Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

কার্ড

ব্যারি পেন

অনুবাদ: অনিন্দিতা মণ্ডল

বছরখানেক আগে এলিজার সঙ্গে আমার একটু মতপার্থক্য হয়। আমি বলেছিলাম যে আমাদের কোনও ভিজিটিং কার্ড নেই।

“না নেই!” সে খুব রেগে বলেছিল, “আমি স্বপ্নেও এমন ভাবি না!”

আমি শান্ত স্বরে বলেছিলাম, “কেন থাকতে পারে না? ভিজিটিং কার্ড একটা স্বাভাবিক বস্তু। সব ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার কাছেই থাকে।”

সে উত্তরে বলেছিল, জিনিসটার যে ঠিক কী দরকার সে তার জানা নেই।

বললাম, অতশত জানি না। এটুকু বলতে পারি যে, ভিজিটিং কার্ড ছাড়া আমি একটি পাও বাইরে রাখছি না।

“দরকারটা কী? আমরা তো কাউকে বাড়িতে ডাকি না। আমাদেরও কেউ ডাকে না।” এলিজা বলল।

—মিস সকার্স কেউ নয় তাহলে?

—তিনি তো কখনও কার্ড রেখে যাননি? তিনি অতি ভদ্র স্বভাবের। আমাকে না পেলে তিনি মেয়েটিকে বলে যান আমাকে বলতে যে তিনি এসেছিলেন। তাঁর যদি কার্ড ছাড়া এভাবে চলে যায় তাহলে আমাদেরও যেতে পারে!

—ধন্যবাদ। সম্মানজনক কাজ সম্পর্কে আমার নিজস্ব ধারণা আছে। মিস সকার্সের থেকে শিখতে হবে না আমায়। আমি আজ সকালে অ্যামরডের কাছে পঞ্চাশটি করে ভিন্ন ভিন্ন রকম কার্ড বরাত দেব।

—শ’য়ে শ’য়ে কার্ড নষ্ট হবে।

—হয় তুমি গুনতে জানো না কিংবা তুমি জানো না যে বিবাহিত দম্পতিরা কত ধরনের কার্ড ব্যবহার করে। স্বামীর একার একরকম, স্ত্রীর একরকম, এবং দুজনের একসঙ্গে যে কার্ড তাতে দুজনের নাম থাকে।

এলিজা চিৎকার করল— তবে আর কী? যাও! বেড়ালের নামেও কার্ড করাও। আমরা যত মানুষ চিনি তার চেয়ে বেশি বেড়ালের সঙ্গে ওর চেনাজানা।

আমি কড়া করে উত্তর দিতে পারতাম কিন্তু একদম চুপ করে থাকাই স্থির করলাম। কারণ তাইতে এলিজার বিশ্রী মেজাজ আরও প্রকট হত। কিন্তু এলিজা থামল না, —মা থাকলে খুব বিরক্ত হত, আমি জানি। যেখানে শেষ হয়ে আসা কয়লার দাম পর্যন্ত এখনও বাকি সেখানে সেই পয়সায় কার্ড আনা আমি কিছুতেই সমর্থন করি না।

কোনও কথা না বলে আমি সোজা অ্যামরডের কাছে গিয়ে কার্ডের অর্ডার দিলাম। নিজের জেদ বজায় রাখতে অনেকের মতই আমি শক্ত হই। আমার সঙ্গে বসবাস অত্যন্ত সহজ, এবং আমি জানি যে এলিজাও সেটা জানে। কিন্তু আমার কথা হল, পুরুষ মানুষ যদি নিজের বাড়ির কর্তা না হয় তবে সে কোথায় কর্তাটি হবে?

***

অ্যামরড যতক্ষণ কার্ড ছাপাচ্ছিল ততক্ষণ আমি অপেক্ষা করলাম। মাঝে মাঝে আমি তাকে কোথাও একটুকরো পাতা, বা নামের তলায় একটা লাইন দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিলাম যাতে কার্ডগুলো দেখতে সুন্দর লাগে। কিন্তু অ্যামরড রাজি হল না। সে মনে করেছে এগুলো নিতান্তই বাহুল্য, আর এর জন্য খরচও বেশি পড়বে। তাছাড়া তার কাছে প্রয়োজনীয় স্টকও নেই। মেনে নিলাম। কার্ডগুলো ভালই দেখতে হল। ছিমছাম পরিষ্কার (শুধু কয়েকটার কালি তখনও শুকোয়নি)। নিজের সম্মানরক্ষার জন্য যথেষ্ট মনে হল।

সেদিন সন্ধেয় একটা ছোট্ট বাক্সে বাগান থেকে কিছু সুন্দর ফুল তুলে ভরলাম। সেখানে একটি কার্ড রাখলাম। কার্ডে লিখলাম, বুকভরা ভালবাসা। তারপর সেটা এলিজার মাকে পোস্ট করলাম।

এতদিন এলিজার মা কার্ডের পেছনে খরচ অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন। কিন্তু এবার তিনি এলিজাকে পাঁচটি শিলিং, তিন পাউন্ড গোরুর মাংস ও একটি অ্যাপ্রন উপহার পাঠালেন।

এই ছোট্ট ঘটনাটি বলবার একটাই উদ্দেশ্য, এক্ষেত্রে কে ঠিক ছিল, এলিজা না আমি?

কয়েকটা কার্ড পকেটে রাখলাম, বাকিগুলো ড্রয়ারে রইল। কয়েক সপ্তাহ পর খুব বিরক্ত হয়ে লক্ষ করলাম, এলিজা কার্ডগুলো সিল্কসুতো গোটাতে ব্যবহার করছে। এলিজা বলল, এভাবে ব্যবহারের জন্য কার্ডগুলো মোটেই নষ্ট হচ্ছে না। ওগুলো ব্যবহার করতে অসুবিধে হবে না।

—কার্ডগুলো ব্যবহারযোগ্য থাকা চাই। ময়লা হলে হবে না, বুঝলে? বললাম আমি।

সেদিন এলিজা খবর দিল যে আমাদের গলির চোদ্দো নম্বর বাড়িতে পপওয়ার্থ নামে একজন ভাড়া এসেছে।

আমি ওকে বললাম, “এ নিশ্চয় সেই ছোকরা পপওয়ার্থ যে আমাদের অফিসে ছিল। শুনেছি এ বছরে বিয়ে করতে চলেছে। অবশ্যই তার বাড়ি যেয়ো ও কার্ড দিয়ে এসো।”

—কোনগুলো? আর ক’টা করে?

—কোনও বই না দেখে এভাবে আমি বলতে পারব না। এটা রুচির ব্যাপার। বেশ ক’টা দিয়ে এসো। বাড়িতে যে ক’জন আছে সবার জন্য।

—কিন্তু আমি কী করে জানব যে বাড়িতে ক’জন আছে?

—ওরা যদি আমরা যে দোকান থেকে মাংস কিনি সেখান থেকেই কেনে তাহলে তো দোকানিকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে।

পরের দিন আমার মনে হল এলিজা নিশ্চয় কার্ড দিয়ে এসেছে। পপওয়ার্থের নিশ্চয় বেশ পয়সা আছে। এত বড় একটা বাড়ি সে ভাড়া নিয়েছে! কিন্তু এলিজা বলল—

—মাংসের দোকানে দোকানি বলল, ও বাড়িতে পপওয়ার্থ, তার বউ, তার দুই বোন, একজন জার্মান বন্ধু ও এগারোটি বাচ্চাকাচ্চা আছে। মানে সব মিলিয়ে ষোলো জন। মানে দাঁড়াল আটচল্লিশটা কার্ড। দেখেছ তো? আমি কিন্তু তোমার নিয়ম ভুলিনি।

—এলিজা, আমি তোমাকে বলেছিলাম, এটা রুচির ব্যাপার। তোমার একসঙ্গে আটচল্লিশটা কার্ড রেখে আসা মোটেই ঠিক হয়নি।

—মানে তুমি বলতে চাইছ যে আমি মাঝে মাঝেই গিয়ে কার্ড রেখে আসব? আমার কি আর অন্য কাজ নেই? ঝুড়িতে তোমার তিন জোড়া ময়লা মোজা এখনও পড়ে। ধোওয়া হয়নি।

—কিন্তু এ তো আমি যাকে মনে করেছি সেই পপওয়ার্থ নয়! যদি তার এ বছর বিয়ে হবার থাকে তাহলে কী করে তার এগারোটা বাচ্চা থাকবে? আর এই বাড়িটাও তেমন নয় যেমনটা ভেবেছি!

—আমিও সেটাই ভাবছিলাম।

—তাহলে তুমি তাদের ডাকলে কেন?

—কে বলেছে আমি ডেকেছি? ডাকিনি তো?

***

আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। সেদিন সন্ধেয় এলিজা যখন কার্ডের দুটি কোনা অল্প ছিঁড়ে সুতো গোটাচ্ছিল, আমি চুপ করে থাকাই স্থির করলাম। মাঝে মাঝে এমন ভান করাটা ভাল, যে তুমি কিছু দেখোইনি।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব

আমাদের খেলা করা দরকার, তাই আমাদের কয়েকজন ছেলে মিলে ক্লাব তৈরি করতে হবে। কোথায় করা যায়? — অমুক জায়গায় — ওই জায়গাটা পড়ে আছে, তা যাদের জায়গা তারা বললেন, “ওই তো ওখানে জঙ্গল হয়ে আছে, তা যদি তোমরা জঙ্গল-টঙ্গল পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে ক্লাব তৈরি করতে পার তো করো।” আমাদের আর পায় কে — আমরা মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলে। উদ্ধার করলাম। উদ্ধার-টুদ্ধার করে এর বাড়ি থকে চারটে বাঁশ, ওর বাড়ি থেকে তিনটে হোগলা এভাবে যোগাড়-যন্ত্র করে-টরে একটা চালাঘর তৈরি করা হলো। সেই চালাঘরকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে আমাদের নতুন লাইব্রেরী তৈরি হলো। ক্লাবের নাম হলো ‘সেনহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাব’।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো! সেই থেকেই ‘বাগনান’!

ছোট্ট ওই ভূখণ্ডটি বাঘের উপস্থিতির জন্যই তখন ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয় বলে প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরার অভিমত। এই বিষয়ে তিনি আরও জানান, আরবি ভাষা অনুযায়ী ‘নান’ কথার অর্থ হল ‘চরভূমি’। ‘নান’ শব্দের আরও একটি অর্থ হল ‘ছাউনি’। তখন কাছারিপাড়া ছাড়াও নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় ইংরেজ সেনাদের ছাউনি ছিল বলে জানা যায়। যার মধ্যে খাদিনান, পাতিনান, খাজুরনান, বাইনান, চিৎনান, মাছিনান ইত্যাদি জনপদগুলি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু নদীর চরে বাঘেশ্বরী দেবীর পুজো হত, সেই জন্য প্রাথমিকভাবে এলাকাটি ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ‘বাঘনান’ অপভ্রংশ হয়ে ‘বাগনান’-এ পরিণত হয়েছে।

Read More »
আবদুল্লাহ আল আমিন

কবিগান: সমাজবাস্তবতা, বিষয়বৈভব ও রূপবৈচিত্র্য

এমন লোকপ্রিয় বিষয় বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা ভাষা, সঙ্গীত ও সাহিত্যে কবিগান ও কবিয়ালদের অবদানের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগান সংগ্রহ এবং এ বিষয় পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে কবিয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কিংবা কবিগানকে সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক এ গানকে সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই গানের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে লোকায়ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক যার অধিকাংশই অনালোচিত ও অনালোকিত রয়েছে অদ্যাবধি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »
দীপক সাহা

বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়ে ইতিহাসকে লেন্সবন্দি করেছেন সাইদা খানম

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে উপমহাদেশের বিখ্যাত প্রায় সকল ব্যক্তিত্ব— ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী, বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আশাপূর্ণা দেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়— কার ছবি তোলেননি! সেই সঙ্গে রানি এলিজাবেথ, মাদার টেরেসা, মার্শাল টিটো, অড্রে হেপবার্নের মতো বিখ্যাত মানুষদের ছবিও তুলেছেন। এই বিশাল তালিকায় আরও তিনটি নাম যুক্ত করে না দিলে অন্যায় হবে। চন্দ্রবিজয়ী নিল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিনস, মাইকেল কলিন্সের ছবিও তুলেছেন তিনি।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

মামলায় জয়ী হয়ে থোড় কুঁচি দিয়ে কালীর আরাধনা করেন জমিদার-গিন্নি

দেবী কালিকার খড়ের মেড় দেখে মজুমদার গিন্নি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, মামলার রায় যদি তাঁদের পক্ষে যায় তাহলে কলাগাছের থোড় কুঁচো দিয়ে হলেও জগজ্জননী মা মহাকালীর পুজো করা হবে, আর যদি মামলার রায় তাঁদের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে ওই খড়ের মেড় দামোদরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। যদিও সেদিন দুপুরের মধ্যেই আদালত থেকে মজুমদার জমিদার পক্ষের জয়লাভের খবর পৌঁছেছিল থলিয়ার মজুমদার বাড়িতে। মজুমদার-গিন্নিও অক্ষরে অক্ষরে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। মামলায় জয়লাভের খবর পাওয়া মাত্রই জমিদার-গিন্নির নির্দেশে প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দীপাবলি উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে যায়।

Read More »