Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ওদের কার্নিভাল, ওদের নিউ ইয়ার

‘একটা চা বলে দাও না গো— বেলা বারোটা বাজতে চলল, এখনও সাইধ হয়নি’— মরচে ধরা হ্যান্ডেলের থেকে সরিয়ে মন্টু সাহার শীর্ণ হাতের আঙুলগুলো ইঙ্গিত করে মালদা শহরের প্রাণকেন্দ্র নেতাজি মোড়ের চায়ের দোকানের কাচের বয়ামের দিকে। কার্নিভাল আর নিউ ইয়ারের তুমুল উদযাপনের ফাঁকে নিঃশব্দে আরও অসহায়, আরও একা হয়ে পড়তে থাকেন এই শহরের রিকশাচালকেরা। ওদের কোনও কার্নিভাল নেই, কোনও নিউ ইয়ার নেই।

পরিসংখ্যান বলছে, একসময় যে মালদা শহরে রিকশার দাপটের খ্যাতি ছিল রাজ্যজুড়ে, সেখানে রিকশার সংখ্যা আজ একশোরও কম। শহরের পাড়ার মোড়ে মোড়ে রিকশা স্ট্যান্ডগুলিও টিকে আছে নাম কা ওয়াস্তে। ২০১৪-১৫ থেকে টোটো আসার পর বেশি সময় নেয়নি এই শতাব্দীপ্রাচীন যানকে শহরের বুকে ফসিল করে দিতে।

সুকান্ত মোড়ের প্রবীণ রিকশাচালক অশোক মণ্ডল বলেন, ‘টোটো আসার পর আমাদের স্ট্যান্ডের অনেকে রিকশা বেচে ধারদেনা করে টোটো নিল, অনেকে দিল্লিতে ঠিকাদারের কাছে দাদন খাটতে চলে গেল, অনেকে এখানেই রাজমিস্ত্রির যোগাড়ে হয়ে কামাইধান্দা করতে লাগল। আর আমার মত যারা কিছুই পারল না, তারাই এখনও মায়া আঁকড়ে পড়ে আছি।’

মায়া হোক, স্মৃতি হোক, বা নস্টালজিয়া— রিকশা থেকেই যায়। রিকশার কনভয় তৈরি করে তাতে মাইক বেঁধে ভোটের প্রচারে বেরিয়েছেন নেতা, রথবাড়ি মোড়ে নামা গ্রাম থেকে আসা রোগীদের মকদুমপুর বা সিঙ্গাতলায় ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাওয়ার জন্য মারামারি বেঁধেছে রিকশাওয়ালাদের মধ্যে, রিকশার হুড ফেলে মধ্যদুপুরের গোপন প্রেম, শেয়ারের প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে ভাড়া ভাগাভাগি করে রিকশা ছুটছে স্টেশনে, সিনেমাহলের নাইট শো ভাঙার পর নির্জন পথে রিকশাওয়ালার সঙ্গে সিনেমার গল্প করতে করতে বাড়ি ফেরা, প্রাইমারি বা হাইস্কুলের সেইসব রিকশাকাকুরা… জলরঙে আঁকা ছবির মত হারিয়ে গেছে এই শহর থেকে, থেকে গেছে শুধু প্রবীণ বা মধ্যবয়সীদের স্মৃতিতে। তাঁদের মনে পড়বে, ১৯৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দিলীপকুমার-বৈজয়ন্তীমালা অভিনীত ‘নয়া দৌড়’ সিনেমায় পরিচালক মোটরবাস আর টাঙ্গার অসম লড়াইতে টাঙ্গাকে জিতিয়ে দিয়েছিলেন— কিন্তু টোটোর সঙ্গে দৌড়ে রিকশা জিততে পারেনি। রিকশা টিকে গেছে চন্দ্রবিন্দুর গানে; বা স্বপ্নময় চক্রবর্তী, অভিজিৎ সেন, রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের গল্প-উপন্যাসে।

Advertisement

পুরাতন মালদার ছাতিয়ান মোড় থেকে রিকশা নিয়ে রোজ শহরে আসেন নিয়ামত শেখ। রিকশা নিজের বলে সাকুল্যে দিনে ১০০ টাকা রোজগার হলেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। নিজের মনেই বলেন, ‘আগে রথবাড়ি ফ্লাইওভারের নিচ থেকে সকাল সাতটায় বিশ-তিরিশ টাকা জমা দিয়ে রিকশা নিতাম। সন্ধে সাতটার মধ্যে রিকশা জমা দিয়ে দিতে হত। তখন রাত সাতটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত রাতের ট্রিপে ওই রিকশা চালাত অন্য লোক। অমৃতি, মিলকি, নিয়ামতপুর, পুখুরিয়া, এমনকি মথুরাপুর থেকে বাস ধরে সন্ধ্যায় শহরে এসে সারারাত রিকশা চালিয়ে পরদিন ভোরবেলায় বাড়ি ফিরে যেত তারা। এই রিকশা চালিয়েই আমার বাড়ি বানানো, সংসার চালানো, দুটা বেটির বিয়ে। আজ সারাদিনে বৃন্দাবনী মাঠ থেকে দুটা প্যাসেঞ্জার পেতেই দিন কাবার। ফাঁকা গাড়ি নিয়েই ফিরতে হবে।’

প্যাসেঞ্জারের খোঁজে হন্যে হয়ে কার্নিভালের রাত কেটে যায়— রোজগারের সামান্য টাকা নিজের পেট ভরতেই খরচা হয়ে যায়। ওরা অনেকে চাদরমুড়ি দিয়ে রিকশাতেই রাত কাটিয়ে দেন, বাড়ি ফেরেন না। সংসারের হাঁ-মুখে যেদিন খুদকুঁড়ো জোটাতে পারেন, সেদিন একটু নিশ্চিন্ত। পাঁচ টাকার মুড়ি, চেয়ে আনা কাঁচালঙ্কা আর জল; কপাল খুব ভাল থাকলে একটা ঠান্ডা তেলেভাজা— এই দিয়েই রাতের খাবার। বছরশেষের রাত পেরিয়ে নতুন সকাল আসে। ভাগ্য ভাল থাকলে স্টেশনে দু-একটা গৌড়ের প্যাসেঞ্জার জোটে। ক্লান্ত পায়ে প্যাডেল করতে করতেই চোখে জল এসে যায় হঠাৎ… সে জল ঠান্ডা হাওয়া আর কুয়াশার ঝাপটায়, না নিভে যাওয়া বিড়ি জ্বালানোর ধোঁয়ায়; ঠিক বুঝতে পারে না ওরা।

চিত্র: গুগল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 + 17 =

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আমার স্মৃতিতে ঋত্বিককুমার ঘটক

দুটো‌ জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম তাঁর।‌ এক, তিনি কথা বলার সময় আত্মমগ্ন‌ থাকতেন। কারও দিকে‌ তাকিয়ে‌ কথা বলতেন না। তাকাতেন‌ হয় সুদূরে, আর নয়তো‌ চোখ বুজে‌ কথা বলতেন। আর দ্বিতীয় যা, তা হল‌ ঋত্বিকের চোখ। এত উজ্জ্বল আর‌ মরমী, এক-ই সঙ্গে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত আর লুব্ধক নক্ষত্রের মতো দীপ্ত, তা আর কারও মধ্যে দেখিনি। সত্যজিৎ-মৃণালের মধ্যেও না, যদিও ঘটনাচক্রে ওই দু’জনের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল অনেক বেশি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঋত্বিক ঘটক ও বাংলাদেশ

ঋত্বিক ঘটকের জীবনের প্রথম বাইশ বছর (১৯২৫-১৯৪৭) কেটেছে মূলত পূর্ব-বাংলায়, যা এখনকার বাংলাদেশ। তাঁর জন্ম ঢাকার ২,ঋষিকেশ দাস রোডের ঝুলন বাড়িতে। ১৯৪৭, অর্থাৎ দেশভাগ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি মূলত পূর্ব-বাংলায় কাটান। আমরা দেখব, পূর্ব-বাংলা যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, সে-দেশ, সে-ভূমির প্রভাব তদনুরূপ ঋত্বিকেরও পড়েছিল তাঁর চলচ্চিত্রে।

Read More »
মণিকর্ণিকা রায়

অনুগল্প: অর্জন

অসহায় বৃদ্ধের খাওয়া হয়ে গেলে মাঝেমাঝে গল্পও করত ওঁর সাথে। আদিত্য লক্ষ্য করেছিল এই ব্যাপারটা যেন তার মনে একটা বদল আনছে— যেন রোজ তার শরীর-মন জুড়ে সঞ্চালিত হচ্ছে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি। যেন সে সত্যিই মানুষ হয়ে উঠছে।

Read More »
মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনানন্দ দাশের সময়চেতনা: পুরাণ, প্রকৃতি ও আধুনিক নিঃসঙ্গতার নন্দনতত্ত্ব

পৌরাণিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিগত সময়চেতনা তাঁকে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে এক স্থায়ী ও ব্যতিক্রমী মহাকবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শিল্পকর্ম আমাদের শেখায়— দ্রুত ধাবমান জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে চলতে, নীরবতার গভীরে কান পাততে এবং প্রতিটি ক্ষণিকের মাঝে অনন্তের ইশারাকে খুঁজে পেতে। তাঁর সাহিত্য ভবিষ্যতের প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের জন্য আধুনিকতার এক অমূল্য পাঠ হয়ে থাকবে, যা মানুষের জীবনকে শিল্প ও প্রকৃতির একাত্মতায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং প্রমাণ করে দেয়— কাব্যই চূড়ান্ত আশ্রয়, যখন সমস্ত পথ ফুরিয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে?

Read More »