গোরুকে আমি সম্যক চিনেছি আমার বাল্যকাল থেকেই। ঠাকুমা আবদার করতেন, যা বাবা, এই শালপাতার দোনায় ঘোষের বাড়ি থেকে একটু গোবর চেয়ে নিয়ে আয়! অমন পাকা দোতলা বাড়িতেও পঞ্চাশ বছর আগে গোবরের উপস্থিতি আবশ্যিক ছিল। একালেও অবিশ্যি আমার ঠাকুমার মতো, শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে গোবর-নির্ভর স্বচ্ছ-বাতিকবাবুদের অভাব নেই। সেকালে মধ্যবিত্ত বাড়িতে টেবিলে খাবার তেমন চল ছিল না; সকলে আসন পেতে মেঝেতে সারি দিয়ে বসে খাওয়ার আলাদা মজা ছিল। আসন অবশ্য আমাদের মতো পোলাপানদের জুটত না। ভাত ফেলে এঁটো করে ফেলবি তোরা, আবার সেসব কাচতে হবে। এই ছিল ঠাকুমার অজুহাত। ইলেকট্রিসিটির মতোই এঁটোসিটিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এটা আমার ‘অতীব সূক্ষ্ম’ বুদ্ধিতেও বেশ বুঝতে পারতাম। আর ওই এঁটোসিটির সবচেয়ে কুপরিবাহী হল গোবর। ন্যাতার ভাঁজের মধ্যে একচিলতে গোবর হলেই এঁটোর দফারফা। বাল্যেই গোবরের এই মহৎ গুণটির সঙ্গে পরিচয়। মুশকিল হল গোরু পোষার হাজার ঝামেলা তাই ঘোষবাড়ি তাদের গোরু দিল বেচে। তখন ঠাকুমার ভরসাস্থল হল ন্যাতার ভাঁজে রাখা ছোট্ট এক চিলতে গোবর-জাত ঘুঁটে। তখন তো ঘুঁটে-কয়লা উনুনের যুগ। তাই ঘুঁটে বস্তুটি বাড়িতে বিস্তর। চোখ বুজলে এখনও পষ্ট দেখতে পাই ভরদুপুরে কোনও বিহারিনী মাথায় বিশাল ঝোড়ায় সুচারু বিন্যাসে ঘুঁটের মিনার নিয়ে ‘ঘুঁটিয়া লিবেন গো’ হেঁকে চলেছে। আর ঠাকুমা মলিনাদেবীর স্টাইলে কোমরে হাত দিয়ে অনুকরণীয় হিন্দিতে ‘শ’ও-কো কেয়া ভাও হ্যায়’ গোছের দরদাম শুরু করছে। শহর কলকাতা আর মফস্বলের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে ছিল অজস্র খাটাল। ছিল কেন, আজও কি কম আছে! খাটাল আছে, দুধ আছে, মশা আছে। গোময়-গোমূত্র পর্যন্ত তাদের হৃতগৌরব আধেক-ভারতে ফিরে পেয়েছে। শুধু বেচারা ঘুঁটের আর কদর নেই।
একদিন সকালে শুনি বেজায় গণ্ডগোল। মা গোয়ালাকে খুব ধমক দিচ্ছে। মোদ্দা কথা যা বুঝলাম, গোয়ালা রোজ আমাদের দু’সের দুধ দেয়, আবার আমাদের পাশের বাড়ির বীণার মাকেও ওই দু’সের দুধই বিক্রি করে। অথচ মাসের শেষে দু’বাড়ির দুধের দামের বিস্তর ফারাক। দুই মা নিজেরা কিছুতেই হিসেব মেলাতে না পেরে আজ চেপে ধরেছে গোয়ালা ব্যাসদেবকে। খুব আবাক হলাম। ব্যাসদেব গয়লার গোরুদের দুধের দাম কেন নানান রকম, সে কীভাবে তার দাম ঠিক করে, দুই অবুঝ মহিলাকে আপ্রাণ এসব নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে! একই গোরুর দুধের দাম কেন এমন ভিন্ন হতে পারে সেটা পষ্ট বুঝতে অবশ্য আমাকে কে সি নাগের গয়লা, দুধ, জল সংক্রান্ত অঙ্কে পৌঁছানো অবধি অপেক্ষা করতে হয়নি। মা বলল, শোন, অনেক বড় হয়েছিস, এখন থেকে ভোরে পাঁচটায় উঠে খাটাল যাবি; নিজে দেখেশুনে খাঁটি দুধ আনবি; পয়সা খরচ করে জল আমি কিছুতেই আর কিনব না। একটা নতুন রকম কাজ পেয়ে মনে বেশ ফুর্তিই হল। বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে। কিন্ত প্রথম প্রভাতেই সব অ্যাডভেঞ্চার শেষ।
খাটাল হল ইঁট-পাতা একটি প্রশস্ত প্রাঙ্গণ, তার একইঞ্চিও শুকনো নয়। ইটগুলো মোটেই সুবিধের নয়; কোনটাতে পা দিলে যে গোময়-গোচোনা-মাটি মেশা বিশ্রী গন্ধের জল প্যাচাক্ করে ছিটকে উঠে বিব্রত করবে না, সেটা বুঝতেই আমার তিনদিন গেল। গোয়ালের একপাশে একটা বড় তক্তাপোষ। তাতে দেখি পাড়ার যত কাকু-জ্যেঠু-দাদুরা বসে গুলতানি করছেন। সেখানে নিদেন একপিস দাদাও নেই। এমন একটি নাদান বালককে পেয়ে জ্যেঠু-দাদুর দল হৈহৈ করে উঠলেন। নিজেদের মধ্যে রেষারেষি করেই তাঁরা সকলে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, কোন গোরুর স্বভাব কেমন, কোন জায়গা দিয়ে হেঁটে এলে কাদা ছিটকে উঠবে না, কোন কোন গরু এখন সবচেয়ে ঘন দুধ দিচ্ছে, যে বালতিতে দুধ দুইবে তার মধ্যে আগে থেকেই জল রাখা নেই সেটা ঠিক কখন উঁকি দিয়ে দেখতে হবে! এমন সব নানান খুঁটিনাটি। প্রথম তিনদিনেই তাঁদের যাবতীয় জ্ঞানের স্টক আমার ওপর ঢেলে দিয়ে তাঁরা তাঁদের আড্ডায় ফিরে গেলেন। আর তখন আমি ফুরসত পেলাম খাটালটাকে খুঁটিয়ে দেখার। তখনই দিনে দিনে আবিষ্কার করলাম, গোরু অতি বুদ্ধিমান প্রাণী। সাদা চাঁদ কপালে কালোটা অতি মিটমিটে। শান্ত দাঁড়িয়ে আছে; সবে দুধ নিয়ে অন্য সব গাঁ-গাঁ, হা-ম-বাঃ, ফোঁস-ফাঁস এড়িয়ে শান্তটির পাশ দিয়ে এগিয়েছি অমনি সেই মিটমিটে তার পেছনের পা এমন সজোরে ইটের ওপর ঠুকল যে সেই আবার প্যাচাক্, আর আমার সারা গায়ে স্প্রেপেন্ট। লালি আবার তার ন্যাজের তুলিটি গোবর আর চোনায় ভিজিয়ে এক্কেবারে অন্য দিকে তাকিয়ে নিশ্চিন্তে বসে জাবর কাটবে। ননীদাদু সবসময় ফিটফাট। ধোপদুরস্ত সাদা ধুতি-শার্ট পরেন। সকালে ফুরফুরে মেজাজে গুনগুন করে শ্যামাসঙ্গীত গাইতে গাইতে সবে লালিকে টপকেছেন, অমনি ছ্যাপাস, তাঁর সফেদ ধুতিতে হলুদ পেন্টব্রাশ। আবার যদি বিষ্টুজ্যেঠু কালো জার্সিটার পাশ দিয়ে আনমনে পা বাড়ান, সে এমন না-না সূচক ভঙ্গিতে ডানদিক-বাঁদিক মাথা দোলাতে শুরু করবে, তার পাশ দিয়ে যায় কার সাধ্য! ওরা প্রায় প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে বুঝিয়ে ছাড়বে ওরা মোটেই গোরু নয়। গোরুর এই বুদ্ধিমত্তার সম্যক ধারণা গোয়ালাদের নিশ্চিত জানা আছে। তারা কখনও তাদের নির্বোধ ছেলেদের গোরু বলছে, কেউ শুনেছে? আমি তো শুনিনি। আমিও সেই থেকে স্যারেরা গোরু বললে একটুও দুঃখ পাইনি। ‘ভানু গোয়েন্দা জহর এ্যাসিস্ট্যান্ট’ ছবিতে তাই যখন পাহাড়ি সান্যাল বলেন, ‘তোর মেজোমামাটা তো একটা গোরুরে, গোরু,’ গোরুর এহেন অপমানে অনেকের মনটা হয়তো বিমর্ষ হয়ে যায়; তবে আমার হয় না। আমি জীবনের প্রভাতকালেই জেনে নিয়েছিলাম গোরুরা তেমন গোরু নয়। সেই তখন থেকেই গোরুর প্রতি সবিস্ময় ভক্তি আমার অন্তরে।
আমার গো-ভক্তি চতুর্গুণ হয়েছিল কেলাস সেভেনে। সেটি বারো নম্বরের বাংলা রচনা লেখার কাল। আমাদের সময় এত ছায়া-কায়া প্রকাশনীর বাড়বাড়ন্ত ছিল না। স্যার বাংলা রচনা বাড়ি থেকে লিখে আনতে বলতেন। উনি পরের সপ্তায় ক্লাসে আমাদের মধ্যে যেসব বঙ্কিম-রবি ঠাকুর-শরৎচন্দ্ররা পড়ত তাদের খাতাগুলো ওল্টাতেন আর বেশিরভাগ সময়েই শাপশাপান্ত করতেন। তবে কারও লেখা মনে ধরলে, তাকে ডাকতেন, তার রচনা ক্লাসকে পড়ে শোনানোর জন্য। আমার বন্ধুরা ছিল সব ধুরন্ধর। বর্ষাকাল, শরৎকাল, গ্রীষ্মকাল, মায় রেডিও কিংবা সংবাদপত্রের ভূমিকার মতো সব রচনায় গীতবিতান আর সঞ্চয়িতার আধখানা করে ঢুকিয়ে দিয়ে তারা বেশ নাম কিনত। তখন সবেমাত্র বছর দু’তিন রবি ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী পার হয়েছে। তার প্রবল ঢাক-ঢোলের বাদ্যির রেশ তখনও আকাশে-বাতাসে। তাই রবি ঠাকুরের ক্রাচে ভর করে বন্ধুরা আমার দিব্য তরতর করে এগোচ্ছিল। স্যারের পাশে দাঁড়িয়ে সারা ক্লাসকে আমার সৃষ্টি প্রকাশ করার সুযোগ আমার যে কোনওদিনই আসবে না, সে আমি বেশ বুঝেছিলাম। আর তেমনই হতাশার গভীর জিরো থেকে হঠাৎই আমাকে একদিন হিরোর পাদপ্রদীপে যে এনেছিল, সে ছিল গাভী। তাই গোরুর কাছে আমার ঋণ শুধু গোয়ালাকে দুধের দাম দিয়ে শোধ হবার নয়। বাংলার স্যার বললেন, শোনো ছেলেরা, তোমরা পরের দিন লিখে এনো ‘আমার সবচেয়ে প্রিয় প্রাণী।’ শিকে বেড়ালের ভাগ্যেও ছেঁড়ে। পরের সপ্তায় স্যার আমাকে ডাকলেন। আমি যেন জানতামই। হাইকোর্টের সামনে ক্ষুদিরামের মূর্তিটির মতো বুক চিতিয়ে স্যারের চেয়ারের পাশে রচনার খাতা-হস্তে হাজির। স্যার বললেন, পড়; আমি শুরু করলাম আমার গোরুর রচনা পড়া। সে রচনা তো আমি ক্লাস থ্রি থেকে লিখে লিখে দক্ষ। ক্লাস সেভেনে উঠতে উঠতে গোরুর তো আর দুটো ল্যাজ কী পাঁচটা পা গজায়নি। আমি শুধু কায়দা করে শিব্রাম চক্কোত্তির ‘গরু’ ছড়াটা থেকে কোটেশান নয়, একেবারে পুরোটাই রচনায় জুড়ে দিয়েছি। তাতে রচনার কলেবর যেমন বাড়ল, কলরবও কম উঠল না! ছড়াটা না শুনলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে না:
শুধালেন স্যার কেলাসেতে, বলতে পারো তোমরা
কি কি কাজে লাগে গরুর চামড়া?
লাগে বৈকি বিশেষ কাজে, জবাব এলো নরুর
চামড়া দিয়ে হাত পাগুলো আটকে থাকে গরুর।
নইলে কোথায় ছিটকে যেতো ধড় মাথা আর ঠ্যাং
সেই চামড়ার ঢাকেই বা কে বাজাতো ড্যাং-ড্যাং!
চামড়াই তার বাসা, তার ভেতরে বসে গরু
হাত-পা খেলায় খাসা; গুঁতোয় গরু আবার
চামড়াখানা খুলে নিলেই শ্রীমান গরু কাবার!
আগের সব নিচু ক্লাসে গোরুর রচনা লিখে লিখে যা কিছু শিখেছিলাম তার সঙ্গে ওই ছড়ার বিষয়বস্তু মিশে যে বস্তুটি তৈরি হয়েছিল সেটি বাংলা স্যারের মন জয় করেছিল সিম্পলি গোরুর জন্য। তাই এই নিরীহ নির্বিবাদী প্রাণীটির কাছে আমি আজও কৃতজ্ঞ।
পাঠকরা বুঝে গেছেন, এই লেখার শিরোনামটি কবি শঙ্খ ঘোষের ‘তুমি তো তেমন গৌরী নও’ থেকে স্রেফ চুরি। তা হোক, আমি তো আর হিমানীশ গোস্বামীর মতো অমন গুণসম্পন্ন গোবরের অর্থই পাল্টে দিইনি। উনি বলে গেছেন গোবর মানে বাংলায় অর্থ ষণ্ড (গো+বর) অথবা ইং-বাং সংযোগে অর্থ যে মহিলা স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছে (go+বর)। কী কাণ্ড! সুকুমার রায় অবধি গোবরকে শুদ্ধতার সার্টিফিকেট দিয়ে লিখে গেছেন, ‘‘শান বাঁধানো ভুঁই গোবর জলে ধুই’’, আর গোস্বামীবাবু গোবরের সেই শুদ্ধতাটুকুও কেড়ে নিলেন! কী আক্কেল ভাবুন! আমি তো তেমন কোনও গর্হিত কাজ করিনি। আমি শুধু এই প্রখর ধী-সম্পন্না মহাভারতের নয়নের মণি মাতৃরূপিনীকে চিনিয়ে দিতে একটু শিরোনাম চুরি করেছি মাত্র।
অনবদ্য!
রসিয়ে লেখা। দেদার মজা।
oshadaron
দারুণ উপভোগ্য লেখা। বেশ ভালো লাগলো।