দামোদরের পার ঘেঁষে লাল মাটির রাস্তা চলে গেছে। টিলারাস্তা। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, যেন সামান্য উঁচু টিলা। ব্যাপক আকাশ আর তার নীচে এই রাস্তা। নদীর যেমন শাখানদী থাকে, এই রাস্তারও তাই। তার ঠিক নীচেই দুই পাশ দিয়ে সমান্তরাল রাহা চলে গেছে। রাহা মানে পথ। মুক্তিপথ। পথের শেষ গিয়ে নদেই মিলছে। দামোদরে। দামোদর মানে এখানে কান্না নয়। বন্যা লাগেনি এই গাঁয়ে। লোকে বলে প্রভুকৃপা। প্রভুকৃপা হলে পঞ্চত্বপ্রাপ্তির পর হিন্দুমানুষ যেখানে যান, সেই শ্মশান আমাদের গন্তব্য।
শ্মশানে ঢুকিনি। আমাদের দাহদেহের জন্য সূর্যই যথেষ্ট। সহযোগী ঠাট্টা করে বলল, ‘অসুবিধা নেই, পোড়াদেহেরই না হোক দাহ করে দেব এই শ্মশানে।’ মানুষের দেহ থেকে এত কি সহজে প্রাণ বেরিয়ে যায়? যাইহোক, টিলারাস্তা ধরে বর্ষা-রোদের অর্গল ভেঙে আমরা আগুয়ান। জায়গাটার নাম বড়শূল। কত বড় শূল জানা নেই। মহাদেব শিবের নিধনাস্ত্র এই ত্রিশূল। শিব কৃষিঠাকুর। সেই কবেকার কালে এক মহারাজার স্তুতি উসকে গাইতে গিয়ে বাঙালি বলে ফেলেছিল, ‘ধান ভানতে মহীপালের গীত।’ পাল বংশের প্রজাপালক এই মহীপাল। কিন্তু তার আগে?
ঈশ্বর আগে নাকি রাজা? যে কৃষক ‘মহীপালের গীত’ বলেছিলেন, তা তো শুনেই বলা। ধান ভানতে শিবের গীত থেকে শোনা। রক্তজাত কথা মান্যতা পেয়েছিল অনেক আগেই। টিলারাস্তার ধারে ঝিঙেখেত ও ধানজমি এমনভাবে আমাদের নেমতন্ন করেছিল যে, মনে হচ্ছিল, বেলা বাড়লে কেউ যদি ভাঙাচালের ভাত আর ঝিঙে-পোস্ত দিত, স্বর্গ হাতে পেতাম।
স্বর্গ আছে, কিন্তু নাগালের বাহির। এখন আছে মালভূমি। উঁহু, মালভূমি নয়, সমতট… সেখানে কৃষিগন্ধ ঝরে পড়ছে আর তা শুঁকতে শুঁকতে মনে পড়ছে কতকগুলো জায়গা। বড়শূল, শক্তিগড়, কোনারপাড়া, স্বস্তিপল্লি, নতুনপল্লি, শেখপুর, বেলুন, গেঁড়াঘাঁটা, কানাইডাঙা, দেয়ালে, শেখরপুর-সাহাপুর রোড। হাঁপিয়ে উঠিনি এখনও। বরং শেখরপুর-সাহাপুর রোডে উঠেই জৌগ্রাম হয়ে গুড়াপ যাব। সেখান থেকে ভাস্তারা, ঝুমা, মহানাদ, মগড়া, আমোদঘাটা হয়ে কল্যাণীতে ঘাঁটি গড়ব। ভোর হলে বেনাপোলের উদ্দেশে রওনা নেব।
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাব জনপুর, কুলিয়া রোড, গয়েশপুর, চাঁদমারি, পিঁজরাপোল, দোগাছিয়া, কাটা বেলিয়া, মুড়াগাছা, আয়েশপুর, নরপতিপাড়া, যাত্রাপুর, তাঁতগাছি, চুয়াডাঙা, কুসুমগ্রাম, চাকদা-বনগাঁ রোড, আমডাঙা, বালিয়া, কদমতলা, নাটাপুলি, বর্ধনবেড়িয়া, গোপালনগর, বনগাঁ… বেনাপোল… বাংলাদেশ… হ্যাঁ বাংলাদেশ… শর্শা, নাভারণ, ঝিকিরগাছা, যশোর, মাগুরা। মাগুরা জেলা। রাজা সমুদ্রগুপ্ত রাজত্বের জন্য মাগুরা এসেছিলেন। একদা মাগুরার প্রভু ছিলেন তিনি। এর পর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, কুমারগুপ্ত, সুন্ধগুপ্ত… শশাঙ্কও দেখেছিলেন এমন সমতট।
একই মাটি ছিল, একই দেশও… কৃষিগন্ধ, ঢেঁকিছাটা চাল, খাল, বিল, নদ, নদী, বৃক্ষকুটুম সবই ছিল এক। তবে মানুষের বর্ণে শক্তি চাই। সে যখন প্রকৃতির সঙ্গে পেরে ওঠে না, তখন তার শক্তিঠাকুর, থুড়ি শিবঠাকুর চাই। শিবঠাকুরের আপন দেশে সমতটের নানা স্থানে তাঁরই মূর্তি গড়া হল। ধান ভানতে শিবের গীত, ধান রুইতে শিবের গীত, ধান হইতে ভাতেও শিব… ইচ্ছামত ফুলে জলে বিল্বপত্রে তাঁকে পুজো করো… জংলিফুল কুন্দফুল আকন্দ হলেই চলবে, কোনও অধিকারী অনধিকারীর ভেদ সেখানে নেই।
মহাদেব থেকে শিব, শিব থেকে শৈবমত দেশ ছড়াল— দেশ ছাড়ালও। সমতট ডেঙাল, কলিঙ্গ পেরল। সাগর পেরিয়ে বালি, সুমাত্রা, লম্বক দ্বীপ সবেতেই তখন শিবের কথা, শিবের গীত— এমন কীর্তিজড়িত মাটি যেন কবিতা। কীর্তিজড়িত এই মাটিই শিবের গীত, এই কীর্তিজড়িত মাটিতেই ক্ষেতি করতে ইচ্ছা করে, কীর্তিজড়িত ধানবীজের ভাত খাই, এই কীর্তির টিলারাস্তাতেই পাখি দেখতে যেতে ইচ্ছা করে… এতটা পথ পেরিয়ে একদিন আসবই বাংলাদেশ।