Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

লোকবিশ্বাসে মনসামঙ্গলের মিথ, পুজো পায় ‘বেহুলার চরণচিহ্ন’

পুরাতন মালদা রেলস্টেশন থেকে চার-পাঁচশো মিটার পায়ে হেঁটে মজে যাওয়া বেহুলা নদীখাতের দিকে এগোলেই গাছগাছালিতে ঢাকা প্রাচীন মন্দিরটি চোখে পড়ে। পুরাতন মালদার এই অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে মনসামঙ্গলের নানা গল্প। আর এই প্রায় অখ্যাত মন্দিরের সঙ্গে লোকবিশ্বাসে জড়িয়ে আছে মনসামঙ্গলের বেহুলার নাম। ‘বেহুলার চরণচিহ্ন’ দেখতে এখনও অসংখ্য ভক্ত সমবেত হন পুরাতন মালদা পঞ্চায়েতের অন্তর্গত দেবকুণ্ডের গন্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে। শিবরাত্রিতে পূজিতা হন মা গন্ধেশ্বরী কালী, অঞ্জলি পড়ে মনসামঙ্গলের বেহুলার চরণে। ফাল্গুনী চতুর্দশীতে শিবরাত্রি উপলক্ষে বিশেষ কালীপূজায় হাজারেরও বেশি ভক্ত সমবেত হন এখানে।

পূজিতা হন গন্ধেশ্বরী কালী, অঞ্জলি পড়ে মনসামঙ্গলের বেহুলার চরণে।

মন্দিরের বর্তমান পুরোহিত বর্ষীয়ান অসীমকুমার খাঁর বক্তব্য, তাঁর বাবা প্রয়াত অশ্বিনীকুমার খাঁ-এর মাধ্যমে ১৯৬৬ সাল থেকে তিনি এই পূজার দায়িত্বপ্রাপ্ত। তখন তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছেন। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৩৬৬ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে। এখানে আলাদাভাবে মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয় না। নিকটবর্তী বেহুলা নদী থেকে প্রাপ্ত পাথরের ফলকেই মায়ের উদাস পূজা হয়। মাঝখানে ১৯৮৯ সালের ৯ এপ্রিল বিএসএফের ক্যাম্প বানানোর জন্য জমি অধিগ্রহণ আরম্ভ হলে এই মন্দির ও দেবত্র সম্পত্তি নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীতে জেলাশাসকের মধ্যস্থতায় বিষয়টি মিটে যায় এবং বিএসএফ কর্মীদের সঙ্গেও হৃদ্যতা তৈরি হয়। বিহার ও পশ্চিম থেকে আগত জওয়ানদের উদ্যোগে এখানে হনুমান মূর্তিও স্থাপিত হয়। ১৯৯৮ সালের বন্যার জল সরে যাওয়ার পর মৃতপ্রায় বেহুলা নদীর মধ্যে একটি পাথরে ‘বেহুলার চরণচিহ্ন’ পাওয়া যায়। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তাকে তুলে আনা যায়নি। পরবর্তীকালে ২০১২ সালে এই পাথর তুলে এনে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। কালী মন্দিরে যারা পূজা দিতে আসেন তারা ভক্তিভরে বেহুলা মাতার চরণেও অঞ্জলি দেন। এই বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, নিকটবর্তী ধোবিঘাটে বেহুলার ভেলা এসে ঠেকেছিল।

বন্যার জল সরে যাওয়ার পর মৃতপ্রায় বেহুলা নদীর মধ্যে একটি পাথরে ‘বেহুলার চরণচিহ্ন’ মেলে।

স্থানীয় প্রবীণ অধিবাসী ও জেলার ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, পুরাতন মালদার বেহুলা নদী সংলগ্ন এই অংশটিতে মনসামঙ্গলের মিথ বহুল প্রচলিত। পুরাতন মালদা জুয়ার মেলাটিও এই মন্দিরের কাছাকাছি অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয়। এমনকি, মনসামঙ্গল কাব্যধারার ‘উত্তরবঙ্গের কবি’ হিসাবে স্বীকৃত জগজ্জীবন ঘোষালের সাধনপীঠ ও মন্দিরের অবস্থান এই অঞ্চলেই বলে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’-এর লেখক আচার্য সুকুমার সেন।

কালী ও বেহুলার লোকবিশ্বাস থেকে এই মন্দিরের গড়ে ওঠার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান করেছেন গৌড় মহাবিদ্যালয়ের দুই ছাত্র অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায় ও অভীক পাল। তারা বলেন, ‘এখনও পর্যন্ত যতটুকু উদ্ধার করা গেছে, তাতে কালী মন্দিরটি অনেক প্রাচীন হলেও বেহুলার গল্প সাম্প্রতিক। কিন্তু যেহেতু জগজ্জীবন ঘোষালের মনসামঙ্গল কাব্যে পুরাতন মালদার এই অঞ্চলের একটি আভাস পাওয়া যায়, তাই বেহুলার গল্পটিকেও একেবারেই ফেলে দেওয়া যায় না। পাথরের ফলকে মা কালী ও বেহুলার চরণচিহ্ন পূজিত হওয়ার বিষয়টি আমাদের কাছে অভিনব লেগেছে। এমনটা আগে কোথাও দেখিনি।’

দেবকুণ্ডের গন্ধেশ্বরী কালী। নিকটবর্তী বেহুলা নদী থেকে প্রাপ্ত পাথরের ফলকেই পূজা হয়।

গবেষকদের এই মতামতকে সমর্থন করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও মন্দির বিশেষজ্ঞ ড. জয়া বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘দেবী কালীর উদ্ভব যদি মোটামুটি নবম থেকে দশম শতাব্দীতে হয়, মনসামঙ্গলের উদ্ভব তার অনেক পরে ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে। ফলে বেহুলার মিথ যে অনেক অর্বাচীন হবে, সেটা বলাই যায়। আর এই মন্দিরের গন্ধেশ্বরী কালী মন্দির নামকরণটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণভাবে গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের দ্বারা পূজিত শক্তিদেবী গন্ধেশ্বরী নামে পূজা পান। তিনি দেবী দুর্গার এক অংশ। এই নামকরণের মধ্যে দুর্গা ও কালীর একটা মিশ্র প্রভাব আছে। উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির অনতিদূরে দেবী গন্ধেশ্বরীর মন্দির এই কথাটিরই সাক্ষ্য বহন করে।’

মন্দিরে পূজা দিতে আগত মিনতি হালদার বা বিদিশা রায়রা বলেন, ‘অনেকদিন আগে থেকে এই কালীমন্দিরে পূজা দিয়ে আসছি। এ বছর শিবরাত্রির দিনও বাবার মাথায় জল ঢেলে ওখানে পূজা দিলাম। বেহুলা মাতার চরণেও জল ঢাললাম।’

পুরাতন মালদার বেহুলা নদী সংলগ্ন এই অংশটিতে মনসামঙ্গলের মিথ বহুল প্রচলিত।

কথাসাহিত্যিক অভিজিৎ সেনের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘দেবাংশী’ বা ‘বিদ্যাধরী ও বিবাগী লখিন্দর’-এর মতো উপন্যাসে তিনি গৌড়বঙ্গের এই অঞ্চলে প্রচলিত মনসামঙ্গলের মিথগুলিকে শাক্ত ঐতিহ্যের সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। অধ্যাপক শশিভূষণ দাশগুপ্ত ‘শক্তি সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’ নামক কালজয়ী গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন, পালযুগের সমস্ত তন্ত্রগ্রন্থে মহাকাল বা শিব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শাক্ত পালসম্রাট ধর্মপালের জয়ধ্বজায় মা তারার নাম খোদাই করা থাকত। সাংখ্য দর্শনের পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্ব মেনেই এই মন্দিরে অতন্দ্র ভৈরবের সঙ্গে শক্তিদেবী নিত্যপূজা পান।

চিত্র: অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায় ও অভীক পাল

লেখা পাঠানোর ইমেল: bhalobhasadigital@gmail.com

4.5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »