নিভৃতে ডেকে নিয়ে গেলেন ‘কাব্যশিল্পী’ সর্বেশ্বর দাস। পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসে শোনালেন স্বরচিত কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি—
বাঘাযতীন হে ভুলি নাহিঁ তুমে
মৃত্যুর অন্তরালে
মরণ বিজয়ী শরণ নেউছ
মুক্তি কিরণ জালে।
রক্ত দেই যে তীর্থ রচিলে
দেশুআ পোখরী তীরে
অশ্রু তর্পণে অর্ঘ্য দেউচি
নিঅ বিপ্লবী বীরে।
এই সেই ‘দেশুআ পোখরী’ (দেশ পুকুর)। ১০৭ বছর পূর্বে পাঁচ বাঙালি তরুণের রক্তে স্নাত হয়ে যা আজ ‘রক্ততীর্থ’-রূপে পরিচিতি পেয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অবশ্য বাঘাযতীনের নেতৃত্বে চিত্তপ্রিয়, মনোরঞ্জন, নীরেন্দ্র ও জ্যোতিষের সেই অসমসাহসী লড়াই বুড়িবালাম (নদীটির ওড়িয়া নাম বুড়াবলঙ্গ)-এর যুদ্ধ নামে খ্যাত। যদিও লড়াইয়ের প্রকৃত স্থান চষাখণ্ড গ্রামের দেশুআ পোখরী থেকে বুড়াবলঙ্গ প্রায় দুই কিমি দক্ষিণে।
১০ সেপ্টেম্বর। বাঘাযতীনের আত্মবলিদান দিবস। দেশুআ পোখরীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বাঘাযতীনের রক্তাভ আবক্ষ মূর্তি। সামনে সাদামাটা ম্যারাপ বাঁধা। ওড়িশা পুলিশের কয়েকজন সিপাই গান-স্যালুটের জন্য প্রস্তুত। অপেক্ষা বালেশ্বর জেলাশাসকের জন্য। দুপুর প্রায় সাড়ে বারোটায় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে জেলাশাসক পৌঁছলেন। জাতীয় পতাকা উত্তোলন, শহিদবেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, শহিদদের উদ্দেশে গান-স্যালুট জানিয়ে স্মরণ অনুষ্ঠানের সূচনা হল। সামনের আসনে তখন পাশাপাশি কয়েকটি বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ভিড়। আগের দিন ওরা বাঘাযতীন ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিষয়ে প্রশ্নোত্তর, বিতর্ক, বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। আজ পুরস্কার নিতে এসেছে। নিকটবর্তী ফুলবাড় কসবা পঞ্চায়েত হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র খগেশ্বর নায়েক, হরজিৎ ভুঁইয়া গড়গড় করে বাঘাযতীনের কাহিনি বলে গেল। জানাল তাদের রোমাঞ্চের কথাও। জেলাশাসক দত্তাতেয় ভাউসাহেব শিণ্ডে তাঁর বক্তব্যে নবপ্রজন্মের কাছে বাঘাযতীনের ত্যাগ, আদর্শ, বীরত্বের কথা তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করলেন।
জেলা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রতিবছর ৯-১০ সেপ্টেম্বর চষাখণ্ড গ্রামের দেশুআ পোখরীর পাড়ে বাঘাযতীনদের স্মরণ করা হয়। আয়োজক ‘বাঘাযতীন বিকাশ পরিষদ’। ১৯৯৬ সাল থেকে পরিষদ এই কাজ করে আসছে। তার আগে ১৯৫৫-১৯৯৫ পর্যন্ত এই স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করত ‘বাঘাযতীন স্মৃতি কমিটি’। অবশ্য ১৯৮২ সালে এই সংস্থার ‘বাঘাযতীন উন্নয়ন কমিটি’ নামে নিবন্ধীকরণ হয়।
বর্তমানে বাঘাযতীন উন্নয়ন কমিটি বাঘাযতীনের আত্মবলিদান দিবস পালন করে বালেশ্বর শহরের বারবাটি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে। সকাল ১০টায় ওড়িশা সরকারের দুই মন্ত্রীর উপস্থিতিতে ১০৭টি প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে যার সূচনা হয়েছে। ইংরেজ আমলে এখানে ছিল সরকারি হসপিটাল। হসপিটালের পুরনো দোতলা ভবন এখন বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ। একতলায় একচিলতে বারান্দা পেরিয়ে লম্বা হলঘর। আলপনা, ফুল-মালায় সুন্দর করে সাজানো। টেবিলে পঞ্চবিপ্লবীর বাঁধানো তৈলচিত্র। একপাশের দেওয়ালে বাঘাযতীনের আবক্ষ মূর্তি। সামনের টেবিলে প্রদীপ জ্বলছে। একটা স্নিগ্ধ পরিবেশ। এই ঘরেই বাঘাযতীন শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
এই আবক্ষ মূর্তিটি নির্মাণ করান কৃষ্ণনগর এ ভি হাইস্কুলের শিক্ষকরা। মূর্তির পাদদেশের ফলকে বাংলা অক্ষরে সেকথা লেখা আছে। বিদ্যালয় চত্বরে বাঘাযতীনের আর একটি আবক্ষ মূর্তি আছে। তার পাশে মঞ্চ বেঁধে বক্তৃতা চলছে। এখানেও বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি। স্মরণ অনুষ্ঠানের শেষে বাঘাযতীন-কেন্দ্রিক বক্তৃতা, প্রশ্নোত্তর প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কার বিতরণ করা হবে। স্বেচ্ছাসেবী ছাত্রীরা ট্রে-তে শরবত নিয়ে ঘুরছে। মঞ্চের সামনে দেখা মিলল অশীতিপর শরৎ দাসের। শরৎ দাস বালেশ্বর বাঘাযতীন স্মৃতি কমিটির প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও স্মৃতি এখনও প্রখর। তাঁর মুখেই শোনা গেল বালেশ্বরে বাঘাযতীন স্মরণের প্রথম উদ্যোগের কথা— স্বাধীনতার পরেও দেশের কর্তাব্যক্তিদের কাছে সশস্ত্র সংগ্রামীরা ‘সন্ত্রাসবাদী’ রূপে থেকে গিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবে বালেশ্বরেও বাঘাযতীনদের স্মরণের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমতাবস্থায় ১৯৫৫ সালে কপ্তিপদার মণীন্দ্র চক্রবর্তীর পুত্র সত্যগোপাল ও কলকাতা থেকে বিপ্লবী পঞ্চানন চক্রবর্তী বালেশ্বরে বাঘাযতীন স্মৃতি দিবস পালনের উদ্দেশে সহযোগিতার আশায় গোপালগাঁ (বালেশ্বর)-র আইনজীবী সুধাংশু ঘোষের বাড়িতে আসেন। সুধাংশু ঘোষ বালেশ্বরের তৎকালীন সমাজবাদী নেতা রবীন্দ্রমোহন দাসের দ্বারস্থ হন। রবীন্দ্রমোহন দাসের আন্তরিক সহযোগিতায় পরের দিন সুধাংশুবাবুর বাড়িতে শহরের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসেন। বৈঠকে স্থির হয় ১০ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় বালেশ্বর টাউন হলে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে শহিদ-স্মরণের সূচনা হবে। তারপর ইউনিভার্সাল এম্পোরিয়াম ছিল যে ঘরে (বর্তমানে সেখানে টেলারিং শপ) সেখানে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, বড় ডাক্তারখানা (বর্তমানে বারবাটি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়)-য় পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে চষাখণ্ড যাওয়া হবে। চষাখণ্ডের দেশুআ পোখরীর পাড়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে শহিদদের স্মরণ করা হবে। ফিরে এসে সন্ধ্যায় টাউন হলে সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। জেলখানার ফাঁসিকাষ্ঠে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের সিদ্ধান্ত হলেও সরকারের অনুমতি মেলেনি।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১০ সেপ্টেম্বর বাকি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। দেশুআ পোখরীর পাড়ে একটি উইঢিবি পরিষ্কার করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। পঞ্চানন চক্রবর্তী-সহ কলকাতা থেকে এসেছিলেন চারজন। তাঁদের মধ্যে একজন ‘বন্দে মাতরম্’ গেয়েছিলেন।
১৯৫৬ সালে ওড়িশায় সীমা আন্দোলনের কারণে বাঘাযতীনের আত্মবলিদান দিবস যথাযথভাবে পালিত হয়নি। ১৯৫৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে রবীন্দ্রমোহন দাস বালেশ্বরের বিধায়ক নির্বাচিত হন। তাঁর উদ্যোগে সেই বছর বিধিবদ্ধভাবে ‘বাঘাযতীন স্মৃতি কমিটি’ গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি হন রবীন্দ্রমোহন। এই বছর জেলখানার ফাঁসিকাষ্ঠে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের অনুমতি পাওয়া যায়। সেই থেকে প্রতিবছর জেলখানায় শহিদদের উদ্দেশে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রমোহন কমিটির সভাপতি থাকেন। ১৯৮৮ সাল থেকে পদাধিকারবলে জেলাশাসক কমিটির সভাপতি। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এই কমিটি বালেশ্বর শহর ও চষাখণ্ডে বাঘাযতীন-স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। ১৯৯৬ সালে চষাখণ্ডে ‘বাঘাযতীন বিকাশ পরিষদ’ গঠিত হয়। এটিরও সভাপতি বালেশ্বর জেলাশাসক। বৃদ্ধ শরৎবাবুর খেদ, ‘স্মৃতি দিবস পালনের জন্য যদি দুটি কমিটি কাজ করে তাহলে ভাল দেখায় না। এই দুই কমিটি মিলিয়ে একটি কমিটি হওয়া একান্ত আবশ্যক।’
এই দুই সংস্থা বালেশ্বরে বাঘাযতীনের আত্মবলিদান দিবস পালনে মুখ্যভূমিকায় থাকলেও বালেশ্বর জেলা জুড়ে আরও বহু প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এই দিনটি যথোচিত মর্যাদায় পালিত হয়। চষাখণ্ডের প্রায় ২ কিমি উত্তরে ওড়ঙ্গী গ্রামে বাঘাযতীন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বাঘাযতীনের আবক্ষ মূর্তি। শিক্ষক নরেন্দ্রকুমার অগস্তি-র বক্তব্য, ১৯৬৩ সালে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বছর থেকেই এখানে বাঘাযতীনের আত্মবলিদান দিবস পালিত হয়ে আসছে। মাঝে কয়েকবছর একইসঙ্গে বিদ্যালয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত। কিন্তু তাঁরা উপলব্ধি করেন তাতে দিনটির গুরুত্ব হ্রাস পায়। তারপর থেকে পৃথক কোনওদিন বিদ্যালয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠান হয়। এবছর প্রধানশিক্ষকের ঘরের দেওয়াল জুড়ে বাঘাযতীনের কাচবাঁধানো প্রতিকৃতি বসানো হয়েছে। শিক্ষকদের কথায় বাঘাযতীনের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা। বিদ্যালয়ের প্রাক্তনীরাও এই দিন বিদ্যালয়ে আসেন শ্রদ্ধা জানাতে। বাঘাযতীনের আত্মবলিদান দিবস বিদ্যালয়ের পুনর্মিলনের চেহারা নেয়।
বালেশ্বর শহরের বাঘাযতীন ক্লাব মানবসেবায় দিনটি উদযাপন করে। প্রতিবছর রক্তদান শিবির, বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদানের আয়োজন করা হয়। বালিয়াপালের ‘বাঘাযতীন স্মৃতি পরিষদ’ প্রতিবছর এইদিন সাইকেল র্যালির আয়োজন করে। এবছর ৭৫ জন সাইকেল আরোহী দিল্লির উদ্দেশে যাত্রা করেন। পথে তাঁরা চষাখণ্ডের ‘রক্ততীর্থ’ সহ স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত স্থানগুলি ছুঁয়ে যান। রেমুণা-র ত্রিবেণী তীর্থ আশ্রমের পক্ষ থেকেও দিনটি পালন করা হয়। এবছর তাদের আলোচনার বিষয় ছিল ‘এসো আমরা শহিদকে জানব, দেশকে ভালবাসব ও মা, মাটির জন্য কাজ করব’। পিছিয়ে থাকে না রাজনৈতিক দলগুলিও। বিজেডি-র মহিলা শাখার ‘সাংস্কৃতিক সমন্বয় ও জনকল্যাণ সমিতি’ বারবাটি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে শহিদদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে। বাঘাযতীনের নামে বালেশ্বরে রয়েছে নানা প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এমনকি লোকনাট্য দলও।
বালেশ্বর জুড়ে বাঘাযতীনের প্রতি এই শ্রদ্ধা, আবেগ দেখে মনে হয় বাংলায় এর ছিটেফোঁটাও কি আমরা দেখাতে পারি না? অবশ্য প্রতিবছর এইদিন কলকাতা থেকে কিছু মানুষ আসেন। বালেশ্বরবাসীর কাছে তাঁরা ‘রক্ততীর্থ-যাত্রী’। এর সূচনা করেন পঞ্চানন চক্রবর্তী। বালেশ্বরে বাঘাযতীন স্মরণের উদ্যেগ প্রসঙ্গে তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। ১৯৫৭ সালে পঞ্চানন চক্রবর্তী কলকাতায় ‘বালেশ্বর আত্মোৎসর্গ স্মারক সমিতি’ গঠন করেন। সঙ্গী ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, হরিপদ চক্রবর্তী প্রমুখ। ১৯৬১ সালে এই সমিতি নিবন্ধীকৃত হয়। সমিতির বর্তমান কার্যকরী সভাপতি প্রবাল মুখার্জি বললেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহযোগিতায় ৯ সেপ্টেম্বর সকালে তাঁরা হেদুয়ায় বাঘাযতীনের মূর্তি সংলগ্ন স্থলে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এছাড়া বছরভর বিভিন্ন দিনে তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। চষাখণ্ডের দেশুআ পোখরীর পাড়ে বাঘাযতীনের মূর্তি প্রতিষ্ঠা ও বাঘাযতীনদের বীরত্বের বিবরণ সম্বলিত ফলক বসানোয় সমিতির ভূমিকার কথাও প্রবালবাবু বললেন।
৯ তারিখ বিকেলে সমিতির সদস্যরা বালেশ্বরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তাঁদের সঙ্গে থাকেন সুজিত ভৌমিকের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম পরিষদের সদস্যরা। এবছর দুই সংগঠনের প্রায় ৩০ জন এসেছেন। এই দলে এসেছেন যাদবপুর বাঘাযতীন হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষাকর্মী উৎপল দাস। তিনি এই প্রথমবার এলেন। তাঁর কথায়, ‘স্কুলে এই দিনটি প্রতিবছর পালন করা হয়। এবার ভাবলাম যাই দেখে আসি আসল জায়গা।’ উৎপলবাবু আবেগবিহ্বল। সেইসঙ্গে জানালেন বালেশ্বরবাসীর আন্তরিকতায় তাঁরা মুগ্ধ। সরকারিভাবে তাঁদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাঘাযতীনকে ঘিরে শ্রদ্ধা, আবেগ, আন্তরিকতার অভাব নেই কিন্তু তাঁর স্মৃতিপীঠ ‘রক্ততীর্থ’ আজও উপেক্ষিত। শশৎবাবু বলছিলেন, প্রথমবার তাঁরা ওড়িশা ট্রাঙ্ক রোড ধরে (বর্তমানে জাতীয় সড়ক ১৬) দেশুআ পোখরী গিয়েছিলেন ধানখেতের মধ্য দিয়ে আলপথ বেয়ে। তারপর এতগুলো বছর কেটে গেলেও জাতীয় সড়ক থেকে দেশুআ পোখরী পর্যন্ত দুই কিমি পথের বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। আলপথের পরিবর্তে খানাখন্দে ভরা মাটির রাস্তা। বাঘাযতীন স্মৃতি কমিটি ১৯৬৪ সালে রাস্তা নির্মাণের জন্য ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আছে আবেদন করেছিল, কিন্তু কোনও সদুত্তর মেলেনি। এই বছরেই বাঘাযতীন অছি পরিষদ গড়ে দেশুআ পোখরীর সামগ্রিক উন্নয়নের চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু অছি পরিষদ সরকারের অনুমোদন পায়নি। পরবর্তীতে টেগোর সোসাইটি ও স্থানীয় বিধায়কদের আর্থিক সহায়তায় দেশুআ পোখরীর সংস্কার, পুকুরের চার পাড় বরাবর ইট বিছানো পথ, ফুল-ফলের বাগান ও একটি হলঘর নির্মিত হয়েছিল। সে-সব আজ ভগ্নপ্রায়। বাঘাযতীনের আবক্ষ মূর্তি থাকলেও তাঁর সহযোদ্ধাদের কোনও মূর্তি নির্মিত হয়নি। রাত্রিকালীন আলোর ব্যবস্থা করা যায়নি। উপযুক্ত শৌচাগার, পানীয়জলের ব্যবস্থাও নেই। অথচ প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বরে ওড়িশা সরকারের মন্ত্রীরা স্থানটিকে পর্যটনস্থল হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলেন। জেলাশাসক আশ্বাস দেন জমিজটে আটকে থাকা রাস্তা দ্রুত পাকা করার। আরও একবছর কেটে যায় কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয় না। এবছরেও জেলাশাসকের কাছে দরবার করা হয়েছে রাস্তা নির্মাণের জন্য। দাবি উঠেছে জাতীয় সড়কে একটি তোরণ নির্মাণের।
প্রবালবাবু প্রস্তাব দেন, প্রস্তাবিত পর্যটন পরিকল্পনায় আলো ও ধ্বনির মাধ্যমে বাঘাযতীনদের ইতিহাস তুলে ধরার। ইতিহাসগত ভ্রান্তিও থেকে যায়। তাই ওড়ঙ্গী গ্রামের বাঘাযতীন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রের মুখে বাঘাযতীনের বাঘ মারার ঘটনা ঘটে কপ্তিপদার জঙ্গলে। যদিও বাঘাযতীনদের নিয়ে গান, কবিতা লেখার বিরাম নেই। সুকুমার সাহুর লেখা ‘চষাখণ্ডর সেনাপতি’ লোকের মুখে মুখে ফেরে। নজরুলের ‘নবভারতের হলদীঘাট’ কবিতার ব্রজনাথ রথ-কৃত অনুবাদও সমান জনপ্রিয়। বাঘাযতীন সম্পর্কে ছোট ছোট পুস্তিকারও অভাব নেই। কিন্তু ওড়িয়া ভাষায় তাঁর কোনও পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ আজ পর্যন্ত লেখা হয়নি। বিষয়টি উপলব্ধি করে ওড়িয়া ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী অশ্বিনীকুমার পাত্র ওড়িয়া ভাষায় বাঘাযতীনের পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখার আহ্বান জানিয়েছেন। আশ্বাস দিয়েছেন সরকারি খরচে গ্রন্থটি প্রকাশ করার।
চষাখণ্ডের পরিকাঠামোগত সমস্যা যাই থাকুক না কেন বাঘাযতীনের প্রতি বালেশ্বরবাসীর শ্রদ্ধায় সবকিছুই অপাংক্তেয় হয়ে যায়। তাঁরা মানেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বালেশ্বরের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেছেন বাঘাযতীন। তাই আগামী বছরের জন্য অপেক্ষা। আগামী বছর আবার তাঁরা রাস্তায় রাস্তায় তোরণ সাজিয়ে রক্ততীর্থ-যাত্রীদের অভ্যর্থনা জানাবেন। আর ১০ সেপ্টেম্বর সকালে গেয়ে উঠবেন সুকুমার সাহুর লেখা সেই গান—
ভারত জননী-মুক্তি সেনানী ওহে বীরেন্দ্র মহামতি,
বালেশ্বরের নাও বন্দনা চষাখণ্ডের সেনাপতি।
… …. …
বুড়াবলঙ্গ তরঙ্গ হিল্লোলে,
চষাখণ্ডের পূত রণস্থলে,
তোমার বীরগাথা এখনও উছলে স্মরি অমর কীর্তি।
চিত্ত, যতীন, নীরেন, মনোরঞ্জন,
দেশের জন্য দিলে অমূল্য জীবন,
রক্তের বিনিময়ে আনিলে যতীন ভারতমাতার মুক্তি।
তোমার রক্তস্নাত রক্ততীর্থ আজ নিবেদন করে ভক্তি।
(সংক্ষিপ্ত অনুবাদ)
বাঘাযতীনের স্মৃতিবিজড়িত চষাখণ্ড সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। তরুণবাবুকে অশেষ ধন্যবাদ, এমন একটি বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য। আগামীতে চষাখণ্ড যেতে চাই।