কবি, তাঁর কবিতা, এবং আবৃত্তিকারের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক কী ধরনের? সম্প্রতি কোলকাতার রোটারি ক্লাব আয়োজিত এক সভায় কবিবন্ধু প্রবালকুমার বসু আবৃত্তিকারদের ত্রুটিতে কবিতার দ্যোতনা নষ্ট হচ্ছে কিনা, সে-প্রসঙ্গ তুলেছেন। আমি শুধু তাঁর প্রস্তাবনাটুকুই শুনেছি; অন্যান্য বক্তাদের আলোচনা পাইনি। তাঁরা কে কী বলেছিলেন, তা জানার উপায় যদিও হাতে নেই, তবু বলা যায় যে অনিবার্যভাবে না হলেও থেকে থেকেই যে নষ্ট হচ্ছে, সে বিষয়ে প্রায় সকল আবৃত্তিশ্রোতাই একমত হবেন। শুধুমাত্র সুর টেনে টেনে কবিতার লাইনগুলো বলার দোষ ছাড়াও অমার্জিত কণ্ঠস্বর ও অপরিশীলিত উচ্চারণ পর্যন্ত শোনা যায়; ভাবের অভিব্যক্তিরও অভাব ঘটে। উপরন্তু কবিতার ব্যঞ্জনাও যথাযথভাবে ফুটলো কিনা, সে নিয়ে রীতিমত সন্দেহ জাগে। প্রবালকুমার যথার্থ ইঙ্গিত রেখেছেন যে কিছু কিছু আবৃত্তিকার কবিতাটি না-বুঝেই তার আবৃত্তি আমাদের শোনান।
অন্যপক্ষে বলতে পারি, আমি বেশ কিছু কবিরই স্বরচিত কবিতাপাঠ শুনেছি; এবং আমার অভিজ্ঞতা এই যে গড় হিসেবে কবিতা সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয় কবির আবৃত্তিতে। কবিতার কালো কালো হরফগুলো ঠিক যেমনটি কাগজের গায়ে সাঁটা এবং অভিব্যক্তিহীন, কবির পাঠে তার চাইতে বেশি কোনো বার্তা শ্রোতার মনে প্রায়ই পৌঁছয় না; উপরন্তু স্বগতপাঠে যেটুকু ব্যঞ্জনা পাঠক নিজে নির্মাণ করে নেন, সেটুকুর দরজাও কবি বন্ধ করে দেন: নিজের লেখা শব্দগুলোকে উচ্চারণ করে দিয়ে কোনোমতে দায় চোকান। (বিষ্ণু দের কণ্ঠে ‘চোরাবালি’, ‘ঘোড়সওয়ার’, ইত্যাদি কবিতা শুনলেই এ-ব্যাপারে চক্ষুকর্ণের বিবাদ মিটবে।) কেবলই মনে হয় কবিতাটি আগেই পড়া না-থাকলে সেটিকে হয় তাৎপর্যবিহীন, নইলে নিতান্ত দ্বিতীয় শ্রেণীর রচনা বলে মনে হতো। অর্থাৎ শ্রোতা অনুভব করেন যে কবিও নিজেও কবিতাটি বোঝেননি।
কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিলেন ও আছেন। অমিতাভ দাশগুপ্ত তাঁদের অন্যতম। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা-পাঠেও ঐশ্বর্য ছিল বলে শুনেছি। আরেক ব্যতিক্রম ছিলেন তুষার রায়, যাঁর উগ্র ও আক্ষিপ্ত আবৃত্তিতে স্বযুগের যত জ্বালা মূর্ত হয়ে আমাদের কান ঝলসে দিয়েছে। প্রবালকুমার নিজে তাঁর ‘জন্মবীজ’ কবিতার সুদীর্ঘ অংশের আবৃত্তি আমাদের শুনিয়েছেন; তবে তাঁর আবৃত্তির সঙ্গে অন্যান্য একাধিক শিল্পী বিবিধ শিল্পের সম্ভার নিয়ে সহায়ক ছিলেন। আমার চোখে সেটি সিদ্ধ প্রচেষ্টা হলেও বলবো, এঁরা কতিপয় ব্যতিক্রমমাত্র; সামান্য অভিজ্ঞতা এই যে কবিরা নিজেদের কবিতার প্রতি সুবিচার করতে পারেন না।
এর কারণ, কবিরা সাধারণত আবৃত্তি ব্যাপারটাকে একটা সাধনযোগ্য শিল্প বলে ভাবেন না। শ্বসন ও রণনের নিয়ন্ত্রণভিত্তিক কণ্ঠসাধনা, স্বরের গভীরতা, তীব্রতা ও বিবিধ স্বরগ্রামের ওপর নিয়ন্ত্রণ, স্বরের নমনীয়তা ও অর্থব্যঞ্জক সুরের প্রয়োগ— এবং বিশেষত অপরের লেখা কবিতা আবৃত্তি করা— এসবের নিয়মিত চর্চা ক’জন কবি করেন? কোনো প্রতিষ্ঠিত কবিকে মঞ্চে উঠে বলতেও শুনিনি যে তিনি এবার রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, কি নিজের কোনো সতীর্থের কবিতা আবৃত্তি করবেন। এসব করা তাঁদের ক্ষেত্রে আবশ্যিকও নয়, আর তাঁদের কাছে আমাদের সে-প্রত্যাশা থাকেও না। তাঁরা কবিতা রচনা করেন— তাতে সিদ্ধির মাত্রার হেরফের হয়েই থাকে, এবং সেটা আমরা স্বাভাবিক বলেই মেনে নিই; কবিতাটা তেমন ভালো না-লাগলে কখনও বলি না যে কবি নিজের বোধটাকে ঠিক বুঝতে পারেননি। আমাদের সাধারণ পূর্বগ্রহ এই যে তিনি যেটা লিখেছেন, সেটা তাঁর অনুভূতি-বোধ-চিন্তা ইত্যাদির নিখুঁত প্রতিফলন। কিন্তু আসলে আমাদের জানার কোনো উপায় নেই যে কবি তাঁর ভাবকে নির্ভুলভাবে ভাষায় ধরতে পেরেছেন কিনা। বরং আমরা উল্টোটা ধরে নিই: ভাষায় যা ধরা পড়েছে, সেটাই নিশ্চয় কবির ভাবনা। আমরা ভাষার দাস।
এই দাসত্বের ব্যাপারটা বুঝতে হয় গ্রীকদের সেই মাইমেসিস-তত্ত্বের প্রেক্ষণ থেকে— যাকে আমরা সহজে ‘অনুকরণ-তত্ত্ব’ বলি। প্লেটো বলেছিলেন কথা হলো ভাষা দিয়ে ভাবনার অনুকরণ। অন্তত কবিতার ক্ষেত্রে, এ-কথাটা নিশ্চয় তর্কাতীত: কবি তাঁর ভাবনাকে ভাষা দিয়েই মাইমেসিস করছেন। আমরা বলতে পারি যে আবৃত্তি হলো কণ্ঠধ্বনি দিয়ে কবিতার অনুকরণ; কারণ আবৃত্তিকার নিজের কণ্ঠধ্বনি দিয়ে কবির ভাষার মাইমেসিস করছেন। সেক্ষেত্রে আবৃত্তিকারের মাইমেসিসটা যথাযথ হলো কিনা এ-প্রশ্ন যদি উঠতে পারে, তবে কবির মাইমেসিসটা যথাযথ হয়েছিল কিনা, সে-প্রশ্নও ওঠা উচিত। কিন্তু আমরা সে-প্রশ্নটা তুলি না; কারণ আমরা ভাষার দাস: ভাষায় যা পাচ্ছি, তা আমাদের কাছে প্রশ্নাতীত।
কবিতা রচনার সঙ্গে কিন্তু আবৃত্তিশিল্পের সরাসরি কোনোই সম্পর্ক নেই। কবিদের কারবার অনুভব, ভাবনা, বোধ, ইত্যাদি নিয়ে; কালি-কলম নিয়ে। তার সঙ্গে শব্দচয়নেরই সম্পর্ক বেশি; শ্রাব্যধ্বনির ততটা নয়। ধ্বনির কারবার আবৃত্তিশিল্পীর। আবেগ-অনুভূতি, মায় চিন্তাগতিকে পর্যন্ত কণ্ঠস্বরের সাহায্যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে তোলার দায়িত্ব তাঁদের। সেসবের চর্চা পর্যন্ত কেউ কেউ করেন। তাঁদের আবৃত্তির ক্ষেত্রে যদি তাঁরা কবিতাটা ঠিক ‘বুঝেছেন’ ও বোঝাতে পারছেন কিনা এ-প্রশ্ন তুলি, তাহলে স্বয়ং কবির আবৃত্তিতেও একই প্রশ্ন ওঠে: নিজে তিনি নিজের ভাবনাটা শ্রোতাকে ঠিকঠাক শোনাতে পারছেন তো?
আমরা হ্যাঁ কিম্বা না জাতীয় সহজ উত্তর খুঁজে নিয়ে তর্ক জুড়ে দিই, কারণ আসলে এই দু’ধরনের উপস্থাপনা ঘটার ফলে দু’ধরনের শ্রোতা তৈরি হয়ে যায়: একদল আবৃত্তিকারের কণ্ঠসৌন্দর্য, উচ্চারণসৌকর্য ইত্যাদিতে মোহগ্রস্ত হয়ে কবিতার তাৎপর্য প্রকাশিত হলো কিনা, সে-নিয়ে মাথা ঘামান না; অপর দল (তাঁরা মূলত কবিতা-পাঠক) কবির বোধের প্রামাণ্যতার খাতিরে কবির উচ্চারণকেই শিরোধার্য মানেন— কখনো এ-বিচার করেন না যে, যে-শব্দগুলো তিনি নীরস চেহারায় ছাপা হরফেই দেখতে পাচ্ছেন সেই শব্দগুলো ঠিক তেমনই নীরস রূপে কানে ঢুকিয়ে নিয়ে তাঁর ঠিক কী লাভ হচ্ছে।
এতে করে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির মোট যে-তফাতটা হয়ে যাচ্ছে সেটা এই ধরনের যে একপক্ষে আমরা আবৃত্তিকারের শিল্পটাকে আর ‘কবিতা’ বলেই ভাবছি না: আবৃত্তিকারের সুখদ কণ্ঠধ্বনি বলে ভাবছি। অন্যপক্ষে, কবিতাকে কোনো অভিজ্ঞতা হিসেবে অনুভব করছি না; কবি ব্যক্তিটির উপস্থিতিটুকুতেই খুশি থাকছি। দু’ক্ষেত্রেই একটা ব্যক্তিপূজার হাওয়া বয়ে আবৃত্তি-শিল্পটাকে আমাদের চেতনা থেকে উড়িয়ে দিচ্ছে।
যেখান থেকে এসব ধন্দের উৎপত্তি, সেটা কিন্তু অনেক পুরোনো একটা ধারণা, যেটার কথা অ্যারিস্টটল প্রথম বলেছিলেন। সেটা হল শিল্পে মাধ্যমের গুরুত্ব: কোন্ মিডিয়াম বা মাধ্যম ব্যবহার করে শিল্প নির্মিত হচ্ছে, তার বিচার। রেডিওতে এবং মৃৎপ্রতিমায় মহিষাসুরমর্দন একভাবে হাজির করা যায় না; দুটোর মাধ্যম আলাদা বলে একটির মানদণ্ডে অন্যটির বিচারও চলতে পারে না। হরফ দিয়ে যা রচিত, ধ্বনি দিয়ে তার পু্নর্নিমাণ করলে পার্থক্য থাকতে বাধ্য। এই সহজ কথাটা মনে না-রাখার দরুন আমরা লিখিত কবিতার মানদণ্ডে উচ্চারিত কবিতার মূল্যায়ন করতে চাই। কিন্তু আগেই যেমন দেখে এলুম, লিখিত কবিতা কবির মনোভাবের নিখুঁত রূপায়ণ না-ও হতে পারে।
এর লাগোয়া আরেকটা কথা থাকে: সার্থক কবি কিন্তু কবিতা সমাপ্ত করে নিশ্চিত হন যে তাঁর যা বলার ছিল, তা সম্পূর্ণরূপেই তিনি বলেছেন, তাঁর বলা শেষ হয়ে গেছে, এবং তার ওপরে তাঁর আর কিছু যোগ করার নেই। সেক্ষেত্রে তিনি আবৃত্তি করবেনই বা কেন? বাড়তি কোন্ মাত্রা তিনি যোগ করবেন, যার দ্বারা প্রমাণ হবে যে তাঁর লেখনী আংশিক ক্ষমতাসম্পন্ন— তাকে আরও সমৃদ্ধ না করলে তার প্রকাশ অসম্পূর্ণ থাকছে? আবৃত্তিকার যে কবির কথায় সেই বাড়তি মাত্রাটা যোগ করছেন, এটা মানতেই হবে। সেই সংযোজনের জায়গায় কবির কল্পনাকে ধাওয়া করতে তিনি বাধ্য নন।
প্রবালকুমার কথাপ্রসঙ্গে একটি ঘটনারও উল্লেখ করেছেন। শঙ্খ ঘোষ মশায় কোনো এক আবৃত্তিকারের মুখে নিজের একটি কবিতার বিরস ‘আবৃত্তি’ শুনে প্রবালকুমারের প্রশ্নের উত্তরে একান্তে জানান যে মঞ্চস্থ লোকটি কবিতাটা ঠিকঠাক বোঝেনি। এ একটা প্রামাণ্য কথা নিশ্চয়ই। শঙ্খ ঘোষ স্বয়ং রচয়িতা, অনুভবী কবি, উপরন্তু অভিকর শিল্পবিষয়ে রীতিমত ওয়াকিবহাল মানুষ ছিলেন বলে এ-নিয়ে কোনো বিতণ্ডার অবকাশ নেই। কিন্তু নীতিগতভাবে, আবৃত্তির বিষয়ে কবির মন্তব্যকে শেষ কথা ধরলে অন্য কিছু সমস্যা দেখা দেয়। তার ভূমিকা হিসেবে ‘আবৃত্তি’-নামক ধারণাটাকে একটু নেড়েচেড়ে দেখা ভালো।
কোনো কিছুকে আবৃত্ত করা, অর্থাৎ আবার বর্তানোকেই মূলে আবৃত্তি বলা হতো— যেমন ‘পুনরাবৃত্তি’ শব্দটায় দেখা যায়। প্রাচীন যুগে মন্ত্র ইত্যাদি বারবার উচ্চারণ করে তাকে স্মৃতিগত করা হতো। এযুগে তার রেশ টিঁকে আছে নামতায়। সেই পুনঃ পুনঃ আবর্তিত উচ্চারণের চর্চা থেকেই আধুনিক আবৃত্তির ধারণাটা এসেছে। অর্থাৎ একটা কবিতা ইতিমধ্যেই অস্তিত্বশীল; সেটাকে পুনরায় অস্তিত্বশীল করে তোলা হলো তার আবৃত্তি। আবৃত্তি প্রাক্লৈখিক যুগের এক শৈলী, যাকে আমরা কালক্রমে শিল্পের পর্যায়ে তুলে এনেছি।
কথা হচ্ছে, আজকের দিনে এ-কাজটা আমি করি কেন? বিশেষত এই মুদ্রণযুগে— যখন ছাপা কবিতাটা সর্বজনে পড়ে নিতে পারে! আমি আবৃত্তিতে নিশ্চয় ছাপা কথাগুলোর সঙ্গে বাড়তি কিছু দিচ্ছি, যাতে তার সংবেদ্যতা বাড়ছে। সেটা কবির অবদান নয়; সেটা নিতান্তই আমার অবদান; এবং সেইটের খোঁজেই লোকে একটা কবিতা পড়ার পরেও তার আবৃত্তিটা শুনতে যায়, উদ্দীপ্ত উৎসবের পরিবেশেও শম্ভু মিত্রের কাছে ‘আট বছর আগের একদিন’ শোনার বায়না ধরে! সেই অবদানটার ওপরে কবির কোনো অধিকার বা নিয়ন্ত্রণ থাকা অযৌক্তিক। মোটের ওপর, পড়ে-নেওয়া কবিতাটা নয়, আবৃত্তিকার কবিতাটি কীভাবে অনুভব করেছেন এবং আমাদের অনুভব করাতে চাইছেন, সেই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যই আমরা আবৃত্তি শুনতে যাই। ‘জং’ কিম্বা ‘কুড়ি বছর পরে’ বইয়ে পড়ে যা অভিজ্ঞতা হয়, শম্ভু মিত্রের আবৃত্তি শুনে তার বিশগুণ সংবেদন আমাদের মনে জাগে।
সাধারণভাবে বলা যায় যে যত বড় কবিই হোন, আবৃত্তির সাধনা যিনি করেননি, তিনি নিজের কবিতার মর্মার্থ আমাদের কানে পৌঁছে দিতে পারবেন না। যে-অভিজ্ঞতাকে তিনি শব্দবন্ধে রূপ দিতে পেরেছেন, সেটাকে তিনি ধ্বনিবন্ধে রূপ দিতে পারবেনই, এমন কোনো নিশ্চিতি নেই। সেখানে ব্যর্থতার সম্ভাবনাই সমধিক। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘মে দিনের গান’-এর আবৃত্তি তার অন্যতম প্রমাণ। তিনি অতুলনীয় শক্তিধর কবি হলেও স্বরচিত ঐ তেজস্বী কবিতার spirit-এর একাংশও আমাদের কানে পৌঁছে দিতে পারেননি।
কবিতার ও আবৃত্তির ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতার চরিত্র পাল্টায়: পড়বার সময়ে চোখের মাধ্যমে বুদ্ধির কাছে আবেদন পৌঁছোয়; আবৃত্তির বেলায় কানের মাধ্যমে। আবেদনের এই যে স্থানান্তর, এইখানে একটা ব্যবধান ঘটে: কবির উদ্দিষ্ট তাৎপর্য পাল্টে গিয়ে অন্য চেহারা নেবার একটা সঙ্গত সম্ভাবনা তৈরি হয়। নিদেনপক্ষে নিতান্ত সাদা-কালো একটা কবিতা রঙিন হয়ে উঠতে পারে আবৃত্তিকারের কল্যাণে। সেই সম্ভাবনার প্রসঙ্গে বহুরূপীর ঘরে শম্ভু মিত্রের একটি স্মরণীয় আবৃত্তির কথা বলতে পারি: সেটি হলো রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষণিকা’ গ্রন্থের ‘যাত্রী’ (‘আছে, আছে স্থান/ একা তুমি, তোমার শুধু একটি আঁটি ধান’)। শম্ভুদা সেদিন কবিতাটি এমনভাবে বলেছিলেন যে কবিতার রোম্যান্টিকতা গিয়েছিল মুছে; শ্রোতাদের মনে হচ্ছিল একটা লোক ভারি কুমতলবে একটি মেয়েকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নৌকোয় তুলে নিতে চাইছে। অবশ্যই তিনি সেটা কোনো প্রামাণ্য আবৃত্তি হিসেবে পেশ করেননি, কিন্তু কবিতার ব্যাখ্যানের সম্ভাবনার এমন চোখে-আঙুল দেওয়া প্রায়োগিক শিক্ষা আর কেউ কখনো কোথাও দিয়েছেন বলে আমি শুনিনি।
এইটে একটা দরকারি প্রেক্ষিত; কারণ আমরা মোটের ওপর মেনে নিই যে শিল্পের দায়িত্ব হলো অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যান দেওয়া। সেই কাজে ব্যর্থ হলে শিল্প তুচ্ছ প্রমোদে পরিণত হয়। কবিতাও কবির অভিজ্ঞতারই ব্যাখ্যান; কিন্তু সেটা কবির নিজের অভিজ্ঞতা— আবৃত্তিকারের অভিজ্ঞতা মোটেই নয়। আবৃত্তিকারের অভিজ্ঞতা হলো কবির কবিতাটি। তিনি তাঁর সেই কাব্য-অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যান হাজির করেন শ্রোতার কাছে। কাজেই কবি কী ভেবে কবিতা লিখেছিলেন, সেটা আবৃত্তিকারের জানার কথাই নয়। কবিতাটি পড়ে তাঁর কী বোধ হয়েছে, সেইটুকুই মাত্র তিনি শোনাতে পারেন। যেহেতু আবৃত্তি হলো কবির নির্মিত শিল্প-সামগ্রীটির একটা ব্যাখ্যান— কবির মূল অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যান নয়— অতএব তত্ত্বগতভাবে, আবৃত্তি-বিষয়ে কবির কোনো বক্তব্যই থাকতে পারে না। তাঁর যে-কোনো বিরূপ বক্তব্যের পিঠে আবৃত্তিকার বলতেই পারেন যে এই কবিতায় কবি তাঁর অভিজ্ঞতাকে এমন কোনো রূপ দিতে পারেননি, আবৃত্তিকালে যার একটাই মাত্র অনিবার্য ব্যাখ্যান হতে পারে।
আরো এক দিক থেকে বিষয়টার দিকে এগোনো যায়। ‘শিল্প-সাহিত্য’— এই যুগ্মকটা আমরা ব্যবহার করি কেন? ‘শিল্প-বিষয়ক’ পত্রিকা আর ‘সাহিত্য-বিষয়ক’ পত্রিকার কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা ভিন্ন ভিন্ন হয় কেন? প্রকৃত বিচারে সাহিত্য কিন্তু শিল্প নয়। তার কারণ শিল্পের আবেদন আমাদের ইন্দ্রিয়ের কাছে: আমাদের aesthesis বা সংবেদনের কাছে; সাহিত্যের আবেদন বুদ্ধির কাছে। সাহিত্য হিসেবে চীনে কবিতার কোনো মূল্য আমার কাছে নেই; কারণ চীনে হরফগুলো আমি পড়ি না, দেখতে পাই মাত্র, তাই আমার কাছে ওদের মূল্য সুসজ্জার বেশি নয়। উপরন্তু চীনে কবিতা শুনলেও আমি কিচ্ছু বুঝব না; কারণ ভাষাতে ধ্বনির সঙ্গে অর্থের কোনো অনিবার্য যোগ প্রায় কখনোই থাকে না। বাংলার ক্ষেত্রেও, কালো কালো হরফগুলোকে মস্তিষ্কের মধ্যে শব্দ, বাক্য, ও অর্থে রূপান্তরিত করে তবে আমায় কবিতা বুঝতে হয়; ধ্বনিপরম্পরাকেও অর্থে অনুবাদ করে নিতে হয়। কিন্তু চীনে কি বাংলা ভূদৃশ্যের ক্ষেত্রে এসব সমস্যা নেই: সে-জিনিস দেখামাত্র আমার সংবেদনে সাড়া জাগায়। তাই সাহিত্য শিল্পপদবাচ্য নয়; ছবি শিল্পপদবাচ্য।
এ-সত্ত্বেও যদি কবিতাকে শিল্প বলে মানি, তবে কথা ওঠে যে কবিতা হলো নির্মিতি বা শিল্প-‘সামগ্রী’, আর আবৃত্তি হলো কৃতি বা শিল্প-‘ক্রিয়া’। দুটো ব্যাপার আলাদা: কাজেই সামগ্রীটার মানদণ্ডে ক্রিয়াটার বিচার করা অসঙ্গত। চিত্রকরের তুলি কিম্বা কবির কলম চালানোর ক্রিয়াতে উপভোক্তা হিসেবে আমার কোনো কৌতূহল নেই; কিন্তু আবৃত্তি, নৃত্য, গান, ইত্যাদির ক্ষেত্রে ক্রিয়াটাই হলো আমার উপভোগের বিষয়। একই রাগাশ্রয়ী বিভিন্ন খেয়ালগানের কোনটা যে ভুল, সে-প্রশ্ন তো ওঠে না; গায়কদের রূপায়ণগুলোই উপভোগ্য ধরা হয়। সমান্তরে একই কবিতার ওপরে বিভিন্ন পাঠ হতেই পারে।
রবীন্দ্রসঙ্গীতে গানের কথা এবং সুর লিপিবদ্ধ ও স্বরলিপিবদ্ধ বলে একটি গানের একটিমাত্রই সঠিক গায়ন থাকতে হবে। তাহলে ‘এখন আমার সময় হলো’ গানটির কোন গায়নটি সিদ্ধ— রাজেশ্বরী দত্তরটি, না দেবব্রত বিশ্বাসেরটি? Dvorak-এর সুবিখ্যাত Humoresque রচনাটি ইউটিউব খুললেই খ্যাত-অখ্যাত অসংখ্য বাদকের বাজানো রূপে পাওয়া যায়। সিদ্ধ বাদকেরাও সেখানে নানা স্বাধীনতা নিয়েছেন; এবং তাদের সবগুলোই মান্য। নাটকের ভাঁড়ামোর দৃশ্যের মজার আবহ হিসেবে ওটার মান্য লয়, ঝোঁক ইত্যাদি পাল্টে আমরা staccato-য় বাজিয়েছি। অধিক কী, Londonderry Air সুরটি ক্রাইসলার, হাইফেৎজ্, মেনুহিন, ইয়ো ইয়ো মা, ও পার্লম্যানের বাদনে শুনলেই কোনটা যে সঠিক ব্যাখ্যান, সে-ধন্দ মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। সুচিত্রা মিত্র, নীলিমা সেন এবং কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এই তিনজনেই ‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ’ গানটি গেয়েছেন। তিনটির মধ্যে গায়নে বেশ কিছু তফাত ধরা পড়ে। এদের মধ্যে কোনটিকে আমরা প্রামাণ্য বলব? কোন্ দু’জন গানটি ঠিক বোঝেননি সে-কথা কে বলে দেবে? রবীন্দ্রনাথকে পাব কোথায়?
তাহলে সমস্যা হল এই যে আজ শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতা আবৃত্তি করলে সেটা কবিতার ঠিক ব্যাখ্যান না ভুল ব্যাখ্যান হলো, সে-কথা স্থির করে দেবার কেউ নেই; কারণ একমাত্র কবিই স্রষ্টা; বাকিরা পাঠক মাত্র, অতএব তাঁদের মত প্রামাণ্য নয়। তখন আমার আবৃত্তিটা যেমন ঠিক বা ভুল হতে পারে, অন্য আবৃত্তিকারদেরও তাই। তেমন পরিস্থিতিতে কোনো ব্যাখ্যানই আর ভ্রান্ত বা অভ্রান্ত হওয়া সম্ভব হয় না। সব আবৃত্তিগুলোই ঠিক বলে ধরলে যেমন একই কবিতার বহুবিধ ব্যাখ্যানের সম্ভাবনা দেখা দেয়, এবং কবিতা একমাত্রিক থেকে বহুমাত্রিকতা পায়, তেমন সবগুলোই ভুল বলে ধরলে সঠিক ব্যাখ্যানটার কোনো সন্ধান মেলে না, এবং ‘সঠিক’ ব্যাখ্যানের অভাবে কবিতাটাই লোপ পেয়ে যায়। সেক্ষেত্রে বলতে হয়, অন্তত আবৃত্তির জগতে, কবি প্রয়াত হলেই তাঁর কবিতার সঠিক আবৃত্তি আর সম্ভব হয় না; তাঁর কর্তব্য মরণোত্তরকালে তাঁর কবিতার আবৃত্তি আইনত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রাখা।
কিন্তু তা হবে না, কারণ এটা লোকমাধ্যমের যুগ। কেউ যদি আমার অমুক কবিতাটি ইউটিউবে আবৃত্তি করার অনুমতি চান তো প্রচারের লোভ আমি ছাড়তে পারব না; ক্রমে মৃত্যুঞ্জয়ী হওয়ার লোভও নয়। পক্ষান্তরে, রবীন্দ্রনাথ যদিও তাঁর গানের পেটেন্ট নিতে বাধ্য হলেন প্রচণ্ড অপগায়নের চাপে, তবু তাঁর মৃত্যুর ষাট বছর পরে তাঁর গানের সুফলা ক্ষেতে উদ্দাম হিড়িকবন্যা ঠেকানো গেল না। তবে সে-হিড়িক শ্রোতাদের বিরক্তিবশত ক্রমে কমে আসছে; কবিকে কোনো আপত্তি জানাতে হচ্ছে না।
তবে কি কবির মন্তব্য প্রামাণ্য নয়, শ্রোতারাই শেষ বিচারক? কিন্তু তাঁরা তো দেখি মিডিয়ার শিকার। তাঁদের মগজ ধোলাই করেই তো শিল্পী-সাহিত্যিক উৎপাদন করা হচ্ছে। আর শ্রোতারাই বা কারা? বন্ধু উত্তম দত্ত সম্প্রতি ফেসবুকে লিখেছেন যে জনৈকা আবৃত্তিকারিণীকে পরিচিত লোকের মাধ্যমে খুব পেড়াপীড়ি করলে তিনি নাকি অল্পস্বল্পে— মানে আশি হাজারের বদলে হাজার ষাটেক টাকা নিয়ে— একটি অনুষ্ঠান করতে রাজি হতেও পারেন। খুবই উৎসাহের কথা। কিন্তু বাকি কথাটা হচ্ছে, যাঁরা তাঁর শ্রোতা— এই বিপুল খরচবাহী ষাট-হাজারী মন্সবদারগণ— তাঁদের মন কি কবিতায় নিমগ্ন, নাকি পয়সা পিটতে ব্যস্ত? কবিতা পড়ার এবং বোঝার সময় তাঁরা পান কখন? বলতে হয়, উক্ত মহিলা প্রচুর টাকার বিনিময়ে বাবুদের সামনে প্রমোদ বিতরণ করেন, আর বাবুরা যা কেনেন, সেটা হলো স্টেটাস— তাঁরা রেগুলার পহা খচ্চা করে সন্স্কৃতি করে থাকেন; ‘ওরা কায়দাকানুন জানে’ বলেই সন্ধেয় মাইফেলে যান। অনেককাল হলো বিখ্যাত সব মিউজিক কন্সফারেন্সেই এঁদের পপকর্ন চিবুতে দেখা যাচ্ছে, তো আবৃত্তি-আসরে কা কথা।
এসব কথার মানে এই নয় যে আবৃত্তিকার সম্পূর্ণ নির্দায় এক স্বেচ্ছাচারী। আবৃত্তিকারের অন্যতম দায় হলো আবৃত্তির যোগ্য, অর্থাৎ অভিব্যক্তি দেওয়ার যোগ্য কবিতার খোঁজ রাখা। যে-কোনো কবিতা ‘আবৃত্তি’ করা যায় না। কবির নামের মহিমায় নিজেকে মহিমান্বিত করার চেষ্টাও ভুল। রবীন্দ্রকাব্যের অধিকাংশ আবৃত্তিকার রবীন্দ্রনাথকে এযুগের দর্শকচেতনার কাছে নিয়ে আসতে পারেন না। গৌণতর কবিদের সঙ্গে শ্রোতাদের পরিচয় করানো আজ বেশি প্রয়োজন; কিন্তু তাঁদের আবার অনেক রচনা আছে, যেগুলোকে কেন যে লেখক ‘কবিতা’ বলছেন, কেউ জানে না: শুধুই খানিকটা নির্জলা গদ্য— যা লিখিত কথাগুলোর বেশি কিছুর ইঙ্গিত রাখতে পারছে না। স্বীকৃত বেশ কিছু কবিতাকে বলা যায় অসাড়, তাই আবৃত্তির অযোগ্য: অর্থাৎ সেগুলোতে প্রাণচাঞ্চল্য বা অনুভব-অনুভূতি সঞ্চারিত করার প্রায় কোনো অবকাশই নেই:
কোনো যুক্তি নেই। তবে যুক্তিতে কে বাঁচে
যুক্তির সেই তো মহা ত্রুটি।
সেকেলে ভাগ্যের মতো যুক্তিরও ভ্রূকুটি।
যুক্তির প্রসাদ কেবা পুঁথি ঘেঁটে যাচে।হয়তো বা যুক্তি নেই, শক্তি খুবই কাঁচা,
ইওরোপীয় নয় সত্য, হয়তো জান্তব—
তবু বাঁচে। বস্তিতে বা ফুটপাথেই অজ্ঞাত কী বাঁচা
এক হিসাবে মনে হয় এরা সব বিশ্বের পাণ্ডব।
(বিষ্ণু দে, ‘এরা সব বিশ্বের পাণ্ডব’)
মনে হয় এ-কবিতাটি ছাপা হরফে যেটুকু, আবৃত্তিতে তার চেয়ে বেশি কিছু বোধ শ্রোতার মনে জাগাতে পারবে না।
এই ‘বেশি কিছু’-র প্রসঙ্গটা স্পষ্টতর হবে সমান্তর একটা শিল্পের নিদর্শন নিলে: সেটা হলো নাটক। লিখিত নাটক যখন মঞ্চনাট্য হিসেবে অভিনীত হয়, তখন সেটা পাঠ্যের একটা ব্যাখ্যানের রূপ নেয়। সফোক্লেসের অয়দিপাউস নাটকটি সফোক্লেস করিয়েছিলেন মুখোশ-পরা অভিনেতাদের মাধ্যমে, যেখানে অভিনেতাদের মুখের অভিব্যক্তি দর্শককে কোনো বার্তা দিতে পারত না। সেটা একটা ঘোর রাজনৈতিক নাট্য; অয়দিপাউস সেখানে এক স্বৈরাচারী: ‘তুরান্নস’ বা tyrant । রাইনহার্ডের উপস্থাপনা রোম্যান্টিক: সেখানে আমরা এক নিয়তিনিপীড়িত প্রজারঞ্জক মহান রাজার নির্মম পতন দেখি— যে-ব্যাখ্যানটা শম্ভু মিত্র মেনেছিলেন। আবার পিলিকিয়ানের প্রযোজনায় নাটকের পুরো ব্যাখ্যানটাই আদিম ও আভিচারিক। এ-ছাড়া multi-media-প্রযুক্ত রাজনৈতিক ব্যাখ্যানের উপস্থাপনাও বাংলায় সম্প্রতি হয়েছে। এদের মধ্যে নাট্যকারের ব্যাখ্যানটাই নিশ্চয় প্রামাণ্য ধরতে হবে; এবং তদনুসারে অভিনেতারা আজ দুপুরে একটা গোল জমির ওপারে দর্শকদের থেকে ষাট-সত্তর ফুট দূরে দাঁড়িয়ে সুর টেনে টেনে ছন্দোবদ্ধ সংলাপগুলো ‘ঘোষণা’ করে দর্শকদের শোনাবেন, আর গোল জমিটাতে কোরাসের দল নাচগান করবে। তাতে করে এ-যুগে নাটকটা বাঁচবে তো, নাকি তাকে অন্য কোনো মঞ্চরূপ দিতে হবে? মোটের ওপর আমরা কিন্তু নাটক দেখতে যাই অমুক নির্দেশক অমুক নাটকের কী ব্যাখ্যান দিচ্ছেন, সেইটে দেখবার জন্য। সেখানে ভুল-ঠিকের বিচারটা হয় ব্যাখ্যানের অভ্যন্তরীণ সুসঙ্গতির ভিত্তিতে।
এমন উদাহরণ আরও দেওয়া যায়; এবং সেই ছুতোয় একটা বোধহীন বিতর্কও এসে পড়ে: আবৃত্তি কি অভিনয় নাকি? যাঁরা আবৃত্তি নিয়ে কিচ্ছু ভাবেননি, তাঁরা এ-তর্কটা তোলেন। আবৃত্তি অভিনয় ছাড়া আর কী? কবিতাকে অপরের লেখা সংলাপের মতো আয়ত্ত করে তাকে উপভোক্তার অভিজ্ঞতা করে তোলাই তো আবৃত্তি। অভিনয়ও মূলত তাই (বাড়তির মধ্যে নাটকে সাধারণত অপর চরিত্রের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ থাকে)। সেই কারণেই অভিনয়শিক্ষার প্রথম ধাপ হলো আবৃত্তিশিক্ষা। আর আবৃত্তির ‘বাচিক অভিনয়’ পদবীটাও ন্যায্যতা পায় তার অভিনয়ধর্মিতার কারণেই। আর্ভিং-এর ম্যাকবেথের চরিত্রায়ণ, বা ওথেলোর অলিভিয়ার-কৃত ‘It is the cause, my soul’ সংলাপের ব্যাখ্যান, বা শম্ভু মিত্রের ‘যাত্রী’ কবিতার পূর্বোক্ত demonstration ইত্যাদি প্রমাণ করে যে লেখক নন, অভিকর শিল্পীই আসল ব্যাখ্যাতা।
অভিনয়ের মতোই, আবৃত্তির মাত্র দুটো ধাঁচ আছে: অক্ষম আবৃত্তি ও সক্ষম আবৃত্তি। অক্ষম আবৃত্তিকার কবিতাকে দেখেন কতকগুলো উচ্চার্য শব্দসমষ্টি হিসেবে; সক্ষম আবৃত্তিকার দেখেন একটা ব্যাখ্যানযোগ্য পাঠ হিসেবে। অক্ষমের কাছে কবিতা হলো গলা খেলাবার একটা অছিলা; সক্ষমের কাছে তা কবির মুখের সংলাপ: যে-সংলাপের মাধ্যমে তিনি কবিকে হাজির করবেন— কোনো ব্যক্তি হিসেবে নয়, সুভাষী এক ‘চরিত্র’ হিসেবে। তিনি সেই চরিত্রে অভিনয় করবেন বলে সে-চরিত্রের বক্তব্যের ব্যাখ্যানের দায় ও অধিকার দুটোই তাঁর। যতগুলি ব্যাখ্যান সেই বক্তব্যে নিহিত আছে, তার যে-কোনো একটি বা একাদিক্রমে সবগুলোই তিনি গ্রহণ করতে পারেন। কবিতা একবার লেখা বা প্রকাশিত হয়ে গেলে তা সম্পূর্ণ ও সমাপ্ত। অভিনেতার দায়বদ্ধতা যেমন নাট্যকারের কাছে নয়, নাটকের কাছে, তেমনই আবৃত্তিকার বিশ্বস্ত থাকেন কবির কাছে নয়, কবিতাটির কাছে। কবিকে তিনি তদনুযায়ী নির্মাণ করে নেন।
সক্ষম আবৃত্তিকারের বিচারের মধ্যে এত কিছু পড়ে যে তার কোনো তালিকা হয় না। তবে একটা ক্ষুদ্র উদাহরণ বরং দেওয়া যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘আছে’ কবিতাটি থেকে—
খুঁজে দেখো, আছে, আছে,
নদী তেপান্তর কিম্বা পাহাড়ের কোলে কুণ্ডলিত
তোমার সে শখের শহর।
এর প্রথম লাইনের দ্বিতীয় শব্দটির উচ্চারণ কী হবে— ‘দেখো’, না ‘দ্যাখো’? দুটোই ঐ-বানানের মান্য উচ্চারণ। ‘দেখো’ উচ্চারণ করলে শ্রোতা অনেকটা মানসিক অবকাশ পেয়ে যান; তিনি অবসরক্রমে নিজের ‘শখের শহর’-কে কল্পনার জগতে খুঁজে নেওয়ার কথা ভাবেন। কিন্তু ‘দ্যাখো’ উচ্চারণ করলে একটা তৎপরতা আসে; মনে হয়, এই যেখানে আমি আছি, এর মধ্যেই এখুনি খুঁজতে হবে সেই শহরকে— এইখানেই কোথাও সে আছে— দেখি তো কোথায় আছে! অর্থাৎ আবৃত্তিকার দর্শককে কল্পলোক না বস্তুজগৎ, কোনটায় জড়াতে চাইছেন তা তাঁকে স্থির করে নিতে হবে; কারণ পাঠে দুটো ধারণাই উপ্ত। কাজেই আবৃত্তিকার কোনো কবিতা ঠিক ‘বুঝেছেন’ কিনা সে-প্রশ্ন আমরা করতে না-পারলেও ঠিক ‘পড়েছেন’ কিনা, সে-কথা তুলতেই পারি। কিন্তু সে-আলোচনা বর্তমান লেখাকে দীর্ঘায়িত করবে; কাজেই বারান্তরে সে-প্রসঙ্গে আসা যেতে পারে।
নিজের সাধ্যসীমা, অর্থাৎ ব্যাখ্যান দেবার ক্ষমতা কতদূর, তাও আবৃত্তিকারকে জানতে হয়। একমাত্র শম্ভু মিত্র ছাড়া আর কোনো পুরুষকণ্ঠে আমি নারীচিত্তের যথার্থ প্রকাশ শুনিনি। ‘জীবনদেবতা’ কবিতাটি কাজী সব্যসাচী কিম্বা উৎপল দত্তর আবৃত্তিতে কেমন শোনাত, ভাবলে আমার হৃৎকম্প হয়। অথচ শম্ভু মিত্র falsetto প্রয়োগে নারীকণ্ঠের অনুকরণ করেননি— যা বোঝাবার তা অভিব্যক্তি দিয়েই বুঝিয়েছেন! কিন্তু সেখানে ভক্তির অন্তরালে নারীচিত্তের যৌনতার যে-স্পন্দমান প্রকাশ তিনি ঘটিয়েছেন, সেটা রবীন্দ্রনাথের প্রকাশ্য উদ্দেশ্য ছিল কিনা সন্দেহ। এছাড়া (সম্ভবত নজরুলের) একটি কবিতা তিনি শুনিয়েছিলেন, যাতে মুহূর্তে বোঝা যেত, নারীকে কেন ‘লীলাময়ী’ বলা হয় (সে-কবিতার শুরুতে ‘সখি, কোস্ নে লো কোস্ নে, সে বড় জ্বালায়’— এইধরনের একটা লাইন ছিল।)
কোন্ কবিতা নিজের কাছে প্রাঞ্জল, সে-সম্বন্ধে আবৃত্তিকারের নিশ্চিতি যেমন প্রয়োজন; তেমনই সেটির সংযোগসাধ্যতার কথাও তাঁকে ভাবতে হয়: অর্থাৎ একটা কবিতা শ্রোতারা ‘শুনে’ বুঝবেন কিনা, সেই বিচারটা সর্বদা মাথায় রাখতে হয়।
তিলভাণ্ড সর্বনাশ, অতিদৈব বিশ্বের দেউল
প্রার্থনা বা অভিযোগ বৃথা;
প্রতিজ্ঞাবিস্মৃত কল্কি, কিংবদন্তী শিবের ত্রিশূল
শূন্যকুম্ভ পুরাণ, সংহিতা।
পড়ে বুঝতে সমস্যা না-হলেও কানে শুনে তৎক্ষণে এর অর্থোদ্ধার করা অসম্ভব। অতএব সুধীন্দ্রনাথের এমন কবিতা আবৃত্তি না-করাটাই নিরাপদ। ‘শাশ্বতী’, ‘উটপাখি’, প্রভৃতির কথা ছেড়ে দিলেও এর চাইতে ঢের বেশি আবৃত্তিযোগ্য হতে পারে তাঁর ‘উন্মার্গ’:
অনাত্মীয়ের মুখ চেয়ে আছি
সেদিন থেকে।
উঞ্ছ কুড়িয়ে অগত্যা বাঁচি
নিরুপার্জন নির্বিবেকে।
দৃষ্টির সীমা মাপে হিমগিরি
পর্ণকুটিরে দুর্যোগে ফিরি
সৈকতে এসে বসি কদাচিৎ
অমার উপক্রমে।
মহার্ণবের সামসঙ্গীত
হয়ত বা শুনি শুক্তির মাধ্যমে।
একটা বিশেষ বয়সে এসে প্রায় সকলেই এ-ধরনের একটা অনুভবের সামিল হন; অনেকে কিছু আগে থেকেই এ-অনুভূতির আঁচ পান। সেইখানে বলতে পারি এ-কবিতা আবৃত্তিযোগ্য, কারণ অনুভবটা বহুজনীন। কিন্তু এমন সব কবিও আছেন, যাঁরা কেবল নিজের তৃপ্তির জন্য আপনমনে কথা সাজান। যেহেতু তাঁদের উদ্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি নেই, অতএব তাঁদের কথার সংযোগসাধ্যতা তাঁরা নিজেরাই খোয়ান। আত্মনিমজ্জিত কবিদের কবিতা সেই অর্থে সঙ্কীর্ণ কবিতা। পাঠকের সঙ্গে সাযুজ্য চাইলে একটা পা নিজের গণ্ডির বাইরে রেখে কবিতা লিখতে হয়। যেহেতু তাঁদের কাব্য একান্তই নিজস্ব ও ব্যক্তিগত বোধের কুঠুরিতে আবদ্ধ, অতএব তা আবৃত্তিকারেরও নাগালের বাইরে বলে সে-সব কবিতার ব্যাখ্যান চিরকাল ভুলই হবে, এবং কবিতা নির্বাচনের ত্রুটি ছাড়া অন্য কোনো খাতেই আবৃত্তিকারকে দায়ী করা যাবে না। আবৃত্তিকারের কাব্যব্যাখ্যানের স্বাধীনতা যেমন বিশাল, তেমনি কাব্যনির্বাচনের সীমানাও সঙ্কীর্ণ। তাঁকেও হিসেব করেই পথ চলতে হবে।
রোটারি ক্লাবের সেই সভায় সম্ভবত এই সমস্ত প্রসঙ্গটাই আরও বিশদ ও রীতিসিদ্ধভাবে আলোচিত হয়ে গেছে; এবং এ-বক্তব্যের মধ্যে যেসব ফাঁকফোকর রয়ে গেল, সেসব হয়ত সেদিনের বক্তারাই ভরিয়ে গেছেন। তবু, তর্কিত বিষয় কানে শুনে যতটা আঁচ করা যায়, পড়লে পরে তার চাইতে বেশি বোধগম্য হয়। নিদেনপক্ষে পুরো ব্যাপারটা আবার পড়ে খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব তো হয়ই। সেই কথা ভেবেই কথাগুলো এখানে রাখা।