Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বসন্তোৎসব: উল্লেখ আছে বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’-তেও

দোল উৎসব বা দোলযাত্রা এমন একটি উৎসব, যাকে ধর্মীয় উৎসব বলা যায়; আবার সামাজিক ও প্রকৃতি-পরিবেশভিত্তিক উৎসব‌ও বলা যায়। তাই এই উৎসবের আবেশ বিপুলাকারে বিস্তৃত। দোলযাত্রা বা হোলি উৎসব সংক্রান্ত পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলি মূলত দুই প্রকার: প্রথমটি দোলযাত্রার পূর্বদিন পালিত বহ্ন্যুৎসব বাংলার ন্যাড়াপোড়া বা বহির্বঙ্গের হোলিকা দহন সংক্রান্ত, এবং দ্বিতীয়টি কৃষ্ণের দোললীলা-কেন্দ্রিক কাহিনি। তবে দুটি কাহিনিই কিন্ত অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির উত্থানের ইতিহাসকে গুরুত্ব দেয়।

প্রথমে আসি এর উৎপত্তিগত ধর্মীয় মিথে। পুরাণ অনুসারে, বসন্ত পূর্ণিমার এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামক অসুরকে বধ করেন। কোথাও কোথাও অরিষ্টাসুর নামক অসুর বধের কথাও আছে। অন্যায়কারী, অত্যাচারী এই অসুরকে বধ করার পর সকলে মহানন্দে মেতে ওঠেন। এই কাহিনির অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আর একটি মিথ, নন্দগাঁও থেকে দলবল নিয়ে কৃষ্ণ যেতেন রাধারানির গ্রাম বরসানাতে, দোল খেলতে। তারপর কী হত, জয়দেব গোস্বামীর পদাবলি থেকে আরম্ভ বিভিন্ন ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতে তার পর্যাপ্ত বর্ণনা আছে, এবং সেসব বর্ণনার অনেকটাই আদিরসাত্মক এবং এখানেই দোলযাত্রা বা হোলির (দুটি উৎসবই এখন এক হয়ে গেছে) মাহাত্ম্য। এই উদ্দামতায়। যৌবনের আত্মনির্ঘোষে। বসন্তের ফিরে আসায়।

অন্য একটি কাহিনি হল, দৈত্যরাজ হিরণ্যকিশপু ছিলেন ঈশ্বর-বিদ্বেষী, অধার্মিক। কিন্তু তাঁর পুত্র ভক্ত প্রহ্লাদ অসুর বংশে জন্ম নিয়েও ছিলেন হরিভক্ত ও পরম ধার্মিক। তাই বারবার নিষেধাজ্ঞা জারি করেও যখন পুত্রকে নিরস্ত্র করতে পারেন না, তখন ক্রোধান্ধ পিতা পুত্রকে হত্যা করতে উদ্যত হন। কিন্তু তাঁকে যখন বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও হত্যা করা যাচ্ছিল না তখন হিরণ্যকিশপুর বোন হোলিকা প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ হোলিকা এই বর পেয়েছিলেন যে, আগুনে তাঁর কোনও ক্ষতি হবে না। কিন্তু অন্যায় কাজে শক্তি প্রয়োগ করায় হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করলে প্রহ্লাদের কোনও ক্ষতি হয় না, কিন্তু হোলিকা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যান। বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের এই অক্ষত থাকার আনন্দ উৎসবে পরিণত হয়।

আবার শৈবশাস্ত্র অনুযায়ী, ভগবান মহাদেব তাঁর ধ্যানভঙ্গ করার অপরাধে কামদেব মদনকে তৃতীয় নয়নের আগুনে ভস্মীভূত করেছিলেন। কিন্তু মুহূর্তের সেই রোষ প্রশমিত হবার পর তিনি উপলব্ধি করেন যে ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। বেচারা মদন সদুদ্দেশ্যে পার্বতীকে সাহায্যই করছিলেন, মহেশ্বরের ধ্যান ভাঙিয়ে তাঁর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। শিব দেখলেন, স্বামীর এই দশার জন্য মদনের স্ত্রী রতি এবং স্বয়ং পার্বতীও ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছেন। তারপর যখন রতি চল্লিশ দিন ধরে কঠিন তপস্যা করলেন স্বামীর জীবন ফিরে পাবার জন্য, তখন আর ভোলানাথ পারলেন না। পুনর্সঞ্জীবিত করলেন ‘অনঙ্গ’ মদনকে। মদন-ভস্মের চল্লিশ দিন পরের সেই দিনটিই নাকি বসন্তপঞ্চমী, যেদিন কামদেবের পুনর্জীবনপ্রাপ্তি হয়। তাই সেদিন বসন্ত উৎসব, কামের অর্চনা। উৎসবটি কবে, কীভাবে দোলপূর্ণিমার সঙ্গে একাকার হয়ে গেল, তা বলা কঠিন।

দোল উৎসবের আগের দিন ‘হোলিকা দহন’ হয় অত্যন্ত ধুমধাম করে। শুকনো গাছের ডাল, কাঠ ইত্যাদি দাহ্যবস্তু অনেক আগে থেকে সংগ্রহ করে সুউচ্চ একটা থাম বানিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করে ‘হোলিকা দহন’ হয়। পরের দিন হয় রং খেলা। বাংলাতেও দোলের আগের দিন এইরকম রীতি আছে, যদিও তার নাম ‘চাঁচর’ বা ন্যাড়াপোড়া। এই চাঁচর বা ন্যাড়াপোড়ার‌ও ঋতুগত ব্যাখ্যা আছে। দোল আমাদের ঋতুচক্রের প্রায় শেষ উৎসব। নতুনের আহ্বান হচ্ছে এই দোল‌ উৎসব। তাই এই সময় শীতের শেষে পাতাঝরার সময় পর্ণমোচী গাছের পড়ে থাকা রাশিরাশি শুকনো পাতা, ডালপালা একত্রিত করে জ্বালিয়ে দেওয়ার মধ্যে এক পরিবেশগত তাৎপর্য রয়েছে। পুরনো জঞ্জাল, রুক্ষতা, শুষ্কতা সরিয়ে তারপর দোল‌ উৎসবে মেতে ওঠার লগ্ন। বাংলায় দোলের আগের দিন ‘চাঁচর’ উদযাপনকে এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়। ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।/একলা রাতের অন্ধকারে আমি চাই পথের আলো॥’ এ যেন চাঁচর বা হোলিকা দহনের তাৎপর্যের বাণীরূপ রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে।

ভারতীয় স্থাপত্যকলায় দোল বা হোলি।

নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ ও ‘জৈমিনি মীমাংশা’-য় রং উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায়, ৩০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দের এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক ‘হোলিকোৎসব’ পালনের উল্লেখ পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের নাটক ‘রত্নাবলী’-তেও হোলিকোৎসবের উল্লেখ আছে। এমনকি আল বেরুণীর বিবরণে জানা যায়, মধ্যযুগে কোনও কোনও অঞ্চলে মুসলমানরাও নাকি হোলিকোৎসবে সংযুক্ত হতেন। অষ্টম শতকের ‘মালতী-মাধব’ নাটকেও এর বর্ণনা পাওয়া যায়। জীমূতবাহনের ‘কালবিবেক’ ও ষোড়শ শতকের ‘রঘুনন্দন’ গ্রন্থেও এই উৎসবের অস্তিত্ব রয়েছে।

আবার বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’, যা রচিত হয়েছিল তৃতীয়-চতুর্থ শতকে, তাতেও এই উৎসবের উল্লেখ আছে। ‘কামসূত্র’ গ্রন্থে দোলায় বসে আমোদ-প্রমোদের কথা আমরা জানতে পারি। ইংরেজরাও প্রথম দিকে এই উৎসবকে রোমান উৎসব ‘ল্যুপেরক্যালিয়া’ হিসেবেই মনে করেছিল। অনেকে আবার একে গ্রিকদের উৎসব ‘ব্যাকানালিয়া’-এর সঙ্গেও তুলনা করতেন। মহামতি আকবর এই রঙের উৎসবের বড় অনুরাগী ছিলেন এবং সপার্ষদ তিনি এই উৎসবে অংশ নিয়ে রঙিন হতেন। রং খেলছেন জাহাঙ্গির বা অন্য মোগল বাদশা, এমন অসংখ্য মুঘল মিনিয়েচার সংরক্ষিত রয়েছে দেশবিদেশের বিভিন্ন জাদুঘরে।

কিছু ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন, পূর্ব ভারতে আর্যরা এই উৎসব পালন করতেন। যুগে যুগে এর উদযাপন রীতি পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। পুরাকালে বিবাহিত নারী তাঁর পরিবারের মঙ্গলকামনায় রাকা (বসন্ত) পূর্ণিমায় রঙের উৎসব পালন করতেন। মতভেদে, অঞ্চলভেদে দোল বা হোলির উৎপত্তি ও উদযাপনের ভিন্ন ব্যাখ্যা কিংবা এর সঙ্গে সংপৃক্ত লোককথার ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু উদযাপনের রীতি প্রায় এক। বাংলায় আমরা বলি ‘দোলযাত্রা’ আর পশ্চিম ও মধ্যভারতে ‘হোলি’।

শাস্ত্র অনুসারে, বৈষ্ণবীয় উৎসবের শেষ উৎসব হোলি বা দোল উৎসব। বাংলার দোল উৎসবের বাহকও আদতে বৈষ্ণব সম্প্রদায়। ষোড়শ শতকের এক অনন্য বিশিষ্ট বাঙালি ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক শ্রীচৈতন্যের ‘আবির্ভাব’ এই দোলপূর্ণিমায় হয়েছিল বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সহিত রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। বৈষ্ণব কবি গোবিন্দদাসের রচনায় তার উল্লেখ মেলে। ‘‘খেলত ফাগু বৃন্দাবন-চান্দ।। ঋতুপতি মনমথ মনমথ ছান্দ। সুন্দরীগণ কর মণ্ডলি মাঝ। রঙ্গিনি প্রেম তরঙ্গিনী সাজ।’’

দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আবির ও গুলালে স্নাত করে দোলায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এরপর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পর রং খেলেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর চৈতন্যদেব জন্মভূমি বাংলা ত্যাগ করে কয়েক বছর ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান পর্যটন করেন। জীবনের শেষ চব্বিশ বছর তিনি অতিবাহিত করেন জগন্নাথধাম পুরীতে। বৈষ্ণবদের অধিকাংশ মনে করেন, পুরীতে দোলোৎসব ফাল্গুন মাসে প্রবর্তনের যে রেওয়াজ হয়, সেখান থেকেই বাংলায় চলে আসে এই সমারোহ যার জন্য দোল‌ উৎসব দোলযাত্রায় পরিণত হয়।

Advertisement

তবে বাংলার দোল‌ উৎসবে শুধু হিন্দুরা নন, দোলের রঙে বহু যুগ ধরে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলে আনন্দ উপভোগ করেছেন। শোনা যায়, মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজদের সঙ্গে আলিনগর চুক্তি সেরে তড়িঘড়ি মুর্শিদাবাদ ফিরে গিয়েছিলেন হোলি উৎসবের জন্য। নবাবের প্রিয় হিরাঝিল প্রাসাদে মহাসমারোহে দোল উৎসব পালন করা হত। তেমনই ঢাকার নবাব নওয়াজিস মহম্মদ খান পটনা থেকে আগত শওকত জঙ্গের সঙ্গে সাত দিন ধরে মুর্শিদাবাদের মোতিঝিল প্রাসাদে হোলি উৎসব পালন করেছিলেন।

ভারতীয় স্থাপত্যকলায় রং খেলা।

এবার আসি শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবের কথায়। অনেক রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ মনে করেন, ১৯০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি, বসন্তপঞ্চমীতে, শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে যে ঋতু উৎসবের সূচনা হয়, তারই পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত রূপ শান্তিনিকেতনের আজকের এই বসন্ত উৎসব বা বসন্তোৎসব। শান্তিনিকেতনের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথের বিদেশযাত্রা বা অন্য আরও দিক মাথায় রেখে কোনও এক নির্দিষ্ট দিনে আশ্রমবাসী মিলিত হতেন বসন্তের আনন্দ অনুষ্ঠানে। একবার ক্ষিতিমোহন সেন এবং অন্য সঙ্গীদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চিন যাত্রা করছেন দোলযাত্রার দিনে। সন্ধ্যায় পূর্ণিমার চাঁদ ও গঙ্গাতীরের গ্রামের কীর্তনের সুর তাঁকে আবেগাপ্লুত করে তুলেছিল। তাই রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে দোল‌ উৎসবের সকাল থেকেই বেজে ওঠে কীর্তনাঙ্গের মত সেই চেনা গান, ‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল।’

শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনী প্রমথনাথ বিশীর ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ স্মৃতি-আলেখ্যে ‘উৎসবরাজ’ দিনু ঠাকুরের নেতৃত্বে খোল-করতাল সহযোগে বসন্তের গান গাইতে গাইতে আশ্রম-পরিক্রমার উল্লেখ পাওয়া যায়। আশ্রমিকদের বাড়িতে বাড়িতে তখন আম্রপল্লবের পত্রলেখায় পৌঁছে যেত বসন্তের আমন্ত্রণলিপি। এই আমন্ত্রণ-প্রকরণের মধ্যেও ছিল একটা স্নিগ্ধ আন্তরিকতার স্পর্শ। আসলে শান্তিনিকেতনে দোলের দিন যে ঋতু-উৎসবটি উদ্‌যাপিত হয়, তার সঙ্গে দোল বা হোলির ধর্মীয় অনুষঙ্গের কোনও যোগ নেই। এ হল নিতান্তই ঋতু-উৎসব। সবার রঙে রং মেলানোর এক সর্বজনীন নান্দনিক উপলক্ষ। দখিনা বাতাসে সজনে ফুলের গন্ধ এলে, পলাশ, শিমুলে ফুল ফুটলে শান্তিনিকেতনের সে কালের আশ্রমিকদের মনে গুনগুনিয়ে উঠত ‘বসন্ত’। তার জন্য ফাল্গুনী পূর্ণিমা পর্যন্ত অপেক্ষাও কখনও কখনও বাহুল্য মনে হত সে কালে। তাই অনেক বার বিভিন্ন তিথিতে বসন্ত-উদ্‌যাপন হয়েছে আশ্রমে! বছরের বাঁধা একটা দিনে উৎসবেই তৃপ্ত হতেন না সে সময়ের আশ্রমিকরা। জানা যায় ১৯২৩ সালে মাঘী পূর্ণিমায় শান্তিনিকেতনে বসন্তের গানের আসর বসেছিল; আবার ফাল্গুনী পূর্ণিমায় আশ্রম-সম্মিলনীর অধিবেশনেও আয়োজন করা হয়েছিল বসন্ত-বন্দনার। সূত্রান্তরে জানা যাচ্ছে, সে বার শ্রীপঞ্চমীর দিনও আম্রকুঞ্জের সভায় বসেছিল ‘ফাল্গুনী’র গানের আসর।

শ্রদ্ধেয় লেখক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব অসুন্দরের মোকাবিলার উৎসব’ লেখাটি পড়ে জানতে পারি, ‘‘সেকালে এই উৎসব রচিত হত আশ্রমিকদেরই রুচিসামর্থ্যে। আশ্রমগুরু স্বয়ং সব সময় উৎসব রচনা করে দিতেন, তা নয়। বসন্ত-উৎসব ঠিক রবীন্দ্রনাথের একক ‘রচনা’ নয়। বলা যায়, তাঁর রুচিনির্মাণ-প্রকল্পের সারাৎসার আত্মস্থ করে আশ্রমিকেরাই রচনা করতেন উৎসবের। আসর শেষে আশ্রমিকেরাই যেতেন তাঁদের গুরুদেবের পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করতে। শান্তিদেব ঘোষ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ১৯৩১ সালের এমনই এক আসরে বসন্তের গানের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত নেচে ওঠেন তিনি; এবং কলাভবনের ছাত্র বনবিহারী ঘোষ। তাঁদের সেই নাচের সুখ্যাতি গিয়ে পৌঁছয় রবীন্দ্রনাথের কানে। এর কয়েক বছর পর থেকেই আম্রকুঞ্জের সকালের অনুষ্ঠানে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ শুরু হয় আশ্রমগুরুর। আর সেই সময় থেকেই, শান্তিদেব ঘোষের বয়ান অনুযায়ী; শান্তিনিকেতনের ‘দোলের উৎসব’ মাত্রান্তরিত হয়ে ফুটে ওঠে নন্দিত ‘বসন্তোৎসব’ হিসেবে! দোলের উৎসবকে নান্দনিক করে গড়ে তোলার প্রয়োজন উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ওই সাক্ষাৎকারেই শান্তিদেব বলেছিলেন, ‘‘আগের দোল-উৎসব যেটা হত, সেটাকে গুরুদেব আর বেশি উৎসাহ দিলেন না কারণ ওই সময় নানা রকম নোংরামি হত। নোংরামি মানে কী— কাদা দিয়ে দিল, ছেলেরা দুষ্টুমি করে কালি দিয়ে দিল— এ রকম এলোমেলো ভাব। উনি (রবীন্দ্রনাথ) ভাবলেন, এটাকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে বেঁধে দিতে হবে। উনি সকালে ‘বসন্তোৎসব’ বলে একটা বিধিবদ্ধ উৎসব করা ঠিক করলেন। তখন থেকেই আরম্ভ হল সকালবেলার অনুষ্ঠান— তাতে গান হবে, কিছু নাচ হবে— ছেলেমেয়েরা নাচবে, গুরুদেব আবৃত্তি করবেন। তখন থেকেই ‘ওরে গৃহবাসী’ গানটার সঙ্গে নানা রকম অর্ঘ্য নিয়ে মেয়েরা আসত।”
১৯৩৪ সাল থেকে ‘নবীন’ নাটকের জন্য লেখা ওই গানের সঙ্গে শোভাযাত্রায় জুড়ে গেল নাচ। সেই নাচের সংযুক্তি ছিল শান্তিদেবেরই পরিকল্পিত। ‘বেশি কমপ্লিকেটেড নয়, মণিপুরী একটা সিম্পল স্টেপ— ব্যস, এই শুরু হয়ে গেল নতুন একটা দিক।’ শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুও হাত লাগালেন সেই নন্দন-আয়োজনে। তালপাতা দিয়ে তিনি বানিয়ে দিতে থাকলেন শোভাযাত্রিকদের হাতের ডালি। তার কোনওটিতে থাকত ফুল, কোনওটিতে আবির। অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা যত বাড়তে থাকল, নাচের দলেও এল নানা বৈচিত্র। যুক্ত হল কাঠির নাচ, মন্দিরার নাচ, হাতের তালির নাচ। যে উৎস থেকেই বেয়ে আসুক সে-সব নাচের ধারা; শেষ বিচারে তার উপর চিরকালের জন্য মুদ্রিত হয়ে রইল শান্তিনিকেতনের নান্দনিক রুচির নিজস্ব স্বাক্ষর।’’
‘‘সেই সময় উৎসবের নামে রুচির সামান্য স্খলনেও পীড়িত বোধ করত আশ্রম। তরুণ পঞ্চানন মণ্ডল তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, ১৯৩৮ সালের উৎসবের দিন বৈতালিকের সময় ছাত্রাবাসের ছাদের উপর কিছু ছাত্র ‘অসংযত আমোদে হৈ হৈ’ করতে থাকে। এই সামান্য ‘হৈ হৈ’ গভীর মনঃপীড়ার কারণ হয় ওই তরুণ আশ্রম-শিক্ষার্থীর। কারণ আশ্রমের এক রকম উপলব্ধি ছিল, তাঁদের গুরুদেবের অভিধানে ‘উন্মাদনা’ শব্দটির কোনও স্থান নেই। রবীন্দ্রনাথের বসন্ত-ভাবনায় উল্লাস-উন্মাদনা নেই, আছে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সংযম-সুন্দর আকুলতা। জগতের দিকে ব্যাকুল ভাবে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গির সঙ্গে, জগতকে সবটুকু আপন করে না পাওয়ার সূক্ষ্ম একটা বেদনাবোধও জড়িয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের বসন্ত-ভাবনায়! ‘নিবিড় অন্তরতর বসন্ত এল প্রাণে’-র মতো গানের চাবি দিয়ে খুলতে হয় রবীন্দ্রনাথের বসন্তের ওই আর এক অনুভববেদ্য অন্তর্প্রদেশ। এ জন্যই কবির প্রয়াণোত্তরপর্বে আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন এক বার বলেছিলেন, কবি নিতান্ত আমোদ-প্রমোদের জন্য এই উৎসবের সূচনা করেননি। এই উৎসব যা মিথ্যা ও কুৎসিত তার উপরে সত্য ও সুন্দরের জয়ের প্রতীক।’’

ভারতীয় স্থাপত্যকলায় রং খেলায় রত নারী।

সাঁওতাল, মুণ্ডা, হো, ওরাঁও আমাদের দেশের আদি জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে বসন্ত উৎসবের এক মাঙ্গলিক তাৎপর্য রয়েছে। তার যেমন বহিরঙ্গ রয়েছে, তেমনই রয়েছে অন্তরের দর্শন।
অযোধ্যা, দলমা, দামোদর নদের উপকূল, পঞ্চকোট মাঠা অরণ্যানী সংলগ্ন সাঁওতালপল্লিতে ধামসা-মাদল আহ্বান করে বসন্ত উৎসব। তবে এ শুধু রঙের উৎসব নয়, এ এক বিবাহ উৎসব। ধরিত্রীর সঙ্গে সূর্যের। যে বিবাহ শেষে নবকুলের সূচনা হয়। বংশরক্ষা হয় অরণ্যের, শস্যের।
এই উৎসবে দোল বা আবিরের কোনও সম্পর্ক নেই। সাঁওতালদের এই উৎসব ‘বাহা’ এবং কুড়মিদের কাছে এই উৎসব ‘শারুল’ নামে পরিচিত। বাহা হল প্রকৃতির নতুন রূপের উদযাপন। এই সময় প্রকৃতির সমস্ত গাছপালা নতুন পাতা ও ফুলে ভরে ওঠে। এই নবপাতা ও ফুলকে স্বাগত জানানোর জন্য সাঁওতাল সমাজের মানুষ এই উৎসব পালন করেন।
এই উৎসবগুলোর মধ্যে কোনও রকম অলৌকিকতা, কুসংস্কারের স্থান নেই। বরং অদ্ভুত এক বিজ্ঞান রয়েছে। এই সময় প্রকৃতিতে নতুন ফুল, পাতা আসে। তাই কেউ যদি ওই ফুল, পাতাগুলি নষ্ট করে দেয়, তা হলে গাছের ক্ষতি হবে। এই ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচতেই মূলত ‘বাহা শারুল’-এর মত উৎসবের সৃষ্টি। সাঁওতাল ও কুড়মি সমাজে একটা প্রথা আছে, যত দিন বাহা বা শারুল উৎসব চলে, তত দিন পর্যন্ত গাছের, বিশেষ করে শাল মহুয়ার কোনও পাতা, ফুল, বা কাঠ ব্যবহার করা যায় না। এই রীতির কারণেই অরণ্য রক্ষা পায় ক্ষতির হাত থেকে।

পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি ছোটনাগপুর মালভূমি এলাকার ওড়িশা, ঝাড়খণ্ডেও এই উৎসব পালিত হয় বসন্তকালে। প্রাকৃতিক সম্পদকে ঐশ্বরিক নিবেদনের পরে, প্রকৃতির সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এই ভাবনাই এই উৎসবের অন্তরের দর্শন। বাহা এবং শারুল বা সারহুল এই দুই উৎসবের‌ই প্রধান চাওয়া বনজ সম্পদ ও বন্যজীবের উর্বরতা বৃদ্ধি ও বিস্তার।
রাঢ় বাংলায় রাধা-কৃষ্ণের রং খেলা নিয়ে একটা ঝুমুর গান শোনা যায়। ‘মনচোরা লাঠুয়া বনমালী, তর সঙ্গে রিঝে রঙে খেলইব নাই আর হুলি’। অর্থাৎ নাটুয়া বনমালী অর্থাৎ কৃষ্ণের সঙ্গে রং খেলতে অনীহা প্রকাশ রাধিকার। আসলে এই নারাজ রাধার মধ্যে অভিমানী সলাজ রাধার দোল খেলার ইচ্ছে আছে কিন্তু তা প্রকাশ্যে নয়, একান্ত মিলনের অভিলাষ।

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় দোল উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে। শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবে ঐতিহ্য সুবিদিত। পাশাপাশি নানা আচার-সংস্কার ও বর্ণাঢ্য আয়োজনের নিরিখে উল্লেখের দাবি রাখে নদিয়ার নবদ্বীপ, শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর ও মাঝদিয়ার দোল; বর্ধমানের কাটোয়ার দোল, কোচবিহারের দোল, হাওড়ার নিমদিঘি, পশ্চিম মেদিনীপুরের বগড়ী কৃষ্ণনগরের দোল, দক্ষিণ ২৪ পরগনার রাজপুরের দোল, উত্তর ২৪ পরগনার কল্যাণী ঘোষপাড়ার দোল, ঝাড়গ্রামের দোল, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর এবং পুরুলিয়ার দোল। দোলযাত্রাকে কেন্দ্র করে এভাবেই ধর্মাচরণ, সামাজিক মিলন বা মেলা ও বিভিন্ন লোকস‌‌ংস্কৃতির চর্চা ও উদযাপন; এই ত্রয়ীর সমন্বয় লক্ষ্য করা যায় সব ধর্ম, সব বর্ণের মানুষ এই উৎসবে একত্রে যোগ দিতে পারেন। সেই সমন্বয়ের ভাবনাই উঠে আসে রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য, ‘আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে।’

চিত্র: ভারতীয় স্থাপত্যকলায় দোল বা হোলি। গুগলের সৌজন্যে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seven + 19 =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »