‘‘…ভেবেছি এই আমার জামতল্লীর গম্ভীরার দিগবিজয়। মনে হয়েছে এই আমার পুড়াটুলির দিগবিজয়। কল্পনা করেছি এই আমার মালদহের দিগবিজয়। আমার চুনিয়া নুনিয়া ভাইদের দিগবিজয়। ছেলেবেলায় অভিজ্ঞতার কেন্দ্রস্থলে ছিল মালদহের গম্ভীরা। সেই গম্ভীরা বিষয়ক বইয়ের সঙ্গে আমার নাম জড়ানো। সেই বই প্রকাশিত হলো লন্ডনে। আর সেই বই দেখেছি নিজের চোখে নিউইয়র্ক প্যারিস বার্লিন লন্ডনের সেরা সেরা গ্রন্থাগারে। এর চেয়ে বেশি আনন্দ জীবনে আর কোন কাজ থেকে পেয়েছি কিনা সন্দেহ!’’ [বিনয় সরকারের বৈঠকে, প্রথম পর্ব]
কলকাতার বালিগঞ্জের ইন্দ্রজাল ভবনে প্রত্যেক বছর জাদুসম্রাট পি. সি. সরকার-এর জন্মদিন ২৩ ফেব্রুয়ারিতে সারা বাংলা থেকে প্রচুর মাদারি জড়ো হতেন একটা সময়ে। দেখাতেন নিজেদের উদ্ভাবিত জাদুর খেলা— সে এক রীতিমত উৎসব। বলতেন, এ হল জাদুসম্রাটের জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। শিল্পকে যদি পূজার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় তাহলেই সম্ভব এইরকম একটি বর্ণময় উৎসবের আনন্দে অবগাহন।
এককালে মালদার প্রধান উৎসব ছিল গম্ভীরা। যেখানে পূজা ও লোকনাটক দুইই অনুষ্ঠিত হত। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষত বরিন্দ আর দিয়ারায় এখনও ছড়িয়ে রয়েছে গম্ভীরা উৎসবের নানান ইতিহাস। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আজ জেলার বহু গম্ভীরা উৎসব অবলুপ্তির পথে। এখনও সামান্য যে কয়টি গম্ভীরা উৎসব স্বমহিমায় বিরাজমান, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, মালদহ শহরের বুকে জামতলি, কালীতলা ও বর্মনপাড়ার গম্ভীরা উৎসব। আধুনিক সময়, দর্শক-শ্রোতার চাহিদা সর্বোপরি করোনা অতিমারীর প্রভাব অনেকাংশেই পাল্টে দিয়েছে গম্ভীরার উপজীব্য বিষয়কে, তবে বদলায়নি গম্ভীরার প্রকাশভঙ্গি। এই গম্ভীরা উৎসবগুলির সঙ্গে মিশে রয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
প্রাচীনকাল থেকেই মালদা শহরের জামতলি, কালীতলা ও বর্মনপাড়ায় প্রতি বছর ১৬ বৈশাখ গম্ভীরা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। চৈত্র হয়ে বৈশাখ পেরিয়ে একেবারে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত চলে এই উৎসব— যতক্ষণ না নতুন ফসলের কাজ আরম্ভ হয়। কৃষিনির্ভর সমাজের বিনোদন সংস্কৃতির সেই ধারা বজায় রেখেই এ বছরেও গম্ভীরা উৎসবের আয়োজন করলেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। বই, বস্ত্র বা শিল্প মেলার পাশে দুয়োরানির মত নয়, একক মেজাজে শুধু গম্ভীরার জন্যই গম্ভীরার নিমন্ত্রণ! এর খবর হয়তো আমরা অনেকেই জানি না।
করোনা অতিমারীর জন্য গত দুই বছর এই ঐতিহাসিক গম্ভীরা উৎসব বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। বর্তমানে তুলনামূলক স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পূর্বোক্ত নির্দিষ্ট দিনে শহরজুড়ে গম্ভীরা উৎসবে মাতলেন শিল্পী থেকে দর্শকেরা। উৎসবের পুণ্য সূচনা হয় গম্ভীরা পূজোর মধ্য দিয়ে। নিষ্ঠাভরে, রীতিনীতি মেনে, পূজার অনুপুঙ্খ নিয়ম পালন করে আবাহন করা হয় গম্ভীরার আরাধ্য দেবতা শিবকে। উৎসবের দ্বিতীয় পর্বে জেলার বিভিন্ন প্রান্তের গম্ভীরা শিল্পীরা তাঁদের শিল্পকে তুলে ধরেন শহরের সমস্ত গম্ভীরা তলায়। আবালবৃদ্ধবণিতার মধ্যে এই গম্ভীরা দেখার তথা উপভোগের উন্মাদনা ছিলো চোখে পড়ার মত। শিল্পীরা গম্ভীরার মধ্যে দিয়ে প্রাচীন লোককথা ও পুরাণের কাহিনিকে ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি গম্ভীরার বিখ্যাত বুড়াবুড়ি নাচ, টাপা নাচ, সারস নাচ, মুখা নাচ, মশান নাচ, কালী নাচ থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুই দেখানো হয় এই উৎসবে। গম্ভীরা উৎসবের মঞ্চে সমাজ সচেতনতার বার্তা নিয়ে গম্ভীরা গানও পরিবেশিত হয়— এটা হয় যুগের চাহিদা মেনেই।
গম্ভীরা যাঁর উদ্যোগে সর্বভারতীয় খ্যাতি পায়, তিনি বিংশ শতাব্দীর বাঙালি বৌদ্ধিক মননের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি বিনয়কুমার সরকার। মালদার এই ভূমিপুত্র ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ‘জাতীয় শিক্ষা সমিতি’ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে এক গম্ভীরা আন্দোলনের জন্ম দেন। জাতীয়তাবাদী ভাবনার বিকাশে এই গণ আন্দোলন চলেছিল ১৯১৪ সাল পর্যন্ত। বিনয় সরকার ও তাঁর সহযোদ্ধা বলদেবানন্দ গিরি, বিপিনবিহারী ঘোষ, রাধেশচন্দ্র শেঠ প্রমুখের মাধ্যমে বিস্তৃত এই আন্দোলনের সোনার ফসল হরিদাস পালিতের লেখা ‘আদ্যের গম্ভীরা’। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের এই রচনাই সারা ভারতবর্ষকে লোকসংস্কৃতির এই বিশেষ ধারার সঙ্গে পরিচিত করায়।
তাঁর বিখ্যাত বই ‘বিনয় সরকারের বৈঠকে’ তিনি অকপটে বলছেন— ‘‘…এ কালে গণতন্ত্র কপচাই। সেই গণতন্ত্রই জীবনে প্রথম দেখেছি জামতল্লীর গম্ভীরার শাসন কায়দায়। আজকাল সমাজতন্ত্রও কপচাই। সেই সমাজতন্ত্রের দম্ভলও জীবনে প্রবেশ করেছিল চুনিয়া-নুনিয়া-পাঁঝরা-কাঁসারি জাতীয় ভাইদের সঙ্গে নাচানাচি আর লাফালাফির আবেষ্টনে।’’
পরবর্তীতে ১৯২৫ সালে যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিচ্ছেন, তখনও জোর গলায় সওয়াল করে গেছেন গম্ভীরার এই সর্বতোমুখিতা নিয়ে। ১৯১৭ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত বই ‘The Folk Element in Hindu Culture’ প্রকাশিত হচ্ছে লন্ডনের লংম্যানস থেকে, যার আধার এই জামতলির গম্ভীরা। তাঁর শেষ কর্মস্থল ছিল আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেই মারা যান ১৯৪৯-এ। কিন্তু মালদার লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি থেকে কোনওদিন বেরোতে চাননি। গর্ব করে বলতেন, এপ্রিল-মে মাসে জামতল্লীর গম্ভীরা আমার বুকের মধ্যে শুনতে পাবে।
খুব সূক্ষ্মভাবে এই গম্ভীরা উৎসব উঠে এসেছে মূলধারার বাংলা সাহিত্যেও। বিজন ভট্টাচার্যের বিখ্যাত ‘দেবীগর্জন’ নাটকের জোতদার নিধনের দৃশ্যে কালীনাচের ব্যবহারের সাক্ষী আছে বাংলা রঙ্গমঞ্চ। কবি ও কথাসাহিত্যিক অমিত গুপ্ত তাঁর স্বল্প আলোচিত গল্পগ্রন্থ ‘ভাঙাচোরা মানুষ ও সোজা জীবনের বৃত্তান্ত’-তে শুনিয়েছিলেন সেই গম্ভীরা শিল্পীর গল্প, যে সারসনাচের শেষে কিছুতেই মুখোশটা খুলতে পারছে না। অবশেষে সে উড়ে যায় এক জাদুবাস্তবতার জগতে। অনেকে এই গল্পের আলোচনায় ফরাসি মূকাভিনেতা মার্সাল মার্সোর একটি বহুখ্যাত অভিনয়ের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজতেন— কিন্তু এর শিকড় নিহিত এই গম্ভীরা উৎসবেই।
বাঙালি নিম্নবর্গের সেই জনসংস্কৃতি, যা প্রতিমুহূর্তে ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠতে চায়, তার শৈল্পিক প্রকাশ হিসাবে গম্ভীরা এবং মালদাকে কোনওভাবে একসূত্রে বেঁধে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। তাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল এই জামতল্লির গম্ভীরা। বর্তমান সময়ে যখন গম্ভীরা হারিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকে সরব হচ্ছেন, সেই একই সময়ে দাঁড়িয়ে জামতলি ও কালিতলার মত জায়গায় গম্ভীরা উৎসবে প্রচুর জনসমাগম এক বিপরীত সত্যের ইঙ্গিত দেয়। তাহলে কি গম্ভীরা গানের বদলে সাধারণ জনমানসে স্থায়ী আসন পাচ্ছে গম্ভীরা উৎসব? সময়ের চাকা কি উল্টো দিকে ঘুরছে? উত্তর কিন্তু সময়েরই হাতে।
এখন এই উৎসবে যাঁরা গম্ভীরা পরিবেশন করেন, তাঁদের অনেকেই পেশাদার। সরকারি ভাতার জন্য সারাবছর ধরে নানা সময়ে তাঁদেরকে প্রচারমূলক গম্ভীরা গান করতে হয়। কিন্তু তারাও আসেন ভালবাসার টানে। তাদের অনেকের বয়স কুড়ি থেকে তিরিশের মধ্যে… পরনে জিনস, গায়ে ট্যাটু, হাতে স্মার্টফোন। বিনোদনের এই বিপ্লবের যুগেও কারও নির্দেশ বা ফরমায়েশে কোনও বাঁধা গতের মনোরঞ্জন নয়; নয় বিনা প্রশ্নে তথাকথিত ‘আধুনিকতা’-কে মেনে নেওয়া— মধ্যরাতে ধীরলয়ে বেজে চলা ঢাকের অদ্ভুত বোলে, করতালের হঠাৎ ঝংকারে, ব্যাটারির নিভু নিভু অল্প পাওয়ারের আলোয় তাঁদের নিবেদন সেই অনন্ত মহাসময়ের কাছে— যা পৃথিবীর সব শিল্পীকেই তাঁর শিল্পকে প্রমাণ করার অন্তত একটা শেষ সুযোগ দেয়।
অনেক নতুন তথ্য জানা গেল।খুব ভালো ও মননশীল বিশ্লেষণ।লেখককে অভিনন্দন।
তথ্যপূর্ণ ও বিশ্লেষণধর্মী
খুব সুন্দর উপস্থাপনা,প্রায় হারিয়ে যাওয়া বাংলার লোক সংস্কৃতির অন্তর্গত গম্ভীরা গান ও বিনয় সরকার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম।লেখক তপোমন ঘোষ কে অভিবাদন।
Interesting and informative article.
অনেঅ অজানা তথ্য উঠে এসেছে।লেখককে ধন্যবাদ।