দুইপাশে ঘন সবুজ গাছপালা। মাঝখানে বয়ে চলেছে অ্যাভন। এই অ্যাভন নদীর তীরেই জন্মেছিলেন মহাকবি উইলিয়াম শেকসপিয়র। আর উইলিয়াম শেকসপিয়র শুধু মহাকবিই নন, তিনি পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার।
১৫৬৪ সালে এই এপ্রিলেই তাঁর জন্ম। ইংল্যান্ডের ওয়ারউইকশায়ারের ছোট্ট শহর স্ট্রাটফোর্ড-আপঅন-অ্যাভনে পৃথিবীর প্রথম আলো দেখেন উইলিয়াম শেকসপিয়র। তাঁর জন্মতারিখটি নির্দিষ্ট করে জানা না গেলেও তাঁকে Baptize বা খ্রিস্টধর্মের সদস্যভুক্তির দিনটি ধরা হয় ২৬ এপ্রিল। সাধারণত জন্মের কয়েক দিনের মধ্যেই এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয়। সেই সূত্রে দিনকয়েক আগেই তাঁর জন্ম হয়েছে বলে ধরে নিতে হয়। আবার ১৬১৬ সালের এপ্রিল মাসের ২৩ তারিখেই তিনি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। মহান মানুষের আবির্ভাব ও তিরোভাব তিথিতে মিল রাখতেই সকলে তাঁর জন্মদিন হিসেবে ২৩ এপ্রিলকেই মেনে নিয়েছেন। মাঝখানের ৫২টি বছর তিনি পৃথিবীতে ছিলেন। পৃথিবীর মানুষের সুখদুঃখের সঙ্গে তিনি নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন। আর এই মাত্র পাঁচ দশকের স্বল্পায়ু জীবনে তিনি পৃথিবীকে দিয়ে গিয়েছেন মোট ৩৭খানি কালজয়ী নাটক, ২খানি কাব্য এবং ১৫৪টি সনেট।
পৃথিবীর ইতিহাসে শেকসপিয়রের মত প্রতিভা খুব বেশি দেখা যায়নি। তাঁর সৃষ্টিও কোনও নির্দিষ্ট কালের বন্ধনে বাঁধা পড়েনি। তা সব কালের সব মানুষের নিজস্ব সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। শেকসপিয়র মানুষের জীবনকে যেমনভাবে নেড়েচেড়ে দেখেছেন, যেমনভাবে মানুষের মন-প্রাণকে বিশ্লেষণ করেছেন, তেমনভাবে পৃথিবীর খুব কমসংখ্যক কবি, লেখক ও নাট্যকারই করেছেন। হয়তো এমনও হতে পারে তাঁর মত করে জীবনকে কেউই উপলব্ধি করেননি। যদিও বা কেউ করে থাকেন তাও তিনি শেকসপিয়রের কাছে গভীরভাবে ঋণী। শেকসপিয়রের কাছ থেকে তিনি উত্তাপ ও আলো ধার করে নিয়েছেন।
আজ স্ট্রাটফোর্ড-আপন-অ্যাভন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্ট্রাটফোর্ডে ছুটে আসেন শেকসপিয়রের এই প্রিয় জন্মভূমি দর্শন করতে। তার আকাশ, বাতাস, মাঠ, বন, প্রান্তর থেকে সুখানুভূতি আহরণ করতে। অ্যাভনের স্রোতধারায় গা ভাসিয়ে দিতে। কবির বাসভূমি আজ পরিণত হয়েছে শেকসপিয়র মিউজিয়ামে। শেকসপিয়র মিউজিয়াম ছাড়াও এই স্ট্রাটফোর্ডেই রয়েছে অ্যান হ্যাথওয়েজ কটেজ। সেই অ্যান হ্যাথওয়ে, যাঁকে কবি তাঁর প্রণয়িনী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। রয়েছে কবির প্রিয় নদী অ্যাভন। তার দু’পাশে সবুজ মাঠ। একটি পার্কে শেকসপিয়রের মর্মর প্রতিমূর্তি। আর তাকে ঘিরে রয়েছে তাঁরই সৃষ্ট নাটকের কয়েকটি চরিত্রের প্রস্তরমূর্তি।
যে এপ্রিল মাসে শেকসপিয়র পৃথিবীতে প্রথম এসেছিলেন সেই এপ্রিল মাসেই আবার তাঁকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। মৃত্যুর পর তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় প্যারিস চার্চের কাছের ওই হিমশীতল মাটিতে। এখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন। তাঁর সমাধিফলকে লেখা এই ক’টি লাইন দর্শকদের চোখকে অশ্রুসজল করে তোলে—
‘GOOD FRIEND FOR JESUS’ SAKE FORBEAR,
TO DIG THE DUST ENCLOSED HERE:
BLEST BE THE MAN THAT SPARES THESE STONES,
AND CURST BE HE THAT MOVES MY BONES.
এই সেই স্ট্রাটফোর্ড-আপন-অ্যাভন। এই মাটিতেই তাঁর পৃথিবীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়। এর আকাশ বাতাস নদীজলের সঙ্গে রয়েছে তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা। এর সবুজ প্রকৃতি তাঁকে দিয়েছে মনের আনন্দ। এর জন-স্রোতধারা তাঁকে দিয়েছে জীবন-রহস্যের নিবিড় অনুভূতি। এই মাটিতেই কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। আবার এর ধূলিধূসর পথে-প্রান্তরে তিনি পা রেখেছেন যৌবনের দোরগোড়ায়।
১৫৮২-র ২৮ নভেম্বর আঠেরো বছর বয়সে অ্যান হ্যাথওয়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। অ্যান ছিলেন শেকসপিয়রের চেয়ে ৭ বছরের বড়। তারপর তাঁদের তিন সন্তানের জন্ম হয়। বড়মেয়ে সুজানার জন্ম ১৫৮৩-তে, তাঁদের বিয়ের ৬ মাসের মাথায় এবং দু’বছর পর ১৫৮৫-তে যমজ সন্তান পুত্র হ্যামনেট এবং ছোটমেয়ে জুডিথের জন্ম। ১৫৯২ সাল। স্ট্যাটফোর্ডের নিবিড় বন্ধনকে শিথিল করে তিনি পা বাড়ালেন লন্ডনের পথে। পিছনে পড়ে রইলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী অ্যান হ্যাথওয়ে, পুত্র হ্যামনেট, দুই কন্যা— সুজানা ও জুডিথ। হ্যামনেটের মৃত্যু হয় মাত্র ১১ বছর বয়সে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, ১৫৮৫ থেকে ১৫৯২ পর্যন্ত শেকসপিয়রের জীবনযাপনের কোনও হদিশ মেলে না। কোনও রেকর্ডও নেই ওই সাত বছরের। এই দীর্ঘ কালপর্বের সবটাই অনুমান-নির্ভর। তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ মনে করেন ওই সময় শেকসপিয়র বিশ্বভ্রমণ করেছেন, কেউ মনে করেন শিক্ষকতা করেছেন, কেউ মনে করেন আইন নিয়ে পড়েছেন, আবার কেউ মনে করেন তিনি একটি অভিনেতৃ সংঘে যোগ দিয়েছিলেন।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগের লন্ডন শহর। এখানেই শেকসপিয়র খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন। এখানেই শেকসপিয়র লাভ করেছিলেন তাঁর জীবনের বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতাকে তিনি সুনিপুণভাবে কাজেও লাগিয়েছিলেন তাঁর রচনাবলিতে। জীবনের বিভিন্ন রহস্যকে তিনি উদঘাটন করেছিলেন। তিনি সব মানুষের মনের কথাকে গভীর মমতায়, অননুকরণীয় ভাষায়, সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন। তাই তো তিনি দেশ ও কালের গণ্ডি ছাড়াতে পেরেছেন। তাই তো তিনি হয়ে উঠেছেন মহাকালের পথের পথিক।
শেকসপিয়র তাঁর সমগ্র জীবনে যে বিপুল সৃষ্টিসম্ভার আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন, তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। তাঁর রচিত নাটকগুলি কমেডি, ট্র্যাজেডি এবং ঐতিহাসিক— তিন ধারায় বিভক্ত করা হয়েছে।
কমেডি রয়েছে ১৬টি: ১. The Tempest, ২. The Two Gentlemen of Verona, ৩. The Merry Wives of Windsor, ৪. Measure for Measure, ৫. The Comedy of Errors, ৬. Much Ado About Nothing, ৭. Love’s Labour’s Lost, ৮. A Midsummer Night’s Dream, ৯. The Merchant of Venice, ১০. As You Like It, ১১. The Taming of the Shrew, ১২. All’s Well That Ends Well, ১৩. Twelfth Night, ১৪. The Winter’s Tale, ১৫. Pericles, Prince of Tyre, ১৬. The Two Noble Kinsmen.
ট্র্যাজেডিগুলি হল: ১. Troilus and Cressida, ২. Coriolanus, ৩. Titus Andronicus, ৪. Romeo and Juliet, ৫. Timon of Athens, ৬. Julius Caesar, ৭. Macbeth, ৮. Hamlet, ৯. King Lear, ১০. Othello, ১১. Antony and Cleopatra, ১২. Cymbeline এবং ঐতিহাসিক নাটকগুলি হল: ১. King John, ২. Richard II, ৩. Henry IV, Part 1, ৪. Henry IV, Part 2, ৫. Henry V, ৬. Henry VI, Part 1, ৭. Henry VI, Part 2, ৮. Henry VI, Part 3, ৯. Richard III, ১০. Henry VIII, ১১. Edward III.
কবিতার জগতেও শেকসপিয়রের ছিল স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তিনি দুখানি কাব্যগ্রন্থও রচনা করেন, ‘Venus and Adonis’ এবং ‘The Rape of Lucrece’। এছাড়াও তিনি ১৫৪টি সনেট রচনা করেন।
সম্ভবত ১৬১০ সালে শেকসপিয়র লন্ডন ছেড়ে ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় জন্মভূমি স্ট্রাটফোর্ড-আপঅন-অ্যাভনে। তারপর ১৬১৬ সালে এখানেই তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় উইলিয়াম শেকসপিয়র—
যেদিন উদিলে তুমি, বিশ্বকবি, দূর সিন্ধুপারে,
ইংলণ্ডে দিকপ্রান্ত পেয়েছিল সেদিন তোমারে
আপন বক্ষের কাছে, ভেবেছিল বুঝি তারি তুমি
কেবল আপন ধন; উজ্জ্বল ললাট তব চুমি
রেখেছিল কিছুকাল অরণ্যশাখার বাহুজালে,
ঢেকেছিল কিছুকাল কুয়াশা-অঞ্চল-অন্তরালে
বনপুষ্প-বিকশিত তৃণঘন শিশির-উজ্জ্বল
পরীদের খেলার প্রাঙ্গণে। দ্বীপের নিকুঞ্জতল
তখনো ওঠে নি জেগে কবিসূর্য-বন্দনাসংগীতে।
তার পরে ধীরে ধীরে অনন্তের নিঃশব্দ ইঙ্গিতে
দিগন্তের কোল ছাড়ি শতাব্দীর প্রহরে প্রহরে
উঠিয়াছ দীপ্তজ্যোতি মাধ্যাহ্নের গগনের ‘পরে;
নিয়েছ আসন তব সকল দিকের কেন্দ্রদেশে
বিশ্বচিত্ত উদ্ভাসিয়া; তাই হেরো যুগান্তর-শেষে
ভারতসমুদ্রতীরে কম্পমান শাখাপুঞ্জে আজি
নারিকেলকুঞ্জবনে জয়ধ্বনি উঠিতেছে বাজি।