Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো! সেই থেকেই ‘বাগনান’!

হাওড়া জেলার বাগনান থানার অন্তর্গত কাছারিপাড়ায় প্রায় চারশো বছরের প্রাচীন বাঘেশ্বরীদেবীর তিন দিন ব্যাপী পুজোকে কেন্দ্র করে সারা বাগনান উৎসব মুখরিত হয়ে উঠেছে। ঐতিহ্যমণ্ডিত এই বাঘেশ্বরীদেবীর নামানুসারেই ‘বাগনান’ নামের উৎপত্তি বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। আজ থেকে কয়েকশো বছর পূর্বে অধুনা কাছারিপাড়ার ছোট্ট একটি জল, জঙ্গলাকীর্ণ ভূখণ্ডে হাঁড়ি, কপালী ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা বসবাস করতেন। তাই লোককথা ছিল, ‘‘হাঁড়ি, কপালী, মুসলমান, এই তিন নিয়ে বাগনান।’’ বর্তমানে যে এলাকাটি ‘বাগনান’ নামে পরিচিত, তা আসলে বেড়াবেড়িয়া ও খালোড়ের অংশ। বর্তমান বাগনান রেল স্টেশন ও বাগনান বাস টার্মিনাসটি প্রকৃতপক্ষে খালোড় মৌজার অন্তর্ভুক্ত। অধুনা কাছারিপাড়াই সর্বপ্রথম ‘বাগনান’ নামে পরিচিত হয়।

সেই সময় ওই ভূখণ্ডের পূর্ব ও পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হত দামোদর ও রূপনারায়ণ নদ। এই দুই নদের চরভূমিতেই তাঁরা বসবাস করতেন। কিন্তু এলাকাটি ব্যাঘ্র সংকুল হওয়ায় প্রায় দিনই কোনও না কোনও মানুষকে বাঘের পেটে যেতে হত। তাই বাঘের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে স্থানীয় বাসিন্দারা গাছের নিচে বাঘের দেবতা বনবিবি, দক্ষিণ রায় ও বাঘেশ্বরী দেবীর মূর্তির আরাধনা শুরু করলেন। ধীরে ধীরে রূপনারায়ণ নদ প্রায় ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে সরে যাওয়ায় এবং দামোদর নদ কিছুটা পূর্বে প্রবাহিত হতে থাকায় ছোট্ট ভূখণ্ডটিও বিস্তার লাভ করতে থাকে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ইংরেজ আমলে স্থানীয় জমিদার গোপাললাল শীল নদীর চর থেকে বাঘেশ্বরীদেবীকে তুলে এনে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। পরে অন্যান্য দেব-দেবীর মূর্তিগুলিকেও তুলে আনা হয়। তিনি কাছারিপাড়ায় বাঘেশ্বরীদেবী ছাড়াও বৃন্দাবন মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে বাঘেশ্বরী মন্দিরটি জীর্ণ হয়ে পড়লে স্থানীয় বাসিন্দারা সেটি নতুন আঙ্গিকে সজ্জিত করেন। বৃন্দাবন মন্দিরটি অবশ্য প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

ছোট্ট ওই ভূখণ্ডটি বাঘের উপস্থিতির জন্যই তখন ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয় বলে প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরার অভিমত। এই বিষয়ে তিনি আরও জানান, আরবি ভাষা অনুযায়ী ‘নান’ কথার অর্থ হল ‘চরভূমি’। ‘নান’ শব্দের আরও একটি অর্থ হল ‘ছাউনি’। তখন কাছারিপাড়া ছাড়াও নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় ইংরেজ সেনাদের ছাউনি ছিল বলে জানা যায়। যার মধ্যে খাদিনান, পাতিনান, খাজুরনান, বাইনান, চিৎনান, মাছিনান ইত্যাদি জনপদগুলি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু নদীর চরে বাঘেশ্বরী দেবীর পুজো হত, সেই জন্য প্রাথমিকভাবে এলাকাটি ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ‘বাঘনান’ অপভ্রংশ হয়ে ‘বাগনান’-এ পরিণত হয়েছে।
ব্যাঘ্রবাহিনী দেবী বাঘেশ্বরী অষ্টভুজা ও মঙ্গলচণ্ডী স্বরূপা। তিনি হলেন দেবী চণ্ডীরই আর এক রূপ। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে এই দেবীকে বনদেবী ‘অভয়া’-র সমগোত্রীয়া বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বৈষ্ণোদেবী ও বিশালাক্ষীদেবীর সঙ্গেও তাঁর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।

বাগনান থানার কাছারিপাড়ায় ঐতিহাসিক বাঘেশ্বরী দেবীর তিন দিন ব্যাপী পুজোকে কেন্দ্র করে মহামিলন উৎসবে মেতে উঠেছিলেন আবালবৃদ্ধবণিতা। সকালে কয়েকশো মহিলা ও টোটোর বিশাল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়ে দুই কিলোমিটার দূরের দামোদর নদ থেকে মঙ্গলঘট ভরে আনার পরেই বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো শুরু হয়। প্রতি বছর রাস পূর্ণিমার দিন ধুমধামের সঙ্গে এই পুজোর আয়োজন করা হয়। সেই রীতি অনুযায়ী এই বছরেও রাস পূর্ণিমার দিন দেবীর পুজোর আয়োজন করা হয়। বাঘেশ্বরীদেবীর মন্দির সংস্কার কমিটির সদস্য চন্দ্রনাথ বসু জানান, পুজো উপলক্ষ্যে এবার প্রায় ১০ হাজার মানুষকে বসে ভোগ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও চারা গাছ বিতরণ, আতশবাজি প্রদর্শনী, অঙ্কন প্রতিযোগিতা, ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস ও কালিদাস

পণ্ডিতেরা তর্ক তুলেছেন, কালিদাস ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ লেখেননি৷ কেননা একেবারে পয়লা আষাঢ়েই যে মেঘ নেমে বৃষ্টি আসবে, তা হয় না। তাঁদের মতে, ওটা আষাঢ়ের শেষদিন, ‘আষাঢ়স্য প্রশম দিবস’ হবে। কিন্তু প্রথম দিবস-ই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং তা এতটাই যে, কালিদাসকে নিয়ে ভারত সরকার যে ডাকটিকিট বের করেছে, সেখানে ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ শ্লোকটি উৎকীর্ণ।

Read More »
রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সোমেন চন্দ: এক বহ্নিময় কথাকার

মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন, যদিও তা অসমাপ্ত থাকে। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘বন্যা’। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি অসমাপ্ত-ই থেকে যায়। আরও দুঃখের বিষয়, এর বৃহদংশ হারিয়েও গেছে। আজ যে সোমেন চন্দের লেখককৃতির জন্য আমরা তাঁকে স্মরণ করি, তা হল তাঁর বেশ কিছু অসামান্য ছোটগল্প। সংখ্যায় খুব বেশি নয়, মাত্র চব্বিশটি। আরও কিছু গল্প লিখলেও তা কালের ধুলোয় হারিয়ে গেছে। গল্পের সংখ্যা সামান্য, তবে অসামান্যতা রয়েছে সেগুলির রচনার পারিপাট্যে, বিষয়বস্তু চয়নে, শিল্পিত প্রকাশে ও লেখনীর মুনশিয়ানায়। এছাড়া তিনি দুটি নাটিকাও লেখেন, ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রস্তাবনা’। লেখেন কিছু প্রবন্ধ। তাঁর ছোটগল্পগুলি এতটাই শিল্পোত্তীর্ণ ছিল যে, তাঁর জীবিতকালেই একাধিক ভাষায় তা অনূদিত হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »