পুরাতন মালদা রেলস্টেশন থেকে চার-পাঁচশো মিটার পায়ে হেঁটে মজে যাওয়া বেহুলা নদীখাতের দিকে এগোলেই গাছগাছালিতে ঢাকা প্রাচীন মন্দিরটি চোখে পড়ে। পুরাতন মালদার এই অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে মনসামঙ্গলের নানা গল্প। আর এই প্রায় অখ্যাত মন্দিরের সঙ্গে লোকবিশ্বাসে জড়িয়ে আছে মনসামঙ্গলের বেহুলার নাম। ‘বেহুলার চরণচিহ্ন’ দেখতে এখনও অসংখ্য ভক্ত সমবেত হন পুরাতন মালদা পঞ্চায়েতের অন্তর্গত দেবকুণ্ডের গন্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে। শিবরাত্রিতে পূজিতা হন মা গন্ধেশ্বরী কালী, অঞ্জলি পড়ে মনসামঙ্গলের বেহুলার চরণে। ফাল্গুনী চতুর্দশীতে শিবরাত্রি উপলক্ষে বিশেষ কালীপূজায় হাজারেরও বেশি ভক্ত সমবেত হন এখানে।

মন্দিরের বর্তমান পুরোহিত বর্ষীয়ান অসীমকুমার খাঁর বক্তব্য, তাঁর বাবা প্রয়াত অশ্বিনীকুমার খাঁ-এর মাধ্যমে ১৯৬৬ সাল থেকে তিনি এই পূজার দায়িত্বপ্রাপ্ত। তখন তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছেন। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৩৬৬ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে। এখানে আলাদাভাবে মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয় না। নিকটবর্তী বেহুলা নদী থেকে প্রাপ্ত পাথরের ফলকেই মায়ের উদাস পূজা হয়। মাঝখানে ১৯৮৯ সালের ৯ এপ্রিল বিএসএফের ক্যাম্প বানানোর জন্য জমি অধিগ্রহণ আরম্ভ হলে এই মন্দির ও দেবত্র সম্পত্তি নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীতে জেলাশাসকের মধ্যস্থতায় বিষয়টি মিটে যায় এবং বিএসএফ কর্মীদের সঙ্গেও হৃদ্যতা তৈরি হয়। বিহার ও পশ্চিম থেকে আগত জওয়ানদের উদ্যোগে এখানে হনুমান মূর্তিও স্থাপিত হয়। ১৯৯৮ সালের বন্যার জল সরে যাওয়ার পর মৃতপ্রায় বেহুলা নদীর মধ্যে একটি পাথরে ‘বেহুলার চরণচিহ্ন’ পাওয়া যায়। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তাকে তুলে আনা যায়নি। পরবর্তীকালে ২০১২ সালে এই পাথর তুলে এনে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। কালী মন্দিরে যারা পূজা দিতে আসেন তারা ভক্তিভরে বেহুলা মাতার চরণেও অঞ্জলি দেন। এই বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, নিকটবর্তী ধোবিঘাটে বেহুলার ভেলা এসে ঠেকেছিল।

স্থানীয় প্রবীণ অধিবাসী ও জেলার ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, পুরাতন মালদার বেহুলা নদী সংলগ্ন এই অংশটিতে মনসামঙ্গলের মিথ বহুল প্রচলিত। পুরাতন মালদা জুয়ার মেলাটিও এই মন্দিরের কাছাকাছি অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয়। এমনকি, মনসামঙ্গল কাব্যধারার ‘উত্তরবঙ্গের কবি’ হিসাবে স্বীকৃত জগজ্জীবন ঘোষালের সাধনপীঠ ও মন্দিরের অবস্থান এই অঞ্চলেই বলে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’-এর লেখক আচার্য সুকুমার সেন।
কালী ও বেহুলার লোকবিশ্বাস থেকে এই মন্দিরের গড়ে ওঠার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান করেছেন গৌড় মহাবিদ্যালয়ের দুই ছাত্র অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায় ও অভীক পাল। তারা বলেন, ‘এখনও পর্যন্ত যতটুকু উদ্ধার করা গেছে, তাতে কালী মন্দিরটি অনেক প্রাচীন হলেও বেহুলার গল্প সাম্প্রতিক। কিন্তু যেহেতু জগজ্জীবন ঘোষালের মনসামঙ্গল কাব্যে পুরাতন মালদার এই অঞ্চলের একটি আভাস পাওয়া যায়, তাই বেহুলার গল্পটিকেও একেবারেই ফেলে দেওয়া যায় না। পাথরের ফলকে মা কালী ও বেহুলার চরণচিহ্ন পূজিত হওয়ার বিষয়টি আমাদের কাছে অভিনব লেগেছে। এমনটা আগে কোথাও দেখিনি।’

গবেষকদের এই মতামতকে সমর্থন করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও মন্দির বিশেষজ্ঞ ড. জয়া বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘দেবী কালীর উদ্ভব যদি মোটামুটি নবম থেকে দশম শতাব্দীতে হয়, মনসামঙ্গলের উদ্ভব তার অনেক পরে ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে। ফলে বেহুলার মিথ যে অনেক অর্বাচীন হবে, সেটা বলাই যায়। আর এই মন্দিরের গন্ধেশ্বরী কালী মন্দির নামকরণটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণভাবে গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের দ্বারা পূজিত শক্তিদেবী গন্ধেশ্বরী নামে পূজা পান। তিনি দেবী দুর্গার এক অংশ। এই নামকরণের মধ্যে দুর্গা ও কালীর একটা মিশ্র প্রভাব আছে। উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির অনতিদূরে দেবী গন্ধেশ্বরীর মন্দির এই কথাটিরই সাক্ষ্য বহন করে।’
মন্দিরে পূজা দিতে আগত মিনতি হালদার বা বিদিশা রায়রা বলেন, ‘অনেকদিন আগে থেকে এই কালীমন্দিরে পূজা দিয়ে আসছি। এ বছর শিবরাত্রির দিনও বাবার মাথায় জল ঢেলে ওখানে পূজা দিলাম। বেহুলা মাতার চরণেও জল ঢাললাম।’

কথাসাহিত্যিক অভিজিৎ সেনের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘দেবাংশী’ বা ‘বিদ্যাধরী ও বিবাগী লখিন্দর’-এর মতো উপন্যাসে তিনি গৌড়বঙ্গের এই অঞ্চলে প্রচলিত মনসামঙ্গলের মিথগুলিকে শাক্ত ঐতিহ্যের সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। অধ্যাপক শশিভূষণ দাশগুপ্ত ‘শক্তি সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’ নামক কালজয়ী গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন, পালযুগের সমস্ত তন্ত্রগ্রন্থে মহাকাল বা শিব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শাক্ত পালসম্রাট ধর্মপালের জয়ধ্বজায় মা তারার নাম খোদাই করা থাকত। সাংখ্য দর্শনের পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্ব মেনেই এই মন্দিরে অতন্দ্র ভৈরবের সঙ্গে শক্তিদেবী নিত্যপূজা পান।
চিত্র: অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায় ও অভীক পাল
লেখা পাঠানোর ইমেল: bhalobhasadigital@gmail.com