দুর্গাপুজোয় দেবী দুর্গা পূজিত হন সপরিবারে-সবাহনে, সর্বোপরি পদতলে আহত অসুরসমেত। দুর্গতি বিনাশ করেন বলেই তাঁর নাম দুর্গা। আবার দুর্গতি দূর হলেই আনন্দ আসে বলে তিনি আনন্দময়ী। মানুষ সামাজিক জীব বলেই একাকিত্বে তার দুর্গতি, সম্মিলনে তার আনন্দ। শরতে আজও বাঙালি সেই সম্মিলনের আনন্দ উপভোগ করে বলেই আনন্দময়ীর আগমনে সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে আসে শারদ-উৎসব। আর তাই তো আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রায় শত বছর আগে (১৯২২ খ্রি.) তাঁর নিজের সম্পাদিত অর্ধসাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার দুর্গাপূজা সংখ্যায় লেখেন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি। এই কবিতা প্রকাশের অভিযোগে ব্রিটিশ শাসকগণ পত্রিকাটি বাজেয়াপ্ত করে এবং রাজদ্রোহের অভিযোগে কবিকে এক বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। কী কথা ছিল সে কবিতায়? কেন একজন ইসলামি শব্দের আড়ম্বরে আলোড়িত কবি দুর্গার স্তুতি গান গাইলেন? কেন বার বার দুর্গা-শিবের নাম নিলেন? দুর্গাপুজোর গান লিখলেন? কী তার স্বরূপ? ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের প্রয়াসে বর্তমান প্রবন্ধ। অস্বীকার অসম্ভব, আজকের দিনেও নজরুলের আগমনী গান ও কবিতার দর্শনে বাংলা সাহিত্যের সাধারণ পাঠক তথা প্রতিটি বাঙালি পাঠক ও গবেষকের গভীর-নিবিড় অভিনিবেশ আবশ্যক।
করুণাময় গোস্বামীর ভাষায়: বাংলার সাথে আরবি, ফার্সি, উর্দু প্রভৃতি শব্দ মেশানো এক প্রকার মিশ্র ভাষায় তাঁকে ইসলামি ভাবাশ্রিত গান রচনা করতে দেখা যায় প্রথম। … পিতৃব্য বজলে করীমের প্রেরণায়ই নজরুল ইসলামি গান রচনায় মনোনিবেশ করেন। চাচার প্রেরণা, অধিকতর অর্থোপার্জনের আশা আর সহজাত সংগীতপ্রিয়তা নজরুলকে লেটোর দলে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করে। আবার কারও মতে, লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নজরুল রাঢ় বাংলায়— পশ্চিম-বাংলার বর্ধমান-বীরভূম অঞ্চলের কবিতা, গান আর নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক ভ্রাম্যমাণ লোকনাট্য লেটোদলে যোগদান করেন। লেটো গানে এসে নজরুল দর্শক-শ্রোতা হিসেবে পান হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি। উভয় ধর্মের ভক্তিবাদে অভিষিক্ত হন নজরুল মূলত এই লেটোর দলে যোগ দিয়ে। ড. মিলন দত্ত মনে করেন, নজরুলের গীতিকার ও সুরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠার মূল উৎস ছিল লেটোর দলের জন্য বিচিত্র অসংখ্য গান রচনার মধ্যে। এর মধ্যে তিনি খুঁজে পেলেন প্রাণের আরাম, মনের তৃপ্তি। এর পর আসানসোলে রুটির দোকানে চাকুরি, সেখান থেকে ময়মনসিংহ গমন এবং সেখান থেকে কলকাতা ফিরে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা। আর প্রবেশিকা-নির্বাচনী পরীক্ষার আগে বাঙালি পল্টনে যোগদান; সে কথা প্রায় সকলের জানা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে নজরুল কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে পরিচিত হন কুমিল্লার আলী আকবর খানের সঙ্গে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে আলী আকবর খানের বাড়িতে যাওয়ার পথে তাঁরা কুমিল্লা কান্দিপাড়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে কয়েকদিন যাত্রাবিরতি করেন। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের স্ত্রী বিরজাসুন্দরী দেবীকে আলী আকবর খান মা বলে ডাকতেন। এবারে তিনি নজরুলেরও মা হলেন। ওই বাড়িতে আরও ছিলেন বিরজাসুন্দরী দেবীর বিধবা জা গিরিবালা দেবী এবং তাঁর মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তা ডাকনাম দুলি বা দোলনা পরে প্রমীলা। এবাড়িতেই নজরুল-প্রমীলার প্রথম পরিচয়। আলী আকবর খানের বোনের মেয়ে সৈয়দা খানম ওরফে নার্গিস আসার খানমের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে (১৭ জুন, ১৯২১) হয়। ‘দুর্ভাগ্যবশত যথাযথভাবে তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হতে পারেনি।’ বিয়ের রাতেই নজরুল দৌলতপুর থেকে পালিয়ে পায়ে হেঁটে কুমিল্লা চলে যান এবং কলকাতা ফেরার আগে বেশ কয়েকদিন কুমিল্লায় অবস্থান করেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ আগস্ট কলকাতায় নজরুল অর্ধসাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই ধূমকেতু পত্রিকাকে আশীর্বাদ জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লেখেন: ‘আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,/ আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,/ দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/ উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!/ … জাগিয়ে দে রে চমক মেরে/ আছে যারা অর্ধচেতন!’। রবি ঠাকুরের প্রত্যাশা ব্যর্থ হয়নি। এই ধূমকেতু-র ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ তারিখে প্রকাশিত দুর্গাপূজা সংখ্যায় নজরুল লেখেন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা। ৪+৪+৪+৪= ১৬ মাত্রার স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত এ কবিতায় ৭৯ পঙ্ক্তি রয়েছে। কেবল শেষ পঙ্ক্তিটি অপূর্ণ, ৪+৪= ৮ মাত্রার। কবিতার শুরুতেই কবি অত্যাচারিত পরাধীন ভারতবাসীর চিত্র আঁকতে লেখেন:
আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,
. ভূ-ভারত আজ কসাইখানা,—আসবি কখন সর্বনাশী?
. দেব-সেনারা টানছে ঘানি তেপান্তরের দ্বীপান্তরে,
. রণাঙ্গনে নামবে কে আর তুই না এলে কৃপাণ ধরে?
বাংলার লোকসাহিত্যের ছন্দে ও লোকভাষায় লিখতে গিয়ে কবি কেবল লৌকিকতায় থেমে থাকেননি; ভুলে যাননি ভারতের ত্যাগের-গৌরবের ইতিহাস। তাই তো ভারত যে ভূ-স্বর্গ সে কথা স্মরণ করিয়ে কবি তুলে আনেন সমকালীন ভারতের ক্ষুদিরামের ফাঁসির (১৯০৮) প্রসঙ্গও। অমন অবস্থা থেকে মুক্তি আর শান্তির আশায় কবি অবগাহন করেন হিন্দু পুরাণ-ঐতিহ্যে; লেখেন:
. মহেশ্বর আজ সিন্ধুতীরে যোগাসনে মগ্ন ধ্যানে
. অরবিন্দ চিত্ত তাহার ফুটবে কখন কে সে জানে!
. সদ্য অসুর-গ্রাসচ্যুত ব্রহ্মা-চিত্তরঞ্জনে, হায়!
. কমণ্ডলুর শান্তি-বারি সিঞ্চি যেন চাঁদ নদীয়ায়।
. শান্তি শুনে তিক্ত এ-মন কাঁদছে আরো ক্ষিপ্ত রবে,
মরার দেশের মড়া-শান্তি, সে তো আছেই কাজ কি তবে?
শান্তি কোথায়? শান্তি কোথায় কেউ জানি না।
মা গো তোর ঐ দনুজ-দলন সংহারিণী মূর্তি বিনা।
নজরুলের এ প্রত্যাশা কেবল হিন্দুর নয়; হিন্দু-মুসলিম সবার। অথচ, সমসাময়িক এলিট-শ্রেণি ও কবি-সাহিত্যিকের দল এই প্রথাগত আনুষ্ঠানিকতায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ আর্যনীতি নিয়ে নিজেদের ব্রিটিশের সগোত্র ভাবেন। কেউ আবার একেশ্বর ব্রাহ্মধর্ম নিয়ে রাজ-ধর্মের (খ্রিস্ট ধর্মের) সঙ্গে সমতা খুঁজতে ব্যস্ত হন। নজরুল তাঁদেরও শনাক্ত করেন। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার ২১ থেকে ২৪ লাইনে এভাবে তা তুলে ধরেন—
রবির শিখা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে আজ দিগন্তরে,
সে কর শুধু পশল না মা অন্ধ কারার বন্ধ ঘরে।
গগন-পথে রবি-রথের সাত সারথি হাঁকায় ঘোড়া,
মর্তে দানব মানব-পিঠে সওয়ার হয়ে মারছে কোঁড়া।
এ রবি যে দিবাকর নয়, রবীন্দ্রনাথ— তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এও সত্য, এ অবস্থার জন্য দায়ীও কেবল হিন্দু নয়; হিন্দু-মুসলিম সকল ভারতবাসী। আর তাই পরের স্তবকেই তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় ইসলামি আবেশ:
‘লানত’ গলায় গোলাম ওরা সালাম করে জুলুমবাজে,
ধর্ম-ধ্বজা উড়ায় দাড়ি, ‘গলিজ’ মুখে কোরান ভাঁজে।
তাজ-হারা যার নাঙ্গা শিরে গরমাগরম পড়ছে জুতি,
ধর্ম-কথা বলছে তারাই, পড়ছে তারাই কেতাব পুঁথি।…
আজ দানবের রংমহলে তেত্রিশ কোটি খোজা গোলাম
লাথি খায় আর চ্যাঁচায় শুধু, ‘দোহাই হুজুর, মলাম মলাম!’
এই মৃত্যুপুরীতেও দেবীর পুজো হয়, চণ্ডীপাঠ হয়। বিশেষত চণ্ডীপাঠ ব্যতীত দুর্গাপূজা অকল্পনীয়। আর তাই তো চণ্ডীর কাহিনিও বাদ যায় না তাঁর কবিতা থেকে। তবে সেই চণ্ডীর কাহিনি-ইতিহাসের রূপান্তর ঘটে কবি-কল্পনায়। সত্য-ত্রেতা যুগের কাহিনির সঙ্গে সমকালীন বীরত্ব গৌরবের ইতিহাস একাকার হয়ে উঠে আসে কবিতায়:
মহিষাসুর বধ করে তুই ভেবেছিলি রইবে সুখে,
পারিস্নি তা ত্রেতা যুগে, টল্ল আসন রামের দুখে।
আর এলিনে রুদ্রাণী তুই, জানিনে কেউ ডাকল কি না
রাজপুজতনায় বাজলো হঠাৎ ‘ময় ভুখা হুঁ’-র রক্তবীণা।
বৃথাই গেল সিরাজ, টিপু, মীর কাসিমের প্রাণ-বলিদান,
চণ্ডী! নিলি যোগমায়া-রূপ, বলল সবাই বিধির বিধান।
সুতরাং, পরাধীনতার গ্লানি আর পরাজয়ের ইতিহাসকে কবি বিধির বিধান বলে মানতে রাজি নন। লৌকিক আচার-নিষ্ঠা আর আন্তরিকতাশূন্য আড়ম্বরপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা দেখে কবি নজরুল ত্যক্ত-বিরক্ত। অভিমানী কবির আক্রোশ অব্যক্ত থাকে না। মা দুর্গার কছে পুত্রের আন্তরিক উচ্চারণ তাই ধ্বনিত হয়:
বছর বছর এ অভিমান অপমান তোর, পূজা নয় এ,
কি দিস্ আশিস কোটি ছেলের প্রণাম চুরির বিনিময়ে!
অনেক পাঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা;
আয় পাষাণী, এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা!
দুর্বলদের বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পুজা
দূর করে দে, বল্ মা, ছেলের রক্ত মাগে মা দশভূজা!
প্রচলিত প্রথাকে যুগের প্রয়োজনে পরিমার্জিত করে প্রয়োগ করাই এখানে নজরুলের লক্ষ্য। হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মেই আন্তরিকতাশূন্য আনুষ্ঠানিকতাকে তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। একই সুর ধ্বনিত হয়েছে তাঁর অগ্নি-বীণা কাব্যের ‘কোরনানী’ কবিতায়: ‘ওরে শক্তি-হস্তে মুক্তি, শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন্।/ … আজ আল্লার নামে জান্ কোরবানে ঈদের পূত বোধন।/ ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!’ একই সুর পাই ‘মোর্হরম’ কবিতায়: ‘ফিরে এল আজ সেই মোর্হরম মাহিনা,—/ ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’ ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার শেষেও তাই মায়ের কাছে কবির আহ্বান— লক্ষ্মী-সরস্বতী, কার্তিক-গণেশ, কলাবউ কিংবা শিব কারও আর এখন আসবার প্রয়োজন নেই; শুধু:
তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে,
রক্ত-তৃষায় ‘ময় ভুখা হুঁ’র কাঁদন-কেতন কণ্ঠে ধরে।…
‘ময় ভুখা হুঁ মায়ি’ বলে আয় এবার আনন্দময়ী,
কৈলাস হতে গিরি-রানীর মা-দুলালী কন্যা অয়ি!
. আয় উমা আনন্দময়ী।
এই আহ্বান কি কেবলই একজন বিদ্রোহী-সর্বহারা কবির, না কি একজন যোগী-সাধক ও একনিষ্ঠ ভক্তের— সে বিচারের ভার পাঠকের হাতেই থাকুক। শুধু স্মরণ করা যেতে পারে— এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায়, ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তাঁকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দি হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দি প্রদান করেন। তাঁর এই জবানবন্দি বাংলা সাহিত্যে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। এই জবানবন্দীতে নজরুল বলেন:
‘আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।… আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে। …’
তবু নজরুলের এক বছরের কারাদণ্ড হয় এবং ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ তারিখে কারাবাস শেষে কবি মুক্ত হন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে বিরজাসুন্দরী দেবীর সম্মতিতে নজরুল বিয়ে করেন প্রমীলাকে। সাধারণে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা হিন্দু বিয়ের কারণে নজরুল দুর্গাপূজা নিয়ে কবিতা লিখেছেন। নজরুল-জীবনীতে দেখা যায়: ১৯৩০-এ তাঁর চার বছরের শিশুসন্তান বুলবুল মারা গেলে শোকে মুহ্যমান হয়ে আত্মার প্রশান্তি লাভের জন্য বরদাকান্ত মজুমদারের কাছে আধ্যাত্মসাধনায় দীক্ষা গ্রহণ করেন। সে থেকেই তিনি যোগসাধনা ও পরলোকচর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গোপাল হালদার মনে করেন, এ সময়েই নজরুল ঈশ্বরানুরক্ত হন এবং উদ্দাম বিদ্রোহী বহির্মুখীনতা ছেড়ে অন্তর্মুখী ভক্তিগীতি রচনায় তাঁর প্রবল আকুতি এরই পরিণাম। কিন্তু ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ অধ্যয়নের পর এতটা সরল ধারণায় আস্থা রাখা অসম্ভব। বিশেষত, তারও আগে প্রকাশিত তাঁর অগ্নি-বীণা (১৯২২) কাব্যের ‘রক্তাম্বর ধারিণী মা’ কবিতায় কবি যখন লেখেন: ‘দেখা মা আবার দলুজ-দলনী/ অশিব-নাশিনী চণ্ডী-রূপ;’ কিংবা, একই কাব্যের ‘আগমনী’ কবিতায়:
রণ-রঙ্গিণী জগৎমাতার দেখ্ মহারণ,
দশ দিকে তাঁর দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ!
. পদতলে লুটে মহিষাসুর,
মহামাতা ঐ সিংহ-বাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে—
শাশ্বত নয় দানব-শক্তি, পায়ে পিষে যায় শির পশুর!
এখানে স্পষ্ট দুর্গা দেবীর মহিমা-কীর্তনের চেয়েও দুর্গা-মূর্তির মধ্য দিয়ে দানব-শক্তির পরাজয় ও বিশ্ববাসীকে মানবিকতার জয়গান শোনানোই কবির লক্ষ্য। অগ্রনায়ক কাব্যগ্রন্থেও ‘আগমনী’ নামে আর-একটি কবিতা আছে। সেখানে কবি লেখেন:
ডাকিছে ঊর্ধ্বে উৎক্ষেপি বাহু উচ্চারি পূজা-মন্ত্র—
‘জাগো রুদ্রাণী, জাগো যোগমায়া’ সীতাহারা রামচন্দ্র।…
অকালে মায়ের সেই যে বোধন শোষক-দৈত্য হরণে
পূজা দিই মোরা মায়ের চরণে সেই শুভ দিন স্মরণে।…
মোদের আঁখির নীলমণি এই পুত্রকন্যা নিত্য
অঞ্জলি দিই মায়ের চরণে ছিঁড়িয়া হৃদয় চিত্ত;
তবু যদি নাহি জাগে সে পাষাণী যোগ-নিদ্রা-নিমগ্ন,
ভৃগুর মতন আঘাত হানিয়া করিব দুয়ার ভগ্ন।
এমন লেখনি কেবল কবি বা গীতিকারের পক্ষে অসম্ভব। এমন আকুতি-আহ্বান আর অভিমানভরা উচ্চারণ একজন একনিষ্ঠ মাতৃভক্ত সাধকের পক্ষেই সম্ভব। সাধক নজরুলের পক্ষেই লেখা সম্ভব দেবীস্তুতি গ্রন্থ। দেবীস্তুতির ‘প্রস্তাবনা’ তে তিনি লেখেন: ‘প্রণমামি শ্রীদুর্গে নারায়ণি/ গৌরি শিবে সিদ্ধিবিধায়িনী।/ মহামায়া অম্বিকা আদ্যাশক্তি/ ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ-প্রদায়িনী॥’ এর পর এ গ্রন্থে তিনি গদ্যে ব্যাখ্যা করে দেখান জলের তিন অবস্থার মত সৃষ্টিতত্ত্ব। তাঁর ভাষায়: ‘যোগদৃষ্টিসম্পন্ন পূর্ণজ্ঞানীর কাছে যিনি সাকার তিনি নিরাকার। তাহার কাছে বুদ্ধের শূন্যবাদ ও শঙ্করাচার্যের পরিপূর্ণবাদ দুই-ই সত্য।’ তিনি যথার্থই মনে করেন এই আদ্যাশক্তিই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব; তিনিই কৃষ্ণ, তিনিই নির্গুণ পরব্রহ্ম। নজরুল তন্ত্র-চণ্ডী-দেবী-ভাগবত পাঠ করে লেখেন: ‘দেবীর প্রথম অবতার মহাকালী রূপে। … দ্বিতীয় অবতার মহালক্ষ্মীরূপে। এই রূপে তিনি মহিষাসুর বধ করেন। আমাদের দেশে শ্রীদুর্গারূপে ইনি পূজিতা হন। … দ্বিতীয় অবতার মহালক্ষ্মী রাষ্ট্রীয় শক্তি। এই মহাভারত যখনই তাহার রাষ্ট্রীয় শক্তি হারাইয়াছে তখনই মহালক্ষ্মীরূপিনী শ্রীদুর্গার শরণাপন্ন হইয়া সে তাহার বিলুপ্ত রাষ্ট্রীয় শক্তি ফিরিয়া পাইয়াছে। …অর্থাৎ সমস্ত দেবশক্তি একত্রীকৃত হইলে অবলুপ্ত স্বর্গ বা রাষ্ট্রীয় শক্তি উদ্ধার হয়। ইহাই এই অবতারের ইঙ্গিত।’ এই ইঙ্গিত থেকেই সিদ্ধান্ত হতে পারে— নজরুল ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা চান আর তার জন্য চান ধন-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের সমন্বয় বা ঐক্য। এই ‘অভেধ ধর্ম-জাতি’ রূপায়ণের লক্ষ্যেই তিনি দুর্গারূপী দেশমাতার বন্দনার শৈল্পিক বাণীরূপ এঁকেছেন তাঁর কবিতায়।
দেবীস্তুতি গ্রন্থের সমাপ্তিতে তিনি শ্রীশ্রী চণ্ডীর ১১/৫৫ শ্লোক দিয়ে শেষ করেছেন। এর সরলার্থ: যখন যখন দানবকৃত উৎপাত সংঘটিত হইবে তৎকালেই আমি অবতীর্ণ হইয়া শত্রুগণকে নিহত করিব। এখানেও নজরুল দেখিয়ে দেন চণ্ডীর শ্লোক আর গীতার ৪র্থ অধ্যায়ের বহুল পঠিত ৭ম-৮ম শ্লোক ‘যদা যদা হি …যুগে যুগে॥’ এর মূল অর্থ একই; এখানেও নজরুলের সমন্বয়বাদী চিন্তার প্রতিফলন স্পষ্ট। অথচ বিশ্বব্যাপী হিন্দু ধর্মের প্রচারক ইস্কন-ভক্তরা প্রচার করেন— কৃষ্ণ ব্যতীত হিন্দুদের আর কোনও দেবতার পূজা করা চলবে না। এভাবে এরা ধর্মের নামে মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বাড়িয়ে চলছে। নজরুল দুর্গার বা আনন্দময়ীর আগমন ঘটিয়ে এ বিভেদ দূর করতে সদা সচেষ্ট থেকেছেন। তাঁর হরপ্রিয়া গীতিনাট্যে নীলাম্বরী বলে: ‘যে শিবানীর একরূপ হলাদিনী রাধিকা।/ যে শিবানী গোলকে রাধিকা,/ শিবলোকে হরপ্রিয়া/ বৈকুণ্ঠে কমলা/ বৃন্দাবনে তিনিই শ্রমতী হয়ে নীল শাড়ী পরি/ নীল যমুনার তীরে করিছেন লীলা।’ এভাবে নজরুল দুর্গার আরাধনার মধ্যে শাক্ত-শৈব-বৈষ্ণব মতের যেমন সমন্বয় চেয়েছেন, তেমনি শারদ-উৎসবকে দেখেছেন সকল মানবজাতির আনন্দ-উৎসব হিসেবে। তাই তো তিনি আনন্দময়ীর আগমনে উদ্বেলিত হয়েছেন আশান্বিত হয়েছেন আর আগমনী কবিতা লিখে গেছেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না— ভারতীয় লোকায়ত ধর্ম প্রধানত সমন্বয়বাদী সনাতন ধর্ম। এখানে লোকজীবনেও একটি সমন্বয়বাদী পথ আছে এবং সেখানে মাতৃকেন্দ্রিক নিবেদন আছে। লোকভাষাতেও ‘ওমা’ কিংবা ‘মাগো’ বলে মায়ের কাছে শরণ প্রার্থনা করা হয়। ‘জয় হিন্দ’ কিংবা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে যতই বিভাজিত হোক সকল সন্তানই মায়ের স্নেহতল প্রার্থনা করে অবনত হয়। নজরুল নিয়ত সে-পথ অনুসরণ করেন। ভারতীয় পুরাণে নারীরা যে ক্ষমতা ও মমতার আধার, এটি নজরুল মনে মনে ধারণ করেছেন এবং সমীহ করেছেন। আনন্দময়ীর আগমনী আর আহ্বানে যার আরম্ভ, শ্যামা সঙ্গীতে তার চূড়ান্ত রূপায়ণ। সেখানে ‘কালো মায়ের পায়ের তলায় দেখে যারে আলোর নাচন’ বলে তিনি মায়ের চরণে শরণ নিয়েছেন। ‘মা’ কবিতায়ও তিনি মধুমাখা মা নামের কথা স্মরণ করান— মায়ের স্নেহ-মমতায় মানুষের সফল জীবন গড়ার ছবি আঁকেন। ‘নারী’ কবিতায় তিনি পুরুষের সর্বেসর্বা মনোভাবের অবসান ঘটান। এভাবে লোকায়তধারা ঐতিহ্য থেকে তিনি নারীর মহিমা কীর্তন করে মা বা প্রিয়ার পায়ে আত্ম-সমর্পণ করে আসলে আত্মসাঁকো রচনা করেন। এখানেই নজরুল থেমে থাকেননি; ‘জাগো নারী বহ্নিশিখা’ গানে মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া ও ভগ্নি— সব রকমের সম্পর্কের নারীকে মুক্তির সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করেছেন। এভাবে নজরুল নারী-শক্তিকে সম্মুখসারিতে রেখে মুক্তির সংগ্রামে শরিক হতে চেয়েছেন। অসুর-বিনাসী শক্তির আবির্ভাব আশা করেছেন। আজও তাই অসাম্প্রদায়িক বিশ্বের স্বপ্ন যাঁরা দেখেন, তাঁদের নিত্যসঙ্গী না হয়ে পারেন না কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আনন্দময়ী দেবী দুর্গা যেমন সুর-অসুর বা আর্য-অনার্যের সমন্বয়বাদী দেবী, নজরুলও তেমনি অভেদ-ধর্ম-জাতির কবি; সাম্যের-আনন্দের কবি, সর্বোপরি সমন্বয়বাদী কবি। শুধু কাব্যে-সাহিত্যে নয়, সমগ্র জীবনেও নজরুল সমন্বয় সাধনা করেছেন। সেই সমন্বয়বাদী মৈত্রীর বন্ধন আজও আমাদের বড় প্রয়োজন। দুর্গা পুজোর সর্বজনীনতাও আমাদের সেই শিক্ষায় প্রাণিত করে, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে আগমনীর সুর শোনায়। বাঙালি আবার ঐক্যের পথে ধাবিত হোক আনন্দময়ী দেবী দুর্গার আগমনকে উপলক্ষ্য করে।