ব্যারি পেন
অনুবাদ: অনিন্দিতা মণ্ডল
বছরখানেক আগে এলিজার সঙ্গে আমার একটু মতপার্থক্য হয়। আমি বলেছিলাম যে আমাদের কোনও ভিজিটিং কার্ড নেই।
“না নেই!” সে খুব রেগে বলেছিল, “আমি স্বপ্নেও এমন ভাবি না!”
আমি শান্ত স্বরে বলেছিলাম, “কেন থাকতে পারে না? ভিজিটিং কার্ড একটা স্বাভাবিক বস্তু। সব ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার কাছেই থাকে।”
সে উত্তরে বলেছিল, জিনিসটার যে ঠিক কী দরকার সে তার জানা নেই।
বললাম, অতশত জানি না। এটুকু বলতে পারি যে, ভিজিটিং কার্ড ছাড়া আমি একটি পাও বাইরে রাখছি না।
“দরকারটা কী? আমরা তো কাউকে বাড়িতে ডাকি না। আমাদেরও কেউ ডাকে না।” এলিজা বলল।
—মিস সকার্স কেউ নয় তাহলে?
—তিনি তো কখনও কার্ড রেখে যাননি? তিনি অতি ভদ্র স্বভাবের। আমাকে না পেলে তিনি মেয়েটিকে বলে যান আমাকে বলতে যে তিনি এসেছিলেন। তাঁর যদি কার্ড ছাড়া এভাবে চলে যায় তাহলে আমাদেরও যেতে পারে!
—ধন্যবাদ। সম্মানজনক কাজ সম্পর্কে আমার নিজস্ব ধারণা আছে। মিস সকার্সের থেকে শিখতে হবে না আমায়। আমি আজ সকালে অ্যামরডের কাছে পঞ্চাশটি করে ভিন্ন ভিন্ন রকম কার্ড বরাত দেব।
—শ’য়ে শ’য়ে কার্ড নষ্ট হবে।
—হয় তুমি গুনতে জানো না কিংবা তুমি জানো না যে বিবাহিত দম্পতিরা কত ধরনের কার্ড ব্যবহার করে। স্বামীর একার একরকম, স্ত্রীর একরকম, এবং দুজনের একসঙ্গে যে কার্ড তাতে দুজনের নাম থাকে।
এলিজা চিৎকার করল— তবে আর কী? যাও! বেড়ালের নামেও কার্ড করাও। আমরা যত মানুষ চিনি তার চেয়ে বেশি বেড়ালের সঙ্গে ওর চেনাজানা।
আমি কড়া করে উত্তর দিতে পারতাম কিন্তু একদম চুপ করে থাকাই স্থির করলাম। কারণ তাইতে এলিজার বিশ্রী মেজাজ আরও প্রকট হত। কিন্তু এলিজা থামল না, —মা থাকলে খুব বিরক্ত হত, আমি জানি। যেখানে শেষ হয়ে আসা কয়লার দাম পর্যন্ত এখনও বাকি সেখানে সেই পয়সায় কার্ড আনা আমি কিছুতেই সমর্থন করি না।
কোনও কথা না বলে আমি সোজা অ্যামরডের কাছে গিয়ে কার্ডের অর্ডার দিলাম। নিজের জেদ বজায় রাখতে অনেকের মতই আমি শক্ত হই। আমার সঙ্গে বসবাস অত্যন্ত সহজ, এবং আমি জানি যে এলিজাও সেটা জানে। কিন্তু আমার কথা হল, পুরুষ মানুষ যদি নিজের বাড়ির কর্তা না হয় তবে সে কোথায় কর্তাটি হবে?
***
অ্যামরড যতক্ষণ কার্ড ছাপাচ্ছিল ততক্ষণ আমি অপেক্ষা করলাম। মাঝে মাঝে আমি তাকে কোথাও একটুকরো পাতা, বা নামের তলায় একটা লাইন দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিলাম যাতে কার্ডগুলো দেখতে সুন্দর লাগে। কিন্তু অ্যামরড রাজি হল না। সে মনে করেছে এগুলো নিতান্তই বাহুল্য, আর এর জন্য খরচও বেশি পড়বে। তাছাড়া তার কাছে প্রয়োজনীয় স্টকও নেই। মেনে নিলাম। কার্ডগুলো ভালই দেখতে হল। ছিমছাম পরিষ্কার (শুধু কয়েকটার কালি তখনও শুকোয়নি)। নিজের সম্মানরক্ষার জন্য যথেষ্ট মনে হল।
সেদিন সন্ধেয় একটা ছোট্ট বাক্সে বাগান থেকে কিছু সুন্দর ফুল তুলে ভরলাম। সেখানে একটি কার্ড রাখলাম। কার্ডে লিখলাম, বুকভরা ভালবাসা। তারপর সেটা এলিজার মাকে পোস্ট করলাম।
এতদিন এলিজার মা কার্ডের পেছনে খরচ অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন। কিন্তু এবার তিনি এলিজাকে পাঁচটি শিলিং, তিন পাউন্ড গোরুর মাংস ও একটি অ্যাপ্রন উপহার পাঠালেন।
এই ছোট্ট ঘটনাটি বলবার একটাই উদ্দেশ্য, এক্ষেত্রে কে ঠিক ছিল, এলিজা না আমি?
কয়েকটা কার্ড পকেটে রাখলাম, বাকিগুলো ড্রয়ারে রইল। কয়েক সপ্তাহ পর খুব বিরক্ত হয়ে লক্ষ করলাম, এলিজা কার্ডগুলো সিল্কসুতো গোটাতে ব্যবহার করছে। এলিজা বলল, এভাবে ব্যবহারের জন্য কার্ডগুলো মোটেই নষ্ট হচ্ছে না। ওগুলো ব্যবহার করতে অসুবিধে হবে না।
—কার্ডগুলো ব্যবহারযোগ্য থাকা চাই। ময়লা হলে হবে না, বুঝলে? বললাম আমি।
সেদিন এলিজা খবর দিল যে আমাদের গলির চোদ্দো নম্বর বাড়িতে পপওয়ার্থ নামে একজন ভাড়া এসেছে।
আমি ওকে বললাম, “এ নিশ্চয় সেই ছোকরা পপওয়ার্থ যে আমাদের অফিসে ছিল। শুনেছি এ বছরে বিয়ে করতে চলেছে। অবশ্যই তার বাড়ি যেয়ো ও কার্ড দিয়ে এসো।”
—কোনগুলো? আর ক’টা করে?
—কোনও বই না দেখে এভাবে আমি বলতে পারব না। এটা রুচির ব্যাপার। বেশ ক’টা দিয়ে এসো। বাড়িতে যে ক’জন আছে সবার জন্য।
—কিন্তু আমি কী করে জানব যে বাড়িতে ক’জন আছে?
—ওরা যদি আমরা যে দোকান থেকে মাংস কিনি সেখান থেকেই কেনে তাহলে তো দোকানিকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে।
পরের দিন আমার মনে হল এলিজা নিশ্চয় কার্ড দিয়ে এসেছে। পপওয়ার্থের নিশ্চয় বেশ পয়সা আছে। এত বড় একটা বাড়ি সে ভাড়া নিয়েছে! কিন্তু এলিজা বলল—
—মাংসের দোকানে দোকানি বলল, ও বাড়িতে পপওয়ার্থ, তার বউ, তার দুই বোন, একজন জার্মান বন্ধু ও এগারোটি বাচ্চাকাচ্চা আছে। মানে সব মিলিয়ে ষোলো জন। মানে দাঁড়াল আটচল্লিশটা কার্ড। দেখেছ তো? আমি কিন্তু তোমার নিয়ম ভুলিনি।
—এলিজা, আমি তোমাকে বলেছিলাম, এটা রুচির ব্যাপার। তোমার একসঙ্গে আটচল্লিশটা কার্ড রেখে আসা মোটেই ঠিক হয়নি।
—মানে তুমি বলতে চাইছ যে আমি মাঝে মাঝেই গিয়ে কার্ড রেখে আসব? আমার কি আর অন্য কাজ নেই? ঝুড়িতে তোমার তিন জোড়া ময়লা মোজা এখনও পড়ে। ধোওয়া হয়নি।
—কিন্তু এ তো আমি যাকে মনে করেছি সেই পপওয়ার্থ নয়! যদি তার এ বছর বিয়ে হবার থাকে তাহলে কী করে তার এগারোটা বাচ্চা থাকবে? আর এই বাড়িটাও তেমন নয় যেমনটা ভেবেছি!
—আমিও সেটাই ভাবছিলাম।
—তাহলে তুমি তাদের ডাকলে কেন?
—কে বলেছে আমি ডেকেছি? ডাকিনি তো?
***
আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। সেদিন সন্ধেয় এলিজা যখন কার্ডের দুটি কোনা অল্প ছিঁড়ে সুতো গোটাচ্ছিল, আমি চুপ করে থাকাই স্থির করলাম। মাঝে মাঝে এমন ভান করাটা ভাল, যে তুমি কিছু দেখোইনি।