Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

আদরের বাংলাদেশ

দামোদরের পার ঘেঁষে লাল মাটির রাস্তা চলে গেছে। টিলারাস্তা। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, যেন সামান্য উঁচু টিলা। ব্যাপক আকাশ আর তার নীচে এই রাস্তা। নদীর যেমন শাখানদী থাকে, এই রাস্তারও তাই। তার ঠিক নীচেই দুই পাশ দিয়ে সমান্তরাল রাহা চলে গেছে। রাহা মানে পথ। মুক্তিপথ। পথের শেষ গিয়ে নদেই মিলছে। দামোদরে। দামোদর মানে এখানে কান্না নয়। বন্যা লাগেনি এই গাঁয়ে। লোকে বলে প্রভুকৃপা। প্রভুকৃপা হলে পঞ্চত্বপ্রাপ্তির পর হিন্দুমানুষ যেখানে যান, সেই শ্মশান আমাদের গন্তব্য।

শ্মশানে ঢুকিনি। আমাদের দাহদেহের জন্য সূর্যই যথেষ্ট। সহযোগী ঠাট্টা করে বলল, ‘অসুবিধা নেই, পোড়াদেহেরই না হোক দাহ করে দেব এই শ্মশানে।’ মানুষের দেহ থেকে এত কি সহজে প্রাণ বেরিয়ে যায়? যাইহোক, টিলারাস্তা ধরে বর্ষা-রোদের অর্গল ভেঙে আমরা আগুয়ান। জায়গাটার নাম বড়শূল। কত বড় শূল জানা নেই। মহাদেব শিবের নিধনাস্ত্র এই ত্রিশূল। শিব কৃষিঠাকুর। সেই কবেকার কালে এক মহারাজার স্তুতি উসকে গাইতে গিয়ে বাঙালি বলে ফেলেছিল, ‘ধান ভানতে মহীপালের গীত।’ পাল বংশের প্রজাপালক এই মহীপাল। কিন্তু তার আগে?

ঈশ্বর আগে নাকি রাজা? যে কৃষক ‘মহীপালের গীত’ বলেছিলেন, তা তো শুনেই বলা। ধান ভানতে শিবের গীত থেকে শোনা। রক্তজাত কথা মান্যতা পেয়েছিল অনেক আগেই। টিলারাস্তার ধারে ঝিঙেখেত ও ধানজমি এমনভাবে আমাদের নেমতন্ন করেছিল যে, মনে হচ্ছিল, বেলা বাড়লে কেউ যদি ভাঙাচালের ভাত আর ঝিঙে-পোস্ত দিত, স্বর্গ হাতে পেতাম।

স্বর্গ আছে, কিন্তু নাগালের বাহির। এখন আছে মালভূমি। উঁহু, মালভূমি নয়, সমতট… সেখানে কৃষিগন্ধ ঝরে পড়ছে আর তা শুঁকতে শুঁকতে মনে পড়ছে কতকগুলো জায়গা। বড়শূল, শক্তিগড়, কোনারপাড়া, স্বস্তিপল্লি, নতুনপল্লি, শেখপুর, বেলুন, গেঁড়াঘাঁটা, কানাইডাঙা, দেয়ালে, শেখরপুর-সাহাপুর রোড। হাঁপিয়ে উঠিনি এখনও। বরং শেখরপুর-সাহাপুর রোডে উঠেই জৌগ্রাম হয়ে গুড়াপ যাব। সেখান থেকে ভাস্তারা, ঝুমা, মহানাদ, মগড়া, আমোদঘাটা হয়ে কল্যাণীতে ঘাঁটি গড়ব। ভোর হলে বেনাপোলের উদ্দেশে রওনা নেব।

ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাব জনপুর, কুলিয়া রোড, গয়েশপুর, চাঁদমারি, পিঁজরাপোল, দোগাছিয়া, কাটা বেলিয়া, মুড়াগাছা, আয়েশপুর, নরপতিপাড়া, যাত্রাপুর, তাঁতগাছি, চুয়াডাঙা, কুসুমগ্রাম, চাকদা-বনগাঁ রোড, আমডাঙা, বালিয়া, কদমতলা, নাটাপুলি, বর্ধনবেড়িয়া, গোপালনগর, বনগাঁ… বেনাপোল… বাংলাদেশ… হ্যাঁ বাংলাদেশ… শর্শা, নাভারণ, ঝিকিরগাছা, যশোর, মাগুরা। মাগুরা জেলা। রাজা সমুদ্রগুপ্ত রাজত্বের জন্য মাগুরা এসেছিলেন। একদা মাগুরার প্রভু ছিলেন তিনি। এর পর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, কুমারগুপ্ত, সুন্ধগুপ্ত… শশাঙ্কও দেখেছিলেন এমন সমতট।

Advertisement

একই মাটি ছিল, একই দেশও… কৃষিগন্ধ, ঢেঁকিছাটা চাল, খাল, বিল, নদ, নদী, বৃক্ষকুটুম সবই ছিল এক। তবে মানুষের বর্ণে শক্তি চাই। সে যখন প্রকৃতির সঙ্গে পেরে ওঠে না, তখন তার শক্তিঠাকুর, থুড়ি শিবঠাকুর চাই। শিবঠাকুরের আপন দেশে সমতটের নানা স্থানে তাঁরই মূর্তি গড়া হল। ধান ভানতে শিবের গীত, ধান রুইতে শিবের গীত, ধান হইতে ভাতেও শিব… ইচ্ছামত ফুলে জলে বিল্বপত্রে তাঁকে পুজো করো… জংলিফুল কুন্দফুল আকন্দ হলেই চলবে, কোনও অধিকারী অনধিকারীর ভেদ সেখানে নেই।

মহাদেব থেকে শিব, শিব থেকে শৈবমত দেশ ছড়াল— দেশ ছাড়ালও। সমতট ডেঙাল, কলিঙ্গ পেরল। সাগর পেরিয়ে বালি, সুমাত্রা, লম্বক দ্বীপ সবেতেই তখন শিবের কথা, শিবের গীত— এমন কীর্তিজড়িত মাটি যেন কবিতা। কীর্তিজড়িত এই মাটিই শিবের গীত, এই কীর্তিজড়িত মাটিতেই ক্ষেতি করতে ইচ্ছা করে, কীর্তিজড়িত ধানবীজের ভাত খাই, এই কীর্তির টিলারাস্তাতেই পাখি দেখতে যেতে ইচ্ছা করে… এতটা পথ পেরিয়ে একদিন আসবই বাংলাদেশ।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen + sixteen =

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আমার স্মৃতিতে ঋত্বিককুমার ঘটক

দুটো‌ জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম তাঁর।‌ এক, তিনি কথা বলার সময় আত্মমগ্ন‌ থাকতেন। কারও দিকে‌ তাকিয়ে‌ কথা বলতেন না। তাকাতেন‌ হয় সুদূরে, আর নয়তো‌ চোখ বুজে‌ কথা বলতেন। আর দ্বিতীয় যা, তা হল‌ ঋত্বিকের চোখ। এত উজ্জ্বল আর‌ মরমী, এক-ই সঙ্গে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত আর লুব্ধক নক্ষত্রের মতো দীপ্ত, তা আর কারও মধ্যে দেখিনি। সত্যজিৎ-মৃণালের মধ্যেও না, যদিও ঘটনাচক্রে ওই দু’জনের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল অনেক বেশি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঋত্বিক ঘটক ও বাংলাদেশ

ঋত্বিক ঘটকের জীবনের প্রথম বাইশ বছর (১৯২৫-১৯৪৭) কেটেছে মূলত পূর্ব-বাংলায়, যা এখনকার বাংলাদেশ। তাঁর জন্ম ঢাকার ২,ঋষিকেশ দাস রোডের ঝুলন বাড়িতে। ১৯৪৭, অর্থাৎ দেশভাগ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি মূলত পূর্ব-বাংলায় কাটান। আমরা দেখব, পূর্ব-বাংলা যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, সে-দেশ, সে-ভূমির প্রভাব তদনুরূপ ঋত্বিকেরও পড়েছিল তাঁর চলচ্চিত্রে।

Read More »
মণিকর্ণিকা রায়

অনুগল্প: অর্জন

অসহায় বৃদ্ধের খাওয়া হয়ে গেলে মাঝেমাঝে গল্পও করত ওঁর সাথে। আদিত্য লক্ষ্য করেছিল এই ব্যাপারটা যেন তার মনে একটা বদল আনছে— যেন রোজ তার শরীর-মন জুড়ে সঞ্চালিত হচ্ছে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি। যেন সে সত্যিই মানুষ হয়ে উঠছে।

Read More »
মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনানন্দ দাশের সময়চেতনা: পুরাণ, প্রকৃতি ও আধুনিক নিঃসঙ্গতার নন্দনতত্ত্ব

পৌরাণিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিগত সময়চেতনা তাঁকে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে এক স্থায়ী ও ব্যতিক্রমী মহাকবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শিল্পকর্ম আমাদের শেখায়— দ্রুত ধাবমান জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে চলতে, নীরবতার গভীরে কান পাততে এবং প্রতিটি ক্ষণিকের মাঝে অনন্তের ইশারাকে খুঁজে পেতে। তাঁর সাহিত্য ভবিষ্যতের প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের জন্য আধুনিকতার এক অমূল্য পাঠ হয়ে থাকবে, যা মানুষের জীবনকে শিল্প ও প্রকৃতির একাত্মতায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং প্রমাণ করে দেয়— কাব্যই চূড়ান্ত আশ্রয়, যখন সমস্ত পথ ফুরিয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে?

Read More »