হাওড়া জেলার বাগনান থানার অন্তর্গত কাছারিপাড়ায় প্রায় চারশো বছরের প্রাচীন বাঘেশ্বরীদেবীর তিন দিন ব্যাপী পুজোকে কেন্দ্র করে সারা বাগনান উৎসব মুখরিত হয়ে উঠেছে। ঐতিহ্যমণ্ডিত এই বাঘেশ্বরীদেবীর নামানুসারেই ‘বাগনান’ নামের উৎপত্তি বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। আজ থেকে কয়েকশো বছর পূর্বে অধুনা কাছারিপাড়ার ছোট্ট একটি জল, জঙ্গলাকীর্ণ ভূখণ্ডে হাঁড়ি, কপালী ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা বসবাস করতেন। তাই লোককথা ছিল, ‘‘হাঁড়ি, কপালী, মুসলমান, এই তিন নিয়ে বাগনান।’’ বর্তমানে যে এলাকাটি ‘বাগনান’ নামে পরিচিত, তা আসলে বেড়াবেড়িয়া ও খালোড়ের অংশ। বর্তমান বাগনান রেল স্টেশন ও বাগনান বাস টার্মিনাসটি প্রকৃতপক্ষে খালোড় মৌজার অন্তর্ভুক্ত। অধুনা কাছারিপাড়াই সর্বপ্রথম ‘বাগনান’ নামে পরিচিত হয়।
সেই সময় ওই ভূখণ্ডের পূর্ব ও পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হত দামোদর ও রূপনারায়ণ নদ। এই দুই নদের চরভূমিতেই তাঁরা বসবাস করতেন। কিন্তু এলাকাটি ব্যাঘ্র সংকুল হওয়ায় প্রায় দিনই কোনও না কোনও মানুষকে বাঘের পেটে যেতে হত। তাই বাঘের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে স্থানীয় বাসিন্দারা গাছের নিচে বাঘের দেবতা বনবিবি, দক্ষিণ রায় ও বাঘেশ্বরী দেবীর মূর্তির আরাধনা শুরু করলেন। ধীরে ধীরে রূপনারায়ণ নদ প্রায় ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে সরে যাওয়ায় এবং দামোদর নদ কিছুটা পূর্বে প্রবাহিত হতে থাকায় ছোট্ট ভূখণ্ডটিও বিস্তার লাভ করতে থাকে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ইংরেজ আমলে স্থানীয় জমিদার গোপাললাল শীল নদীর চর থেকে বাঘেশ্বরীদেবীকে তুলে এনে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। পরে অন্যান্য দেব-দেবীর মূর্তিগুলিকেও তুলে আনা হয়। তিনি কাছারিপাড়ায় বাঘেশ্বরীদেবী ছাড়াও বৃন্দাবন মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে বাঘেশ্বরী মন্দিরটি জীর্ণ হয়ে পড়লে স্থানীয় বাসিন্দারা সেটি নতুন আঙ্গিকে সজ্জিত করেন। বৃন্দাবন মন্দিরটি অবশ্য প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ছোট্ট ওই ভূখণ্ডটি বাঘের উপস্থিতির জন্যই তখন ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয় বলে প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরার অভিমত। এই বিষয়ে তিনি আরও জানান, আরবি ভাষা অনুযায়ী ‘নান’ কথার অর্থ হল ‘চরভূমি’। ‘নান’ শব্দের আরও একটি অর্থ হল ‘ছাউনি’। তখন কাছারিপাড়া ছাড়াও নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় ইংরেজ সেনাদের ছাউনি ছিল বলে জানা যায়। যার মধ্যে খাদিনান, পাতিনান, খাজুরনান, বাইনান, চিৎনান, মাছিনান ইত্যাদি জনপদগুলি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু নদীর চরে বাঘেশ্বরী দেবীর পুজো হত, সেই জন্য প্রাথমিকভাবে এলাকাটি ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ‘বাঘনান’ অপভ্রংশ হয়ে ‘বাগনান’-এ পরিণত হয়েছে।
ব্যাঘ্রবাহিনী দেবী বাঘেশ্বরী অষ্টভুজা ও মঙ্গলচণ্ডী স্বরূপা। তিনি হলেন দেবী চণ্ডীরই আর এক রূপ। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে এই দেবীকে বনদেবী ‘অভয়া’-র সমগোত্রীয়া বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বৈষ্ণোদেবী ও বিশালাক্ষীদেবীর সঙ্গেও তাঁর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।
বাগনান থানার কাছারিপাড়ায় ঐতিহাসিক বাঘেশ্বরী দেবীর তিন দিন ব্যাপী পুজোকে কেন্দ্র করে মহামিলন উৎসবে মেতে উঠেছিলেন আবালবৃদ্ধবণিতা। সকালে কয়েকশো মহিলা ও টোটোর বিশাল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়ে দুই কিলোমিটার দূরের দামোদর নদ থেকে মঙ্গলঘট ভরে আনার পরেই বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো শুরু হয়। প্রতি বছর রাস পূর্ণিমার দিন ধুমধামের সঙ্গে এই পুজোর আয়োজন করা হয়। সেই রীতি অনুযায়ী এই বছরেও রাস পূর্ণিমার দিন দেবীর পুজোর আয়োজন করা হয়। বাঘেশ্বরীদেবীর মন্দির সংস্কার কমিটির সদস্য চন্দ্রনাথ বসু জানান, পুজো উপলক্ষ্যে এবার প্রায় ১০ হাজার মানুষকে বসে ভোগ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও চারা গাছ বিতরণ, আতশবাজি প্রদর্শনী, অঙ্কন প্রতিযোগিতা, ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।