আজকে এই একুশ শতকের তৃতীয় দশকে এসে বিগত উনিশ শতকের বাঙালি মনীষীদের সামনে এসে যখন দাঁড়ানো যায়, আপনিই নতজানু হতে হয় দেশ ও দশের জন্য তাঁদের সতত সংরাগের পরিচয় পেয়ে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার করালদ্রংষ্টা তাঁদের স্বধর্মচ্যুত করতে পারেনি। উপমহাদেশের পরাধীনতা তাঁদের এতটাই মর্মবিদ্ধ করত যে, জীবনের অন্তিম পর্যন্ত তাঁরা দেশকে শৃঙ্খলামুক্ত করার কথা চিন্তা করে গিয়েছেন। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথা ভাববার অবকাশ পাননি তাঁরা। আজকের এই নিতান্ত স্বার্থপরতা আর আত্মবলয়িতার সময়খণ্ডে দাঁড়িয়ে কল্পনাও করা যাবে না তাঁদের সংকল্প দৃঢ়তা তেজ একমুখিতা ও আত্মত্যাগকে।
মহাত্মা আশ্বিনীকুমার দত্ত (২৫ জানুয়ারি ১৮৫৬-৭ নভেম্বর ১৯২৩) ছিলেন এরকমই একজন পুরুষ, বাঙালি নিতান্ত বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি না হলে যাঁকে এই ছল সময়ে আরও বেশি করে আশ্রয় করত। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর আবির্ভাব ও কৃতির স্বাক্ষর রাখবার আগেই কিন্তু দেশবাসীর কাছে অশ্বিনীকুমার ‘মহাত্মা’ আখ্যায় ভূষিত। অবিভক্ত ও পরাধীন ভারতবর্ষের মানচিত্রে অখণ্ড বাংলার বরিশাল জেলার স্থান ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, তবু অশ্বিনীকুমারের বরিশাল, এবং স্বয়ং অশ্বিনীকুমার ব্রিটিশ শাসকের কাছে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
রাজনীতি, শিক্ষা, ধর্মসমন্বয়, কুসংস্কার বিরোধিতা, দৃঢ়চিত্ততা, চূড়ান্ত সততা, অসাম্প্রদায়িকতা, মননশীলতা এবং আন্তর্জাতিকতাবোধ, এ সবেরই সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। কেবল বাঙালির চিৎসত্তায় নয়, তাঁর স্থান হওয়া উচিত চিরন্তন মানবহিতৈষীর কোঠায়, সর্বমানবের হৃদয়ে।
কথাটা বাড়াবাড়ি শোনাতে পারে, যদি এ বক্তব্যের পেছনে কোনও যুক্তি না থাকে। পরাধীন ভারতবর্ষে তাঁর জীবিতকালে যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন, তার মধ্যে প্রধান ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধীনে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এর যে নানান স্তর-স্তরান্তর, নরমপন্থা-চরমপন্থা, অন্যদিকে সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদ, আধুনিক ঐতিহাসিকরা যাকে বলেন ‘প্যাসিভ রেজিস্টান্স’, মুসলিম লীগ, বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী, রাজধানী স্থানান্তর, অসহযোগ আন্দোলন ইত্যাদি। এসব হল মুদ্রার একপিঠ। অন্যপিঠে ব্রিটিশ দমননীতি, ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি, নানান দমনমূলক আইন, সাইমন কমিশন, জালিয়ানওয়ালা বাগ, স্বদেশপ্রেমীদের ফাঁসি, গোলটেবিল বৈঠক। এসবের মধ্যে মহাত্মা অশ্বিনীকুমারের জন্ম, কর্ম ও প্রয়াণ।
অশ্বিনীকুমার ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী তো ছিলেন-ই, তার ওপর তাঁর চরিত্রের সততার কথা ভাবলে তাঁর প্রতি নতজানু না হয়ে পারা যায় না। তাঁর জন্ম তারিখটি তাঁর বাবা ব্রজমোহন বাড়িয়ে লিখেছিলেন। সে-কালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে গেলে ষোল বছর বয়স পূর্ণ করতে হত। কিন্তু অশ্বিনীকুমারের প্রকৃত বয়স তখন পুরো ষোল হয়নি। একথা যখন তিনি জানতে পারলেন, সেবছরে পরীক্ষা না দিয়ে পরের বছর বয়স ষোল পূর্ণ করার পরই পরীক্ষা দিয়েছিলেন। আজকের এই তঞ্চকতা আর মিথ্যাচারে ভরা পৃথিবীতে বসে এই নীতিবোধকে স্মরণে আনলে বিস্মিত হতে হয়।
অবিভক্ত ভারতের বাংলা প্রদেশের একটি জেলার নাম বরিশাল। নদীনালায় ভরা দেশ। তীব্রস্রোতা সে-সব নদী— আড়িয়াল খাঁ, গাবখান। বরিশাল শহরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে কুমীর-কামট-মৎস্যসঙ্কুল কীর্তনখোলা নদী। ধানসিড়ির মত স্নিগ্ধ নদীও রয়েছে এদেশে, কবি জীবনানন্দ দাশ, বরিশালের অন্য খ্যাতিমান ভূমিপুত্র যে নদীটিকে অক্ষয় করে রেখে গেছেন তাঁর কবিতার পর কবিতায়। তীব্রস্বনা নদীগুলো বরিশাল জেলাকে চারদিকে থেকে এতটাই ঘিরে রেখেছে যে যুগ যুগ ধরে বন্যা এ জেলার ললাটলিখন। আবার নদীর প্রাচুর্যই এই জেলার জমির স্বর্ণফসলপ্রসূতার কারণ। এজন্য বরিশালকে বলা হত Grannery of India। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (বাংলা ১১৭৬, ইংরেজি ১৭৭০) বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। সংখ্যাটা এক কোটি (বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা মিলিয়ে যে বঙ্গপ্রদেশ তখন, সেখানকার লোকসংখ্যা তখন ছিল ৩ কোটি)।
তবু বরিশাল জেলাকে কিন্তু দুর্ভিক্ষ ছুঁতে পারেনি। আবার ১৩৫০-এর যে মন্বন্তর (ইতিহাসে পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে খ্যাত, ইংরেজি ১৯৪৩ সাল), তখন এই বরিশাল থেকে খাদ্যশস্য গেছে বাংলার অন্যান্য স্থানে, এমনকি বহির্বাংলাতেও, বিশেষ করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনির জন্য। বেপরোয়া নদীর পর নদী, আর এজন্যই রেলপথ সম্ভব হতে পারেনি। মুসুর ডাল, বালাম চাল আর অফুরন্ত মাছ, সুপারি ও নারকেলের দেশ এই বরিশালে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান ও মগদের বাস। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বরিশাল নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘এখানে খাদ্যসুখের কথা বর্ণনা করা যায় না। ফল, মূল, ননী, দুগ্ধ, ঘৃত, ক্ষীর, মৎস্য, মাংস, তরিতরকারি, চাউল, ডাউল, মিষ্টান্ন, চিনি, গুড়, লবণ ও কাষ্ঠ প্রভৃতি সকল সস্তা। নারিকেল অনেক। এখানকার মত উত্তম চাউল বোধকরি বঙ্গদেশের আর কুত্রাপি নাই। বাণিজ্যক্ষেত্রে এই স্থান অতি প্রধান স্থান। বাণিজ্যদ্রব্য পরিপূরিত নৌকায় আমদানী রপ্তানি কত হয়, তাহার সংখ্যা হয় না। বাষ্পীয় জাহাজ এখানে অনায়াসেই আসিয়া থাকে।’
এই বর্ণনা পড়ে এ-জেলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একটি চিত্র পাওয়া গেল। এখানকার অধিবাসীর মধ্যে সাধারণভাবে এর প্রভাব পড়েছে, যে কারণে এ জেলার মানুষজনের মধ্যে অপার অতিথিপরায়ণতা, আন্তরিকতা ও অন্যান্য সদগুণের বিকাশ হতে পেরেছে। অশ্বিনীকুমারকে নির্মাণ দিয়েছে যে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, তার জলহাওয়ার বৈচিত্র্য আর বিন্যাস জেনে নেওয়া জরুরি। এজন্যই বরিশাল জেলা নিয়ে আগেভাগে কিছু আলোচনা করে নেওয়া গেল। অশ্বিনীকুমারের অসাম্প্রদায়িকতার পশ্চাৎপট যেমন রচিত হয়েছিল এ-জেলায় বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের দীর্ঘকালের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভেতর। হিন্দু ও মুসলমান তো বটেই, খ্রিস্টানদেরও সম্ভ্রান্ত উপস্থিতি এ-জেলায় লক্ষ করা যায়। পলাশীর যুদ্ধের পরপরই ১৭৬৪-তে একদল ধর্মযাজক রাফেল জ্যা এনজুস-এর নেতৃত্বে বরিশালে আসেন। ১৮৭২-এই দেখা যাচ্ছে, এ জেলার শিবপুরে আটশোজন খ্রিস্টধর্মাবলম্বী। এখানেই বরিশালের প্রথম গির্জা নির্মিত হয়। ১৯০৪-এ অক্সফোর্ড মিশন চার্চ গঠিত হয়, এবং আরও বহু আগে ১৮৪৫-এ রোমান ক্যাথলিক চার্চ স্থাপিত হয়েছিল। অশ্বিনীকুমারের মধ্যে যে প্রবল খ্রিস্টীয় ভাবনা কার্যকর ছিল, তার প্রমাণ খ্রিস্টীয় ভাবাদর্শে সমাজ সেবাকল্পে তাঁর ‘Little Brothers of the Poor’ কিংবা ‘Band of Mery’ আর ‘Band of Hope’ গঠন। খ্রিস্টধর্মের মহিমময় কল্যাণকরতা অশ্বিনীকুমারকে প্রভাবিত করেছে নিঃসন্দেহে।
তেমনি ইসলাম ধর্মকেও মনে-প্রাণে শ্রদ্ধা করতেন তিনি। মুসলমান সম্প্রদায়কে অভিনয়হীনভাবে বিবেচনা করতেন আত্মজনরূপে। অপুত্রক অশ্বিনীকুমার পোষ্যপুত্র নিয়েছিলেন একটি মুসলমান ছেলেকে, কেবল এই তথ্যের ভিত্তিতেই তাঁর ধর্মমোহের কারা ভেঙে ফেলার প্রমাণ পাই আমরা। ইসলাম নিয়ে সুগভীর অধ্যয়ন ছিল তাঁর। এই অনুধ্যানকে নিবিড় করার জন্য তিনি ফার্সি ও উর্দু ভাষা শিখেছিলেন। জালালউদ্দীন রুমি-রচিত ‘মসনবী’, যাকে ভক্ত মুসলমানরা কোরান শরীফের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে মানেন ও পাঠ করে থাকেন, অশ্বিনীকুমার সে-গ্রন্থ পাঠ করেই তৃপ্ত হননি, অনুবাদও করেছিলেন। এছাড়াও তাঁর প্রিয় ছিল হাফেজের কবিতা। হাফেজের কবিতাও অনুবাদ করেন তিনি। পরিতাপের বিষয়, এই অনুবাদগুলি পাণ্ডুলিপি আকারেই রয়ে গিয়েছে, প্রকাশিত হয়নি কোনওদিন।
হিন্দু ধর্ম আর ইসলামের মধ্যে যে মৌলিক কোনও বিরোধ নেই, তাঁর প্রজ্ঞা, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা এবং তাঁর অন্তরের অসাম্প্রদায়িক বোধ তাঁকে এই সত্যে উপনীত করিয়েছিল। তিনি তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘‘A Hindu reads the Quran or the sublime writings of Maulana Rumi or the ecstatic ‘Gazal’ of Hafez, he will wonder at the agreement he will find in the cardinal principles of his religion and of Islam, and in the courses of what is termed ‘Ishq’ by the Mussulmans and ‘Prema’ or ‘Bhakti’ by the Hindus.’’
বরিশাল তথা সমগ্র পূর্ববঙ্গই ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কেন্দ্র। বরিশালে ব্রিটিশ-বিরোধী যে স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার পেছনে একদিকে যেমন ছিল বরিশালবাসীর স্বাধীনচিত্ততা, অন্যদিকে অশ্বিনীকুমারের প্রভাব। অশ্বিনীকুমারের স্বদেশচেতনার বাণীবাহক ছিল প্রাথমিকভাবে তাঁর ছাত্রদল। প্রসঙ্গত, তিনি ছিলেন আদিতে, মধ্যে ও অন্তে একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। তাঁর আমলে সমগ্র বারিশাল জেলা ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে সমগ্র বাংলাদেশেই অগ্রসর। ১৮৯৭-৯৮-এ ‘Government Report on Education’ জানায়, ‘The school is unrivalled in point of discipline and efficiency. It is an institution that aught to serve as a model to all schools, Government or Private.’
মিশনারিদের প্রয়াস, বরিশালে ব্রাহ্ম আন্দোলন এবং সেইসঙ্গে মহাত্মা অশ্বিনীকুমারের শিক্ষাভাবনা, এই তিনে মিলে শিক্ষাক্ষেত্রে বরিশালে অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছিল। স্ত্রীশিক্ষাক্ষেত্রেও অগ্রণী এই বরিশাল, এমনকি অশ্বিনীকুমার যখন ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ, সে-সময় তাঁরই প্রয়াসে সেখানে সহশিক্ষা প্রচলিত হয়েছিল, যা তখন কলকাতার কোনও কলেজে ছিল অভাবিত। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই তৈরি হয়েছিল অগণিত দেশপ্রেমিক, স্বদেশানুরাগী ছাত্র, যাঁরা তাঁদের পরবর্তী জীবনে অনেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনে সর্বস্ব দান করতে কুণ্ঠিত হননি। ছাত্রদের এহেন স্বদেশপ্রীতি সরকারের এতটাই গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠল যে বাংলার ছোটলাট বামফিল্ড ফুলার আদেশ জারি করলেন ব্রজমোহন কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হওয়া কোনও ছাত্র সরকারি চাকরিতে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। আশঙ্কা ছিল, এই দমনমূলক ব্যবস্থার জেরে কলেজে ছাত্রসংখ্যা রাতারাতি শূন্যে এসে ঠেকবে। কেন-না পাশ করে সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা ভোগ করবে, ব্রিটিশ-প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্রদের সামনে একমাত্র স্বপ্ন তো ছিল এটাই। কিন্তু ফুলার বিএম কলেজের ছাত্রদের আগ্নেয় মানসিকতা আর তাঁদের আচার্য অশ্বিনীকুমারের শিক্ষাদানজাত দৃঢ়ব্রত হবার সঙ্কল্পের পাঠ নিতে ভুল করেছিলেন। ছাত্রদের অভিভাবককুলের দৃঢ়চিত্ততাও অজ্ঞাত ছিল ফুলারের। তাই এই অধ্যাদেশ জারির পরেও দেখা গেল, ফুলারের আশায় জল ঢেলে দিয়ে বিএম কলেজের ছাত্রসংখ্যা তো কমল-ই না, বরং তা আগের চেয়ে আরও বেড়ে গেল। দেবপ্রসাদ ঘোষ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় মেধাতালিকায় সেরা হলেন। তিনি পড়তেন ব্রজমোহন কলেজেরই বিদ্যালয় বিভাগে। তাঁকে বৃত্তি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি! তবু আশ্চর্য, ছাত্রসংখ্যা বাড়তে লাগল, কী বিএম স্কুলে, কী কলেজে। শিক্ষক অশ্বিনীকুমারের প্রতি ছাত্রদের অসীম আনুগত্যের ফলেই এমনটা সম্ভব হয়েছিল। পূর্ণমাত্রায় শ্রদ্ধেয় না হয়ে উঠলে এরকম নিরঙ্কুশ আনুগত্য লাভ করা যায় না।
কীভাবে অশ্বিনীকুমার নিজেকে এই আনুগত্যলাভের যোগ্য করে তুলেছিলেন? বরিশালে শিক্ষকতা করার আগেই তাঁর শিক্ষকজীবন শুরু হয়েছিল হুগলির শ্রীরামপুরে। সেখানে তিনি ছিলেন প্রধানশিক্ষক। তিনি তখন সদ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ পাশ করা যুবক। সেই সঙ্গে বিএল ডিগ্রিও ছিল তাঁর। সেই ১৮৮০-র চব্বিশবর্ষীয় অশ্বিনীকুমার ছাত্রদের সঙ্গে নিজেও খেলাধুলোয় অংশ নিতেন। আরও আশ্চর্যের, ছাত্ররা তাঁর কোলে মাথা রেখে গান করত। প্রবেশিকায় বৃত্তি পাওয়া তুখোড় মেধাবী ছাত্র, যাঁর শিক্ষাজীবন কেটেছে রংপুর, কৃষ্ণনগর, বিষ্ণপুর আর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে, যে কলকাতায় তাঁর কলেজজীবনে রাজনারায়ণ বসু, রামতনু লাহিড়ী, রামকৃষ্ণ পরমহংস, কেশবচন্দ্র সেনের মত বিখ্যাতজনদের সান্নিধ্যলাভ ঘটেছে, তিনি বালকদের সঙ্গে এই যে অন্তরঙ্গ হয়ে মিশছেন, এই অন্তরঙ্গতার জোরেই পরবর্তীকালে ছাত্রদের কাছে যথার্থ গ্রহণযোগ্য, শ্রদ্ধেয় আর সর্বাতিশায়ী মান্য হয়ে উঠেছিলেন। গুরু যা কিছুই আজ্ঞা করেন, নির্বিচারে শিষ্য সেই আজ্ঞা পালন করবে, যোগ্য গুরু সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, গুরুরাজ্ঞা হি অবিচারণীয়া। অশ্বিনীকুমার হয়ে উঠেছিলেন তেমনই এক গুরু। রবীন্দ্রনাথ ‘গুরুদেব’ হওয়ার আগেই দেখি গুরু হওয়ার সাধনা শুরু হয়েছিল অশ্বিনীকুমারের, এবং তা শ্রীরামপুরে। শিক্ষকের সঙ্গে নদীতে নৌকায় বাইচ খেলব আর গান গাইব। এমন গুরু কি আমরা সবাই মনে মনে চেয়ে আসিনি? ধন্য সে-সব ছাত্র, যাঁরা অশ্বিনীকুমারের মত, নিবেদিতা-রবীন্দ্রনাথ-বিদ্যাসাগরের মত গুরু পেয়েছিলেন।
আনুগত্য আরও অনেক কারণেই এসেছিল। কোন ছাত্রের কী অভাব, সেই বুঝে তাকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া, ছাত্রের অসুখ-বিসুখে তাকে নিজ হাতে সেবা করা, তাদের সঙ্গে ইতিহাস, সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্ম, এমনকি প্রেম ও পরিণয় নিয়েও অবাধে আলোচনা করা, এ-সবই করতেন তিনি। আমাদের শাস্ত্রেই তো এর অনুমোদন রয়েছে, ‘প্রাপ্তেতু ষোড়শে বর্ষে পুত্রং মিত্রবদাচরেৎ’, অর্থাৎ পুত্র (এবং কন্যাও) ষোল বছরের হলে তার সঙ্গে বন্ধুর মত আচরণ বিধেয়। বন্ধুত্বের মূর্তিমান বিগ্রহই ছিলেন যেন তিনি। কলেজের অধ্যক্ষ বই লিখছেন, যে বইয়ের নাম ‘প্রেম’, ভাবা যায়? ঐশ্বরিক অহেতুকী প্রেম নয়, রক্তমাংসের নারী-পুরুষের জাগতিক প্রেম নিয়ে লেখা গ্রন্থ। নাতিবৃহৎ এই গ্রন্থটি সব দেশের সব ছাত্র-ছাত্রীর অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। জাগতিক প্রেমকে বর্জনীয় মনে করা হয়নি এ গ্রন্থে, বরং প্রেম-ভালবাসাকে প্রেমিক-প্রেমিকার অলঙ্কার হিসেবেই মূল্যায়িত করা হয়েছে। এখানেই বইটির গুরুত্ব ও উপযোগিতা।
শিক্ষাদানের ক্ষেত্র কেবল যে নির্দিষ্ট সিলেবাসেই সীমাবদ্ধ নয়, এবং এজন্য একজন শিক্ষকের দায়িত্ব শিক্ষার ব্যাপকতা জীবনের বৃহত্তর ও সার্বিক স্তরে প্রসারিত করে দেওয়া, ছাত্রের কাছে যথার্থ পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠা, অশ্বিনীকুমারের জীবনদর্শন ছিল তা-ই। কেবল উপদেশে সীমায়িত না থেকে সখ্য ও সৌহার্দের সাহায্যে ছাত্রের মন জয় করতেন তিনি।
ছাত্রদের কাছে নমস্য ছিলেন তিনি তাদের কাছে নম্য হবার গুণে কিন্তু তাই বলে কখনওই নিজের ব্যক্তিসত্তা বিসর্জন দিয়ে নয়। ছাত্রদের মধ্যে তিনি অনুস্যূত করে দিয়েছিলেন, ‘সত্য, প্রেম, পবিত্রতা’-র বোধ, যে তিনটি শব্দ ছিল তাঁর মূলমন্ত্র। ছাত্রদের তিনি এমন এক উচ্চ স্তরের আদর্শে দীক্ষা দিয়েছিলেন যে ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, তাঁর বিদ্যায়তনে পরীক্ষা চলাকালীন কোনও প্রহরা থাকত না! স্বদেশী ও বয়কটের প্রথম উদ্গাতা তিনি-ই। ১৯০৬-এ বরিশালে কংগ্রেসের যে প্রাদেশিক সম্মেলন আহূত হয়েছিল, সেখানে সভাপতি ছিলেন ব্যারিস্টার আবদুল রসূল। যোগদানকারীদের মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণকুমার মিত্র, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ছিলেন ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র সম্পাদক মতিলাল ঘোষ। সুদূর বরোদা থেকে এসে যোগ দিয়েছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। আর ছিল ছাত্রসমাজ, যারা হাসিমুখে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করেছে একদিকে, অন্যদিকে ‘বন্দে মাতরম্’ স্লোগান দিয়েছে গুর্খা পুলিশের লাঠির আঘাত অগ্রাহ্য করে। তবে প্রত্যাঘাত করেনি কোনও ছাত্র, কেন-না অশ্বিনীকুমারের নির্দেশ ছিল অহিংস থাকবার।
১৯০৬-এর ১৪-১৫ (১-২ বৈশাখ ১৩১৩) এপ্রিলের বরিশাল প্রাদেশিক সম্মেলন আজ এক ইতিহাস, কেন-না যে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিকে নিষিদ্ধ করেছিল প্রশাসন, বরিশালে প্রাদেশিক সম্মেলন শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যেই উঠে যায় সেই অধ্যাদেশ। এ খবর এদেশে এসে পৌঁছলে দশ হাজার লোকের মিছিল বেরোয় বরিশাল শহরে, অশ্বিনীকুমারকে পুরোধা করে। যে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চারশো টাকা জরিমানা হয়েছিল সম্মেলন চলাকালীন ‘বন্দে মাতরম্’ উচ্চারণ করায়, তাঁকে এনে সংবর্ধনা দেওয়া হল। সুরেন্দ্রনাথকে যে স্থানে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, অশ্বিনীকুমারের প্রস্তাবমত সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভও স্থাপিত হয়। এই ছিলেন অশ্বিনীকুমার, বরিশালের মুকুটহীন সম্রাট। সুদূর পঞ্জাব থেকে মাদ্রাজ পর্যন্ত তাঁকে ওই নামে অভিহিত করা হত।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলেন তিনি। এখানে উল্লেখযোগ্য, ১৮৮৫-তে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আগে ১৮৭৬-এ যেমন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ‘Indian Association’ গড়ে উঠেছিল, ঠিক একই রকমভাবে ১৮৮৫-তে বরিশালে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়, ‘বরিশাল জনসাধারণ সভা’। উকিল প্যারীলাল রায় ছিলেন এ-সভার সভাপতি আর অশ্বিনীকুমার সক্রিয় সদস্য। এখানকার সদস্যরূপেই তিনি মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত ১৮৮৭-র কংগ্রেসের তৃতীয় অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। ১৮৯৭-এ কংগ্রেসের তৃতীয় অধিবেশনকে (অমরাবতী) তিনি ‘তিনদিনের তামাসা’ বলে ব্যঙ্গ করেন। কেন-না এই বাৰ্ষিক অধিবেশনের মধ্যে তিনি সদর্থক কিছু দেখতে পাননি।
সর্বভারতীয় রাজনীতি ছেড়ে তিনি তাঁর জেলা বরিশালকেই কর্মক্ষেত্র নির্বাচন করেন অতঃপর। ১৯০৫ সালে তাই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বেপথু সময়ে তিনি গঠন করেন ‘স্বদেশবান্ধব সমিতি’। এই সমিতির মত সক্রিয় সমিতি সমগ্র বাংলায় একমাত্র ‘অনুশীলন সমিতি’ ছাড়া আর ছিল না। বরিশাল জেলাতে এই সমিতির ১৭৪টি শাখা দ্রুত গড়ে ওঠে। রাজনীতি ছাড়াও দুস্থের সেবা, দুর্ভিক্ষ ও বন্যায় আর্তত্রাণ, শরীরচর্চার মাধ্যমে দেহকে সুস্থ ও সাবলীল রাখা, গ্রন্থপাঠের অভ্যাস গড়ে তোলা ইত্যাদি ভূমিকা পালন করত এখানকার সভ্যবৃন্দ, যাদের বৃহদংশই ছাত্রসম্প্রদায়।
আদর্শ শিক্ষক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ‘আশ্রমের শিক্ষা’ প্রবন্ধে যা লিখেছিলেন, অশ্বিনীকুমারকে সেই উক্তিটির আলোয় বিচার করলে এই দুই মনীষীর চিন্তার সাদৃশ্য দেখতে পাব আমরা। রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘যে গুরুর অন্তরে ছেলেমানুষটি শুকিয়ে কাঠ হয়েছে তিনি ছেলেদের ভার নেওয়ার অযোগ্য। উভয়ের মধ্যে শুধু সামীপ্য নয়, আন্তরিক সাযুজ্য ও সাদৃশ্য থাকা চাই, নইলে দেনা-পাওনায় নাড়ীর যোগ থাকে না।’ ছাত্রদের সঙ্গে এই নাড়ির যোগটি ছিল অশ্বিনীকুমারের। আজীবন বিদ্যা দান করেছেন, বিদ্যা বিক্রয় করেননি কোনওদিন। ব্রজমোহন কলেজে তাঁর দীর্ঘ পঁচিশ বছর অধ্যক্ষতার সময় তিনি বেতন নেননি কখনও। উপরন্তু তিনি পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা দান করে গিয়েছেন কলেজকে। তাছাড়া কত ছাত্রের যে বেতন যুগিয়েছেন, নিজ হাতে সেবা করেছেন, বই ও টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেছেন, তার লেখাজোখা নেই।
রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন যেমন ঔপনিষদিক আবহে নির্মিত, সেখানকার উপাসনালয়ের গেটে যেমন ‘আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি’ লেখা দেখি বা ‘তিনি আমার আত্মার আনন্দ’ যেমন ধ্রুবপদ ছিল তাঁর, অশ্বিনীকুমারেরও তেমনি চালিকাশক্তি ছিল, ‘সত্য, প্রেম, পবিত্রতা’। তাঁর প্রত্যেক শিষ্যের মধ্যে এই তিন গুণের তাৎপর্য ও বার্তা তিনি জারিত করে দিতে চেয়েছিলেন। এবং তা এত গভীর সঞ্চারী হয়েছিল যে তা ভাবলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। তাই এখান থেকে পাশ করা কোনও ছাত্র যে সমাজে শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র হবে, সে তো স্বতঃসিদ্ধ। লাহোর থেকে গৌহাটি পর্যন্ত এমন কোনও কলেজ ছিল না, যেখানে ব্রজমোহন কলেজের কোনও না কোনও ছাত্রকে অধ্যাপনা করতে দেখা যায়নি। অশ্বিনীকুমার দত্তের জীবনীকার ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ সেন লিখেছেন, ‘সমগ্র বাঙ্গালায় এমন একটি বিদ্যালয়ও ছিল না, যেখানে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের ছাত্ররা শিক্ষকতা করে নাই।’
‘প্রেম’ নামে যে গ্রন্থটির কথা আগে বলা হয়েছে, সে-বইটি নিয়ে একটু আলোচনা করা জরুরি। এ গ্রন্থে স্বদেশপ্রেম, বন্ধুপ্রীতি, ঈশ্বরপ্রেম যেমন আছে, তেমনি নর-নারীর প্রেম নিয়েও আলোচনা রয়েছে।
এই সামগ্রিক প্রেমের ব্যাপ্তি বোঝাতে গিয়ে অশ্বিনীকুমার গ্রন্থটিতে যে-ক’টি নিশানাকে প্রেমের স্বরূপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, সেগুলি হল, ১. আনন্দ, ২. নবত্ব, ৩. নিত্যত্ব, ৪. উচ্চত্ব, ৫. ব্যাপ্তিত্ব এবং ৬. স্বার্থরাহিত্য। বস্তুত, অশ্বিনীকুমারের জীবনের এই প্রেম ছিল তাঁর জীবনবর্তিকা যা তিনি তাঁর সামগ্রিক জীবনের বিচিত্র কর্মমুখিনতায় সঞ্চার করে দিয়েছিলেন। তাঁর স্বদেশ হিতৈষণা এই প্রেমজাত, আর্তত্রাণে বারবার তাঁর মহতী ভূমিকার পিছনেও রয়েছে এই প্রেম, অর্থাৎ মানবপ্রীতি। ইচ্ছে করলে বরিশাল ছেড়ে আরও বৃহত্তর মানচিত্রে নিজেকে স্থাপন করতে পারতেন কিন্তু বরিশালের প্রতি প্রীতিবশতই তাঁর যৌবনের উপবন আর বার্ধক্যের বারানসী হয়ে রইল এই বরিশাল। প্রখ্যাত লেখক (‘মহারাষ্ট্র জীবনপ্রভাত’, ‘রাজপুত জীবনসন্ধ্যা’, ‘The Economic History of India’) ও একদা বরিশালের ম্যাজিস্ট্রেট রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁকে বলেছিলেন, নাম করতে চাইলে যেন তিনি কলকাতায় বাস করেন, আর কাজ করতে চাইলে বরিশালে। নিজের জেলাকে হাতের তালুর চিনে নিয়ে বরিশালে রয়ে গেলেন তিনি আর তৈরি করলেন অগণিত ইস্পাত, যাঁদের কল্যাণে দুর্গতিমোচন হয়েছিল অনেকটা।
কেবল ছাত্ররাই নয়, দেশের মনীষী ও শিক্ষাব্রতীরাও এই নির্ভীক অন্তিম পর্যন্ত সততার প্রতিমূর্তি মানুষটিকে শ্রদ্ধা করতেন। ১৯০৮-এ অশ্বিনীকুমারকে জেলে যেতে হয়। এক বছর বাদে তাঁর কারামুক্তির প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল ভগিনী নিবেদিতার? প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণা তাঁর রচিত ‘ভগিনী নিবেদিতা’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসে (১৯১০) অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রভৃতি নির্বাচিত নয়জন নেতা মুক্তিলাভ করলেন। নিবেদিতার সেদিন কী আনন্দ! বিদ্যালয় গ্রন্থাগারে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের চিহ্নস্বরূপ পূর্ণকুম্ভ ও কলাগাছ রাখা হইল এবং আনন্দের দিন বলিয়া বিদ্যালয়ে মেয়েদের ছুটি দেওয়া হইল।’ হ্যাঁ, ঠিক এইভাবেই এক বিদ্যাদাত্রী অন্য এক বিদ্যাদাতাকে সেদিন সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সম্পর্কে লিখছেন, ‘He organized the whole district for the Swadeshi Movement। অন্যদিকে বিপিনচন্দ্র পাল তাঁর সম্পর্কে শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন একইভাবে, ‘In Aswini Kumar, we have a most convincing proof of the profound spirituality of the Nationalist Movement in Bengal. সুরেন্দ্রনাথ এবং বিপিনচন্দ্র একজন নরমপন্থী, অন্যজন চরমপন্থী। কিন্তু দু’জনেই অশ্বিনীকুমারের প্রতি সমান শ্রদ্ধাবনত। ঐতিহাসিক ড. সুমিত সরকার The Swadeshi Movement in Bangal গ্রন্থে সম্পর্কে তাঁর সম্পর্কে যা বলেছেন, তা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘অশ্বিনীকুমারের ব্যক্তিত্ব অরবিন্দের মত অগ্নিশিখার স্ফুলিঙ্গ না হলেও তিনি যে গণভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তার নজির স্বদেশী যুগের আর কোনও নেতার মধ্যে পাওয়া যায় না।’
অশ্বিনীকুমার ছিলেন বেশ কিছু গ্রন্থের প্রণেতা, ‘কর্ম্মযোগ’, ‘ভক্তিযোগ’, ‘দুর্গোৎসবতত্ত্ব’ ইত্যাদি গ্রন্থ ছাড়াও বেশ কিছু সঙ্গীত রচনা করেছিলেন তিনি। নানা সময়ে দেওয়া তাঁর কিছু ইংরেজি-বাংলা ভাষণও সঙ্কলিত হয়েছে। গ্রন্থকাররূপেও যে তিনি কতখানি সার্থক ছিলেন, তার প্রমাণ, স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘ভক্তিযোগ’ পাঠ করে লিখছেন, ‘আমার বিশ্বাস যে, এরূপ উৎকৃষ্ট গ্রন্থ বাঙ্গালা ভাষায় সম্প্রতি দেখি নাই অথবা বাঙ্গালা ভাষায় অল্পই দেখিয়াছি।’ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত, ‘আমার ধ্রুব বিশ্বাস যে, আপনার পুস্তক পাঠে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই বিশেষ উপকৃত হইবেন।’ মনীষী রাজনারায়ণ বসুও এ গ্রন্থ পাঠে মুগ্ধ হয়ে না বলে পারেননি। ধর্মের সঙ্কীর্ণতা নয়, উদারতার পরিচয় রেখেছেন লেখক, রাজনারায়ণের সন্তোষ এ-জন্য, ‘তুমি কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য এই গ্রন্থ লিখ নাই, সকল সম্প্রদায়ের জন্য লিখিয়াছ, ইহা আমার বিশেষ সন্তোষের কারণ হইয়াছে।… তুমি যেখানে ঈশ্বর প্রেমের বিষয় লিখিয়াছ সেই সকল স্থান অমৃত।’ রেভারেন্ড স্টপফোর্ড ব্রুকের মন্তব্যটি একটু দীর্ঘ। তবু প্রাসঙ্গিক বলে উদ্ধার না করে পারা গেল না, ‘Since I have read, I have been in another world than this noisy world of the west, where we spend our days in pursuing nothing which we think everything… the little stories which illustrate your points of thought and pratice are of great interest, and I am personally delighted with the quotations from the poets of India. The life of that great country is made clearer and nearer to me.’
একটিমাত্র গ্রন্থ নিয়ে বিদগ্ধজনের এ সমস্ত প্রশস্তিবাক্য একথাই প্রমাণ করে, অশ্বিনীকুমার যদি লেখালেখিতে আরও অধিক মনোনিবেশ করতেন, তাহলে তাঁর হাত দিয়ে আমরা আরও আরও অমৃতপ্রতিম প্রসঙ্গ পেতে পারতাম। কিন্তু তাঁর জীবনের একটি প্রধান অংশ ব্যয়িত হয়েছে ছাত্র গঠনে, এবং তার পাশাপাশি সমাজসেবায়। রাজনৈতিক কার্যকলাপ ক্রমশ পেছনে পড়ে গেছে, যদিও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভারতের রাজনীতির সঙ্গে কমবেশি যোগ ছিল তাঁর। ১৯১৭-তে ভগ্নস্বাস্থ্যের দরুন তিনি যখন কাশীবাস করছিলেন, সে সময় কংগ্রেসের বেনারস অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯১৯ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে লালা লাজপত রায়কে সভাপতি করে কলকাতায় এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিলেন। গান্ধী এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র এসেছিলেন বরিশালের বাটাজোড়ে মহাত্মা অশ্বিনীকুমারের সঙ্গে দেখা করতে। ছাত্রবয়সে কলকাতায় রামকৃষ্ণদেবের দক্ষিণেশ্বরে যে একাধিকবার গিয়েছেন, সেখানে নরেনকে দেখলেও আলাপ হয়েছিল দীর্ঘদিন বাদে আলমোড়ায়, ১৮৯৭-এ। অশ্বারোহী স্বামীজিকে দেখে বিমুগ্ধ অশ্বিনীকুমার। তাঁকে ‘স্বামীজি’ সম্বোধন করায় স্বামীজি বাধা দিয়ে বলেছিলেন, ‘সে কি? আপনার কাছে আমি কবে স্বামী হয়ে উঠলাম, আমি এখনও সেই একই নরেন্দ্র।’ অর্থাৎ স্বামীজির কথায় ১৮৮৫-র প্রতিধ্বনি, যেদিন দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণসকাশে দু’জনের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল।
এসব লিপিবদ্ধ রয়েছে স্বামী গাম্ভীরানন্দ প্রণীত ‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’-এ। এরপর এই দুই মনীষীর যে কথোপকথন, সেখানে এক দিকে যেমন দেখি স্বামীজির অশ্বিনীকুমার সম্বন্ধে, তাঁর বর্তমান শিক্ষাদাতারূপে কার্যকলাপ সম্পর্কে তথ্য জানা রয়েছে, অন্যদিকে এ-দুজনের শিক্ষাভাবনার সমীপবর্তিতা। জাতীয় কংগ্রেস নিয়েও স্বামীজির ক্ষোভ এখানে স্পষ্ট। ‘আপনি বলতে পারেন কংগ্রেস জনসাধারণের জন্য এ পর্যন্ত কী করেছে? আপনি কি মনে করেন, গোটাকয়েক প্রস্তাব নিলেই স্বাধীনতা এসে যাবে?’
তারপর শিক্ষাদর্শন সম্পর্কে স্বামীজির উক্তি, ‘আপনার ছাত্রদের চরিত্র বজ্রদৃঢ় করে গড়ে তুলুন। বাঙালি যুবকদের হাড় থেকেই তৈরি হবে সে বজ্র যা ভারতের দাসত্বকে চূর্ণ করবে।’ তারপর তিনি আনলেন অদ্ভুত মুচি মেথরদের কথা, আজকে যাদের ব্রাত্য, দলিত, অপর বলা হয়, পারিভাষিকভাবে নিম্নবর্গ, সাব-অলটার্ন। ‘তাদের মধ্যে স্কুল বসান, আর তাদের গলায় পৈতে ঝুলিয়ে দিন।’ স্বামীজির চেয়ে আট বছর বয়সে বড় অশ্বিনীকুমার, জ্যেষ্ঠকে তবু উপদেশ দিচ্ছেন! তবে তাঁকে যে উপদেশ দেবার দরকার করে না, স্বামীজি জানতেন না। গোপাল নামে এক মেথরকে বিষ্ঠার ভার মাথায় অবস্থায় একদিন আলিঙ্গন করে লোকচক্ষুর অন্তরালেই তিনি অস্পৃশ্যতাবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। এক শিখ দারোয়ানের ধর্মবিশ্বাস যাতে আহত না হয়, সেজন্য তাঁর নিত্যপাঠ্য ‘গ্রন্থসাহেব’ রেখেছিলেন গদি তৈরি করে তার ওপর। অজ্ঞাতকুলশীল এক মুসলমান রাস্তায় রক্তবমি করছে, নিজের পিঠে করে তাকে বয়ে আনলেন চিকিৎসকের কাছে। বহুরূপে সম্মুখে পেয়ে ভগবানকে মানুষের নারায়ণকে এইভাবেই অশ্বিনীকুমার সেবা করে গেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বরিশালে। সেখানকার জমির অধিকাংশের মালিক ঢাকার নবাব। তবু ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের দুরূহ লগ্নে নবাবের হাটে যখন বিলেতি দ্রব্য মিলছে, অশ্বিনীকুমার হুকুম দেন নদীর অপর পারে হাট বসাবার। ফলে নবাবের পুরনো হাট ক্রেতাশূন্য। নবাবের কর্মচারীরা অবাক। তারা জানতে চাইল, ‘কী আশ্চর্য! তোমরা মুসলমান! তোমরা একটা হিন্দুর হুকুমে নবাবের হুকুম অমান্য কর!’ উত্তর এল, ‘আপদে-বিপদে আমাদের খবর রাখেন বাবু। আকালের সময়ে ক্ষুধার অন্ন পাঠাইয়া দেন তিনি। গ্রামে ওলাওঠা লাগিলে ঔষধ ও চিকিৎসক পাঠাইয়া দেন তিনি। এতকাল তো কই নবাবসাহেব আমাদের সুখ-দুঃখের খোঁজ রাখেন নাই। আজ তাঁহার হুকুমে বাবুর বুকে ব্যথা দিলে খোদা নারাজ হইবেন।’ একথা জানলে বোঝা যায়, কতখানি ঈশ্বরপ্রতিম ছিলেন অশ্বিনীকুমার।
ঈশ্বরপ্রতিম-ই তো। বরিশালের মানুষ তাঁর বাড়ির প্রথম ফলটি অশ্বিনীকুমারকে নিবেদন না করে পারতেন না। গোরু বিয়োলে তার প্রথম দিনের দুধ যেত তাদের প্রিয় ‘বাবু’-র বাড়িতে। ১৯০৮-এ তিনি যেদিন গ্রেপ্তার হলেন, বরিশালবাসী অরন্ধন পালন করেছিলেন। জনৈক মিষ্টিবিক্রেতা দু’দিন উপবাসী ছিলেন। একজন মুসলমান তাঁর মুক্তিকামনায় রমজান মাসের রোজা আরও দশদিন প্রলম্বিত করেছিলেন। আর তাঁর কারাবাসের চোদ্দ মাস এক ব্রাহ্মণ প্রতিদিন ১০৮টি তুলসীপাতা নারায়ণকে নিবেদন করতেন। দু’দিন উপোস করেছিলেন যে মিঠাইওয়ালা, উত্তর ভারতের লোক ছিলেন তিনি। অশ্বিনীকুমারের মুক্তির জন্য পুরি-তরকারিও মানত করেছিলেন।
এসব কিংবদন্তি নয়, লিখিত ইতিহাস। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সুরেন্দ্রনাথ সেন, অশ্বিনীকুমারের অন্যান্য জীবনীকার যেমন শরৎকুমার রায়, সুরেশচন্দ্র গুপ্ত, তপংকর চক্রবর্তী প্রমুখের লেখার মধ্য দিয়ে সুচারুভাবে চিত্রিত হয়েছেন তিনি। ‘বরিশালের ইতিহাস’ প্রণেতা সিরাজউদ্দীন আহমেদ তাঁর বইয়ে বাটাজোরে অশ্বিনীকুমার দত্তের বংশলতিকা প্রকাশ করেছেন। তাঁর সম্পর্কে বহু তথ্য পাই এ গ্রন্থে। যেমন অশ্বিনীকুমার দত্ত ছিলেন ব্রজমোহন-প্রসন্নময়ী দম্পতির জ্যেষ্ঠ পুত্র। তাঁর অপর দুই সহোদর যথাক্রমে কামিনীকুমার এবং যামিনীকুমার। বরিশালের অন্যতম সমাজসেবী রাজনীতিবিদ মহিলা ফুলরেণু গুহ ছিলেন অশ্বিনীকুমারের জ্ঞাতি। অশ্বিনীকুমারের বিবাহ হয়, নথুল্লাবাদের মীরবহর পরিবারের সরলাবালার সঙ্গে ১৮৭২ সালে, তিনি যখন সবে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ পাশ করেছেন। কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে তিনি বিএ পাশ করেন। আর এমএ পড়তে আসেন ফের প্রেসিডেন্সিতে। বিএল-ও হয়েছিলেন তিনি। কৃষ্ণনগর জেলা স্কুলে ও পরে শ্রীরামপুরের একটি বিদ্যালয়ে প্রধানশিক্ষকরূপে কাজ করে তিনি বরিশাল ফিরে গিয়ে ওকালতি ব্যবসায়ে যুক্ত হন। অচিরেই তিনি উপলব্ধি করেন, নৈতিকতা বজায় রেখে এ পেশায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না। ১৮৮৪-র ২৭ জুন তিনি বিদ্যালয় স্থাপন করে সেখানে পড়ানো শুরু করেন। ১৮৮১-র ১৪ জুন স্থাপন করেন পিতার নামে ‘ব্রজমোহন কলেজ’, সংক্ষেপে বিএম কলেজ। প্রসঙ্গত, তাঁর পিতা ব্রজমোহন দত্ত ছিলেন পেশায় মোক্তার। তিনি নিজেও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন।
অশ্বিনীকুমারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল সারস্বত সমাজের এক আলোকিত বলয়— রজনীকান্ত গুহ, জগদীশ মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (পরবর্তীকালে স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী), সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারিণীকুমার গুপ্ত (পেশায় চিকিৎসক), মনোমোহন চক্রবর্তী (বরিশাল ব্রাহ্মসমাজের প্রচারক। উল্লেখ্য, অশ্বিনীকুমার ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। পরে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর কাছে মন্ত্র নিয়ে পুনরায় হিন্দু সমাজে ফিরে আসেন), নিশিকান্ত বসু (চিকিৎসক এবং গ্রামাঞ্চলে স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে প্রোৎসাহী), নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত (এই বিস্মৃত স্বদেশপ্রেমী বিএম স্কুলের গোড়ার দিকের ছাত্র। বরিশালে জনহিতকর কাজে অগ্রণী, শিক্ষাবিদ। ১৯২১-এ অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে পেনশন বর্জন করেন। শেষজীবনে রাঁচীতে ছিলেন। ‘দেশ’, ‘যুগশঙ্খ’ ইত্যাদি পত্রিকায় খেড়িয়া, হরিজনদের নিয়ে লিখতেন মহাশ্বেতা দেবীর অনেক পূর্বে), রামচন্দ্র দাশগুপ্ত (স্বদেশী গান রচয়িতা। ‘জাগরণ’, ‘দৈববাণী’, ‘দীক্ষা’ নামে বই আছে তাঁর), দুর্গামোহন সেন (বরিশাল থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বরিশাল হিতৈষী’-র সম্পাদক। স্বদেশী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী), মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা (স্বদেশী আন্দোলনে ১৯০৭-এ দেশের পূর্ণ স্বাধীনতার সপক্ষে বলতে গিয়ে জানান, ‘We want a warrior class and not a race of shop-keepers in Bengal.’ গিরিডি ও কোডারমায় অভ্রখনি ছিল বলে ডিনামাইটের পারমিট পেতেন। সেখান থেকে বারীন্দ্রনাথ ঘোষকে ডিনামাইট দিয়েছিলেন। ব্রিটিশের কোপে পড়ে রেঙ্গুনের কারাগারে প্রেরিত হন। এ সময় খনির মালিকানা চলে গিয়ে সর্বস্বান্ত হন) এঁদের মধ্যে কতিপয়। অশ্বিনীকুমার যাঁকে নিকটতম জন হিসেবে পেয়েছিলেন, ব্রজমোহন স্কুল ও একই সঙ্গে কলেজের শিক্ষক জগদীশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্কল্প ছিল, বাবা হবেন না, দীক্ষাগুরু হবেন না, গ্রন্থকার হবেন না। অন্যদিকে বিএম কলেজের অধ্যক্ষ রজনীকান্ত গুহ বাংলা ছাড়াও গ্রিক, ল্যাটিন, ইংরেজি, সংস্কৃত আর ফারসি ভাষা জানতেন। মূল গ্রিক ভাষা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সুবিশাল দুই খণ্ডে তিনি সক্রেটিসের জীবনী লেখেন, যা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ করেছিল। তাঁর লেখা ‘আন্টোনিয়াসের আত্মচিন্তা’ আর ‘সম্রাট মার্কাস অরোলিয়াস’-ও দুটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। বিখ্যাত আয়ুর্বেদীয় গ্রন্থ প্রকাশক, ঔষধ প্রস্তুতকারক উপেন্দ্রনাথ সেনকেও এই বলয়ে আমরা দেখি, যিনি ওই সময়ে দাঁড়িয়ে একদিকে স্বদেশী আন্দোলনে অংশ নেন, ‘বেঙ্গলী’ ও ‘হিতবাদী’ পত্রিকার উন্নতিবিধানে সচেষ্ট হন, ‘বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল’ পরিচালনা করেন ও সর্বোপরি অসবর্ণ বিবাহের সমর্থনে পালন করেন সক্রিয় ভূমিকা। উল্লেখ্য, প্রায় একই সময়ে দাঁড়িয়ে সুদূর মাদ্রাজে বিখ্যাত তামিল কবি সুব্রাহ্মণ্য ভারতীও জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছিলেন।
ছাত্রদের তিনি বন্ধুর মত ভালবাসতেন, তবে কোথাও বিলাসিতা দেখলে তা বরদাস্ত করতেন না। বিলাসিতার জন্য এক ছাত্রকে তিনি ট্রান্সফার সার্টিফিকেট পর্যন্ত দিয়েছিলেন, তাঁর আদর্শনিষ্ঠা ছিল এতটাই কঠোর। এর বহুকাল পরে মাদ্রাজ কংগ্রেস থেকে ফেরার পথে পুরীতে এক যুবক তাঁকে আপ্যায়ন করেন। বরিশাল ফিরে তিনি পত্র পান, ‘তেরো বছর আগে বিলাসিতার জন্য আপনি যাকে কলেজ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন, আমি সেই। আপনার ভর্ৎসনায় আমার চৈতন্য হয়। আপনি জেনে সুখী হবেন যে আমি বিলাসিতা একদম বর্জন করেছি।’ শাস্তিদানের সদর্থক দিকও তাহলে আছে!
১৯০৮ সালে অশ্বিনীকুমার ও সেইসঙ্গে ময়মনসিংহের কৃষ্ণকুমার মিত্র (যিনি ১৯০৬-এ বরিশাল জেলা কংগ্রেসের অন্যতম নেতা) গ্রেপ্তার হলেন সম্ভবত আলিপুর বোমা মামলার সূত্র ধরে। ধৃত প্রায় সকলেরই দ্বীপান্তর হলেও অরবিন্দ-সহ তাঁদের দু’জনকেই ছেড়ে দেওয়া হয়। চরমপন্থী রাজনীতি করিয়েদের দলে ছিলেন তিনি, এ থেকেই তা অনুমিত হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘স্বদেশবান্ধব সমিতি’-র বহু সদস্যই চরমপন্থায় বিশ্বাসী। চরমপন্থা, এবং তার সঙ্গে অসাম্প্রদায়িকতা, এই দুই বৈশিষ্ট্যে অন্বিত ছিল তাঁর ‘স্বদেশবান্ধব সমিতি’। সে-সময়কার, আরও বহু সমিতি, যেমন ময়মনসিংহের ‘সাধনা ও সুহৃদ সমিতি’, ফরিদপুরের ‘ব্রতী সমিতি’, ঢাকার ‘মুক্তিসঙ্ঘ’, পুলিনবিহারী দাসের ‘ঢাকা অনুশীলন সমিতি’ কার্যকর ছিল। অধ্যাপক সুমিত সরকার জানিয়েছেন, পুলিনবিহারী দাসের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ছিল। তিনি লিখছেন, ‘পুলিনবিহারী দাস-প্রতিষ্ঠিত ঢাকা অনুশীলন গোড়া থেকেই তার কাজকর্ম কেন্দ্রীভূত করেছিল শরীরচর্চা আর হিন্দুত্বের আচারে আবিল শপথের মাধ্যমে কর্মীদলের গুপ্ত প্রশিক্ষণে।’ আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে স্বদেশী প্রচারে এই সাম্প্রদায়িকতা-সঙ্কীর্ণতা দেখেই রবীন্দ্রনাথ ‘ব্যাধি ও তার প্রতিকার’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না।’ আমাদের মূল সমস্যা হল, ‘আমরা শিক্ষিত কয়েকজন এবং আমাদের দেশের বহুকোটি লোকের মাঝখানে একটা মহাসমুদ্রের ব্যবধান।’
যা হোক, অশ্বিনীকুমারের ‘স্বদেশবান্ধব সমিতি’ কিন্তু সালিশি সভা বসিয়ে মামলা-মোকাদ্দমা দ্রুত মিটিয়ে দেবার দায়িত্বও নিয়েছিল। এতে একদিকে বিবাদের দ্রুত নিষ্পত্তি হত, অন্যদিকে অর্থব্যয় থেকে বাদী-বিবাদী বেঁচে যেত।
অশ্বিনীকুমারের গড়া অন্য একটি প্রতিষ্ঠান হল, ‘বরিশাল সেবা সমিতি’। এর জন্মলগ্ন ১৯০৭। কলকাতায় গড়ে ওঠে এটি। উদ্দেশ্য, বরিশাল-আগত ছাত্রদের পরিষেবা দেওয়া, শিক্ষাদান প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে সহায়তা দান, চিকিৎসার জন্য আগতদের যথাযোগ্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। পরবর্তীকালে আরও বহুবিধ কর্মধারা যুক্ত হয় এর সঙ্গে। সেগুলির মধ্যে প্রধান হল এই সমিতির প্রকাশনা হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বানারিপাড়ার ভূমিপুত্র শ্রদ্ধেয় যতীন্দ্রনাথ ঘোষের উদ্যোগে ও কর্মতৎপরতায় গড়ে ওঠে এই প্রকাশনা। তাঁর একক প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয় একশোর মত বই। সুরেন্দ্রনাথ সেন রচিত মহাত্মা অশ্বিনীকুমারের জীবনী-সহ বেশ কয়েকজন বরিশালবাসীর জীবনীগ্রন্থমালা প্রকাশ করেছেন; যেমন যতীন্দ্রনাথ, তেমনি জেলার কংগ্রেসের বিবরণী, যা মূল্যবান ঐতিহাসিক তথ্যের আকর। রজনীকান্ত গুহ-রচিত আত্মজীবনীও এই প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। অশ্বিনীকুমার দত্ত রচনাবলিও তাঁরই উদ্যোগে বেরোয়, যদিও অন্য প্রকাশনা থেকে (‘অধ্যয়ন’)। রচনাবলির ভূমিকা লেখেন যতীন্দ্রকুমারের অগ্রজ মণীন্দ্রকুমার ঘোষ। মণীন্দ্রকুমারের পুত্র কবি শঙ্খ ঘোষ, যতীন্দ্রকুমারের ভ্রাতুষ্পুত্র। ‘সেবা’ নামে একটি সাময়িকপত্রও প্রকাশিত হত যতীন্দ্রকুমারের উদ্যোগে। তাঁর প্রয়াণের পর পত্রিকাটির প্রকাশ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। যতীন্দ্রকুমারের নিষ্ঠা, তামাম কলকাতা ঘুরে উদ্বাস্তুদের সুলুকসন্ধান, বহু মানুষকে দিয়ে লেখানো, এসব দেখে মনে হত তিনি যথার্থ অর্থেই ছিলেন পরার্থপরায়ণ। যতদিন সুস্থ ছিলেন, কলকাতা পুস্তক মেলায় স্টল দিতেন ‘বরিশাল সেবা সমিতি’-র, জল ও বাতাসা দিয়ে আগন্তুকমাত্রকে আপ্যায়ন করতেন। চিরকুমার যতীন্দ্রকুমার ঘোষ চিরায়ত বরিশালের আন্তরিকতা-আতিথেয়তার প্রতিমূর্তি। বরিশালের কোনও-না-কোনও কৃতী ব্যক্তিকে সম্মান জানানো, বিজয়া সম্মেলনীর আয়োজন করা, বার্ষিক পিকনিকের আয়োজনের মাধ্যমে অতীত বরিশালবাসীদের মধ্যে যোগাযোগের সুযোগ দিতেন। এখন তার রেশ মিইয়ে গেছে।
কেবল কলকাতাতেই তিন-তিনটে অঞ্চলের অশ্বিনীকুমারের নামে। টালিগঞ্জে রয়েছে অশ্বিনীনগর, রয়েছে গড়িয়াহাটে ট্র্যায়াঙ্গুলার পার্কে (এখানে ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের একটি বাড়ি রয়েছে), এবং বাগুইআটিতে। কলকাতায় প্রয়াত তিনি, ১৯২৩-এর ৭ নভেম্বর। কেওড়াতলা শ্মশানঘাটে তাঁর একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে।
অশ্বিনীকুমারের যুগ আজকের, কতই তফাত! তিনি যে জীবনাদর্শ রেখে গিয়েছেন আমাদের সামনে, তা যদি অনুসরণ করতে পারি আমরা, মানুষ হিসেবে, জাতি হিসেবে আমরাই সমৃদ্ধ হব। তাঁর পিতা তাঁকে বলেছিলেন, যেখানে থাকবে, প্রধান হয়ে থাকবে; জুলিয়াস সিজারেরই যেন বাক্যবন্ধ এটি— ‘I shall rather be the first man in a village than the second in Rome.’
অশ্বিনীকুমার লিখেছেন, ‘দধীচি তাঁহার অস্থি দান করিলে দেবতাগণ জয়ী হইতেন না। আমরাও আমাদিগদের হৃদয়ের উদ্যম ও ধৈর্য দ্বারা আধ্যাত্মিক তত্ত্ব নির্মাণ করিব, তাহা দ্বারাই এই সংগ্রামে জয়লাভ করিব।’ অশ্বিনীকুমারের ‘এই সংগ্রাম’ কিন্তু ফুরোয়নি এখনও, যেন মনে রাখি।
খুব সুন্দর এবং তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। অনেক ধন্যবাদ। কেবল ‘গুরুরাজ্ঞা’ সংস্কৃত শব্দটি ভুল। কারণ, ‘গুরু’ শব্দের প্রাতিপদিকে বিসর্গ নেই। সম্ভবত ‘আজ্ঞা গুরুণাং হ্যবিচারণীয়া’ হবে।