২০০৫ সালের শেষের দিকে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন শহরে আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবে যোগ দিতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতার একটি ছিল পারফর্মেন্স পোয়েট্রি৷ অথবা বলা যেতে পারে প্রয়োগ কবিতা৷ এই শব্দবন্ধ বাংলা কবিতা জগতে সেইভাবে প্রচলিত নয়৷ পারফর্মেন্স পোয়েট্রির ব্যাখ্যাও সব দেশে এক নয়৷ ভিন্ন ভিন্ন দেশে এক একরকম তার অভিব্যক্তি৷
নিউজিল্যান্ডে বসবাসকারী আমেরিকান এক কবি ডক ড্রামহেলার প্রয়োগ কবিতা বলতে দেখাচ্ছেন কবিতা পাঠের সঙ্গে সঙ্গে ল্যাপটপ কম্পিউটরে স্লাইড শো৷ কোনও বিশেষ পঙ্ক্তি পড়ার সময় পিছনের পর্দায় ফুটে উঠছিল সেই পঙ্ক্তির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ছবি৷ কখনও স্থিরচিত্র, কখনও চলমান ছবি৷ এর বেশ কিছু বছর পরে দিল্লিতে ড্রামকে আবিষ্কার করি একটা গিটারের মত বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বাজাতে বাজাতে, কোথাও কোথাও সুর করে কবিতা পাঠ করছে৷
ওয়েলিংটনেই আলাপ হয় চিকানো ভাষার মেক্সিকান কবি কার্মেন টাফোলার সঙ্গে৷ কবিতা পাঠ এই কবির কাছে অভিনয়৷ বিভিন্ন কবিতা পারফর্ম করার সময় পোশাক পাল্টে নেন৷ প্রয়োজন হলে কবিতা অভিনয় করতে করতে মঞ্চ অতিক্রম করে চলে আসেন বাইরে৷ এইভাবে গড়ে তোলেন সেতু৷
জাপান থেকে এসেছিলেন টেন্ডো টাইজেন৷ টেন্ডোর কবিতা পাঠ প্রায় যজ্ঞের মত৷ কবিতা পাঠের সময় এক বিশেষ ধরনের কালো পোশাক পরেন, জুতোও৷ কবিতা পড়তে পড়তে গলার ওঠানামা, নানান শারীরিক অভিব্যক্তিতে নিজেকে নিংড়ে বার করে আনেন৷ বিচরণ করেন মঞ্চের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে৷ টেন্ডোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এইভাবে কবিতা পড়েন কেন, এত উত্তেজিত হয়ে? টেন্ডোর বক্তব্য, কবিতার প্রাণটাকে তা না হলে স্পর্শ করা যায় না৷
বিদেশে এই পারফর্মেন্স পোয়েট্রি দেখতে আর শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল আমাদের কবিতা পাঠ বা আবৃত্তির সঙ্গে এদের কোথায় কতখানি মিল বা অমিল৷ এই ধরনের পারফর্মেন্স পোয়েট্রির চল আমাদের দেশে যে একেবারে নেই, তা নয়৷ মালায়ালাম ভাষার অত্যন্ত জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় কবি আয়েপ্পা পানিকর কবিতা পাঠের সময় সুর দিয়ে, ঠিক গান নয়, গান করার মতন করে কবিতা পড়তেন৷ এই সবক’টি ক্ষেত্রেই মুখ্যভূমিকা থাকত কবির৷ কবিতা লেখেন না, অথচ কবিতাকে পারফর্ম করেন, এর উদাহরণ বোধহয় বাংলা ভাষা ছাড়া আর কোনও ভাষাতেই নেই৷ এই ধারা আবৃত্তি নামে পরিচিত, যা মূলত কণ্ঠ-নির্ভর অভিব্যক্তি৷
বাংলা ভাষার আবৃত্তির শুরু, বাংলা নাটকের শুরুর সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ নাট্যাভিনয় হত অনেকটা আবৃত্তির ঢঙে৷ অভিনয়ের রীতিটাই ছিল এগিয়ে যাও চেঁচিয়ে বলো৷ অভিনয়ে চারিত্রিক বিশ্লেষণাত্মক অনুভূতির অভাবে প্রাধান্য পেত আবেগ যার প্রকাশ ঘটত কণ্ঠের ওঠানামার মাধ্যমে৷ আমাদের যাত্রা পালাগানেও তাই দেখা যেত৷ নাট্যভিনয় যে শুধু আবৃত্তিতে সীমায়িত নয়, এই উপলব্ধিতে আমাদের উপনীত করেন শিশিরকুমার ভাদুড়ি৷ নাটক শুরুর আগে অনেক সময় শিশিরকুমার রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তি করতেন৷ পরবর্তী সময় শম্ভু মিত্র আবৃত্তিকে এত স্বতন্ত্র শিল্পের পর্যায় উন্নীত করেন৷ গীতিকারের লেখা গান যেমন রসিকজনের কাছে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব গায়ক-গায়িকার, কবিতার ক্ষেত্রেও সেই ভূমিকাটা পালন করলেন আবৃত্তিকারেরা৷ কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে৷ আর এখানেই বিষয়টা জটিল আকার নিল৷ গান এককভাবে সাহিত্য নয়, সঙ্গীত হিসেবে পরিবেশনে বা গাওয়াতেই তার সার্থকতা৷ অর্থাৎ গান শ্রবণের৷ সুরের যোগেই পূর্ণতা৷ সেই গাওয়ার একটা ব্যাকরণ আছে৷ সেই ব্যাকরণের বাইরে গেলে গানের তাল ভঙ্গ হয়৷ কবিতার ক্ষেত্রে চিত্রটা অন্যরকম৷ কবিতা স্বয়ংসম্পূর্ণ, নিভৃত একাকী পাঠের৷ ব্যক্তিগত নিভৃতি থেকে বার হয়ে অনেক সময় কবিরা সীমায়িত সমষ্টিতে কবিতা পাঠ করলেও কোনও ব্যাকরণের ওপর তাকে নির্ভর করতে হয় না৷ নিজের আবেগ ও অনুভূতি অনুসারে পাঠ করেন৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই পাঠ খুব একটা শ্রুতিমধুর হয় না৷ এই ফাঁকটা ভরাট হয়ে যায় অনেকটাই আবৃত্তিকারদের সৌজন্যে৷
আমরা যারা সামান্য পদ্যকার, আবৃত্তি যাঁরা করেন অর্থাৎ বাচিক শিল্পীদের কাছে কৃতজ্ঞ যে তাঁরা কবিতাকে জনপ্রিয় করতে, সাধারণ মানুষের কাছে আরও বেশি মাত্রায় পৌঁছে দিতে অবশ্যই এক অক্লান্ত যোগসূত্রের ভূমিকা পালন করে আসছেন৷ তাঁদের কাব্যপাঠের গুণে, অতি আপাত নীরস কবিতাও ভিন্ন ব্যঞ্জনায় ভিন্ন অর্থবহ হয়ে উঠছে শ্রোতাদের কাছে৷ কবিতার পাঠক থেকে ক্রমশ সৃষ্ট হচ্ছে কবিতার শ্রোতা, কখনও কখনও দর্শকও৷ কবিতা জনপ্রিয় হচ্ছে আবৃত্তিকারদের মাধ্যমে৷
প্রশ্ন এই জনপ্রিয়তা নিয়ে৷ জনপ্রিয়তার ভূমিকা নিয়ে৷ কবিতা যে নিবিড় নিমগ্নতা দাবি করে তা কি অনেকটাই লঘু হয়ে যায় না এই জনপ্রিয়তার আড়ালে?
কবি যে ভাবনা থেকে, যে চেতনা থেকে একটা কবিতা লেখেন, এক এক জনের কাছে তা এক এক রকমভাবে উন্মোচিত হয়৷ নিজের ভিতরে সেই উন্মোচন কেউ যখন অন্যজনকে বা অন্যজনদের ব্যাখ্যা করেন, যেমন অধ্যাপক, কবিকেও অনেকসময় বিস্মিত হতে হয় যে তাঁর সৃষ্ট লাইনগুলোর অন্তরালে এত ভাবনা লুকিয়ে থাকতে পারে৷ আবৃত্তিতে এই ব্যাখ্যার সঙ্গে যোগ হয় শিল্পগুণ যেমন উচ্চারণের শুদ্ধতা, কণ্ঠের ওঠানামা, মুখভঙ্গির ব্যবহার৷ এক একজন বাচিকশিল্পীর উপস্থাপনা এক একরকমের৷ শ্রোতারা এই আবৃত্তি শুনে উদ্বুদ্ধ হন, নিজের মত করে কবিতার রস আস্বাদন করেন৷ আর এখান থেকেই পদ্যকার হিসেবে আমার আশঙ্কার শুরু৷
কেউ বলতেই পারেন কবিতা এক স্বতন্ত্র শিল্প, আবৃত্তি আর এক৷ কিন্তু আবৃত্তির যেহেতু কোনও নির্ধারিত ব্যাকরণ নেই, তা অনেক বেশি করে সম্পূর্ণটাই কবিতার ভাব-নির্ভর৷ সেই ভাবের প্রসারণ ঘটতেই পারে, কিন্তু মানে বদলে গেলে কবিতার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য লঘু হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে৷ একটা উদাহরণ দিলে হয়ত কিছুটা স্পষ্ট হবে৷ শঙ্খ ঘোষের বহুশ্রুত এক কবিতার প্রথম পঙ্ক্তিটি এইরকম— ঘরে ফিরে মনে হয় বড় বেশি কথা বলা হল/ চতুরতা, ক্লান্ত লাগে খুব? আমি অনেককেই আবৃত্তির সময় যতিচিহ্ন উহ্য রেখে আবৃত্তি করতে শুনেছি৷ এতে কবিতার মানেটা পাল্টে যায়৷ মানে দাঁড়ায় সারাদিন আমরা যে চতুরতা করি সেটাই ক্লান্ত লাগে কিনা? কিন্তু কবি তো তা বলেননি৷ তিনি চতুরতাকেই প্রশ্ন করেছেন, তার ক্লান্তি লাগে কিনা৷ এরকম বিভ্রান্তি আরও নজরে পড়ে৷ যে কবিতায় যে শব্দের ওপর শ্বাসাঘাত প্রয়োজন হয়ত সেই শব্দের ওপর না পড়ে অন্য কোনও শব্দে পড়ল৷ এতে কবির বক্তব্য যা তিনি বলতে চেয়েছেন তা হয়ত হয়ে উঠল অনেকটা লঘু৷ নিজেরই একটি কবিতা থেকে যদি উদাহরণ দিই৷ প্রথম পঙ্ক্তিটি এইরকম— ‘যেভাবে বেঁচে আছি এইভাবে বেঁচে থাকতে থাকতে একদিন রাষ্ট্র হয়ে যাব’৷ এখানে ‘রাষ্ট্র’ শব্দটা প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ, ‘বেঁচে’ শব্দটা দ্বিতীয়৷ কোনও আবৃত্তিকার যদি ‘বেঁচে’ শব্দটা প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন ও অন্যটা দ্বিতীয় তাহলে কবিতার গুরুত্ব হ্রাস পায়৷ আবৃত্তি তো পুরোপুরি টেক্সট্ নির্ভর৷ অর্থাৎ কবিতা নির্ভর৷ যেহেতু অন্য কোনও উপাদান নেই, কবিতার ভাবের তারতম্য সামগ্রিক ভারসাম্য বিঘ্নিত করে৷
পরবর্তী যে বিষয়টা আসে তা হল কবিতা নির্বাচন৷ আমার অভিজ্ঞতায় বলে বাচিক শিল্পীরা যে কবিতা আবৃত্তির জন্য নির্বাচন করেন সেগুলো বেশিরভাগই কবির জনপ্রিয় কবিতা৷ আর জনপ্রিয় কবিতা মাত্রেই যে খুব ভাল কবিতা হবে তা নয়৷ এ নিয়ে বাচিকশিল্পীদের নিজস্ব যুক্তি নিশ্চয়ই থাকবে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে পরিচিত কবিদের জনপ্রিয় কবিতা আর অল্পপরিচিত বা অপরিচিত কোনও কবির যে কবিতা আবৃত্তির জন্য বিবেচিত হয় তার গুণগত মান সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়৷ তাই প্রায়শই নজরে আসে এমন সব কবিতা সংকলন যার নাম ‘আবৃত্তিযোগ্য ভালো কবিতা’ বা এরকমই কাছাকাছি কিছু৷ অর্থাৎ এই ঘেরাটোপ রয়েছেই আর তার বলয়ে বাচিক শিল্পীরা সকলেই কম-বেশি সম্পৃক্ত৷
বাদ্য সঙ্গীত সহযোগে কবিতা আবৃত্তিতে আমার আদর্শগত কোনও আপত্তি না থাকলেও এর প্রয়োগ নিয়ে আমার দ্বিধা বা সংশয় কোনওটাই কাটিয়ে উঠতে পারি না৷ পরিবেশনায় দেখি খাজনার চাইতে বাজনা অধিক হল৷ এখানে কবিতার চেয়েও প্রধান হয়ে উঠল বাদ্যযন্ত্র বা সঙ্গীতের ব্যবহার৷ কবিতার তো প্রাথমিক দাবি নিমগ্নতা, পরিবর্তে নিজের অজ্ঞাতে কবিতাই হারাল তার গুরুত্ব৷ অনেক কবিকে সেইজন্যই হয়ত দেখেছি কোথায় একটা আবৃত্তির প্রতি ছুৎমার্গিতা কাজ করে৷ এর দায় বাচিক শিল্পীরা এড়াতে পারেন না৷
কবিতা বহুমুখী, এর একক ব্যাখ্যা বলে কিছু হয় না৷ এর অনেকগুলো জানলা৷ এক এক জানলা থেকে তার এক এক অবয়ব ভেসে আসে৷ কিছু মূল অবয়ব বা ভাবটা অপরিবর্তনীয়ই থাকে৷ বাচিক শিল্পীদের হাত ধরে কবিতা পাঠকের দরবার থেকে শ্রোতার দরবারে এসেছে, কিন্তু এই শ্রোতাকেও তো দীক্ষিত শ্রোতা হতে হবে৷ সূক্ষ্ম শিল্পমাধ্যমের রস আস্বাদনের এটাই প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তা৷ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত যেমন সকলের জন্য নয়, কবিতাও তাই৷ শ্রোতার মনোরঞ্জনের জন্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে যদি লঘু করে পরিবেশন করা যায়, তাতে যেমন মার্গীয় সঙ্গীত তার চরিত্র হারাবে, কবিতার ক্ষেত্রেও সেই সম্ভাবনা প্রবলভাবে থেকেই যায়৷
একজন বাচিক শিল্পী তো প্রথমে পাঠক, তারপর আবৃত্তিকার৷ কবিতা পাঠের নিমগ্নতা, ব্যাপ্তি ও ঘরানার ওপর নির্ভর করেই গড়ে ওঠে আবৃত্তিকারের রুচি ও কবিতা নির্বাচন৷ এই অনুশীলনে ফাঁক থেকে গেলে রুচি ও নির্বাচনে তার প্রভাব অনিবার্য৷
সঙ্গীতে যেমন সুরকারের একটা ভূমিকা থাকে, আবৃত্তিতে তার অবকাশ নেই৷ কিন্তু আবৃত্তিকারদের কোথাও একটা কোনও নির্দেশিকা মেনে চলা উচিত৷ এমনিতে প্রচারের ঢক্কানিনাদে শ্রোতাদের অতিক্রম করে আবৃত্তিকারেরা কবিদেরও প্রভাবিত করা শুরু করেছেন৷ এরপর কবিরাও লিখতে শুরু করে দেবেন হয়ত আবৃতিযোগ্য ভাল কবিতা৷ অনেকেই প্রভাবিত হয়ে কবিতা বা ছড়ার বিভাজন প্রায় ঘুচিয়ে ফেলেছেন৷ এরপর অনেকেই হয়ত পারফর্মেন্স কবিতা লিখতে শুরু করবেন৷
যাঁরা কবিতার মধ্যে অন্য কোনও উপাদান নয়, কবিতাতেই বিশ্বাসী তাঁদের একটু সচেতন হবার সময় বোধহয় এসেছে৷ এরপর কি কবিরা ভাল নাট্যপোযোগী কবিতা লিখবেন যদি কবিতাকে মঞ্চস্থ করার কথা ভাবা হয়, অথবা ফিল্ম হলে সিনেমা উপযোগী কবিতা? কবিতা যে নিমগ্নতা দাবি করে, সেই দাবি মেনেই বাচিকশিল্পীদের হাত ধরে তো পৌঁছে যেতে পারে শ্রোতাদের কাছে৷ এই দায় তো কবি, বাচিকশিল্পী ও আবৃত্তি শিক্ষার্থী সবার৷