প্রতিদিনের এডিটোরিয়াল মিটিং শুরুর আগেই অফিসে পৌঁছে গিয়েছিল সায়ন। এই মিটিংয়ে রিপোর্টারদের কাজ ভাগ করে দেন কাগজের এক্সিকিউটিভ এডিটর বিকাশদা। খুব বেশি দিন আগে সায়ন এই কাগজে সাংবাদিক হিসাবে কাজে যোগ দেয়নি। তবুও আজ পর্যন্ত কোনওদিনই সে এই প্রতিদিনের এডিটোরিয়াল মিটিং বাদ দেয়নি। একারণে কাগজের এক্সিকিউটিভ এডিটর বিকাশদার নজরে কাজের ছেলে হিসাবেই পরিচিতি পেয়েছে। যা তার অনেক সহকর্মী ভাল চোখে নেয়নি।
প্রতিদিনই ঠিক বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ বিকাশদার ঘরেই শুরু হয় এই মিটিং। সায়ন মিটিংয়ে হাজির থাকলেও বিকাশদার থেকে একটু দূরত্ব রেখেই চেয়ারে বসে। বিকাশদার কাজ ভাগ করে দেওয়ার পরেই প্রত্যেক সাংবাদিক নিজের নিজের ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ নিয়ে কাজে বেরিয়ে পড়ে। সন্ধ্যার মধ্যে সেই খবর এনে বিকাশদার সঙ্গে আলোচনা করে নিজেদের কপি লিখতে শুরু করে। খবরের কাগজের এটাই নিয়ম। আজ বিকাশদা যে সায়নকে এই ধরনের অ্যাসাইনমেন্ট দেবেন, সেটা তার নিজের চিন্তার বাইরে ছিল।
হঠাৎ বিকাশদা বললেন, ‘সায়নকে আজ সে ধরনের কোনও বড় অ্যাসাইনমেন্ট দিচ্ছি না। ওর কাজ হবে সত্তর দশকে যেসব নকশাল এখন জেল খেটে বেরিয়ে এসেছেন, তাঁদের কাউকে ধরে একটা এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ নিতে হবে। তবে কাজটা আজকেই করতে হবে, তা নয়! তবে হেঁজিপেঁজি নকশাল হলে কিন্তু চলবে না। সে যুগের আগুনখেকো যেসব নকশাল দীর্ঘদিন বিনা বিচারে জেলবন্দি ছিলেন, পুলিশের অত্যাচার সহ্য করেছেন, এমন প্রকৃত নকশাল খুঁজে বের করতে হবে এবং তাঁর সাথে কথা বলতে হবে। দরকার হলে সায়ন কপি লেখার আগে আমার সঙ্গে একবার আলোচনা করে নিতে পারিস!’
সায়নের বয়স এখন ত্রিশের কোঠায়। যেসময় এই আন্দোলন সারা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বলে সে শুনেছে, সে সময় তো তার জন্মই হয়নি। তাহলে কীভাবে তাঁদের খুঁজে বের করবে সে! এই খবরের কাগজে সে সাধারণত দৈনন্দিন ইনসিডেন্ট নিয়েই কাজ করে। বিকাশদার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেও সবার সামনে বিকাশদাকে এনিয়ে মুখে কিছু বলল না! মিটিং শেষে সবাই যখন ঘর থেকে নিজেদের কাজ বুঝে নিয়ে বেরিয়ে গেল, তখনও সায়নকে চেয়ারে উদ্বিগ্নভাবে বসে থাকতে দেখে বিকাশদাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে সায়ন, কাজটা কি খুব ভারি মনে হচ্ছে?’
‘না মানে, আমার জন্মের আগেই তো এই আন্দোলন শেষ হয়ে গিয়েছিল! আমার কোনও চেনাজানা নকশালও নেই! তাই ভাবছি, কী করব!’
‘গত সপ্তাহে যে তুই রবিবারের পাতায় ডারউইনের বিবর্তন নিয়ে লিখেছিলি, যেটা বড় করে আমরা নিয়েছিও, সেই ডারউইনের সঙ্গে কি তোর কোনও চেনাজানা ছিল? তাহলে! খোঁজ নে, সোর্স লাগা! আমি কিন্তু অনেক ভেবেই তোকে এই কাজটা দিয়েছি। রূপায়ণকে বললে হয়তো দুদিনের মধ্যেই আমার টেবিলে লেখা জমা দিয়ে দিত!’
‘কিন্তু বিকাশদা, আমি তো একেবারে যাকে বলে নিউ জেনারেশনের ছেলে। আমি নকশাল আন্দোলন নিয়ে কী লিখব! আপনিই আমাকে কিছু একটা উপায় বলে দিন না প্লিজ!’ অনুরোধ করে সায়ন।
মুখে মিটিমিটি হাসি এনে বিকাশদা সায়নের কাঁধে একহাত দিয়ে বলেন, ‘এখানে জয়েন করার আগে যে কাগজে তুই কাজ করতি, সেখানে কোন বিট কভার করতি যেন!’
সায়ন আমতা আমতাভাবে জবাব দেয়, ‘পলিটিক্যাল বিট। তাও এই জমানায় বিরোধীদের খবর সংগ্রহ করতাম। মানে, এককথায় বামপন্থী বিট!’
‘তা হলে! সেখানে পুরনো কোনও সোর্সকে কাজে লাগা। নকশাল তো বামপন্থীদের একটা অংশ। তবে আমরা নেহাত বামপন্থী বলতে যা বুঝি, নকশালরা কিন্তু ছিলেন চরমপন্থী। বামপন্থীদের সাথে কোনও যোগাযোগ নকশালদের ছিল না ঠিকই, তবে সেসময় তো বামদলের একাংশ ভেঙেই নকশাল তৈরি হয়েছিল। অনেক বেশি বলে ফেলেছি, আর কিছু এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করবি না! তুই পুরনো সোর্সদের কাছে ভালভাবে খোঁজ নে। আমার মনে হয় তোর কাজ হবে।’
২
সায়নের মাথা ধরে গিয়েছিল। সে কি জানত, আজ এই ধরনের একটা জটিল অ্যাসাইনমেন্ট তার ঘাড়ে চড়াবেন বিকাশদা! পুরনো কাগজের অফিস ছেড়ে এই কাগজে কাজে যোগ দেওয়ার পরে, সেই অফিসের কলিগদের সঙ্গে মাঝেমাঝে যোগাযোগ কেবল হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেই হয়। সে মাথাধরা ছাড়াতে এক কাপ লাল চা খেতে অফিসের ক্যান্টিনে এসে বসল। ক্যান্টিনের দায়িত্ব সামলান অলোকদা। এই প্রবীণ মানুষটাকে খুব ভাল লাগে সায়নের। শান্তশিষ্ট বেশ মিশুকে মানুষ। সায়নকেও বেশ স্নেহ করেন। অলোকদাকে লাল চা দিতে বলে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে সেটা ঘাঁটতে লাগল সায়ন। পুরনো অফিসের যে ক’জনের নম্বর এখানে রয়েছে, তাদের কাছে কোনও হেল্প চাইবে কি না ভাবছে, তাতে খবর লিক্ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে— এসব ভাবছে, সেসময় হাতে গরম চায়ের কাপ নিয়ে হাজির হলেন অলোকদা। সায়নকে এরকম উদাসীন হতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার! বাড়ির সব খবর ভাল তো! তোমাকে তো সব সময় হাসিখুশি দেখি ভাই! কী হয়েছে আমাকে কি বলা যাবে!’
সায়ন কী করবে ভেবে পাচ্ছে না! তার মুখ দিয়ে বেরিয়েই গেল, ‘আর বলবেন না অলোকদা, বিকাশদা এক বিচ্ছিরি কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন! আমার কোনও ধারণাই নেই! এদিকে বলেছেন, এক পুরনো সেযুগের জীবন্ত আগুনখেকো নকশালকে খুঁজে বের করে তাঁর ইন্টারভিউ নিতে! কী করব বুঝতে পারছি না! কীভাবে খুঁজে পাব সেযুগের আসল আগুনখেকোকে!’
সব কথা দাঁড়িয়ে শুনে নিজের জায়গায় ফিরে যেতে যেতে অলোকদা নিজের মনেই যেন বললেন, ‘দ্যাখো কী করবে! তোমাদের বাপু খবরের কাগজের আপিস। এখানে তো এসব উদ্ভট কাজ থাকবেই।’
চা শেষ করে সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে লাগলেও সায়নের মনে পড়ছে না, আগের অফিসে কাজ করার সময় এধরনের কোনও নকশালের কথা সে শুনেছিল কি না! একমনে ভাবতে ভাবতে কখন যে বেলা দুটো পনেরো বেজে গিয়েছে, খেয়ালই করেনি। এরমধ্যে তার সিগারেটের প্যাকেট অনেকটাই হাল্কা হয়ে এসেছে। এভাবে ক্যান্টিনে বসে থাকার কোনও মানে হয় না! বরঞ্চ অফিসঘরে গিয়ে বিকাশদাকে সব খুলে ‘আমার পক্ষে অসম্ভব’ বলে অ্যাসাইনমেন্টটা বদলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাতে অফিস কলিগদের কাছে টিটকারি খেতে হলেও সেটা অনেক ভাল তার নিজের জন্য।
অফিসঘরে নিজের কিউবিক্যালের দিকে রওনা দেওয়ার মুখে দেখল, তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন ক্যান্টিনের অলোকদা। অলোকদার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তিনি সায়নের বর্তমান মানসিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। নিজেই একগাল হেসে বললেন, ‘কী পেলে না তো! সত্তর দশকের আগুনখেকো কোনও আসল জীবন্ত নকশালের খোঁজ! আর পাবেই বা কী করে! সেদিন কি আর আছে! সব বদলে গিয়েছে না! যেসময় এলাকায় শিয়াল ডাকত, ভয়ে সন্ধের পরে মানুষ এলাকা মাড়াত না, সেখানে এখন সব আধুনিক মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং উঠেছে। সেখানকার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের সব পড়াশোনা জানা ছেলে যে তোমরা। অফিসে আসো, কাজটি মেটাও। আর মাসের শেষে পকেটে মোটা অংকের টাকার চেক নিয়ে বাড়ি যাও! কিন্তু বাবা, বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই প্রফেশনে তো তোমাদের চোখ, কান একটু খোলা রাখা দরকার! অন্তত তোমাদের পেপারের মালিক তো সেটাই বলেন। দ্যাখো কী হচ্ছে! একান্ত না হলে আমাকে জানিয়ো। আমি দেখব, এখনও কেউ পুরনো যুগের আগুনখেকো নকশাল বেঁচে রয়েছেন কি না!’
‘আপনার চেনা কেউ আছেন নাকি অলোকদা!’ চোখ ঝকমকিয়ে ওঠে সায়নের।
‘সেটা তো এখন বলব না ভাই! আগে তোমার কেরামতি দেখি!’ হেসে উত্তর দিলেন অলোকদা।
‘প্লিজ অলোকদা, হেঁয়ালি করবেন না! খুব বিপদে পড়েছি! কাজটা করতে না পারলে অফিসে মানইজ্জত থাকবে না! আমাকে এবারের মত বাঁচান অলোকদা!’ আকুতি ঝরে পড়ে সায়নের গলায়।
‘এখন না, আমিও একটু খোঁজ নিয়ে তবেই তোমায় জানাব! বেঁচে তো আছেন অনেকেই, কিন্তু সবাই তো আর নকশাল না! সেসব দিনে তো পুলিশ যাঁকে মনে করত, নকশাল সন্দেহে গ্রেফতার করে জেলে ভরত, নয়তো ময়দানে এনকাউন্টারে মেরে দিত। আমাকেও একটু খোঁজ নিতে হবে। তবে সেই তখন থেকেই তো তোমাকে চিন্তামগ্ন দেখছি, খোঁজ পেলে তোমায় আমি নিশ্চয়ই জানাব। তবে আমার ওপর ভরসা রেখে তুমি নিজের খোঁজখবর করা বন্ধ করে দিয়ো না ভাই!’ বললেন অলোকদা।
সায়ন কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে অফিসের নিউজ রুমে ফিরে দেখল, এরমধ্যেই দু-একজন রিপোর্টার ফিরে এসে নিজের কিউবিক্যালে ঢুকে খবর লেখার কাজ শুরু করে দিয়েছে। সায়ন বিকাশদার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল, সেই ঘরও ফাঁকা। নিজের কিউবিক্যালে ফিরে চেয়ারে বসে কী মনে হতে পুরনো এক নেতাকে ফোন করল সায়ন। বলা তো যায় না! খোঁজ পেলেও পেতে পারে কোনও আসল নকশালের। কিন্তু সেখান থেকেও আশার কোনও কথা শুনতে পেল না সায়ন। ওই নেতা সব শুনে বললেন, ‘আছেন তো একজন এখনও বেঁচে। তিনি আবার ওঁদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা। কিন্তু ভাই, তিনি তো এইমুহূর্তে ছেলের সঙ্গে বিদেশে থাকেন! সেখানেই সেটল্ড। তাঁকে পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। আর এদিক-ওদিক যারা নিজেদেরকে নকশাল বলে জাহির করেন, তাঁদের আমরা আবার মানি না। আর তাছাড়া দলগত বিভেদ আর আমাদের সঙ্গে ওঁদের মতপার্থক্য থাকায় আমরা ওঁদের তেমন কোনও খোঁজ রাখি না।’
৩
রবিবার অফিসের ক্যান্টিন বন্ধ থাকায় অলোকদা সেদিনই সময় দিয়েছিলেন সায়নকে। অফিসেও সায়নকে বিকাশদা এই কাজের জন্য খোঁজখবর করতে দৈনন্দিন হাজিরার বিষয়ে ছাড় দিয়েছেন। সুতরাং অলোকদার হাতিবাগানের পুরনো একান্নবর্তী পরিবারের সেই বাড়িতে সকালেই হাজির হয়েছে সায়ন। গতকাল অলোকদা জানিয়েছেন, তাঁর এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় পুরনো নকশাল। তবে তিনি নাকি হাঁটতে পারেন না। যতটা বয়সের কারণে, তার চেয়ে ঢের বেশি নকশাল হিসাবে পুলিশি অত্যাচারে। আজ সকালে সায়নকে নিয়ে অলোকদার সেই আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার কথা। তিনি আবার থাকেন হুগলি জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেকারণে কলকাতা থেকে দ্বিতীয় হুগলি ব্রিজ পেরিয়ে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে সেখানে যাওয়ার জন্য নিজের বাইকটাকে সঙ্গে নিয়েছে সায়ন। সঙ্গে একটা আলাদা হেলমেট। অলোকদার জন্য।
অলোকদা বিয়ে করেননি। পরিবারের সবার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকলেও খাওয়াদাওয়া করেন এক দাদা-বউদিদের সঙ্গে। সেই বউদির হাতের এক কাপ চা খেয়ে নিয়ে বাইকে স্টার্ট দেয় সায়ন। বাইকের পিছনে বসেছেন অলোকদা।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক বাইক চালিয়ে আসার পরে অলোকদা বলেন, ‘এবার বাঁ দিকের রাস্তায় যেতে হবে।’
বাইক হাইওয়ে থেকে বাঁ দিকের অপেক্ষাকৃত সরু পিচের রাস্তায় নিয়ে এক পাশে দাঁড় করায় সায়ন। বলে, ‘আপনি ঠিক কোথায় নিয়ে যেতে চাইছেন, আমাকে সেখানকার জায়গাটার নাম বলুন! আমি আমার মোবাইল ফোনের জিপিএস অন করে দিচ্ছি। আপনার আর কোনও টেনশন থাকবে না। জিপিএসেই বলে দেবে ডানে না বাঁয়ে ঘুরতে হবে। আসল জায়গাতে পৌঁছে গেলে আপনি ওনার বাড়ি চিনে আমাকে নিয়ে যেতে পারবেন তো! আপনি কতদিন আগে এসেছিলেন সেই জায়গায় শেষ বার?’
‘তা বছর পনেরো তো হবেই!’
‘মেরেছে! এত দিন আগে এসে কী ভরসাতে আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন ওনার সঙ্গে দেখা করাতে!’
‘আমি যখন বলছি, তুমি চলো। তোমার কাজ হবেই। আর ওঁকে নিয়ে তুমি যে সন্দেহ করছ, তেমন কিছু ঘটনা ঘটেনি, সেবিষয়ে আমি নিশ্চিত। কারণ দূর সম্পর্কের আত্মীয় হলেও সে রকম কিছু হলে আমি নিশ্চয়ই জানতাম!’
আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক পিচ রাস্তার ইঙ্গিত দিল সায়নের জিপিএস। সেই পথ আসতে কোনও অসুবিধা হয়নি। তারপর থেকেই রাস্তার হাল বদলে গেছে। পিচের বদলে এখন মাটির রাস্তা। জিপিএসের ইঙ্গিতমত যেতে যেতে হঠাৎ বাইকের পিছন থেকে অলোকদা চিৎকার করে ওঠেন, ‘আরে, রাস্তা তো ভুল হল! এই রাস্তা নয়। আমাদের যেতে হত ডানদিকের রাস্তাতে। বাইক ঘোরাও, বাইক ঘোরাও।’
সায়ন আবার বাইক ঘুরিয়ে কিছুটা গিয়ে দেখল রাস্তা আর নেই! এই জায়গা থেকে শুরু হয়েছে আলুর খেত। তবে সেই আলুর খেতকে রাস্তা হিসাবে ধরলে পৌঁছনো যেতে পারে কয়েকটি গ্রামীণ বাড়িতে। এবার চোখে ঝিলিক দিয়ে উঠল অলোকদার। ‘পৌঁছে গেছি! পৌঁছে গেছি!’ সায়নকে ইঙ্গিত করে ডান হাত তুলে বাড়িগুলির দিকে দেখিয়ে বলেন, ‘ওখানেই তো বেচুদার বাড়ি!’
‘বেচুদা!’ অবাক হয় সায়ন!
‘আরে, তুমি যাঁকে খুঁজতে এখানে আজ এসেছ। কতদিন পরে এই গ্রামে এলাম। রাস্তায় অনেক কিছুর বদল চোখে পড়লেও, বেচুদার বাড়ির আশেপাশের এলাকা কিন্তু একই আছে। সেই যেমন অত বছর আগে দেখে গিয়েছিলাম।’
এই জমির আল দিয়ে বাইক চালিয়ে যাওয়া সায়নের পক্ষে অসম্ভব। তাই বাইকটাকে সেখানেই রেখে দিয়ে অলোকদার সঙ্গে আলু খেতের আল বরাবর হাঁটা দিল সায়ন।
অলোকদা যে বাড়ির সামনে এসে ‘বেচুদা আছ নাকি বাড়িতে, ও বেচুদা। দেখো তো কে এসেছি!’ করতে করতে সায়নকে সঙ্গে নিয়ে সোজা হাজির হলেন বাড়ির উঠোনে, সায়ন দেখল, বাড়ির দেওয়াল কোনওমতে ইটের তৈরি হলেও বাড়িটির ছাদ টিনের তৈরি। আশেপাশের আলুর খেত, গাছগাছালি, কিছু দূরের পুকুর, পাশের অন্য কিছু চাষ হওয়া জমির মধ্যে এই বাড়ি যেন শিল্পীর তুলিতে গ্রাম-বাংলার কোনও চিত্রপট। সেই বাড়ির দাওয়ায় একদিক ভেঙে যাওয়া প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। বয়স আনুমানিক সত্তরের কোটায়। খালি গা। পরনে শুধু একফালি কাপড়। যার রং আগে কখনও সাদা ছিল বলে অনুমান করা যায় মাত্র।
অলোকদা এবার মুখ থেকে মাক্স খুলে দাওয়ার পরে কাছে গেলে চোখদুটো যেন জ্বলে উঠল বৃদ্ধের। তিনি অলোকদাকে চিনতে পেরেছেন। সেটা বুঝতে পেরে একদিক থেকে নিশ্চিন্ত হল সায়ন। অন্তত এতদিনে বৃদ্ধের স্মৃতি হয়তো মুছে যায়নি। বেচু নামের বৃদ্ধের শরীরের প্রায় প্রতিটি হাড় চোখে পড়ছে সায়নের। চেয়ারে বসে থাকলেও বৃদ্ধের দুটো পা হাঁটুর নীচ থেকে যে অসাড়, সেটা সাধারণ চোখে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।
‘এই যে, এ হল সায়ন। আমাদের আপিসের একজন রিপোর্টার। তোমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছে বেচুদা!’
‘আমার সঙ্গে আবার কীসের কথা!’ বেচুদা উত্তর করলেন। এইটুকু কথা বলতেই কাশির দমক উঠে এল। সঙ্গে হাঁপের টান। বুকের চামড়ার আবরণ ভেদ করে যেন বুকের পাঁজরার হাড়গুলো বের হয়ে আসতে চাইছে।
কাশি থামলে বললেন, ‘খুব অল্প বয়স থেকে অভ্যেস। তার ফল এখন ভোগ করছি। আসলে খুব অল্প বয়স থেকে দিনে বান্ডিল তিনেক কড়া হাতে বাঁধা বিড়ি আর সঙ্গে দু’প্যাকেট প্লেন চারমিনার সিগারেটের এসব ফল’, হাঁপাতে হাঁপাতে বলে চললেন, ‘যৌবনে শরীরকে তো আর শরীর মনে করিনি। যত রকম অনিয়ম হয়, সবই ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। ছাড়ো ওসব কথা। তা অলোক, বলো কী বলতে চাইছ তোমরা।’
‘আমি তো কিছু বলব না! আপনার কাছ থেকে আপনাদের নকশাল আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা জানতে এসেছে এই সায়ন। ও সেসব কাগজে লিখবে!’ জবাব দেন অলোকদা।
কথা শুরু করার আগে নিজেকে একটু আপন করে নিতে সায়ন বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার যে এত কাশি হচ্ছে, এই করোনার মধ্যে একটু সাবধানে থাকবেন!’
যেন জ্বলে উঠলেন বেচুদা। বললেন, ‘কীসের করোনা! ওসব করোনা-টরোনা বলে কিছু নেই! এগুলো সব বুর্জোয়া পুঁজিপতিদের বানানো চক্রান্ত।’
নিজেকে সামলে নিয়ে সায়ন এবার প্রশ্ন করে, ‘আপনি তো নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে ছিলেন শুনেছি। তা আপনি কি নিজেকে এখনও একজন নকশাল বলে মনে করেন!’
প্রশ্নটা শুনে একভাবে বেচুদা তাকিয়ে থাকলেন সায়নের দিকে। যেন সায়নের মনে তার সম্পর্কে প্রশ্নগুলো পড়ে নিতে চাইলেন। তারপর প্লাস্টিকের যে চেয়ারে তিনি বসেছিলেন, তার পাশ থেকে দুটো ক্র্যাচ বগলের নীচে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চললেন একটা ঘরের দরজার দিকে। অলোকদা আর সায়নকে ডেকে বললেন, ‘এসো আমার সঙ্গে।’ সায়নরা ঘরের ভিতরে ঢুকতে দেওয়ালের কয়েকটি ছবির দিকে মাথা দিয়ে ইশারা করে দেখালেন। ওরা দেখল, ঘরের দেওয়াল জুড়ে টাঙানো রয়েছে, লেনিন, মার্কস, স্তালিন, কিরভ, মাও সে তুং, চারু মজুমদার সহ কয়েকজনের ছবি।
গলার কফে ঘড়ঘড়ানো গলায় বেচুদা বললেন, ‘এই যে, এই দ্যাখো। কীভাবে এখনও কমরেডরা আমাকে পাহারা দিচ্ছেন!’
সায়ন যত দেখছিল, তত অবাক হয়ে যাচ্ছিল। ছবি দেখিয়ে বৃদ্ধ আবার রওনা দিয়েছেন ঘরের বাইরের বারান্দা বা দাওয়ার দিকে। পিছনে পিছনে সায়ন আর অলোকদা। সায়ন আবার প্রশ্ন করে, ‘আপনাদের আন্দোলন তো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে। আপনি কি মনে করেন, আপনাদের দলের চিন্তাভাবনা গঠননীতি ভুল ছিল বা গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার যে স্লোগান আপনারা তুলেছিলেন, সেটা অবাস্তব ছিল! নয়তো আন্দোলন এভাবে মাঝপথে শেষ হয়ে গেল কেন! বা আপনাদের খতমের যে রাজনীতি, বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস অথবা সরাসরি রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে পার্লামেন্ট শুয়োরের খোঁয়াড় বলে যে স্লোগান দিয়ে তরুণ সমাজকে কাছে টেনেছিলেন, সেটা ভুল ছিল! যার ফলে বেশ কয়েকশো পড়াশোনা জানা তরুণ যুবকের মৃত্যু হয়েছে!’
বৃদ্ধ আবার সেই দৃষ্টিতে সায়নকে পড়ার চেষ্টা করলেন। গলার কফ ঝেড়ে নিয়ে বললেন, ‘তুমি তো সাংবাদিক! সত্যির খোঁজ করাই তো তবে তোমার পেশা। জানো আমি কেন কীভাবে নকশাল হয়েছিলাম। আর এই নকশাল হওয়ার কারণে আমার ওপর দিয়ে কী পরিমাণ ঝড় চলে গিয়েছে!’
সায়ন যেন এবার নিজের লাইন খুঁজে পেয়েছে। সে কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বলে চলল, ‘আপনার সব কথা শোনার জন্যই তো কলকাতা থেকে এত দূরে এসেছি!’
৪
কথা শুরুর আগে বৃদ্ধ একটা বিড়ি ধরালেন। কয়েক টান দিয়ে সেটা ফেলে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন—
‘‘আমার আদি বাড়ি বর্ধমান জেলায়। আমার বাবা ছিলেন ভাগচাষি। ভাগচাষি বোঝো তো! মানে জোতদারের জমিতে ফসল ফলিয়ে অর্ধেক ফসল নিজে নেন। আর জমির মালিক বাকি অর্ধেক ফসল পান। এখন তো শুনি, এই ভাগচাষিদের বর্গাদার বলে। যাইহোক, আমার বাবা সেই বর্ধমানের গ্রামে ভাগচাষি ছিলেন। যে পরিমাণ জমিতে বাবা ফসল চাষ করতেন, তাতে আমাদের খুব ভাল না হলেও চলে যাচ্ছিল। কিন্তু চিরদিন যে কারও সমান যায় না!
একদিন আমি একটা কাজে সদরে গিয়েছিলাম। বাড়িতে ছিলেন বাবা, মা, আর দিদি। আমি সেদিন সদরে যাওয়ার জন্য বাবা একাই জমির ফসল তোলার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎ সেখানে হাজির হয় জোতদারের কয়েকজন লেঠেল। তারা বাবাকে জমির ধান কাটতে বাধা দেয়। বাবা স্বাভাবিক কারণে বলেন, প্রতিবার অর্ধেক ফসল কেটে নিয়ে আমরা নিয়মিত জোতদারের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি। কিন্তু লেঠেল বাহিনী কোনও কথা শুনতে না চেয়ে বাবাকে জমির ফসল কাটতে নিষেধ করলে বাবা সেটা মানতে চাননি। এরমধ্যে জমিতে উপস্থিত হয় জমির মালিক! সেই মালিকের সেখানে অনেক জমি। জোতদারও সেই মালিক। এই লেঠেল বাহিনীও তার পাঠানো। জোতদারকে দেখে বাবা হাতজোড় করে বলে ওঠেন, ‘মালিক, প্রতিবার তো আমি নিজে থেকেই অর্ধেক ফসল আপনার বাড়ির গুদামে দিয়ে আসি। এবার কী অপরাধ করলাম! নিজে কষ্ট করে ধান ফলালাম। এখন ধান কাটার সময় আপনার এই লোকেরা বলছে, জমির ধান কাটতে দেবে না!’
জোতদার তার নিজের হাতের শৌখিন ছড়িটার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুই যে জমির ধান অর্ধেক নিবি, তোর কাছে কাগজ আছে! এই জমির মালিক তুই না আমি! মালিক তুই হলে কাগজ নিয়ে আয়! আমার লোকরা সবাই চলে যাবে! সব ধান তুই নিয়ে যাবি। আর যদি কাগজ না থাকে, যদি জমির মালিক আমি হই, সব ধান আমার। আমার কাগজ দেখতে হলে বাড়িতে চলে আয়!’ এরপরেই সঙ্গে নিয়ে আসা লোকজনকে হুকুম করে জোতদার যে সব ধান কেটে নিয়ে নিজের গুদামে ভরে দিতে। যদি কেউ বাধা দিতে আসে, তবে তাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ারও নির্দেশ দিয়ে জমি ছেড়ে জোতদার চলে যায়।
বাবা জোতদারের এই নীতি মেনে নিতে না পারার কারণে যারা জমির ধান কাটতে শুরু করেছিল, তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে লাঠিয়ালদের লাঠির আঘাতে মাথা ফেটে যায়। রক্ত বের হতে থাকে। সেই অবস্থাতেও বাধা দিতে গেলে লাঠিয়ালরা বাবাকে প্রচণ্ড পেটায়। বাধ্য হয়ে বাবা বাড়িতে আমি ফিরে এসেছি কি না, সেটা খোঁজ নিতে আসে। বাবার পিছনে পিছনে বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করে আসে লাঠিয়ালের দল। বাড়িতে তখন মা আর দিদি। বাবাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে মা-দিদি চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে। লাঠিয়ালদের মধ্যে একজন দিদিকে চেপে ধরলে রক্তাক্ত অবস্থায় বাবা বাধা দিতে গেলে বাবাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। আর একজন লাঠিয়াল বাবাকে টেনেহিঁচড়ে টেনে নিয়ে বারান্দার বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখে। মা তাকে বাধা দিতে এলে মাকেও মাটিতে ফেলে দেওয়া হয় ধাক্কা মেরে।
ততক্ষণে আমি বাড়ির এলাকায় ফিরে চলে এসেছি। বাড়িতে ঢুকেই দেখতে পাই বাবার মাথা দিয়ে রক্ত পড়ছে, আর আমার দিদি এবং মাকে একসঙ্গে দু’জন লাঠিয়াল ধর্ষণ করছে। সেই দৃশ্য দেখে আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। আমি ওদেরই ফেলে রাখা লাঠি কুড়িয়ে তুলে আমার মায়ের শরীরের ওপর যে ছিল, তার মাথায় বাড়ি মারতে থাকি। তার মাথা ফেটে যায়। পরে সে নাকি মারা যায়। আরও পরে শুনেছি, জোতদারের লোকজনরা আমাদের বাড়ি লুঠ করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।”
একটানা এতক্ষণ কথা বলে বৃদ্ধ থামলেন। সপ্রশ্নে তাকালেন সায়নের দিকে। এতক্ষণ সায়ন আর অলোকদা বৃদ্ধের এই পুরানো দিনের গল্প যেন ছবির মত চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলেন। বৃদ্ধ প্রশ্ন করলেন সায়নকে, ‘কৃষক বাবাকে আহত করে খুঁটিতে বেঁধে তার সামনেই মা–মেয়েকে একসঙ্গে ধর্ষণ করা, মানেটা কী! জোতদারেরা এভাবেই গরিব কৃষকদের রক্ত চুষত। জমির ফসলও নিত, আবার বাড়ির মেয়ে-বউয়ের ইজ্জতও নিত।’
সায়ন নিজের প্রসঙ্গে ফিরে আসে। জিজ্ঞাসা করে, ‘কিন্তু এর সঙ্গে আপনার নকশাল হওয়া বা দলীয় নীতিকে সমর্থন করার সম্পর্ক কোথায়?’
বৃদ্ধ চেয়ারে বসেই মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করেন—
“সম্পর্ক এসবের সঙ্গে নেই ঠিকই। তবে জোতদারের বিরুদ্ধে যাওয়ার মানসিকতা সেদিন থেকেই জন্মেছিল। সেটা বিকাশ লাভ করে ওই খুনের অভিযোগে জেলে থাকার সময়। তখন জেলে আমার সেলেই কয়েকজন নকশাল বন্দি ছিলেন। তাঁরা একদিন সব শুনে আমাকে দলের হয়ে কিছু কাজ করে দেওয়ার পরামর্শ দেন। সেই শুরু। আমার সাজার মেয়াদ অল্প হওয়ার জন্যে খুব তাড়াতাড়ি আমি মুক্তি পেয়ে যাই। আসলে পুলিশ সেসময় উঠতি নকশালদের নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, আমার খুনের কেসটার চার্জশিট ঠিকমত জমা দিতে পারেনি। আর জেলবন্দি নকশালরা জানতেন, আমার বুকের মধ্যে জোতদারের বিরুদ্ধে কী আগুন জ্বলছে! সেটাকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন তারা। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমার কাজ ছিল মূলত চিঠি আদানপ্রদান করার।
এই চিঠির মাধ্যমেই দলের সব প্রচারের কাজকর্মের খবর দেওয়া নেওয়া হত। আমি ছিলাম সেই চিঠির ক্যারিয়ার। এভাবেই কোনও একদিন আমার হাতে চলে আসে নকশালদের গীতা হিসাবে পরিচিত রেডবুক। সেটা পড়ে আমি মাওপন্থী দলের প্রতি আকর্ষণ বোধ করি। বুঝতে পারি, কীভাবে সারা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন পাড়ায় পাড়ায়, গ্রাম থেকে গ্রামে, মহল্লা থেকে মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ছে এই আন্দোলন। হাজার হাজার বিভিন্ন পেশার মানুষ কীভাবে দলের সঙ্গে এক হয়ে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন এই আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য। রাষ্ট্র ইতিমধ্যে এই দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্রশক্তির সশস্ত্র হামলা আন্দোলনের কর্মীদের বাধ্য করেছে লুকিয়ে দলের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য। আমার মধ্যে এমনিতেই জোতদারদের বিরুদ্ধ মানসিকতা ছিলই। আমিও চিঠি আদানপ্রদান করতে করতেই কীভাবে যেন জড়িয়ে গেলাম সশস্ত্র হামলার সঙ্গে। আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার বীজ যদি বলো, আমার মধ্যে রোপণ হয়েছিল, যখন প্রথমবার জেলে ছিলাম, তখনই।”
‘একবারেই আপনি অ্যাকশান স্কোয়াড মেম্বার হয়ে গেলেন!’ অবাক হয় সায়ন। সে যেমন কথা শুনছে, তেমনই বুক পকেট থেকে স্বভাবতই অভ্যাসমত নোটবই বের করে সব কথা নোট করে চলেছে।
যেন লজ্জা পেলেন বৃদ্ধ, ‘ধ্যাৎ! সেটা কি সম্ভব নাকি!’
‘তবে?’
‘ঘটনাটি ছিল এরকমের। আমি যখন মোটামুটিভাবে স্থির করে ফেলেছি, যে জেল থেকে বেরিয়েই আমি নকশালদের হয়ে কাজ করব, সেসময় একদিন জেলে এক অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হলাম, যা আমার মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিল। বর্ধমানের জেল থেকে আমি ট্রান্সফার হয়েছিলাম আলিপুর জেলে। সেখানে বেশ অনেকজন নকশাল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। ওঁদের মুখেই শুনতাম, যাঁরা জেলে আসেন, তাঁদের অর্ধেকের বেশি নকশালকে বাইরে ময়দানে রাতের অন্ধকারে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। আর পরের দিন বলা হচ্ছে, পুলিশের লকআপ থেকে পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে অথবা ময়দান এলাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর সময় এনকাউন্টারে মারা গিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই তো পুলিশ জলজ্যান্ত ছেলেগুলোকে ধরে নিয়ে এসে মেরে দিয়ে নিখোঁজ বলে চালিয়ে দিচ্ছে।’
‘এগুলো তো নকশালদের নিয়ে প্রচলিত কিছু কথা। অন্য কিছু বলুন, তবে তো পাঠকরা পেপারে পড়বেন, আর আপনাদের সম্পর্কে এখনও জানার কৌতূহল দেখাবেন!’ সায়ন বলে ওঠে।
“যে ঘটনাটা আমাকে নাড়া দিয়েছিল, সেটা হল এক নকশাল কর্মীর মায়ের কাহিনি। সুদীপ্ত নামের এক নকশালকে পুলিশ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এক গভীর রাতে। সহবন্দিদের মুখে শুনেছি, সুদীপ্তকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল টালিগঞ্জের সেই ইন্দ্রপুরী স্টুডিওর উল্টোদিকের কুখ্যাত রিট্রিট হাউস নামের বাড়িটাতে। সেখানে তাঁর ওপর প্রচণ্ড পুলিশি অত্যাচার চালানো হয়। নকশালদের পুলিশ সেযুগে কী রকম অত্যাচার করত, এখনকার কোনও মানুষ সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না। সেই রিট্রিট হাউসের কয়েকটি ঘর ছিল সলিটরি সেলের মত! সলিটরি সেল বোঝো তো! সলিটরি সেলে বন্দিকে একা রেখে দেওয়া হত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেখানে বন্দি থাকলে যেকোনও মানুষ একাকী হয়ে পড়ে। একমাত্র লোহার ফটক আর ছোট্ট একফালি জানালা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। মাঝে মাঝে দরজা খুলে বন্দি মানে, নকশালদের নিয়ে আসা হয় একটি বিশেষ ঘরে। যে ঘরের দেওয়াল থেকে দরজা জানালা সবই ফেলট্ মোড়ানো ফাঁপা রবারের নল বসিয়ে সাউন্ডপ্রুফ করা। ঘরের ভিতরের আতর্নাদ, গোঙানি, পুলিশের মারের আওয়াজ, জেরাকারী অফিসারের গর্জন— কিছুই বাইরের মানুষ বুঝতে পারেন না। ওই ঘরের ভিতরেই নকশালদের জেরা করা হয়। যাঁকে জেরা করা হচ্ছে, তাঁর মাথার উপরে জ্বলে হাজার ওয়াটের আলো। সেই আলো সরাসরি বন্দির চোখে গিয়ে পড়ে। যে অফিসার বন্দিকে জেরা করেন, তিনি থাকেন আলোর বাইরে, অন্ধকারে। জেরাকারী অফিসার সিগারেটখোর হন বা না হন, তাঁর হাতে জ্বলতে থাকে জ্বলন্ত সিগারেট। সেই সিগারেট আবার কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে দেরি হলেই বন্দি নকশালের শরীরের বিভিন্ন অংশে ছ্যাঁকা দেওয়ার রেওয়াজও ছিল। এই রকম সলিটরি সেলে মাথা আর চোখের উপর কড়া আলো নিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকারীদের অত্যাচার সহ্য করতে পারেননি সুদীপ্ত। টানা কয়েকদিন এই একই রকম অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সে সেখানেই মারা যান।
যেহেতু পুলিশ তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে সরাসরি রিট্রিট হাউসে জেরা করতে নিয়ে গিয়েছিল, সেকারণে লালবাজার বা অন্য কোনও থানার পুলিশ রেকর্ডে সুদীপ্তর গ্রেফতার হওয়ার কোনও প্রমাণ ছিল না। সুদীপ্তের খোঁজ করতে বিভিন্ন থানা, এমনকি কাটাপুকুর মর্গে ঘুরেও যখন কোনও হদিস পাচ্ছিলেন না, তাঁর মা তখন সব জেলগুলোতে ছেলেকে খুঁজতে শুরু করেন।
এভাবেই সুদীপ্তর খোঁজ করতে একদিন তাঁর মা আলিপুর জেলে এসেছিলেন। সেখানে বন্দি নকশালরা জানতেন, পুলিশ রিট্রিট হাউসে মারধর করে সুদীপ্তকে মেরে লাশ গায়েব করে দিয়েছে। তাই সুদীপ্তর মা বিভিন্ন জেলের সুপারদের কাছে আবেদন করতেন, তাঁর ছেলে যদি জেলে বন্দি থাকে, তো তাঁকে সেটা জানানোর জন্য। আমার এখনও মনে আছে, সেই গরমের দুপুরে জেলের হঠাৎ করে জেলের এক সাজাপ্রাপ্ত বন্দি আমাদের সেলে এসে খবর দিলেন, সুদীপ্ত সেনগুপ্তের মা দেখা করতে এসেছেন আমাদেরই সঙ্গে ওই সেলে বন্দি থাকা নকশাল নেতা তপনদার সঙ্গে! আমি তো অতটা ভিতরের খবর জানতাম না। পরে সমস্তটা শুনেছিলাম সহবন্দিদের কাছে। যাইহোক, আমাদের সেলে বন্দি নকশালরা সমস্ত ঘটনা জানলেও সুদীপ্তের মা কিছুই জানতেন না। প্রায় অনেকদিন হতে চলল সুদীপ্ত নিখোঁজ। তাই জেলর সাহেবের অনুমতি নিয়ে এসেছেন সুদীপ্তর বন্ধু, পার্টির সহকর্মী তপনদার সঙ্গে জেলে দেখা করতে— যদি কোনও সন্ধান পাওয়া যায় ছেলের। সেলের ভিতরে থাকা সব নকশালরা একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘তপনদা, এবার মাসিমাকে আসল সত্যিটা জানিয়েই দিন। কতদিন এভাবে তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে সুদীপ্তকে খুঁজে বেড়াবেন!’ তপনদা কিছুতেই সেকথা জেলে দেখা করতে আসা সুদীপ্তর মাকে জানাতে চাইছিলেন না! বারবার বলছিলেন, ‘এ ভীষণ কঠিন কাজ দিচ্ছেন কমরেডরা আমাকে! আমি কীভাবে আসল সত্যিটা একজন মাকে জানাব! আমি পারব না।’
পরে অবশ্য দলের স্বার্থে আসল সত্যিটা জানাতে বাধ্য হলেন তপনদা। তপনদা ফিরে আসার পরে নিজেই সেলের এক কোণে দু’হাঁটুর মধ্যে মাথা গুজে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। পরে কিছুটা স্বাভাবিক হলে জানালেন, সত্যি কথাটা জানার পরে সুদীপ্তর মা নাকি জেলের গেটেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। জেলের পাহারায় থাকা পুলিশরা মহিলাকে ধরাধরি করে তোলার চেষ্টা পর্যন্ত তপনদা দেখতে পেয়েছেন। বাকিটা তিনি দেখতে পাননি। কারণ, দেখা করার সময়ের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তপনদাকে আর সেখানে থাকতে দেয়নি কারারক্ষীরা।
সেসময় জেলবন্দি নকশালদের সঙ্গে বেশিক্ষণ বাইরের লোকদের দেখা করতে দিত না জেলের রক্ষীরা। তাতে নাকি জেলের ভিতরে নানা অশান্তির সৃষ্টি হয়।
সমস্ত ঘটনা জানার পরে ওই মহিলার জন্য আমার প্রচণ্ড দুঃখ হয়েছিল। আমি নিজেও তো শোষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার পরিণামের শাস্তি ভোগ করছিলাম। আমি সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম, যদি আমাদের ওপর নির্বিচারে অত্যাচার চালানো জোতদারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতেই হয়, তবে এই নকশালের পথই আমার একমাত্র পথ। আমি তো বিনা কারণে খুনটা করেছিলাম না! চোখের সামনে মা-দিদিকে ধর্ষিতা হতে দেখে, বাবাকে রক্তাক্ত হতে দেখে দোষীকে নিজেই সাজা দিয়েছিলাম। তার বদলে পুলিশ আমাকেই জেলে ভরল! এমনকি বর্ধমান জেল থেকে আমাকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ট্রান্সফার করে দিল। আমি কি ঠিক বিচার পেয়েছিলাম!”
সায়ন আর অলোকদা একমনে শুনে চলেছেন এই বৃদ্ধ নকশালের সেসময়ের কথাগুলি। একদমে কথাগুলি বলে আবার বিড়ি ধরালেন বৃদ্ধ। আবার কাশি শুরু হল! কাশির দমক কমতে সায়ন প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু বেচুদা, আপনার ইন্সপিরেশনের কথা তো শুনলাম। কিন্তু আপনার জেলে যাওয়া বা সশস্ত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কথা কিছু বলুন না!’
বৃদ্ধ এবার মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অনেকক্ষণ ধরে একটানা কথা বলে চলেছি। একটু চা খাব। তোমরাও নেবে তো এককাপ করে লাল চা?’
চা এল বাড়ির ভিতর থেকে। চিনেমাটির কাপের বদলে মাটির খুরিতে। চা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে সায়ন চিন্তা করতে লাগল, সে যা চেয়েছিল, এখনও পর্যন্ত মনে হচ্ছে ঠিক লোককেই খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু এই বৃদ্ধ যে আগুনখেকো নকশাল, এমন তথ্য এখনও হাতে আসেনি। বৃদ্ধের স্মৃতিচারণায় অনেক কথা উঠে এলেও নকশাল হিসাবে এঁকে প্রমাণ করা বেশ শক্ত। দেখা যাক, এরপরে কী বলেন!
চা শেষ হয়ে গেল। এবার সায়ন জানতে চাইল, ‘নকশালদের মধ্যে গোপনে চিঠি লেনদেন ছাড়া আর কি কিছুই আপনি করেননি!’
জবাবে মুচকি হেসে বৃদ্ধ বললেন, ‘সবুর করো ভাই। আসলে তোমাদের বয়স কম হওয়াতে ধৈর্য্যও অনেক কম। অত সহজে কি সব কথা বলা যায় নাকি! দেখো বাপু, তুমি খবরের কাগজের লোক, কিছু উলটোপালটা লিখে দিয়ো না! এমনিতেই বর্তমান সমাজের মানুষ আমাদেরকে এখনও বাঁকা নজরে দেখে। খারাপ কিছু লেখা পড়লে তাদের সেই খারাপ ধারণা আরও বদ্ধমূল হবে!’
‘সত্যিটা জানতেই তো আপনাকে খুঁজে কথা বলতে এসেছি।’ সায়ন জবাব দেয়।
‘তবে শোনো কীভাবে জড়িয়ে গেলাম নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে।’ বলেই আবার বলতে শুরু করলেন বৃদ্ধ—
‘‘বর্ধমানের সেই খুনের ঘটনায় জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নকশালদের কাজে প্রথম জড়িয়ে পড়েছি। জেলে থাকতেই আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল বাবলু নামের এক নকশালের সঙ্গে। বাবলু তখনও পুলিশের খোঁচরের নজরে পড়েনি। একদিন জেলে তপনদার সঙ্গে দেখা করতে এলে আমার নাম তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার আগে আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, কোথায় আমাকে বাবলুর সঙ্গে দেখা করতে হবে, সে বিষয়ে। যাইহোক, কথামত একদিন বরানগরে এক জায়গায় গিয়ে দেখা করলাম বাবলুর সঙ্গে। একটা কাগজে লেখা চিঠি আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বাবলু সাবধান করে দিল, ‘খুব সাবধানে কাজ করবে কিন্তু চারিদিকে পুলিশের খোঁচর ছড়িয়ে আছে। এই চিঠিটা তোমাকে যাদবপুরের অমিয়কে পৌঁছে দিতে হবে। কখনওই নিজের নাম কোথাও বলবে না!’
কাজটা আমি ভালমতই করে দিয়েছিলাম। এরপরে আরও চিঠি পৌঁছাতে হত বাবলুর দেওয়া ঠিকানাগুলিতে। ততদিনে আমার রেডবুক পড়া হয়ে গিয়েছে। কলকাতায় আমার থাকার ব্যবস্থাও বাবলু করে দিয়েছিল, এক সহযোদ্ধার সঙ্গে। আর জি কলেজের ডাক্তারি পড়তে আসা ছাত্রদের সঙ্গে হোস্টেলে। দিনে কাজ করতাম। একদিন আমার সেই রুমমেট রবির সঙ্গে অনেক রাতে বের হলাম দেওয়াল লেখার কাজ নিয়ে। এখনকার ইলেকশনের মত রং-তুলি দিয়ে নকশা করা সেই দেওয়াল লেখা নয়। দেখলাম, একটা বড় স্টেনসিল কাগজে আগে থেকে ফুটো করে করে তৈরি করে নেওয়া হয়েছে এক টুপি পরা লোকের ছবি। স্টেনসিল কাগজটা দেওয়ালে চেপে ধরা ছিল আমার কাজ। সেই কাগজের ওপরে কাপড় আলতাতে ভিজিয়ে নিয়ে ছোপ দিলেই দেওয়ালে ছবি, লেখা ছাপা হয়ে যেত। দেখলাম। এভাবে মাও সে তুং-এর ছবি দ্রুত আঁকার এবং তাড়াতাড়ি দেওয়াল লেখার পদ্ধতি। লেখা হতে লাগল, ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’, ‘সত্তরের দশক মুক্তির দশক’, বা ‘শ্রেণীশত্রুদের ধ্বংস করুন’-এর মত সব স্লোগান। আমার কাজটা করতে বেশ ভালই লাগছিল। এরমধ্যে একদিন আমাকে আর রবিকে দেওয়ালে ছাপ দেওয়ার সময় পুলিশের একটা দল ধাওয়া করল। আমি এর আগে কখনও এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়িনি। স্বভাবতই ঘাবড়ে গেলাম। রবির সঙ্গে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমরা দেরি করে ফেলেছি। পুলিশের দলটা যেকোনও সময় আমাদেরকে ধরে নেবে। এমন সময় দেখলাম, রবি কী যেন ছুড়ে দিল পুলিশের দলটাকে লক্ষ্য করে! ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে চারদিক। রাত থাকায় রাস্তার ধারের বাড়িগুলোর দরজা, জানালা সব বন্ধ। রবি এবার পাথর ছুড়ে ল্যাম্পপোস্টে লাগানো ডুম বাল্বগুলোকে ভাঙতে লাগল। রবির দেখাদেখি আমিও ওকে সাহায্য করতে পাথর ছুড়তে লাগলাম ল্যাম্পপোস্ট লক্ষ্য করে। সেযাত্রায় পালিয়ে বাঁচলেও আবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার চিন্তা মাথায় ঢুকে গেল।
একদিন আর জি কলেজের হোস্টেলের ঘরে রবি আমাকে জানাল, আজ বিকালে সংগঠনের একটা মিটিং আছে দমদম এলাকাতে। সেখানে দলের অনেক বড়মাপের নেতা-কর্মী হাজির থাকবেন। আমাকে নিয়ে রবি যাবে ওই মিটিংয়ে। কিন্তু আলাদাভাবে যেতে হবে আমাদের। রাস্তায় দেখা হলেও কেউ কাউকে চিনি না, এমন ভাব করতে হবে। রবি আমাকে মিটিংয়ের জায়গার ঠিকানা জানিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘খুব গোপন বৈঠক কিন্তু। রাস্তায় পুলিশ যেমন পাহারায় থাকবে, তেমনই ছড়িয়ে থাকবে পুলিশের নানা বেশের খোঁচরেরা। খুব সাবধান! সেখানে সংগঠনের নেতা রঘুদার আসার কথা আছে। সব ঠিক থাকলে তিনি আসবেনই। তোকেও সেখানে হাজির থাকতে বলেছেন সংগঠনের নেতারা। বৈঠকের পরে পার্টির ক্লাস হবে।’ সেই পার্টির ক্লাসেই ঠিক হয়, আমাকে বোমা বাঁধার কাজ শিখতে হবে পার্টিরই অসিতদার কাছে। আর আমার ওপর আরও একটি দায়িত্ব দেওয়া হল, গোপনে পার্টির পত্রিকা বিলি করার জন্য। সেই বৈঠকেই রঘুদা বলেছিলেন, আমাদের মত নকশালদের এখন একমাত্র কাজ হওয়া উচিত নিজেদেরকে এমন একজন গুন্ডা হিসাবে প্রস্তুত করা, যে গুন্ডা বিল্পবের স্বার্থে গুন্ডামি করতে সবসময় প্রস্তুত।’’
৫
বৃদ্ধ বেচুদা এভাবে বলে চলেছেন আর বিড়ির পর বিড়ি, সিগারেট ফুঁকছেন। সায়ন নিজের নোটবইতে বৃদ্ধা বেচুদার সব কথার নোট নিয়ে চলেছে। বৃদ্ধ বলে চলেছেন তাঁর পুরনো স্মৃতি।
“বোমা বানানোর কাজ বেশ ভালই রপ্ত করেছিলাম। রাতে কলেজ স্ট্রিটে বা অন্য কোথাও গিয়ে কয়েকটি মূর্তির মাথা ভেঙে আসা ছিল আন্দোলনের একটা অংশ। একদিন বিকালের দিকে শোভাবাজারের এক কমরেডের বাড়ির ছাদে বসে বোমা বানানোর কাজে যখন ব্যস্ত, সেসময় হঠাৎ নিচে পাহারায় থাকা আমাদের এক সহকর্মী কল্যাণ এসে খবর দিল, তিন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পুলিশ কনস্টেবলটিকে রাস্তায় দেখেছে। আমাদের কাছে আগে থেকেই খবর ছিল, রাত আটটা পর্যন্ত ওই পুলিশ কনস্টেবলের ডিউটি সেখানে রয়েছে। রাত আটটা মানেই অন্ধকার। অন্ধকার মানেই অ্যাকশন নেওয়ার সময়। সদ্য বানানো বোমাগুলি হাতের কাছেই মজুত ছিল। সেগুলির সদ্ব্যবহার করতে উপস্থিত সকলেরই চোখ চকচক করে উঠল। পুলিশ শ্রেণীশত্রু। শ্রেণীশত্রুদের খতম করাই তখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে পার্টির বিভিন্ন ক্লাসে রঘুদা বলতেন, ‘পুলিশকে আমরা মারব ঠিকই, তবে বোমা-গুলিতে নয়। বিশেষ করে পুলিশ কনস্টেবলদের হত্যা করা উচিত ছুরি জাতীয় কিছু দিয়ে। যাতে সেই মৃত পুলিশের রক্ত কমরেডদের হাতে লাগে। শ্রেণীশত্রুর রক্তে কমরেডরা নিজেদের হাত রাঙাবে।’ কিন্তু সেদিন যেন সবাই সেকথা ভুলে গিয়েছে। বিপ্লব মানে বিপ্লব। একদম রেড অ্যাকশন। রঘুদার কথা আমার একবার মনে এসেছিল, কিন্তু তখন আর সেসব চিন্তা করার সময় নেই। আমাদের এই ইউনিটের যদি কোনও কাজ ভুল মনে হয়, সেটা ঠিক করবে পার্টি। তবে রঘুদার কথাটা আমার মাথায় ছিল।
ডিউটি শেষ করে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে রাস্তার একধার দিয়ে থানার দিকে ফিরছিল ওই কনস্টেবল। ঘামে পোশাকের পিছন দিকটা একদম ভেজা। ঘাড়ের ঘাম বারবার মুছছিল সে। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল। আমরা কয়েকজন অনেকক্ষণ আগেই তার পিছু নিয়েছি। অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে প্রথম হামলাটা চালিয়ে ছিলাম আমিই। পিছন থেকে ঘাড়ে ভোজালির কোপ মেরেছিলাম। কোপটা এতটাই জোরে হয়ে গিয়েছিল যে পুলিশ কনস্টেবলটি মুখ থুবড়ে পড়ল রাস্তায়। তারপর সবাই মিলে একসঙ্গে এলোপাথাড়িভাবে ভোজালির কোপ মারা শুরু করেছিলাম। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল তার পুলিশের উর্দি। সে তখন মাছকে ডাঙায় তুললে যেভাবে খাবি খায়, সেভাবে কাতরাচ্ছিল আর কাতরভাবে ‘জল’ ‘জল’ করে গোঙাচ্ছিল। সেটা ছিল আমার দ্বিতীয় খুন! আমাদের দলের মধ্যেই কে যেন চিৎকার করে বলে উঠেছিল, ‘পুলিশ, পালা।’
এই শব্দটা কানে পৌঁছনোমাত্র অন্যদিকে দৌড় শুরু করেছিলাম। উত্তর কলকাতার শোভাবাজার এলাকার গলিগুলো ভালভাবে চেনা ছিল। সেই গলিগুলি দিয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করা সময় পিছনে শুনতে পাই পুলিশের বুটের খটখট করে দৌড়ে আসার শব্দ। আমার হাতের বোমার ব্যাগটা তখন নেই। ভোজালির কোপ মারার আগে সেটা কল্যাণের হাতে দিয়েছিলাম, এটুকু মনে আছে। কিন্তু কল্যাণ কোথায়! ওকে কি পুলিশ ধরে ফেলেছে! একজন ধরা পড়লেই তো সর্বনাশ! কল্যাণ ধরা না পড়লে এতক্ষণে বোমার আওয়াজ অন্তত শুনতে পেতাম। সেসব চিন্তা করছি, আর বেখেয়ালে কখন যে গলি থেকে বেরিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে চলে এসেছি, সেটা খেয়াল করিনি!
হঠাৎ এক লোমশ হাত গলা এমনভাবে জাপটে ধরল যে, আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম! যত চেষ্টা করছি সেই হাত ছাড়ানোর, গলার ওপর চাপ তত বাড়ছে! যে গলি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলাম, পুলিশটা সেই গলি দিয়েই আমাকে টেনে নিয়ে গেল, যেখানে পুলিশের সেই কালো ভ্যান গাড়িটা দাঁড় করানো ছিল। শুধু দেখলাম, রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় মরে পড়ে রয়েছে সেই পুলিশ কনস্টেবলের মৃত শরীরটা। যাকে আমি ভোজালির কোপ মেরেছিলাম। ভাবলাম, সঙ্গে থাকা ব্যাগের বোমাগুলি চার্জ না করে ভালই করেছে কল্যাণ। অযথা পুলিশের নজরে চলে আসত! আমার সারা বিকাল ধরে বানানো বোমাগুলো ব্যর্থ হল। আমি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলাম। সেই প্রথম নকশাল হিসাবে আমাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করল। শোভাবাজার থেকে লালবাজার পর্যন্ত সারাটা রাস্তা আমাকে পুলিশের ভ্যানের মেঝেতে শুইয়ে রেখে সেই পুলিশ কনস্টেবলটা আমার দিকে এমন আজবভাবে ঘাড় কাত করে তাকিয়েছিল, যেন পৃথিবীতে প্রথম কোনও জীবকে দেখছে।
আমার তখন মনে পড়ছিল, রঘুদার কাছে শোনা কথাগুলো। রঘুদা পার্টির ক্লাসগুলোতে বলতেন, ‘মনে রাখবেন কমরেড, বিপ্লব কোনও নেমন্তন্ন সভা বা স্বরচিত কবিতা পাঠের আসরের সভা নয়। বিপ্লব হল উগ্র বলপ্রয়োগের কাজ। যার মধ্যে দিয়ে এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীকে ধ্বংস করে, উৎখাত করে…’। মাও সে তুং-এর নানা বাণী, রঘুদার শেখানো কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই পুলিশের গাড়ি পৌঁছে গিয়েছিল লালবাজারে।
গাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে আমাকে লালবাজারের ভিতরে নিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম, অন্য একটা পুলিশের ভ্যান থেকে নামানো হচ্ছে কল্যাণকে। তখনই বুঝতে পারলাম, কল্যাণও পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছে। তারপরে কল্যাণকে আমি আর দেখতে পাইনি। পরে যখন কল্যাণকে দেখেছিলাম, সে কল্যাণ অন্য এক কল্যাণ। আমাকে টেনে অফিসারের ঘরে নিয়ে যেতেই ডিউটি অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা আবার কে রে! কাকে ধরে নিয়ে এসেছিস!’
‘স্যার, এটা একটা নকশাল নেতা। পুলিশকে খুন করেছে আজ সন্ধ্যাতেই। শোভাবাজার এলাকায়।’
‘এটা তো বাচ্চা একটা ছেলে! এটা আবার পুলিশকেই খুন করেছে বলছিস! এলেম তো কম নেই ব্যাটার!’
প্রথম রাতটা ভয়ানক খারাপ কেটেছিল আমার। এর আগেও পুলিশ আমাকে খুনের চার্জে অ্যারেস্ট করেছে। কিন্তু তখন নকশাল ছাপ আমার শরীরে লাগেনি। অন্ধকার লকআপে চোরগুন্ডাদের সঙ্গে কাটিয়েও পরের দিন যখন আমাকে কোর্টে চালান করল না, তখন আমার নানা কুচিন্তা মাথায় ঘুরতে শুরু করেছিল। রঘুদার বাণী, রেডবুকে পড়া মাও সে তুং-এর নানা কথা, পার্টির ক্লাসে আমাদের শেখানো নানা ভাষণের কথা ভেবে মনে জোর আনার চেষ্টা চালাতে থাকলাম।
আরও একদিন লালবাজারের লকআপে আমাকে রেখে বেশ গভীর রাতে আমাকে এক সেপাই ডেকে নিয়ে গেল এক পুলিশ অফিসারের ঘরে। পরে জেনেছিলাম, ওই অফিসারকে ওরা নিয়োগী স্যার বলে, যে কলকাতার অ্যান্টি নকশাল স্কোয়াডের হেড।
অফিসারের ঘরে ঢুকেই দেখলাম, বিশাল এক কাঠের টেবিলের অন্য পাশে বসে আছে, তার টাইটেল নিয়োগী। তার সামনে বিভিন্ন কমবয়সী ছেলেদের ছবি লাগানো একটি ফাইল খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আমাকে দেখে মুখে চুকচুক শব্দ তুলে অফিসার বলল, ‘দেখলি তো কত সহজেই তোকে আমরা ধরে ফেললাম। যা বাবা, এবার তোর সঙ্গে কারা ছিল, তাদের নামগুলো বলে দে। তোকে আমরা ছেড়ে দেব।’
দুদিন লালবাজারের লকআপে কিছু খেতে দেয়নি আমাকে। আমার ঘুমও হয়নি। তাই মাথা কিছু কাজ করছিল না। তবে কমরেড রঘুদার শেখানো বুলি মনে ছিল, পুলিশের হাতে কখনও ধরা পড়লে পুলিশ প্রথমে নানা ছলাকলা করবে, দলের সবার নাম জানতে চাইবে, ভাল ব্যবহার করে নাম জেনে নিয়ে ময়দানে গিয়ে ‘যা তোকে ছেড়ে দিলাম’ বলে গাড়ি থেকে নামিয়ে পালানোর সুযোগ করে দেবে। তুমি যেই দৌড়নো শুরু করবে, পিছন থেকে গুলি করে তোমাকে মেরে দেবে! সুতরাং কমরেড, কোনওভাবেই রাষ্ট্রীয় পেশিশক্তিকে বিশ্বাস করে নিজের পার্টির সহযোদ্ধাদের নাম বলবেন না!’
এসব ভাবতে ভাবতে নিয়োগী বলে উঠল, ‘কী রে! তুই নাকি নকশাল! এরমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লি কেন!’
এবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেপাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আরে এ তো বাচ্চা ছেলে! সবার নাম বলে দেবে এক্ষুনি! তরফদার খাতা-পেন রেডি করে নাও আর ও যে নামগুলো বলছে, তাদের কোথায় কখন পাওয়া যাবে লিখে নিয়ে ওকে ছেড়ে দিয়ো।’
তরফদার নামের সেপাইটি হাসতে হাসতে বলল, ‘না স্যার, এ ঘুমিয়ে পড়েনি। ভনিতা মারছে। এরা খুব সাংঘাতিক হয়েছে স্যার! এর সঙ্গে আরও একজন ধরা পড়েছে। সে রিট্রিট হাউসে আছে। সেটার কাছ থেকে এক ব্যাগ বোমা পাওয়া গিয়েছে। পেটো নয় স্যার! একেবারে আসল বোমা!’
‘সে কী রে! আসল বোমা! তুই বোমা বানাতে পারিস! নাকি তোদের দাদারা দিয়েছিল! ফালতু ফালতু পুলিশ কনস্টেবলটাকে মারতে গেলি কেন রে! যা জানিস বলে দে। তোর ভালর জন্যেই বলছি।’
‘স্যার, ভোজালির কোপ দিয়ে মারা হয়েছে পুলিশ কনস্টেবলকে!’ তরফদার ফুট কাটে।
‘হ্যাঁ তো, তা ভোজালি চালিয়েছিল কে, তুই, না কি তোর সঙ্গে থাকা বাকিদের কেউ! যা জানিস বলে দে না বাবা! তোকে তো ছেড়ে দেবই! শুধু ভোজলিটা কোথায় ফেলেছিস, সেটা বের করে দে!’
আমি কিন্তু একটা কথাও মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিনি!”
থামলেন বেচুদা। এদিকে বেলা বেড়ে চলেছে। দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। সায়ন একবার মোবাইল থেকে সময় দেখে নিয়েছে। আজ অলোকদার আত্মীয় এই বেচুদা মানে এই নকশাল বৃদ্ধ বেশ কথা বলার মুডে রয়েছেন। এখন যদি এঁকে একবার ছেড়ে দেওয়া হয়, পরে আর এভাবে মুখ খুলবেন কি না সন্দেহ! হয়তো অনেক ঘটনাই তখন বেমালুম চেপে যাবেন! কী করবে বুঝতে পারছে না সায়ন! সে উদ্বিগ্নভাবে তাকাল অলোকদার দিকে। অলোকদাও তার ইশারা বুঝতে পেরেছেন! কিন্তু ইন্টারভিউ নেওয়া এই মুহূর্তে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে যে অলোকদা নন, সেটা সায়নকে বোঝাতে নিজেই বেচুদাকে প্রশ্ন করলেন সাংবাদিকের ঢংয়ে।
‘তাহলে বেচুদা, তোমাকে তখন কোনও টর্চার করেনি পুলিশ, বলো!’ বলে কথা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় দেন অলোকদা।
‘টর্চার আবার করেনি! সেটা হয় নাকি! একজন নকশালকে পুলিশ খুনের অভিযোগে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করল, লালবাজারে নিয়ে গিয়ে ভাল কথা শুনিয়ে ছেড়ে দিয়েছে, এমন কথা শুনেছ কখনও!’ বৃদ্ধ যেন রেগে ওঠেন।
সায়ন এবার বলে ওঠে, ‘সত্যি, পুলিশ প্রথমে আপনার সঙ্গে এতক্ষণ ধরে ভাল ব্যবহার করে গেল, কিন্তু কেন?’
‘আমাদের তো শেখানোই ছিল পুলিশের নীতিগুলো! প্রথমে ভাল ব্যবহার করত শুধু সব জেনে নেওয়ার কারণে। শোনো না, তারপরে লালবাজারে নিয়োগী কী করল!’
বৃদ্ধ যেন অনেকদিন পরে নিজের মনের কথা বলার উৎসাহী লোক পেয়েছেন এমনভাবে ফের বিড়ি ধরিয়ে সেটা শেষ করে বলতে শুরু করলেন—
“আমাকে নানা প্রশ্ন করার ফাঁকেই একটা ফোন আসল নিয়োগীর কাছে। সব শুনে নিয়োগী আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপরে আমার হাত ধরে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘চল তো তোকে একটু বাইরে ঘুরিয়ে আনি!’ তরফদার নামের পুলিশটিকে আমাকে দিয়ে বলল, ‘আমাকে ফলো কর।’
তরফদার আমার হাত ধরে রয়েছে। আমাকে ফের পুলিশের একটি ভ্যানে তুলে রওনা দিল কোনও অজানা জায়গার উদ্দেশে। আমাকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হল, সেটা একরকম মফস্বল এলাকার মত। রাস্তার ধারে একটা দোতলা বাড়ির একটি ঘরে তরফদার আমাকে ধরে বসে থাকল। নিয়োগী তখনও সেই ঘরে আসেনি। আমি চুপচাপ বসেছিলাম। তরফদার আমাকে বলল, ‘কেন ভাই ঝামেলা বাড়াচ্ছ! নিয়োগী স্যার খুব ভালমানুষ। চটপট যা জানো সব বলে দিলে তো ছাড়াই পেয়ে যাবে। আমাদেরও ঝামেলা কমে। এই এখন রিট্রিট হাউসে আসতে কার আর ভাল লাগে!’
ঠিক তখনই ঘরে ঢুকল নিয়োগী। আমাকে দেখে বলল, ‘চল তো, ওই ঘরে। ওর নামটা বলে দে তো অফিসারকে।’ বলে আমাকে প্রায় একরকম ঘাড় ধরেই একটা ঘরে নিয়ে ঢোকাল আর আমার চোখে পড়ল, ঘরের মধ্যে ছাদ থেকে দড়িতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কাউকে ঝোলানো হয়েছে। যাকে ঝোলানো হয়েছে, তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার প্রচণ্ড তেষ্টা পেল! দড়িতে ঝুলছে কল্যাণ। আমি তরফদারের কাছে একটু খাবার জল চাইলাম। নিয়োগীর নির্দেশে আমাকে এক গ্লাস জল এনে দিল একজন সেপাই। নিয়োগী আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এবার এর নামটা বলে দে তো! তোর বন্ধু তো এটা! দেখেছিস, আমরা কত ভাল! তোকে কিছুই করিনি। আর তোর বন্ধুর তো আদরের চোটেই ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে।’
আমি এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, পুলিশের মারে রিট্রিট হাউসে কল্যাণ মারা গিয়েছে। ওকে তবে এখানে আলাদা রেখেছিল পুলিশ। তাই লালবাজারে আমার সঙ্গে একবারের বেশি ওর দেখা হয়নি।
প্রাণেই যখন পুলিশ কল্যাণকে মেরে ফেলেছে, তাই ওর নাম বলতে দ্বিধা করলাম না। তবে ঠিকানা জানি না বলে দিলাম। সত্যিই আমি কল্যাণের বাড়ির সম্পূর্ণ ঠিকানা জানতাম না। কল্যাণের জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেল। হাজার হোক, একসঙ্গে অ্যাকশনটা করেছিলাম তো! কিন্তু উপায় কী! রাষ্ট্রীয় পেশিশক্তির কাছে আমাদের কত কমরেড যে রোজ এভাবে প্রাণ দিচ্ছেন, তার হিসাব নেই, সেই খবর জানতাম আগেই, প্রথমবার জেলে থাকার সময়ই।
কল্যাণের নাম শোনার পরে আবার নিয়োগী আমাকে নিয়ে লালবাজারে ফেরত এল। আবার সেই ঘরে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘এবার সত্যি কথাটা বল তো চাঁদু। ওদিকে তোর বন্ধু নাকি কমরেড, কী যেন বলে সব ডাকিস নিজেদের, সে তো সব কথা উগলিয়ে দিয়েছে পুলিশের আদরের চোটে।’
আমাকে পার্টির ক্লাসেই শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এগুলো সব পুলিশের এক-একটা চাল। নানাভাবে নিজের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করবে, তারপরে হয় জেলে ফেলে রাখবে নয়তো ময়দানে নিয়ে গিয়ে পিছন থেকে গুলি করে দেবে। আমিও সহজে মনোবল ভাঙলাম না! পুলিশ যতভাবেই টর্চার করুক না কেন, সংগঠনের গোপন কথা কিছুতেই আমার মুখ থেকে পুলিশ কেন, নিয়োগীও বের করতে পারেনি।
‘কী রে বলবি কিছু, না অন্য ব্যবস্থা নেব!’ সরাসরি হুমকিই দিল নিয়োগী। তারপর কী ভেবে বলল, ‘তুই তো অনেকক্ষণ কিছু খাসনি। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই! এখানে তো আর ভাত-মাংস পাওয়া যায় না! আপাতত চা চলুক এক রাউন্ড! তুই কী পছন্দ করবি, চা না কফি?’
আমি মুখে কিছু না বললেও তরফদারই বলে উঠল, ‘ওর জন্যে একটু গরম চা বলছি স্যার! চা খেয়ে যদি মাথাটা একটু খোলে!’
নিয়োগী বলল, ‘আগে চা খেয়ে নে! তারপরে ভালছেলের মত সব বলে দিস বাবা। আমার মনটা না আবার খুব নরম। ওই যেখানে তোর কমরেড বন্ধু ছিল, সেখানকার অফিসারদের মত না। আমি মারধর ওভাবে অমানুষের মত করতে পারি না!’
আমি চুপচাপই বসে সব শুনছিলাম। প্রায় দুদিন পেটে কিছুই পড়েনি। তাই একটু গরম চা হলে যে একটু ভাল লাগবে, সেটা বুঝতে পেরে ভাল লাগছিল। হঠাৎ দেখলাম একজন সেপাই তিনটি বড় লাঠির একদিক একসঙ্গে বেঁধে ঘরে নিয়ে ঢুকে বাঁধা দিকটা উপরের দিকে দিয়ে লাঠি তিনটার পায়ের দিকগুলো ত্রিভুজের মত ছড়িয়ে দিল। ফলে যা দাঁড়াল, অনেকটা স্ট্যান্ডের মত হয়ে লাঠি তিনটা দাঁড়িয়ে থাকল। এবার অন্য এক সেপাই একটা গামলা দুদিকে কাপড় দিয়ে ধরে নিয়ে এসে ওই স্ট্যান্ডের তিনটি লাঠির মধ্যে ঝুলিয়ে দিল। গামলাতে যে গরমজল জাতীয় কিছু রয়েছে, সেটা গামলার ভিতর থেকে ধোঁয়া ওঠা দেখেই বুঝতে পারছিলাম।
‘কী রে চা খাবি না! একটু অপেক্ষা কর। তরফদার এলেই তোর চা বানানো হবে।’
আমি অবাক হয়ে নিয়োগীর কীর্তিকলাপ দেখছিলাম! সেপাইরা ঘরের ভিতরেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এবার হাতে একটা মোটা দড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকল তরফদার নামের লোকটা। দুজন সেপাই আমাকে মেঝেতেই ধরে নিয়ে হাতদুটো পিছনে আর হাঁটুদুটো ভাঁজ করে বাঁধল। বাঁধা শেষ হলে আমাকে টেনে নিয়ে ওই গরমজলের গামলার নীচে বসিয়ে দিল।
আবার মুখ খুলল নিয়োগী। ‘কি কিছু বলবি! তোরা তো নকশাল নেতা রঘুর লোক, সেটা তোর কমরেড বন্ধু মরার আগে কবুল করে গিয়েছে। রঘু এখন কোথায় আছে সেটা অন্তত বল।’ মুখ খুলছিলাম না দেখে নিয়োগী তরফদারকে ইশারায় কী যেন বলতেই সে গামলার নিচের একটা কী যেন খুলে নিল। আর যেই খোলা, অমনি আমার মাথার তালুতে ফোঁটা ফোঁটা গরমজল পড়তে শুরু করল। যন্ত্রণায় আমার তখন সাংঘাতিক অবস্থা! আমার অবস্থা দেখে নিয়োগী হেসে বলল, ‘তুই তো গরম চা খেতে চাইলি। তাই গরম চা দিলাম। কফি খেতে চাইলে অবশ্য তারজন্য অন্য ব্যবস্থা রয়েছে।’
আমি এবার বুঝতে পারছিলাম, কেন নিয়োগীকে নকশাল দমন শাখার হেড করা হয়েছে। কীভাবে নকশালদের উপরে ঠান্ডা মাথায় অত্যাচার চালানো যায়, সেটা এই লোকটার চেয়ে বেশি কে জানবে! তবুও আমার মুখ খুলছিল না। আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম। এরপরে আর আমার কোনও জ্ঞান ছিল না।”
‘সে কী! চায়ের নামে মাথার তালুতে গরমজলের ড্রপ!’ সায়ন বৃদ্ধের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল!
‘তবে আর বলছি কী! এটা তো কিছুই না! প্রচণ্ড অত্যাচার করেছে নিয়োগী আমার ওপর। আজ যে আমার দু’পা খোঁড়া দেখছ, সেটাও তো নিয়োগীর দান!’
‘কী রকম!’ প্রশ্ন করলেন অলোকদা। অলোকদাও সব শুনে অবাক হয়ে গিয়েছেন।
বৃদ্ধ আবার একটা বিড়ি ধরিয়ে কয়েক টান দিয়ে কাশতে শুরু করলেন। কাশিটা একটু থামলে বললেন, ‘ওই ঘটনার পরের দিন আমার যখন জ্ঞান ফেরে তখন নিজেকে আবিষ্কার করি একটা অন্ধকার ঘরের ভিতরে। মাথাটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে! একটু ধাতস্থ হতে না হতেই সেই অন্ধকার ঘরে এসে ঢুকল তরফদার নামের পুলিশটি। সে আমাকে বোঝাতে লাগল, আমি কেন মুখ খুলছি না! শুধু শুধু পুলিশের টর্চার সহ্য করছি! আমি যদি রঘুদা কোথায় আছে সেটা বলে দিই, তবেই আমার ওপরে অত্যাচার হবে না, ইত্যাদি নানা রকমের মনভোলানো কথা। আমি যদিও জানতাম রঘুদা তখন কোথায় আছেন, তবুও মুখ খুলিনি।’
‘কোথায় ছিলেন আপনাদের নেতা রঘুদা?’ প্রশ্ন করল সায়ন। তাঁর মধ্যে সাংবাদিক সত্ত্বা আবার জেগে উঠেছে।
“রঘুদা তখন কোলাঘাট রেঞ্জে কাজ করছিলেন। বেশিদিন অবশ্য আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতে পারেননি। পুলিশ পাগলা কুকুরের মত হয়ে গিয়েছিল রঘুদাকে খুঁজে বের করতে। দলের মধ্যেই বিভাজন তৈরি করে দিয়েছিল পুলিশ। সেকারণে অন্য এক ইউনিটের কমরেডরা খবর লিক করে ফেলেছিলেন পুলিশের অত্যাচারে। ফলে রঘুদা পুলিশের জাল টপকাতে পারেননি।
তার আগে আমার মুখ খোলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল নিয়োগী প্রতিদিন একবার, দু’বার করে এসে। কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা করে বসেছিলাম, কোনও কমরেডের নাম, ঠিকানা বা সম্ভাব্য লুকিয়ে থাকার কোনও খবর আমি পুলিশকে দেব না।
একদিন তো আমাকে ওই অন্ধকার ঘর থেকে ডেকে বাইরে নিয়ে গেল তরফদার। লালবাজারের ভিতরেই একটা খোলা মাঠের মত জায়গা। সেখানে একটা লম্বা বাঁশ মাটিতে পোঁতা রয়েছে। পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে নিয়োগী। আমাকে দেখেই তরফদারকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওকে কিছু খেতে দিয়েছ!’ এর আগে খেতে দেওয়ার নামে যে অত্যাচার আমার উপরে চালানো হয়েছিল, সেটা আমি জানতাম বলেই বললাম যে আমার খিদে-তৃষ্ণা কিছুই নেই। শুনেই রেগে গেল নিয়োগী। তার নির্দেশেই আমাকে দড়ি দিয়ে বাঁশের সঙ্গে উলটো করে বেঁধে দিল দুজন সেপাই। মানে যাকে বলে হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ আর কী! তারপর শুরু হল ধোলাই। দুজন সেপাইয়ের হাতে দুটি লম্বা তেল চকচকে লাঠি। সেদুটো দিয়ে আমাকে প্রচণ্ড মেরে চলেছে ওরা। মাঝেমাঝে নিয়োগী প্রশ্ন করছে, ‘মনে পড়ছে, রঘু কোথায় রয়েছে!’, ‘বোমাগুলো কে সাপ্লাই করত!’, ‘কেন পুলিশকে খুন করেছিলি!’ ইত্যাদি। মারের চোটে আমি যতক্ষণ না অজ্ঞান হতাম, এটা ছিল রোজকার ঘটনা। একদিন তো আমাকে এমন কচুয়া ধোলাই দিল, যে তারপর থেকে দু’পায়ের শক্তি যেন উবে গেল! পরে জেলে বিনা বিচারে বন্দি থাকার কারণে আমার পায়ের ঠিকমত চিকিৎসা হয়নি। যার ফল তোমরা আজও আমাকে দেখেই বুঝতে পারছ!
কিন্তু আমি সংগঠনের সঙ্গে কোনও বেইমানি করিনি। প্রায় টানা পনেরো দিন লালবাজারে নিয়োগীর ধোলাই খেয়ে গেলাম প্রেসিডেন্সি সেন্ট্রাল জেলের ১৩ নম্বর সেলের নকশাল বন্দি হিসাবে। সেখানেও আরও নানা কীর্তি। আমার পাদুটোই নষ্ট করে দিল ওই নিয়োগী।
লালবাজারে পুলিশে থার্ড ডিগ্রি খেয়েও প্রেসিডেন্সি জেলে গিয়ে বিনা চিকিৎসায় পাদুটোর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছিল তখন নকশাল নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছে পুলিশ। একের পর এক নকশালকে ধরছে আর হয় গুলি করে মেরে দিচ্ছে, নতুবা জেলে ভরছে। ছারখার করে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে আমাদের আন্দোলনকে বন্ধ করার। এদিকে জেলে বসেই শুনতে পেলাম আমাদের সংগঠনের আসল নেতা কমরেড চারু মজুমদারকে পুলিশ নিজেদের হেফাজতে খুন করেছে। আমাদের মত জেলবন্দি নকশালদের বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছে জেলের ভিতরে। অনেক নকশাল কমরেডের মনোবল ভেঙে আসছিল চারু মজুমদারের মৃত্যুর পরে। এদিকে যাঁরা বাইরে তখনও সংগঠনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, সেইসব নকশালরা ঘোষণা করলেন, ‘নোপ বেইল, ব্রেক জেল’ নীতি। আমাদের প্রেসিডেন্সি জেলেও সেই নীতির কথা পৌঁছেছিল, সেই থেকে আমাদের ওপরে জেলের ভিতরে অত্যাচার কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল জেলের অন্য বন্দি থেকে শুরু করে জেলরক্ষীরা। আমার দুপায়ের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়ে আসছিল। আমি নিজে থেকে হাঁটতে পারতাম না। ক্রমেই আমার পাদুটোর কারণে জেলের সেলের ভিতরে ঘসটিয়ে ঘসটিয়ে কোনওরকমে চলাফেরা করতাম। তাই দল থেকে ‘ব্রেক জেইল’ কর্মসূচি নিলেও সেটা আমার ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর হবে, তা বুঝতে পারছিলাম না। আমি প্রায় সারাদিন সেলের ভিতরেই কাটাতাম।
যাইহোক, একদিন, সালটা সম্ভবত একাত্তর সালের এক গরমকালের বিকালে দিকে কয়েদি গুনতির সময় কর্তৃপক্ষ জানতে পারে, নকশালরা জেল ভাঙার চেষ্টা চালাচ্ছে। নকশাল কমরেডরা একসঙ্গে হঠাৎ করে জেলের মূল ফটকের সামনে গিয়ে জেলরক্ষীদের মারধর করা শুরু করলেন। কেউ কেউ ফটকের চাবি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে যেতেই হুলুস্থূল কাণ্ড বেঁধে গেল। বাধ্য হয়ে নকশালরা যেসব সেলে থাকতেন সেখানে জেলবন্দিরা ঢুকে গিয়ে যে ক’জন নকশাল বন্দি আটক ছিলেন, তাদের বেধড়ক মারধর করতে শুরু করে দিল। কোনও দোষ না করেও কেবলমাত্র নকশাল বন্দি হওয়ার কারণে সেই মারের হাত থেকে ছাড় পেলাম না আমিও। জেলরক্ষীদের সঙ্গে নকশালদের শায়েস্তা করতে জুটেছিল প্রেসিডেন্সি জেলের অন্য দীর্ঘমেয়াদি সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরাও। আমাকে এমন মার মারল যে, আমার পাদুটির অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ জেলে বাজিয়ে দেওয়া হল ‘পাগলাঘণ্টি’। তারমধ্যে কানে এল গুলির আওয়াজও।
পরে শুনেছিলাম, নকশালরা পঁয়তাল্লিশ জন কমরেডকে নির্বিঘ্নে জেল থেকে মুক্তি দিতে পেরেছেন। কিন্তু নকশাল বন্দিদের লক্ষ্য করে জেলরক্ষীরা গুলি চালানো শুরু করায়, পনেরোজন কমরেড জেলরক্ষী আর সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের হাতে ধরা পড়ে গেছেন।
এরপরেই শুরু হল সেই পনেরোজন কমরেডের ওপর অত্যাচার চালানো। এমনকি, নিজের সেল থেকে শরীরের নীচের অংশ কোনও রকমে ঘসটিয়ে গারদের কাছে নিয়ে এসে বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, সেই ভয়ংকর দৃশ্য। এক লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে পনেরো জন কমরেডকে। তাদের সামনে হাতে বেয়োনেট লাগানো রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাঁচজন জেলরক্ষী। এরপরেই তাদের রাইফেলগুলি গর্জে উঠল আর একজনের পর একজন কমরেড মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিলেন। জেল ভাঙার অপরাধে এবং পঁয়তাল্লিশ জন নকশাল বন্দিকে জেল থেকে পালাতে সুযোগ করে দেওয়ার কারণে বিনা বিচারে জেল কতৃর্পক্ষ পনেরো জনকে গুলি করে খুন করল। যাদের কোনও বিচার হয়নি বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। ঘটনার পরে আমাদের সেলে বন্দিদের মধ্যে নেমে এল এক অদ্ভুত রকমের নীরবতা। আমি দেখলাম, আমাদের সেলের নকশাল বন্দির সংখ্যা ছয়জন কম। তারা জেল থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছেন, না অন্য কমরেডদের পালাতে সুযোগ করে দেওয়ায় জেলরক্ষীদের রাইফেলের গুলিতে শহিদ হয়েছেন, সেটা জানতে পারলাম না।
এর কিছুদিনের মধ্যেই তো দেশে সাধারণ নির্বাচন হল। কমিউনিস্ট পার্টি রাজ্যে ক্ষমতায় এল। আমাদের মত বিনা বিচারে যেসব বন্দি রাজ্যের বিভিন্ন জেলে বন্দি ছিলেন, তাদের মুক্তি দিল সরকার। আমিও জেল থেকে ছাড়া পেলাম। কিন্তু ততদিনে আমার বর্ধমানের গ্রামের বাড়ির কোনও খবর জানি না। অবশ্য প্রথমবার জেলে যাওয়ার পর থেকেই গ্রামের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরে হুগলির এই গ্রামে এক কমরেডের আশ্রয়ে থাকার ব্যবস্থা হল। তারপর থেকে এখানেই রয়েছি।”
‘তা এখন কেমন লাগছে দেশের অবস্থা!’ সায়ন এবার প্রশ্ন করল।
‘দূর! যতই আমাদের আন্দোলনের পদ্ধতি ভুল থাকুক না কেন, সেটা যে কত প্রয়োজন ছিল, দেশের মানুষের জন্য কত ভাল ছিল, এখন হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছি!’ বৃদ্ধ অম্লানবদনে জানালেন!
মোটামুটিভাবে আসল নকশাল খুঁজে বের করে তাঁর ইন্টারভিউ নেওয়ার কাজ শেষ হয়েছে। এবার ফিরে গিয়ে কপি লিখে বিকাশদার টেবিলে জমা দিতে হবে। সায়নের ধারণা, এই কপি দেখার পরে, সমস্ত ঘটনা শুনে বিকাশদা আর তাকে কিছু বলতে পারবেন না। তবে কীভাবে এই নকশাল খুঁজে পেল, সে বিষয়টি গোপন রাখতে অনুরোধ করেছেন স্বয়ং অলোকদা। সেটা গোপন রেখেই কপিটা লিখতে হবে।
[এই গল্পের সমস্ত ঘটনা কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে কেউ কোনও মিল খুঁজে পেলে তা হবে একান্তই কাকতালীয়।]