The more successful the villain, the more successful the picture. মোক্ষম ভিলেন বোঝাতে হিচককের এই উক্তি কিনা জানি না। কিন্তু আমরা সকলেই বুঝি, গব্বর সিং বা মোগাম্বোর মত ট্রেডমার্ক ভিলেন ছাড়াও ভিলেন আমরা সিনেমায় বহু দেখেছি। এবং তাদের প্রতিই আমাদের আগ্রহ বেশি। তারাই অনেক সিনেমার চালিকাশক্তি, উতরে দিয়েছে অতি সাধারণ সিনেমাও। যদিও ‘শেষ অঙ্ক’ একটি অসাধারণ গল্প, মেকিং অনেক ইন্টারন্যাশনাল ছবিকে গোল দিতে পারে। প্রথাগত ভিলেন চরিত্রের বাইরে ধূসর চরিত্রের নিদর্শন এই ছবির শ্রেষ্ঠতা। ছবির শুরুর দিকেই আমরা দেখব, সুধাংশু গুপ্তর (উত্তমকুমার) খানসামা আবদুল গৃহস্বামীর একশো টাকা ফেরত দেয়, ইস্তিরি করার সময় কোর্টের পকেটে ছিল। পরক্ষণেই মালিকের অনুপস্থিতিতে সোফায় বসে মালিকেরই সিগারেট হাতসাফাই করে টি-টেবিলে পা তুলে নাচাতে নাচাতে খেতে দেখি। ওদিকে করণাক্ষ সমাদ্দার (বিকাশ রায়) টেলিফোন করে। আবদুলের কাছে খোঁজ নেয় সুধাংশু গুপ্ত কখন বাড়ি ফিরবে, আলমারির ডুপ্লিকেট চাবির। তারপরই আমরা শুনতে পাই, করণাক্ষ সমাদ্দার এখানে সেলিম মিঞা, ইম্ফলে রমণীমোহন হালদার, মিস লতা বোসকে (সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) একটা মঙ্গলসূত্র পরে নিতে দেয়। কুমারী লতা দ্বিধা করে, মি. সমাদ্দার মণিপুরে জেলহাজতের হুমকি শোনায়। ওষুধে কাজ দেয়। লতা প্রস্তুত হয় মি. গুপ্তর মৃতা স্ত্রী সাজতে। এদিকে সুধাংশু গুপ্ত সান্ধ্যভ্রমণে বেরোচ্ছে, সঙ্গে হবু-স্ত্রী সোমা (শর্মিলা ঠাকুর), তাদের বাড়ির খানসামা আড়াল থেকে তীক্ষ্ণ নজরে খেয়াল করে হবু দম্পতির গতিবিধি। গাড়ি থেমে যায়; লেভেল ক্রসিং পড়েছে। জোরে ট্রেন যাচ্ছে, আর ভেঙে যাচ্ছে সুধাংশুর চেহারা; কিছু পূর্বেই মন্দস্ত্রী মন্দভাগ্যের স্মৃতিচারণায় যা ছিল বেদনাসিক্ত। সন্দেহে সোমার ভ্রু কুঁচকে ওঠে, কিলবিল করে ওঠে আমাদের ভিতরটা। সব চরিত্রের ভিতরই দেখতে পাই একটা অঙ্ক, একটা গরমিল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, রূঢ় বাস্তবজীবনের ঐকিক নিয়মে তার হিসেব চালিত। এবং ছবি জুড়ে শেষ পর্যন্ত যা চলে।
এখানেই ছবির পরিচালকের বাজিমাত, কাহিনিকারের কলমের জোর। এই ছবির কাহিনিকার রাজকুমার মৈত্র মনুষ্যচরিত্রের প্রতিটি কোনায় টর্চ ফেলেছেন আর পরিচালক হরিদাস ভট্টাচার্য চিমটে দিয়ে দিয়ে তুলেছেন আত্মার পোকা। খুবই সহজসরল গল্প, ছবিতে ততোধিক নিটোল। সুধাংশুর স্ত্রী কল্পনা ছিল বিকারগ্রস্ত। মানসিক তাড়নায় রেললাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। সুধাংশু পুনরায় বিবাহের সিদ্ধান্ত নেয় স্যার হরপ্রসাদ (পাহাড়ী সান্যাল)-এর কন্যা সোমাকে। এইসময় কল্পনা ফিরে আসে। সুধাংশু তাকে স্ত্রী হিসেবে চিনতে অস্বীকার করলেও তার কাছে সমস্ত প্রমাণ মজুত। এখানে গল্পের গতি স্বাভাবিক, যা ছবিতেও সঞ্চালিত। সম্পূর্ণ কাহিনিচিত্র আলো-আঁধার, ধরা-অধরা, সিন্দুকবদ্ধ; অথচ আমরা সকলেই জানি, সিন্দুকের চাবি কার কাছে, কে সিন্দুক খুলেছে, অবশেষে কি পাওয়া যাবে সিন্দুক ভেঙে। তবুও আমরা ঠায় বসে থাকি, নিষ্পলক প্রশ্নময় অপেক্ষা করি কী ঘটতে চলেছে পরের দৃশ্যে, আল্টিমেটলি সুধাংশুর পরিণতি। আমরা জানি আলমারি খুলে সুধাংশু যে ছবির অ্যালবাম বের করবে সেসব ছবিই এখন যে দাবি করছে তার মৃতা স্ত্রী, তারই। আমরা নিশ্চিত কল্পনার দাদা (তরুণকুমার) মিস লতা বোসকেই তার ভগ্নী হিসেবে চিহ্নিত করবে। তবুও আমাদের বুক ছ্যাঁৎ করে উঠবে কখন সেই অপেক্ষায় থাকি। অদৃষ্ট এমনই। জগদীশ গুপ্তর ছোটগল্প। দিবসের শেষে। সরল গ্রাম্য শিশুটি জানে তাকে আজ কুমিরে নেবে; প্রতিটি পদক্ষেপে তার ভীতিপ্রদ সংশয় সঞ্চালনা তাকে ক্রমশ কুমিরের দিকে টেনে যায় এবং আমাদেরও টেনে নিয়ে চলে। সেখানেই এই ছবির কাহিনিকার এবং পরিচালকের কেরামতি।
তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্যামেরা এবং আলোর ব্যবহার। যেহেতু কোর্টরুম ড্রামা, ইনডোর সেহেতু ছবির অধিকাংশ দৃশ্যই তোলা ক্লোজশট, মিড ক্লোজশটে। সুধাংশুর দরজার আড়ালে লুকিয়ে আছে মি. সমাদ্দারের মুখ, দরজার গায়ে সুধাংশুর মুখের ছায়া এগিয়ে আসার দৃশ্যটা ভাবুন। প্রচণ্ড বিপাকগ্রস্ত সুধাংশুর নেপথ্যে ট্রেন চলার শব্দে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে মুখের সিলিউট ক্লোজআপের ছবিটা ভাবুন। বাইরে গাড়ি দাঁড়ানো গ্যাসবাতি এবং গাড়ির পিওভি-তে সুধাংশুর সুরেনবাবুর (কমল মিত্র) দরজায় নক করার ফ্রেমে আলোর ব্যবহার যে কোনও ছবির সম্পদ। ষাটের দশকে বেশকিছু ছবির চিত্রশিল্পী কানাই দে। আমার মনে হয় আলোকবিজ্ঞানী। তাঁর চিত্রশিল্পিত যে কোনও ছবিতেই আলোকসম্পাত, ফ্রেম টু ফ্রেম দৃশ্যের বুনন, সাদা-কালোর মধ্যেই টেনশন এঁকে চলার জন্য রীতিমত আলোকশিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। কিছুটা ত্রুটি চোখে পড়ে এডিটিংয়ের ক্ষেত্রে। ফ্রেমের গায়ে ফ্রেম লেগে থাকে, ওঠাপড়া নেই, তাই কিছু দৃশ্য ফ্ল্যাট মনে হতে পারে।
তবে অভিনয় এ ছবিকে প্রতিষ্ঠা দেয়, সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতিও ঢেকে দেয় অনায়াসে। তারমধ্যে প্রথমেই বলতে হয় বিকাশ রায়ের কথা। এই ছবিতে তিনি তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তারজন্য কিন্তু ছদ্মবেশ, মেকআপ বা একটুও আয়াস করতে হয়নি। সুধাংশুর দ্বিতীয়বারের বিবাহ আসরে, পুলিশ অফিসার মি. চ্যাটার্জির দপ্তরে নমস্কারের ভঙ্গিমা, কৌণিক দৃষ্টি, ঈষৎ পিঠ বাঁকিয়ে দাঁড়ানোর দৃশ্যে তাঁকে স্বভাবতই শুঁটকিমাছ বিক্রেতা বা নাগর মনে হবে। মিস লতার সঙ্গে ব্যবহারের দৃশ্যে তাঁকে মনে হবে দালালদের পাণ্ডা। আবার কোর্ট প্যান্ট পরনে সুধাংশুকে ইন্টারোগেশন করার দৃশ্যে তিনি যথার্থই গোয়েন্দাপ্রবর। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় তাঁর মতই সাবলীল। যে কোনও চরিত্র হয়ে উঠতেই তিনি মানানসই হয়ে উঠতে জানতেন। পাহাড়ী সান্যাল তাঁর মতই যথাযথ। এ ছবিতে শর্মিলা ঠাকুরের কিছু করার ছিল না। অবাক করেন কমল মিত্র। যথাবিবিধ এলিট, গাউন গায়ে, নায়ক বা নায়িকার বাবার বাইরে পুরোদস্তুর অন্য ভূমিকায়। বিশেষত এজলাসে দাঁড়িয়ে ব্যারিস্টার মিত্তিরের (উৎপল দত্ত) সওয়াল জবাবের দৃশ্যে তিনি নজরকাড়া। আরেকজন, যিনি অনেকানেক ছবিতেও ব্লটিং পেপারের মত শুষে নিতে পারেন সহ-অভিনেতার কৌশল, সকল কারিকুরি; তিনি তরুণকুমার। শেষ কয়েকটা দৃশ্যের ক্যামিও চরিত্র। তাতেই ঢেলে দিয়েছেন অভিনয়ের প্রাণ। আর শেষ প্যারাগ্রাফটা রেখেছি উত্তমকুমারের অভিনয় প্রসঙ্গে।
কাকে বলব বিহেভিয়ার, কাকে বলব অ্যাক্টিং, এই ছবিতে উত্তমের ভূমিকা এমনই দ্বন্দ্বে ফেলে। রেলগেট পড়ার দৃশ্যে ছুটন্ত ট্রেনের দিকে নিমগ্ন তাকানো অবস্থার পর সোমার সন্দিগ্ধ আহ্বানে সম্বিত ফিরে তার দিকে স্থির তাকিয়ে দু-চারবার পলক নাড়ানো বিহেভিয়ার নাকি অ্যাক্টিং বোঝা মুশকিল। প্রতিটি দৃশ্য প্রতিটি ফ্রেমে নিজেকে সন্দেহভাজন করে তোলা আবার মুহূর্তে নিজেকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে সপ্রমাণের চেষ্টা অবাক করে। শুঁটকি মাছের ব্যবসায়ী শুনে মি. সমাদ্দারের দিকে ঝটিতি তাকানো জেশ্চরিয়াল অ্যাক্টিংয়ের মাস্টারপিস; কোথাও আমরাও বোধহয় শুঁটকি মাছের গন্ধে নাক কুঁচকে উঠি। ব্যারিস্টার মিত্তিরের দপ্তরে ‘সোমার জন্য আমি সব করতে পারি’ বলে ত্বরিতে উঠে যাওয়ার দৃশ্য মেথড অ্যাক্টিংয়ের সমস্ত প্রথা ভেঙেচুরে ফেলে; আন্ডার অ্যাক্টিংয়ের নমুনা আমাদের ঠুলিপরা চোখ খুলে দেয়। উত্তমের শ্রেষ্ঠ অভিনয় মূলত ষাটের দশক জুড়েই; তারমধ্যে ‘শেষ অঙ্ক’ একটা আনকাট ডায়মন্ড।