প্রাক্-কথন
পৃথিবীতে রয়েছে নানা দেশ, নানা জাতি, নানা ধর্মাবলম্বী মানুষ। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই তারা বিচিত্রভাবে উৎসব উদযাপন করে। উৎসব ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ, দু-ধরনেরই হয়। বুদ্ধজয়ন্তী, ঈদ-উল ফিতর, এক্সমাস ডে যেমন ধর্মীয় উৎসব, তেমনই নববর্ষ, বিভিন্ন মনীষীর জন্মদিন পালন ইত্যাদি সামাজিক ও ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। কোনও উৎসব সাধারণ ও স্বল্পস্থায়ী, আবার দু-একটি ব্যাপক আর দীর্ঘস্থায়ী। সব দেশে, সব কালে। সব জাতি, দেশ বা সব সম্প্রদায়ের মধ্যে। বাঙালির-ও তাই রয়েছে নিজস্ব বেশ কিছু উৎসব। বাঙালির মধ্যে নানা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাস। তাই ধর্মীয় উৎসব-ও নানারকম। মুসলিমদের দীর্ঘস্থায়ী যাপন বাৎসরিক ঈদ্ উল ফিতর নিয়ে, খ্রিস্টানদের এক্সমাস বা বড়দিন নিয়ে, আর হিন্দুদের দুর্গাপুজোকে ঘিরে। এখানে আমরা দুর্গোৎসবের কথা বলব।
দুটি প্রচলিত ধারণাকে প্রথমেই সংশোধন করে নিতে চাই। এক, দুর্গাপুজোকে শারদীয় উৎসব বলা হয়। সর্বাংশে ঠিক নয় কথাটি। শারদ মাসদুটি হল ভাদ্র ও আশ্বিন। দুর্গাপূজা কখনও আশ্বিনে, আবার কখনও কার্তিক মাসে হয়। কার্তিক মাস হেমন্ত ঋতুর আওতায়। দুর্গাপূজা যেবছর আশ্বিন মাসে হয়, পরের বছর অবধারিতভাবে কার্তিকে হবে, তিথি-অনুযায়ী। অতএব একে শারদীয় পুজো বলব কিনা, বিবেচনার বিষয় আছে।
দ্বিতীয়ত, দুর্গাপূজা বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব আখ্যা পেয়ে আসছে। এটা ভুল, কেননা বাঙালির মধ্যে যেহেতু মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, এবং তারা দুর্গাপূজায় সহযোগিতা করলেও সরাসরি পুজো করেন না, তাই দুর্গাপূজা নয়, ঈদকেই বাঙালির সর্বাধিক যাপিত উৎসব বলা উচিত। তবে হ্যাঁ। যাপিত উৎসব রূপে দুর্গোৎসব প্রতিমার নান্দনিকতা, আলোর রোশনাই, প্যান্ডেলের অভিনবত্ব আর শোভনতায় অনন্য, একথা মানতেই হবে। আরও কৌতূহলী বিষয়, দুর্গামূর্তি গড়া, এমনকি এই দেবতার পুজো করতেও মুসলমান পুরোহিতকে দেখা গেছে। স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং এক মুসলমান মেয়েকে দেবী জ্ঞানে কুমারীপুজো করেছিলেন।
দুর্গাপূজা: বাংলায়
কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে, বাংলাদেশে সর্বপ্রথম দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান করেন তাহেরপুরের (বর্তমানে৷ রাজশাহী জেলান্তর্গত) রাজা কংসনারায়ণ। সময়কাল সতেরো দশক। তথ্যটি বিবেচনাসাপেক্ষ।
এখানে একটি ধন্দ আছে। দুর্গাপুজো নিয়ে বাংলা ভাষায় একাধিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে চতুর্দশ শতক থেকেই। বাচস্পতি মিশ্রের ‘কৃতচিন্তামণি’ লেখা হয় একাদশ শতকে। চতুর্দশ শতকেই আমরা শূলপাণি-রচিত তিনটি গ্রন্থ পাচ্ছি,– ‘দুর্গোৎসব বিবেক’, ‘দুর্গোৎসব প্রয়োগবিবেক’ এবং ‘বাসন্তী বিবেক’। পঞ্চদশ শতকের বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি লিখেছেন ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের ধর্মমঙ্গল কাব্যে দুর্গাপুজোর যে ব্যাপকতা, তাতে মনে হয়, তাঁর আমলে তো বটেই, এমনকি তার আগে থেকেই বাংলায় দুর্গাপূজার জনপ্রিয়তা ছিল।
মধ্যযুগের একাধিক কাব্যে দুর্গাপুজোর উল্লেখ আছে। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ফুল্লরার বারোমাস্যা অংশে পাই ‘আশ্বিনে অম্বিকা পূজা প্রতি ঘরে ঘরে’। কৃত্তিবাসের রামায়ণেও দুর্গার অকালবোধনের বর্ণনা আছে। তাতে মনে হয়, বাংলায় এ-পুজোর জনপ্রিয়তা। পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপূজার ইতিহাসে কৃষ্ণনগর, সিদ্ধেশ্বরী, নোয়াখালি, শোভাবাজার, বাগেরহাটে বহুযুগ থেকেই চলে আসছে দুর্গারাধনা। সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বাইরে বেরোবার সময় দুর্গাকে স্মরণ করে ঘর থেকে উঠোনে পা ফেলে। এটাও দুর্গার জনপ্রিয়তার প্রমাণ।
মুকুন্দরামের কাব্যে এই যে দুর্গারাধনার উল্লেখ, তা কিন্তু উপনিবেশবাদী ধারণার সঙ্গে মেলে না। কবিকঙ্কণ আরও লিখেছেন, ‘আশ্বিনে অম্বিকা পূজা করে জনে জনে,/ ছাগল মহিষ মেষ দিয়া বলিদানে।/ উত্তম বসনে বেশ করয়ে বনিতা,/ অভাগী ফুল্লরা করে উদরের চিন্তা’! পুজোয় নববস্ত্র কেনার তথ্যও মিলছে এখানে। এই চিত্র আজ-ও সমানে চলছে। দুর্গাপুজোয় অপু-দুর্গা বা ঈদে মায়মুন, কাসু রাসু ওই উদরের চিন্তা নিয়েই কাটায়।
আশ্চর্যের কথা, বাল্মিকী-রামায়ণকে ভিত্তি করে মোট আটত্রিশটি ভারতীয় ভাষায় রামায়ণ তার কাহিনি গ্রহণ করলেও কেবল কৃত্তিবাসের লেখাতেই রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার কথা পাই, অন্যত্র নয়। অথচ মূল রামায়ণের পুথি পাওয়া গেছে ২০২২টি! অষ্টম শতকে চালুক্য রাজবংশে এর প্রচলন ছিল, আর ১৫১০ ও ১৬১০-এ যথাক্রমে কুচবিহার ও বরিষা সাবর্ণ চৌধুরীদের বাড়িতে দুর্গাপূজার প্রমাণ আছে। বারোয়ারি পূজার প্রথম নিদর্শন মেলে ১৭৯০-এ। সেটা ছিল হুগলীর গুপ্তিপাড়ায়।
রাজা কংসনারায়ণের পূজা আজ পর্যন্ত উচ্চারিত হয়ে আসছে। একটি প্রামাণ্য তথ্য আছে এ নিয়ে। এখানকার রাজবাড়ির গোবিন্দমন্দিরে যে শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে, যেখানে দুর্গাপূজার প্রচলন সন-তারিখ সহ খোদিত।
একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
একবার, বোধ হয় ১৯৯৮-তে, দুর্গাপূজার সময় ঢাকায়। দিনের বেলায় গিয়েছি ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পুজো দেখতে, কেননা রাতে অসম্ভব ভিড় হয় শুনেছি। কিন্তু দিনের বেলাতেও যে এমন অভাবিত ভিড় হবে, কল্পনা করতে পারিনি। কলকাতা শহরের লোক আমি। ম্যাডক স্কোয়ার, মুদিয়ালি, সুরুচি সংঘ, গড়িয়াহাট এভারগ্রিন আর মহম্মদ আলী এবং কলেজ স্কোয়ার-পার্ক সার্কাসের ভিড় তো আমার কাছেই নয় কেবল, জগদ্বিখ্যাত। সেসব জায়গায় রাতে প্রতিমা দেখতে গেলে দু-তিন ঘণ্টা লাগে জনপ্লাবন ঠেলে প্রতিমার কাছে পৌঁছাতে। কিন্তু দিনের বেলা ঢাকেশ্বরীর মন্দিরে ঢুকতে যে এত দীর্ঘ লাইন, স্বপ্নেও ভাবিনি। জগন্নাথের রথ দেখতে বা হরিদ্বারের কুম্ভমেলার সঙ্গে তুলনা করা যায় এই ভিড়ের সঙ্গে। দেখেছি জগন্নাথ হলের পুজো, রমনা কালীবাড়ির, চট্টগ্রাম, বরিশাল, পুরনো ঢাকার তাঁতীবাজারের, কিন্তু ঢাকেশ্বরী ঢাকেশ্বরী।
এই অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বিস্ময়কর এবং চিরস্থায়ীভাবে মর্মে গেঁথে যাওয়া ঘটনার কথা বলি। সকালে সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে গেছি, ওই সে বছরেই। এখানে, মানে বাংলাদেশে, একটি সুন্দর নিয়ম আছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা চাওয়া হয় না বিশেষ। যে-পাড়ার পুজো, সেখানে গিয়ে পাড়ার লোক চাঁদা দিয়ে আসেন। পুজো সাধারণত মন্দিরে হয়। নৈতিক দায় মনে করে চাঁদা দেন সবাই, জোরজবরদস্তি নেই। আমার অভিজ্ঞতা এটা। তা সেবার সিদ্ধেশ্বরীর মন্দিরের এক কোণে টেবিল-চেয়ার পেতে চাঁদা নেয়া হয় যেখানে, আমাকে সেখানে বসিয়ে (পুজোর ক’দিন আগে থেকেই প্রতিমা গড়া দেখতে যেতাম বলে কর্মকর্তারা চিনতেন আমাকে) জনৈক কর্মকর্তা একটু দরকারি কাজে বাইরে গেছেন। টেবিলে এখন আমি একা, চাঁদাগ্রহণকারী। একটু বাদে দেখি, চার কিশোরী আমার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কী নিয়ে যেন ফিসফিস করছে। ফিসফিসান্তে তারা আমার কাছে এল। নম্রকণ্ঠে জানতে চাইল, ‘আমরা কি চাঁদা দিতে পারি?’ আমি হতচকিত। চাঁদা দিতে ইচ্ছে এবং যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন? বললাম, নাম কী তোমাদের? তারা কেউ মনিরা, কেউ ফাতেমা, রিলি, তাসমীমা। মুহূর্তের ভিতর বুঝলাম, ওদের দ্বিধার বার্তা। ওরা সবাই ক্লাস নাইনের মেয়ে। বললাম, নিশ্চয়ই পারো। কিন্তু চাঁদা দিতে চাইছ কেন? ওদের সমবেত মন্তব্য, ‘আমাদের খুব ভাল লাগছে।’ দুর্গাপুজো কেবল ভক্তের জন্য-ই নয়, ভাল লাগাদের জন্যও। যে ভাল লাগা থেকে ভাই গিরীশচন্দ্র সেন কোরানশরীফ বাংলায় অনুবাদ করেন, অদ্বৈত আচার্য যবন হরিদাসের উচ্ছিষ্ট নিজহাতে পরিষ্কার করেন, স্বামী বিবেকানন্দ মুসলিম-তনয়াকে কুমারীপুজো করেন! ভাল লাগা থেকে ওরা চারজন মিলে একশো টাকা দিল, ওই টাকায় নিজেদের অন্য ভাল লাগাকে কুরবানি দিয়ে।
ঢাকায় বহু মুসলমানকে স্বেচ্ছায় চাঁদা দিতে দেখেছি। একবার ঢাকা স্টেডিয়ামে ‘হাক্কানি’ প্রকাশনীর মালিককে দেখলাম, ডেকে চাঁদা দিলেন। তবে পুজোবিদ্বেষী কিছু মানুষের কণ্ঠস্বরে বীতরাগ দেখেছি, সত্যের খাতিরে এটাও বলব। আর-একটা উল্লেখযোগ্য দিক হল, পুজোর প্যান্ডেলের জন্য নতুন কাপড় কিনে আনেন ডেকরেটাররা। কারণ, পুরনো ব্যবহৃত কাপড়ে অন্য সম্প্রদায়ের ছোঁয়াছানি লাগা ছিল হয়তো। তবে সব পুজোমণ্ডপেই এ-নীতি অনুসরণ করা যায় কিনা, সম্ভব কিনা, জানা নেই। হয়তো কেঁচে-ধুয়ে কাজ চালানো হয়।
এখানকার পুজোয় মাইক, প্যান্ডেল, মূর্তিনির্মাণ ইত্যাদি মূলত বাহ্যাড়ম্বর বর্জিত। আলোর বাড়াবাড়ি না করেও যে স্নিগ্ধ আলোয় সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা আনা যায়, তা এখানকার প্রতিমামণ্ডপ আয়োজনেই
বোঝা যায়। একচালা মূর্তি-ই এখানকার বৈশিষ্ট্য। তবে এর বিপরীতে আলাদা আলাদাভাবে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ-কার্তিককেও স্থাপন করা হয়। প্রতিমার মুখ সাবেকি। প্রায় সর্বত্র। কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ বা বিদেশের বিভিন্ন স্থানে যে পরীক্ষামূলক, যাকে বলে থিম ডাস্কর্য, এখানে দেখা যায় অত্যন্ত কম। মণ্ডপসজ্জাতেও এমন বাড়াবাড়ি নেই, যাতে ‘তোমায় পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’, এই বোধ উদ্রিক্ত না হয়।
থিমপুজো নয়, তবে মণ্ডপসজ্জায় অভিনবত্ব আর অনুসরণীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন নারায়ণগঞ্জের টানবাহার সাহাপাড়ার তরুণ তুর্কির দল। ২০২৩-এর এপ্রিলে বঙ্গবাজারে আগুন লাগে। মালামাল দগ্ধ হয় প্রচুর। সেখানকার পুড়ে যাওয়া তিনশো শাড়িকাপড় দিয়ে মণ্ডপ সাজিয়েছিলেন তাঁরা। সঙ্গে আরেকটি বিপ্লব-ও আনেন তাঁরা। সাধারণত কালো কাপড় দিয়ে প্রতিমার মণ্ডপ হয় না। কিন্তু এঁরা সেই কালোর মিথটাও ভেঙেছেন! কমলকুমার মজুমদারের ভাষায়, ‘আলো আসিতেছে!’ অনুরূপ আরেকটি প্রথাবিরোধী কাজ কলকাতাও করে দেখিয়েছে, মুসলমান পুরোহিত দুর্গাপূজক! টানাবাজারের পূজা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সুমন সাহা এবং তাঁর সহযোগীদের কুর্নিশ! আলো ক্রমে আসিতেছে!
বাংলাদেশ বিশ্বাস করে ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’। তাই তো নারায়ণগঞ্জের গোপীনাথের আখড়ায় যে পূজামণ্ডপ, সেখানে সাঁওতাল সংস্কৃতির ছাপ। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের গোপীনাথ জিউর আখড়ায় পরিবেশবান্ধব রং দিয়ে প্রতিমা নির্মিত। আর ওখানকার-ই চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীরা প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে দেবীমূর্তি গড়েছেন স্রেফ শীতলপাটি ও পাতা ব্যবহার করে।
প্রাক্-খ্রিস্টীয় বহুদেবতাবাদ বনাম দেবী দুর্গা
প্রাচীন মিশর, গ্রীস ও রোমে যেসব দেবদেবী, দুর্গার সঙ্গে সরাসরি না হলেও কখনও কোথায় যেন মিল আছে। পাশ্চাত্য দেবীদের হাতেও অস্ত্র দেখি, যেমন আফ্রোদিতি।
তুলনামূলক মূর্তিতত্ত্বে দেখব, গ্রীক, রোমান, মিশরীয়, এমনকি প্রাক্-ইসলামের আরবে বহুদেবতাবাদ এবং দেবতাদের নানা বর্ণ, অঙ্গসংস্থানের বৈচিত্র্য রয়েছে। গ্রীক দেবী হেরিস। তাঁর ছিল এক রক্তমাখা তরবার। মিশরীয় দেবীরা থাকতেন বর্ম পরিহিতা। আফ্রোদিতির ছিল পরিকর (বেল্ট), শত্রুনিধনে যা কাজে লাগত। গ্রীক পুরাণে আফ্রোদিতি, আইসিস ও যিশুমাতাকে একীভূত করে দেখানো হয়েছে। আল লাত, মানাত, উজ্জা ছিলেন ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে মক্কার কাবাঘরে পূজিত দেবতা। আল লাতের উপাসনালয় এখনও রয়েছে, যেখানে একটি পাথরকে পবিত্র মনে করা হয়। মানাত ভাগ্যদেবী এবং উজ্জা শক্তির প্রতীক। পবিত্র কোরানশরীফে তাঁদের কথা আছে। অন্যদিকে বৌদ্ধরা মূর্তিপূজক না হলেও সনাতন হিন্দুধর্মের প্রভাবে সেখানেও প্রজ্ঞাপারমিতা, তারা প্রমুখ দেবী পূজা পান। দশটি হাত দেবী দুর্গার। বৌদ্ধদের তারাদেবী সহস্রহস্তা, তারা আবার অবলোকিতেশ্বরের সঙ্গে একীভূত। ঠিক যেন দুর্গা ও শিবের অর্ধনারীশ্বর-সত্তা! গ্রীকদেবী হেকেটি। নামটি আমরা রবীন্দ্রনাথের জীবনীপ্রসঙ্গে পেয়েছি। কবি কাদম্বরীকে এই নামে ডাকতেন ও বই উৎসর্গ করেছেন। হেকেটির তিনটি মাথা ছিল। শতমস্তক দেবী, সে-ও আছে, দেব তিপন-এর। টাইফনের ছিল একশোটি মুখ! এইভাবে দেখা যায়, মানব-অতিরিক্ত অঙ্গসংস্থান নিয়ে দেবদেবীরা বাস করেন। দশ হাত, দশ মাথা, হস্তীমুখ তাঁরা।
দুর্গাপূজা: পরিশিষ্টবচন
একদা পূর্ববঙ্গের মানুষ অনেকেই চাকরি, ব্যবসা, পড়াশোনা ও অন্যান্য সূত্রে কলকাতা বা ভারতের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতেন। পুজোর ছুটিতে বৎসরান্তে তাদের বাড়ি ফিরবার হিড়িক পড়ে যেত। বাংলা উপন্যাস ও ছোটগল্পে এর প্রচুর কাহিনি আছে। ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর থেকে এ জিনিস আস্তে আস্তে কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় দাঁড়িয়েছে। এখন চলছে উল্টোরথ। ঈদের আগে হাজারে হাজারে, বা বলা যায় লাখে লাখে মানুষ কলকাতা যান শপিং করতে।
মায়ের কাছে মামাবাড়ির দুর্গাপূজার কথা বহুবার শুনেছি। সারারাত নৌপথে মায়েরা বরিশাল শহর থেকে জলাবাড়ি (এখন পিরোজপুর জেলা) যেত। পূজা, সে-উপলক্ষ্যে মামাদের নিজস্ব মঞ্চে নাটক, আমার বাবা দেখতে সুন্দর বিধায় তাঁকে নারীচরিত্রে রাখা হত। (একবার সুলতানা রিজিয়া সাজেন বাবা। দর্শকদের মধ্যে কয়েকজন ঠিক করে, একে কিডন্যাপ করবে!) সেরা শিল্পীকে সোনার মেডেল প্রদান, বিসর্জন ও লক্ষ্মীপূজা-শেষে গৃহে ফিরে আসা কাজরীগাথার মতো মা বর্ণনা করত। সে অযোধ্যাও নেই, রাম-ও না!
বাংলাদেশে জেলায় জেলায় কুমোরপাড়া আছে। প্রতিমা তৈরি করে হিন্দু, হাত লাগান মুসলমানরাও। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে আজকাল মহিলারাও পূজা করছেন, কিন্তু বাংলাদেশে তার খোঁজ পাইনি। তবে সুইটি পাল বলে এক মহিলা মূর্তি গড়তেন। গোপালগঞ্জের লোক, তবে বরিশালে বসে প্রতিমা বানাতেম এই গুণরাজ (মৃৎশিল্পীকে এইনামে ডাকা হয়)।
দুর্গা বাঙালির কাছে, ধর্মনির্বিশেষে আগ্রহের, যেহেতু এই দেবী পরিবারসহ আসেন, আর সঙ্গে নিয়ে আসেন কাশফুল আর শিউলি। তাই তো সনাতন রামপ্রসাদ, খ্রিস্টান মাইকেল, ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ এবং মুসলমান কাজী নজরুল দুর্গাকে নিয়ে কলম না ধরে পারেননি!
কভারের ছবি: ভারতের রাজস্থান থেকে পাওয়া লাল বেলেপাথরের দুর্গা ভাস্কর্য, (৮৫০-৯০০ খ্রিস্টাব্দ); লস এঞ্জেলেস কাউন্টি মিউজিয়াম অফ আর্টে সংরক্ষিত।
দুর্গাপূজা, মূর্তিপূজা: দেশে দেশে দুর্গাপুজো: অতীত দিনের স্মৃতি