Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

‘সভ্যতার আলো’য় নিষ্প্রভ জোনাকিদের জীবনে অদ্ভুত আঁধার

উড়ন্ত আলোর প্রাণী জোনাকি নিয়ে আপনার কোনও স্মৃতি আছে? প্রকৃতি-দৃশ্যে জাদুকরী সংযোজন এই পতঙ্গ পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলে আপনার কিছু আসে-যায়? উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’, তবে আপনার জন্য মনখারাপ করা সংবাদ আছে। মৌমাছি, ভ্রমর, প্রজাপতি, নানা পাখি ও উভচরের পথেই এই জোনাকিরা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। কারণটি সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও জোনাকিদের এই দুর্গতির জন্যে অপরিণামদর্শী মানুষের তিনটি কৃতকর্মকে দায়ী করা যাচ্ছে: বনবাদাড় ও জলাভূমি ধ্বংস করে অবাধ বসতি ও আবাস নির্মাণ, কীটনাশক হিসেবে বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার এবং আলোক দূষণ। ‘সভ্যতার আলো’-য় নিষ্প্রভ জোনাকিদের জীবনে ক্রমে ঘনিয়ে আসছে অদ্ভুত আঁধার।

কেন এই পরিস্থিতি জানার আগে জোনাকি-জীবন সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে রাখা ভাল। ক্ষুদ্রাকৃতি উল্কার মত ছুটে চলা এই অত্যাশ্চর্য পতঙ্গটিকে রাতের বেলা আকাশের তারার মত মিটমিট করে জ্বলতে দেখা যায়। তাদের তলপেটের কাছে স্বয়ংপ্রভ নীলাভ-সবুজ ঝলমলে আলোটি আসলে শরীর নিঙড়ে বের করা। এই আলো-পোকারা অক্সিজেন শোষণ করে এবং নির্দিষ্ট কোষের মধ্যে লুসিফেরিন নামক এক রাসায়নিক পদার্থের মিশেলে তাপহীন আলো তৈরি করতে সক্ষম। শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত এই দ্যুতিকে লুমিনেসেন্স হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এই কোল্ড লাইট বা মৃদু‌ আলো তারা উৎপন্ন করে কোনও আল্ট্রাভায়োলেট বা ইনফ্রারেড তরঙ্গ ছাড়াই। এই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ৫১০ থেকে ৬৭০ ন্যানোমিটার।

বিশ্বের গ্রীষ্মপ্রধান এবং নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডল অঞ্চলে জোনাকির প্রায় দু’হাজার প্রজাতি রয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি প্রজাতির জোনাকির স্ত্রীরা উড়তে পারে না। যদিও সব প্রজাতির জোনাকি আলো উৎপন্ন করতে পারে। এই আলোর রং প্রজাতিভেদে হলুদ, সবুজ এবং ঈষৎ লাল হয়ে থাকে। বেশিরভাগ প্রজাতির জোনাকি বনে-বাদাড়ে বিভিন্ন জলাশয় বা জলাভূমির কাছে আস্তানা গাড়ে। তাদের পছন্দের পরিবেশটি উষ্ণ, আর্দ্র এবং যেকোনও জলের কাছাকাছি; যেমন পুকুর, জলধারা, নদী ও অগভীর জলাজমি, যা আশপাশের জমির চেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে জল ধরে রাখে। ভেজা পচা কাঠ এবং বৃক্ষজাত জঞ্জাল থেকে খাদ্যগ্রহণ করে জোনাকির লার্ভা বেড়ে ওঠে। লার্ভা থেকেও আলো নির্গত হয়, তাই এদের গ্লোওয়ার্ম বলে।

প্রধানত সঙ্গমের উদ্দেশ্যে এই আলোসজ্জায় সেজে ওঠে জোনাকি। মিলনপিয়াসী পুরুষ ও স্ত্রী জোনাকি পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে, খুঁজে পেতে, অনাহূত অতিথিদের দূরে রাখতে এবং মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে আলো উৎপন্ন করে। স্ত্রী জোনাকি দু’ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে এবং পুরুষ জোনাকি মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্যই এই আলো নির্গত করতে পারে। অবাক করার বিষয়, জোনাকিরা সমবেতভাবে একছন্দে মিটমিট করতে পারে এবং এই আলো উৎপাদনে অবাক করা পারদর্শিতা দেখায়। আলোকসজ্জার বাল্বগুলি কেবলমাত্র ১০ শতাংশ শক্তিকে আলোকে রূপান্তরিত করে, বাকি ৯০ শতাংশ তাপের আকারে ছড়িয়ে যায়। অথচ জোনাকি নিজের শরীরে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ১০০ শতাংশ শক্তিকেই তাপহীন আলোকে রূপান্তরিত করতে সক্ষম।

এমন আশ্চর্য ক্ষমতা সত্ত্বেও জোনাকি ক্রমে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি থেকে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বনজঙ্গল সাফ করে, জলাভূমি বুজিয়ে যত্রতত্র বসতি ও আবাস নির্মাণের দরুন জোনাকির আবাসস্থল সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় ও শামুক খেয়ে জোনাকি কৃষকের উপকার করলেও কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক হিসেবে ব্যবহৃত রাসায়নিকের বিষে লার্ভা অবস্থাতেই ধ্বংস হচ্ছে জোনাকির বংশ। সবচেয়ে মুশকিল করেছে ‘সভ্যতার আলো’। রাতভর আলো জ্বলছে চতুর্দিকে। পথবাতি থেকে আবাসন, দোকানপাট সর্বত্র আলোময়। সঙ্গে গাড়ির হেডলাইটের ঝলকানিও তমোমণি পতঙ্গটিকে কার্যত অন্ধ করে ফেলছে। এই অনাসৃষ্টি জোনাকির সৃষ্টি ও সুখে মস্ত বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিকভাবে থমকে যাচ্ছে বংশবিস্তার।

কাব্যের জোনাই সংস্কৃতে খদ্যোৎ, হিন্দিতে জুগনু, বাংলায় জোনাকি, ইংরেজিতে Firefly। প্রায় সব ভাষারই রূপকথায়, লোকগাথায়, কাব্য-গানে, গল্প-ছবিতে তাদের অমলিন উপস্থিতি। জোনাকিরা দীপ জ্বেলে চিরকাল মানুষের মনে আশার আলো জাগিয়েছে। গ্রীষ্মের রাতে ঝোপঝাড়, মাঠপ্রান্তর এবং আমাদের হৃদয় আলোকিত করে স্বল্পায়ু মানুষকে প্রাণের রসদ যুগিয়েছে। অথচ ‘আঁধার মানিক’ জোনাকিদের বংশবিস্তার থমকে যাচ্ছে ক্রমবর্ধমান মানুষের ‘অমানুষিক’ অত্যাচারে। প্রাণীশ্রেষ্ঠ হওয়ার অহমিকায়‌ যে মানুষ বাকি জগৎকে তুচ্ছ করতে শিখেছে! আবার, আলোসখা পতঙ্গটিকে বিলুপ্তির দোরগোড়া থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে সম্ভবত মানুষই। সেই মানুষের সুমতি হোক। সেই মানুষের মনের অন্ধকুঠুরিতে এসে বসুক একটি জোনাকি!

চিত্র : গুগল
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »