ছোট্ট গাবোকে ৮ বছর বয়সে দাদা-দাদীর জিম্মায় রেখে যখন তার পরিবার অন্যত্র শেকড় গাড়ে, তখন কর্নেল দাদার কাছে প্রায়ই যুদ্ধের গল্প শোনার সুযোগ হত তার। কিন্তু তাকে গড়তে প্রয়োজন হত একজন দাদীর যিনি কিনা যাদুবিদ্যায় বিশ্বাস করেন, আর নাতিটার মাথার কোষে কোষে ঢুকিয়ে দিতে পারেন ভূত-প্রেত-দৈত্য-দানোর হাজারো যাদুকরী গল্প! যুদ্ধক্ষেত্রের কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে যাদুর পালক গেঁথে দিয়ে সেই নাতিই লিখলেন এমন সব অমর গল্পকথা, যা বিশ্বসাহিত্য আগে দেখেনি, শোনেনি। যা লিখে খুদে গাবো হয়ে উঠলেন গ্যাব্রিয়েল হোসে দে লা কনকর্ডিয়া গার্সিয়া মার্কেজ, সেই গল্পগুলোরই প্রাণ স্পর্শ করতে এক গোলার্ধ পথ পেরিয়ে সুদূর কলম্বিয়ায় পাড়ি জমান লাতিন সাহিত্যের দীর্ঘদিনের মুরিদ ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক রাজু আলাউদ্দিন; আর তাঁর দেখা ও অনুভবকে ঘিরে রচিত হয় ‘জাদুবাস্তবতার টানে মার্কেসের কলম্বিয়ায়’ শিরোনামে এক যাদুকরী গ্রন্থ, ২০২৩-এর একুশে বইমেলায় আলোর মুখ দেখে যা ইতিমধ্যেই পাঠক-হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে।
এই ভ্রমণকাহিনিটিকে কলম্বিয়া সম্পর্কে বাংলা ভাষায় প্রথম গ্রন্থ বলে দাবি করা হচ্ছে। যদিও এখানে আন্দেজের তীরে গড়ে উঠা লাতিন আমেরিকান দেশটির কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়নি, কিন্তু বইটি মূলত এক প্রিয় লেখককে আবিষ্কারের রোমাঞ্চকাহিনি, যা প্রাকৃতিক নিদর্শনকে আবিষ্কারের অভিজ্ঞতা থেকে কম উত্তেজক ও শিহরক নয়। যেমন, প্রথম পাতাতেই লেখক মার্কেসের একটি উদ্ধৃতি স্মরণ করিয়ে দেন, “নিজেকে আমি একজন শুদ্ধ এবং সাধারণ বাস্তববাদী বলে মনে করি।’’ যাদুবাস্তবতার এক অবিসংবাদী আলেম, যার পাতায় পাতায় রয়েছে অসামান্য সব যাদুকরী কাণ্ডকারখানা, উদ্ভট সব পাগলামির ওরশ, সেই তার কণ্ঠেই কিনা এই ওয়াজ! তাহলে রহস্যটা কোথায়? কলম্বিয়ার ওই অঞ্চলটি, যেখানে তার জন্ম ও বেড়ে উঠা, সেই আরাকাতাকা, বাররাঙ্কিয়া ও কার্তাহেনার পরিবেশ, প্রকৃতি ও পরিমণ্ডলে এমন কোন বাস্তবতা আছে, যা স্বভাবে কিছুটা খ্যাপাটে? লেখক রাজু আলাউদ্দিন যেন সেই খ্যাপাটে বাস্তবতারই অনুসন্ধানে বেরিয়েছেন মার্কেসকে অনুসন্ধানের আড়ালে, আর এই ভ্রমণকাহিনিটি যতই এগুনো যায়, তার স্বাক্ষর রেখে যেতে থাকে। দিন শেষে অবশ্য পরিষ্কার হয় যে, এই যাদুবাস্তবতা শুধু কলম্বিয়ার একার সম্পদ নয়, সারা বিশ্বেই রয়েছে এমনি বাস্তবতা, যা যাদুমাখা, যার সর্বশরীরে ভূত আর ভূত! আইন ও কানুনের সীমানা আমাদের বেঁধে রাখে সত্যি, কিন্তু যখন আমরা মুক্ত হই, উড়ে চলি তো যাদুরই কার্পেটে!
লেখকের মার্কেজকে অনুভব কত তীব্রতায় আচ্ছন্ন তা বোঝা যায় একটি ঘটনায়। লেখক বোগোতায় পৌঁছেন প্রথম, সেখানে গরমের মৌসুমেও শীত অনুভূত হতে থাকে। আর লেখকের কলম থেকে বেরিয়ে পড়ে, “পূর্বপাঠ আমাকে প্রতারিত করেছে, প্রতারিত করেছেন মার্কেসও, কারণ তিনি কলম্বিয়ার বোগোতা অঞ্চলে এই ঠান্ডার কথা তো আমাকে বলেননি তার কোনো লেখায়।” এই শীতেও গরম হয়ে ওঠার সুযোগ অবশ্য অবারিত কলম্বিয়ায়, কারণ মাদকের স্বর্গরাজ্য হিসেবে সারা পৃথিবীতেই সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে রাজু আলাউদ্দিন সেই মাদকের টানে পাড়ি জমাননি কলম্বিয়ায়; তিনি তো নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন ভীষণ কড়া এক মার্কেজ-মাদকে, যা নেশাগ্রস্ত করলেও ক্ষতি করে না কখনওই!
এই ভ্রমণটা আদ্যোপান্ত একটা সাংস্কৃতিক ভ্রমণ; একজন প্রিয় লেখককে তাঁর দেশ, তাঁর মানুষ, তাঁর রীতিনীতি দিয়ে আবিষ্কারের চেষ্টা। এজন্য এয়ারপোর্টে ভাড়া করা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে লেখক, তাঁর ভ্রমণসঙ্গী মার্কেস-অনুবাদক আনিসুজ জামান আর কবিবন্ধু তাপস গায়েন অনুরোধ জানান স্থানীয় খাবারের স্বাদ পাওয়া যাবে এমন একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে। এই রেস্তোরাঁয় লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এক ওয়েটার মেয়ে যার “নাদুস-নুদুস, চোখেমুখে হাসির একটা ফেনা ভাসমান ওর অভিব্যক্তির মাধুর্যের কারণে। এটা যে খদ্দের মুগ্ধ করার জন্য নয় তা বোঝা যায় ওর বন্ধুসুলভ আচরণে ও সম্বোধনের মধ্যে।” লেখক লিখছেন, “দু-চারটা হালকা কিন্তু যৌন সুড়সুড়িমূলক রসিকতা দিয়ে ওকে খোলতাই করে নেওয়ার দুষ্টুমিটা হাতছাড়া করলাম না। মেয়েটিও বেশ আনন্দ পেল আমার রসিকতায়। আমি ওর কাঁধে ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম আর মেয়েটি পেছন দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরা অবস্থায়…’’। এই যে একজন বাঙালি লেখকের পাগলামো, তাতেও সেই মার্কেজ-ভূত কাজ করেছে বলে মনে হয়। মার্কেজের যাদুবাস্তবতার দেশে এমন এক যাদুর মেঘ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র, প্রতি ক্ষণে ক্ষণে যাদুটোনা করা হয় এখানে, মানুষগুলিও যেন জিন-পরিতে আক্রান্ত। লেখকের সফর সেই যাদুকে উন্মোচন করে!
এল দোরাদো এয়ারপোর্টে পৌঁছুনোর পথে বোগোতার রাস্তা উন্মনা করে তোলে লেখককে; মার্কেজ কোনও একদিন এই পথ ধরেই গিয়েছিলেন! শহরটা লেখকের ভ্রমণসঙ্গী কবি তাপস গায়েনের কাছে পরিচ্ছন্ন মনে হয়; কিন্ত লেখকের চিন্তার মানচিত্রে প্রতারণাটি ঠিকই ধরা পড়ে, “অবশ্য তৃতীয় বিশ্বের শহরগুলোর একটা অংশ পরিচ্ছন্ন, আর অন্য একটা অংশ অপরিচ্ছন্ন। একদিকে সুরম্য অট্রালিকা, অন্যদিকে বস্তির বিস্তার। আমরা হয়তো পরিচ্ছন্ন অংশে ঘুরে বেড়াচ্ছি।” লেখক বেরিয়েছেন এক আবিষ্কারে, বইয়ের পাতার মার্কেজকে বুঝে নিতে ভূগোলে, ইতিহাসে, পৌরনীতিতে; আর তাই তো তিনি যখন বলেন যে তার কাছে ‘‘আকাশপথে ভ্রমণের চেয়ে সড়কপথে গাড়িতে বা ট্রেনে ভ্রমণ’’ বেশি আকর্ষণীয়, তখন একটুও অবাক করে না পাঠককে। মার্কেজের আরাকাতাকা গ্রামের পথে যেতে যেতে ‘মরূদ্যানের মত ছোট ছোট বাজারগুলো’ তাকে মনে করিয়ে দেয় তার জন্মস্থান বাংলাদেশের শরীয়তপুরকে, ‘‘এত যে উন্নয়নবঞ্চিত এসব এলাকা কিন্তু মানুষগুলোর মধ্যে এই রাতের বেলায়ও প্রাণচাঞ্চল্য যেন উপচে পড়ছে।” এরপর লেখক যখন বলেন, তাঁর ইচ্ছে করছিল একটি বাজারে গাড়িটা থামিয়ে একটুখানি দাঁড়াতে এবং কী আছে সেখানে তা দেখতে, তখন পাঠক যেন পেয়ে যান আর এক যাদুবাস্তবতার শিহরণ! প্রথম বিশ্বের সুসজ্জিত বাগানের কাছে তৃতীয় বিশ্ব একটা নর্দমাই হয়তো, কিন্তু সেখানেও আছে প্রাণের এক বিপুল আলোড়ন, অভূতপূর্ব সব জৈবিক অনুরণন! আর একজোড়া বিস্ময়-কামুক পর্যটক আঁখির সামনে সেই যাদুর গোলক ঘুরে ঘুরে ফেনা তুলতে থাকে!
মার্কেসের ‘শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা’-য় মাথা তোলা কলম্বিয়ার বিখ্যাত সিয়েনাগা অঞ্চলটির বিশাল কলার রাজ্য পেরুনোর সময় লেখকের সঙ্গে সঙ্গে ভয় ও কল্পনার এক অদ্ভুত রসায়ন মিথষ্ক্রিয়া করছিল পাঠকমস্তিষ্কের সঙ্গেও। “সম্মিলিত নক্ষত্রপুঞ্জের নিক্ষিপ্ত আবছা আলোয়” যখন “চারিদিক গভীর ধূসর এক ধাবমান প্রতিমা ছড়িয়ে চলে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে’’, তখন লেখকের মনে হতে থাকে, “যেন কলা গাছের সারি নয়, ওগুলো যেন বঞ্চিত ও নিপীড়িত কলা-চাষিদেরই চাপাতি যা যে-কোনো সময় আমাদের ওপর এসে সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়বে।” এখানেও যাদুতে মোড়া এক অব্যাখ্যাত দ্রোহের আভাস, যা অনুভূত বইটির গোপন সব নিশ্বাসে!
আরাকাতাকা গ্রাম আর আগের মত গ্রাম নেই। বরং লেখকের চোখে— “মার্কেসের খ্যাতির কারণে এর গ্রামীণ চরিত্রের ওপর হঠাৎ করে শহুরে এক ধর্ষক যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে;”। মজার ব্যাপার হল, এ সাজসজ্জায় বেছে নেয়া হয়েছে ‘শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা’ উপন্যাসের চরিত্রগুলোর নাম। কিন্তু তিরিশ বছর আগে যখন মার্কেসের আরাকাতাকার সঙ্গে প্রথম পরিচয় লেখকের, সেই সময়কার আবেগ, ও উত্তাপ তিনি সুসজ্জিত দরদালানে নয়, পেয়েছেন গ্রামবাসীর সহজ সরল জীবনযাপনে।
মার্কেজের গ্রাম দেখে রাত কাটাতে যে হোটেলটিতে উঠেছিলেন লেখকেরা, তার নাম ‘রিয়েলিজমো ম্যাজিকো’। গ্রামের অতিসাধারণ এই হোটেলে এসির ব্যবস্থা লেখককে আর একরাশ কঠিন যাদুবাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়! এরপর লেখক মারিয়া মন্তেসসোরি নামের একটি স্কুলের সঙ্গে পরিচিত হলেন যেখানে যাত্রা করেছিল তাঁর বিদ্যাপীঠ। তারপরেই নজরানা দিয়ে ঢুকতে হল মার্কেসের বাড়িতে যেখানে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে রয়েছে মার্কেসের দোলনা, যা পাঠককে শিশু মার্কেসে ঘুরিয়ে আনবে, হয়তো নিয়ে যাবে ‘পথের পাঁচালি’-র দোলনায় শুয়ে থাকা অপুর কাছে, এভাবে মার্কেজের দাদী হয়ে উঠবেন অপুর ইন্দির ঠাকরণ।
আরাকাতাকা রেলস্টেশনের পাশে নির্দিষ্ট দূরত্বে কয়েকটি বিধ্বস্ত ও ভূতুড়ে একতলা বাড়ি লেখকের ভ্রূ উঁচিয়ে দেয়, তাদের ভ্রমণ গাইড রাফায়েল বলেন, “কিছু ইতিহাস যার ইঙ্গিত কেবল আছে ঐ শতবর্ষের নিঃসঙ্গতায় আর বাকিটা এখানে তুষের আগুনের মতো নিচে লাল হয়ে আছে, তোমার কৌতূহলী ফুঁয়ের মাধ্যমে তা আবার জ্বলে উঠবে।” এই ইতিহাস এক হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস, যা মঞ্চস্থ হয়েছিল মার্কেজ জন্মাবার এক বছর পর যখন কলাচাষিরা ডাক দিয়েছিলেন ধর্মঘটের, আর তার পিতামহ কর্নেল নিকোলাস মার্কেজ ছিলেন যার একজন নেপথ্য যাদুকর! আমাদের দেশের নীলচাষিদের নিয়েও রচিত হয়েছে এমনি কত যাদুকরী সব উপাখ্যান, কিন্তু সেই যাদু কেন পৌঁছেনি সারা বিশ্বে, পাঠককে এই জায়গাটা একটুখানি হলেও ভাবাবে।
এরপর লেখকের ভ্রমণ বাররাঙ্কিয়ায় যেখানে তিনি পাচ্ছেন পাউল ব্রিতোর সঙ্গে মার্কেসকেও, কারণ এই শহরটিতে অঙ্কিত হয়েছে মার্কেজের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কৈশোর ও যৌবনে পড়াশুনোর পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যচর্চার সূতিকাগারও ছিল এই শহর। পাউল ব্রিতোর সঙ্গে শহরটির লাস রোকাস রেস্তোরাঁয় লোকসঙ্গীত বাইয়্যেনাতো শোনার সৌভাগ্য হয় লেখকদের যা কৃষকদের মধ্য থেকে উঠে এলেও পুরো কলম্বিয়াকে ব্র্যান্ডিং দিচ্ছে। ইউরোপীয় বাদ্যযন্ত্র অ্যাকোর্ডিয়ন, গিটারের সঙ্গে আছে বাঁশি, বেহালা জাতীয় গুয়াচারাকা, ঢোল জাতীয় তাম্বোর, আর ঝুমঝুমির মত একটা বাদ্যযন্ত্র, যা থেকে বেরুনো সুর যেকোনও সৃজনশীল ও সংবেদনশীল মানুষের মত ভাষার প্রাচীর ডিঙিয়ে লেখকদের একদম মর্ম-বেদিতে কম্পন তুলছিল। পাঠকদের এখানে নিশ্চয়ই মনে পড়বে, দেশের ফোক সঙ্গীতের পুনর্জাগরণ এবং আধুনিক সঙ্গীত-যোদ্ধাদের গোলচত্বরে তার উন্মত্ত ঘূর্ণির কথা। দেশ-কাল-পাত্র ভেদে গল্পগুলো সব একই, এই যাদুবাস্তবতার আলেখ্য সেই বার্তাই যেন দিয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে।
লা কুয়েবা, একটি রেস্তোরাঁ, যার অর্থ গুহা। পরদিন সকালেই লেখকেরা তোড়জোড় শুরু করেন এই রেস্তোরাঁর উদ্দেশে। ভ্রমণকালে অন্য কোনও রেস্তোরা আগে থেকে ঠিক না থাকলেও এই রেস্তোরাঁটিকে চকের মোটা দাগে আগেই চিহ্নিত করা হয়েছিল। কারণ সাহিত্যের ইতিহাসে সে এতটাই জায়গা নিয়ে আছে যে, তাকে এড়িয়ে যাওয়া একপ্রকার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা! এই সেই জায়গা যেখানে গ্রুপো দে বাররাঙ্কিয়া নামে একটি সাহিত্য গোষ্ঠীর জন্ম হয়, যেখানে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে দেখা যায় আলবারো সেপেদা সামুদিও, আলফনসো ফুয়েনমাইয়োর, হেরমান বার্গাস, হোসে ফেলিক্স, রামোন বিনইয়েস, রাফায়েল এস্কালোনা, আলেহান্দ্রো অব্রেগন-এর মত উজ্জ্বল সব নক্ষত্রকে। প্রথম চারজন তো ‘শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা’ উপন্যাসটির বিখ্যাত ‘চার তার্কিক’ যারা মার্কেজের ছায়াচরিত্র আউরেলিয়ানো বাবিলনিয়ারের বন্ধু। আর বইটির শেষে অঙ্কিত জ্ঞানী কাতালান আর কেউ নয়, এই গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা, পুস্তকবিক্রেতা ও প্রকাশক রামোন বিনইয়েস। মজার ব্যাপার হল, মার্কেস না কি আলবেরো সেপেদার মত লেখক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন, অথচ একটা সময় তাঁকে ছাড়িয়ে এতটা উঁচুতে উঠেছেন যে, মানুষ সেপেদাকেই ভুলতে বসেছে। মার্কেস এঁদের যোগফল, সবার কাছ থেকে নিয়েছেন, আর এজন্যই হয়তো তিনি বিশ্বসেরার মর্যাদায় আসীন!
রেস্তোরাঁটির গুহায় ঢুকতে যেয়ে লেখকের সঙ্গে পাঠকও যেন কান পেতে শোনেন গলা ফাটানো চিৎকার, চোখের সামনেই যেন দেখতে পান বিতর্কের স্ফুলিঙ্গ— হয়তো মার্কেজ তাঁর নতুন কোনও লেখা পাঠ করে শোনাচ্ছেন, চলছে হৃদয় ভেঙে দেয়া সমালোচনার তির, আবার সঙ্গে উড়ে আসছে মজনু কোনও পাঠকের মাতোয়ারা সব শব্দের পুষ্প! লেখকের ভাষায়, “কিংবা ফকনার, বোর্হেস, কার্পেন্তিয়ের প্রমুখ পাঠের গনগনে অভিজ্ঞতা ঢেলে দিচ্ছেন বন্ধুদের পানপাত্রে। তাদের নানা রকম মত ও মতান্তরের আগুনে, পঠিত লেখকরা কামার ঘরের লোহার মতো লাল হয়ে উঠেছেন।” এই জায়গায় এই অন্য রকম ভ্রমণকাহিনিটি পাঠকের কাছে যেন সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে! পৃথিবীতে অনেক রকম ভ্রমণ আছে, কিন্তু এই সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক ভ্রমণ যেন নিজের বোধ ও সত্তারই এক ভ্রমণ।
লেখক সেখানে বসে বন্ধু এরিবের্তোর পানের আমন্ত্রণে যখন সাড়া দিয়ে বসলেন, তখন ঘোর দুপুর। লেখকের কাছে বন্ধুদের সঙ্গে মদ্যপান উপাসনার মত— এ যেন মেঘমল্লার রাগ, অবেলাতে জাগানোর মধ্যেই এর সার্থকতা! তার মনে পড়ে যায়, ওমর খৈয়ামের বাণী, “জ্ঞানী হামিক বিষ যদি দেয় বরং তাহাই করবে পান, সুধাও যদি দেয় আনাড়ি— করবে তাহা বিসর্জন।” এতে পাঠকের অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ যাদুবাস্তবতার দেশে এই পরিস্থিতিগুলোর জন্য তাঁর মন ইতিমধ্যে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। লেখক তাঁর লাতিন সাহিত্যগুরু বোর্হেসের দর্শন থেকে এ জায়গায় নিজেকে পৃথক করে নেন। বোর্হেস পাঠ তথা জ্ঞানের মাধ্যমে বাস্তবের স্বাদ গ্রহণ করলেও লেখক নেরুদার দর্শনকে পেঁচিয়ে ধরে ধরে রক্তমাংসের স্পর্শ ও অভিজ্ঞতাকে পান করতে চান; তাঁর কাছে ‘বাস্তবের ইন্দ্রিয়ঘন অভিজ্ঞতার চেয়ে’ কিছু বড় নেই। মার্কেসকে রক্তে মাংসেই অনুভব করতে চেয়েছেন, অনুকরণ-অনুসরণ করতে চেয়েছেন; আর সেই কোমল অনুভূতিগুলোর জিন দানা বাঁধতে বাঁধতে এক সময় গর্ভবতী করে তোলে লেখকের মগজকে, তিনি প্রসব করেন ‘জাদুবাস্তবতার টানে মার্কেসের কলম্বিয়ায়’ নামক এক অপূর্ব গ্রন্থ।
এক সময় বাররাঙ্কিয়া থেকে লেখকদের রথ ঘুরে যায় ইউরোপীয় দাস ব্যবসার কেন্দ্রস্থল কার্তাহেনা বন্দর শহরের দিকে। এখানেই রয়েছে আমেরিকাকে স্প্যানিশদের থেকে মুক্তকারী সিমন বলিবারের নামে বলিবার পার্ক। এখানে কমলা, মেলন, নীল, সবুজ, লাল আর মার্কেসের প্রিয় হলুদ বর্ণের বাড়িঘর আলোকিত করে রেখেছে পুরো শহর, লেখকের চোখে যা প্রতীকায়িত করে “এই অঞ্চলের মানুষের মনের স্ফূর্তি, আনন্দ আর সহাবস্থানের সম্প্রীতি। যাদের মন বহুত্বের প্রতিনিধি তারা যে মিশুক প্রকৃতির হবে— এ তো এমনিতেই অনুমান করা যায়।” পার্কের পাশে বিভিন্ন রঙে আবৃত ফলবিক্রেতা তিন রমণীর মধ্যেও যেন এই বহুত্ব ও বন্ধুত্বের নিদর্শন পান লেখক।
মার্কেস এখানে একটি পত্রিকা অফিসে কাজ করতেন, তাও দেখা হল। লেখকের শহরটিকে ভাল লাগে, কারণ “ইতিহাসের স্মৃতিকাতরতা ও দীর্ঘশ্বাস যেখানে মিলেমিশে থাকে সেখানে আমার এক প্রগাঢ় আকর্ষণ কাজ করে।” লেখকের বন্ধু তাপসেরও ভাল লাগে এই কার্তাহেনা, কিন্তু অন্য সঙ্গী আনিসের মন পড়ে আছে আরাকাতাকায়। এই আপেক্ষিক ভাল লাগা নিয়ে ভীষণ সুন্দর একটি পর্যবেক্ষণ পাঠকের জন্য বরাদ্দ হয় এখানে, “কিন্তু ব্যাপার হলো এই যে কখনো কখনো সবকিছু একই সমতলে এসে মিলিত হয় বলেই— সেও নানান রকম শর্তপূরণের সাপেক্ষে বলেই— আমরা একটি মাহেন্দ্রক্ষণ পেয়ে যাই।” মানে, অনেক অচিন শর্ত বেয়ে বোধহয় তাপসের কাছে মাহেন্দ্রক্ষণ নেমে এসেছিল কার্তাহেনায়, আনিসের কাছে আরকাতাকায়। পাঠকও মাহেন্দ্রক্ষণের পাঁকে জড়িয়ে যায়, অনেকক্ষণ ধরে হাবুডুবু খেতে থাকে এই আবিষ্কারটি নিয়ে!
কার্তাহেনা থেকে লেখক আবার বোগোতায় ফিরে আসেন, সেখানে একটি রেস্টুরেন্টে খেতে যেয়ে লেখক কাঁচা মরিচের জন্য উতলা হয়ে ওঠেন। ইংরেজি ও মেহিকান ভাষায় প্রচলিত ‘চিলি’ শব্দটি উচ্চারণ করে রেস্তোরাঁ-মালিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, লোকটি খালি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন, কোনও শব্দ বা অ্যাকশন দৃষ্টিগোচর হয় না তার থেকে। পরে লেখক আবিষ্কার করলেন, এদের কাছে কাঁচা মরিচ ‘আহি’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু যে ‘আহি’ এত লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে হোটেল-মালিকটি হাজির করলেন, তা লেখকের মুখেই ঢুকল শুধু, মগজে পৌঁছুল না। ঝালে ভরা বাঙালিকে আর চেনার সুযোগ হল না কলম্বিয়ান হোটেল-মালিকটির। অন্য সব কিছুতে হলেও, বাঙালির সঙ্গে ঝালে মিতালী গড়া সত্যিই কষ্টকর!
সব কিছুর সঙ্গে আসলে মিতালী হয় না। কিছু ব্যাপার থাকে যা একান্তই নিজস্ব, আদিম ও অকৃত্রিম এক দর্শনজাত। যেমন বোগোতার এক নাইট ক্লাবে একটি মেয়ে এগিয়ে এলে তাকে বিয়ার খাওয়ার দাওয়াত দেন লেখক। স্প্যানিশ নিয়ে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে মেয়েটি লেখকের একটি হাত তুলে নিয়েছে তার হাতে। ওর আর একটি হাত লেখকের ঊরুসন্ধির কাছে সোহাগ দিচ্ছিল— “কখনো ঘুমন্ত তরবারিকে জাগিয়ে তোলার জন্য দরদি আঙুলের চোরাগুপ্তা প্রলেপ দিয়ে যাচ্ছে। ওর যমজ সম্ভার দিয়ে মাঝেমধ্যে আমার কাঁধে চাপ দেওয়ার মাধ্যমে চেষ্টা করছে। অতিরিক্ত কৌশল হিসেবে কান ও কপোলের কাছে মুখ এনে কথা বলার ছলে ছড়িয়ে দিচ্ছে সুবাস ও উষ্ণতা।” মেয়েটির সব সৈন্যসামন্ত ঘিরে আছে লেখককে, কিন্তু লেখক যে প্রেম ছাড়া সন্ধিস্থাপন করতে অপরাগ। তাহলে কি যাদুটোনা ব্যর্থ এখানে? না কি, যাদুর সঙ্গে জুড়ে আছে প্রেমের অপূর্ব কোনও শংকর, যার বিচরণ যৌন অনুভূতিরও অনেক ঊর্ধ্ব কোনও আকাশে?
লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে বাস্তববাদের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হলেন হোসে আসুন্সিয়ন সিলবা। তাঁর নামেই গড়ে তোলেন ‘কাসা দে পয়েসিয়া সিলবা’ নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। সাহিত্যের মেলবন্ধনের জন্য প্রতিষ্ঠানটি প্রায়ই আমন্ত্রণ জানায় বিভিন্ন দেশের লেখকদের। লাতিন সাহিত্যকে বাংলা ভাষায় পরিচিতকরণের অন্যতম নেপথ্য নায়ক রাজু আলাউদ্দিনকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিল কাসা দে পয়েসিয়া সিলবার কর্তাব্যক্তিরা। অনুষ্ঠানে লেখক নিজের একটি কবিতা পাঠ দিয়ে শুরু করেন তাঁর আলোচনা। কবিতাটা হল:
আমি যত দূরে যাই
আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে।
মিগেল জানতে চায়: কোথায় তোমার দেশ?
বাংলাদেশ, শোনোনি কখনো?
না, কখনোই নয়।
কোথায় এ দেশ?
ভারতের কাছে।
ওহ্, তাই বলো।
আমি যত দূরে যাই
আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে।
একদিন মারিয়ানা জানতে চেয়েছে,
কোথায় তোমার দেশ?
একই কথা বললাম তাকে।
লজ্জিত জানালো সে, হ্যাঁ,
ভারতের কথা আমি শুনেছি, যদিও
জানি না আসলে ঠিক কোথায় এ দেশ।
এশিয়ার কথা তুমি শোনোনি কখনো?
ওহ্, তাই বলো। বাংলাদেশ তবে সেই
এশিয়ার মাঝে।
ঠিক তাই।
যদি আমি কোনো দিন আরও দূরে চলে যাই
ধরা যাক, মঙ্গলগ্রহে।
তখন সেখানকার কেউ যদি জানতে চায়,
হেই, কোথায় তোমার দেশ?
আমি তো এসেছি দূর সবুজে আচ্ছাদিত
পৃথিবী নামক এক গোলাকার গ্রহভূমি থেকে।
সেখানে এশিয়া নামে বড় এক মহাদেশ আছে।
সেই মহাদেশে আছে ভারতভূমি।
আর সেই ভারতেরই কাছে এক সমুদ্র-তনয়া
হলো আমার স্বদেশ।
আমি যত দূরে যাই
আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে।
বড় হতে হতে ক্রমে আমার নিকটে চলে আসে।
যখন নিকটে আসে, কানে কানে বলি তাকে:
যত ছোট মনে হয় তুমি তত ছোট নও, শোনো,
তুমি পৃথিবীর যে-কোনো দেশের মত বড়
তুমি এই পৃথিবীরই মতো,
তুমি আমার পৃথিবী।
এভাবে নিজের দেশের যাদু দিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করলেন লেখক। আসলে মার্কেসের যাদুবাস্তবতা তো বিশ্বজনীন; আর লেখক রাজু আলাউদ্দিন তো যাদুবাস্তবতাকে খুঁজতে যাননি মার্কেসের দেশে; বলা যেতে পারে, আরও ভাল করে শিখে নিতে গিয়েছেন সেই যাদু, যা তিনি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়ার ব্রত নিয়েছেন। তিনি তো মনে হয় স্বপ্ন দেখেন, একদিন পৃথিবীটা বাস্তবের কৃত্রিম আবরণ খুলে ফেলে হয়ে উঠবে আদি ও অকৃত্রিম যাদুর গোলক, আবার!
জাদুবাস্তবতার টানে মার্কেসের কলম্বিয়ায় ।। রাজু আলাউদ্দিন