গতবছরই তাঁর জন্মের একশো বছর পেরিয়ে এসেছি। কর্ণাটকে (তখন মহীশূর) মাইসোরের কাছে নাঞ্জানগাড নামে একটি জায়গায় প্রগতিশীল, শিক্ষিত এবং সংস্কৃতিসম্পন্ন এক পরিবারে রাজেশ্বরীর জন্ম। সেসময়ের আর পাঁচটা পরিবার যেমন, তেমনই একান্নবর্তী পরিবার ছিল। দেখে নেওয়া যাক কেমন ছিল সেই পরিবার। যে কথা পরে রাজেশ্বরী নিজেই লিখেছেন, সেখান থেকেই পড়ে নেওয়া যাক। ‘ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স’ প্রকাশিত ‘লাকি টু বি হোয়ের আই অ্যাম’ শীর্ষক রচনাটি যে বাক্যগুলি দিয়ে শুরু হয়েছে, তা পড়লেই সে কথা জানা যায়। ‘‘১৯২২ সালের জানুয়ারিতে একটি প্রগতিশীল এবং সংস্কারমুক্ত পরিবারে জন্ম হয়েছে আমার। না, রুপোর চামচ মুখে দিয়ে জন্ম হয়নি আমার, বরঞ্চ নিশ্চিতভাবে বলা যায় জন্ম হয়েছিল ‘বই’ হাতে।”
রাজেশ্বরীর ঠাকুমা, কমলাম্মা দাসাপ্পার কথা উল্লেখ করতেই হয়। তিনি ছিলেন সে সময়ের একজন স্নাতক। ছিলেন একজন সমাজসংস্কারকও। ভারতবর্ষের মেয়েদের বিশেষত কম বয়সে বিধবা এবং দুস্থ মেয়েদের যাতে পড়াশোনা করতে কোনও অসুবিধা না হয়, তার জন্যে তিনি ছিলেন সচেষ্ট। মহিলাদের উন্নয়নের জন্যে নানান উদ্যোগের পাশাপাশি মেয়েদের পড়াশোনা করার জন্যে কমলাম্মা একটি স্কুল স্থাপনও করেছিলেন। ঠাকুমার প্রতিষ্ঠা করা ‘স্পেশাল ইংলিশ স্কুল’-এ রাজেশ্বরীর প্রাথমিক বিভাগের পড়াশোনা শুরু হয়েছিল।
‘সেন্ট্রাল কলেজ অফ ব্যাঙ্গালোর’ থেকে গণিত নিয়ে বিএসসি এবং এমএসসি পাশ করেন রাজেশ্বরী। দুটি পরীক্ষাতেই মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেন রাজেশ্বরী। এরপর Indian Institute of Science (IISc)-এ সি ভি রামনের কাছে গবেষণা করার জন্যে আবেদন করলেন। কিন্তু রাজেশ্বরীর ফিজিক্সে ডিগ্রি না থাকায় রামনের গবেষণাগারে কাজ করার সুযোগ পেলেন না। ড. রামন যেহেতু তাঁর গবেষণাগারে কোনও ছাত্রী নিতেন না, সেই কারণে কেউ কেউ মনে করে থাকেন যে, রাজেশ্বরীর ক্ষেত্রে ‘পদার্থবিদ্যা’ না পড়ার জন্যে নয়, আদতে মেয়ে বলেই তাঁকে নেওয়া হয়নি। যাইহোক, পরে প্রচুর বিতর্কের পরে IISc-এ ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজি ডিপার্টমেন্টে কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয় নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পেলেন রাজেশ্বরী।
রাজেশ্বরী যে সময়ে লেখাপড়া করেছেন তখন উচ্চশিক্ষার জগতের দরজায় প্রবেশ করা বিশেষ করে মেয়েদের পক্ষে মোটেই সহজ ছিল না। আর বিষয় হিসেবে যদি তা বিজ্ঞান বা ইঞ্জিনিয়ারিং হয়, সেক্ষেত্রে তো শুধু একচেটিয়া ছেলেদেরই অধিকার। তবু লিঙ্গবৈষম্যের আবহের মধ্যেও কমলা সাহানি, আন্না মানি বা এ ললিতা কিংবা বিভা চৌধুরীর মত মেধাবী মেয়েরা বাধার প্রাচীর ভেঙে পথ করে নিয়েছেন এগিয়ে যাওয়ার। সেরকমই আর এক উজ্জ্বল প্রতিভা রাজেশ্বরী চট্টোপাধ্যায়। উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার জগতে তাঁকেও নানান বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আর সেই অভিজ্ঞতার কারণেই পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষে মহিলা বিজ্ঞান এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়াদের পথচলার রাস্তা মসৃণ করে তুলতে সক্রিয় ছিলেন রাজেশ্বরী। এ বিষয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং অবদান রেখে গেছেন তিনি।
ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স (IISc)-এ ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজি ডিপার্টমেন্টে ‘কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তখন ১৯৪৬ সাল। ওই সময় পরাধীন ভারতবর্ষে দিল্লি সরকারের অধীনস্থ সায়েন্টিফিক কমিটি রাজেশ্বরীকে ‘ব্রাইট স্টুডেন্ট’ হিসেবে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে পড়ার জন্যে নির্বাচিত করে। তখনকার সমাজ মেয়েদের একা বিদেশে পড়াশোনা করতে যাওয়াকে ভাল চোখে দেখত না। যাইহোক, ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভের মাত্র কয়েক মাস আগে জাহাজে করে আমেরিকার উদ্দেশে একা পাড়ি দিলেন তেইশ বছর বয়সের রাজেশ্বরী। আমেরিকায় মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হলেন। ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, আট মাস ওয়াশিংটন ডিসি-তে ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অফ স্ট্যান্ডার্ডস’-এ (National Bureau of Standards) রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি বিভাগে হাতেকলমে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে হয়েছিল। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রিও অর্জন করলেন রাজেশ্বরী।
কর্নাটক রাজ্যের প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে রাজেশ্বরী দেশে ফিরে এলেন ১৯৫৩ সালে। ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সে (IISc)-র ‘ডিপার্টমেন্ট অফ ইলেকট্রিকাল কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগে লেকচারার পদে নিযুক্ত হন। ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অ্যান্ড সায়েন্স-এর প্রফেসর শিশিরকুমার চট্টোপাধ্যায় রাজেশ্বরীর পূর্বপরিচিত, তাঁর সঙ্গে কাজও করেছেন আগে। সেই শিশিরকুমারের সঙ্গে বিয়ে হল। বিয়ের পরে রাজেশ্বরীর নামের পাশে যুক্ত হয়েছে চট্টোপাধ্যায় পদবি। IISc-তে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক থিয়োরি, ইলেকট্রন টিউব সার্কিট, মাইক্রোওয়েভ টেকনোলজি, রেডিও ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ওপর নিবিড় গবেষণা করেছেন। পরবর্তী সময়ে ‘প্রফেসর’ ও ইলেকট্রো কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ‘চেয়ারপার্সন’ হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন রাজেশ্বরী। প্রায় তিরিশ বছর এখানে গবেষণা করে একশোটির বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। কুড়ি জন ছাত্রছাত্রীকে পিএইচ.ডি করিয়েছেন। তাঁর নিজের গবেষণার ক্ষেত্র, মাইক্রোওয়েভ এবং অ্যান্টেনা, সেই বিষয়ে ছ’টি বই লিখেছেন।
মাইক্রোওয়েভ এবং অ্যান্টেনা ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণায় রাজেশ্বরী অন্যতম পথিকৃৎ। এই বিভাগে তিনি রেখে গেছেন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তাঁর উদ্ভাবিত একাধিক প্রযুক্তি আজও প্রতিরক্ষা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে ব্যবহৃত হয়। উপগ্রহ কিংবা বিমানের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ‘অ্যান্টেনা’ বিষয়ক গবেষণা ও উদ্ভাবনার জন্যে এবং বিশেষজ্ঞ হিসেবে রাজেশ্বরী একটি সুপরিচিত নাম। ভারতবর্ষে মহিলা বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়ারদের পথচলার যে রাস্তা, তা মসৃণ করে তুলেছিলেন তিনিই।
মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার ও বিজ্ঞানী রাজেশ্বরী তাঁর গবেষণা ও অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জীবদ্দশায় দু-তিনটি পুরস্কার পেয়েছেন ঠিকই, তবে তা তাঁর অবদান ও কৃতিত্বের নিরিখে যথাযোগ্য ছিল না। তাছাড়া, সেসময় ভারত সরকারের কাছ থেকে কোনও স্বীকৃতি পাননি। মৃত্যুর পরে ভারত সরকারের ‘ইউনিয়ন মিনিস্ট্রি অফ চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট’ তাঁকে মরণোত্তর “one of the country’s first women achievers” হিসেবে সম্মানিত করে।
সত্যি কথা বলতে কী, আজও আমরা অনেকেই রাজেশ্বরী চট্টোপাধ্যায়ের (Rajeshwari Chatterjee, ১৯২২-২০১০) নাম শুনিনি! আজ ২৪ জানুয়ারি, বিস্মৃতপ্রায় রাজেশ্বরী চট্টোপাধ্যায়ের ১০১তম জন্মদিন নীরবে পেরিয়ে গেল। এই মেধাবী প্রযুক্তিবিজ্ঞানীর জন্মদিনে তাঁর উদ্দেশে আমাদের শ্রদ্ধার রজনীগন্ধা সাজিয়ে রাখলাম।