পলাশী যুদ্ধের পর বাংলার বুকে নেমে আসে নানা ধরনের সংকট ও অবক্ষয়, নেমে আসে রুচিহীনতার মতো মহাবিপর্যয়। পালাবদল ঘটে সমাজ, সংস্কৃতি, শাসনযন্ত্রের পরিকাঠামো ও ভূমিব্যবস্থাপনায়– ইংরেজদের অনুকম্পায় ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ে গজিয়ে ওঠে সুযোগসন্ধানী, ভোগলিপ্সু, প্রমোদপ্রিয় একটি ক্ষুদ্র ধনিক শ্রেণি। বাংলা-বাঙালির ক্রান্তিকালে হঠাৎ-গজিয়ে-ওঠা এই ধনিক শ্রেণির আমোদ-প্রমোদ ও মনোরঞ্জনে নিরক্ষর ও স্বল্পশিক্ষিত কবিয়ালদের মাধ্যমে লঘুরসের যে মৌখিক সাহিত্যধারা গড়ে ওঠে, তা লোকগানের পরম্পরায় কবিগান নামে পরিচিত। পদ্য ও গানের মিলিত রূপ এই সাহিত্য বা সঙ্গীতধারায় খুঁজে পাওয়া যায় বাঙালির সমাজ ও যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গ। আঠারো ও উনিশ শতকের অবিভক্ত বঙ্গদেশের সমাজবাস্তবতা, অর্থনীতি, সামাজিক স্তরবিন্যাস, জাতপাতের ঠেলাঠেলি অনুধাবনে এখনও আমাদের কবিগানের দ্বারস্থ হতে হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির রসরুচিবোধ ও সৃষ্টিশীল চেতনার ভাবচিত্রটা কেমন ছিল, সেটা জানতেও কবিগানের পাঠ গ্রহণ করতে হয়।
বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রসাহিত্য ও বৈষ্ণবসাহিত্যের পরেই সবচেয়ে আলোচিত বিষয় সম্ভবত কবিগান। আঠারো ও উনিশ শতকের কলকাতার অশিক্ষিত, প্রমোদপরায়ণ, প্রমদাসক্ত বাবুদের স্থূল বিনোদনের খোরাক হিসেবে মূলত এই গান রচিত ও পরিবেশিত হলেও এর ভাঁজেভাঁজে লুকিয়ে আছে বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের জলছবি। সঙ্গীত হিসেবেও কবিগান শিল্পপ্রসাদগুণসম্পন্ন। কালের পরিক্রমায় যদিও নাগরিক জীবন থেকে এগান প্রায়-বিলীন হয়ে গেছে, তার পরও গ্রামবাংলায় এর কিছু অবশেষ রয়ে গেছে। আজও বাংলার গ্রামেগ্রামে কবিগানের আসর বসে বিভিন্ন উপলক্ষ ও পার্বণে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিসরে সাহিত্যের পাঠ্য-বিষয় হিসেবে কবিগান, পাঁচালি, আখড়াই, হাফ-আখড়াই প্রভৃতি পঠিত হয়।
একসময় উচ্চবিত্তীয় ও নিম্নবিত্তীয় পরিমণ্ডলে কবিগানের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল, কিন্তু বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির যুগন্ধর পুরুষরা এ গান সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেননি বা করতে পারেননি। অশ্লীলতা ও আদিরসের ব্যবহার দেখে তাঁরা একে নিকৃষ্ট শ্রেণির বিনোদন মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কবি ঈশ্বরগুপ্ত কবিগানকে ‘অপবিত্র শব্দে বিন্যস্ত… অতিজঘন্য, অতিঘৃণিত, অশ্রাব্য, অবাচ্য শব্দে পুরিত’ বলে তিরস্কার করেছেন, কিন্তু পণ্ডিতপ্রবর বিদ্যাসাগর কবিগানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। উনিশ শতকের শেষদিকে রবীন্দ্রনাথও কবিগান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন, তবে তিনি এও বলেছেন, ‘কবির দলের গান আমাদের সাহিত্য এবং সমাজের ইতিহাসের একটি অঙ্গ– এবং ইংরেজ রাজ্যের অভ্যুদয়ের যে আধুনিক সাহিত্য রাজ্যসভা ত্যাগ করিয়া পৌরজনসভায় আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছে, এই গানগুলি তাহারই প্রথম পথপ্রদর্শক।’ রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছেন, কবিগান ‘বঙ্গ সাহিত্যের স্বল্পক্ষণস্থায়ী গোধূলি আকাশে অকস্মাৎ দেখা দিয়েছিল’।
এখন প্রশ্ন, বঙ্গ সাহিত্যাকাশে অকস্মাৎ আবির্ভূত-হওয়া কবিগান কি কবিতা না গান? কবিগানের রচয়িতারা কবি-সাহিত্যিক হিসেবে অভিহিত হন নাকি অন্য কিছু? এসব প্রশ্নের সুরাহা করতে গিয়ে অনেক পণ্ডিত ও সাহিত্যবোদ্ধা কূল-কিনারা হারিয়ে ফেলেছেন। কবিগানের রচয়িতারা কখনওই কবি বা সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি পাননি, তাঁরা কবিয়াল, লোককবি বা সরকার হিসেবে পরিচিত লাভ করেছেন। কোনও কোনও সাহিত্য-গবেষকের মতে, কবিয়ালরা যেমন কবি নন, তেমনই কবিগানও কবিতা নয়। কারণ কবিতা রচনার প্রতি তাঁদের তেমন মনোযোগ ছিল না, তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আসরে নামা প্রতিপক্ষ কবিয়াল ও তাঁর দলকে পরাস্ত বা ঘায়েল করে যশ-খ্যাতি ও অর্থলাভ করা। তার পরও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কবিয়ালরা স্মরণীয় হয়ে আছেন, কারণ মধ্যযুগের বড় কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের (১৭১২-১৭৬০) তিরোধানের পর বাঙালির শিল্পভুবন তথা সাহিত্যাকাশে দীর্ঘকাল ব্যাপী যে গাঢ় অন্ধকার দেখা দিয়েছিল, সেই অন্ধকার দূর করতে এই কবিয়ালরাই প্রদীপ জ্বালতে চেয়েছিলেন, যদিও সফল হতে পারেননি। সাহিত্য-সংস্কৃতি ভুবনে আলো জ্বালানোর জন্য যে উন্নত রুচিবোধ, প্রতিভা, পরিশীলন ও সংযমতা প্রয়োজন, সেটা তাঁদের মধ্যে ছিল না বললেই চলে। ফলে সাহিত্যের আঙিনায় যে গাঢ় আঁধার ভর করেছিল, সেটা সময়ের পরিক্রমায় আরও ঘন ও আরও গাঢ়তর হয়। তার পরও কবিগান বা কবি-সঙ্গীতের রসমূল্য, বিনোদনমূল্য ও জনাদর অস্বীকার করা যায় না।
ভেবে বিস্মিত হতে হয়, কালের ঝড়-ঝাপটা সয়ে আজও এ গান টিকে আছে, আজও এ গানের অনুশীলন ও পরিবেশনা রয়েছে, জনপ্রিয়তাও রয়েছে, তবে এর সুর-স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ন রাখা যায়নি। স্থূল গ্রাম্যতা ও অশ্লীলতার দায়ে কবিগান এতটাই লুপ্ত ও বিধ্বস্ত হয় যে, এর তাল, সুর ও গায়নপদ্ধতির বিশুদ্ধ রূপ আর আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। ফলে বাংলা গানের গুরুতর ক্ষতি হয়ে গেছে, অথচ এর সুর-স্বাতন্ত্র্য ও গায়কী আমাদের সামাজিক ও সাঙ্গীতিক জিজ্ঞাসার জন্য একুশ শতকেও খুবই প্রাসঙ্গিক। বিষয়-বৈভব ও বৈচিত্র্যের কারণে একুশ শতকের মননশীল গবেষক, লেখক ও চলচ্চিত্রকাররাও কবিগানের শিল্প ও সাহিত্যিক মূল্য অস্বীকার করতে পারছেন না, যদিও এ গানের উদ্ভব ও বিকাশকাল নিয়ে পণ্ডিত ও গবেষকদের মধ্যে বিস্তর মতদ্বৈধতা ও বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, সপ্তদশ শতাব্দীতে কলকাতা নামক নগরটির পত্তনের সমসময়ে বঙ্গদেশের জমিদার ও রাজা-মহারাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে কবিগানের জন্ম, যার এক পা ছিল গ্রামে, আরেক পা কলকাতায়। সাহিত্য-গবেষকদের ধারণা, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, নবকৃষ্ণ বাহাদুরের মতো জমিদাররা ‘জ্ঞাতি, কুটুম্ব, স্বজন, সজ্জন, পরিজনে পরিবেষ্টিত হইয়া গদগদ চিত্তে কবিগান শ্রবণ করিতেন’।
ইতিহাস ও পুঁথি-পাঁচালি ঘেঁটে জানা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে চন্দননগর-চুঁচুড়া, সপ্তগ্রাম, শ্রীরামপুর, শান্তিপুর-কৃষ্ণনগর, কাশিমবাজারের জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় গঙ্গার দুধারে বেশ কয়েকটি কবিগানের আখড়া গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে বিকাশ-পরিপুষ্টি, জনসম্পৃক্তি ও সমাদর ঘটে কলকাতার বাবুসমাজের পৃষ্ঠপোষকতায়। সেই হিসাবে ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ পর্যন্ত সময়কালকে কবিগানের স্বর্ণযুগ হিসেবে গণ্য করা হয়। কবিগান, কবিয়ালদের জীবনী, গানের সংকলন নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। কবি ঈশ্বরগুপ্ত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় কবিয়ালদের জীবনী ও কবিগান সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছিলেন। ‘কবি-সঙ্গীত’ নামে রবীন্দ্রনাথ একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ রচনা করেন। সজনীকান্ত দাশ রচনা করেন ‘বাংলার কবিগান’ নামে এক অসাধারণ গ্রন্থ। কবিগানের ভাবৈশ্বর্য অবলম্বনে পল্লীকবি জসীমউদদীন অজস্র কালোত্তীর্ণ কবিতা ও মননশীল প্রবন্ধ রচনা করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কবিয়াল ভোলা ময়রার গানের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাকে জাগাতে যেমন রামগোপাল ঘোষের মতো বাগ্মী, হুতোম প্যাঁচার মতো আমুদে লোকের প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন ভোলা ময়রার মতো লৌকিক গায়কদের।’
বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির এই বলবান ও লোকপ্রিয় ধারাটি সম্পর্কে আজ পর্যন্ত যত গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, তন্মধ্যে কৃতবিদ্য অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন আরা সাথীর ‘কবিগান: সমাজপরিপ্রেক্ষিত ও রূপবৈচিত্র্য’ বইটি প্রকৃতপক্ষে একটি মহামূল্যবান আকরগ্রন্থ। রাজনৈতিক উত্থান-পতন, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, অভাব-দুর্ভিক্ষ, প্রতিরোধ-আন্দোলন কবিগানের ওপর কেমন প্রভাব বিস্তার করেছে, সেটারও অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন মনস্বী গবেষক ইয়াসমিন আরা সাথী তাঁর এই বইয়ে। পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের কবিগানের স্থানিক বৈশিষ্ট্য ও কবিয়ালদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে আলোচ্য গ্রন্থে। অধ্যাপক ইয়াসমিন আরা সাথী বাংলা সাহিত্যের নানা শাখায় কাজ করে মনস্বিতার স্বাক্ষর রেখেছেন, কিন্তু তাঁর আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসার প্রধান ক্ষেত্র বাংলার লোকজীবন ও লোকসাহিত্য। আলোচ্য বইটি পোস্ট-ডক্টরাল অভিসন্দর্ভ হিসেবে রচিত হলেও এটি গৎবাঁধা একাডেমিক ছকে লেখা হয়নি। বরং এই বইয়ে লেখকের গবেষকীয় সত্তার সঙ্গে সৃজনশীল সত্তার সম্মিলন ঘটেছে। পাঁচটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত বইটির ভাষাভঙ্গি, বর্ণনাশৈলী দারুণভাবে নির্মেদ, ঝরঝরে, প্রাঞ্জল ও মনোগ্রাহী। ভূমিকায় তিনি লেখেন: “কবিগান’ আসরে পরিবেশিত গান। যাঁরা কবিগান পরিবেশন করেন তাঁদেরকে বলা হয় ‘কবিয়াল’ বা ‘কবিওয়ালা’। পশ্চিমবঙ্গে এঁরা লোককবি নামে পরিচিত। কবিয়ালরা গায়ক ও কবি। কবিগান একসময় পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। আঙ্গিক ও বিষয়বৈচিত্র্যের কারণে কবিগান বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নেয়।” (ভূমিকা-২) তিনি আরও বলেন, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর গায়ক হন বর্ণজ্ঞানহীন নিম্নসম্প্রদায়। তবে বর্তমান সময়ে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও কবিগান করেন। কবিগানের ভাষা, রচনারীতি, ছন্দ-অলঙ্কার বিদগ্ধ সমাজে সমালোচিত হলেও এর শিল্পমূল্য অস্বীকার করার উপায় নেই।’ সাহিত্যিক মূল্য স্বীকার করে নিয়ে বাংলা সাহিত্যের কৃতী শিক্ষক ও গবেষক ড. ইয়াসমিন আরা সাথী কবিগানকে ‘বাঙালির হৃদয়ের সামগ্রী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কবিগানের উদ্ভব ও বিকাশকাল নিয়ে যে ভ্রান্তি, সেটা দূর করারও চেষ্টা করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, ড. হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ও ড. সুশীলকুমার দের মতো সাহিত্য-গবেষকগণের অভিমতের সঙ্গে একমত পোষণ করে তিনি বলেন, সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বাংলা সংস্কৃতির এই উজ্জ্বল ধারাটি পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। ড. সুশীলকুমার দে কবিগানের উদ্ভব ও বিকাশকাল সম্পর্কে বলেন, ‘অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে, এমনকি সপ্তদশ শতাব্দীতেও কবিগানের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু কবিওয়ালাদের প্রকৃত বিকাশকাল ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যবর্তী সময়।’১ আঠারো শতকের মধ্যভাগ থেকে পরবর্তী অর্ধশতাব্দীকাল নব্য কবিগান ও পাঁচালি গান কলকাতা ও তৎসলগ্ন অঞ্চলে এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, সাহিত্যের অন্যান্য ধারাগুলির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। কিন্তু বিশ শতকের প্রারম্ভে কলকাতার কবিগান আধুনিক জীবনের তরঙ্গ-বিভঙ্গের অভিঘাত সইতে না-পেরে অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে গ্রামের দিকে যাত্রা করে। ভিক্টোরিয় রুচিশাসিত কলকাতা মহানগরের ভদ্রসমাজ এ গানকে গ্রহণ না-করলেও গ্রাম-জনপদে টিকে থাকে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে।
২
আলোচ্য গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে লেখক কবিগানের ঐতিহ্য ও স্বরূপসন্ধান করতে গিয়ে কবিয়াল এবং কবিগানের সংজ্ঞা ও স্বরূপ, উৎস ও উৎসবকাল, পরিবেশনরীতি, বিভিন্ন পর্যায়, দল, আসর ও পৃষ্ঠপোষক সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, দীর্ঘ ঐতিহ্যের পথ ধরে কবিগান বাঙালির একান্ত আপন ভাবসম্পদে পরিণত হয়েছে। কবিগান সম্পর্কিত ধারণা স্পষ্টতর করতে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, ‘ভারতবর্ষে পূর্বে জ্ঞানীমাত্রকেই কবি বলিত। শাস্ত্রবেত্তারা সকলেই কবি। শাস্ত্রকাররাও কবি, জ্যোতিষশাস্ত্রকাররাও কবি।– তারপর এই শতাব্দীর প্রথমাংশে ‘কবির লড়াই’ হইত। দুইদল গায়ক জুটিয়া ছন্দোবদ্ধে পরস্পরের কথার উত্তর-প্রত্যুত্তর দিতেন। সেই রচনার নাম ‘কবি’।২ কবিগানকে একসময় কবি-সঙ্গীত বলা হত, রবীন্দ্রনাথও কবিগানকে অভিহিত করেছেন কবি-সঙ্গীত হিসেবে। কবিতার সঙ্গে সঙ্গীত মিশ্রিত হয়ে কবি-সঙ্গীত সৃষ্টি হয়েছে বলে কবিগানের রচয়িতারা কবিয়াল নামে পরিচিত, যাঁরা একাধারে কবি ও গায়ক। তাঁরা যখন গানরচনা করেন তখন তাঁরা কবি, আর যখন গেয়ে থাকেন তখন তাঁরা গায়ক। তবে এঁরা কেউ-ই কোনও মৌলিক সাহিত্যসৃষ্টি করতে পারেননি। কবিয়ালদের সম্পর্কে লোকগবেষক দীনেশচন্দ্র সিংহ বলেন, ‘‘কবিওয়ালা’ শব্দটিই প্রাচীন। কবিগায়কগণ পয়সা নিয়ে গান করেন। গান তাঁদের পেশা ও ব্যবসা।’৩ কবিগানের উৎস ও উদ্ভবকাল বর্ণনা করতে গিয়ে গবেষক ইয়াসমিন আরা সাথী বাংলা গানের ইতিহাস ও বাঙালি সমাজের ঐতিহাসিক পরিবর্তন ও বাঁকবদলগুলি সম্পর্কেও ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তন করলে বাংলার চিরায়ত সমাজব্যবস্থার খোল-নলচে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, বিধ্বস্ত হয় গ্রাম-জনপদের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ। অন্যদিকে ইংরেজদের অনুকম্পায় ব্যবসায়ী, বেনিয়ান, স্টিভডোর, জোগানদারদের নিয়ে গড়ে ওঠে কলকাতাকেন্দ্রিক একটি সচ্ছল বাবু শ্রেণি। স্বল্পসময়ের মধ্যে এই বাবুরা ‘কলকাতার দ্রুত পরিবর্তনশীল ভাগ্যাকাশে উজ্জ্বল তারকার মত স্থান করে নেয়’। ‘এইসব বঙ্গসন্তান বেশিরভাগ ছিলেন প্রায় অশিক্ষিত, কুরুচিপূর্ণ, প্রমোদ-পরায়ণ, প্রমদাসক্ত এবং হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। অর্থগৃধ্নু ও অলস। আদি কলকাতার নানা বর্গের গান ও গায়ক সম্প্রদায় গড়ে ওঠে এঁদেরই স্বৈর-ইচ্ছায় ও খালখেয়লিপনায়।– দেশকাল সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে এঁদের ছিল না ন্যূনবোধ। দেশপ্রেম ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যচেতনা ছিল এঁদের অজ্ঞাত। এক সামূহিক ও আত্মনাশা বিনোদনে এঁরা ভোগবাদী হয়ে উঠেছিলেন।’৪ নেতৃস্থানীয় এই ভোগবাদী বাবু শ্রেণির আমোদ-আহ্লাদ ও রসতৃষ্ণা নিবারণের জন্য কবিগান ও কবিয়ালদের উদ্ভব। ইংরেজ আমলের নব্যধনীরাই ছিলেন কবিগানের পৃষ্ঠপোষক ও সমঝদার, ফলে কবিগানের কথা ও সুরে কুরুচি ও বিকৃতির ছাপ পড়ে এক অনিবার্য কারণেই। কবিগানের ভিতর-বাহির লক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ খেদের সঙ্গে বলেছেন, কবিগানে ‘কলঙ্ক’ ও ‘ছলনা’ এদুটি বিষয়ই এ গানে প্রাধান্য পেয়েছে। কবিগানে রাধাকৃষ্ণ কাহিনির কলঙ্ক ও ছলনা অংশটুকু ব্যক্ত হয়েছে মূলত আমোদগেড়ে শ্রোতাদের রস-রুচির পরিতৃপ্তির জন্য।
৩
কবিগান রাজদরবার বা রাজসভার গান নয়, এ গানের আশ্রয়দাতা সর্বসাধারণের রাজা তথা কলকাতার নব্য ধনিক শ্রেণি। কলকাতা মহানগরকে কেন্দ্র করে কবিগান বিকশিত হলেও সময়ের পরিক্রমায় এ গান গ্রাম-জনপদ ও মফস্বল শহরে ছড়িয়ে পড়ে, সেটারও বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে আলোচ্য গ্রন্থে। কবিগানের ওপর সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রভাব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গবেষক আলোচ্য গ্রন্থে কবিয়ালদের একটি বিশাল তালিকা প্রণয়ন করেছেন বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্যসংগ্রহ করে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মতের সঙ্গে সহমত পোষণ করে তিনিও গোঁজলা গুঁইকে (১৭৬০- ১৮২১) প্রাচীন কবিয়ালদের মধ্যে অগ্রগণ্য হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। তাঁর চারজন শিষ্য হলেন– লালু, নন্দলাল, রামজী রঘুনাথ দাস ও কৃষ্ণচন্দ্র দাস ওরফে কেষ্টামুচি। এ যুগের শ্রেষ্ঠ কবিয়াল রাম বসু (১৭৮৬-১৮২৮) ছিলেন রামজীর প্রশিষ্য। মহানগর কলকাতার উত্থানপর্ব ও কবিয়াল রাম বসুর বেড়েওঠা একই সময়ে। হরু ঠাকুরের (১৭৪৯- ১৮২৪) শিষ্য ভোলা ময়রা উনিশ শতকে কবিয়াল হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর গানে শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকত। ভোলা ময়রার এই গান একসময় মানুষের মুখেমুখে ফিরত। কবিয়াল হিসেবে ঠাকুরদাস সিংহ ও এন্টনি ফিরিঙ্গিও খুব জনপ্রিয় ছিলেন। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘জাতিস্মর’ সিনেমায় কবিয়াল রাম বসু ও যজ্ঞেশ্বরীকে একালের বব ডিলান ও জোয়ান বায়াজের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাঁদের প্রেম ও রোম্যান্স নিয়ে অনেক রসালো কাহিনি রয়েছে। যজ্ঞেশ্বরীর গানে পরিস্ফূট হয়েছে বাঙালি-নারীর মানসিক যন্ত্রণার চালচিত্র।
রাম বসুর সঙ্গে এন্টনি ফিরিঙ্গির প্রায় লড়াই হত। একদিন এক আসরে রাম বসু বললেন:
‘একবার বলো হে, এন্টনি আমি একটি কথা জানতে চাই,
এসে এই দেশে তোমার গায়ে কেন কুর্তি-টুপি নাই।’
তৎক্ষণাৎ এন্টনি ফিরিঙ্গি জবাব দিলেন:
‘এই বাংলায় বাঙালির বেশে আনন্দেতে আছি।/ হয়ে ঠাকরে সিংহের বাপের জামাই কুর্তি-টুপি ছেড়েছি।’
এন্টনি ফিরিঙ্গি ছিলেন কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের অধিকারী বাকশিল্পী। এক আসরে রাম বসু বলছেন:
‘সাহেব, মিছে তুই কৃষ্ণপদে মাথা মুড়ালি।/ ও তোর পাদ্রীসাহেব জানতে পারলে মুখে দেবে চুনকালি।’
শান্ত কণ্ঠে সেই আক্রমণের জবাবে এন্টনি ফিরিঙ্গি বলছেন:
‘খ্রিস্টে আর কৃষ্টে কিছু তফাত নাইরে ভাই।/ শুধু নামের ফেরে মানুষে ফেরে এও কথা শুনি নাই।’
এই এন্টনি ফিরিঙ্গি পর্তুগীজ ছিলেন, কিন্তু সৌদামিনী নামক এক ব্রাহ্মণকন্যার পাণিগ্রহণ করে গোদালপাড়ার কাছে এক বাগানবাড়িতে বাস করতেন। কলকাতাকেন্দ্রিক মধ্যযুগীয় কবিয়ালদের যুগবসানের পর আসে পূর্ববঙ্গীয় কবিয়ালদের যুগ। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে পূর্ববঙ্গের কবিগানের ধারাকে সমৃদ্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা যশোরের বাগজয়পুর গ্রামের কবি রসরাজ তারকচন্দ্র সরকার ও হরিচরণ আচার্য। তারকচন্দ্রের বাবা কাশীনাথ সরকারও কবিয়াল ছিলেন। তিনি অন্ত্যজ শ্রেণিভুক্ত ছিলেন বিধায় তিনিই প্রথম সুরকার থেকে সরকার পদবি ব্যবহার করেন। তখন থেকে কবিয়ালরা বংশগত পদবি ত্যাগ সরকার পদবি ব্যবহার করতে থাকেন। তারক সরকার গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দির হরিঠাকুর প্রবর্তিত মতুয়াধর্মের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কবিগানে সাঙ্গীতিক কুশলতা ও নৈপুণ্য দেখিয়ে যাঁরা খ্যাতি অর্জন করেছেন তাঁদের মধ্যে পাঁচু সরকার (উনিশ শতক), নড়াইলের তারকচন্দ্র সরকার (১৮৪৫-১৯১৪), বাগেরহাটের রাজেন্দ্রনাথ সরকার (১৮৯২-১৯৭৪), নড়াইলের বিজয় সরকার (১৯০৩-১৯৮৫), অশ্বিনী সরকার (১৮৭৭-১৯২৭) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নড়াইলের তারকচন্দ্র সরকারের শিষ্য-পরম্পরার কবিয়ালগণ বিশ শতকে বৃহত্তর যশোর, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশালে প্রতিনিধিত্ব করেন। গোপালগঞ্জের হরিবর সরকার, মনোহর গোঁসাই (১৮৭৯-১৯৩৯), বাগেরহাটের অনাদিজ্ঞান সরকার, কামিনী সরকার প্রমুখ ছিলেন তারক সরকারের শিষ্য-পরম্পরায় কবিয়াল। এঁরা নিরক্ষর কিংবা স্বল্পশিক্ষিত হলেও সমাজ-রাজনীতিমনস্ক, তত্ত্বজ্ঞান ও রসবোধসম্পন্ন। তারক সরকারের শিষ্যপরম্পরার কবিয়ালদের মধ্যে রাজেন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন সমাজসচেতন এবং ব্যক্তিগতভাবে নিম্নবর্গীয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের বর্ণাশ্রম প্রথা, ছুঁৎমার্গ, অস্পৃশ্যতা, জাতপাতের বিরুদ্ধে রাজেন্দ্রনাথ সরকার গান করেছেন বিভিন্ন আসরে। তাঁর মালশি গানের একটি বিখ্যাত অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হল:
‘কতো মদের নেশায় বদের দশায় ব্রাহ্মণ খায় বেশ্যাবাড়ির ভাত।/ তাতে হয় না জাতিপাত, মাগো বেশ্যালয় কি ঠাকুর জগন্নাথ।।/ নটীর হুঁকার তামাক খেয়ে কুলীন কোলায় বাড়ি গিয়ে/ এসব ব্রাহ্মণ কেন প্রণাম দিয়ে নটীর পদে কোটি দণ্ডবৎ।’
রাজেন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন একাধারে সুগায়ক, প্রতিভাধর বাদ্যযন্ত্রী, প্রত্যুৎপন্ন বাকশিল্পী। তিনি কলকাতার মানুষকে পূর্ববঙ্গের কবিগান শুনিয়েছিলেন কলকাতার আলবার্ট হলে। রাজেন্দ্রনাথ সরকারের প্রায় সমসাময়িক নড়াইলের বিজয় সরকারেরও কবিয়াল হিসেবে খ্যাতি ছিল বাংলার সারস্বত সমাজে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও সুকুমার সেনের মত পণ্ডিতরাও তাঁর গানের প্রশংসা করেছেন। বিজয় সরকার কবিগানকে খিস্তিখেউড়ের ঘেরটোপ থেকে বের করে এনে শিল্পোত্তীর্ণ সঙ্গীতে রূপান্তরিত করেছেন।
কবিয়াল বিজয় সরকার পল্লীকবি জসীমউদদীনের ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ কাব্যের মূলচরিত্র রূপাই ও সাজুর জীবনালেখ্য অবলম্বনে একটি অনবদ্য গান রচনা করেন। তিনি গেয়েছেন:
‘নক্সীকাঁথার মাঠেরে/ সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রূপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি।/ তাদের আশার বাসা ভেঙে গেছেরে/ তবু যায়নি ভালবাসাবাসি।।/ সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রূপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি।/ কত আশা বুকে নিয়ে (তারা) বেঁধেছিল ঘর/ কত সুখে মিশেছিল মিলন-মঞ্চ ‘পরে/ হঠাৎ আসিয়া এক বৈশাখী ঝড়রে/ সেঘর কোথা গেল ভাসি।।/ সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রূপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি।/… নক্সীকাঁথার মাঠে লোকে আজো শুনতে পায়/ সাজুর ব্যথায় রূপাই মিঞার বাঁশরি বাজায়/ পাগল বিজয় বলে পরাণে চায়ও /আমি একবার গিয়ে শুনে আসি।।/ সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রূপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি।’৫
বিজয় সরকার ছিলেন পল্লীকবি জসীমউদদীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পল্লীকবি বিজয়ের গান সম্পর্কে বলেছেন, ‘বিজয়ের রচিত বিচ্ছেদগান শুনিয়া পাগল হই। এমন সুন্দর সুর বুঝি কেহই রচনা করিতে পারে না।’৬ জসীমউদদীন শৈশব থেকেই ছিলেন কবিগানের গুণমুগ্ধ ভক্ত। অল্পবয়সে নিজগ্রাম অম্বিকাপুরের সন্নিকটবর্তী লক্ষীপুর গ্রামে কবিয়াল হরি আচার্যের কবিগান ও তার জ্ঞানগর্ভ কথার ঝলকানিতে মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরিণত বয়সে তিনি হরি আচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেছিলেন, “আপনার রচিত নিমাই সন্ন্যাস গানটি যদি আগে শুনিতাম, তবে হয়তো আমার ‘কবর’ কবিতা রচনা করিতাম না। আপনার নিমাই সন্ন্যাস যে আসরে গীত হয়, সেখানে শ্রোতারা কাঁদিয়া বুক ভাসায়।”
এ যুগে কবিগানের সেই জৌলুশ তেমন নেই, তার পরও বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলির বিভিন্ন গ্রামে কবিগানের আসর বসে। ড. ইয়াসমিন আরা সাথী দুই বাংলার গ্রামগঞ্জ ঢুঁড়ে দেখেছেন এখনও অনেক শিল্পী কবিগানের সাথে যুক্ত আছেন, কবিয়ালগিরিই তাঁদের পেশা। এক্ষেত্রে নড়াইলের নারায়ণ বালা, মীরা সরকার; খুলনার বটিয়াঘাটার সদানন্দ সরকার; বাগেরহাটের মণিশঙ্কর সরকার, শঙ্কর সরকার; মেহেরপুরের রমজান আলী বিশ্বাস, কমরউদ্দিন বিশ্বাস, চুয়াডাঙ্গার নুর ইসলাম প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। গবেষণাগ্রন্থ কিংবা অভিসন্দর্ভ প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ড. ইয়াসমিন আরা ক্ষেত্রসমীক্ষাকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করেছেন। প্রাচীন কবিয়ালদের জীবন কর্ম ও তাঁদের গান অনুসন্ধান করতে গিয়ে খুঁজে বের করেছেন অনেক হারিয়ে-যাওয়া গ্রাম, হাট-বাজার ও আম্রকানন– যেখানে কবিগানের আসর বসত। ক্ষেত্রসমীক্ষা পরিচালনা করতে গিয়ে খুঁজে পান মেহেরপুরের আলমপুর গ্রামের কবিয়াল অনিলকুমার মুখোপাধ্যায় ও তাঁর গুরু বিষ্ণুনারায়ণ পাণ্ডে নামের দুই অবজ্ঞাত ও উপেক্ষিত কবিয়ালকে, যাঁরা তাঁদের সমকালে ছিলেন আসর-জমানো কবিয়াল। করিমপুরের কবিয়াল বলহরি সাহা কবিগান করতে এসেছিলেন মেহেরপুরের হিতিমপাড়া গ্রামে, এ তথ্যও লেখক সংগ্রহ করেছেন। হিতিমপাড়ায় যে আমবাগানে একসময় মহাসমারোহে কবিগানের আসর বসত, সেটাও উল্লেখ করেছেন। কবিগানের বৈচিত্র্য, উপমা, রূপক জানতে দিনাজপুরের কবিয়াল এম এ কুদ্দুসের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, গবেষকীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে।
৪
‘কবিগানের সমাজপরিপ্রেক্ষিত ও কবিয়ালের সমাজভাবনা’ অধ্যায়ে গবেষক দেশভাগ-পূর্ব অবিভক্ত বঙ্গদেশের কবিগানের প্রবণতা ও সমাজবাস্তবতা বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসিত কবিয়ালরা কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের কবিগানকে প্রভাবিত করেছেন সেটা তিনি আলোচনা করেছেন। সমাজ-রাজনীতির কোন অংশের ওপর কবিয়ালরা কীভাবে আলো ফেলতে চেয়েছেন, সেটাও তিনি তুলনামূলক ও বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
‘যদি শ্যাম না এল বিপিনে/ তবে কি হবে সজনি।/ লম্পটোস্বভাব তার জানি।/– বুঝি কারো সহবাসে পোহায় রজনী।।’৭ হরু ঠাকুর, ভোলা ময়রা, ঠাকুরদাস সিংহের কবিগান অশ্লীলতাদোষে দুষ্ট হলেও অশ্লীলতার ধারাটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে কবিগান দেশরাষ্ট্রসমাজ অভিমুখী হয়, কবিগানের কথায় ধ্বনিত হতে থাকে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সুর। যুক্ত হয় দেশপ্রেম, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, পরাধীনতার গ্লানি, স্বদেশি আন্দোলন ও বিলাতি পণ্যবর্জন সহ নানা রাজনৈতিক অনুষঙ্গ। কবিগান ‘বৈষ্ণবলীলাকুঞ্জের মন্ত্রশান্ত বেষ্টনী’ অতিক্রম করে ‘বাস্তবজীবনের অশান্ত অন্তর্দ্বন্দ্বসংক্ষুব্ধ পরিবেশে অবতরণ’ করে। স্বদেশি যুগে চারণকবি নিতাই দাস, কিশোরীমোহন, মুকুন্দদাসের মতো কবিয়াল ও পালাকাররা বাঙালির জীবনে যে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন, সেটাও দেখানো হয়েছে আলোচ্য বইয়ে। ১৯০৮ সালে পুলিশের হাতে আটক হয়ে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর ফাঁসি হয়, হাসতে হাসতে ক্ষুদিরাম বসু ফাঁসির মঞ্চে আরোহণ করেন। অসংখ্য বিপ্লবীর আত্মবলিদানের বিনিময়ে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি আসে না। কিশোরীমোহন নামের বীরভূমের এক কবিয়াল পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক দুর্দশা ও মানবিক অবক্ষয় নিয়ে গানেগানে প্রশ্ন করেন,
‘ক্ষুদিরাম প্রফুল্ল চাকী/ জীবন দিল এইজন্য কি/ দুঃখের কথা জানাব কি নাই জানাবার ক্লেশ।’
দেশভাগ ও দেশভাগের দুর্মর যন্ত্রণা, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, শ্রমিক অসন্তোষ, বেকারত্ব, নকশাল আন্দোলন, কৃষক বিদ্রোহ, ব্যভিচারিতা, কালোবাজারি, বামপন্থী গণআন্দোলন, মধ্যবিত্তের আদর্শচ্যুতি ও স্বপ্নভঙ্গের হাহাকার, দেশত্যাগী-ছিন্নমূল মানুষের মর্মবেদনাও প্রতিফলিত হয়েছে কবিগানে। ছিন্নমূল, খেটে-খাওয়া কৃষকের প্রসঙ্গও অনিবার্য হয়ে বারবার ফিরে এসেছে কবিগানের ঝরনাতলায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়েও যে বাংলার কবিয়ালরা গান বেঁধেছেন, সেটা নিয়ে আমাদের একাডেমিক পরিমণ্ডল তেমন সরব নয়। শেকড়সন্ধানী গবেষক ড. ইয়াসমিন আরা তাঁর গবেষণাগ্রন্থে উল্লেখ করেন, কবিয়াল বিজয় সরকার, রসিকলাল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একাধিক গান রচনা করেছেন। এসব গানে বঙ্গবন্ধুকে দীনদরিদ্রের দরদি, স্বাধীনচেতা নেতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ১৯৭৫-এ জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ড, সামরিক স্বৈরশাসন এবং মৌলবাদের উত্থান নিয়েও যে দুবাংলার কবিয়ালরা অসংখ্য গান রচনা করেছেন, সেটা এই গ্রন্থের পাঠগ্রহণ না করলে অজানা থেকে যেত। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদদীনের মতো বিজয় সরকারও যে উচ্চস্তরের সমাজ-ভাবুক, মানব-দরদি ও রাজনীতিমনস্ক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তার সমর্থনে অজস্র গানের উদাহরণ টেনেছেন গবেষক। জনজাগরণে, সমাজচৈতন্যকে উজ্জীবিত করতে, সমাজকে প্রগতির পথে চালিত করতে স্বল্পশিক্ষিত কিংবা সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন কবিয়ালরাও যে কখনও লোকশিক্ষক, কখনও লোকনেতার ভূমিকা পালন করেছেন, তা এই বইয়ের পাতায় পাতায় খুঁজে পাওয়া যাবে।
৫
বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে কবিগানে পুরাণভাবনা নিয়ে। এ অধ্যায়ে পুরাণের সংজ্ঞা, কবিগানে প্রাচ্য পুরাণের ব্যবহার, বিভিন্ন পৌরাণিক আখ্যান ও চরিত্র সম্পর্কে কবিয়ালদের নিজস্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন গবেষক। হরু ঠাকুর, ভোলা ময়রা, এন্টনি ফিরিঙ্গি, রাজেন্দ্র সরকার, হরিচরণ আচার্যের গানে দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী সহ নানা পৌরাণিক অনুষঙ্গ ভিন্নতর ব্যঞ্জনা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যবহৃত হয়েছে, সেটার বিস্তৃত বর্ণনা করা হয়েছে। গবেষক বলেছেন, ‘কবিগানে যে পুরাণ ব্যবহৃত হয়েছে তার অধিকাংশই চিরায়ত। তবে কখনও কখনও শুধু কাহিনি বর্ণনের বিষয় না হয়ে সমকালীন বিষয়ের সাথে যুক্ত হয়েছে। (পৃষ্ঠা: ২৬৭)
‘কবিগানের রূপবৈচিত্র্য’ অধ্যায়ে লেখক উনিশ ও বিশ শতকের কবিগানের বিন্যাসগত বৈচিত্র্য আবিষ্কার করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এ অধ্যায়ে তিনি পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের কবিগানের উপস্থাপনশৈলীর পার্থক্য ও পরিবর্তন সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। ধ্বনিগত রূপান্তরের মাধ্যমে কবিগানে যেসব অবজ্ঞাসূচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেসব বিষয়ও লেখক উল্লেখ করেছেন। সময় পরিক্রমায় কবিগানের ব্যাপ্তি, পরিবেশনরীতি, যন্ত্রানুষঙ্গের প্রয়োগে পরিবর্তন এসেছে, বদলে গেছে এর কন্টেন্ট বা বিষয়বৈভব। শাক্ত-বৈষ্ণব ভাবে ভাবিত কবিগানে যুক্ত হয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষঙ্গ, আঠারো-উনিশ শতকীয় সমাজবাস্তবতায় কবিয়ালরা হয়ে ওঠেন নন্দিত লোকশিক্ষক কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে সর্বজনমান্য লোকনায়ক। লেখক কবিগানের সাহিত্যমূল্য বা কাব্যমূল্য বিচার করতে গিয়ে এর শব্দবৈচিত্র্য, ছন্দ, উপমা, রূপক, চিত্রকল্পও কবিগানে ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন নিয়েও আলোচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার ও গবেষকরা কবিগানের গবেষণায় পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের কবিগানকে সবিশেষ গুরুত্ব দেননি। কিন্তু অবিভক্ত নদীয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যস্নাত কন্যা হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থের লেখক পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পদ্মা-মেঘনা-বুড়িগঙ্গা বিধৌত পূর্ববঙ্গের কবিগানকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ তিনি ভাল করেই জানেন, ‘পূর্ববঙ্গ কবির রাজ্য/ ঢাকার সেই হরি আচার্য/অসংখ্য তার শিষ্যভক্ত/ বাংলাদেশ কবির ক্ষেত্র’। পূর্ববঙ্গ বিশেষত ঢাকা-ময়মনসিংহ-ফরিদপুর অঞ্চলের সঙ্গে রাঢ়বঙ্গের শব্দের ব্যবহার-বৈচিত্র্যও তুলনামূলকভাবে আলোচনা করা হয়েছে এ অধ্যায়ে। লেখক কবিগানের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করতে বলেন, ‘আধুনিক কলাবিধিতে আসতে কবিগানকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এই পথপরিক্রমায় কবিগানের বহুমাত্রিক পরিবর্তন ও রূপান্তর ঘটেছে।’ (পৃষ্ঠা: ২৭৫) কবিগান একসময় সৌখিন বাবুদের ‘উদ্দাম অশ্লীল আনন্দের উদ্দাম সহচারিণী ছিল’, পরে তার গায়ে ‘কলকাতার সংস্কৃতির মণ্ডপে মাজাঘষা’ করে ধোপদুরস্ত আধুনিক আবরণ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শিল্প-সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তিমাত্রই জানেন, কবিগান বাংলার লোকসংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ। প্রায় পৌনে দুইশত বছর ধরে কবিগান নিয়ে বিস্তর লেখালেখি ও গবেষণা হয়েছে। কবিগানের ওপর অভিসন্দর্ভ রচনা করে বহু ধীমান গবেষক পিএইচ.ডি উপাধি অর্জন করেছেন। কবিগানের উপর ভিত্তি করে ‘এন্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘ভোলা ময়রা’, ‘জাতিস্মর’-এর মতো দর্শকনন্দিত সিনেমা নির্মিত হয়েছে, রচিত হয়েছে অজস্র যাত্রা-নাটক। সত্যি বলতে কী, এমন লোকপ্রিয় বিষয় বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা ভাষা, সঙ্গীত ও সাহিত্যে কবিগান ও কবিয়ালদের অবদানের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগান সংগ্রহ এবং এ বিষয় পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে কবিয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কিংবা কবিগানকে সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক এ গানকে সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই গানের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে লোকায়ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক, যার অধিকাংশই অনালোচিত ও অনালোকিত রয়েছে অদ্যাবধি। ড. ইয়াসমিন আরা সাথীর লেখা বর্তমান গ্রন্থটি কবিগানের সমাজপ্রেক্ষিত ও রূপবৈচিত্র্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এক অমূল্য সংযোজন। ক্ষেত্রসমীক্ষাকেন্দ্রিক গবেষণাধর্মী বইটি কবিগান নিয়ে গবেষণায় এক সাহসী পদক্ষেপ, কবিগানের যেসব দিক গবেষকদের দৃষ্টিগোচরে আসেনি সেসব বিষয়ের ওপর আলো ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর সংগৃহীত কবিগান সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্তের বিশাল ভাণ্ডার দেখে বিস্মিত হতে হয়। তিনি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে ঘুরে কবিগান, কবিগানের পাণ্ডুলিপি, আসরের ছবি, কবিয়ালদের জীবনী সম্পর্কিত বিশাল তথ্যভাণ্ডার সংগ্রহ করেছেন। সেই তথ্যভাণ্ডার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিন্যস্ত করে সত্য উদ্ধার করতে চেষ্টা করেছেন।
ড. ইয়াসমিন আরা সাথীর বইটি পড়লে বোঝা যায়, নতুন গবেষণার পথ-সৃজনের জন্য যে আত্মশক্তি দরকার, তা তাঁর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় রয়েছে। আগামীদিনের গবেষকরা বইটির পাঠগ্রহণ করে আরও উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হবেন, এ আমার দৃঢ়বিশ্বাস। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে, ধ্রুব এষের করা শিল্পমণ্ডিত প্রচ্ছদ বইটির মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, বইটি কেবল শিক্ষক, শিক্ষার্থী, গবেষক কিংবা একাডেমিক পরিমণ্ডলে নয়, কলারসিক পাঠকদের কাছেও আদৃত হবে।
কবিগান: সমাজপরিপ্রেক্ষিত ও রূপবৈচিত্র্য।। ড. ইয়াসমিন আরা সাথী।। প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৩।। প্রকাশক: অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা।। প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ।। পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৩৬৪।। মূল্য: সাত শত টাকা
তথ্যসূত্র:
১. Sukumar, Dr., History of Bengali Literature, Sahitya Akademi, pp. 156–157
২.ভবতোষ দত্ত সম্পাদিত, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবনচরিত ও কবিত্ব। কলকাতা: সাহিত্যলোক, ২০০৬। পৃ: ২৮
৩. দীনেশচন্দ্র সিংহ, পূর্ববঙ্গের কবিগান। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯৩। পৃ: ১৯
৪.সুধীর চক্রবর্তী: পুরোনো কলকাতার গান, সুধীর চক্রবর্তী রচনাবলি। কলকাতা: লালমাটি প্রকাশন, বইমেলা ২০১৪। পৃ: ১৯৫
৫. উদ্ধৃত: সাইমন জাকারিয়া: বাংলাদেশের লোকসংগীত। ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৩। পৃ: ২০১-২০২
৬. জসীমউদদীন, জীবনকথা, পৃ: ১১২
৭. প্রফুল্ল পাল: প্রাচীন কবিওয়ালার গান, পৃ: ৮১