দুনিয়াতে কোথাও শান্তি নেই। বিশেষত আমার মত অপয়া লোকের। ঢেঁকি তুমি যেখানেই যাও ধান ভানতেই হবে। চেনাপরিচিত আত্মীয়স্বজন যার বাড়িতেই যাই মিনিট দশেক বসতে না বসতে কেউ না কেউ একটা মোবাইল আমার হাতে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘দেখো তো একটু, হিসবুকটা কাজ করছে না।’
কেউ তো আবার এককাঠি এগিয়ে, সোজা জিজ্ঞেস করে বসে যে, আমি তার জন্মছক থেকে রাহুকে তাড়িয়ে দিতে পারব কিনা। এইরকম হাজারো আবদারের চক্করে পড়ে কারওর বাড়ি যাওয়া ছেড়েই দিয়েছি। কিন্তু সেদিন যেতেই হল। হাজার হোক কলেজ জীবনের বন্ধু, তার বিপদের দিনে না গেলে নিজের কাছেই ছোট হয়ে যেতে হয়। বন্ধু ফোন করে বারবার বলে দিয়েছে যে সে খুবই সঙ্কটাপন্ন, আমি উদ্ধার না করলে ফটো হয়ে যাবে নির্ঘাত।
বন্ধুকে ফটো হতে দেওয়া যায় না। বরং বন্ধুর জন্য ফটো হওয়া যায়। হাজার বন্ধুরতা অতিক্রম করা যায়। তাই আশ্বাস দিয়ে বললাম, ‘মাভৈঃ! তোকে উদ্ধার আমি করবই। একমাত্র ধার দিতেই যা পারব না।’
বন্ধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘তোর থেকে ধার চাইছে কে রে? আমার বউয়ের জিভের যা ধার ওই যথেষ্ট। ইষ্টনাম ভুলিয়ে দেয়। সে যাই হোক, তুই চলে আয় চটপট।’
বন্ধু প্রতীকের বউ রুষা ঈষৎ মুখরা। তার ভয়ে চালে কাক বসার সাহস পায় না। যে বেচারি সাতসকালে ছেলের মুখে কাকা ডাক শুনে ঘর থেকে বেরিয়েছে তার মেজাজ যে গরম থাকবেই এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কাকেরা সেরকম নয়, তাদের মেজাজ এমনিতেই গরম থাকে। আর তাদের মস্তিষ্কের গরম বাষ্প সুতীক্ষ্ণ কা-কা রবে উদঘোষিত হয়। আর সেই ডাক মনুষ্যকর্ণের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে।
তো বেচারা কাক ভুল করেই ভুল চালে বসেছিল। বলা যায় চালে ভুল করেছিল। কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে গৃহকর্ত্রীর জিহ্বানিঃসৃত যা সব বেরিয়ে এল, তাতে কাকের কাকত্ব ধুলোয় মিশে গেল। সে বারকয়েক গলা ফুলিয়ে প্রতিস্পর্ধার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হয়নি। পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিতে পারে না কাকেরা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এসেছিল দলবল নিয়ে। কিন্তু এঁটে উঠতে পারেনি। শোনা যায় নাকি সেই কাক এখন আন্দামানের কাছাকাছি কোনও এক দ্বীপে নির্বাসিত আছে। গোষ্ঠীপতি তাকে নির্বাসনের সাজা শুনিয়ে বলেছে, ‘যে কাক তার দলবলকে অ্যাটম বোমের মুখে নিয়ে যায় তাকে কোনওভাবেই দলে রাখা যায় না। মরতে মরতে বেঁচেছি। আর ও বাড়ির ধারেকাছেও নয়।’
তো সেই বাড়িতেই চলেছি সজ্ঞানে এবং সুস্থ শরীরে। বেরোনোর সময় ইনসুরেন্সের কাগজপত্র সব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি বউকে। আর বলেছি, ‘যদি বেঁচে ফিরি তো আমাকে রাঁচিতেই দিয়ো। পুরোনো পাগলখানা তো, চিকিৎসা ভাল হয়।’
দুরুদুরু বুকে বন্ধুর ঘরে গিয়ে পৌঁছলাম। তিনটে ঘরের পরে একটা বকুলগাছে কাক ডাকছে তারস্বরে। বোধহয় সতর্ক করে দিতে চাইছে। কিন্তু সংকল্প করে পূরণ না করলে নরকে যেতে হয়। ওজন্যই আগেভাগে সংকল্প করিয়ে নেয় নাম-গোত্র ধরে, যাতে পিছিয়ে আসতে না পারে কেউ। ‘যায় যাক প্রাণ’ বলেই ঢুকে পড়লাম। মনে মনে গিন্নি আর ছেলেমেয়েদের মুখগুলো স্মরণ করে নিলাম আর-একবার।
‘এই যে সুপ্রকাশ এসেছিস দেখছি। আয় আয়। পথে কোনও অসুবিধা হয়নি তো?’ একমুখ হেসে বলল বন্ধুবর। আমি মনে মনে বললাম, ‘তোর তো গোটাটাই আয়, আর আমার জীবন ব্যয় হতে বসেছে।’ বাইরে বললাম, ‘কী কেস রে প্রতীক?’
প্রতীক বলল, ‘কী কেস আন্দাজ করতে পারছিস না?’
‘না তো? আরে দাঁড়া দাঁড়া, গোটা বাড়িতে এত নৈঃশব্দ্য কেন? এ তো শ্মশানের শান্তি ভাই।’
প্রতীক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘এ সব ওই হতভাগা বাঁদরওয়ালার কেরামতি।’
‘বাঁদরওয়ালা?’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কালা জাদু করেছে নাকি?’
প্রতীক শুরু করল সেই ইতিহাস। একদা এক সকালে রুষা প্রতীককে চায়ে চিনির পরিমাণ আর শাশুড়িকে কতখানি সভ্য হতে হয় এই দুটি বিষয়ে সদুপদেশ দিচ্ছিল। টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট সেই উপদেশামৃত শ্রবণের পর একখানা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেল প্রতীক। উপদেশামৃত তখনও চলছে। আর প্রতীকের বিপি বেড়েই চলেছে ক্রমাগত। ওষুধ কাজ করছে না। মাথার শিরাগুলো টনটন করছে। স্ট্রোক হল বলে।
এমত অবস্থায় বাইরে ডুগডুগি বেজে উঠল। রুষা তার প্রবচনসভা শেষ করে সেই দিকে কান পাতল। তারপর দরজা খুলে ছুটে গেল বাঁদরওয়ালার কাছে। কিছু উপদেশ তাকেও দিতে যাচ্ছিল কিন্তু বাঁদরওয়ালা জগৎসংসার চরিয়ে খাওয়া লোক। সে অপরপক্ষকে সুযোগ না দিয়েই শুরু করল, ‘লে মেরা রূপকুমার ইসকি কিসমত বাতা। মা জননীর ভবিষ্যৎ বলে দে তো বাপ। একটা ভাল মানুষের উপকার কর। মা জননী, এ বান্দর বলছে কী, আপনি খুব ভালমানুষ কিন্তু কেউ আপনাকে বোঝে না। আপনি সবার ভাল করেন কিন্তু কেউ আপনার ভাল চায় না। আপনার স্বামী, আপনার হাজবেন্ড আপনার কথা বুঝতে চায় না। আপনার মনে কষ্ট বোঝে না।’
এই দীর্ঘ বক্তৃতার মধ্যেই স্ত্রীর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে প্রতীক। সে বুঝেছে যে, এই বাঁদরওয়ালার জন্যই তার সর্বনাশ হবে। তাই শুকনো মুখে হাতজোড় করেছে বাঁদরওয়ালার উদ্দেশে। বাঁদরওয়ালা বিষয়ী লোক, সর্বোপরি বিবাহিত। তাই প্রতীকের ওপর তার করুণা হল। সে ঈশারায় বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে।
আর তার পরেই সেই কেলোর কীর্তি। বক্তৃতা শুরু করল বাঁদরওয়ালা। ঝাড়া একঘণ্টা বক্তৃতা। আর পুরোটা সময়ই প্রতীকের বউ চুপ। একাগ্রমনে কথা শুনছে। ঠিক ময়াল আবিষ্ট হরিণীর মত। একদম শেষকালে বাঁদরওয়ালা চালল সেই চাল। রুষার কপালের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোর মৃত্যুযোগ আছে মা। এর আগে দু’-দুবার তুই বেঁচেছিস। তবে এবার বাঁচার আশা কম।’
‘আমি মরতে চাই না বাবা, আমাকে বাঁচান। আমি মরে গেলে ওই শয়তানটা একটা শয়তানি ধরে আনবে। আমার আত্মা শান্তি পাবে না বাবা। এত টাকাপয়সা গয়নাগাটি সব পরে ভোগ করবে।’ ডুকরে কেঁদে উঠল রুষা। কন্যাবিদায়ের পর এই দ্বিতীয়বার তার চোখে জল দেখছে প্রতীক।
বাঁদরওয়ালা তার বাঁদরকে বলল, ‘মাঈজিকে বাঁচাতে হবে তো। বাঁচা মাঈজিকে। সীতা মাঈয়ার মত উদ্ধার কর।’
বাঁদর প্রশিক্ষিত ও বুদ্ধিমান, সে বাঁদরওয়ালার ঝোলা থেকে একটা তাবিজ বের করে রুষার হাতে দিল। মাত্র চার হাজার টাকা। একটা মূল্যবান জীবনের দাম। তবে শর্ত একটাই, কথা কম বলতে হবে। এক-একটা শব্দ মানে মৃত্যুর দিকে এক সেন্টিমিটার এগিয়ে যাওয়া। আর সেদিন থেকেই রুষা চুপ। প্রয়োজনেও কথা বলতে চায় না। ঈশারায় জানিয়ে দেয়। প্রতীক প্ররোচিত করলেও মুখের অর্গল খোলে না। জীবন সবার উপরে, তার নিচে সব। কোনওভাবেই মুখ খুলবে না সে।
সব শুনে বললাম, ‘এতে সমস্যা কোথায়? মাত্র চার হাজার টাকার বিনিময়ে ঘরে শান্তি ফিরেছে।’
প্রতীক বলল, ‘বড় একা লাগে রে। মনে হয় শ্মশানে বসে আছি। ও চিৎকার-চেঁচামেচি করলেও সংসারে একটা প্রাণ ছিল। সেই আগের রুষাকে ফিরিয়ে দে ভাই। আমি জানি তুই সব পারিস। আমি ওকে বলেছি যে, বাঁদরওয়ালা ফ্রড কিন্তু ও আমার কথা বিশ্বাস করে না। ভাবে ওর উপর বিরক্ত হয়ে আমি ওকে মারার ষড়যন্ত্র করছি।’
বললাম, ‘বাঁদরওয়ালা কোথায় থাকে জানিস?’
প্রতীক উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, রেলস্টেশনের পাশে একটা শেডে। সামনের মাসেই চলে যাবে অন্যত্র।’
আমি আর একমিনিটও দাঁড়ালাম না। পরের সংসারে শান্তিভঙ্গ করে কী লাভ! আমার দরকার ওই বাঁদরওয়ালাকে। খিটখিটে বসটাকে টাইট দিতে হবে।