‘একটা চা বলে দাও না গো— বেলা বারোটা বাজতে চলল, এখনও সাইধ হয়নি’— মরচে ধরা হ্যান্ডেলের থেকে সরিয়ে মন্টু সাহার শীর্ণ হাতের আঙুলগুলো ইঙ্গিত করে মালদা শহরের প্রাণকেন্দ্র নেতাজি মোড়ের চায়ের দোকানের কাচের বয়ামের দিকে। কার্নিভাল আর নিউ ইয়ারের তুমুল উদযাপনের ফাঁকে নিঃশব্দে আরও অসহায়, আরও একা হয়ে পড়তে থাকেন এই শহরের রিকশাচালকেরা। ওদের কোনও কার্নিভাল নেই, কোনও নিউ ইয়ার নেই।
পরিসংখ্যান বলছে, একসময় যে মালদা শহরে রিকশার দাপটের খ্যাতি ছিল রাজ্যজুড়ে, সেখানে রিকশার সংখ্যা আজ একশোরও কম। শহরের পাড়ার মোড়ে মোড়ে রিকশা স্ট্যান্ডগুলিও টিকে আছে নাম কা ওয়াস্তে। ২০১৪-১৫ থেকে টোটো আসার পর বেশি সময় নেয়নি এই শতাব্দীপ্রাচীন যানকে শহরের বুকে ফসিল করে দিতে।
সুকান্ত মোড়ের প্রবীণ রিকশাচালক অশোক মণ্ডল বলেন, ‘টোটো আসার পর আমাদের স্ট্যান্ডের অনেকে রিকশা বেচে ধারদেনা করে টোটো নিল, অনেকে দিল্লিতে ঠিকাদারের কাছে দাদন খাটতে চলে গেল, অনেকে এখানেই রাজমিস্ত্রির যোগাড়ে হয়ে কামাইধান্দা করতে লাগল। আর আমার মত যারা কিছুই পারল না, তারাই এখনও মায়া আঁকড়ে পড়ে আছি।’
মায়া হোক, স্মৃতি হোক, বা নস্টালজিয়া— রিকশা থেকেই যায়। রিকশার কনভয় তৈরি করে তাতে মাইক বেঁধে ভোটের প্রচারে বেরিয়েছেন নেতা, রথবাড়ি মোড়ে নামা গ্রাম থেকে আসা রোগীদের মকদুমপুর বা সিঙ্গাতলায় ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাওয়ার জন্য মারামারি বেঁধেছে রিকশাওয়ালাদের মধ্যে, রিকশার হুড ফেলে মধ্যদুপুরের গোপন প্রেম, শেয়ারের প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে ভাড়া ভাগাভাগি করে রিকশা ছুটছে স্টেশনে, সিনেমাহলের নাইট শো ভাঙার পর নির্জন পথে রিকশাওয়ালার সঙ্গে সিনেমার গল্প করতে করতে বাড়ি ফেরা, প্রাইমারি বা হাইস্কুলের সেইসব রিকশাকাকুরা… জলরঙে আঁকা ছবির মত হারিয়ে গেছে এই শহর থেকে, থেকে গেছে শুধু প্রবীণ বা মধ্যবয়সীদের স্মৃতিতে। তাঁদের মনে পড়বে, ১৯৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দিলীপকুমার-বৈজয়ন্তীমালা অভিনীত ‘নয়া দৌড়’ সিনেমায় পরিচালক মোটরবাস আর টাঙ্গার অসম লড়াইতে টাঙ্গাকে জিতিয়ে দিয়েছিলেন— কিন্তু টোটোর সঙ্গে দৌড়ে রিকশা জিততে পারেনি। রিকশা টিকে গেছে চন্দ্রবিন্দুর গানে; বা স্বপ্নময় চক্রবর্তী, অভিজিৎ সেন, রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের গল্প-উপন্যাসে।
পুরাতন মালদার ছাতিয়ান মোড় থেকে রিকশা নিয়ে রোজ শহরে আসেন নিয়ামত শেখ। রিকশা নিজের বলে সাকুল্যে দিনে ১০০ টাকা রোজগার হলেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। নিজের মনেই বলেন, ‘আগে রথবাড়ি ফ্লাইওভারের নিচ থেকে সকাল সাতটায় বিশ-তিরিশ টাকা জমা দিয়ে রিকশা নিতাম। সন্ধে সাতটার মধ্যে রিকশা জমা দিয়ে দিতে হত। তখন রাত সাতটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত রাতের ট্রিপে ওই রিকশা চালাত অন্য লোক। অমৃতি, মিলকি, নিয়ামতপুর, পুখুরিয়া, এমনকি মথুরাপুর থেকে বাস ধরে সন্ধ্যায় শহরে এসে সারারাত রিকশা চালিয়ে পরদিন ভোরবেলায় বাড়ি ফিরে যেত তারা। এই রিকশা চালিয়েই আমার বাড়ি বানানো, সংসার চালানো, দুটা বেটির বিয়ে। আজ সারাদিনে বৃন্দাবনী মাঠ থেকে দুটা প্যাসেঞ্জার পেতেই দিন কাবার। ফাঁকা গাড়ি নিয়েই ফিরতে হবে।’
প্যাসেঞ্জারের খোঁজে হন্যে হয়ে কার্নিভালের রাত কেটে যায়— রোজগারের সামান্য টাকা নিজের পেট ভরতেই খরচা হয়ে যায়। ওরা অনেকে চাদরমুড়ি দিয়ে রিকশাতেই রাত কাটিয়ে দেন, বাড়ি ফেরেন না। সংসারের হাঁ-মুখে যেদিন খুদকুঁড়ো জোটাতে পারেন, সেদিন একটু নিশ্চিন্ত। পাঁচ টাকার মুড়ি, চেয়ে আনা কাঁচালঙ্কা আর জল; কপাল খুব ভাল থাকলে একটা ঠান্ডা তেলেভাজা— এই দিয়েই রাতের খাবার। বছরশেষের রাত পেরিয়ে নতুন সকাল আসে। ভাগ্য ভাল থাকলে স্টেশনে দু-একটা গৌড়ের প্যাসেঞ্জার জোটে। ক্লান্ত পায়ে প্যাডেল করতে করতেই চোখে জল এসে যায় হঠাৎ… সে জল ঠান্ডা হাওয়া আর কুয়াশার ঝাপটায়, না নিভে যাওয়া বিড়ি জ্বালানোর ধোঁয়ায়; ঠিক বুঝতে পারে না ওরা।