নবনীতা দেবসেন। পিতৃকুল, মাতৃকুল এবং শ্বশুরকুল, এই কৌলীন্যের ত্র্যহস্পর্শযোগ ঘটেছিল তাঁর জীবনে। বাংলার সংস্কৃতি জগতে এমন আর দেখা যায়নি কারও। অন্যদিকে তাঁর এবং তাঁর স্বামী অমর্ত্য সেনের নাম রেখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। আর কোনও সৌভাগ্যবান দম্পতি নেই, যাঁদের নামকরণ কবিগুরুকৃত। অমিয়জায়ার (কবি অমিয় চক্রবর্তী) নাম রাখেন রবীন্দ্রনাথ হৈমন্তী (হিমের দেশ ডেনমার্কের মেয়ে বলে), বা আদরের নাতনিকে নাম দেন নন্দিনী ও পুপে। কিন্তু নবনীতা-অমর্ত্য যেন নিয়তিনির্দিষ্ট হয়ে ছিল, দু’জনের নামকরণ করবেন তিনি-ই।
নিয়তিনির্দিষ্টই বটে। কেন-না নবনীতার নামকরণ করবার কথা ছিল আসলে অন্য এক বাঙালি মনীষী শরৎচন্দ্রের। সেরকম ইচ্ছেও ছিল সেই দরদী কথাকারের। শরৎচন্দ্রের সঙ্গে নবনীতার মা রাধারাণী দেবীর এতই অন্তরঙ্গতা ছিল যে তিনি শরৎচন্দ্রকে ‘দাদা’ ডাকতেন। তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস ‘শেষের পরিচয়’ লিখতে লিখতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন শরৎচন্দ্র এবং সে উপন্যাসটি লিখে শেষ করেছিলেন রাধারাণী দেবী। কিন্তু নবনীতা যখন জন্মান, শরৎচন্দ্র মৃত্যুশয্যায়। তাই সদ্যোজাত কন্যাটির নাম রাখতে পারেননি অপরাজেয় এই কথাশিল্পী।
অন্যদিকে রাধারাণী দেবী-নরেন্দ্র দেব বিবাহপর্বটি ছিল নাটকীয়। রাধারাণী ছিলেন বিধবা, এবং ‘অপরাজিতা দেবী’ নামে লিখতেন। তাঁর কবিতা মুগ্ধ করেছিল রবীন্দ্রনাথকে এবং সেই সূত্রেই দু’জনের আলাপ। নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে রাধারাণীর বিয়ের উদ্যোক্তা রবীন্দ্রনাথ, যিনি নিজের পুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গেও বিধবা মেয়ে প্রতিমা দেবীর বিয়ে দিয়েছিলেন।
নবনীতা: উৎস থেকে মূলে
নবনীতা দেবসেন যে পরিবারে জন্মেছেন, তা তাঁকে যথার্থ এক আধুনিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে নিশ্চিতরূপে সহায়তা দিয়েছিল। তাঁর পিতা নরেন্দ্র দেব ছিলেন উনিশ শতকের শেষপাদের একজন বিদগ্ধ মানুষ। নিজের শিক্ষাদীক্ষা ও পরিশীলনের গুণে তিনি তখনকার সারস্বতসমাজে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন। সেজন্য তখনকার দিনের বাংলা সাহিত্য যাঁরা শাসন করছিলেন, সেই রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের স্নেহচ্ছায়ায় তিনি এসেছিলেন এবং তাঁর সমসাময়িক লেখকদের তিনি ছিলেন মধ্যমণি। নিজে ছিলেন কবি, তাই তাঁর নামটি সর্বদাই উচ্চারিত হত ‘কবি নরেন্দ্র দেব’ বলে। ছিলেন অনুবাদক। ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত-অনুবাদক হিসেবে যদিও আমরা কাজী নজরুল ইসলাম আর কান্তিচন্দ্র ঘোষকে পেয়েছি, তবু তাঁর অনুবাদটিও যথেষ্ট স্বাতন্ত্র্য নিয়ে আছে বলেই আজকের দিনেও বইটি পুনর্মুদ্রিত হয়ে চলেছে।
নরেন্দ্র দেবের পরিচয় কেবল কবি হিসেবেই নয়, আরও বহুবিধ। তিনি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক, তিনি ভ্রমণপিপাসু, তিনি চলচ্চিত্রের গোড়ার দিকের একজন যথার্থ বোদ্ধা ও চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকার সম্পাদক, চলচ্চিত্রের পৃষ্ঠপোষক। সেই সূত্রে তাঁর সময়কার অভিনেতা-পরিচালক- প্রযোজক-কলাকুশলীর সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। তিনি নিজে ছবি আঁকতেন। নবনীতা তাঁর একটি লেখার নরেন্দ্র দেবের শিল্পসত্তার সুন্দর একটি পরিচয় দিয়েছেন, ‘আমাদের ঘুলঘুলিগুলি বাবার এঁকে দেওয়া সুন্দর ডিজাইনের সিমেন্টের কারুকাজ করে তৈরি।’
যে-বাড়িটি প্রসঙ্গে নবনীতার এই উক্তি, সে বাড়িটি দক্ষিণ কলকাতার অবিনাশী ঐতিহাসিক বাড়ি। বাড়িটির নাম ‘ভালো-বাসা’। ঐতিহাসিক, কেন-না এ-বাড়িতে পদপাত ঘটেনি কার? স্বয়ং শরৎচন্দ্র প্রায়শ আসতেন এ-বাড়িতে; তাঁর নিজের অশ্বিনী দত্ত রোডের বাড়ি ছিল এ বাড়ি থেকে হাঁটাপথের দূরত্বে। আসতেন সে সময়কার সাহিত্যের রথী-মহারথীরা প্রায় সকলেই। পাড়াটিও বিখ্যাত হয়ে আছে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী, পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরীর পাড়া হিসেবে। রবীন্দ্রগবেষক পুলিনবিহারী সেন এসে দেখেন নরেন্দ্র দেব চিৎকৃত কণ্ঠে টেলিফোনে কথা কইছেন প্রতিবেশী সুনীতিকুমারের সঙ্গে। শুনে তিনি রসিকতা না করে থাকতে পারলেন না, ‘কেন অযথা অর্থব্যয়, এ তো বিনা টেলিকোনেই শোনা যাচ্ছে।’
এই হচ্ছেন নরেন্দ্র দেব। অন্যদিকে নবনীতার মা কিশোর বয়স থেকেই কবিতা লিখতেন ছদ্মনামে। তাঁর ছদ্মনাম ছিল ‘অপরাজিতা দেবী’। তাঁর কবিতা রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি খোঁজ করে যোগাযোগ করেন এই মহিলার সঙ্গে। বেগম সুকিয়া কামাল, প্রতিভা সোম (পরবর্তীকালে বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী হওয়ার সূত্রে বসু) যেমন স্নেহধন্যা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের, ঠিক তেমনি রাধারাণী দেবীও। আবার অন্যদিকে অপূর্ব চন্দ-রানী চন্দের বিয়েতে যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল রবীন্দ্রনাথের, তেমনই নরেন্দ্র দেব-রাধারাণীর বিয়েতেও ছিল। এই দম্পতির প্রতি কবির ছিল অপার স্নেহ। এঁদের কন্যার ‘নবনীতা’ নামকরণের মধ্য দিয়েও তার পরিচয় আমরা টের পাই।
অন্যদিকে শরৎচন্দ্র ছিলেন রাধারাণীর জ্যেষ্ঠাগ্রজের মত। জীবনের সুধদুঃখ আনন্দ বেদনা অথবা যে-কোনও সংকটে তিনি শরৎচন্দ্রের কাছে যেতেন পরামর্শ নিতে, সান্ত্বনা খুঁজতে। তাঁকে লেখা শরৎচন্দ্রের বেশ কিছু চিঠি তাঁদের নিবিড় সম্পর্কের সাক্ষ্য দেয়। তাই তো অন্য কাউকে নয়, নিজ ভগ্নীসমা রাধারাণীর সাহিত্যবোধ সম্পর্কে আস্থাশীল শরৎচন্দ্র তাঁকেই আদেশ দিয়ে যান ‘শেষের পরিচয়’ সমাপ্ত করার। রাধারাণী শরৎচন্দ্রকে নিয়ে একটি গ্রন্থও রচনা করে গেছেন।
নবনীতা: পরম্পরা
কেবল পারিবারিক ঐতিহ্যই নির্মিতি দেয়নি নবনীতাকে। তাঁর নির্মিতির পেছনে বহুতর অনুঘটকের অবদান নির্দেশ করা সম্ভব। আধুনিক ভারতে উনিশ শতকে ঔপনিবেশিক অধ্যায়কে যদি বিহঙ্গাবলোকনের দৃষ্টিতেও তাকিয়ে দেখি, তাহলে লক্ষ করব, এই শতকের এবং পরবর্তী বিশ শতকের প্রথমাংশজুড়ে একদিকে নারীর প্রতি অবহেলা-ঔদাসীন্য, অন্যদিকে হাজার প্রতিকূলতা ঠেলে নারী তার আত্মসত্তা বিকাশে মরিয়া ও তৎপর।
প্রাচীন ভারতে আর্য সভ্যতার গোড়ায় পুরুষ ও নারীর সমানাধিকার ছিল। এর ফলে মৈত্রেয়ী বা গার্গী, ঘোষা অথবা লোপামুদ্রার সাক্ষাৎ পাই। নারী রচিত স্তোত্র বৈদিক সাহিত্যে দেখা যায়। যাজ্ঞবল্ক্যের সঙ্গে গার্গীর তর্ক উপনিষদে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগ থেকে নারীর যে অবনমন শুরু হল, তা যুগের পর যুগ ধরে কঠোর থেকে কঠোরতর হতে লাগল। মনু পরাশর বৃহস্পতি চাণক্য থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর রঘুনন্দন পর্যন্ত স্মার্ত পণ্ডিতেরা নারীর ওপর নিষেধাজ্ঞার পর নিষেধাজ্ঞার পাহাড় নামিয়ে আনলেন। সমানাধিকারের তো প্রশ্নই নেই, নারীর শিক্ষালাভ গেল বন্ধ হয়ে, আর নিতান্ত ‘গৃহদীপ্তি’ হল নারীর একমেব সংজ্ঞা।
বৌদ্ধযুগে নারীর মর্যাদা সামান্য পরিমাণে ফিরে এসেছিল, যদিও তা বৌদ্ধসঙ্ঘে। সেখানে বৌদ্ধ রমণী শিক্ষার অধিকার পেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন তাঁদের সৃষ্টিকর্ম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ। যার ফলে বহু বৌদ্ধ নারী কবিতা রচনা করে গিয়েছেন, যা বিধৃত হয়ে আছে ‘থেরীগাথা’ নামক অমর সঙ্কলনগ্রন্থে। কিন্তু তার বাইরের নারীবিশ্ব ছিল নিতান্তই অন্ধকারময়।
মধ্যযুগও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে মুঘল শাসনামলে রাজপরিবারে অন্তত নারীশিক্ষার প্রচলন ছিল। এজন্যই দেখা যায় হুমায়ূনের বোন গুলবদন বেগম লিখছেন ‘হুমায়ূননামা’, অর্থাৎ ভাই তথা মুঘল আমলের ইতিহাস। জাহানারাও বাবর কিংবা জাহাঙ্গীরের মত আত্মজীবনী লিখছেন। জাহানারা, রোশেনারা, শালাহানলায়া মমতাজ বেগম আর জাহাঙ্গীরের প্রিয়তমা নূরজাহান আশ্চর্য করে দিচ্ছেন কবিতা লিখে। কিন্তু তার বাইরে নারী অবরোধবাসিনী ও পুরুষের দাসীমাত্র!
ক্ষণপ্রভার মত দক্ষিণ ভারতে কবি মসিতাম্মা, উত্তর ভারতে মীরাবাঈ, বাংলার ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জে উঁকি দিয়ে যান চন্দ্রাবতী। অলৌকিক মনে হয় আমাদের। অন্দরের অবরোধ ঠেলে নারীর পাদপ্রদীপে আসা, নবনীতাতে পৌঁছনো তাই একদিকে শ্রদ্ধার, অন্যদিকে অনুপুঙ্খ অভিনিবেশের। তাই এই প্রাক্-কথন।
উনিশ শতকে রাজা রামমোহনের উদ্যোগে আইন করে নিবারিত হল সতীদাহের মত নিষ্ঠুর প্রথা (১৮২৯), আর পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রের সর্বৈব প্রবর্তনায় প্রচলিত হতে পারল বিধবাবিবাহ (১৮৫৬)। বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন বহুবিবাহের মত নিতান্ত মধ্যযুগীয় কুপ্রথাটিও বিলুপ্ত করতে, কিন্তু পারেননি। এই দুই যুগন্ধরের সমসাময়িক ইয়ং বেঙ্গল দলের হোতা স্বল্পায়ু ডিরোজিওর ভাবনাতেও কিন্তু নারী জাগরণের শুভৈষা ছিল, যা তাঁর শিষ্যদের মধ্যেও অনুষ্যুত হতে দেখা যায়। ডিরোজিওর অন্যতম শিষ্য রাধানাথ শিকদার তো মেয়েদের জন্যই একটি পত্রিকা প্রকাশ করে ফেললেন, মাসিক পত্রিকা। অন্যদিকে আর এক ডিরোজিয়ান কোন্নগরবাসী শিবচন্দ্র দেব তাঁর পুত্রবধূকে নিজে পাঠদান করে শিক্ষিত করে তুলছেন। পরবর্তীকালে ঠাকুর পরিবারে আরও এর অনুসৃতি দেখা যাবে।
আমাদের অবাক লাগে, যে অচলায়তন নারীমুক্তিকে বাধা দিয়ে রেখেছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে, আগল টুটতে না টুটতে মাত্র দুই শতকে নারীবিশ্বে এই উপমহাদেশ যেন জাদুকরীর ভূমিকা নিয়েছে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার (১৮৫৭) পর প্রথম বিএ পাশ করলেন বঙ্কিমচন্দ্র, আর তার একযুগের মধ্যেই তাঁকে ছুঁয়ে ফেললেন চন্দ্রমুখী বসু। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা সম্পাদনার কিছুকালের মধ্যেই আমরা মহিলা-সম্পাদিত পত্রিকা পেলাম। এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রের হাত দিয়েই বাংলা উপন্যাসের সূত্রপাত (দুর্গেশনন্দিনী, ১৮৬৫), এ নিয়ে যে তর্ক আছে তাতে বঙ্কিম-পূর্ববর্তী প্যারীচাঁদ মিত্র-রচিত ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বা তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘স্বর্ণলতা’ গ্রন্থের পাশাপাশি অন্য যে উপন্যাসটি প্রথমতম হওয়ার দাবিদার, সেই ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ কিন্তু লিখেছিলেন একজন নারী— হানা কাথারিন ম্যালেনস্। হতে পারেন তিনি বিদেশিনী, কিন্তু কলকাতায় জন্ম তাঁর, বিদ্যালয়ে বাংলা পড়াতেন, আর ইতোপূর্বে বর্ণিত তিনটি উপন্যাসের আগে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বই। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু উপন্যাসটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে গেছেন। তাছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের আগে, যদিও বিভাষায়, বিদেশে বসে উপন্যাস লিখেছিলেন কিন্তু এক বাঙালিনী, যাঁর নাম তরু দত্ত। তাঁর ‘বিয়াঙ্কার রাজা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৮৩০ সালে। কোন বাঙালি তাহলে প্রথম উপন্যাসকার, এখন কি তা খানিক বিবেচনাসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায় না?
অন্দরের অবরোধ ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসছেন মেয়েরা কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ঘোর প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে। আমরা জানি, মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা আছে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের। মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে বিধবা হবে, এমন প্রচারের মধ্য দিয়েও সেকালের বহু নারীকে বিদ্যাশিক্ষা থেকে সরিয়ে রাখা গিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে বিদ্যাসাগর, বেথুন এগিয়ে এলেন নারীশিক্ষার প্রসারে, সমর্থন পেলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কারের মত আধুনিকমনার।
প্রচলিত শিক্ষা না পেয়েও সেই আঠারো শতকের ‘অর্ধবঙ্গেশ্বরী’ রানি ভবানী কি জমিদারি পরিচালনার কাজে বিস্ময়কর কৃতিত্ব দেখাননি? তাঁরই উত্তরাধিকার বর্তেছিল রানি রাসমণির মধ্যে, নবাব ফয়েজউন্নিসার মধ্যে। নারী হয়েও ইংরেজদের কাছে ‘বেগম’ উপাধি নিতে অস্বীকার করেছিলেন ফয়েজউন্নিসা। তাই তিনি তামাম উপমহাদেশে একমাত্র মহিলা যিনি ‘নবাব’ আখ্যায় ভূষিত। বাঙালি নারীর বিস্ময়করতা, স্বীকার করতেই হবে এবং তিনি নিজে তাঁর জমিদারিতে নারীশিক্ষার জন্য একের পর এক বিদ্যালয় খুললেন। আর লিখলেন উপন্যাস, ‘রূপজালাল’। মনু যে বলেছিলেন, ‘ন স্ত্রী, স্বাতন্ত্র্যমর্হতি’, স্ত্রীদের স্বাতন্ত্র্য থাকতে নেই, শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্রসন্তানের অধীন তারা, এই প্রত্যয় নস্যাৎ করে দিলেন এঁরা।
এঁরা এবং আরও অনেকে, যেমন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। নারীজাগরণের এই অগ্রদূতীর প্রতি প্রণত হবে না কে? অথবা বিদেশিনী হয়েও ভগিনী নিবেদিতা, যিনি একদিকে স্ত্রীশিক্ষা, অন্যদিকে ভারতীয় সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে তুলে ধরার জন্য লেখনী চালনা, এবং ভারতে বিপ্লববাদের জ্বলন্ত মশাল হয়ে দীপিত করে গিয়েছেন ভারতবর্ষকে। স্বদেশী নেতা অশ্বিনীকুমার দত্তের কারামুক্তিতে নিজের বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করেন এই দুঃসাহসিনী নারী। রবীন্দ্রনাথ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে কোন বিরূপতা আসবে তার পরোয়া না করে। তাঁর কাজটি যেমন দুঃসাহসিক, নিবেদিতার কাজটিও তাই।
নবনীতা দেবসেন এই উনিশ শতকীয় নারীপ্রগতি-ধারাবাহিকতার ফসল। উনিশ ও বিশ শতকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে আর নারীশিক্ষার দুয়ার খুলে যাচ্ছে। কলকাতা থেকে সুদূর বরিশালে চালু হচ্ছে সহশিক্ষা, এবং সেখান থেকে ঈশান স্কলার (স্নাতকে প্রথম) হয়ে বেরোচ্ছেন, না, কোনও পুরুষ নন, মহিলা,— শান্তিসুধা ঘোষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার (১৯২১) অচিরেই সেখান থেকে লীলা নাগ স্নাতক হয়ে বেরোলেন। তাছাড়া উনিশ শতকে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত বেথুন ও লোরেটো কলেজেরও রয়েছে নারী শিক্ষার্থীর সুবিস্তৃত মেধাতালিকা। তিনের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর পাশ করে উচ্চশিক্ষার্থে বিলেত গেলেন এক নারী— ফজিলতুন্নিসা। অতএব বলা যায়, ‘আলো ক্রমে আসিতেছে।’
এই আলো এল রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনকে ঘিরেও। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেই এর বহুপূর্বে নারীমহলে দেবতার দীপ হস্তে এগিয়ে এসেছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে উপন্যাসকার-সম্পাদক স্বর্ণকুমারী দেবী, লেখক-সম্পাদক জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, সমাজসেবী সরলা দেবী, বিদুষী ইন্দিরা দেবী এবং প্রতিমা দেবীরা তো ছিলেনই— শান্তিনিকেতন নির্মাণ দিল রাণী চন্দ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়দের, দিল অসংখ্য নারীকে আত্মতার দীক্ষা। যে নবনীতা আজ আমাদের আলোচ্য, তাঁর মা এবং শ্বশ্রুমাতা, উভয়ের বিকাশের পেছনে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমরা এইসব মাথায় রেখে নবনীতা আখ্যান বুনতে অগ্রসর হব এবার।
নবনীতা: গঠনপর্ব
নবনীতা দেবসেনের শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে পিতামাতার ছত্রছায়ায়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আত্মিক যোগ ছিল নবনীতার বাবা-মা উভয়ের, তবু তিনি শান্তিনিকেতনে পড়তে যাননি, যেমন যাননি সুশোভন সরকারের মেয়ে শিপ্রা, কেন-না রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য অপিচ ব্রাহ্মসমাজ পরিচালনায় আনুষ্ঠানিকভাবে রবীন্দ্রনাথের সহযোগী হলেও সুশোভন শান্তিনিকেতনে নিজ কন্যার শিক্ষালাভকে সমর্থন করতে পারেননি। পেরেছিলেন মনীশ ঘটক, যিনি তাঁর কন্যা মহাশ্বেতাকে রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালেই শান্তিনিকেতনে পড়তে পাঠান।
নবনীতার ক্ষেত্রে কারণটা অনুমান করা যায়। বাবা এবং মা কেউই শিশুসন্তানকে দূরে রেখে স্বস্তি পেতে চাননি। এবং এর কলেই নবনীতা অতীব সৌভাগ্যবতী হয়ে উঠলেন নিজের উন্মেষপর্বে পিতামাতার সারস্বত সান্নিধ্যের। তাঁর বিভিন্ন রচনায় নবনীতা তাঁর শৈশবের যে উচ্ছল স্মৃতিচারণা করেছেন, তাতে কেবল তাঁর পিতামাতার কথাই নয়, রয়েছে অসংখ্য পিতৃবন্ধুর কথা, যাঁদের সান্নিধ্যে তিনি ঋদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন।
কিন্তু কেবল বুধজনসান্নিধ্যেই বড় হয়ে ওঠেননি নবনীতা। ছিল নিজস্ব নীল নির্জন-এর জগৎ, যে জগতের একাকী অধিশ্বরী তিনি নিজে। এই যে মোহন একাকিত্ব দিয়ে নির্মিত তাঁর জীবন, অবশেষে তা-ই তো তাঁর কারুবাসনার জন্ম দেবে। শিশুর একান্ত নিভৃত নিবিড় জগতের বাসিন্দা হয়ে তাঁর অনুভবকে তিনি এভাবে মেলে ধরেন— ‘ঘুলঘুলি দিয়ে আসা আলোর সঙ্গে ছায়া মিশে আশ্চর্য আলপনা। হাইড্র্যান্টের জল উপচে রাস্তা কখনও নদী, জল সরে গেলে জেগে থাকত ধবধবে সাদা গঙ্গামাটির পলি। কয়লার উনুনের ধোঁয়ায় দিনে দু’বার মেঘ জমত আকাশে।’ এক অপার অফুরন্ত ছেলেবেলা কেটেছে তাঁর, যখন হারিয়ে যাওয়ার মানা ছিল না কোনও, স্বেচ্ছাচারী হবার ছাড়পত্র পেয়ে ভাবছেন, ‘ফুটপাতের পাড় ঘেঁষে সারাদিন রাত কী চমৎকার ঘোলা জলের বন্যা বইয়ে দিত। ঠিক যেন ছোট একটা নদী ঠিকানা ভুলে এসে পড়েছে হিন্দুস্তান পার্কে। …অত জল বয়ে যাচ্ছে বাড়ির সামনে দিয়ে, পাড়ার মধ্যে দিয়ে, জলে নামতে হবে না? জুতো মোজা খুলে রেখে যতক্ষণ সম্ভব ছপছপ করে খালি পা ডুবিয়ে সেই জলের মধ্যে খেলা করতুম, ফ্রকের নিচটা গুটিয়ে নিয়ে, জলের ছিটে লাগবে তো!’
গঠনপর্বে নবনীতার কাছে অনুকূলতা হিসেবে দেখা দিয়েছিল বাবা-মার পারস্পরিক প্রীতির সম্পর্ক, বাড়িতে নিয়ত এক সারস্বত পরিবেশ, আত্মীয়-অনুষদ এবং সর্বোপরি শিশুর স্বাতন্ত্র্য বিঘ্নিত না হওয়ার নিশ্চিন্ততা। মাত্র তের বছরে বিধবা হন রাধারাণী, পুনর্বিবাহ করেন আঠাশ বছর বয়সে, যে বয়স স্বভাবতই জগৎ ও জীবনকে উপলব্ধি করার সমূহ সুযোগ দিয়েছিল তাঁকে। ইতোমধ্যে কবিতা ও উপন্যাস লিখে তিনি খ্যাত হয়েছেন, নিজের অবস্থান নির্দেশ করতে সমর্থ হয়েছেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যতটা সম্ভব।
হ্যাঁ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এবং তার বিপ্রতীপে রাসসুন্দরী, বিনোদিনী, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনদের জেহাদ-এর ধারাবাহিকতা দিয়েই বিচার করতে হবে জ্যোতির্ময়ী দেবী, কামিনী রায়, কুসুমকুমারী (দাসী!), নিরুপমা দেবী, অনুরূপা দেবী, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, আশাপূর্ণা দেবী, বাণী রায় বা রাধারাণীকে। ১৮৬৮-তে বাংলায় প্রথম আত্মজীবনীটি লিখলেন রাসসুন্দরী। বেদনামথিত স্বরে তিনি জানাচ্ছেন, ‘আমার নারীকুলে কেন জন্ম হইয়াছিল? আমার জীবন ধিক্।… আমি যদি পুত্রসন্তান হইতাম, আর মার আসন্নকালের সম্বাদ পাইতাম, তবে আমি যেখানে থাকিতাম, পাখির মত উড়িয়া যাইতাম। কি করিব, আমি পিঞ্জর-বন্ধ বিহঙ্গী।’ এই পিঞ্জরাবস্থা ছিল বেগম সুফিয়া কামালেরও। তাঁর বড়মামা তাঁকে ‘মেঘদূত’ পড়ে শোনাচ্ছেন। ‘রঘুবংশ’ আর ‘রাজতরঙ্গিণী’ অনুবাদ করে করে শোনাচ্ছেন। অথচ সে-ই মামাই কিন্তু সুফিয়া কামালের লেখা প্রকাশিত হতে দেখে তাঁর প্রতি খড়্গহস্ত। বেগম সুফিয়া কামাল অতি দুঃখে আক্ষেপ করে লিখছেন, ‘আমার বড়মামা শায়েস্তাবাদের বাড়ি বসেই সে লেখা দেখে আগুন হয়ে আমাকে শহর থেকে (বরিশাল শহর) আবার শায়েস্তাবাদে নিয়ে গেলেন। অকথ্য গালি দিলেন তাঁর আপন ভাইয়ের ছেলে আমার স্বামীকে।’
অর্থাৎ সেই মনুকথিত প্রবল বাণী, ‘ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।’ না, এ বাণী শাশ্বত নয়, এবং একেও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো যায়, প্রমাণ করলেন রাধারাণী। যার সফল ফসল নবনীতার হার্ভার্ড পর্যন্ত যেতে পারা।
কীভাবে ভাঙলেন রাধারাণী? এক, নিজের বিয়ের ক্ষেত্রে বিপ্লব এনে। হিন্দুমতে বিয়ে করতে গেলে কন্যা সম্প্রদান অবশ্যকৃত্য। এটাও মনুবাহিত নিয়ম। এক খাঁচা থেকে অন্য খাঁচায় ঢোকানো হয় নারীকে। রাধারাণী অন্যের দ্বারা সম্প্রদান হতে দিলেন না। নিজেকেই নিজে সম্প্রদান করলেন। এ নিয়ে স্বর্গ থেকে পুষ্পবৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল, হয়নি। ঈশ্বরগুপ্ত বেঁচে থাকলে এ নিয়ে জল কতটা ঘোলা হত তা অনুমান করতে পারি মাত্র। আর বিদ্যাসাগর বিবাহস্থলে এসে অশ্রুমোচন করতেন এ-ঘটনায়, নিঃসন্দেহ আমরা। এসবের কিছুই হয়নি। কেবল সে সময়ে খবর হয়েছিল ওটা, ‘কন্যার আত্মসম্প্রদান’ শিরোনামে।
রাধারাণীর মনুবিরোধী দ্বিতীয় স্বাতন্ত্র্য অর্জন রবীন্দ্রনাথের আজ্ঞার বিরোধিতা করে। মজার ব্যাপার হল, ‘নবনীতা’ নামটি রবীন্দ্রনাথ কিন্তু গোড়ায় দিতে চেয়েছিলেন রাধারাণীকেই। কবির যুক্তি ছিল, যা তাঁর চিঠিতে ব্যক্ত, ‘আজ থেকে তুমি নতুন জীবনে আনীতা হলে। তাই তোমার নাম হল নবনীতা।’ রাধারাণী এর জবাবে কবিকে লিখলেন, ‘কিন্তু আমি আপনার নামটি নিতে পারছি না। আমি ২৮ বছর ধরে রাধারাণী, আমার দুটো বই এই নামে আছে। কাজেই এই নাম আমি নিতে পারব না।’ আমরা একে নারীর স্বাতন্ত্র্য অর্জন হিসেবেই দেখব।
এরই পরম্পরায় নবনীতা। গোখেল মেমোরিয়াল স্কুল, লেডি ব্রেবোর্ন, প্রেসিডেন্সি কলেজ শেষে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষার্থী জীবন পরবর্তীকালে তাঁকে নির্মিতি দিয়েছে। বিশেষ করে নবনীতার যে সারস্বত বোধের ব্যাপ্তি, তার পেছনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা প্রচুর। তিনি এখানে পান বুদ্ধদেব বসু এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মত দুই দিকপাল শিক্ষক। তুলনামূলক সাহিত্য পাঠে তাঁর বোধি এর ফলে অর্গলমুক্ত হয়। কখনও হোমার-ভার্জিল-ইসকাইলাস, কখনও কালিদাস-কম্বন-তুকারামে প্রবেশ ঘটে তাঁর। রামায়ণ নিয়ে পরবর্তীকালে তাঁর যে গবেষণা, অথবা নানান ভাষা থেকে তাঁরকৃত অনুবাদসমূহ, তার সুতিকাগার তো ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে তিনি শিক্ষার্থীরূপে আসেন, শিক্ষক হয়ে অবসর নেন। তাঁর সহশিক্ষকদের বলয়টিও ছিল ঈর্ষণীয় বুধজনসমাকূল। নরেশ গুহ, ফাদার ফাঁলো, ডেভিড ম্যাককাচ্চান, হৃষিকেশ বসু, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, অমিয় দেব, রবের আঁতোয়ান, এঁরা মিলে যে বহুরত্নসভা ছিল যাদবপুরে, তার ইতিহাস লেখা উচিত জুলিয়াস সিজারের লেখনী দিয়ে। ছিলেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অজিত দত্ত। বাংলা অনুবাদ- সাহিত্যের এক সম্ভ্রান্ত পরম্পরায় সেতু রচনা অভিপ্রেত এবং উপেক্ষিত হয়ে আছে, যেখানে বুদ্ধদেব-সুধীন্দ্রনাথ-আঁতোয়ান (ঈ’নীড)-মানবেন্দ্র-অলোকরঞ্জন হয়ে নবনীতা পর্যন্ত প্রসারিত রাজপথ লক্ষ করব আমরা।
নবনীতা কবিতাচর্চা দিয়ে সাহিত্যজীবন শুরু করেন। বিখ্যাত পিতামাতার সন্তান তিনি, তবু নিজের পথ নিজেকেই তৈরি করতে হয়েছে তাঁকে। ‘বঙ্গদর্শন’ বা ‘সবুজপত্র’, ‘কল্লোল’ বা ‘কবিতা’, কোথাও সম্পাদক-সহকারীদের নারী সংলগ্নতা ছিল না। ‘কৃত্তিবাস’ প্রশ্রয় দিল কবিতা সিংহ, নবনীতা দেবসেন, দেবারতি মিত্র, বিজয়া রায় প্রমুখকে। এ-ও অর্জন। আবার ‘দেশ’ পত্রিকা প্রথমবারের মত যাঁকে শারদীয় সংখ্যায় উপন্যাস লেখক হিসেবে স্থান দিল, তিনি নবনীতা (আমি অনুপম, ১৯৬৯)। এই অর্জন, অর্জনসমূহ নিয়ে আমরা সোচ্চার নই। যেমন সোচ্চার নই শৈলবালা ঘোষজায়ার ‘শেখ আন্দু’ অথবা প্রতিভা বসুর ‘সমুদ্রহৃদয়’ উপন্যাসটি নিয়ে, বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-মুসলমান নরনারীর (সামাজিক উপন্যাসে) প্রেম যাঁদের লেখায় ব্যতিক্রম হয়ে দেখা দিয়েছিল। নবনীতার যে গবেষণা নারী-রচিত রামায়ণাবলি নিয়ে, সেখানেও তিনি আশ্চর্য ভগীরথ। নবনীতা-অনুধাবনে এসব আমাদের বিবেচ্য হয়ে উঠুক। ‘নটি নবনীতা’ নয়, এক ব্যাপ্ত অনুসন্ধানে তখন জানব আমরা, কটি নবনীতা।
এইসঙ্গে দরকার আধুনিক ভারতবর্ষের নারী-লেখকদের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে নবনীতাকে পাঠ করা। মামণি রায়সম আর অমৃতা প্রিতম, কমলা দাস, অরুন্ধতী রায়, নন্দিনী শতপথীদের যে সান্দ্র ও মায়াময় জগৎ, বা কপিলা বাৎসায়ন-গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক-কুররাতুল আইন হায়দার আর কেতকী কুশারী ডাইসন-সুকুমারী ভট্টাচার্য-অনিতা অগ্নিহোত্রীদের মেধাবী কারুবাসনা, তার সঙ্গে মিলিয়ে না দেখলে নবনীতা তাঁর সমূহ তাৎপর্যে উঠে আসবেন না। তাঁর মধ্যে কতটা ইন্দিরা গোস্বামী আর কতটাই ইসমত চুগতাই, ধ্যানে তিনি কতখানি অমৃতা শেরগিল অনিতা দেশাইয়ের সঙ্গে যুক্ত এবং ঝুম্পা লাহিড়ী, সেলিনা হোসেন এবং আনোয়ারা সৈয়দ হকের সঙ্গে তাঁর ব্যবধানটাই বা কতখানি, তা জানার মধ্য দিয়েই নবনীতাপাঠের দ্বার খুলবে।
নবনীতা তাঁর মায়ের বৈধব্যকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন তাঁর এক লেখায়। নিতান্ত কাকতালীয়। বিদ্যাসাগরের প্রথম বিধবাবিবাহটি-ই তো প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে যে বালবিধবা প্রতিমার বিয়ে দিয়েছিলেন, তা-ও ব্যর্থ প্রণয়ে পর্যবসিত হয়। বাংলা সাহিত্যে যে কুন্দ-রোহিণী-দামিনী-সাবিত্রী, এঁরা বড় জটিল। সেই দিক দিয়ে নবনীতা অশেষ সৌভাগ্যবতী। এজন্যই অতি সহজতায় তাঁর কাছে গবেষণা করতে পারেন লিঙ্গান্তরিত নারী মানবী। এই যে আধুনিকতায় উত্তরণ, এজন্যই নবনীতাকে মনে রাখব। দেশবিদেশে তাঁর অধ্যয়ন-অধ্যাপনা ঘটনামাত্র। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, দৃষ্টিকোণ সম্মানার্হ।
নবনীতা: ব্যক্তিগত
তাঁর সঙ্গে পরিচয় দীর্ঘদিনের। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাঁর গৃহে, নানা সভাস্থলে তাঁর সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে। ১৯৮৫-তে ‘দেশ’ পত্রিকায় কমলকুমার মজুমদারের লিখনশৈলী নিয়ে আমার একটি মৌলিক সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে তিনি চিঠি দেন আমাকে। আমার অকালপ্রয়াত স্ত্রী দেবাঞ্জলির স্মরণসভায় যোগ দিতে তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। বহু স্মৃতি আছে তাঁকে নিয়ে।
সবচেয়ে উজ্জ্বল স্মৃতি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শেষযাত্রার দিনের। সুনীলদার শরীর ইলেকট্রিক চুল্লিতে দাহ হচ্ছে, আর তারই খানিক দূরে বসে আছি আমরা। সুনীলদা সম্পর্কে বহু কথা বলে যাচ্ছিলেন। বলতে বলতে তাঁর মনে পড়ে গেল বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যুর কথা। চলে গেলেন তাঁর প্রসঙ্গে। বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যুদিনটিতে তিনি আর অলোকরঞ্জন বসে বসে স্মৃতিচারণ করছিলেন বুদ্ধদেবের, জানালেন। সেদিন অন্য এক নবনীতাকে পেয়েছিলাম। আজ বুদ্ধদেব সুনীল নবনীতা কোথায় কোন নক্ষত্রলোকে প্রতিবেশী!
নবনীতা দেবসেন প্রয়াত হয়েছেন ৭ নভেম্বর ২০১৯-এ। এক বিদুষী, সু-অধীত, প্রাজ্ঞ, কবি-প্রাবন্ধিক-গল্পকার-রম্যরচনাকার-অনুবাদক-ঔপন্যাসিকের জীবন সম্-এ এসে ঠেকে সহসা। তবু আমাদের কাছে নবনীতা রইলেন। তাঁর রচনায় ‘ভালো-বাসার বারান্দা’-য়, তাঁর ‘সই’-তে, তাঁর রঙ্গ-রসিকতায়, তাঁর দুই আত্মজায়, আর আমাদের মত স্মৃতিকাতরদের অন্তরে।
অসাধারণ লেখা! ঝরঝরে ও নির্মেদ লেখা।