নাম ওলেমি (Wollemi)। পাইন জাতীয় এই বৃক্ষটি পৃথিবীতে রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। যখন ধরাধামে চরে বেড়াত ডাইনোসরেরা, তার আগে থেকেই তারা পৃথিবী গ্রহের বাসিন্দা। ওলেমি গাছের প্রাচীনতম জীবাশ্মটির বয়স ২ কোটি বছর বলে জানা গিয়েছে। মাত্র ৬০ হাজার বছর আগে ধরণিতে আসা আধুনিক মানুষের তাই ওলেমি গাছ নিয়ে বিস্ময়ের অন্ত নেই। গত বছরের গোড়ায় অস্ট্রেলিয়ায় সর্বগ্রাসী বনাগ্নির হাত থেকে তাদের রক্ষা করেছে মানুষই। না হলে বিশ্ব থেকে চিরতরে মুছে যেতে পারত আদিমতম তরু-প্রজাতিটি।
সর্বনাশের হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে এই তথাকথিত ‘ডাইনোসর ট্রি’। গতবছর জানুয়ারিতে। ভয়ংকর দাবানল দুঃস্বপ্নের মত নেমে এসে অস্ট্রেলিয়ার নববর্ষ উদযাপনের আনন্দে জল ঢেলে দেয়। সেই সর্বনাশা আগুনে বাস্তুচ্যুত হয় লক্ষ লক্ষ বন্যপ্রাণ। ঘটনার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সচেতন নাগরিক এবং অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরা তৎপরতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেন। তাতেই রক্ষা পেয়ে যায় অনেক রকম প্রাণী এবং গাছ, বিশেষত প্রাগৈতিহাসিক গাছের প্রজাতিটি। তারপর অস্ট্রেলিয়ান প্রশাসনের সেই ঘোষণা আশ্বস্ত করে গোটা বিশ্বকে, তারা সিডনির দক্ষিণাঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক ওলেমি গাছের অন্তিম বাসস্থানটি সাফল্যের সঙ্গে রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছেন।
কিন্তু দুর্গম পর্বতমালা ব্লু মাউন্টেনস পেরিয়ে কীভাবে ওলেমি বৃক্ষের জঙ্গলকে বাঁচানো সম্ভব হয়? জানা যায়, সপ্তাহখানেকের চেষ্টায় দাবানলের লেলিহান আগুন আর দুর্গম পর্বতমালা ব্লু মাউন্টেনসের বাধা ডিঙিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ২০০টি ওলেমি পাইনের জঙ্গলে পৌঁছয় সাহসী দমকলকর্মীদের হেলিকপ্টারগুলি। তাতে ছিলেন বিশেষজ্ঞ অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরা। ওলেমি গাছবসতিতে পৌঁছেই গাছগুলিকে আর্দ্র রাখতে মরিয়া লড়াই শুরু হয় তাদের। তৈরি করা হয় জলসেচ ব্যবস্থা। বনাগ্নি যাতে ওলেমি জঙ্গলকে ছুঁতে না পারে, তার জন্য নিকটবর্তী জলাশয়ের সন্ধান চালানো হয় এবং সেখান থেকে পাম্পের মাধ্যমে প্রতিদিন জল ঢেলে ভিজিয়ে রাখা হয়। পাশাপাশি, অগ্নিনির্বাপক বিমান সুকৌশলে গ্যালন গ্যালন জল ঢেলে আগুন প্রশমনে সাহায্য করে।
ওলেমি পাইন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গাছের প্রজাতি-বিশেষ, যেহেতু এটি কেবল অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে। এই বৃক্ষ-প্রজাতির স্থানিকতাই এর বিপদ। প্রাণী বা গাছের ক্ষেত্রে স্থানিক তখনই বলা হয়, যখন কোনও প্রজাতিকে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়া অন্য কোথাও দেখা যায় না। তো সেই স্থানিকতার কারণেই ওলেমি পাইন বনাঞ্চলের মধ্যে ক্ষুদ্র বৃক্ষসমষ্টি হয়ে রয়ে গিয়েছে। তাদের প্রাণশক্তি এতটাই যে, লক্ষ লক্ষ বছর আগে ডাইনোসররা পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেলেও আশ্চর্যজনকভাবে ওলেমি গাছেরা টিকে রয়েছে। ওলেমি পাইন সেইসব প্রাণের মধ্যে অন্যতম, যাদের ‘জীবিত জীবাশ্ম’ বলা হয়। ১৯৯৪-তে এর অস্তিত্ব আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত ওলেমিকে পাওয়া গিয়েছে শুধু জীবাশ্ম আকারেই। দাবানলের গ্রাসে পড়ে সেই অস্তিত্বটুকুও লোপ পেতে বসেছিল। শেষমেশ মানুষের দৌলতে শেষরক্ষা হয়েছে।
অবশ্য সর্বগ্রাসী বনানলের হাত থেকে অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিকে বাঁচাতে পারেনি মানুষ। ন্যাশনাল পার্কস অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিসের তরফে বলা হয়েছে, আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় ৫১০,০০০ হেক্টর বনভূমি। ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর থেকে চলা দাবানলে মৃত্যু হয়েছে লক্ষ লক্ষ বন্যপ্রাণী এবং ২৮ জন মানুষের। পুড়ে খাঁক হয়েছে ২৬০০ বাড়ি এবং নিউ সাউথ ওয়েলসের ১০.৩ মিলিয়ন হেক্টর জমি। ১ মিলিয়নে ১০ লক্ষ হলে, সংখ্যাটা হিসেব করুন! এবং ছাই হয়ে গিয়েছে জগতে ওলেমি গাছের একমাত্র ঠিকানা ওলেমি ন্যাশনাল পার্কের ৫,০০০ হেক্টর জমির ৯০ শতাংশ এলাকাও। এত বিপুল বিপর্যয়ের মধ্যেও নিতান্ত আশার খবর, ওলেমি গাছের রক্ষা পাওয়া। দুনিয়ার প্রাচীনতম বৃক্ষ-প্রজাতিকে রক্ষা করতে এই ওলেমি ন্যাশনাল পার্কের অবস্থান সাধারণের কাছে গোপন রাখা হয়েছে।