ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের কীভাবে বিচার করতে হয় সে-বিষয়ে বইটি একটি মডেল। আধুনিক যুগের দেশ-বিদেশের পনেরোজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বকে নিয়ে পনেরোটি লেখা জড়ো করা হয়েছে দুই মলাটের মধ্যে। এই পনেরোজনের কাজের ক্ষেত্র আলাদা আলাদা, মতবাদও বিভিন্ন কিন্তু একটি বিষয়ে মিল আছে— এঁরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের কাজের জগতে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিভিন্ন মতের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষদের নিয়ে আলাদা আলাদা আলোচনা থাকায় কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের দেখা উচিত— সেটি পরিষ্কার করে বুঝতে বইটি খুবই সহায়ক।
বইটির ভূমিকাটি বাংলা ভাষায় লেখা একটি অমূল্য দলিল। খুব ছোট পরিসরে এমন ঝরঝরে ভাষায় ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা, প্রতিভা, ইত্যাদি নিয়ে অনেকগুলো অত্যন্ত কাজের কথা লেখা বোধহয় রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর পক্ষেই সম্ভব। ভূমিকাতে লেখক জানান:
“স্পষ্ট করে বলে রাখি: আমি অনুতাপহীন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী। কয়েক দশক ধরে ঘরে-বাইরে অনেক হুজুগ আসতে-যেতে দেখেছি। কিন্তু তার ধাক্কায় হাওয়া বুঝে নিত্যনতুন পাল খাটাইনি। তাই প্রতিটি লেখাতেই কম বেশি জোর পড়েছে এমন কয়েকটি দিকের ওপর যেগুলি মার্কসবাদীদের চোখে গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য, অন্যদের কাছে তেমন না-ও পেতে পারে। যাঁদের নিয়ে লিখছি তাঁদের সকলেই যে অনুসরণযোগ্য— এমন নয়। তাঁরা সকলে মার্কসবাদীও নন। তবু ঐতিহাসিক বিচারে প্রত্যেকেরই নিজস্ব মহিমা আছে। সকলের ক্ষেত্রেই চোখ রাখা হয়েছে তাঁদের কর্মজীবনের ওপর: ব্যক্তিগত জীবনের কথা, তাঁদের ‘সীমা ও স্ববিরোধ’ বড় হয়ে ওঠেনি।”
সুইস অর্থনীতিবিদ্ ও ঐতিহাসিক জাঁ সিমমঁদির ওপর আলোচনা করতে গিয়ে লেনিন লিখেছিলেন,
“আধুনিক প্রয়োজনের নিরিখে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বরা কোন কোন অবদান রাখেননি সেই নিয়ে ঐতিহাসিক পরিষেবার বিচার হয় না, তাঁদের পূর্বসূরিদের তুলনায় তাঁরা যে নতুন নতুন ‘অবদান রেখেছিলেন’ বিচার হবে তা-ই দিয়ে।”
লেনিনের এই মতামতকেই কেন্দ্রে রেখে এই বইতে রামকৃষ্ণবাবু খুব স্বল্প জায়গায় পনেরোজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আলোচনা করেছেন। বইয়ের শেষে তাঁদের জীবনের একটি করে সংক্ষিপ্ত তথ্যপঞ্জিও দেওয়া আছে।
চারপাশের অতি-প্রগতিশীলদের হালচাল দেখে লেনিনের এই কথাগুলো বারবার উল্লেখ করতে ইচ্ছে করে। বিশেষ করে বাঙালি কৃতী মানুষদের আলোচনায় বরাবরই দুটি খুব চরমপন্থা লক্ষ্য করা যায়। একদল গবেষক আর তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গরা ব্যস্ত থাকেন ওইসব কৃতীদের খুঁত ধরতে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কী করেছেন আর কাজের ক্ষেত্রে কী কী করেননি তার ফিরিস্তি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ওঠে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র সকলেই এই চোখে-আঙুল-দাদাদের আক্রমণের শিকার। একজন মানুষ যত প্রতিভাবানই হোন না কেন তিনি যে তাঁর সমসময়ের নিগঢ়ে বাঁধা, সেই বন্ধন যে কেটে ফেলা সম্ভব নয়— এই সরল সত্যি কথাটা এঁরা বুঝতে চান না। ‘চান না’ শব্দটি ইচ্ছে করেই ব্যবহার করলুম কারণ কথাটা না-বোঝার কিছু নেই। বুঝেশুনে জ্ঞানপাপীদের মতই তাঁরা অক্লান্ত ভুল ধরার কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাতে যে নিছক গর্ভপাতের বাইরে কোনও কাজের কাজ হয় না সেটি তাঁরা বুঝতে পারেন কি না তা অবশ্য আমার জানা নেই।
আর-এক দল তো মনীষীমাত্রই পুজোয় বিশ্বাসী। জন্ম বা মৃত্যুতিথিতে কৃতী মানুষদের ছবিতে মালা-চন্দন দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে স্মরণ। অনেকটা জন্মাষ্টমী পালনের মত, শ্বেতশুভ্র পোশাক আর কিঞ্চিৎ সাত্ত্বিক আহারের বন্দোবস্ত।
আসল সমস্যা অন্য জায়গায়। অনেক অধার্মিক ধর্ম ছাড়লেও আদতে ধর্মীয় ধারায় চিন্তার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। ধর্মর বদলে তাঁরা রাজনীতি কিংবা যুক্তিবাদকে গ্রহণ করেন। ধর্মর যে ব্যক্তিগত নিষ্ঠা পালনের দাবি সেই দাবি তাঁরা রাজনীতি বা অন্য কাজেও করে থাকেন। কে কী কাজ করছেন তার চেয়ে অনেক বড় হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত নিষ্ঠা, শুচিতা ইত্যাদি। কাজের লোক হওয়ার চেয়ে অপাপবিদ্ধ হওয়াতেই এঁদের আগ্রহ বেশি। জীবনচর্চা আর জীবনচর্যা থেকে কে কতখানি বিচ্যুত হল সেই অনুসন্ধানের কাজেই প্রায় সর্বশক্তি খরচ করে ফেলেন এঁরা। সেই মানসিকতারই প্রকাশ পায় ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের বিচারের ক্ষেত্রেও।
একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের অবদানের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার পথে কেউই হাঁটতে চান না। রামকৃষ্ণবাবুর মত লেখকরা ব্যতিক্রমই বটে।
এইরকম অবিরত খুঁত খুঁজে চলা মানুষদের রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ‘ঐতিহাসিকম্মন্য’ বলেই ব্যঙ্গ করেছেন,
“রামমোহন, ডেভিড হেয়ার, বিদ্যাসাগর— বিস্তর নামজাদা ঐতিহাসিকম্মন্য এঁদের ব্যক্তিগত জীবনের খুঁত ধরতেই বেশি ব্যস্ত। রামমোহন তেজারতি করতেন, ডেভিড হেয়ার সাধু ব্যবসায়ী ছিলেন না, বিদ্যাসাগর কেন তারানাথ তর্কবাচস্পতির সংস্কৃতজ্ঞান নিয়ে কটাক্ষ করলেন— এইসব ব্যক্তিঘেঁষা, আদ হোমিনেম কুযুক্তির পসরা সাজিয়ে কিছু লেখক/ভাষণ-বিশারদ অমল আনন্দ পেয়ে থাকেন। অথচ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-এর শিক্ষা ঠিক তার উল্টো।”
এই প্রসঙ্গেই ভূমিকাতে এসেছে রনে দেকার্ত-এর প্রসঙ্গ। রনে দেকার্ত-এর পদার্থবিদ্যা আর অধিবিদ্যা ছিল পুরোপুরি আলাদা। “পদার্থবিদ্যায় তিনি অদ্বৈত বস্তুবাদী, আর অধিবিদ্যায় নিছক ভাববাদী”। তাতে কোনও অসুবিধে হয়নি। দেকার্তীয় বস্তুবাদ থেকেই প্রয়োগ করেই “আত্মা যে দেহেরই কার্যপ্রণালী, ভাবনাগুলো যান্ত্রিক গতি”— এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। কোপারনিকাস ছিলেন পাদ্রি, নীডহ্যাম ভক্ত খ্রিস্টান— তাতে তাঁদের অবদানগুলো বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক অবদানগুলো বাতিল হয়ে যায় না। এই প্রসঙ্গে এই বইয়ের ভূমিকাতে রামকৃষ্ণবাবু বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ই এইচ কার-এর একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। কার লিখছেন:
“বলা হয় যে পাস্তুর ও আইনস্টাইন-এর ব্যক্তিগত জীবন ছিল দৃষ্টান্তস্থানীয়, এমনকি সন্তসুলভ। কিন্তু ধরা যাক, তাঁরা ছিলেন চরিত্রহীন স্বামী, নিষ্ঠুর পিতা ও অসৎ সহকর্মী। তাহলে কি ঐতিহাসিক কৃতিত্ব কিছু কম হত? আর, এইসব নিয়েই ঐতিহাসিক ব্যাপৃত থাকেন। স্তালিন নাকি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে নিষ্ঠুর ও হৃদয়হীন আচরণ করেছিলেন; কিন্তু সোভিয়েট ঘটনাবলীর ঐতিহাসিক হিসেবে আমি নিজে তাতে খুব একটা ভাবিত হই না। এর মানে এই নয় ব্যক্তিগত নৈতিকতার কোনও গুরুত্ব নেই বা নীতির ইতিহাস ইতিহাসের ন্যায্য অংশ নয়। কিন্তু ঐতিহাসিকের বই-এর পাতায় যেসব ব্যক্তি হাজির হন, তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে নৈতিক রায় ঘোষণা করার জন্যে তিনি ঘুরে দাঁড়ান না। করার মত অন্য অনেক কাজ তাঁর আছে।”
এখানে একটা ক্যাভিয়েট দিয়ে রাখা ভাল। এখানে আলোচনা চলছে ইতিহাস যথেষ্ট অবদান রেখেছেন তেমন ব্যক্তিত্বদের নিয়ে। সাধারণ ধান্ধাবাজ সেলফ-ডিক্লেয়ারড মহাপুরুষদের কথা কিন্তু বলা হচ্ছে না।
ভূমিকাতেই এসেছে প্রতিভা আর ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকার প্রসঙ্গও,
“‘প্রতিভা’ শব্দটি নিয়ে কেউ কেউ দেখেছি অস্বস্তিবোধ করেন। এক নয়া বাম তো বলেই ফেলেছিলেন ওটা একটা অর্থহীন শব্দ। আমার মতো সাবেকী বামরা অবশ্য জানেন মার্কস-এঙ্গেলস কখনও কার্পণ্য করেননি। সেখানে শ্রেণী বিচারের প্রশ্ন ওঠেনি। আরিস্তোতলকে মার্কস মনে করতেন: “মহান চিন্তানায়ক।…
আসলে ভুল হয় কোথায়? সব মানুষ সমান— এই কথার মানেটা ঠিকমত বোঝা হয় না। বাস্তবেই দেখা যায়: সব বিষয়ে সকলের ক্ষমতা এক নয়। চেহারার তফাত (লম্বা-বেঁটে-রোগা-মোটা) ইত্যাদি ছাড়াও ক্ষমতার তফাত থাকে। এমনকি প্রতিভাবান নিজের কর্মক্ষেত্রর বাইরে অন্য পাঁচজন প্রতিভাহীনেরই সগোত্র।…
কেন কিছু মানুষ অন্যদের চেয়ে বেশি ক্ষমতা ও দক্ষতার পরিচয় দেন— একদিন হয়তো তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে কিন্তু কেন আরও অল্প কিছু লোক ‘নব নব উন্মেষশালিনী বুদ্ধি’-র পরিচয় দেন তা এখনও জানা যায়নি। তাই প্রতিভাবানরা অন্য দশজন অকুশলী এমনকি কুশলী লোকদের চেয়ে আলাদা। তার কারণ না-জানলেও ঘটনাটিকে অস্বীকার করা অসম্ভব।…
সার বক্তব্য এই: ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকাকে মার্কসবাদ অস্বীকার করে না। বরং সমাজ জীবনের যে যে ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে ব্যক্তি হিসেবেই কাজ করতে হয় (অর্থাৎ সমষ্টির অংশ হিসেবে নয়) সেখানে ব্যক্তির ভূমিকাই প্রধান। শিল্প-সাহিত্য, দার্শনিক চিন্তা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তত্ত্বভাবনা, ভৌতবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের গবেষণা ইত্যাদি সেই ধরনের ক্ষেত্র।”
এইবারে দেখে নেওয়া যাক বইটির সূচিপত্রটি:
১. ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়: চির-অশান্ত স্বাদেশিক
২. প্রফুল্লচন্দ্র রায়: মুক্তচিন্তার অজানা পদাতিক
৩. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত: জাতীয় বিপ্লববাদ ও মার্কসবাদের যোগসূত্র
৪. গেওর্গ লুকাচ: মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বর অনন্য স্থপতি
৫. রাহুল সাংকৃত্যায়ন: সদাচলমান বিপ্লবী বিদ্বান
৬. এফ আর লীভিস: সাহিত্য ও সমাজের শুচিতারক্ষার প্রহরী
৭. জোসেফ নীডহাম: পূর্ব-পশ্চিম সেতুবন্ধর মহান রূপকার
৮. গোপাল হালদার: সংস্কৃতির রূপান্তর ও রূপান্তরের সংস্কৃতি
৯. শিবরাম চক্রবর্তী: তিন পুরুষের ধারের জের
১০. দামোদর ধর্মানন্দ কোসম্বী: ‘দুই সংস্কৃতি’ তত্ত্বর জীবন্ত প্রতিবাদ
১১. হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়: মার্কসবাদ, ধর্ম ও মুক্তমতি
১২. পল সুইজি: স্রোতের বিরুদ্ধে অবিচল যোদ্ধা
১৩. ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়: মনোরাজ্যের দুঃসাহসিক অভিযাত্রী
১৪. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়: সহজ করে জানা, সহজ করে বলা
সংযোজন
প্যারীচাঁদ মিত্র: বাঙলা ও ইংরিজির সব্যসাচী।
সূচিপত্রতে চোখ বোলালেই বৈচিত্র্যর কথাটা বোঝা যাবে। পনেরোজন আলাদা আলাদা কর্মক্ষেত্রর মানুষ। তবু এঁদের লেখক একসুতোয় বেঁধেছেন এক অন্য ভাবনা থেকে:
“অনেক গরমিল থাকলেও, এক জায়গায় [এঁদের মধ্যে] বড় একটা মিল আছে। সেটি এই: এঁরা কেউই গতানুগতিক পথে চলেননি; নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী পরিস্থিতির প্রয়োজনে নতুন পথ কেটে নিয়েছেন।…
কোনও প্রতিষ্ঠানের সমর্থন না-নিয়ে বিদ্যেবুদ্ধির ওপর ভরসা করে এইভাবে লড়ে যাওয়া সদাসর্বদা প্রত্যাশিত নয়। ছক-কষা জীবন আর চেনা নক্সায় চিন্তা এ দু-এর বাইরে আসা বিরল ঘটনা, আমাদের দেশে তো বটেই, দুনিয়ার সর্বত্রই। মাপ যেমনই হোক, খুব ছোট বা বড় এই বইয়ের মানুষরা নিজের নিজের সাধ্য অনুযায়ী পথিকৃতের কাজ করেছেন— আমার চোখে এই তাঁদের আসল গৌরব।”
বইটির ছাপা ছিমছাম। সাদামাটা কিন্তু চোখ টানার মত প্রচ্ছদ তৈরি করেছেন অনুপ রায়।
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ।। মননের মূর্তি ।। কোরক