ফ্রানজ কাফকা
অনুবাদ: অনিন্দিতা মণ্ডল
বড্ড দোলাচলে পড়েছি। দশ মাইল দূরের এক গ্রামে একজন গুরুতর অসুস্থ রোগী আমার অপেক্ষায়। ভীষণ তুষারঝড় আমার ও তার মাঝখানের সম্পূর্ণ দূরত্বটা ঢেকে দিয়েছে। আমার একটি দুইচাকার গাড়ি আছে, ঠিক যেমনটা গাঁয়ে দরকার হয়। লোমের জামায় গা ঢেকে হাতে ডাক্তারির ব্যাগটা নিয়ে আমি রওনা হওয়ার জন্য উঠোনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। কিন্তু ঘোড়া নেই। একটিও নেই। আমার নিজের ঘোড়াটি গত রাতে মারা গিয়েছে। ক্লান্তি ও তীব্র শীত সম্ভবত তার মৃত্যুর কারণ। আমার পরিচারিকা মেয়েটি সারা-গাঁয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে একটি ঘোড়া ধার করতে। কিন্তু সে আশা নেই বললেই চলে। আমি তা জানি। তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি আর আমার চারপাশে আরও আরও বরফ জমে আমাকে ঢেকে তুলছে, এমনভাবে যাতে আমি একটুও নড়তে না পারি।
হঠাৎ দরজার কাছে মেয়েটি এসে দাঁড়াল। হাতে তার একটি লন্ঠন, সে সেটি দোলাচ্ছে। কে তাকে এই অসময়ে একটি ঘোড়া ধার দিতে পারে?
আমি উঠোনের মধ্যে দিয়ে আর-একবার হেঁটে গেলাম। কোনও পথ দেখতে পাচ্ছি না। অসহায় রাগে প্রায় বছরখানেক খালি থাকা শুয়োরের খোঁয়াড়ের দরজাটায় একটি লাথি মারলাম। সেটি খুলে গেল এবং কব্জাগুলোয় ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে দরজাটা দুলতে থাকল।
ভেতর থেকে ঘোড়ার গায়ের গন্ধ আর বাষ্প যেন বেরিয়ে আসছে। একটা হলদেটে আবছা আলোর লন্ঠন যেন আস্তাবলের দড়ি থেকে ঝুলছে। ভেতরের ঝুপসি থেকে একটা মানুষের মুখ দেখা গেল। নীল চোখ তার। ‘ঘোড়াদুটি জুতে দিতে হবে কি?’ সে জিজ্ঞেস করল। ততক্ষণে হামাগুড়ি দিতে দিতে সে বেরিয়ে এসেছে। আমি বুঝতে পারলাম না কী বলতে হবে। শুধু ঝুঁকে পড়ে বসে দেখতে থাকলাম যে খোঁয়াড়ে আর কী কী আছে। পরিচারিকা মেয়েটি আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিল। সে বলে উঠল, তোমার বাড়িতে যে কী কী পাওয়া যেতে পারে সে বিষয়ে তুমি কিছুই জানো না। আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম। ‘ও ভাই, ও বোনটি’, সহিসটি হেঁকে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গেই দুটি তেজী ঘোড়া দরজা জুড়ে বেরিয়ে এল। তাদের সুন্দর পেশি, মাথাদুটো উটের মত সামনে ঝোঁকানো। এসেই তারা সোজা হয়ে দাঁড়াল। তাদের পাদুটি সোজা ও লম্বা এবং তাদের সমস্ত শরীর থেকে ঘাম বের হচ্ছে। ‘ওর হাতটা ধরো’, মেয়েটিকে বললাম। মেয়েটি তাড়াতাড়ি এসে সহিসটিকে ঘোড়া জুততে সাহায্য করল। মেয়েটি কাছাকাছি যেতেই সহিস অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় তাকে ধরে তার গালে নিজের মুখটি চেপে ধরল। মেয়েটি চিৎকার করে উঠল এবং আমার কাছে পালিয়ে এল। তার গালে দু’সারি দাঁতের লাল দাগ বসে গেল।
‘শয়তান! মার খেতে চাস?’ আমি রাগে চিৎকার করে উঠলাম। আর তার পরেই মনে হল এই সহিস একেবারেই অপরিচিত। আমি জানি না সে কোথা থেকে এসেছে এবং যখন কেউ কোথাও নেই তখন স্বেচ্ছায় সে আমাকে সাহায্য করছে। সে মনে হয় আমার চিন্তা পড়তে পারছিল, আর তাই মন দিয়ে ঘোড়াদুটিকে গাড়ির সঙ্গে জুতে দিচ্ছিল। একবার শুধু ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘উঠে পড়ুন।’ সবকিছু প্রস্তুত। সুন্দর একজোড়া তেজী ঘোড়া, এমন আমি হয়তো কখনও চড়িনি, সেটা লক্ষ্য করে উঠে বসলাম।
‘কিন্তু আমি গাড়ি চালাব, তুমি রাস্তা চেনো না’, বললাম। ‘নিশ্চয়ই! এমনিতেও আমি আপনার সঙ্গে আসছি না। আমি রোজের সঙ্গে থাকছি।’ সহিস অকপট।
‘না!’ রোজ কঁকিয়ে উঠল। যেন তার দুর্ভাগ্য অবশ্যম্ভাবী এইভাবে সে ছুটে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। আমি শুনতে পেলাম সে সদরের আগল বন্ধ করছে, দরজায় তালা দিচ্ছে, এমনকি সে ঘরের সমস্ত আলো নিভিয়ে দিচ্ছে, প্রতিটি ঘর অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে যাতে তাকে কোনওভাবেই খুঁজে না পাওয়া যায়।
সহিসটিকে বললাম, ‘তুমি আমার সঙ্গে এসো, না হলে আমি যাব না। আর আমার যাওয়াটা অত্যন্ত দরকারি। আমি এর মূল্য হিসেবে মেয়েটিকে তোমার হাতে তুলে দিতে পারব না।’
কিন্তু সে জোরে হাততালি দিল, আর গাড়িটা ঝড়ের মুখে কুটোর মত উড়ে বেরিয়ে গেল।
আমার বাড়িটা ওই সহিস যেন উন্মত্তের মত ভেঙে দিয়ে ঢুকে পড়ছে ভেতরে, দূর থেকে শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু তারপরেই ভীষণ ঝড় আমাকে অন্ধ ও কানা করে দিল। আমার সমস্ত অনুভূতিকে স্তব্ধ করে দিল। কিন্তু তা যেন একটি মুহূর্তমাত্র। কারণ আমি আমার রোগীর বাড়ির উঠোনে পৌঁছে গেছি। ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে পড়েছে। ঝড় থেমে গেছে। চারিদিকে চাঁদের আলো। রোগীর বাবা মা শশব্যস্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। তাদের পেছনে রোগীর বোন। আমায় যেন গাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হল। তাদের এমন ত্রস্ত ভাবের সামনে আমার মুখ থেকে কোনও কথা বের হল না।
রোগীর ঘরে বাতাসে নিশ্বাস নেওয়া যাচ্ছিল না। অবহেলায় নিভন্ত স্টোভ থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। আমি ঠেলে একটা জানালা খুলতে চাইলাম। কিন্তু প্রথমে আমার রোগীকে দেখা দরকার। এক তরুণ তার পালকের বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি করে উঠে বসল। তার মুখটি কৃশ, তার গায়ে কোনও উত্তাপ নেই। চোখদুটি নির্বাক। গায়ে কোনও জামা নেই। সে আমার গলা জড়িয়ে কানে কানে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, আমাকে মরতে দিন।’ আমি ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম কেউ তার কথা শুনতে পায়নি। তার বাবা মা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে আমার বিচারের অপেক্ষা করছিলেন। তার বোন একটি চেয়ার আমায় ব্যাগ রাখতে এগিয়ে দিয়েছিল।
আমি ব্যাগ খুলে যন্ত্রপাতি বার করতে লাগলাম। একজোড়া চিমটে নিয়ে মোমের আলোয় পরখ করলাম। তারপর আবার রেখে দিলাম। ‘হুঁ’, ভাববার ভান করলাম একটু। ‘এমন ক্ষেত্রে দেবতারাও সহায়তা করেন। হারানো ঘোড়া ফিরিয়ে দেন, সঙ্গে আর-একটি জুতে দেন এবং আরও সোনায় সোহাগা করতে একটি সহিসও দেন।’ আর ঠিক তখনি আমার রোজকে মনে পড়ল। এখন আমি কী করি? কী করে তাকে রক্ষা করি! কীভাবে দশ মাইল দূরে থাকা সেই সহিসের কাছ থেকে তাকে টেনে আনি এমন দুটো ঘোড়া নিয়ে যাদের ওপর আমার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই!
এখন সেই ঘোড়াদুটো সম্ভবত বলগা আলগা করে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়েছে। আমি জানি না কেমন করে, হয়তো প্রত্যেকেই মাথা দিয়ে জানালায় ধাক্কা দিয়েছে। পরিবারের বাকিদের কান্নায় বিচলিত না হয়ে আমি রোগীকে দেখলাম। এবার বরং ফিরে যাই, ভাবলাম। যেন ঘোড়াদুটো আমাকে নিয়ে যাবার অপেক্ষাতেই আছে। তবুও আমি রোগীর বোনকে আমার কোট খুলে নিতে দিলাম। আমার জন্য রাম ঢালা হল। বৃদ্ধ লোকটি আমার পিঠে চাপড় দিলেন। তার সম্পদের একটি প্রকাশ। আমি মাথা নাড়লাম, বৃদ্ধ লোকটির এমত ভাবনায় আমি যেন অসুস্থ বোধ করলাম। সেই কারণেই আমি মদ পান করলাম না। মা বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, আমাকে বিছানার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন ঘোড়াগুলো খুব জোরে ডেকে উঠছিল। আমি ছেলেটির বুকে মাথা রাখলাম। আমার ভেজা দাড়ির তলায় তার বুক কেঁপে উঠল। আমি নিদান দিলাম। ছেলেটি সম্পূর্ণ সুস্থ। তার হয়তো রক্ত চলাচলে কোনও অসুবিধে হয়ে থাকতে পারে, যা তার মা কফি খাওয়ালে ঠিক হয়ে যাবে। তবে সে এতটাই সুস্থ যে, যে কোনও মুহূর্তে গা-ঝাড়া দিয়ে বিছানা থেকে উঠতে পারে। আমি কোনও নীতিবাগীশ নই, তাই তাকে শুয়ে থাকতে দিলাম।
আমি জেলার ডাক্তার। নিজের কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করেছি এমনভাবে, যেখানে কাজটি অসম্ভব সেখানেও দায়িত্ব ছেড়ে আসিনি। আমার দক্ষিণা নামমাত্র। আমি দয়ালু এবং গরিবদের সাহায্য করে থাকি।
এখন রোজ ঠিক আছে কিনা সেইটা দেখা আমার কর্তব্য। তারপর ছেলেটি তার যা ইচ্ছে তা করতে পারে, আর আমিও মরতে পারি। এই তীব্র শীতে আমি এখানে কী করছি? আমার ঘোড়া মরে গেছে। গাঁয়ের একটি লোকও আমাকে ঘোড়া ধার দেবে না। আমাকে খোঁয়াড় থেকে নিজের যা কিছু বার করতে হবে। যদি সেখানে ঘোড়া না থাকে আমাকে হয়তো শুয়োরের পিঠে চড়তে হবে। ব্যাপারটা এমনই। আমি ওই পরিবারের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম। তারা এই সম্পর্কে কিছুই জানেন না। জানলেও তারা বিশ্বাস করবেন না। প্রেসক্রিপশন লেখা আর মানুষকে সেটা বুঝিয়ে দেওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। যাই হোক আমার রোগী দেখা শেষ হয়ে আসছে। আমাকে আবার হয়তো অকারণে ডাকা হবে। এর জন্য আমি প্রস্তুত। সমস্ত জেলা আমার জীবনটাকে রাতের ঘণ্টি দিয়ে নরক করে রেখেছে। আমি অবশ্য তাতে অভ্যস্ত। কিন্তু এবার হয়তো আমাকে রোজকে ছেড়ে দিতে হবে। সেই মিষ্টি মেয়েটি যে আমার বাড়ি এত বছর ধরে দেখাশোনা করে আসছে অথচ যাকে আমি কখনও ভাল করে তাকিয়ে দেখিনি তার দিক থেকে ত্যাগ আশা করাটা বড্ড বেশি। যেভাবেই হোক কোনও একটা কায়দায় আমাকে একটা যুক্তি তৈরি করতে হবে। জগতের সমস্ত শুভশক্তিও রোজকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
কিন্তু আমি আমার ব্যাগ বন্ধ করতেই এবং আমার কোটে হাত রাখতেই পরিবারটি আবার সার দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বাবার হাতে রামের গ্লাস, তিনি সেটি নাকের কাছে রেখেছেন, মা যেন হতাশ হয়ে আমাকে দেখছেন— কেন? মানুষ আর কী আশা করে? তিনি ঠোঁট কামড়ে চোখের জল চেপে রেখেছেন। আর বোনটি একটি রক্তমাখা তোয়ালে আমার সামনে দুলিয়ে দিচ্ছে। ফলে কোনওভাবে আমাকে মানতেই হল যে ছেলেটি অসুস্থ। আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম সে হেসে আমাকে কাছে ডাকল যেন নিরাময়হীন একটি ওষুধ আমি তাকে দিতে চলেছি। আঃ, ঘোড়াদুটির হ্রেষাধ্বনি শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তারা ঈশ্বরের আদেশ নিয়ে এসেছে যেন আমি রোগীকে দেখি। এইবার আমি দেখলাম ছেলেটি সত্যিই অসুস্থ। তার ডানদিকে কোমরের নিচে একটি বড় ক্ষত প্রায় আমার হাতের তালুর সমান। একেবারে গোলাপি-লাল। নানা রকমের রং। গভীরে তা বেশি লাল আর কানার দিকটায় হালকা।
নরম দানাদার অসম রক্তপিণ্ড যেন দিনের আলোয় খুলে যাওয়া খনিমুখ। দূর থেকে এমনই দেখাচ্ছিল ক্ষতটাকে। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখি, না, আরও বেশি কিছু! বিস্ময়ে আমার মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরিয়ে এল। ওঃ! পোকা! গোলাপি রংয়ের পোকা! আমার কনিষ্ঠ আঙুলের সমান, সাদা মুখ আর ছোট ছোট পাওয়ালা অজস্র পোকা কিলবিল করছে সেই ক্ষতর মধ্যে। বেচারা ছেলেটা। কোনও সাহায্যই আর কাজে লাগবে না। আমি তোমার বিরাট আঘাত সনাক্ত করতে পেরেছি। এই যে তোমার পাশে এত বড় হয়ে ফুটে উঠেছে তোমাকে শেষ করবে বলে। পরিবারের সকলে বেশ সন্তুষ্ট। তারা দেখছে, আমি ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। বোনটি মাকে বলল, মা বাবাকে, বাবা আরও অনেক পড়শিকে। যারা সমানে ঘরের মধ্যে আসছে। চাঁদের আলোয় খোলা দরজা দিয়ে চুপিচুপি নিঃসারে ঘরে ঢুকে আসছে। ‘তুমি কি আমাকে বাঁচাবে?’ ছেলেটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ফিসফিস করে উঠল। নিজের ক্ষতটির মধ্যে অসংখ্য প্রাণ সম্পর্কে যেন সে অন্ধ। তারা তাদের প্রাচীন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। অন্তিম সময়ে যাজক ঘরে বসে একটি একটি করে তার পোশাক খুলে ফেলেন। কিন্তু ডাক্তার যেন সর্বশক্তিমান। তার হাতদুটি যেন সব কিছু করতে পারে। ঠিক আছে যা তাদের খুশি করুক। আমি তো জোর করে তাদের সেবা দিতে আসিনি। তারা যদি সেই পবিত্র পরিণতি না চেয়ে আমাকে ব্যবহার করে তাহলে আমিও নিজেকে সঁপে দিচ্ছি। এর চেয়ে বেশি আমি আর কী করতে পারি? আমি এক গাঁয়ের ডাক্তার! আমার পরিচারিকাটিকে পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হল।
তারা এল। পরিবারটি, গাঁয়ের বুড়োরা, সকলে মিলে আমার পোশাক খুলতে থাকল। বাড়ির সামনে এক শিক্ষক তার বিদ্যালয়ের সঙ্গীত দলটি নিয়ে দাঁড়িয়ে সহজ সুরে এই গানটি গাইতে থাকল।
‘ছাড়িয়ে দাও ওর পোশাক।
তাহলে ও আমাদের আরোগ্য দেবে।
যদি না দেয় তাহলে ওকে মৃত্যু দেবে।
ও শুধু চিকিৎসক একজন চিকিৎসক।’
ততক্ষণে আমার পোশাক ছাড়ানো হয়ে গিয়েছে। আমি চুপ করে লোকগুলোর দিকে দেখলাম। দাড়ির মধ্যে হাত রেখে আমার মাথাটা একদিকে ঝুলে গেল। আমি খুব শান্ত এবং পরিস্থিতি বুঝতে পারছি। যদিও তা আমাকে কোনও সাহায্য করছে না কারণ এবার তারা আমাকে মাথা ও পা দুদিকে ধরে বিছানায় নিয়ে চলেছে। তারা আমাকে দেয়ালের ধারে ক্ষতটার অপরদিকে শুইয়ে দিল। তারপর তারা ঘর ছেড়ে চলে গেল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। গান থেমে গেল। চাঁদ মেঘে ঢেকে গেল। বিছানাটা উষ্ণ হয়ে আমাকে জড়িয়ে নিল। খোলা জানালা দিয়ে ঘোড়াদের মাথার ছায়া দেখা যাচ্ছে।
আমার কানের মধ্যে একটি কণ্ঠস্বর যেন বলছে— তুমি জানো আমি তোমার ওপর এতটুকু ভরসা করি না। তবু তোমাকে এখানে তুলে আনা হয়েছে, তুমি নিজে আসোনি। আমাকে সাহায্য করার পরিবর্তে তুমি আমাকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিয়েছ। আমার কি ইচ্ছে করছে জানো? আমার ইচ্ছে করছে তোমার চোখদুটো উপড়ে তুলে নিই।
‘ঠিকই বলেছ।’ আমি বললাম, ‘সত্যিই এটা লজ্জার। অথচ আমি একজন ডাক্তার। বিশ্বাস করো, ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না।’
—‘তাহলে কি আমি তোমার এই ক্ষমা চাওয়াতেই সন্তুষ্ট থাকব? নাকি এছাড়া আমার আর কিছু করার নেই! আমাকে সব সময়ই সবকিছু সইতে হয়েছে। এ পৃথিবীতে আমি একটি সুন্দর ক্ষত বহন করেছি। সেই আমার একমাত্র সঞ্চয়।’
—‘বন্ধু এ তোমার ভুল। তোমার দৃষ্টি আসলে বড্ড সংকীর্ণ। আমি পৃথিবীতে বহু বহু রোগীর ঘরে গিয়েছি। আমি তোমাকে বলছি তোমার ক্ষতটা তত খারাপ নয়। একটি শক্ত জায়গায় দুটিমাত্র কুঠারের আঘাতে এটি তৈরি করা হয়েছে। অনেকেই এভাবে নিজেকে এগিয়ে দেয়। আর বনে কুঠারাঘাত শোনা যায় না। কাছে আসা টের পাওয়া তো দূরের কথা’, বললাম আমি।
‘ওঃ! সত্যিই তাই! নাকি তুমি আমাকে জ্বরের মধ্যে প্রতারণা করছ?’
—‘সত্যি। একজন পেশাদার ডাক্তারের কথা মেনে নাও।’
সে হয়তো মেনে নিল। চুপ করে শুয়ে রইল।
কিন্তু এবার আমাকে পালাবার সুযোগ খুঁজতে হবে। ঘোড়াগুলো এখনও বিশ্বস্তভাবে ওই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। আমার পোশাক আমার কোট আমার ব্যাগ সবকিছু তাড়াতাড়ি নিয়ে নিলাম। আমি পোশাক পরবার জন্য সময় নষ্ট করিনি। যেভাবে ঘোড়াদুটি বাড়ি থেকে এখানে আমাকে এনেছিল যদি একইভাবে নিয়ে যায় তাহলে এই বিছানা থেকে নিজের বিছানায় লাফিয়ে পড়া মুহূর্তের অপেক্ষা। খুব বাধ্যভাবে একটি ঘোড়া জানালার দিকে এগিয়ে এল। আমি আমার পোঁটলাটা গাড়িতে ছুড়ে দিলাম। কোটটা ফসকে গিয়ে একটা হুকে হাতটা নিয়ে ঝুলতে লাগল।
যাক গে, আমি একলাফে ঘোড়ায় চড়ে বসলাম। বলগা ছাড়িয়ে আর একটি ঘোড়া হালকাভাবে যেন জুড়ে আছে। পেছনে গাড়িটা একদিকে হেলে আছে। আমার কোটটা কখন বরফে হারিয়ে গেল।
‘হ্যাট হ্যাট’। বললাম, কিন্তু ঘোড়া দৌড়তে শুরু করল না।
ধীরে ধীরে বৃদ্ধ মানুষের মত হামাগুড়ি দিয়ে আমি সেই বরফের আবর্জনার মধ্যে চলতে লাগলাম।
পেছনে তখন বহুদূর থেকে বাচ্চাদের গলায় একটি অন্য গান ভেসে আসছে।
‘ওগো রোগীর দল,
আনন্দে থাকো।
কারণ, ডাক্তারকে তোমাদের পাশেই শুইয়ে রাখা হয়েছে।’
এভাবে আমি কখনওই বাড়িতে পৌঁছতে পারব না। আমার দুরন্ত পসার শেষ হয়ে গেল। আমার উত্তরাধিকারী আমাকে লুঠ করেছে। কিন্তু তা ব্যর্থ, কারণ সে আমার জায়গা নিতে পারবে না। আমার বাড়িতে সেই শয়তান সহিস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। রোজ অত্যাচারিত। এর বেশি আমি আর ভাবতে পারছি না। নগ্ন, জীবনের সমস্ত অসুখী বছরের তুষার আমার গায়ে, একটি পার্থিব শকট নিয়ে, অপার্থিব ঘোড়াসহ, আমার মত বৃদ্ধ, এখন এখানে, যার সব নষ্ট। আমার পশমের কোটটা গাড়ির বাইরে ঝুলছে। আমি তাকে ধরতে পারছি না। আমার রোগীর দল একটি আঙুল তুলেও এগিয়ে আসছে না। প্রবঞ্চিত প্রবঞ্চিত!
অসময়ে বেজে ওঠা রাতের ঘণ্টি একটি সংকেত দেয়।
‘কোনও কিছু আরোগ্য করা যায় না। কোনওদিন নয়। কখনও নয়।’
বেশ ভাল লাগল গল্পটি। অনুবাদককে অনেক ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।