আমি তখন খুব ছোট, বছর দুয়েক বয়স। বোন মায়ের পেটে। লরি অ্যাক্সিডেন্টে বাবা হঠাৎ মারা গেল। একটা বাচ্চা ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে রাস্তার পাশের একটা গাছে বাবার মালবোঝাই লরিটা জোরে ধাক্কা মেরেছিল। স্টিয়ারিংটা নাকি এতই জোরে বাবার বুকে এসে লেগেছিল যে, বাবা ঘটনাস্থলেই মারা গেছিল। বাবা ছিল সুরজমল মাড়োয়ারির লরির ড্রাইভার। সুরজমল লোকটা ছিল ভারি কঞ্জুস ধরনের। লরি ড্রাইভার অ্যাসোসিয়েশনের লোকজন সুরজমলকে চেপে ধরে কোনও মতে পাঁচ-সাত হাজার টাকা আদায় করতে পেরেছিল। দুর্ঘটনায় বাবার মারা যাওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে। মায়ের তখন অসহায় অবস্থা। সম্বল বলতে ওই পাঁচ-সাত হাজার টাকামাত্র। ব্যাস।
তখন আমরা একটা ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। মায়ের মুখে শুনেছি, বাড়িটা নাকি মোটামুটি ভালই ছিল। একটা শোবার ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম-পায়খানা। একটুকরো বারান্দাও ছিল। ভাড়াও খুব একটা বেশি ছিল না। মা হিসেব করে দেখল, বাড়ির ভাড়া গুনতে গিয়ে মায়ের সম্বল ওই সামান্য ক’টা টাকা দু’দিনেই শেষ হয়ে যাবে। মা তাই বাড়ি করার জন্য একটুকরো জমি কিনল। জমিটা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পাকা সড়কের পশ্চিম দিকে। শহর থেকে একটু দূরে। নাবাল জমি বলেই হয়তো অমন নামমাত্র দামে জায়গাটা বিক্রি হচ্ছিল। একটু বৃষ্টি হলেই জায়গাটায় একহাঁটু জল দাঁড়িয়ে যেত। আশপাশের নয়ানজুলির সঙ্গে একাকার হয়ে যেত। মায়ের মত গরিব মানুষরাও জায়গাটা কিনে একটা বসতি বানিয়ে ফেলল। অবস্থাপন্ন মানুষ নতুন গড়ে ওঠা বসতির একটা যুতসই নামকরণ করল। কাঙালিপাড়া। নিষ্ঠুর শোনালেও নামটার মধ্যে সত্যতা ছিল ষোলোআনা।
বাবা মারা যাওয়ার পর মা শোক করার অবকাশ পায়নি। জমি কিনে সেখানে মাটি ফেলে কিছুটা উঁচু করে মাটির দেওয়াল খাড়া করে তার ওপর রানিগঞ্জের টালি দিয়ে ছোট্ট একটা মাথা গোঁজার ঘর বানিয়ে ফেলল মা। তাতেই সেই পাঁচ-সাত হাজার টাকা নিঃশেষ। টাকা শেষ হলেও মা কিছুটা নিশ্চিন্ত হল, মাসে মাসে অন্তত বাড়িভাড়ার টাকা গুনতে হবে না। ইলেক্ট্রিকের আলোর বদলে কেরোসিনের কুপির মিটমিটে আলোয় আমাদের সেই ছোট্ট কুঁড়েঘরের সবটা আলোকিত হত না। কেমন একটা ভুতুড়ে অন্ধকার সন্ধ্যা হলেই ঘরটাকে গিলতে আসত যেন। ওই অনভ্যস্ত পরিবেশ মায়ের খুব খারাপ লাগত। কাঠের উনুনের আগুনে মা রুটি সেঁকত সন্ধ্যাবেলায়। মায়ের দু’চোখ দিয়ে জল গড়াত। ঠোঁটের ডান দিকটা দাঁত দিয়ে চেপে কান্না চাপার চেষ্টা করত। আমি মায়ের গা ঘেঁষে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর বোঝার চেষ্টা করতাম, মায়ের এই কান্নাটা আসলে কীসের জন্যে। বাবার জন্যে, নাকি প্রায় দিনই আমাদের ভরপেট খেতে না দিতে পারার কারণে।
আমাদের এই ছোট্ট সংসার টানতে মাকে রীতিমত হিমসিম খেতে হত। মা ক্লাস সিক্স অবধি পড়াশোনা করেছিল। প্রথম দিকে পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ানোর কাজ শুরু করেছিল। সকাল-বিকেল এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে আমাদের বাড়ির উঠোনে বসে মায়ের কাছে পড়াশোনা করত। প্রথম প্রথম এতে মায়ের কিছু আয় হত। কিন্তু অধিকাংশই গরিব ঘরের ছেলেমেয়ে। তারা মায়ের প্রাপ্য মাইনে ঠিকমত দিতে পারত না। কেউ কেউ টাকার বদলে ঘরের সামান্য সবজি, মুড়ি, দুধ দিয়েও মায়ের পাওনা শোধ করার চেষ্টা করত। বেশিরভাগই মাসের পর মাস কিছুই দিতে পারত না। আয় কমে যাওয়ায় ছেলে পড়ানোর কাজটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল মা। তখন থেকে মাকে মুড়ি ভাজা, বিড়ি বাঁধা, ঠোঙা বানানোর মত কাজ করতে হত। মাকে জাল বোনার কাজ করতেও দেখতাম। সমুদ্রে মাছ ধরার জন্যে যে জাল ব্যবহার করা হত। সুচাঁদ হালদার ওজন করে নাইলনের সুতো দিয়ে যেত মাকে। মা তাতে গিঁট দিয়ে দিয়ে জাল বুনত। ক’দিন পরে সুচাঁদ ওজন করে সে জাল নিয়ে যেত। বদলে মা মজুরি পেত।
যত নগণ্যই হোক, নিজস্ব একটা বাড়ি হওয়াতে মায়ের মনে একটা তৃপ্তির ভাব এসেছিল। মাঝে মাঝেই মা আক্ষেপ করে বলত— ‘সে বেঁচে থাকতে কত জল্পনা-কল্পনা করত। একটা বাড়ি করব ছোটখাটো। আমাদের নিজস্ব বাড়ি। আমাকে বলত— তুমি মনের মত করে ঘর সাজাবে। তোমার জন্যে একটা ঠাকুরঘর আর বাবুর জন্যে আলাদা একটা পড়ার ঘর। ইলেক্ট্রিকের আলো থাকবে। খুব আনন্দে থাকব আমরা নিজেদের বাড়িতে— দেখো।’ মা চোখ মুছত আর বলত— ‘ও যেমন চাইত, তেমন না হলেও তো আমাদের নিজের একটা বাড়ি হয়েছে সত্যি সত্যি। ওর টাকাতেই তো হল। ওর জীবনের বদলে। ও-ই খালি দেখে যেতে পারল না।’ মা কাঁদত শুধু। আমার স্মৃতি থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া বাবার জন্যে বুকের মধ্যে কষ্টের একটা মোচড় দিত। তখন আমি অনেকটা বড় হয়ে গেছি। প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস টু-তে পড়ি। বাবার কথা খুব আবছা মনে পড়ে। আমাকে কোলে নিয়ে বাবা আদর করতে করতে বলছে— ‘আমি লরির ড্রাইভার। বাবু বড় হয়ে এরোপ্লেনের পাইলট হবে।’ মায়ের কাছে গল্প শুনে আমার মনে এ ধরনের একটা চিত্রকল্প তৈরি হয়ে গেছে। এটা আদৌ কোনও স্মৃতিই নয় হয়তো।
আমাদের বাড়িটা ছিল যেহেতু অত্যন্ত নিচু জায়গায়, একটু ভারি বৃষ্টি হলে বাড়ির চারদিকে জল থইথই করত। বসতির বাড়িগুলোকে এক একটা দ্বীপের মত দেখাত। বর্ষায় মায়ের তেমন কাজ জুটত না। সংসার চালানো মায়ের পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়ত। আমার আর বোনের তখন ভারি মজা হত। আমরা জলে জলে সারাদিন ঘুরে বেড়াতাম। কাগজের নৌকা তৈরি করে জলে ভাসাতাম। পাটকাঠিতে সুতো বেঁধে ছিপ বানিয়ে ঠায় বসে থেকে মিছিমিছি মাছ ধরার খেলা খেলতাম। মায়ের কপালে কিন্তু দুশ্চিন্তার রেখা গভীর হত।
তারপর বর্ষা কেটে যেত। আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরা শেষ হত। আমদের বাড়ির চারপাশের জল আস্তে আস্তে শুকিয়ে যেত। কাদাও শুকোত একদিন। মায়ের কাজ জুটতে শুরু করত। মুখে হাসি ফুটত আবার।
সন্ধেবেলায় কুপি জ্বেলে দাওয়ায় বসে মা আমাকে পড়াতে বসত। মায়ের কোলে থাকত বোন। একফালি উঠোনের কোণের বকফুল গাছতলা থেকে অবিরাম ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে যেত। দাওয়ার এক কোণে মায়ের পোষালি নেওয়া ভরণ* কালো ছাগলটা ব্যা ব্যা করে উঠত হঠাৎ হঠাৎ। কুপির শিখা কাঁপত অল্প অল্প। আমি দুলে দুলে ইস্কুলের পড়া তৈরি করতাম। আমর পড়া শেষ হলে ওই কুপি নিয়ে মা খাবার করতে যেত। অবশ্য বাড়িতে যদি রান্না করার মত কিছু থাকত তবেই। বাড়িতে খাবার থাকলে মাকে খুব খুশি খুশি দেখাত। মা রান্না করতে করতে বাবার গল্প করত। বলত— ‘এক এক দিন রাতে তোর বাবা ছাইপাঁশ সব গিলে আসত। আমি রাগ করতাম। তখন ছেলেমানুষের মত খালি কাঁদত আর আমাকে বলত— তোমার গা ছুঁয়ে কিরে করছি পারু, আর কোনও দিন এসব বাজে জিনিস খাব না।’
আমি মাকে বাধা দিয়ে বলতাম— ‘ছাইপাঁশ কী মা?’
মা আসলে এসব কথা আমাকে শোনাত না। নিজেকেই নিজে শোনাত। হয়তো তার নিজের সেইসব সুখের দিনগুলোতে ফিরে যেতে চাইত। তাই আমার প্রশ্ন হয়তো মায়ের কানেই যেত না। নিজের মনেই হাসত আর বলত— ‘মানুষটা আগের দিন যে প্রতিজ্ঞা করত, পরদিন সেকথা বেমালুম ভুলে গিয়ে আবার টলতে টলতে বাড়ি ঢুকে ভেউ ভেউ করে কান্না জুড়ে দিত।’ বলতে বলতে মায়ের মুখে কেমন একটা প্রশ্রয়ের হাসি ফুটে উঠত।
সে বছর বর্ষা তেমন যুতসই হল না। আমাদের নিচু পল্লিতে তেমনভাবে জল জমেনি। মা স্বস্তিতেই ছিল। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। তখন ভাদ্রের মাঝামাঝি, এমন সময় একদিন শেষবিকেলে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করল। সঙ্গে এলোমেলো বাতাস। দাওয়ায় বসে সেদিন আমার আর পড়া হল না। বাতাস এসে বারবার কুপি নিভিয়ে দিচ্ছিল। মা বলল— ‘দিনের গতিক ভাল ঠেকছে না। থাক তোকে আজ আর পড়তে হবে না।’ বলে তাড়াতাড়ি আমাদের খাইয়ে দিল। খাওয়া বলতে খেসারির ছাতু। মায়ের মুখে মেঘের প্রতিবিম্ব। আমরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম ভেঙে মাকে বিছানায় দেখতে পেলাম না। কখন উঠে গেছে। পাশে বোন তখনও ঘুমোচ্ছে। আমি বিছানা ছেড়ে বাইরে এসে দেখি, আকাশ মেঘে ঢাকা। এলোমেলো বাতাস বইছে। বাতাসে উঠোনের বকফুল গাছটা বারবার নুয়ে পড়ছে। উঠোনময় সে গাছের পাতা ছড়িয়ে আছে। উঠোনের জলকাদা দেখে বোঝা যায়, রাতে ভালই বৃষ্টি হয়েছে। উঠোনের নরম মাটিতে পায়ের ছাপ। উঠোন পেরিয়ে দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেছে সেই ছাপ। একটু পরেই উঠোনে ফেরার চিহ্ন এঁকে মা কোত্থেকে ঘরে ফিরল। মুখে একরাশ দুশ্চিন্তার ছাপ নিয়ে আমাকে বলল— ‘ছাগলটা ছেড়ে দে। অনেকক্ষণ থেকে ব্যা ব্যা করছে।’ গলার দড়িটা খুলে দিতে ওটা লাফিয়ে উঠোনে নেমেই বকফুলের ঝরে পড়া পাতা খেতে লাগল। এ সময়ে বাতাসটা থামতে ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামল। ছাগলটা দৌড়ে দাওয়ায় উঠে এল আবার।
বেলা বাড়তে লাগল। কিন্তু আকাশ পরিষ্কার হল না। সমানে এলোমেলো বাতাস। আর বাতাস থামতেই ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি। একটু বেলার দিকে রোদের আভা দেখা দিতে আমি ইস্কুলে গেলাম। ইস্কুল থেকে ফিরে আসতেই আকাশ আবার পুরু মেঘের আবরণে ঢাকা পড়ে গেছে। ছাগলটা কোথায় চরছিল। জোরে বৃষ্টি নামল। দৌড়ে বাইরে থেকে এসে লাফিয়ে দাওয়ায় উঠে এল। উঠোনে টাঙানো দড়িতে ভিজে জামাকাপড় মেলে দেওয়া ছিল, মা ছুটে গিয়ে সেগুলো তুলতে লাগল। মায়ের মুখ বিষন্ন। মায়ের এ রকম বিষন্ন মুখ দেখতে আমার একদম ভাল লাগে না। বোন ক্রমাগত কেঁদে চলেছে। দুপুরের সামান্য ছাতুতে ওর পেট ভরেনি। আমি জানি, বোন কাঁদলেও মায়ের কিছু করার নেই।
বেলা থাকতে থাকতেই চারদিক অন্ধকার হয়ে এল। সেই যে দুপুরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে— একমুহূর্তের জন্যেও সে বৃষ্টি থামেনি। একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। আমাদের পাড়াতে এখন একহাঁটু জল দাঁড়িয়ে গেছে। আমাদের উঠোনেও জল থইথই। মা বলল— ‘আজ রাত অবধি এমন বৃষ্টি চললে, আমাদের পাড়া কেন গোটা লালগোলা শহরই বন্যায় ভাসবে।’ আমাদের ছাগলটা সেই যে দাওয়ায় এসে উঠেছে, আর নামার নাম করেনি। দাওয়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর একরত্তি লেজটা নাড়াচ্ছে আর মুখবন্ধ করেই কেমন একটা আওয়াজ করছে। ওর পেট আর দাবনার পেশি কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে।
সন্ধে লাগতেই মা আমাদের খাইয়ে দিল। কৃপণের মত সঞ্চয় করে রাখা খেসারির ছাতু। মায়ের সে ভাণ্ডারও ফুরিয়ে আসার কথা। বোন একটুকরো গুড়ের জন্যে জেদ ধরে কাঁদতে শুরু করে দিল। মা নির্বিকার। মনে মনে আমি বোনের ওপর বিরক্ত হচ্ছিলাম।
মা চিন্তিত মুখে স্বগতোক্তি করল— ‘এ বারও দেখছি সে বারের মতই অবস্থা।’
আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম— ‘সে বার কী হয়েছিল মা?’
মা বলল— ‘সে বার ক’দিন ধরে এমনি বৃষ্টিতে বন্যায় চারদিক ভেসে গেছিল। সে কী অবস্থা! আমরা তখন আগের বাসাবাড়িতে থাকতাম। তোর বাবা বেঁচে। তুই তখন কোলে, এই এত্তটুকু।’
বোন কান্না ভুলে মাকে জিজ্ঞেস করল— ‘আর আমি কত বড় তখন, মা?’
—‘তুই তখন কোথায়! তুই জন্মাসনি।’
—‘জন্মেছি।’
—‘না রে।’
—‘এখন হয়েছি?’
বোনের অদ্ভুত প্রশ্নে আমি আর মা হেসে উঠলাম। মা বোনকে জড়িয়ে ধরল। মায়ের মুখে হাসি দেখে আমার ভীষণ ভাল লাগল।
মা আবার শুরু করল— ‘চারদিন ধরে বৃষ্টি, মোটে থামেনি। আমাদের পুরনো পাড়ার সবার ঘরে জল। রান্নার জ্বালানি নেই। ঘরে চাল-আটা থেকেও খাবার তৈরির উপায় নেই। খাবার নেই। খাবার জল নেই। পাড়ার সবাই যুক্তি করে ইস্কুলবাড়িতে গিয়ে ওঠা হল।’ মা বলে চলল— ‘ঘরে তালা লাগিয়ে ইস্কুলবাড়িতে গিয়ে উঠলাম সবাই। যাদের গোরু-ছাগল ছিল, তারা সেগুলো সঙ্গে নিল। আমরা দোতলার পুব দিকের কোণের ঘরটায় গিয়ে উঠলাম। চমৎকার ঘর। অমন অঝোর বৃষ্টিতেও কেমন শুকনো খটখটে। কী আরাম!’
আমি জিজ্ঞেস করলাম— ‘মা, তখন তো আমাদের অবস্থা ভাল ছিল। নিশ্চয়ই রোজদিন ভাত রাঁধতে?’
মা একটু উদাস হয়ে বলল— ‘বাড়িতে রোজদিন রাঁধতাম। কিন্তু ইস্কুলবাড়িতে গরমেন্ট থেকে খাবার দিত। প্রথম দিন শুকনো চিঁড়ে আর গুড়। পরদিন থেকে রাঁধা খিচুড়ি, রুটি, ভাত-তরকারি। বিনে পয়সায় ভরা পেট।
আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম— ‘তাই কখনও হয় নাকি! একেবারে বিনা পয়সায় খাবার?’
—‘গরমেন্টের খাবার— পয়সা লাগবে আবার কী! বানভাসিদের খাওয়ানোর দায়িত্ব তো গরমেন্টের। আর তুই তো তখন এত্তটুকু ছেলে, ভাত-তরকারি খেতে পারতিস না। তোর জন্যে দুধ দিত— এমনি এমনি— বিনি পয়সায়। তুই তাই খেতিস, চুক চুক করে।’ মা আমার দুধ খাওয়ার নকল করে দেখাল। আমি আর বোন হেসেই আকুল। মাও হাসে।
আমি চোখ বন্ধ করে সেই কবেই ভুলে যাওয়া মহার্ঘ তরল পানীয়ের স্বাদ মনে করার চেষ্টা করি। মনে করতে পারি না।
মাকে পীড়াপীড়ি করি সেই সুসময়ের কথা আরও বলার জন্যে।
মা আমাদের জোর করে শুইয়ে দেয়। বলে— ‘শুয়ে পড়। কুপি নিভিয়ে দিই। কেরোসিন তেল আর সামান্যই আছে।’
বাইরে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি। সকালেও তেমনই বৃষ্টি। উঠোন ছাপিয়ে বৃষ্টির জল দাওয়ায় উঠতে চাচ্ছে। ছাগলটা উঠোনেও আর নামতে পারছে না। দাওয়ায় দাঁড়িয়ে কেবল ব্যা ব্যা করে ডাকছে। মা ওর সামনে কিছু গাছের পাতা ছড়িয়ে দিয়েছে। সেই পাতা চিবোচ্ছে ছাগলটা চোখ বন্ধ করে।
বকফুল গাছে একটা ভেজা কাক এসে বসল। কর্কশ স্বরে কা কা ডাক জুড়ে দিল। ডাকটা কেমন যেন অলক্ষুণে ধরনের। মা কাকটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করতে, কাকটা ঘাড় কাত করে মায়ের দিকে একবার বিরক্তির সঙ্গে তাকিয়ে হুস করে উড়ে পালায়। আর ইস্কুলে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। মুড়ি ভেজে রাখার মস্ত খালি বস্তাটা মাথায় দিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই মা প্রতিবেশীদের কাছে গেল ধার চাইতে। ফিরে এল খালিহাতে। এসে নিজের মনেই বলল— ‘সবার অবস্থাই তো সমান। ধার দেবেটা কে!’
বোন কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি পেটে এক রাজ্যের খিদে নিয়ে সারাদিন বৃষ্টি দেখলাম।
সন্ধে হতে কেরোসিনের যোগানে টান থাকা সত্ত্বেও মা অল্প সময়ের জন্যে কুপি জ্বেলেছিল। রাজ্যের পাখাওয়ালা উইপোকা এসে জ্বলন্ত কুপির শিখা ঘিরে উড়তে লাগল। বিরক্ত হয়ে মা কুপিটা নিভিয়ে দিল। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘরের মধ্যে। ওই সন্ধেরাতেই আমরা উপোসী তিনটে প্রাণী শুয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। সম্পূর্ণ ঘুম ভাঙতে চোখ খুলে কিছু দেখতে পেলাম না। ঘন অন্ধকার। বিছানা জলে সপসপ করছে। বাইরে বৃষ্টি পড়ার শব্দ। হাত দিয়ে অনুভবে বুঝলাম পাশে মা নেই। ওপাশে বোন ঘুমোচ্ছে। অন্ধকার আমার চোখসওয়া হয়ে গেলে ভেজানো দরজা খুলে মাকে ঘরে ঢুকতে দেখলাম। ঘরে ঢুকেই মা কুলুঙ্গিতে রাখা কুপিটা জ্বালাতে জ্বালাতে বলল— ‘শিগগিরি বোনকে জাগা। এখুনি বেরোতে হবে। পাড়ার সবাই তৈরি হয়ে গেছে।’
কুপির শিখার চারপাশে পাখাওয়ালা উড়ন্ত উইপোকার ভিড়। ঘরের মেঝে জলে থইথই। ঘরে আলো দেখে দাওয়া থেকে ছাগলটা ঘরে এসেই লাফিয়ে চৌকির বিছানায় উঠে এল। ঠান্ডায় কাঁপছে ছাগলটা। ওটাকে কাছে টেনে নিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম— ‘কোথায় যাব মা আমরা?’
মা কোঠা থেকে আমাদের টিনের তোরঙ্গটা টেনে নামিয়ে আমাদের যাবতীয় সম্পত্তি ভরতে ভরতে বলল— ‘মাটির ঘর যখন-তখন ভেঙে পড়তে পারে। জলে জলে পুস্তা* দুর্বল হয়ে গেছে। তাছাড়া ঘরের টালি রসে গিয়ে ঘরময় কেমন জল পড়ছে দেখ। বিছানাপত্র কিছু আর শুকনো নেই।’
বোনকে কোলে তুলে নিয়ে আমার মাথায় একটা পুঁটুলি তুলে দিয়ে মা বলল— ‘ছাগলটার গলায় দড়ি বেঁধে, ওকেও নিয়ে চল।’
কাঁচাঘুম ভাঙতে অথবা ঘুম ভাঙতে খিদের জ্বালা জানান দিতে কাঁদতে শুরু করল বোন। আমার পেটও খিদেতে চোঁ চোঁ করছে। ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে মাকে জিজ্ঞেস করলাম— ‘কোথায় যাচ্ছি মা আমরা? অভ্যাসবশে মা আমাদের শূন্য ঘরের দরজায় নিরাপত্তার শিকল তুলে আমার প্রশ্নের জবাবে বলল— ‘ইস্কুলবাড়িতে।’
***
পরের দৃশ্যটা সংক্ষিপ্ত। কাঙালি পাড়ার উদ্বাস্তু মানুষের অসংগঠিত একটা মিছিল চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। মিছিলের মধ্যে তিনজনের একটা ছোট দল। তাদের যথাসর্বস্ব অস্থাবর সম্পত্তি তাদের মাথায়— কাঁধে— হাতে। ছোট্ট কাঁদুনে অবোধ মেয়েটা মায়ের কোলে। ক্লাস টু-তে পড়া রাতারাতি বড় হয়ে যাওয়া ছেলেটার হাতে ধরা একটা দড়ি। দড়ির অন্য প্রান্তে একটা অন্তঃসত্ত্বা ছাগল বাঁধা। কাদা-জল ভেঙে মাথায় অঝোর বৃষ্টি নিয়ে তারা উঁচু পাকা সড়কে উঠে এল। ছেলেটা দ্রুত হাঁটে। স্কুলবাড়ির দোতলার পুব দিকের কোণের ঘরটার দখল নিতে হবে তাদের। সে আশ্চর্য ঘর নাকি এই সর্বনাশা বাদলেও শুকনো, আরামদায়ক। নিজেদের ঘরদোর ছেড়ে চলে আসার দুঃখ ছাপিয়ে উপোসী ছেলেটার মনে একটা খুশির ভাব টলটল করে সারাক্ষণ। বেশ ক’দিনের জন্যে নিশ্চিন্তি। বিনি পয়সায় ভরপেট সরকারি খাবার পাওয়া যাবে। একটা গোপন সুখের চিন্তা ছেলেটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। উপর দিকে তাকিয়ে মেঘের ঘনত্ব পরখ করার চেষ্টা করে সে একবার। তারপর মনে মনে প্রাণপণ প্রার্থনা করে— ‘ভগবান, এ বর্ষা তুমি থামিয়ো না কখনও।’
তারপর উত্তেজনায় অবলা প্রাণীটার গলার দড়িতে টান মেরে দ্রুত সামনে হাঁটতে থাকে অন্ধকার আর বৃষ্টি ভেদ করে।
*ভরণ= গর্ভবতী, পুস্তা= মাটির ঘরের চওড়া ভিত।