Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

মালদার শতাব্দীপ্রাচীন গঙ্গালাহানি মেলা

নদীর ধার ঘেঁষে রাতারাতি বসে গেছে বেশ কয়েকশত দোকান। খাবারদাবার থেকে আরম্ভ করে লোহা এবং কাঠের জিনিসপত্র, মণিহারি জিনিস, গয়নার দোকান মিলিয়ে চেনা ঘাটগুলি একদিনের জন্য আস্ত একটা মেলার চেহারা নিয়েছে। মানিকচকের রাজমহল ঘাট পঞ্চানন্দপুর পাগলাঘাট, নাজিরপুর ঘাট বা সাদুল্লাপুর ঘাটে শতাব্দীপ্রাচীন গঙ্গালাহানি মেলায় মেতে ওঠেন স্থানীয় এবং বাইরে থেকে আসা লক্ষাধিক মানুষ। মেলা ছাড়াও হয়েছে রীতি মেনে গঙ্গাপূজা। বসেছে বাউল গানের আসর। মাঘী পূর্ণিমার গঙ্গা স্নানযাত্রাকে কেন্দ্র করে প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন এই মেলা আধুনিকতার দাপট এড়িয়েও বজায় রাখতে পেরেছে তার লোকঐতিহ্য।

কেন এমন অদ্ভুত নাম এই প্রাচীন মেলার? উত্তর দিতে গিয়ে খোট্টা ভাষা গবেষক ড. পতিতপাবন চৌধুরী বলেন, ‘‘মানিকচক, রতুয়া এবং মোথাবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের লক্ষাধিক মানুষের কথ্য খোট্টা ভাষার প্রভাবেই এমন নাম। খোট্টা মৈথিলিতে হিন্দি স্নানযাত্রা বা ‘নাহানি’ পরিবর্তিত হয়ে ‘লাহানি’ হয়েছে। তাই এই মেলাকে এককথায় গঙ্গাস্নানের মেলা বলা যেতেই পারে।’’

মাঘী পূর্ণিমার গঙ্গাস্নানের সঙ্গে পাপমোচনের এক সামাজিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য আছে।

মাঘী পূর্ণিমার গঙ্গাস্নানের সঙ্গে পাপমোচনের এক সামাজিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য আছে। রয়েছে বাড়ির অন্তঃপুরের মহিলাদের বছরের একটা দিনের জন্য ঘরের বাইরে বেরিয়ে গঙ্গাস্নানের পর নদীর ধারে খোলামেলা চড়ুইভাতি বা কেনাকাটি করার স্বাধীন আনন্দের স্বাদ পাওয়া। অনেকে গঙ্গাস্নান করার পর ডাব, কলা আর ফুল দিয়ে নিষ্ঠাভরে গঙ্গামাইয়ার পূজা করেন।

মানিকচকের লালবাথানি গ্রামের ষাটোর্ধ্ব প্রবীণা ঝর্না রায় এই মেলায় প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আগে গ্রাম থেকে ফুল, মালা আর রঙিন ফিতে দিয়ে সুন্দর করে সাজানো গোরুর গাড়ি ভাড়া করে সমস্ত মেয়ে-বউরা নদীর ধারে আসত। বাড়ি থেকে রান্না করে আনা লুচি, ছোট আলুর তরা (কথ্য খোট্টা মৈথিলিতে অর্থ তরকারি), বাঁধাকপির ঘন্ট, বুনিয়া (কথ্য খোট্টা মৈথিলিতে অর্থ বোঁদে) আর নানা খাবারদাবার নিয়ে গঙ্গাস্নান করার পর পূজা করে সবাই মিলে বসে খাওয়া হত। অনেকে নদীর ধারে খিচুড়ি রান্না করত। আশপাশের দোকান আর মেলা থেকে মিষ্টি কিনে নেওয়া হত। বছরেরই একটা দিনের জন্য সকলেই সমান। এমনও হয়েছে যে গোরুর গাড়ি ভাড়া করেছে, তার পরিবার আর যে গাড়োয়ান, তার পরিবার একইসঙ্গে গঙ্গালাহানির মেলায় গেছে।’

মৈথিল জনসংস্কৃতির লোকাচারও মিশে রয়েছে এই একদিনের উৎসবের মধ্যে।

এই মেলার সঙ্গে মিশে থাকে হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের কিছু প্রাচীন সংস্কার। লোকসংস্কৃতিবিদদের একাংশের মতে, এই বিশেষ মেলা এই দুই প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। কেননা, গৌড়বঙ্গে এই দুই ধর্মের শাসকরাই একসময় রাজত্ব করেছেন। মানিকচক, মোথাবাড়ি ও রতুয়া অঞ্চলে বসবাসকারী মৈথিল জনসংস্কৃতির লোকাচারও মিশে রয়েছে এই একদিনের উৎসবের মধ্যে। ত্রিপিটক-এ আছে, এই মাঘী পূর্ণিমার দিনে ভক্তদের উদ্দেশে অন্তিম উপদেশ দান করেছিলেন ভগবান বুদ্ধ। আবার প্রচলিত হিন্দু সংস্কারে, এই মাঘী পূর্ণিমার দিন গঙ্গাস্নান করলে রোগশোক থেকে মুক্তি, জরামুক্তি এবং পাপমুক্তি ঘটে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’ উপন্যাসেও ইছামতী নদীর তীরে গ্রামের সমস্ত মেয়ে-বউদের গোরুর গাড়িতে করে গিয়ে গঙ্গাস্নানের মেলায় যাওয়ার উচ্ছ্বাস এবং নদীর তীরে বনভোজনের স্মৃতি বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে রয়েছে।

বাঙ্গিটোলা গ্রামে বসবাসকারী নতুন প্রজন্মের তরুণী সর্বাণী ঝা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে মায়ের সঙ্গে গঙ্গালাহানি মেলায় গিয়ে গঙ্গাস্নান করেছি। এখন নতুনদের মধ্যে এসবের প্রচলন কমে গেছে বটে তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে এতে মানসিক শান্তি পাই। হাজার হাজার মানুষ টোটো ভাড়া করে পাশের গ্রামগুলো থেকে, এমনকি গাড়ি ভাড়া করে শহর থেকেও এই দিনটায় পাগলাঘাটে আসেন।’

এই মেলার সঙ্গে মিশে থাকে হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের কিছু প্রাচীন সংস্কার।

তবুও মানুষ মুক্তি চায়। অনেক না বলা যন্ত্রণা, চেপে রাখা চোখের জল, গোপন পাপ থেকে মুক্তি। রতুয়ার বাহারালের সেই পঞ্চাশোর্ধ্ব যেমন। অন্ধকারে বুঝতে না পেরে শেয়াল ভেবে মাছমারা কোঁচের ঘায়ে মেরে ফেলেছিলেন আট বছরের ভাইকে— তখন তার বয়স বারো। থানা-পুলিশ-জেল আর অনুতাপের আগুনে নিজেকে পুড়িয়ে ছাই করে যখন বেরিয়ে এলেন, তারপর থেকে একটা বছরও বাদ দেননি গঙ্গালাহানির মেলায় আসতে। একা আসেন— একা একাই দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন জলে। গঙ্গামাইয়ার ঠান্ডাজল বুক ছাড়িয়ে গলা অবধি উঠে আসে, কিন্তু জ্বালা কমে কই? তার শরীরের ওপর দিয়েই চুপচাপ বয়ে যান পতিতোদ্ধারিণী জাহ্নবী— তিনি তো সবার মা; ‘খুনি’-রও।

চিত্র: সৌমেন্দু রায়
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সোমেন চন্দ: এক বহ্নিময় কথাকার

মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন, যদিও তা অসমাপ্ত থাকে। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘বন্যা’। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি অসমাপ্ত-ই থেকে যায়। আরও দুঃখের বিষয়, এর বৃহদংশ হারিয়েও গেছে। আজ যে সোমেন চন্দের লেখককৃতির জন্য আমরা তাঁকে স্মরণ করি, তা হল তাঁর বেশ কিছু অসামান্য ছোটগল্প। সংখ্যায় খুব বেশি নয়, মাত্র চব্বিশটি। আরও কিছু গল্প লিখলেও তা কালের ধুলোয় হারিয়ে গেছে। গল্পের সংখ্যা সামান্য, তবে অসামান্যতা রয়েছে সেগুলির রচনার পারিপাট্যে, বিষয়বস্তু চয়নে, শিল্পিত প্রকাশে ও লেখনীর মুনশিয়ানায়। এছাড়া তিনি দুটি নাটিকাও লেখেন, ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রস্তাবনা’। লেখেন কিছু প্রবন্ধ। তাঁর ছোটগল্পগুলি এতটাই শিল্পোত্তীর্ণ ছিল যে, তাঁর জীবিতকালেই একাধিক ভাষায় তা অনূদিত হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »