেগকে বেশি প্রশ্রয় দেয়। এই সময়ে নির্বিকার ও ভাবলেশহীন চন্দ্রাণী আবার বলে, ‘কী চাও?’
বিমর্ষ ও মরিয়া গৌরব বাধ্যত বলে, ‘আমার তোকেই দরকার। আমি তোকে চাই।’
কিছুক্ষণ নীরবতা ভেঙে এক-ইয়ার জুনিয়র চন্দ্রাণী বলেছিল, ‘তুমি কি কথাটা সিরিয়াসলি বলছ? নাকি এটা কোনও খেয়াল?’
গৌরব যে-কথা বলতে চায়নি, যেভাবে বলতে চায়নি, অন্তত শুরুটা এভাবে হোক, কোনওমতেই চায়নি, তবুও এমন একটা অবিশ্বাস্য ও নাটকীয় কথা তার মুখ থেকেই বেরুল? কিন্তু, যে কোনও সংঘাতময় ও গতিপ্রবণ সংলাপ, নিজের নিয়মেই নিজের যথোচিত অভিব্যক্তি ও শব্দসমূহ খুঁজে নেয়। সেই সময়ের অনন্যোপায় গৌরবের মুখ থেকে এমনই এক মা নিষাদ উচ্চারিত হয়, যা তাকে অনতিবিলম্বেই চন্দ্রাণীর গাঢ় নৈকট্য দেবে। কেননা, এর পরের থেকেই চন্দ্রাণীও গৌরবকে আশ্চর্য করে দ্রুত প্রতিরোধহীন, ব্যক্তিগত ও ক্রমশ নিবিড় হয়ে উঠল।
পরের কয়েক দিন তীব্র ঘোর ছিল গৌরবের। সান্ধ্য ঘোর। সেদিকেও চন্দ্রাণীর সজাগ দৃষ্টি ছিল।
‘তোমার এই ঘোর যদি কেটে যায় কোনওদিন?’, মৃদু স্বরে বলেছিল সে। তার স্বরে একধরনের মায়াময় অসহায়তা ছিল।
কবে বলেছিল চন্দ্রাণী? কোন মাসে?
অনেক ভেবেচিন্তে একটি গর্হিত কাজ করেছে গৌরব। একটা ফেক প্রোফাইল খুলেছে ফেসবুকে। প্রাথমিকভাবে ফেসবুকে সার্চ দিয়ে অপরিসীম মাত্রায় নানাবিধ চন্দ্রাণী রায় আসতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে ক্লান্ত গৌরবের খেয়াল হয়, চন্দ্রাণী আজ, সম্ভবত, বিবাহিত, এবং, পদবি বদলানোও কিছু অসম্ভব নয়।
পরে জনা কয়েক কলেজের ফেসবুক-ফ্রেন্ডের প্রোফাইলে সে চন্দ্রাণী রায় বসু খুঁজে পেল। কিন্তু, সেই প্রোফাইলে ক্লিক করে প্রোফাইল পিকচারে একটি জে কে রাউলিংয়ের ছবি ছাড়া সে আর কিছুই পেল না। এর থেকে দুটি অনুমান করা যায়। হয় চন্দ্রাণীর নাম কা ওয়াস্তে একটা ফেসবুক প্রোফাইল আছে, যা কার্যত ব্যবহৃত হয় না। অথবা, তার নিজের প্রোফাইলটি এমনভাবে কাস্টমাইজ করা, যা কেবলমাত্র বন্ধুরাই অ্যাকসেস পেতে পারে।
যাই হোক, কোনওমতে চন্দ্রাণীর জন্মদিনটি জানা জরুরি। সেহেতু, গৌরবের এই প্রোফাইল, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আজ জুনের ১৮ হয়ে গেল। প্রোফাইল খোলার তিনদিনের মধ্যেই জনা পঞ্চাশেক ফেসবুক বন্ধুও হয়ে গেছে প্রোফাইলে। কলেজের হস্টেলের দুটো পুরোনো ছবি সে নিজের প্রোফাইলে দিয়ে রেখেছে। তাছাড়া একটি কমন মেসেজ পাঠিয়েছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টে। ‘‘1996 এ পাস আউট। কল্লোল হাজরা। টিটি খেলতাম। মনে আছে তো? তোমাদের সঙ্গে প্রচুর মেমরি আছে। কাইন্ডলি একসেপ্ট ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট।’’ আজকাল মানুষ অতশত তলিয়েও দেখে না। কলেজের লোগো আর হস্টেলের ও ক্যান্টিনের কিছু ছবিই যথেষ্ট প্রমাণ যেন। অবশ্য, কেউ আগ বাড়িয়ে খুব আগ্রহ প্রকাশ করে অন্যের সম্পর্কে জানতে চাইবে, এত সময়ও কারও নেই। এই ফেসবুক, আর তার বন্ধুসমূহ, জাস্ট কিছু অনাবশ্যক অর্নামেন্ট বই কিছু নয়।
জুনের ১৮, হয়তো আজকেও হতে পারে চন্দ্রাণীর জন্মদিন। কে বলতে পারে? কিন্তু, যদি আজকেই হয়, তার, গৌরবের দৈনন্দিনে তা কোনও ভূমিকা রাখতে পারে? না, পারে না, কিন্তু বিস্মৃতি কি যথাযথ উচিত কাজ করল? বিস্মৃতির, আংশিক না হয়ে, সেরিব্রাল অ্যাটাকের মত তীব্র ও সম্পূর্ণ হওয়া উচিত ছিল না কি? যাকে বলে স্মৃতি, তা একটা অনভিপ্রেত খেলা খেলছে গৌরবের সঙ্গে। যেমনভাবে পাথরের প্রাচীন মূর্তিগুলিকে জল আর হাওয়া কালক্রমে খুবলে নেয়, তাতে আরও প্রকটভাবে অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়ে ওঠে গুহার গায়ের মূর্তিগুলি, আরও আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে লুব্ধ পর্যটকদের, এ সেই লুপ্ত সভ্যতার প্রতি অনাবশ্যক অপ্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক আগ্রহ যেন, যার কোনও ব্যবহারিক উপযোগিতা নেই, থাকতে পারে না।
কিন্তু, লুপ্ত সভ্যতার সংরক্ষণ যারা করে করুক, গৌরব কোনওদিনই এমন অনুচিত সঞ্চয়ের পক্ষপাতী নয়। সে অতীতের কোনওকিছুই জমিয়ে রাখে না। চন্দ্রাণীর সমস্ত চিঠি বা অন্যান্য অবান্তর স্মৃতিচিহ্ন তুলে রাখেনি। কোথায় সেসব পড়ে আছে, কোথায় ফেলেছে তা সে নিজেও জানে না। কেননা, সে শপথ নিয়ে নিজের হাতে আগুনে পুড়িয়ে পারলৌকিক প্রথায় কোনও অভিজ্ঞান দাহও করেনি। সুতরাং, সে সময়ের হাতেই সব কিছু ছেড়ে দেওয়া সমীচীন মনে করেছিল। এভাবেই এতকাল নিজের গতানুগতিক জীবন কাটাচ্ছিল।
কিন্তু, এ বছরের জুন যেন অস্বাভাবিক। মনসুন আসছে না। অন্যবার তো এসে যায়। মেঘের নামগন্ধ নেই। রেকর্ড তাপমাত্রা চারিদিকে। অনেকেই বলছে, এসবই গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের লক্ষণ। প্রকৃতিও সভ্যতার ওপরে প্রতিশোধ নিচ্ছে ভেতরে ভেতরে।
অস্বাভাবিক এই বছরেই দু-দশক পার করে চন্দ্রাণীর অনাহুত জন্মদিন তাকে এসে ক্রমাগত অনুযোগ জানিয়ে চলেছে : আমাকে মনে করো।
জুনের এই অনাবশ্যক দাবি মেনেই সেও এক অচেনা চন্দ্রাণীকে ছুপে পাঠিয়ে দিচ্ছে অপাংক্তেয় ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। অতীতের এক ঘনিষ্ঠ পরিচিতের কাছে আজ পুনর্বার ফরম্যাল ও আনুষ্ঠানিক রিকোয়েস্টের এই আয়োজন আজকের এই ছদ্ম-অপরিচিতের। এ কি তবে তার ছদ্মবেশে অ্যারাইভাল? চন্দ্রাণীর ভারচুয়াল রিয়েলিটিতে?
চন্দ্রাণীকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর সময় ছেচল্লিশ বছরের গৌরবের হাসিই পাচ্ছিল।

‘আমি কোনওদিন দেশে ফিরব না আর। দেখে নিয়ো।’ টেলিফোনে শেষ গলা শুনেছিল সে চন্দ্রাণীর, সেটা ১৯৯৭ সালে। কিন্তু কোন মাসে কে জানে?
কিছুই মনে করতে চায় না সে। তবুও নির্বাচিত সময়শাসিত স্মৃতি এসে বলছে কার বিশিষ্ট হাঁটার ধরন? গান শুরুর অব্যবহিত পূর্বের চোখ বুজে ফেলা কার? এসব অবচেতনে জমে ছিল ঠিক, আজ, তবুও এ এক আত্যন্তিক অনধিকার চর্চা।
আজ, তেইশে জুন হয়ে গেল। জন্মদিনের ফয়সালা হল না আজও, শুধু অনর্থক ভাবনা পেয়ে বসছিল আজ। অকিঞ্চিৎকর এই জীবনের বিগত ও লুপ্ত প্রেম বিষয়ক। তেমন করে ভাবলে এই প্রেম বিষয়টার কোনও কারিকুলাম নেই, প্রেম তবু যৌথ অনুমোদনের সাপেক্ষে এক অলিখিত অধিকার এনে দেয়, যা পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় কমন এক স্বার্থপর এজেন্ডায় নিয়োজিত। বন্ধুত্বের মত সম্পর্কে বলা হয় না একথা। ফলে বন্ধুত্বের এমন আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন নেই। অথচ প্রেমের একটা ন্যূনতম উদ্বোধন, প্রস্তাবনা তথা উদযাপন লাগে। কায়েমি সামাজিক বন্ধনে চিরস্থায়ী সিলমোহর যদি বিয়ে নামক প্রথা দেয় তবে প্রেম এক অসামাজিক অ্যানার্কির সংযত চেহারা। এই ভাবনায় সায় দিয়ে ফেলে গৌরব। প্রকৃত প্রস্তাবে, ঠোঁটে ঠোঁট রাখার যে প্রকৌশল আবিষ্কার করছে দুজনে, সেখানে ইন্ডিভিজুয়ালি নিজেকে খুঁজে পাওয়া ও হারিয়ে ফেলা— এমন এক আইনরহিত ও অতিবাহিত ক্রীড়াচ্ছল। ওইটুকু আদিম নিয়ম ধার্য রয়েছে আজও, শ্রেণি ও বর্ণ নিরপেক্ষ। এ এক শপথ নেওয়ার প্রক্রিয়া।
ফলে সমূহ ফারাক এসে একটি বিন্দুতে বিলীন হয়ে বদ্ধপরিকর থাকে দুটি ঘনীভূত ও আশ্বস্ত ঠোঁট। সেই সময়ে, যখন গৌরবের নিজের জীবনজারিত অনুভবকে চূড়ান্ত মনে হত, যে-সময়ে সে বাইনারি ওয়ার্ল্ডের অসহ্য ঝোঁকে আকাশে মুষ্টিবদ্ধ, সেই সময়ে চন্দ্রাণী নিজের সহজ আস্তিকতায় রেশমগুটি বুনছে। তাদের এই ফারাক চন্দ্রাণীর কাছে সহনীয় ছিল। সে তার নিজের যাপিত জীবনকে বাড়তি গরিমায় আলোকিত করেনি। তার কাঙ্ক্ষিত পরিসর ছিল একটি নিভৃত ছিমছাম দুজনের বাসযোগ্য একটি পৃথিবী। যতটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা একজন মোটামুটি মেধাবী কলেজপড়ুয়া ডিজার্ভ করে, ততটাই চন্দ্রাণীর নিজ-উদ্দিষ্ট ছিল। তার এই খেলাঘরে সে গৌরবকে সক্রিয়ভাবে চেয়েছিল। কিন্তু, গৌরবের তৎকালীন তারুণ্য এক অবুঝ ইডিওলজির দ্বারা আক্রান্ত ছিল। দুনিয়ার অন্যায় ও অসাম্য সে চারপাশের পরিবেশেই দেখতে পেত, কেননা সামাজিক বোধ এমনভাবেই একুশ বাইশের তরুণকে উদ্দীপ্ত করে। হা তার ইডিওলজি! তা চন্দ্রাণীর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, নাকি তারপরে, সে ঠিক জানে না, অন্ধ কানাগলিতে আছড়ে পড়ে একদিন। অতঃপর সে সেই জীবনই নির্বাচন করে যা চন্দ্রাণীর কাঙ্ক্ষিত ও অনুমোদিত ছিল। অথচ যে-কারণে চন্দ্রাণী তাকে অ্যাকিউজ করে চলে যায়, সেই কারণটাকেই ততদিনে অনর্থক বোধ হল তার নিজেরও। একটা মোটামুটি চাকরি, যা সাচ্ছল্য দিতে পারে, কিছু বন্ধু, এবং বিয়ে ও সংসার, অর্থাৎ একটি সাধারণ গতেবাঁধা জীবন অনুযায়ী অদ্যাবধি কাটছে গৌরবের। এই জীবনে তার ততটা ধিক্কার নেই, যতটা সায় আছে। অধ্যাপনা মন দিয়ে সে করে, প্রাপ্য প্রমোশন সময় মোতাবেক যেমন হয়, তেমনই পেয়েছে। গবেষণা করতেই হয়, তাই করে। যে কোনও কাজ করতে গেলে ভালবাসার চেয়েও বেশি ইনভলভমেন্ট লাগে। সেটুকু তার আছে। তেমন কোনও অভিযোগ নেই এই জীবনের কাছে। কিন্তু এই জীবনে বাড়তি গরিমাও নেই। অতীতের সেই গৌরব, যে অতীত এসে দাঁত দেখায়, দুয়ো দিতে চায়, সেই অতীতকে থোড়াই কেয়ার করে আজ গৌরব। হ্যাঁ, এই জীবনই চেয়েছিল চন্দ্রাণী, একটা ছোট হয়ে সুখে থাকার গতানুগতিক নির্ধারিত জীবন। এর ব্যতিক্রম ঘটাতে গেলে যে দুঃসাহস লাগে তা গৌরবের ছিল না। তবুও সে অস্বীকার করত। আর এই জীবনকে স্বীকৃতি দিতে চাইত চন্দ্রাণী তার প্রতিটি মরিয়া চুম্বনে।
মধ্যরাত হল। এই সময়ে তার মোবাইলে নোটিফিকেশন এল, চন্দ্রাণী রায় বসু হ্যাজ অ্যাক্সেপ্টেড ইওর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট।
গৌরব ক্লিক করে ঢুকল চন্দ্রাণীর প্রোফাইলে। ঢুকেই দেখল ওয়ালে একের পর এক ফেসবুক বন্ধুদের শুভেচ্ছার বার্তা। মেনি হ্যাপি রিটার্নস। হ্যাপি বার্থ ডে। কেকের ছবি। আজ, ২৩-এ জুন, আশ্চর্য, চন্দ্রাণীর জন্মদিন। অদ্ভুত এক সমাপতন। যা খুঁজছিল, যেন একটা ধাঁধা, নিমেষেই তার সমাধান হয়ে গেল, অক্লেশে। একটু স্ক্রোল করে সে চন্দ্রাণীর ছবি দেখতে পেল। দুদিকে দুই ছেলে। একজনের চোদ্দো-পনেরো হবে। আর একজন বছর দুয়েক কম হবে। পাশে সম্ভবত হাজব্যান্ড। মনে হল চার-পাঁচ বছরের বড়। সোবার দেখতে।
কিছু কি বদলেছে? হাসিটা একই রকম লাগছে। আর বাকি কিছু বোঝার উপায় নেই। খুব কিছু বদল ধরা পড়ল না গৌরবের চোখে।
লোকেশনও দেওয়া আছে: স্যান জোস, ক্যালিফোর্নিয়া। ঠিকঠাক শপথ রেখেছে চন্দ্রাণী।
গৌরব চন্দ্রাণীর ওয়ালে লিখতে উদ্যত হল: হ্যাপি বার্থ ডে। কাটল। লিখল, শুভ জন্মদিন। পরক্ষণেই ডিলিট করল। কী হবে এই অযথা বাড়াবাড়ির আয়োজনে? এই অনধিকার চর্চায়?
যাক, যা জানার ছিল জানা হয়ে গেছে। ২৩ জুন। অতঃপর গৌরব নিজের ফেক প্রোফাইল ডিলিট করতে উদ্যত হল। কয়েক সেকেন্ড। কয়েকটি মাত্র স্টেপ।
কল্লোল হাজরার প্রোফাইল ডিলিট করে ঘুমোতে গেল গৌরব।

চিত্রণ : চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
মণিশংকর বিশ্বাস
মণিশংকর বিশ্বাস
2 years ago

খুব, খুব ভালো লাগল! অসামান্য গল্প।

Recent Posts

কাজী তানভীর হোসেন

ধানমন্ডিতে পলাশী, ৫-ই আগস্ট ২০২৪

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে কয়েকদিন ধরে যা ঘটেছিল, তা শুরু থেকেই গণআন্দোলনের চরিত্র হারিয়ে একটা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে পরিণত হয়েছিল। আজ আমরা কার্যক্রম দেখেই চিনে যাই ঘটনাটি কারা ঘটাচ্ছে। আগুন আর অস্ত্র নিয়ে রাজনীতি করার স্বভাব রয়েছে বিএনপি-জামাত ও রোহিঙ্গাদের। তারা যুক্তিবুদ্ধির তোয়াক্কা করে না।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য: কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

আমরা বিধানচন্দ্র রায়ের মতো মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছিলাম, যাঁকে খুব সঙ্গত কারণেই ‘পশ্চিমবঙ্গের রূপকার’ বলা হয়। পেয়েছি প্রফুল্লচন্দ্র সেন ও অজয় মুখোপাধ্যায়ের মতো স্বার্থত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী। এবং জ্যোতি বসুর মতো সম্ভ্রান্ত, বিজ্ঞ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখর কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ। কিন্তু তাঁদের সকলের চেয়ে অধিক ছিলেন বুদ্ধদেব। কেননা তাঁর মতো সংস্কৃতিমনা, দেশবিদেশের শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্র নাটক সম্পর্কে সর্বদা অবহিত, এককথায় এক আধুনিক বিশ্বনাগরিক মানুষ পাইনি। এখানেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অনন্যতা।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর দুটি কবিতা

তারার আলো লাগে না ভাল, বিজলীবাতি ঘরে/ জ্বালাই তাই অন্তহীন, একলা দিন কাটে/ চেতনা সব হয় নীরব, বেদনা ঝরে পড়ে/ যজ্ঞবেদী সাজানো থাকে, জ্বলে না তাতে ধূপ/ রাখে না পদচিহ্ন কেউ ঘরের চৌকাঠে/ শরীরে ভয়, নারীরা নয় এখন অপরূপ/ তারারা সব নিঝুম ঘুমে, চাঁদের নেই দেখা/ অর্ধমৃত, কাটাই শীত ও গ্রীষ্ম একা একা

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বিশ্বকর্মার ব্রতকথা

বিশ্বকর্মা পুজোতেও কেউ কেউ বিশ্বকর্মার ব্রত পালন করে থাকেন। এমনিতে বিশ্বকর্মা যেহেতু স্থাপত্য ও কারিগরির দেবতা, তাই কলকারখানাতেই এই দেবতার পুজো হয়ে থাকে। সেখানে ব্রতকথার স্থান নেই। আবার কোন অলৌকিক কারণে এবং কবে থেকে যে এদিন ঘুড়িখেলার চল হয়েছে জানা নেই। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শহর ও গ্রামের আকাশ ছেয়ে যায় নানা রঙের ও নানা আকৃতির ঘুড়িতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার কখনও বাংলাদেশে পা রাখেননি!

ভাবতে অবাক লাগে, ‘৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ উত্তমকুমারকে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। টালিগঞ্জের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করেছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে। অন্যদিকে ববিতা, অলিভিয়া ও আরও কেউ কেউ টলিউডের ছবিতে কাজ করেছেন। ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার ও পরে গৌতম ঘোষ ছবি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশে এসে, কিন্তু উত্তমকুমারকে আহ্বান করার অবকাশ হয়নি এখানকার ছবি-করিয়েদের।

Read More »
নন্দিনী কর চন্দ

স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্দরমহলে: কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি

বিস্মৃতির অতলে প্রায় তলিয়ে যাওয়া এমন কয়েকজন মহিলা কবির কথা আলোচনা করব, যাঁরা তাঁদের কাব্যপ্রতিভার দ্যুতিতে বাংলা কাব্যের ধারাকে উজ্জ্বল ও বেগবান করে তুলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষ্ণকামিনী দাসী, মোক্ষদায়িনী দেবী, প্রসন্নময়ী দেবী, লজ্জাবতী বসু, জগন্মোহিনী দেবী, গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী, হিরণ্ময়ী দেবী, অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্ত, সুরবালা ঘোষ প্রমুখ।

Read More »