Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বঙ্গদেশের নাটকের ইতিকথা

পূর্বকথা

ভরতমুনি ছিলেন একজন প্রাচীন ভারতীয় নাট্য ও সঙ্গীত বিশারদ। তিনি প্রাচীন ভারতীয় নাটক, বিশেষ করে সংস্কৃত মঞ্চনাটক ও অভিনয় বিদ্যা বিষয়ক নাট্যশাস্ত্র রচনা করেছেন। ভরতকে ভারতীয় নাট্যধারার জনক বলা হয়ে থাকে।

নাটককে পঞ্চম বেদ বলা হয়। অনুমান করা হয়, বেদের সময় আদি নাটকের সৃষ্টি। ঋগ্বেদের সূত্র মতে, আদিতে যম-যমী (সুক্ত ১০.১০), পুরুরবা-উর্বশী (সুক্ত ১০.৯৫), সরমা-পনি (সুক্ত ১০.১০৮)-দের কথোপকথন থেকে প্রথম নাটকের ধারণা জন্মেছে, অন্তত ম্যাক্সমুলার, লেভি, হার্টেল প্রমুখ এই ধারণা পোষণ করেন।

যম আর যমী সম্পর্কে ভাইবোন বলে কথিত হয়েছে। কিন্তু যৌবনে কামের তাড়নায় যমী নিজের ভাইয়ের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। এদের কথোপকথন নিম্নরূপ:

যমী: এই নির্জন দ্বীপে আমি তোমার সহবাসে অভিলাষিণী।

যম: তুমি সহোদরা ভগ্নী, সুতরাং অগম্যা। এ স্থান নির্জন নয়, দেবগণ সর্বত্র দেখছেন।

যমী: পত্নী যেমন পতির নিকট তেমন আমি তোমার নিকট স্বদেহ অর্পণ করি। রথচক্রদ্বয়ের ন্যায় এসো আমরা এক কার্যে প্রবৃত্ত হই।

যম: তুমি অপরের সঙ্গে এই কার্যে প্রবৃত্ত হও।

যমী: দ্যুলোক ভূলোক স্ত্রী-পুরুষবৎ সম্বন্ধযুক্ত। যমী ভ্রাতা যমের আশ্রয় গ্রহণ করুক।

যম: ভবিষ্যতে এমন মুখ আসবে, যখন ভ্রাতা-ভগ্নী সহবাস করবে। এখন আমি ভিন্ন পুরুষান্তরকে পতিত্বে বরণ করো।

যমী: সে কীসের ভ্রাতা যে থাকতে ভগ্নী অনাথা হয়? আমি কামনায় মূর্ছিত হয়ে তোমাকে অনুনয় করছি। তোমার ও আমার শরীর মিলিয়ে দাও।

যম: ভগ্নীতে যে উপগত হয়, তাকে পাপী বলে।

যমী: হায় তুমি নিতান্ত দুর্বল পুরুষ। রজ্জু তেমন অশ্বকে, লতা যেমন বৃক্ষকে বেষ্টন করে তেমন অন্য নারী তোমাকে আলিঙ্গন করে, অথচ তুমি আমার প্রতি বিমুখ।

যম: অন্য পুরুষ তোমাকে আলিঙ্গন করুক, তাহার মন‌ তুমি হরণ করো, সে তোমার মন হরণ করুক।

এদের পারস্পরিক কথোপকথন দীর্ঘ হয়ে যাবে বলে দিলাম না। তবে এইসব কথোপকথন লক্ষ্যণীয়ভাবে নাট্যধর্মী। ম্যাক্সমুলার মনে করেন, সময়বিশেষে কোনও সংবাদ সুক্ত অভিনয় করে দেখানো হত। যথা একপক্ষ ইন্দ্র, অপরপক্ষ অন্য মরুৎগণের কথোপকথন অভিনয় করে দেখাত।

আবার সামবেদ থেকে যেসব সঙ্গীতের উৎপত্তি এবং কুমারীরা তাদের দয়িতকে আকর্ষণ করতে নৃত্যের মাধ্যমে অনুভূতির প্রকাশ করত, যা পুরোহিতগণ স্বর্গীয় মুনিঋষির অনুকরণে মর্ত্যে প্রকাশ করতেন অভিনয়ের মাধ্যমে। একথা লেভির মতানুসারে বলা হয়।

পাশ্চাত্য পণ্ডিত পিশেল আবার মনে করেন, পুতুলনাচের থেকে নাকি নাটকের ধারণা প্রথম জন্মেছিল।

অনেকের মতে, বসন্ত উৎসব ছিল নাটকের সৃষ্টির মূলে। আবার অনেক পণ্ডিতের মতে, পরলোকগত আত্মার উদ্দেশ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পরিবর্তিত এবং পরিমার্জিত রূপ নাটকের সৃষ্টির দাবিদার। তবে পণ্ডিত নির্বিশেষে মত পোষণ করেন যে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকেই নাটকের শুরু। যথা রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনি অথবা শ্রীকৃষ্ণের কীর্তিকলাপও নাটকের মাধ্যমে প্রচার করা হত।

আবার অনেক পণ্ডিত মনে করেন, আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময়কাল, অর্থাৎ ৩২৭-৩২৬ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে ভারতবর্ষে প্রথম গ্রীক নাটক অভিনীত হয় এবং গ্রীক থিয়েটারের অনুকরণে প্রথম রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা হয় (যথা ছোট নাগপুর রামগড় পাহাড়ের গুহায়) এবং বোধহয় তখন থেকেই ভারতবাসী নিয়মিত নাটক অভ্যাস করে। এই মতের সমর্থনে নিম্নলিখিত যুক্তিগুলো দেখানো হয়েছে। যথা:

১) ভারতীয় নাটকে ‘যবনিকা’ শব্দের উদ্ভব গ্রীক ‘যবন’ থেকে। অনেক নাট্যগ্রন্থে রাজার দেহরক্ষিণীদের ‘যবনী’ বলা হয়েছে। কারণ সহজে অনুমেয়।

২) গ্ৰীক নাটকের সঙ্গে ভারতীয় দৃশ্যকাব্যের মিল আছে। যেমন, কোনও অজ্ঞাতপরিচয় যুবতীর প্রতি রাজার অনুরাগ, বহু বাধা পেরিয়ে সেই যুবতীর পরিচয় লাভ এবং পরে বিয়ে, এসব উভয় দেশের নাটকেই পরিলক্ষিত হয়।

৩) প্রেমঘটিত নাটকে রাজনৈতিক ঘটনার সংমিশ্রণও উভয় দেশের নাটকে পাওয়া যায়। যথা: মৃচ্ছকটিক এবং গ্রীক cistslleria বা aulularia।

৪) আবার দেখা যায় ভারতীয় নাটকের বিট, বিদুষী এবং শকারের সঙ্গে গ্ৰীক-রোমান নাটকের Parasite, Servus, Currens এবং Miles-এর সাদৃশ্য বিদ্যমান।

৫) উভয় দেশের নাটকেই বস্তু প্রাধান্য লাভ করেছে। যথা ভারতীয় নাটকে চরিত্র ত্রিবিধ: উচ্চ, মধ্যম এবং নীচ। গ্রীক নাটকের চরিত্র যথাক্রমে Ideal, real এবং inferior।

৬) অনেকের মতে, ভারতীয় নাটক গ্রীক mime দ্বারা প্রভাবিত।

এই মতের আবার বিপরীত যুক্তিও আছে। ভরতের নাট্যশাস্ত্র অনুসারে ব্রহ্মা স্বয়ং দৃশ্যকাব্যের সৃষ্টিকর্তা। তিনি নিজে ‘অমৃতমন্থন’ ও ‘ত্রিপুরদাহ’ নামে দুখানি নাটক রচনা করেছিলেন। এই আখ্যান বিশ্বাসযোগ্য নয় যদিও, তবে ভারতে হয়তো গ্ৰীক আসার আগেও নাটকের প্রচলন ছিল ধারণা করা যায় দুটি সঙ্গত যুক্তিতে:

যজুর্বেদে ‘শৈলুষ’ শব্দের ব্যবহার আছে (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩.৪.২ এবং বাজসনেয়ী সংহিতা ৩০.৪)। এই শব্দে নট বা অভিনেতা কিংবা সঙ্গীতজ্ঞ বা নর্তককে বোঝাত। পাণিনির অষ্টধ্যায়ীতেও (৪.৩.১১০) নটসূত্রের উল্লেখ আছে। সুতরাং নাটকের ইতিহাস গ্ৰীক আবির্ভাবের আগেও ছিল এই অনুমান অসঙ্গত হবে না। পতঞ্জলির মহাভাষ্যে (খ্রিস্ট-পূর্ব ২য় শতক) নাটকের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

বাংলা নাটকের আদিযুগ

বঙ্গদেশের নাটকের ইতিহাস বেশ‌ পুরোনো। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে বাংলা নাটকের প্রথম সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে নাট্যচর্চায় বাঙালি তৎকালীন প্রচলিত লোকনাট্য রীতি, যা মোটামুটি গীতিনির্ভর ছিল, তাই গ্রহণ করেছিল। এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে বাংলায় সেসময় বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার সম্পূর্ণ। তাই সে-সময়ের গীতিনাটকে বৌদ্ধ ধর্মীয় গীতবাদ্য ছিল লক্ষ্যণীয়। যদিও স্বয়ং বুদ্ধ নৃত্যগীত নিষিদ্ধ করেছিলেন, তবে মনে হয়, মহামতি অশোকের সময়কাল থেকে উত্তর ভারতের মগধ থেকে বাংলায় গীতিনাট্যের আগমন ঘটে। তবে এসব গীতিনাটকে গান এবং নৃত্যের বাইরে কোনও সংলাপ থাকত কিনা তা সঠিকভাবে জানা যায় না। প্রাচীনতম বাংলা নাটকের প্রথম সন্ধান পাওয়া গেছে বৌদ্ধ চর্যাপদের ১১ নং পদে। এই পদে বৌদ্ধ যুগের নাটকের বর্ণনা প্রক্ষিপ্ত। চর্যাপদের পদগুলোতে বৌদ্ধ সহজিয়া সাধনার ওপর প্রণীত। নবম-দশম শতকে বৌদ্ধরা তাদের ধর্মসাধনার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে নাটককে বেছে নিয়েছিলেন। আলোচিত চর্যাপদের সূত্রে পাই, “নাচন্তি বাজিল, গাওন্তি দেবী/ বুদ্ধনাটক বিষমা হোই…”। এই লাইনে দেখা যাচ্ছে, পুরুষ নাচছে, মহিলা গাইছে। এখানে বুদ্ধের নাটগীত উল্টো রকম। সে যাই হোক, গীতিনাট্যে ধর্মীয় বিষয় উপস্থাপনা করা ছিল তৎকালীন বৌদ্ধ রীতি।

তৎকালে লোচন পণ্ডিত নামে জনৈকের লেখা ‘রাগতরঙ্গিনী’ নামের এক পুস্তকে ‘তুম্বুরু’ নামের একটি নাটকের কিছু উদ্ধৃতি আছে। তুম্বুরু নাট্যপুস্তক পাওয়া না গেলেও উপরোক্ত উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায়, বাংলায় এটা বোধহয় নাট্য বিষয়ক কোনও শাস্ত্রীয় গ্ৰন্থ ছিল।

এরপরে আমরা চলে আসব রাজা লক্ষ্মণ সেনের আমলে। এই সময় বাংলায় নৃত্য, গীত, অভিনয়ের ব্যাপক প্রচার ও শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল। উল্লেখ্য, এই সময় ‘গঙ্গানট’ নামে এক বিখ্যাত নট রাজার পারিষদ ছিলেন, যিনি একবার রাজ অনুরোধে ভবভূতি রচিত ‘উত্তরচরিত’ নাটকের ‘ছায়া’ নামের অঙ্ক থেকে সীতার অভাবে রামের আচরণ অভিনয় করে দেখিয়েছিলেন রাজসভায়।

অভিনয় এত উৎকর্ষতা লাভ করেছিল যে, নট রামের বেশে সীতার স্পর্শ অনুভব করে নিম্নোক্ত শ্লোক গাইতে গাইতে সভার মূর্ছিত হয়ে পড়ে দেহত্যাগ করেন।

সারণ্যানী স বটবিটপ হন্ত দেব সথলীয়ং
সীতা সেবা স্পৃশতি হৃদয়ং সোহহমেবাশ্মি রামঃ।
এবং কান্তা বিরহ বিলসদ্ রামতাদাত্ম্য দিগ্ধো
নৃত্যাবেশান্ মুনিরিব নটো রামসাজুজ্যমাপ।।

এই ঘটনার সত্যতা নিরূপণ সম্ভব না হলেও অভিনয়শৈলী যে অতি উচ্চমানের ছিল, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

বাংলায় সে-সময় এই নাট্যাভিনয় একদল লোকের জীবিকা ছিল। এদের ‘নট-পেটিকা’ বলা হত। হয়তো নাটকের সাজসজ্জা এক পেটিকায় নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করতেন বলে এদের এই নামে ডাকা হত। চর্যাপদের ২০নং পদে কাহ্নপাদ এদের ‘নড়-এড়া’ বলে সম্বোধন করেছেন যা এই নট-পেটিকা ছাড়া কিছু নয়।

এই সময়কালে আমাদের মহাকবি জয়দেব ‘গীতগোবিন্দম’ রচনা করে ফেলেছেন‌, যা বিভিন্ন কারণে মহাকাব্যের তকমা না পেলেও একটা শ্রেষ্ঠ গীতিকাব্য বটে। মহাকাব্যের আদলে ১২টি সর্গে বিভক্ত এই গীতিময় কাব্য নিয়ে পণ্ডিতেরা নানাভাবে বিচার করেছেন। এর গানগুলোতে গীতিকবিতার লক্ষণ এবং রাধা কৃষ্ণ সখীর সংলাপাত্মক সঙ্গীতগুলির পরম্পরা লক্ষ্য করে লসেন এটাকে Lyrical drama বলে অভিহিত করেছেন। উইলিয়াম জোন্স ‘গীতগোবিন্দ’-কে pastoral drama বলেছেন, আবার পিশেল বলেছেন, melodrama। আবার ‘গীতগোবিন্দ’-তে সঙ্গীতের প্রাধান্য দেখে লেভি একে বলেছেন, Opera। ড. সুকুমার সেন বলেছেন‌, এটা গীতিনাট্য। মোদ্দা কথা, ‘গীতগোবিন্দ’ হল সর্বকালের একটা সেরা নাট্য।

বাংলা নাটকের মধ্যযুগ

মধ্যযুগে এরপর আসে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। চর্যাপদের সময় থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ অথবা ষোড়শ শতক অব্দি বাংলায় গীতিনাট্যই প্রচলিত ছিল। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-কে ‘গীতগোবিন্দ’-এর সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে সতীশচন্দ্র রায় বলেছেন যে, ‘গীতগোবিন্দ’ কথোপকথনরূপে লিখিত হলেও এতে মহাকাব্যিক গুণ আছে, অথচ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ ‘গীতগোবিন্দ’-এর ধাঁচে লেখা হলেও‌ এতে নাটকের উপাদান বেশি এবং সে হিসেবে বড়ু চণ্ডীদাস কৃত এই নাটক বাংলা নাটকের এক অতুলনীয় সম্পদ। এছাড়া সাগর নন্দীর পঞ্চদশ শতকে লিখিত ‘নাটক লক্ষণ রত্নকোষ’ নামের বইতে সেসময়ের বেশ ক’টি বাংলা নাটকের উল্লেখ পাওয়া যায়, যদিও নাটকগুলোর সন্ধান পাওয়া যায়নি। নাটকগুলো হল ‘মারীচবঞ্চিতক’, ‘কৃত্যারাবণ’, ‘বালিবধ’, ‘শর্মিষ্ঠা পরিণয়’, ‘উৎকন্ঠিত মাধব’, ‘রেবতীপরিণয়’, ‘কেলিরৈবতক’, ‘রাধা’, ‘উষাহরণ’, ‘সত্যভামা’ প্রভৃতি পৌরাণিক ছাড়াও মধ্যযুগে কিছু অপৌরাণিক নাটকেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। যথা ‘উন্মত্ত চন্দ্রগুপ্ত’, ‘মায়া কাপালিক’, ‘মদনিকা-কামুক’, ‘মায়া-শকুন্ত’ ইত্যাদি। এগুলো সবই সম্ভবত বাংলা নাটক এবং মধ্যযুগের নাট্যরীতির উৎকর্ষতার নিদর্শন।

এই সময় বাংলায় চৈতন্যদেবের আবির্ভাব এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই সময় থেকেই পৌরাণিক দেবস্তুতিসমৃদ্ধ নাট্যরীতি থেকে সরে আসেন নটরা। এর আগে অর্থাৎ আদিযুগ থেকে এই চৈতন্য-পূর্ববর্তী আমল পর্যন্ত নাটকে সংলাপ প্রায় থাকতই না। গীতসর্বস্ব নাটকে কখনও অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নিজে নিজে তাৎক্ষণিক সংলাপ বানিয়ে নিক্ষেপ করতেন। কিন্তু চৈতন্যদেবের সময় থেকে নাট্যরীতিতে এক পরিবর্তন ঘটে। এই সময় থেকে ভক্তিরসাত্মক নাটগীতির প্রচলন হয় এবং এসব নাট্যকলাকে যাত্রা নামে অভিহিত করা হয়। সে হিসাবে পঞ্চদশ শতকের শেষভাগকে বাংলা যাত্রার আদিযুগ বলা যেতে পারে, যা অষ্টাদশ শতক অব্দি বিস্তৃত ছিল। এই সময়ে আদিরসাত্মক নাটপালা চৈতন্যদেব শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক ভক্তিরসাশ্রিত যাত্রাপালায় রূপান্তরিত করেন। এই প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এবং কালীয়দমন পালা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই প্রসঙ্গে ড. সুকুমার সেন বলেছেন যে, প্রথমে যাত্রার বিষয় ছিল কৃষ্ণলীলা, তার মধ্যে বিশেষ করে কালীয়দমন কাহিনি। এই জন্য যাত্রার নামান্তর ছিল কৃষ্ণ যাত্রা বা কালীয়দমন। কৃষ্ণলীলার অন্যান্য কাহিনি যাত্রায় গৃহীত হলেও কালীয়দমন সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল বলে একসময় যাত্রার নামকরণ হয়ে গেছিল কালীয়দমন। এই কালীয়দমন নাম নিয়ে যাত্রাপালা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে অব্দি চলে এসেছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কোনও পালার লিখিত কোনও সংরক্ষণ না থাকায় আমাদের কল্পনা ছাড়া কিছু করার নেই। অনুমান করা যায়, ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর যাত্রাপালায় কোনও বাঁধা কাহিনি ছিল না। দান, মান, মাথুর, অক্রুর সংবাদ, উদ্ধব সংবাদ, যুগলমিলন ইত্যাদি যে কোনও প্রসঙ্গ অবলম্বন করে সঙ্গীতের পর সঙ্গীত সংযোজন করে কাহিনি পরিণতির দিকে এগোত, তার ফলে দর্শকমনে কোনও স্থায়ী দাগ কাটত না। গানের ফাঁকে ফাঁকে অভিনেতা কিছু কিছু সংলাপ তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি করে প্রক্ষেপ করতেন। স্ত্রী-চরিত্রে পুরুষেরা অভিনয় করতেন। সাজপোশাকেরও বিশেষ পারিপাট্য থাকত না।

আগেই বলেছি, এই যুগের যাত্রাগানের ঐতিহাসিক উপাদান নেই বললেই চলে। ফলে যাত্রার ইতিহাস বাংলার নাট্যগীতেই অনুসন্ধান করতে হবে। নাটগীতিই বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে লোকশিক্ষার বাহনরূপে বহুকাল বিকশিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে শিশির ভাদুড়ী বলেছেন, “যাত্রা ছিল দেবদেবীর পূজার অংশ। শুধু পূজার অংশ নয়, লোকশিক্ষারও অঙ্গ। আমাদের দেশের লোক অক্ষরজ্ঞানকে শিক্ষার একমাত্র সোপান মনে করতেন না। বর্ণজ্ঞান না থাকলেও আমাদের দেশের নিরক্ষর কৃষক এই পৌরাণিক উপাখ্যানমূলক যাত্রার সাহায্যে ধর্ম-দর্শনের সাথে মোটামুটি পরিচিত হতে সক্ষম হতেন। জীবনের উচ্চ আদর্শগুলি— সত্যানুরাগ, পরোপচিকীর্যা, পরার্থে আত্মত্যাগ, সতীধর্ম, পিতৃধর্ম, সৌহার্দ্য ও দেবদ্বিজে ভক্তি লোকের মনে সংক্রামিত হতো।’’

অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে যদিও বীরভূমের কেন্দুবিল্ব গ্রামের শিশুরাম অধিকারী কৃষ্ণলীলার সঙ্গে ঝুমুর ও মঙ্গলগান ও কীর্তন মিশিয়ে এক নব সংস্কৃত ধারার কালীয়দমন যাত্রা শুরু করেন কিন্তু অচিরেই মনুষ্যচরিত্রের পরিবর্তন ঘটে এবং বাংলা নাট্যজগতে অবক্ষয়ের যুগ শুরু হয়। যে উচ্চ আদর্শ নিয়ে এতকাল ধরে নাট্যরীতি চলে আসছিল, সেই উচ্চকোটির নাট্যজগৎ বিকৃত রুচির পোষকতায় অধঃপাতে চলে যায়। বাংলার নাটকের ইতিহাসে অষ্টাদশ শতাব্দী অবক্ষয়ের যুগ হিসাবে চিহ্নিত। নৈতিক মান নেমে গিয়ে সাহিত্য ও নাট্যশিল্প আদিরসাশ্রিত হয়ে পড়েছিল। তার ফলে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিকৃত রুচির তাগিদে সাধক রামপ্রসাদের মত ব্যক্তি বিদ্যাসুন্দরের মত আদিরসাশ্রিত কাব্য লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভারতচন্দ্র বিশেষ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন বলে এই বিকৃত কাননে কাব্যের কুসুম ফুটিয়েছিলেন। উচ্চ আদর্শসম্পন্ন নাট্যরীতিতে যুগরুচির ছোঁয়া লেগে তা পর্যবসিত হয়েছিল অশ্লীলতায় ভরা কুরুচিপূর্ণ অনুষ্ঠানে। যাত্রাগানের এই রুচিবিকৃতি ভদ্র মানুষের ধিক্কারের কোপে পড়ল।

বাংলা নাটকের বর্তমান যুগ

অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই বাংলা নাটকের জগতের বর্তমান যুগের গোড়াপত্তন। এই সময় থেকেই এদেশাগত ব্রিটিশ রাজপুরুষেরা অবসর বিনোদন করার লক্ষ্যে আধুনিক রীতিতে মঞ্চাভিনয়ের সূচনা করেন। অভিনয়প্রিয় ইংরেজরা ১৭৫৩ সালে কলকাতায় ‘ওল্ড প্লে হাউস’-এর প্রতিষ্ঠা করেন। নাট্যশালাটি ইংরেজদের হাতে প্রতিষ্ঠিত এ দেশে প্রথম রঙ্গমঞ্চ। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি এটি তৈরি; বর্তমানে লালবাজার স্ট্রিটের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে, পুলিশদের প্রধান কার্যালয়ের বিপরীত দিকে এটি অবস্থিত ছিল। মূলত অভিনয় করতেন ইংরেজ কর্মচারীগণ (এমেচিওর)। যা ১৭৫৬ সালের যুদ্ধের সময় ধ্বংস হয় সিরাজের সৈন্যদের হাতে। সেই সময়ের কোনও পত্রিকাতে উল্লেখ পাওয়া যায় না এই মঞ্চের এবং সেই জন্যেই কী কী নাটক, কবে, কাদের দ্বারা অভিনীত হয়েছিল সেই সমস্ত বিষয় প্রায় অজানাই।

১৭৭৫ সালে জর্জ উইলিয়ামস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই মঞ্চ, পরবর্তী বিদেশি রঙ্গালয় হিসেবে শহরে খ্যাতি অর্জন করে। বর্তমানে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের লায়ন্স লঞ্জ-এর পশ্চিম দিকে অবস্থিত। ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকায় এই মঞ্চের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেকালের প্রায় সব বিখ্যাত ইংরেজগণ ছিলেন এর পৃষ্ঠপোষক। এই মঞ্চে অভিনয় করতেন প্রধানত এমেচার অভিনেতারা, প্রথম দিকে পুরুষদেরই দেখা যেত নারীদের ভূমিকায়। সেই যুগের রঙ্গালয় হিসেবে এটির দর্শকাসন ও মঞ্চব্যবস্থা ছিল বেশ উন্নত। শ্রুতিমধুর একদল গায়নের, মঞ্চের সঙ্গীত, মধ্যস্থলে আলো এবং যথোচিত দূরত্বে কাচের শেডের মধ্যে মোমবাতি জ্বালা হত অভিনয়ের সময়ে। ছিল বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা। এখানে অভিনীত হয়, শেক্সপীয়ারের ‘হ্যামলেট’, ‘রিচার্ড দি থার্ড’, ‘ওথেলো’, শেরিডনের ‘স্কুল ফর স্ক্যান্ডাল’, জর্জ ফারকুহুরের বেশ কিছু নাটক। ১৭৮৮ সালের শেষের দিকে মিসেস ব্রিস্টো নামক এক বিখ্যাত অভিনেত্রীর নৃত্য, গীতে, ও অভিনয়ের পারদর্শিতা লক্ষ্য করে এই ক্যালকাটা থিয়েটার তাঁকে গ্রহণ করে, যার ফলে এই রঙ্গালয়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় অনেকখানি। প্রায় তেত্রিশ বছর ধরে বহু নাটক অভিনীত হয় এখানে। কিন্তু টিকিটের অতিরিক্ত দামের জন্য এই থিয়েটার জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে এবং ১৭৯৫ সনে এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে।

হেরাসিম লেবেডেফ নামে এক রাশিয়ান ব্যক্তি ডোমতলা (বর্তমান এজরা স্ট্রিট) এলাকায় ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’ নামে এক নাট্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে বলে রাখা ভাল, এই সময় শিক্ষিত বাঙালি সুশীল সমাজ ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠিত রঙ্গমঞ্চগুলোতে উচ্চকোটির অভিনয় দেখেন এবং স্বভাবতই বাংলা যাত্রাগান পালা ইত্যাদির নিম্নরুচির অভিনয়ের প্রতি বিরক্তি এবং বিতৃষ্ণা অনুভব করতে থাকেন। এই সন্ধিক্ষণে লেবেডেফের বেঙ্গলি থিয়েটার এক মুক্ত বাতাস নিয়ে আসে। ১৭৯৫ সনের ২৭-এ নভেম্বর বেঙ্গলি থিয়েটারে লেবেডেফ তাঁর ভাষাশিক্ষক গোলকনাথ দাসের সাহায্যে একটি ইংরেজি নাটক ‘The disguise’-এর‌ বাংলা অনুবাদ করে ‘কাল্পনিক সংবদল’ নামে মহাসমারোহে মঞ্চস্থ করেন। একটা ফরাসি নাটকের ‘Love is the best doctor’ অনুবাদও অভিনীত হয়েছিল। ১৭৯৬ সালে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এই থিয়েটার চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেলেও রুচিবান বাঙালির মনে ‌বাংলা নাটকের বীজ ততদিনে অঙ্কুরিত হয়ে গেছে। নতুন ধাঁচের নাট্যালয় বাঙালির মনে সাড়া ফেলে দিয়েছে। অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে যেমন থিয়েটার প্রচলিত ছিল, সেই অনুকরণেই তৈরি হয় এখানের কিছু থিয়েটার। সাজপোশাক, যন্ত্রানুসঙ্গীত, অভিনয়রীতি সবই ইংল্যান্ডের ধাঁচে করা হয়। মঞ্চের সামনে তৈরি হল দর্শকাসন এবং সবটা ঘিরে শুরু হল ‘থিয়েটার হল’। বাংলায় নাট্যশালা বা রঙ্গালয়। ইংরেজিতে ‘প্রসেনিয়াম থিয়েটার’। অভিনেতা-অভিনেত্রী, উদ্যোক্তা, পৃষ্ঠপোষক, নির্দেশক, নীতিরীতি— সবই বিদেশি।

কিন্তু বাংলা রঙ্গালয় আসতে তখনও বেশ দেরি। ইংরেজি নাটক মহাসমারোহে চলছে। ১৮১৩ সালে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি একত্রিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘চৌরঙ্গী থিয়েটার’। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরও এর পরিচালকমণ্ডলীতে ছিলেন এবং একসময় এই থিয়েটার কিনে নিয়েছিলেন। ‘ক্যাসল স্পেক্টর’ ও ‘সিক্সটি থার্ড লেটার’ নাটকের অভিনয় দিয়ে শুরু হয় এই রঙ্গালয়। শেক্সপিয়ার থেকে শুরু করে সেরিডন, গোল্ডস্মিথের মতো প্রখ্যাত নাট্যকারদের নাটক অভিনীত হয়েছে এখানে। অভিনীত হয় ‘দি স্লিপিং ড্রট’, ‘হানিমুন’, ‘ম্যাট্রিমনি’, ‘দি আয়রন চেস্ট’ প্রভৃতি। ২৬ বছর সগৌরবে চলার পর চৌরঙ্গী থিয়েটার ১৮৩৯ সালে বন্ধ হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে ১৮৩৫ সালে বাংলা নাটকের ইতিহাসে আর-এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার এলাকার বাবু নবীনচন্দ্র বসুর প্রাসাদোপম বাড়িতে সেদিন বড় গোল। প্রায় ৩০০ জন বিশিষ্ট নিমন্ত্রিত ছাড়াও বাড়ির অন্যান্য আবাসিকদের কৌতূহলের সীমা নেই, কারণ, বাবু নাকি থ্যাটার না কি বলে ছাই, তাই করবেন। সমবেত অতিথিরা অপেক্ষারত, কখন শুরু হবে যাত্রাপালা, এ নাকি অন্য ধরনের পালা। যদিও ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘বিদ্যাসুন্দর’ পালাখানা নাকি গাইবেন, একে নাকি বলে ‘থ্যাটার’। নাটক শুরু হল সন্ধ্যায়। অদ্ভুত এক সেটিং। সারা বাড়ির বিভিন্ন কক্ষে, বাগানে, ইত্যাদি স্থানে অভিনয় করতে লাগলেন নট-নটীরা। নটীরা মানে তখনকার ব্যবস্থা অনুযায়ী নবীনবাবু অনেক নগদ খরচ করে চারজন নামীদামি বারবণিতা নিয়ে এসেছেন। ঘর এবং বাগান জুড়ে বিদ্যাসুন্দর অভিনীত হতে থাকল সারা রাত জুড়ে এবং অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের পেছন পেছন নিমন্ত্রিত দর্শকরাও ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করে যাচ্ছিলেন। সব জায়গায় সবচেয়ে মহার্ঘ পানীয় এবং খাদ্য নবীনবাবুর ভৃত্যেরা সরবরাহ করে যাচ্ছিল অবিরত। সেই ছিল কলকাতা তথা বাংলায় প্রথম বাঙালি পরিচালিত থিয়েটারের রাত এবং বাবু নবীনচন্দ্র বসু সেই প্রথম থিয়েটার করেই শুধু বিখ্যাত হলেন তাই নয়, সে-রাতে ১৮৩৫ সালে খরচ হয়েছিল ২,০০,০০০ টাকা এবং এর জন্য তাঁর অন্য একটা বাড়ি বিক্রি করতে বাধ্য হন।

এদিকে একটা অন্য ঘটনা ঘটে গেছে। সময়টা ১৮৩৯ সাল। অভিজাত ইংরেজদের নিজের হাতে গড়া ‘চৌরঙ্গী থিয়েটার’ কিছুদিন আগেই আগুনে পুড়ে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। একটা নিজস্ব থিয়েটার ছাড়া শ্বেতাঙ্গ আভিজাত্য সম্পূর্ণ হয় না। এদিকে ‘চৌরঙ্গী থিয়েটার’ পুড়ে যাওয়ার পর কলকাতায় বসবাসকারী ইংরেজ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের একটা বড় অংশ ইংল্যান্ডে চলে গেছিলেন। ফলে নানারকম পরিকল্পনা চললেও কলকাতায় তখন অভিনেতা-অভিনেত্রীর আকাল। বাংলায় তখনও বাঙালিদের দ্বারা থিয়েটার অভিনয় চালু হয়নি। অবশ্য যাত্রা বা অন্যান্য লোকনাট্যের জনপ্রিয়তা কম ছিল না। কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি যুবকেরও অভাব নেই। কিন্তু তাঁরা তো আর ইংরেজদের থিয়েটারে ঢুকতে পারবেন না। এমনকি অভিজাত ও অর্থবান বাঙালি ছাড়া ইংরেজদের অভিনয় দেখার সৌভাগ্যও সবার ছিল না। এই পরিস্থিতিতে কলকাতায় ইংরেজদের থিয়েটারি আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য এগিয়ে এলেন ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও অভিনেতা মি. স্টোকলার। তড়িঘড়ি তিনি লন্ডন থেকে নিয়ে এলেন মিসেস লিচ-কে। যিনি ছিলেন চৌরঙ্গী থিয়েটারের প্রাণভোমরা। তিন মাসের মধ্যে গড়ে উঠল ইংরেজদের নিজস্ব ‘সাঁ সুসি থিয়েটার’। প্রথমে অস্থায়ী মঞ্চে অভিনীত হল ‘ইউ ক্যান্ট ম্যারি ইওর গ্রান্ডমাদার’ নামের একটি নাটক এবং দুটি প্রহসন। টিকিটের দাম ছিল ওই সময়ে ছয় টাকা, পাঁচ টাকা ও চার টাকা। পুরো হলটি ছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। চারশো সিটের থিয়েটার হল প্রথম রাতেই হাউসফুল।

শুধু মিসেস লিচ বা স্টোকলার নন, মিসেস ব্ল্যাক, মিসেস ফ্রান্সিস, মি. বলিনের অভিনয়ে-নাচে-গানে কলকাতায় ইংরেজ থিয়েটারের সুসময় ফিরে এল। লন্ডন থেকে বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও এসে যোগ দিলেন। ফলে প্রয়োজন পড়ল আরও বড়, আরও সুসজ্জিত থিয়েটার হলের। অর্থসাহায্য করতে এগিয়ে এলেন স্বয়ং বড়লাট অকল্যান্ড এবং দ্বারকানাথ ঠাকুর। মিসেস লিচ নিজের সমস্ত সম্পত্তি দান করলেন নতুন থিয়েটার বাড়িটির জন্য। অবশেষে ১৮৪১ সালের মার্চ মাসে স্থায়ী ‘সাঁ সুসি থিয়েটার’-এর উদ্বোধন হল। ঠিকানা— আজ যেখানে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ।

কিন্তু সুখের সময় বেশিদিন থাকে না। ১৮৪১ সালের নভেম্বর মাসে ‘হ্যান্ডসাম হাজব্যান্ড’ নাটকের অভিনয় চলাকালীন পোশাকে আগুন লেগে মিসেস লিচের মৃত্য হয়। চৌরঙ্গী থিয়েটার পুড়ে যাওয়ার পর তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে গেছিলেন। নতুন উন্মাদনায় ফিরে এসে যে থিয়েটারের জন্য নিজের সর্বস্ব দান করেছিলেন, সেই থিয়েটার মঞ্চে আগুনে পুড়েই তাঁর মৃত্যু ঘটল। নিয়তি আর কাকে বলে!

লিচের মৃত্যুর পর কখনও মাদাম ব্যাক্সটার, কখনও জেমস ব্যারি সাঁ সুসির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু লিচের অভাব পূর্ণ হয়নি। নিত্যনতুন নাটক অভিনয়ে করে বা টিকিটের দাম কমিয়েও দর্শকের মনোরঞ্জন করা যাচ্ছিল না। এমনকি মঞ্চে ঘোড়ার খেলা দেখানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আর সত্যিকারেই নাটকের মধ্যে দড়ির ওপর নাচের সার্কাস দেখানো হয়েছিল। তা সত্ত্বেও অবস্থার বদল হয়নি।

সেই সময়েই সাঁ সুসি-তে আবির্ভাব ঘটল ‘দ্য হিন্দু ওথেলো’-র। তাঁর নাম বৈষ্ণবচরণ আঢ্য। ১৮৪৮ সালের ১৬ আগস্ট শেক্সপিয়রের ‘ওথেলো’ নাটকের মূলচরিত্রে অভিনয় করলেন তিনি। ডেসডিমোনার চরিত্রে ছিলেন মিসেস লিচের মেয়ে মিসেস অ্যান্ডারসন। এই চরিত্রটার জন্যই তাঁকে ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা হয়ে হয়েছিল। ১২ সেপ্টেম্বর আবার ‘ওথেলো’-র অভিনয় হল।

মিসেস অ্যান্ডারসনের অসাধারণ অভিনয় সত্ত্বেও মোকাম কলিকাতায় তখন শুধুই বৈষ্ণবচরণের নাম। সাহেবি থিয়েটারের প্রথম বাঙালি ‘হিরো’ তিনি। তাঁর উচ্চাঙ্গ অভিনয়, ইংরেজি বলার কায়দা এবং জড়তাহীন অঙ্গভঙ্গি নিয়ে তিনি প্রথম অভিনয়েই দর্শকের মন জয় করে ফেললেন। আর একটা বড় কারণ, সাঁ সুসি তখন ধনী বাঙালিদের অর্থসাহায্যেই চলছিল। ততদিনে উচ্চশিক্ষিত ও ধনী বাঙালিরা ইংরেজ থিয়েটারের গ্ল্যামারে মুগ্ধ হতে শুরু করেছেন। তাঁরা বুঝে গেছিলেন থিয়েটার করলে যেমন ইংরেজসুলভ কৌলীন্য পাওয়া সম্ভব, তেমনই নিজস্ব আভিজাত্য দেখানোও সহজ হবে। অবশ্য তখনও বিদেশি অনুকরণে বাঙালি থিয়েটার চালু হয়নি। কিছুদিনের মধ্যে ‘সাঁ সুসি’-সহ কলকাতার প্রায় সবক’টা সাহেবি থিয়েটার উঠে যাওয়া তার প্রমাণ হিসেবে হাজির করা যেতে পারে।

বৈষ্ণবচরণকে নিয়ে বাঙালির মধ্যে যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল এটাই ছিল তার মূল কারণ। যদিও এই দুটি অভিনয়ের পর বৈষ্ণবচরণকে আর মঞ্চের আলোয় দেখা যায়নি। সাঁ সুসিই ছিল কলকাতার শেষ সফল সাহেবি থিয়েটার।

এদিকে বাবু নবীনচন্দ্রের হাত ধরে বাংলা থিয়েটারের পথচলা শুরু ১৮৩৫ সনে, তার পূর্ণতা পাওয়া শুরু হল আরও ২২ বছর পর। বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসের দিকে তাকালে, এই যুগের প্রতিনিধি হিসেবে নির্দেশ করা যায়— রামনারায়ণ তর্কালঙ্কার, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্রকে। এই যুগের প্রবর্তক হিসেবে গণ্য করা যায়— মনোমোহন বসুকে, যাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই যুগকে বিশেষরূপে সমৃদ্ধ করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমৃতলাল বসু, গিরিশ ঘোষ প্রমুখ। এই যুগের অবসান ঘটে রবীন্দ্র নাট্যচর্চার ক্রমবিকাশে। এতদ্বারা বোঝা যায়, থিয়েটার বাঙালির অন্দরমহলে না হলেও, বৈঠকখানায় প্রবেশ করতে শুরু করে ক্রমশ এই সময়ে এবং এই সময় শুরু হয় কিছু প্রচলিত সংস্কৃত নাটকের অভিনয়। ১৮৫৭ সালে আশুতোষ দেব ওরফে সতুবাবুর বাড়িতে কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ নাটকটি অভিনীত হয়। একই সালে জয়রাম বসাকের বাড়িতে অভিনীত হয় ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ এবং মেট্রোপলিটন থিয়েটারে ‘বিধবা বিবাহ’। এই অনুবাদ ধারার নাটক থেকে শুরু হয় কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘বিদ্যোৎসাহিনী’ থিয়েটার (১৮৫৭), যার উদ্বোধন হয় ভট্টনারায়ণের ‘বেণীসংহার’ নাটক দিয়ে, যেটি অনুবাদ করেন তৎকালীন সুপণ্ডিত রামনারায়ণ তর্কালঙ্কার। এই সাফল্য ক্রমশ কালীপ্রসন্নকে উদ্বুদ্ধ করে আরও বেশ কিছু সংস্কৃত নাটকের বঙ্গানুবাদ ও মঞ্চস্থকরণে। তালিকায় ছিল কালীদাসের ‘বিক্রোমবর্বশীয়ম্‌’, ভবভূতির ‘মালতীমাধব’ এবং এগুলির থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখেন তৎকালীন সময়ের অতি জনপ্রিয় একটি নাটক— ‘সাবিত্রী সত্যবান’। এই সময়ের নাটক বিশেষত সংস্কৃত নাটকের কথা উল্লেখ করলে যার নাম বা যার বিষয়ে খানিক বিস্তারিত না বললে অসম্পূর্ণ রয়ে যায় এ আলোচনা, তিনি রামনারায়ণ তর্করত্ন।

এই সন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হন দীনবন্ধু মিত্র। তাঁর ‘নীলদর্পণ’ প্রথম জাতীয়তাবাদী নাটক, ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর। বাঙালি তখন একটু একটু করে ব্রিটিশ প্রভুর অপশাসনের কথা অনুধাবন করতে পারল। গ্রামেগঞ্জে এই নাটকের জনপ্রিয়তা এত বৃদ্ধি পায় যে, সরকার এই নাটকের প্রদর্শন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে (১৮৭৬)। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং নানা রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা হতে থাকে। দীনবন্ধু মিত্রের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা হয় ‘জমিদার দর্পণ’, ‘কেরাণী দর্পণ’ ইত্যাদি। ততদিনে ৬নং বিডন স্ট্রিটে ‘গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। মহাসমারোহে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরুবিক্রম’, ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’, ‘সরোজিনী’, ‘চিতোর আক্রমণ’ জয়প্রিয় হয়েছে। সরোজিনী তো‌ দারুণ সার্থক নাটক।

তখন গিরিশ ঘোষ, অমৃতলাল বসু, বিনোদিনী দাসী, কাদম্বিনী আদি সবাই ন্যাশনাল থিয়েটারে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’ চলাকালীন হলের মালিক প্রতাপ চাঁদ জহুরীর সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় সবাই ন্যাশনাল থিয়েটার ছেড়ে আলাদা হয়ে যান। ইতিমধ্যে হরলাল ঘোষের ‘বঙ্গের সুখাবসান’, অমৃতলালের ‘হীরকচূর্ণ’ ইত্যাদিতে প্রকাশ পায় ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাব। দেখানো হয় নিরন্ন ভারতীয়দের হাহাকার, খাবারের জন্যে ব্রিটিশ-বিরোধী সন্তানদের ওপর ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচার, যা স্বাভাবিকভাবেই ক্রুদ্ধ করে তোলে শাসকদের।

এরপরেই বাংলা নাটকে স্টার থিয়েটারের সৃষ্টি এবং সেই বিখ্যাত ত্রয়ীর নাট্যজগতে আবির্ভাব হয়। এঁরা হলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল বসু এবং পরে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। গিরিশচন্দ্র ঘোষকে তখন‌ ইংল্যান্ডের বিখ্যাত নট গ্যারিকের সঙ্গে তুলনা করে ‘বাংলার গ্যারিক’ বলা হত। গিরিশ আর বিনোদিনীর অভিনয়ে একে একে ‘দক্ষযজ্ঞ’, ‘নল দময়ন্তী’, ‘কমলেকামিনী’ বাংলা নাটকে ঝড় তুলেছে। এরপরে বিনোদিনীর জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় ‘চৈতন্যলীলা’। বাংলা নাটকে তখন উত্কর্ষতার বান‌ ডেকেছে।

মতিলাল শীলের ছেলে গোপাললাল শীল খুলেছেন ‘এমারেল্ড থিয়েটার’। অমৃতলাল হলেন‌ ওখানকার সর্বেসর্বা। কিন্তু বেশিদিন টিকল ‌না। অমর মল্লিক নিয়ে এলেন‌ অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফিকে। এদিকে ততদিনে ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব স্টেজে নতুন ধারার নাটক শুরু হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা নাটকগুলো মঞ্চস্থ হতে লাগল সগৌরবে। মাইকেল মধুসূদন লিখলেন— ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০), ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০), দীনবন্ধু মিত্র লিখলেন ‘সধবার একাদশী’ (১৮৬৫), ‘জামাইবারিক’ (১৮৭২) ইত্যাদি । এই সমস্ত নাটক ক্রমশ একপ্রকার ‘খোঁচা’ দিয়ে যাচ্ছিল বাবুসমাজের রীতি–নীতি, আদবকায়দা, রাজনৈতিক মনোভাবকে এবং নাট্যকারদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, এই বার্তা সাধারণ দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এসব নাটকে মহিলা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ভদ্রসমাজের কোনও মহিলা পাওয়া সম্ভব ছিল না, কারণ নাট্যসমাজ মদ, মেয়েমানুষ ইত্যাদি নিয়ে চলতে থাকত, তাই স্বভাবতই গণিকাদের দিয়ে স্ত্রী-চরিত্র অভিনীত হত তখন। উনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে অবস্থা বদলায়। কালক্রমে নাটক ও থিয়েটার ক্রমশ প্রবেশ করতে থাকে বাংলার ঘরে ঘরে। থিয়েটারে প্রবেশের জন্যে বদলাতে শুরু করল বাংলার বহু ক্ষেত্রের সামাজিক–রাজনৈতিক ও সর্বোপরি মানসিক চিত্র। অন্ধকূপে নিমজ্জিত বাঙালির ঘরে আলো প্রবেশ করতে শুরু করল ক্রমশ। যে বাঙালি আগে ভুল দেখলে চুপ করে থাকত, সেই বাঙালি নাটক ও অন্যান্য বহির্জগতের আলোয় আলোকিত হয়ে ভুলকে ভুল এবং ঠিককে ঠিক বলতে, জানতে ও জানাতে শুরু করে। যে বাঙালি মেয়েরা আগে নিজেদের অস্তিত্ব সমতুল্য করে তুলেছিলেন তাদের স্বামীর অস্তিত্বের সঙ্গে, সেই মেয়েরা ধীরপায়ে হলেও নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে ও পেতে শুরু করেন। অদ্ভুত এক পরিবর্তনের স্রোত বওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল তৎকালীন বাংলায়। ক্রমে ক্রমে শুরু হতে থাকে বাংলায় বহু রকমের নাটকের প্রচার। বিংশ শতক থেকে মোটামুটি শিক্ষিত বাঙালির ঘরে, প্রায় সব শুভ অনুষ্ঠানে জায়গা করে নিত নাট্যাভিনয়। মানুষের ভরসা জন্মাতে থাকল থিয়েটার ও নাটকের ওপর। এর সঙ্গে আবশ্যিকভাবে উল্লেখ করতে হয় ব্রাহ্ম সমাজের অনস্বীকার্য ভূমিকা। তারা ক্রমে যেমন নারীশিক্ষার বিষয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে শুরু করে, তেমনই তার সঙ্গে শুরু হয় ব্রাহ্ম নারীদের থিয়েটারে অভিনয়। এ ব্যাপারে ঠাকুরবাড়ির ভূমিকা অনস্বীকার্য।

এভাবে একদিন বাংলা নাটকের জগৎ বিশ শতকে প্রবেশ করে। বিশ‌ শতকের প্রথম ভাগকে ঐতিহাসিক নাটকের স্বর্ণযুগ বলা যায়। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং সমসাময়িক ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের হাত ধরে বহু কালজয়ী নাটক রচিত এবং অভিনীত হতে থাকে। ‘তারাবাই’, ‘প্রতাপ সিংহ’, ‘নূরজাহান’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘শাজাহান’, ‘মেবার পতন’, ‘দুর্গাদাস’, ‘সিরাজদ্দৌলা’ প্রভৃতি ঐতিহাসিক নাটক এবং ‘কল্কি অবতার’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘পুনর্জন্ম’, ‘আনন্দ বিদায়’ আদি প্রহসন দ্বিজেন্দ্রলালের এবং ‘সপ্তম প্রতিমা’, ‘রঞ্জাবতী’, ‘রঘুবীর’, ‘দৌলতে দুনিয়া’ ইত্যাদি ক্ষীরোদপ্রসাদের উল্লেখযোগ্য নাটক। এই সন্ধিক্ষণে দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। এক, রবীন্দ্রনাথ তাঁর নতুন ধারার নাটক রচনায় পূর্ণ মনোনিবেশ করেন আর দুই, গিরিশচন্দ্র ঘোষের মৃত্যুর পর শিশির ভাদুড়ীর যুগের শুরু হয়। সাধারণ রঙ্গমঞ্চে সূর্য চৌধুরী, নির্মলা মিত্র, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, যোগেশ চৌধুরী প্রমুখ শক্তিশালী অভিনেতাদের প্রবেশ ঘটে। এই সময় রবি ঠাকুর তাঁর রচিত নাটক, প্রহসন নাটক ইত্যাদিতে মেতে ওঠেন। ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব স্টেজে বিভিন্ন নাটক অভিনীত হতে থাকে। ১৮৮১ সনে ‘বাল্মিকী প্রতিভা’, ১৮৮২ সনে ‘কালমৃগয়া’ এবং তাঁর আরও দুটো বিখ্যাত সৃষ্টি ‘রাজা ও রাণী’ (১৮৮৯), ‘বিসর্জন’ (১৮৯০)। গীতিনাট্য পর্বে তিনি আরও দুটি নাটক রচনা করেন। যথাক্রমে ‘চিত্রাঙ্গদা’ (১৮৯২) এবং ‘মালিনী’ (১৮৯৬)। এসব গীতিনাট্যে তিনি নিজেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এরপর রবি ঠাকুর প্রহসন নাটকে মন দেন। ‘গোড়ায় গলদ’ (১৮৯২), ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ (১৮৯৭), ‘হাস্যকৌতুক ও ব্যঙ্গকৌতুক (১৯০৭) এবং ১৯২৬ সনে ‘চিরকুমার সভা’ ও ‘রক্তকরবী’। এছাড়া রূপক আঙ্গিকে তিনি ‘শারদোৎসব’, ‘রাজা’, ‘ডাকঘর’, ‘অচলায়তন’, ‘ফাল্গুনী’, ‘মুক্তধারা’, ‘তাসের দেশ’, ‘কালের যাত্রা’ ইত্যাদি নাটক ১৯০৮ থেকে ১৯৩৩ অব্দি রচনা করে শান্তিনিকেতনে ছাত্রদের রিহার্সাল দিয়ে মঞ্চস্থ করেন।

এরপর কালের বিবর্তনে নাট্যজগতেও পালাবদল ঘটে। ১৯৪২-এর আগস্ট বিপ্লব এবং ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের সময় গঠিত হয় গণনাট্য সংঘ এবং এই সময়ের অন্যতম পুরোধা ছিলেন বিজন ভট্টাচার্য। যাঁরা গণনাট্য আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গেছেন‌ সর্বভারতীয় স্তরে, তাঁরা হলেন‌ কায়ফি আজমী (অভিনেত্রী শাবানা আজমির বাবা), বলরাজ সাহানী, শান্তি বর্ধন, পৃথ্বীরাজ কাপুর প্রমুখ। এই গণনাট্য সংঘের প্রাদেশিক শাখা বাংলায় প্রতিষ্ঠা হয় এবং তাতে ছিলেন‌ সুনীল চ্যাটার্জী, দিলীপ রায়, শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, বিনয় রায় প্রমুখ।

বিজন ভট্টাচার্য কৃত ‘আগুন’, ‘জবানবন্দী’, ভাল নাটক হলেও সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল‌ ‘নবান্ন’। ‘নবান্ন’ গণনাট্য সংঘের প্রথম সফল প্রযোজনা।

এই সময়ে আর-এক বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব হলেন বিধায়ক ভট্টাচার্য। আধুনিক বাঙালি পরিবার যেসব সমস্যাজর্জর, তার বাস্তব চিত্র দেখিয়েছেন তিনি তাঁর নাটকে। তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক ‘মাটির ঘর’ আধুনিক নাটকের পথিকৃৎ। এছাড়া তিনি ‘ক্ষুধা’, ‘মেঘমুক্তি’, ‘তাইতো’, ‘বিশবছর’ ইত্যাদি অনেক উল্লেখযোগ্য নাটক লিখে গেছেন। ১৯৮৬ সনে এই প্রতিভাবান ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে।

গণনাট্য সংঘের হাত ধরে‌ বাংলা নাটক কল্লোল যুগে প্রবেশ করে। ততদিনে এসে গেছেন উৎপল দত্ত তাঁর ‘টিনের তলোয়ার’ নিয়ে। বাদল সরকার নামে এক আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ব্যক্তি তাঁর অদ্ভুত প্রতিভা নিয়ে থার্ড থিয়েটার সৃষ্টি করেছেন। ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ (১৯৬২), ‘বাকি ইতিহাস’ (১৯৬৫), ‘পাগলা ঘোড়া’ (১৯৬৭), ‘ভোমা’ (১৯৭৬) ইত্যাদি করে নিজে ইতিহাস হয়ে গেছেন।

এদিকে গণনাট্য সংঘের সদস্যরা ১৯৪৭ সালের পরে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়েন। সদস্যরা আইপিটিএ-র ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন এবং একই মতাদর্শের সঙ্গে কয়েকটি দল গঠন করে। অহীন্দ্র চৌধুরী, শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র ‘বহুরূপী’-র নেতৃস্থানীয় সদস্য। ‘রক্তকরবী’, ‘তাহার নামটি রঞ্জনা’, ‘চার অধ্যায়’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিত) হল বহুরূপী গ্রুপের প্রথম দিকের কিছু প্রযোজনা। উৎপল দত্ত শিল্পীদের অন্য একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন এবং ‘টিনের তলোয়ার’ এবং ‘কল্লোল’-এর মত ক্লাসিক নাটক তৈরি করেছিলেন। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে অনেক সমালোচকদের প্রশংসিত প্রযোজনার নাটক আয়োজন করা হয়েছিল, যাঁরা আন্তন চেখভ, লুইগি পিরানদেল্লো, হেনরিক ইবসেন এবং বের্টোল্ট ব্রেশটের কাজ-সহ আন্তর্জাতিক সাহিত্য ব্যবহার করতেন। এক সমালোচকের মতে, প্রযোজনাগুলিতে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঠিক মিশ্রণ ছিল— একটি বিপ্লবী ভাষাসৈনিকের প্রতি বিচরণশীল কয়েকটি গোষ্ঠী— এবং সারা বিশ্ব থেকে নির্বাচিত সাহিত্যের উপর ভিত্তি করে মানবিক আদর্শ দেখা যেত নাটকগুলিতে।

আগেই বলা হয়েছে, বিশ শতকের চল্লিশের দশকে বাংলা নাটকের জগতে প্রভূত পরিবর্তন হয়ে গণনাট্য সংঘের সূচনা হয়। নাটক যেহেতু প্রযোজক, পরিচালক, আলোকশিল্পী এবং অন্যান্য কলাকুশলীদের মিলিত প্রচেষ্টার ফসল এবং যেহেতু এটা গ্ৰুপ প্রজেক্ট তাই এর নামকরণ হয় গ্ৰুপ থিয়েটার। ১৯৩১ সনে নিউইয়র্কে ক’জন নাট্যব্যক্তিত্ব মিলে গ্ৰুপ থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন‌। এই ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গণনাট্য সংঘ থেকে ১৯৪৮ সনে একদল বেরিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বহুরূপী’। এই ধারার ‘সুন্দরম’ গ্ৰুপে প্রথম কাজ করেন‌ মনোজ মিত্র। মনোজ মিত্রের লেখা প্রথম নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’ (১৯৫৮), তারপর ১৯৬০ সালে ‘ত্রিংশ শতাব্দী’। মনোজ মিত্রের বহু আলোচিত উল্লেখযোগ্য নাটক হল‌ ‘চাকভাঙা মধু’, ‘নরক গুলজার’, ‘সাজানো বাগান’, ‘কালবিহঙ্গ’ ইত্যাদি।

এই সময়কালে বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্বরা হলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, কেয়া চক্রবর্তী (দুর্ঘটনায় অকালপ্রয়াত), শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, উৎপল দত্ত, বাদল সরকার, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, রুমা গুহঠাকুরতা, মনোজ মিত্র, উষা গাঙ্গুলি এবং শাঁওলি মিত্র প্রমুখ।

পরিশেষে বলি, এই নাট্যধারার জ্বলন্ত মশাল বর্তমান সময়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত সামনের দিকে যাঁরা, তাঁদের মধ্যে ব্রাত্য বসু, দেবশংকর হালদার, গৌতম হালদার উল্লেখযোগ্য।

তথ্যঋণ

১) নাট্যশাস্ত্র ভরতমুনি।। বঙ্গানুবাদ: ড. সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ছন্দা চক্রবর্তী
২) international journal of creative research and thoughts article by Ghanashyam Roy
৩) কলকাতার গ্ৰুপ থিয়েটার।। উইকিপিডিয়া
৪) বিশ শতকে নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস।। গৌতম জানা
৫) আঠেরো উনিশ শতকের কলকাতার থিয়েটার ও সমাজ: পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিবর্তনের একটি আলোচনা।। সৃজনী দাস, সপ্তডিঙা সাহিত্য পত্রিকা, তৃতীয় সংখ্যা, ১৪২৭।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব

আমাদের খেলা করা দরকার, তাই আমাদের কয়েকজন ছেলে মিলে ক্লাব তৈরি করতে হবে। কোথায় করা যায়? — অমুক জায়গায় — ওই জায়গাটা পড়ে আছে, তা যাদের জায়গা তারা বললেন, “ওই তো ওখানে জঙ্গল হয়ে আছে, তা যদি তোমরা জঙ্গল-টঙ্গল পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে ক্লাব তৈরি করতে পার তো করো।” আমাদের আর পায় কে — আমরা মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলে। উদ্ধার করলাম। উদ্ধার-টুদ্ধার করে এর বাড়ি থকে চারটে বাঁশ, ওর বাড়ি থেকে তিনটে হোগলা এভাবে যোগাড়-যন্ত্র করে-টরে একটা চালাঘর তৈরি করা হলো। সেই চালাঘরকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে আমাদের নতুন লাইব্রেরী তৈরি হলো। ক্লাবের নাম হলো ‘সেনহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাব’।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো! সেই থেকেই ‘বাগনান’!

ছোট্ট ওই ভূখণ্ডটি বাঘের উপস্থিতির জন্যই তখন ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয় বলে প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরার অভিমত। এই বিষয়ে তিনি আরও জানান, আরবি ভাষা অনুযায়ী ‘নান’ কথার অর্থ হল ‘চরভূমি’। ‘নান’ শব্দের আরও একটি অর্থ হল ‘ছাউনি’। তখন কাছারিপাড়া ছাড়াও নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় ইংরেজ সেনাদের ছাউনি ছিল বলে জানা যায়। যার মধ্যে খাদিনান, পাতিনান, খাজুরনান, বাইনান, চিৎনান, মাছিনান ইত্যাদি জনপদগুলি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু নদীর চরে বাঘেশ্বরী দেবীর পুজো হত, সেই জন্য প্রাথমিকভাবে এলাকাটি ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ‘বাঘনান’ অপভ্রংশ হয়ে ‘বাগনান’-এ পরিণত হয়েছে।

Read More »
আবদুল্লাহ আল আমিন

কবিগান: সমাজবাস্তবতা, বিষয়বৈভব ও রূপবৈচিত্র্য

এমন লোকপ্রিয় বিষয় বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা ভাষা, সঙ্গীত ও সাহিত্যে কবিগান ও কবিয়ালদের অবদানের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগান সংগ্রহ এবং এ বিষয় পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে কবিয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কিংবা কবিগানকে সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক এ গানকে সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই গানের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে লোকায়ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক যার অধিকাংশই অনালোচিত ও অনালোকিত রয়েছে অদ্যাবধি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »
দীপক সাহা

বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়ে ইতিহাসকে লেন্সবন্দি করেছেন সাইদা খানম

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে উপমহাদেশের বিখ্যাত প্রায় সকল ব্যক্তিত্ব— ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী, বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আশাপূর্ণা দেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়— কার ছবি তোলেননি! সেই সঙ্গে রানি এলিজাবেথ, মাদার টেরেসা, মার্শাল টিটো, অড্রে হেপবার্নের মতো বিখ্যাত মানুষদের ছবিও তুলেছেন। এই বিশাল তালিকায় আরও তিনটি নাম যুক্ত করে না দিলে অন্যায় হবে। চন্দ্রবিজয়ী নিল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিনস, মাইকেল কলিন্সের ছবিও তুলেছেন তিনি।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

মামলায় জয়ী হয়ে থোড় কুঁচি দিয়ে কালীর আরাধনা করেন জমিদার-গিন্নি

দেবী কালিকার খড়ের মেড় দেখে মজুমদার গিন্নি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, মামলার রায় যদি তাঁদের পক্ষে যায় তাহলে কলাগাছের থোড় কুঁচো দিয়ে হলেও জগজ্জননী মা মহাকালীর পুজো করা হবে, আর যদি মামলার রায় তাঁদের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে ওই খড়ের মেড় দামোদরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। যদিও সেদিন দুপুরের মধ্যেই আদালত থেকে মজুমদার জমিদার পক্ষের জয়লাভের খবর পৌঁছেছিল থলিয়ার মজুমদার বাড়িতে। মজুমদার-গিন্নিও অক্ষরে অক্ষরে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। মামলায় জয়লাভের খবর পাওয়া মাত্রই জমিদার-গিন্নির নির্দেশে প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দীপাবলি উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে যায়।

Read More »