দরজা খুলে চশমার ওপর দিয়ে আপাদমস্তক দেখে বুড়ো ভদ্রলোক তাকিয়ে রইলেন। ‘কাকে চাই?’
‘কিছু মনে করবেন না।’ আমতা আমতা করে বললাম, ‘আপনারা কতদিন আছেন?’
বিরক্ত হলেন। ‘আছি অনেকদিন। আপনার কী চাই? আমার তাড়া আছে, স্নানে যাব।’ দেখলাম গামছা পরা। ‘কোনও ঠিকানা খুঁজছেন? আমি বলতে পারব না। আমি এখানে বেড়াতে এসেছি, বলতে পারব না।’
‘কে, কে বাবা? কার সঙ্গে কথা বলছ!’ বলতে বলতে একটি যুবতী মহিলা এসে দাঁড়ায়। বাবাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কে ইনি?’
আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছি দেখে বিরক্ত হয়। ‘কী ব্যাপার বলুন তো? কী চাইছেন?’ এবার সে একটু কর্কশ।
এবার বলতেই হল। ‘বহু বছর আগে আমি এখানে থাকতাম।’ এতটুকুই মুখ দিয়ে বের হয়। এই অসমাপ্ত কথা শুনে মেয়েটি ও তার বাবা একসাথে বলেন, ‘ও।’
ব্যাস চুপ। এখন দুপুরের মুখে কী উপদ্রব করব সেটা বুঝতে পারছেন না। তাই কথা বাড়াতে চান না। বাবা হঠাৎ করে একটু নরম হলেন। ‘দেখবেন?’
মেয়েটি বলে উঠল, ‘আঃ, বাবা।’ তারপর বিরক্তি সহকারে বলল, ‘আসলে, এখন তো স্নান-খাওয়ার সময়। আপনি বিকেলের দিকে এলে আপনার পুরনো বাড়ি দেখাতে পারতাম।’
এরপর আর দাঁড়ানো যায় না। মেয়েটির বাবা বলেন, ‘তুই ভিতরে যা।’
বড় ভুল সময় এসেছি। বললাম, ‘ঠিক আছে। আমি পরে আসব। আসলে অনেক দিন কাটিয়েছি, তাই কিছু স্মৃতি রয়ে গেছে। তারই টানে…।’
ভদ্রলোকের কী মায়া হল, বললেন, ‘আসুন ভিতরে।’
ঢুকেই যে ঘরে আমি পড়াশুনা করতাম, শুতাম, দেখি, সেই ঘরটা কাঠের পার্টিশন করে ছোট একফালি ঘর হয়েছে। দুটো জানলায় দামি পর্দা। সামনের টেবিল-চেয়ারও বেশ দামি। আমাদেরটা দামি ছিল না। শিয়ালদহ থেকে সস্তা কাঠের কেনা। পর্দাগুলো রংওঠা জ্যালজ্যালে কাপড়ের, তাও দুয়েক জায়গায় মায়ের সেলাই করা। ঘরে ঢুকেই অচেনা হয়ে গেল বাড়িটা। বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, ‘জল খাবেন?’ মেয়েটি বিরক্ত হয়ে ভিতরে চলে গেছে। বৃদ্ধ আমার সম্মতি পেয়ে এক গ্লাস জল এনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আসলে যে বাড়িতে প্রথম জ্ঞানের উদ্রেক হয়, সেই বাড়িটিই নিজের বাড়ি। বাকি সব আসাযাওয়া।’
বললাম, ‘খুব ভাল বলেছেন। আমি আসতে চাইনি। কোথায় কোন গহীন কোণে স্মৃতি লুকিয়ে থাকে কে জানে! সেই টানতে টানতে…।’
‘কে কে থাকতেন এখানে?’
‘আমি, ভাই, দিদি, মা-বাবা। আজ কড়া নেড়েই ফেললাম কিন্তু অনেকদিন আপনাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গিয়েছি। অনেকটা দূর থেকে এসে উল্টো দিকের ফুটপাতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে গেছি। খুব শান্তি লেগেছিল।’
‘আশ্চর্য! কেন? আমাদের ডাকতে পারতেন। আদতে আমরা তো একই বাড়ির বাসিন্দা। তাই না?’ ভদ্রলোক ভারী সুন্দর কথা বলেন।
জামা পাল্টায়, সেই জামায় লেগে থাকে স্মৃতি। উল্টো দিকের ফুটপাতে একটা টিউবওয়েল ছিল। বাবা রাস্তা পেরিয়ে টিউবওয়েল থেকে জল নিয়ে এসে স্নান করতেন। ‘দরজার পাশে একটা ছোট্ট লেটার বক্স ছিল। কতদিন সেখানে চিঠি পেয়ে আনন্দে ভেসে গেছি আমি, মা। কতদিন শুধু খুলে খুলে হাতড়ে দেখেছি ইন্টারভিউ বা চাকরির পরীক্ষার চিঠি এল কিনা। এই দেখুন, ঠিক বেরিয়েই এখানে। ছেলেমানুষের মত বেরিয়ে গিয়ে দেখালাম।’
ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কত বছর ছিলেন?’
‘বেশি না। প্রথম বারো বছর।’
বুড়ো ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘আপনি তো তাও দেখতে পেলেন আপনার বাড়ি। আর আমাদের তো তারও উপায় নেই।’
‘কেন?’
‘সব ফেলে এসেছি। এখন বুঝি ওটাই সর্বস্বান্ত হওয়া। ধন নয়, মান নয়, স্মৃতিকে আর না ছুতে পারা।’ উদাস দৃষ্টিতে বললেন, ‘এমনকি এখন গেলেও দেখিয়ে দিতে পারি চাঁদপুরের বসবার ঘরের জানলার কাঠের ফ্রেমের মধ্যে গর্ত করে গুলি খেলার গুলি লুকিয়ে রেখে মুখ কাঠের গুঁড়ো দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ওপর থেকে কেউ বুঝতে পারবে না।’
‘সেকি কেন?’ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
মলিন হেসে বললেন, ‘দাদার হাত থেকে বাঁচাতে।’ বলে হেসে ফেললেন। ‘দাদা আজ কতদিন হল চলে গেছে। এপারে চলে আসার পর ও অনেক বার জিজ্ঞাসা করেছে নীল রঙের গুলিটা কোথায় রেখেছিস রে?’
‘বলিনি। কারণ আমার ধারণা ছিল এখানে কিছুদিনের জন্যে এসেছি, আবার ফিরে যাব বাড়িতে। নিজের বাড়িতে। যার প্রতিটি কোনা খামচি, ভাঙাচোরা আমি চিনি। যার প্রতিটি জায়গার গন্ধ আমি চিনি।’
মেয়েটি এসে দাঁড়ায়। ‘বাবা, চলো ভিতরে, চান করে নাও, তোমার খেতে অনেক দেরি হয় যাবে।’ বিরক্তভাবে বোঝাতে চায়, আমি এখনও দাঁড়িয়ে?
এরপর আর দাঁড়ানো সমীচীন নয়। বুড়ো ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘দাঁড়ান দেখি, ভিতরে গিয়ে দেখানো যায় কিনা।’ আমি রাজি হয়নি। ওদের দরজা বন্ধ হল।
***
ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে রাসবিহারী মোড় পেরিয়ে ছেলের বাড়ির কাছে আসতেই দুটো বাড়ি আগে দেখি ডক্টর চক্রবর্তীকে দুই ছেলে ধরে ধরে বিরাট গাড়ি থেকে নামিয়ে ভিতরে যাচ্ছে। আর এক ছেলে কাছে দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘অসুস্থ? কী হল?’
ছোটছেলে সমীর বিমর্ষ মুখে বলল, ‘‘কী বলি বলুন তো কাকু! এই যে কী এক রোগ হয়েছে বাবার, বুঝতে পারছি না। প্রায়ই না বলে বেরিয়ে যায়। জিজ্ঞাসা করলে বলে, ‘বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে চলে গিয়েছিলাম দূরে!’ এটা কোনও কথা হল? এত বড় বাড়ি, সঙ্গে দেখাশুনার জন্যে সব সময়ের লোক আছে, তবু বাবা কেমন অবুঝের মতন করে। বাড়ি আর কোথায়? এটাই তো বাড়ি, তবু মাঝে মাঝেই বলে, ‘আমার বাড়ি কই? আমি বাড়ি যাব।’ সল্ট ইমব্যালেন্স বা মাথার গণ্ডগোল হল কিনা বুঝতে পারছি না।’’
ডক্টর চক্রবর্তী এক সময় ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ-এ একজন সফল বৈজ্ঞানিক ছিলেন। তিন ছেলেই উচ্চশিক্ষিত। তিনতলা বিরাট বাড়ি। সমীরকে বললাম, ‘চিন্তা করো না। বয়েসকালে মানুষ উৎসমুখে ফিরতে চায়, ফিরে দেখতে চায়। মনখারাপ করো না। উনি ওনার ছোটবেলার বাড়ি বোধ হয় খুঁজছেন।’ সমীর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আরও ব্যথিত চোখে তাকিয়ে বলল, ‘এটা বাবার বাড়ি নয়? তাহলে এতবড় বাড়ি করে কী লাভ হল?’ অন্য দুই দাদা ডাকছে বলে হুড়োহুড়ি করে বাবাকে ধরতে এগিয়ে গেল।
ভদ্রলোক ঠিকই বলেছেন, যে বাড়িতে থেকে নৌকা ভাসিয়েছি জলে, যেখানে বর্ষার সময় ছপর ছপর করে হাফ প্যান্ট পরে ফিরেছি ভিজে চুপচুপে হয়ে, যার সোঁদা দেয়ালে গাঁথা আছে আমার সুখ দুঃখ বিরহ, সেই হচ্ছে আমার বাড়ি। জানলার ক্ষয়ে যাওয়া লোহার শিকের নীচে বৃষ্টির সময় ফোঁটা ফোঁটা জল টইটুম্বুর হয়ে থাকে। জানলার পচে ফুলে যাওয়া ফ্রেমে পিঁপড়েরা লাইন দিয়ে অপেক্ষা করে জল শুকিয়ে পারাপার হবার। ইট কাঠ পাথরের বাড়ি একই থাকে। পাল্টে যায় মানুষজন। বাড়ি একটা স্মৃতির অংশ।
আমার ছেলে বিরাট বাড়ি করে বড় একটা ঘরে আমাকে থাকতে দিয়েছে। বিরাট খাট, বড় হাতলওয়ালা চেয়ার। সঙ্গে দক্ষিণের বারান্দা। পিছনে গাছগাছালির শোভা। শীতের সময় রৌদ্রে ঘর ভেসে যায়। বউমা রৌদ্রে বালিশ রেখে গরম করে দেয় আরামের জন্যে। কিন্তু আমি ওখানে শুধু থাকতে এসেছি কয়দিনের জন্যে। জানি ওটা আমার বাড়ি নয়।
আমার বাড়ি তো সেই দেড় ঘরের পুরনো বাড়ি। তার একটা ছোট্ট ঘরে শীতের দিনে একই খাটে মা আমি ভাই দিদি একটা লেপ নিয়ে টানাটানি করি। কে জানলার ধারে শোবে, কে মার পাশে শোবে এই নিয়ে চলে মারপিট। মাঝরাতে ঝগড়া করি, মার কাছে বকা খাই। আবার অকাতরে ঘুমাই। বকাঝকাতেও ঘুম ভাঙে না। ওইটা আমার বাড়ি। কয়লার ধোঁয়ায় কালো পলেস্তারা ভাঙা ছোট্ট এক রান্নাঘরে মা তরকারি কুটছে, আমি পিছন থেকে গলা ধরে দোল খাচ্ছি, সামনে তরকারি ছেটানো, লোহার বালতি, বাসনে পা রাখার জায়গা নেই। মা পড়া ধরছে তার মধ্যে ‘কুমোর পাড়ার… বল বল। তারপর কী? গো… গো…।’ অস্পষ্ট ছবি, তবু ওইটা আমার বাড়ি। ওই ভাঙাচোরা রান্নাঘরে হামাগুড়ি দেওয়া থেকে থপথপ করে হেঁটে আসা, মায়ের পিঠ ধরে ঝোলা, জলের বাটির মধ্যে পা পড়ে যাওয়া, ওইটা আমার বাড়ি।
এখন কে ফেরত দেবে? কার সেই সাধ্য? ছেলের বাড়ি আমার বাড়ি নয়। কতগুলো ছোট থেকে বড় বাড়িতে জীবনের খণ্ড খণ্ড সময় কাটিয়েছি, সেগুলো হচ্ছে থাকবার বাসা, সে আমার বাড়ি নয়। আমার বাড়ির দেড়খানা ঘরে, কাচভাঙা আলমারিতে, রান্নাঘরে, বিশৃঙ্খল বইয়ের তাকে আমার বাড়ি লুকিয়ে আছে। সেই বাড়িকে আমি বয়ে বেড়াই। আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
আমি জানি ডক্টর চক্রবর্তীর মাথার গণ্ডগোল হয়নি। উনিও আমার মত সেই বাড়িকেই খুঁজছেন।