Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

আমি শুধু ‘ভাইরাল’ হব, এটাই আমার অ্যাম্বিশন

—কী হে ভাগ্নে, সকাল থেকে বার্ড ফ্লু হওয়া মুর্গির মতো অমন গোল গোল করে সারা বাড়িময় ঘুরছ কেন হে?

—এটা ফাজলামি করার সময় নয় মামা, সরে দাঁড়াও!

—ওহ বাবা, এ তো পুরো মিলিটারি মেজাজ! বলি ব্যাপারটা কী হে? অফিসের ম্যানেজার আবার ছুটির দিনেও বাঁশ দিল নাকি হে?

—আরে না না, সেসব কিছু না! খুঁজছি…

—অ্যাঁ! এ কী অলুক্ষুনে কথা! তা কী খোঁজা হচ্ছে? দুর্গাপুজোর ছুটিতে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জায়গা নাকি?

—আরে না না, সেসব খুঁজছি না!

—তাহলে পুজোর চারদিন ম্যাডক্স স্কোয়ারে বা হেঁদুয়ায় একসাথে হাত ধরে ঘোরা আর এগরোল খাওয়ার জন্য নতুন বান্ধবী খুঁজছ নাকি হে?

—উফফ! তোমাকে নিয়ে আর পারা গেলো না মামা! দুর্গাপুজো এখন ঢের দেরি! আর কত্তবার বলেছি দেশটা এই ক’বছরে হুহু করে এগিয়ে গেছে!

—হুহহ! তাতে কী হল?

—এটাই যে ‘প্রেম করাটা মধ্যবিত্ত বাঙালির সেরা অ্যাডভেঞ্চার, আর বিয়ে করাটা সেরা অ্যাচিভমেন্ট’— এই  তত্ত্ব থেকে এবার একটু বিরতি নাও!

—অহহ, তাহলে কি বুদ্ধিজীবী খুঁজছ নাকি হে?

—খামোকা বুদ্ধিজীবী খুঁজতে যাব কী দুঃখে!

—না, ওই ক’দিন ধরে খবরের কাগজে আর পাড়ার চায়ের দোকানে দোকানে মেলা শোরগোল চলছে না— ‘বুদ্ধিজীবীরা এখন কোথায়?’, ‘বুদ্ধিজীবীরা কি এখন নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে?’ তাই ভাবলাম তুমিও বুঝি তাদেরই খুঁজছ!

—তোমার বাজে বকাটা এবার থামাও! আর বুদ্ধিজীবী দিয়ে হবে কী! সব শালারা মাকাল ফল!

—ওহ বাবা! তুমি তো দেখছি হে বুদ্ধিজীবীদের ওপর বিশাল খাপ্পা!

—না হওয়াটাই অস্বাভাবিক! সব শালারা অপারচুনিস্ট খচ্চর!

—সে তো ভাগ্নে সব বাঙালিই কোনও না কোনও স্তরে রবীন্দ্রনাথ, সব পলিটিক্যাল নেতাই কোনও না কোনও স্তরে গোরুচোর, আর সব ক্রিমিনালই কোনও না কোনও স্তরে সমাজসেবী! তা নিয়ে অত গোঁসা করার কী আছে!

—ছাড়ো! ও তুমি বুঝবে না!

—ঠিক করে বোঝালেই বুঝব! যাক ছাড়ো, কী খুঁজছ সেটা তো বলো হে…

—চটজলদি বিখ্যাত হবার তারিকা…

—অ্যাঁ! চটজলদি বিখ্যাত হওয়া! অহহ, মানে ‘ভাইরাল’ হওয়া?

—হ্যাঁ, ওই একই হল!

—এই তো ভাগ্নে, বেসিক জিনিসে ভুল! পুরি আর ডালপুরি যেমন এক জিনিস নয়, বা কাম আর কামরাঙা, বা রসগোল্লা আর রাজভোগ, তেমনি বিখ্যাত হওয়া আর ভাইরাল হওয়া— দুটো আলাদা জিনিস! এগুলো সম্পর্কে একটু ওয়াকিবহাল থাকতে হবে বইকী! নাহলে তো সবই ওই ‘উটের পাকস্থলী’ হয়ে যাবে!

—ব্যস! ওই শুরু হয়ে গেল জ্ঞানভৈরবী!

—না না ভাগ্নে, সেই প্রাচীন আপ্তবাক্যটা শোনোনি? A problem can not be solved that starts from an absurd hypothesis…

—উফফ, এ তো দেখছি পুরো পাগল করে ছাড়বে!

—আর না না, তা হটাৎ অমন ভাইরাল হবার সাধ জাগল কেন? খাটের তলা থেকে কোটি কোটি টাকা বেরোচ্ছে বলে মাথায় ব্যামো চাপল নাকি?

—জাগবে নাই বা কেন! কোনও সুরতালের বালাই নেই, কিন্তু তার গানে আসমুদ্রহিমাচল পাব্লিক যেখানে-সেখানে কোমর-পশ্চাদ্দেশ দুলিয়ে নাচছে! বছর ষাট-এর বুড়ো ভাম নেতা, আড়াল থেকে স্বচ্ছন্দে টিটকারি দেওয়া যায় ‘চলমান মাংসের দোকান’ বলে, সে কিনা বছর ২০-২৫-এর মামণিদের সাথে নেচেকুঁদে বাজার মাত করছে! আবার কেউ হাফবয়সি ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর বাড়িতে কোটি কোটি টাকা রেখে খবরকাগজের হেডলাইন বাগিয়ে নিচ্ছে! এগুলো মেনে নেওয়া যায়?!

—ভাগ্নে, একটু জেলাস মনে হচ্ছে? তা তুমিও ওই ঘুরে ঘুরে নেচে ভিডিও বানাও না, ওই ৩০-৪০ সেকেন্ডের? কী যেন বলে বেশ ওগুলোকে?

—রিল?

—হ্যাঁ হ্যাঁ, রিল! তা তুমিও ওরকম কিছু বানাও না?

—হুহ্, ছেলেদের আবার রিল করে ভাইরাল হওয়া! যেন কাঁঠালের আমসত্ত্ব!

—ওহ বাবা, সেগুলো কি আর তেমন এফেক্টিভ নয় নাকি?

—নাহ, রিল-খ্যাত মামণিরা এখন হালে পানি না পেয়ে তাদের পোষা কুকুর-বেড়াল থেকে শুরু মায় তাদের খুদে খুদে বাচ্চাগুলোকে দিয়ে নাচিয়ে-কুঁদিয়ে বাজার ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে!

—হুহু বাবা! অধিক প্রয়োগে ব্রহ্মাস্ত্রও ভোঁতা হয়ে যায়! তাহলে আর কী, বেখাপ্পা গলায় তারস্বরে গান গাও আর কী!

—নাহ, সেটাও ঠিক জুতসই হবে না!

—অহহ, তাহলে কবিতা লিখে বই আকারে ছাপাও না, বেশ সুনীল-শক্তি ধাঁচের!

—মামা তুমি এখনও সেকেলেই রয়ে গেলে! গীতাঞ্জলীকে ‘বাপি বাড়ি যা’ স্টাইলে বাজার থেকে হঠিয়ে কথাঞ্জলির রমরমা এখন! ওসব আর চলে না!

—তাহলে কোনও গরমাগরম স্লোগান আমদানি করো না হে!

—উহু, ‘খেলা হবে’-র পর আর কোনও স্লোগানই ধোপে টিকবে না!

—এ তো মহা মুশকিল! তাহলে একটা রান্নার ভিডিও! আমি তো আছিই পাকা রাঁধুনি! ভাগ্নেকে নাহয় একটু সঙ্গত দিয়ে দেব। তাতে যদি তুমি একটু ভাইরাল হও!

—সে মোলাসেসেও বালি! বাজারে ঝাঁট দিলেই এমন রান্নার ভিডিও ঝুড়ি ঝুড়ি মিলবে!

—বলো কী! তাদের সব্বার রেসিপি ভাল?

—কোনওটার রেসিপি ভাল, আবার কোনওটার উপস্থাপিকা!

—গোলমেলে ব্যাপার হে! একটু খোলসা করে বলো দেখি! উপস্থাপিকার জোরে রান্নার ভিডিও হিট!

—মানে, ধরো, রাঁধছে টমেটোর চাটনি…

—আরে দাঁড়াও দাঁড়াও! এ তো পাতি রান্না…

—আমাকে সবটা বলে শেষ করতে দাও আগে!

—বেশ বলো!

—রাঁধছে টমেটোর চাটনি, কিন্তু উনুনে আগুন নেই! আর ভিডিওর শুরু থেকে শেষ অব্দি তেনার শাড়ির আঁচলের স্থিরতা বজায় থাকছে না! শেষে এমন হাল যে, শাড়ির আঁচল থাকার প্রধান উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ! আর তাতেই ভিডিও ভাইরাল!

—এ তো ঘোর কলি হে ভাগ্নে! তা বলি কী ভাগ্নে, ভাইরাল হওয়াটা কি নিতান্তই জরুরি?

—সব্বাই তো হচ্ছে, ধিনচ্যাক পূজা থেকে ভুবন বাদামওয়ালা! আমারও কি সাধ জাগে না!

—সে তো বুঝলাম, তবে একটা কথা না বলে পারছি না! সেদিন আমার ঘরে চুপিচুপি সিগারেট আনতে গিয়ে আমার ঘরের কম্পিউটারে একটা কবিতা চলছিল, সেটা শুনে তো মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে ছিলে!

—হ্যাঁ তা ছিলাম বইকী! কবিতাটা ঠিক মনে পড়ছে না!

—হুম, শম্ভু মিত্রের গলায় ‘মধুবংশির গলি…’।

—কারেক্ট! এবার মনে পড়েছে!

—হ্যাঁ, তা কেমন লাগল?

—আনরিয়্যাল!

—হুহু বাবা, পিওর সাধনা! টানা ১২ বচ্ছর ঘর বন্ধ করে কবিতাপাঠের সাধনা! লোকে ভেবেছিল লোকটা নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে!

—তাহলে বলছ, অমন চটজলদি দু’দিনের ভাইরাল হয়ে তারপর পুকুরের ঢেউয়ের মতো মিলিয়ে গিয়ে কোনও লাভ নেই?

—এতক্ষণে মাথায় ঢুকল তাহলে!

—গ্যারান্টি দিচ্ছ যে সবুরে মেওয়া ফলে?

—একদমই! গোলবাড়ির মাটন কষা-র দিব্যি! কথাতে আছে না, দু’মিনিটে কেবল ওই ম্যাগিই হয়, বিরিয়ানি রাঁধতে একটু সময় লাগে যে ভাগ্নে! সবুরে মেওয়া আর সাধনায় অমৃত… মিলিবেই মিলিবে…

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
4.5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Dr. S K Mukhopadhyay
Dr. S K Mukhopadhyay
1 year ago

সৌমাভ চমৎকার লিখেছেন

Soumavo Ghosh
Soumavo Ghosh
1 year ago

ধন্যবাদ স্যার!

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »
শুভদীপ রায়চৌধুরী

শুভদীপ রায়চৌধুরীর দুটি কবিতা

অন্ধকারের তুমি,/ নরম পুঁইমাচার নিচে সবজেটে বহুরূপী/ তোমাকে আলোর কণার ভেতর গড়িয়ে যেতে দেখব বলে/ আমি এই পাগলের পৃথিবী ছেড়েছি/ টিলাপায়ে বাস করি/ নাম, সমুদ্রসম্ভব।/ পাতার ইমারত আছে, আছে/ কিছু দৈনন্দিন কাজ/ মাছ ধরার নাম করে/ বালসাভেলায় অনেকদূর যাওয়া/ যতদূর ভেসে গেলে ঢেউয়ের চুম্বন থেকে/ ছোবলটুকু আলাদা করাই যায় না

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | দ্বিতীয় পর্ব

সকালে চিড়ে নারকেল-কোরা আর গুড় খেয়ে আমি সাইকেলে চেপে ছুটিয়ে দিলাম— আট মাইল রাস্তা ঠেঙিয়ে যখন পৌঁছালাম— তখন গণগণে রোদ্দুর তেষ্টায় গলা কাঠ। ঘন্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে একটা বাড়ি দেখে সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম যদি একটু জল খাওয়া যায়। বাড়ির বারান্দায় একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি বসেছিলেন— তার কাছে উদ্দিষ্ট ঠিকানার কথা প্রশ্ন করতেই তিনি উঠে এসে আমার হাত ধরে আমাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে একটা পাটি পেতে বসতে দিলেন। আমি আবার জল চাইলে বললেন, “দাদাঠাকুর ব্যস্ত হবেন না— ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন।”

Read More »