Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

মহাশ্বেতা দেবী: বিচিত্রমুখী ও মৃত্তিকাসংলগ্ন

রবীন্দ্রনাথ বা সত্যজিৎ রায়ের যেমন বংশ পরম্পরাগত ঐতিহ্য বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জগতে, মহাশ্বেতা দেবীরও তাই। এই ঐতিহ্য ও পরম্পরার সূচনা মহাশ্বেতার মাতৃবংশে জাত যাদব চক্রবর্তীকে দিয়ে। মহাশ্বেতার প্রমাতামহ যাদবচন্দ্র ছিলেন পাবনা জেলার লোক, কোচবিহার মহারাজের দেওয়ান। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা ছিল এবং সেই সুবাদে তিনি ব্রাহ্ম হতেও গিয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁকে নিবৃত্ত করেছিলেন। যাদবচন্দ্র ছিলেন গ্রন্থকর্তা ও চিত্রশিল্পী। রাজা রামমোহন রায়ের প্রথম জীবনী রচয়িতা তিনি। সিংহল ও মায়ানমার (সাবেক বৰ্মা) বেড়াতে গিয়ে সে-সব জায়গার মন্দির ও প্যাগোডার স্কেচ করে এনেছিলেন।

কবি অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন যাদবচন্দ্রেরই পৌত্র। মহাশ্বেতা দেবীর দিদিমা কিরণময়ী দেবীও লেখিকা ছিলেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর ঢাকা শাখার সম্পাদক ছিলেন তিনি। পরিষদের পত্রিকা ‘প্রতিভা’-তে তাঁর লেখা প্রকাশিত হত। মহাশ্বেতার এক মামা শচীন চৌধুরী ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’ নামে মুম্বইয়ের বিখ্যাত পত্রিকাটির সম্পাদক এবং হিমাংশু রায়ের মৃত্যুর পর মুম্বইয়ে হিমাংশু-প্রতিষ্ঠিত ‘বম্বে টকিজ’-এর পরিচালক ছিলেন। অন্য মামা শঙ্খ চৌধুরী প্রখ্যাত ভাস্কর।

এই গেল মাতৃকুল। পিতৃকুলে বিখ্যাততম হলেন ঋত্বিককুমার ঘটক, মহাশ্বেতার প্রায়-সমবয়সী কাকা। মহাশ্বেতার পিতামহ সুরেশচন্দ্র ঘটক ইংরেজি, সংস্কৃত ও ইতিহাস এই তিনটি বিষয়ে এমএ! এঁর পুত্রদের মধ্যে মহাশ্বেতার পিতা মণীশ ঘটক ছিলেন কবি ও প্রাবন্ধিক। ‘কল্লোল’ যুগের অন্যতম স্বনামধন্য লেখক, যাঁর ‘পটলডাঙ্গার পাঁচালী’ বহুচৰ্চিত গ্রন্থ। ‘মান্ধাতার বাবার আমল’ নামে আত্মজীবনীও রয়েছে তাঁর। মহাশ্বেতার মা ধরিত্রী দেবীও লেখালেখি করতেন। তাঁর লেখা ‘নারী’ কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রশংসা অর্জন করে। এটি ‘জয়শ্রী’-তে বেরিয়েছিল। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় তাঁর গল্পও ছাপা হয়। ‘মাসিক বসুমতী’-তে বেরোয় পার্ল এস বাক রচিত গল্পের অনুবাদ। তাছাড়া হাতে-লেখা একটি পারিবারিক পত্রিকা ছিল তাঁদের, নাম ‘ফসল’।

পরিবারে খ্যাতনামাদের মধ্যে আর-একজন হলেন মণীশের অন্য এক ভাই সুধীশচন্দ্র ঘটক, যিনি বিমল রায়ের সঙ্গে বিলেত গিয়ে সিনেমা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে এসে নিউ থিয়েটার্স-এ যুক্ত হন। বহু ছবির ক্যামেরাম্যান তিনি, যেমন কানন দেবী-সায়গলের ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’। কয়েকটি সিনেমার পরিচালকও ছিলেন ঋত্বিক-অগ্রজ সুধীশচন্দ্র। ‘রাধারাণী’ (১৯৫০), ‘দ্বৈরথ’ (১৯৫১), ‘পঞ্চায়েত’ (১৯৫১) সুধীশ-পরিচালিত চলচ্চিত্র।

এমন এক ঐতিহ্যিক পরিবারে মণীশ-ধরিত্রীর পাঁচ মেয়ে ও চার ছেলের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ হয়ে মহাশ্বেতার জন্ম। বাবা ছিলেন প্রেসিডেন্সির কৃতী ছাত্র। মেয়েকে প্রথমে ঢাকার ইডেন মান্টেসরিতে ভর্তি করেন। বাবা চাকরি করতেন সরকারি রাজস্ব বিভাগে। বদলির চাকরি। তাই মহাশ্বেতা এরপর মেদিনীপুরের স্কুলে পড়েন। তারপর পিতার ইচ্ছায় শান্তিনিকেতন। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ প্রথম দফায় এই যে তিন বছর সেখানে পাঠভবনে পড়াশুনো, তা তাঁকে এক গভীর জীবনবোধ অর্জনে সহায়তা করে। আমাদের একটু আশ্চর্যই লাগে, যে মণীশ ঘটক (ছদ্মনাম যুবনাশ্ব) ছিলেন কল্লোল গোষ্ঠীর লেখক এবং যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে সাহিত্যে আধুনিকতা আনতে চান তিনিই কিনা আত্মজাকে ভর্তি করালেন শান্তিনিকেতনে, বিশাল এক পরিবারের অর্থকৃচ্ছ্রতা সত্ত্বেও! আর তা ঠিক এমন এক সময়ে, যখন কল্লোল রীতিমত জয়ধ্বজা ওড়াচ্ছে তার!

এই শান্তিনিকেতন-পর্ব মহাশ্বেতাকে নির্মিতি দিয়েছে বহুল পরিমাণে। একে তো মাথার ওপরে জাজ্বল্যমান রবীন্দ্রনাথ আর তার ওপর ওখানকার যে মনীষীসমাবেশ— তেজেশচন্দ্র সেন, হাজারিপ্রসাদ দ্বিবেদী, কৃষ্ণ কৃপালনী, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রামকিঙ্কর বেইজ, দীনবন্ধু এন্ড্রুজ, সরলা দেবী, এই অভাবিত নক্ষত্রসন্নিবেশ তাঁকে গড়ে তুলেছে। দৈনন্দিন পঠন-পাঠনের বাইরে প্রকৃতিকে চেনা, দেশবিদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের উষ্ণ সান্নিধ্য, আকাশ-বাতাসমুখরিত সঙ্গীতের আবহ, খেলাধুলোর প্রসন্ন পরিবেশ, মাঝে মাঝেই খোয়াই দৰ্শন, সেই ‘সব পেয়েছির দেশ’ সম্পর্কে মহাশ্বেতার মন্তব্য, ‘আমি ওই তিন বছরে অনেক পেয়েছি। সেদিনের শান্তিনিকেতনের কাজই ছিল, শৈশব থেকে মনের অজস্র চোখ ও দরজা খুলে দেওয়া।’ পিতার আর্থিক কারণেই হয়তো তাঁকে তিন বছর বাদে ওখান থেকে চলে এসে কলকাতার বেলতলা গার্লস-এ ভর্তি হতে হয়। ম্যাট্রিক পাশ করেন ওখান থেকেই। পরে আশুতোষ কলেজে ভর্তি হলেও তৃতীয় বর্ষে আবার শান্তিনিকেতন এবং সেখান থেকেই ’৪৬-এ বিএ ডিগ্রি অর্জন। এমএ-তে ভর্তি হলেন এমন এক ক্রান্তিকালে, ’৪৬-এর দাঙ্গা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দিল না তাঁকে, মামাবাড়ি ল্যান্সডাউন রোডে থেকে প্রত্যক্ষ করেন দাঙ্গার বীভৎসতা, দেখেন ডাবলডেকার বাস-ভর্তি মৃত ও আহত লোকের শরীর। বহু পরে ১৯৬৩-তে প্রাইভেটে এমএ পাস করেছিলেন তিনি ইংরেজি সাহিত্যে। ১৯৪৭-এর ২০ অক্টোবর বিয়ে হয় মহাশ্বেতার, আর-এক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নাট্যকার নাট্য পরিচালক মঞ্চ ও চলচ্চিত্রাভিনেতা বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে। ১৯৪৮-এর ২৩ জুন (পলাশীর যুদ্ধের তারিখ) জন্ম হয় তাঁদের একমাত্র পুত্র নবারুণের।

মহাশ্বেতা লিখতে শুরু করলেন কীভাবে ও কবে থেকে? স্বামী বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন কমিউনিস্ট। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৪৮ থেকে পার্টি নিষিদ্ধ, ফলে বিজনকে প্রায়ই চলে যেতে হয় আন্ডারগ্রাউন্ডে। এর মধ্যেই বিজন গণনাট্য সংঘের হয়ে নাটক করছেন, লিখছেনও, ‘আগুন’, ‘জবানবন্দী’, ‘নবান্ন’। সংসারের দায়িত্ব নিয়ে মহাশ্বেতা আজ এ চাকরি, কাল ও চাকরি। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ মূর্ত হয়ে উঠেছিল মহাশ্বেতার জীবনে, মায় তাঁর ঢিবিতে আক্রান্ত হওয়ার বাস্তবতাসমেত। তবে নীতার মত তাঁকে মরতে হয়নি। স্বামী পার্টি করতেন বলে কেন্দ্রীয় সরকারের ১৪০ টাকা মাইনের চাকরিটি খোয়াতে হয়েছিল তাঁকে, এইমাত্র। তখন টিউশন ভরসা।

এর মধ্যে সহসা ঝাঁসীর রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের জীবনী তাঁকে আকৃষ্ট করল। এই চরিত্রটির গভীরে ডুব দিতে দিতে দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে ন্যাশনাল লাইব্রেরি গিয়ে এতদসংক্রান্ত বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে তাঁর সংকল্পে থিতু হলেন তিনি, এই রানিকে নিয়ে লিখবেন তিনি। প্রাথমিকভাবে লিখেও ফেললেন চারশো পৃষ্ঠা। স্বস্তি পেলেন না লিখে। ছিঁড়ে ফেললেন সে-লেখা আর ঝাঁসী গিয়ে রানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি হৃদ্গত করে নিয়ে লিখবার জেদ তাঁকে সেখানে নিয়ে ছাড়ল। তারই ফলশ্রুতি ‘ঝাঁসীর রাণী’ রচনা, ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৯৫৫ সাল জুড়ে ধারাবাহিকভাবে তা ছাপলেন সাগরময় ঘোষ। সাপ্তাহিক পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক তিনি। ইতিহাসবিদ প্রতুলচন্দ্র রায় তাঁর বন্ধু। প্রতুলচন্দ্রের সুপারিশেই সে-লেখা ছাপা হয়েছিল ‘দেশ’-এ। তাছাড়া তিনি একদিকে বহু গ্রন্থ পড়তে দিয়ে, গ্রন্থের তালিকা দিয়ে যেমন সাহায্য করেছিলেন মহাশ্বেতাকে, তেমনি ১৯৫৩-তে আহমেদাবাদে অনুষ্ঠিত ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসে মহাশ্বেতার যোগদানের ব্যবস্থা করে গ্রন্থ রচনায় প্রভূত সাহায্য করেন।

সে বড় সুখের সময় ‘দেশ’-এর, বাংলা সাহিত্যের। বিমল কর ও শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক উপন্যাসের পরেই মহাশ্বেতা! তার পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবেই ধীরাজ ভট্টাচার্য লিখছেন ‘যখন নায়ক ছিলাম’, বেরোচ্ছে সমরেশ বসুর গল্প, বিজ্ঞাপিত হচ্ছে ‘বহুরূপী’-র রবীন্দ্রনাটক রক্তকরবী, সাবিত্রী রায়ের ‘পাকা ধানের গান’ আর লীলা মজুমদারের ‘মণিকুন্তলা’-র আবির্ভাব হচ্ছে, উপন্যাস লিখছেন আরও এক নারী আশা দেবী, যাঁর গ্রন্থটি (মেঘলা প্রহর) ওই সময়েই সমালোচিত হতে দেখি ‘দেশ’-এ। সাহিত্যে এই যে মেয়েরা স্থান করে নিচ্ছেন স্বাধীনতার এক দশকের মধ্যেই প্রবলভাবে, খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এর বার্তা। শুধু গদ্য রচনাতেই, বা কেবল সাহিত্য রচনাতেই নয়, সময়টিকে আমরা স্বাধীনতা-পরবর্তী নারী-জয়যাত্রার সূচনালগ্ন হিসেবেও ধরতে পারি। নাটকে তৃপ্তি মিত্র, চলচ্চিত্রে সুচিত্রা সেন আলো ছড়াচ্ছেন। ‘দেশ’-এই তো দেখছি জগন্নাথ চক্রবর্তী, শামসুর রাহমান, আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যেমন, তেমনই কবিতা লিখছেন আরতি দাস। এই শুভলগ্নেই ৩০ জুলাই ১৯৫৫-য় ‘দেশ’ পত্রিকাতেই বিজ্ঞাপন বেরোল, ‘১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসের এক স্মরণীয় ঘটনা।… রাণী লক্ষ্মীবাঈ ছিলেন তার অন্যতমা সংগ্রামী। ১৮৫৭ সালের ৪ঠা জুন থেকে ১৮৫৮ সালের ৩রা এপ্রিল পর্যন্ত ঝাঁসিতে ব্রিটিশরাজের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ তিনি করেছিলেন, অবশেষে ১৭ই জুন অবিচ্ছেদ্য ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের পর গোয়ালিয়রের রণক্ষেত্রে তাঁকে প্রাণ হারাতে হয়।

‘সারা ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালনের উদ্যোগ-আয়োজন শুরু হয়েছে। এই উপলক্ষ্যে মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য কর্তৃক লিখিত বীরশ্রেষ্ঠা ভারতীয় নারী লক্ষ্মীবাঈয়ের বহু নূতন তথ্য সংবলিত জীবনালেখ্য ‘ঝাঁসীর রাণী’ আগামী সপ্তাহ থেকে দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।’

এমন কিন্তু নয় যে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি শুরু হয় এ লেখাটির মাধ্যমে। এর আগে ‘দেশ’ পত্রিকাতেই তাঁর দু-তিনটে ছোটগল্প বেরিয়েছিল। জিম করবেট, যাঁকে তিনি পরবর্তীকালে অনুবাদ করবেন, ছিল তাঁর প্রবন্ধের বিষয়, ওখানেই।

তাছাড়া মহাশ্বেতার লেখক সত্তার উন্মেষকাল তো শৈশবেই, শান্তিনিকেতন পর্বে। সেখানে সে সাহিত্যসভা হত নিয়মিত, সরলা দেবী চৌধুরানী সভাপতিত্ব করতেন, দশ-বারো বছরের মহাশ্বেতা লেখা পড়তেন সেখানে, যা ছাপাও হয়েছিল। সেই বয়সে আলফ্রেড নোবেলকে নিয়ে মহাশ্বেতা প্রবন্ধ লিখছেন, ভাবা যায়? পরবর্তীকালে খগেন্দ্রনাথ সেনের ‘রংমশাল’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’ বইয়ের আলোচনা করেন যখন, তখন তাঁর বয়স মাত্রই তের (১৯৩৯)। হাতে-লেখা পত্রিকা বার করাও বাদ যায়নি, বয়সে তিন মাসের ছোট ঋত্বিক যে-কাজে তাঁর সহযোগী। পত্রিকায় ছবি আঁকার দায়িত্ব ছিল ঋত্বিকের। রাজলক্ষ্মী দেবী ছিলেন বেলতলা স্কুলে মহাশ্বেতার সহপাঠিনী, এমএ ক্লাসেরও। স্কুলে পড়ার সময় তাঁরা আর-একবার হাতে-লেখা পত্রিকা বার করলেন, নাম ‘ছন্দ-ছড়া’।

দ্বিতীয়বারের শান্তিনিকেতন-পর্বে তাঁর গল্প লেখার সূচনা। ‘দেশ’, ‘সচিত্র ভারত’ পত্রিকা-সহ আরও নানা পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন এ-সময়ে, পাঁচের দশকের গোড়া থেকে।

দুই

দীর্ঘ প্রায় সাত সাতটি দশকজুড়ে মহাশ্বেতা দেবী অনলস লিখে গেছেন। রচনা সম্ভারের বিপুলতা এবং বৈচিত্র্য, উভয় দিক থেকেই বিস্ময় জাগে তাঁর রচনাবলির দিকে তাকালে। উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, অনুবাদ ছাড়াও ছাত্রপাঠ্য বহু বই লিখতে হয়েছে তাঁকে। পাঁচের দশকের মাঝামাঝি থেকে লেখাকেই পেশা করে নেন তিনি, যাকে বলে প্রফেশনাল রাইটার। সমরেশ বসু ছাড়া বাংলা সাহিত্যে একমাত্র মহাশ্বেতা দেবীকেই এই অভিধা দেওয়া হয় এবং সম্ভবত পরবর্তীকালে কিন্নর রায়কে। মাঝে অল্প কয়েক বছরের জন্য তিনি বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজে ইংরেজির অধ্যাপিকা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। আবার ছেড়েও দিয়েছেন সে-চাকরি, পূর্ণ সময়ের লেখক হওয়ার জন্য। একে নিতান্ত দুঃসাহস ছাড়া আর কী-ই বা বলা যাবে, যখন বাংলাভাষায় লিখে নিয়মিত উপার্জন করা ছিল অলীক স্বপ্ন!

লেখার পাশাপাশি তাঁর অন্যতর পরিচয় আছে সমাজকর্মী হিসেবে এবং তা কোনও সৌখিন পদচারণা ছিল না। বাংলা-বিহার-ওড়িশার প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর আদিবাসীর মধ্যে কাজ করে গেছেন তিনি আজীবন। জঙ্গলমহলের খেড়িয়া, শবর, লোধাদের সামাজিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন তিনি। এই জনজাতিকে জমির পাট্টা দিতে তাঁর নেতৃত্বদানের জন্য তিনি সেখানে মায়ের মত সম্মান পান। শবর জাতির ওপর ঔপনিবেশিক শোষণ ছিল সীমাহীন উপরন্তু ব্রিটিশরা এঁদের আখ্যা দেয় ‘অপরাধপ্রবণ’ জাতি হিসেবে। মহাশ্বেতা তাঁদের সেই দুর্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে দেখান, তাঁদের প্রাচীন সংস্কৃতি কী মহান। একদিকে তিনি তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁদের অর্থনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে গিয়েছেন, অন্যদিকে তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে ভারতের আদিবাসী সমাজের এক বিরাট অংশ তাঁদের সভ্যতা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-উত্তরাধিকার নিয়ে প্রামাণ্য ও মহত্ত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর’, ‘কৈবর্তখণ্ড’ ইত্যাদি উপন্যাস এবং তাঁর অসংখ্য ছোটগল্পে আদিবাসী মানুষের স্বেদ রক্ত হাহাকার ও সহজ আদিম জীবনযাপনের রেখাচিত্র অঙ্কিত হয়ে আছে। আদিবাসীদের জীবনের গভীরে গিয়ে তাঁদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হওয়া, তাঁদের লোকাচার এবং ইতিহাসের পরম্পরাকে শ্রদ্ধাসহকারে অনুধাবনের চেষ্টা আর কোনও বাঙালি লেখকের মধ্যে দেখা যায়নি। বাংলা সাহিত্যের ভূগোলকে বিস্তৃতি দিয়েছেন তিনি, আদিবাসী সমাজের সঙ্গে আমাদের নৈকট্য এনে দিয়েছেন। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’ আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ আদিবাসীদের বহিরঙ্গটুকু দেখায় মাত্র। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শরৎচন্দ্র পর্যন্ত সময় লেগেছিল অভিজাত উচ্চবিত্ত থেকে উপন্যাসে মধ্যবিত্তের কথাকলি নির্মিত হতে। আর সেখান থেকে আদিবাসী সমাজে আসতে লেগে গেল আরও বহু বছর। বাংলা সাহিত্যের সীমাবদ্ধতা এখানেই যে, কেবল আদিবাসী সমাজ-ই নয়, দলিত সমাজের প্রতিনিধিস্থানীয় গল্প-উপন্যাসেরও বড় দৈন্য, দৈন্য মুসলমান সমাজের প্রতিফলনেও। তাছাড়া বাঙালি বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সমাজ বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব আছে, বাংলা সাহিত্য পড়ে তা টেরই পাওয়া যায় না। মহাশ্বেতা দেবীর কাছে বাংলা কথাসাহিত্য চিরঋণী হয়ে থাকবে এই কারণেই যে, পূর্ব-ভারতের ভূমিপুত্র-কন্যাদের তিনি তাঁর লেখায় এনেছেন। এর ফলে ব্রাত্যজন পদাবলির যে নিরন্তরের চেতনাপ্রবাহ, তার পরিচয় পাই। দলিত, ব্রাত্য আর কৌম জনজাতি-ই যে ভারতবর্ষ নামক সুপ্রাচীন সভ্য দেশের প্রাণ, তা এমন করে বাংলা সাহিত্যে কেউ তুলে ধরেননি। এমনকি রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং সাঁওতাল-প্রতিবেশে জীবনের চল্লিশটি বছর কাটিয়েও তাঁদের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাননি। শান্তিনিকেতনে যে ব্রহ্মাচর্যাশ্রম, সেখানকার চতুষ্পার্শেই তো সাঁওতালপল্লি। তাঁর কবিতা ও গানে সাঁওতালরা বড় রোমান্টিকভাবে উপস্থিত, তাঁদের আত্মতা নিয়ে নয়, যে আত্মতা দেখা গেছে রামকিঙ্করের সাঁওতালদের নিয়ে ছবি আঁকা ও ভাস্কর্য নির্মাণে। সাঁওতালি ছেলেকে সজল সঘন নববরষার কিশোর দূত কল্পনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর সেখান থেকে তাকে নিয়ে গিয়েছেন আরও দূরবগাহ স্থানে তাই ‘ঝড়ে চঞ্চল তমালবনের প্রাণে/ তোমাতে আমাতে মিলিয়াছি একখানে’ কবির অনুভবগম্য হলেও সাঁওতাল ছেলে ভিরমি খাবে হয়তো এ কথা শুনে। সাঁওতাল মেয়ের কথা পাই তাঁর ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতায়, এবং সেখানেও রবীন্দ্রসৌন্দর্যতত্ত্বের দূতী সে, সাঁওতাল সমাজের অন্তরঙ্গ কেউ নয়।

মহাশ্বেতার আগে একমাত্র বিভূতিভূষণের লেখাতে বিশেষ করে ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে আদিবাসী সমাজের সম্ভ্রান্ত চিত্রণ লক্ষ্য করি। কেবল তা-ই নয়, লেখক আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ এনেছেন, দেখিয়েছেন, কীভাবে আর্য উপনিবেশবাদ প্রাগার্য ভারতীয় সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে, তার জন্য বেদনাবোধও করেছেন। যে উৎসাহ-কৌতূহল নিয়ে মিশর ভ্রমণে যায় দেশ-বিদেশের ভ্রমণার্থী মিশরের রাজারাজড়ার সমাধি দেখবার অদম্য বাসনায়, তার ভগ্নাংশ আগ্রহও দেখা যায় না দোবরু-পান্নাদের পারিবারিক সমাধিক্ষেত্র দেখে আসবার। মিশরের Valley of Flowers আর দোবরু-পান্নাদের সমাধিস্থল যে একই মাহাত্ম্য ধরে, ইতিহাস ও পুরাতত্ত্বের নিরিখে দুই-ই যে তুল্যমূল্য, বিভূতিভূষণ হিরন্ময় পাত্রের অভ্যন্তরে নিহিত এই সত্যটি আমাদের দেখিয়ে দেন। তাই আদিবাসী সমাজের অন্তরঙ্গতা-অতিথি পরায়ণতা-সহজতাই নয় কেবল, এখানে তারও অধিক কিছু মেলে পাঠকের।

মহাশ্বেতা দেবীতে আদিবাসী সমাজ আরও ব্যাপ্ত, বিচিত্র আর ব্যাখ্যেয় হয়ে উঠেছে। ‘সাঁওতাল পল্লীতে উৎসব হবে’, এ-জাতীয় বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়, তিনি সাঁওতাল-শবর-লোধা সমাজকে দেখেছেন একেবারে মাটির কাছাকাছি থেকে। তাঁদের লোকাচার, ধর্মবিশ্বাস, প্রেম-বিরহ-গান্ধর্ববোধ, প্রকৃতিলগ্নতা আর ঈশ্বরচেতনা, প্রান্তিক অরণ্যচারী মানুষ হিসেবে তাদের ওপর শোষক শ্রেণির অত্যাচার ও তার বিচিত্র প্রতিক্রিয়া মহাশ্বেতার গল্প-উপন্যাসে বড় মরমী অন্তরঙ্গতায় বিন্যস্ত। সাঁওতাল তথা নিম্নবর্গীয় মানুষের নিয়ত সংগ্রামকে মহাশ্বেতা তাঁর লেখনীর আয়ুধ করেছেন। সেখানে কখনও সেই ব্রাত্য মানুষটি তার জীবন সংগ্রামে বিধ্বস্ত ও পরাজিত, আবার কখনও তার সাময়িক বিজয় দেখা গিয়েছে উচ্চবর্গ তথা এলিট শ্রেণির বিরুদ্ধে কিন্তু সংগ্রাম তার ফুরোয়নি। হাজার হাজার বছর ধরে আজকের ইতিহাসের পরিভাষায় যাদের বলা হয় সাবঅলটার্ন সেই ব্রাত্যজন পদাবলি মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্যের অন্যতম বিশেষ অলঙ্কার। অন্যতম, মনে রাখতে হবে একমাত্র নয়।

মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্যভাবনার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা বিচিত্রমুখী ও মৃত্তিকাসংলগ্ন। নিকট ও দূরের ইতিহাসকে তিনি যেমন গ্রথিত করেন তাঁর সাহিত্যে, তেমনি সাম্প্রতিক সময়কেও ইতিহাসেরই বস্তুনিষ্ঠ তাৎপর্যে তুলে ধরেন তাঁর লেখায়। বর্তমানতার মধ্যেও তাই তাঁর লেখায় থাকে যেন দূরকালের ইতিহাসের বিভ্রম। সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ তাঁর সমসময়ের দলিল, এমনকি যে বিয়াল্লিশের আন্দোলন নিয়ে রচনাটি, তাতে অংশগ্রহণও ছিল লেখকের। তবু পড়তে পড়তে মনে হয়, যেন কোন অতীতের রহস্যময়তা সেখানে। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শোক মিছিল’-এর নামও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।

তিন

‘অরণ্যের অধিকার’ মহাশ্বেতার সাহিত্য রচনার মধ্যপর্বের ফসল। ১৯৭৭-এ প্রকাশিত এই উপন্যাসের জন্য ১৯৭৯-এ তিনি লাভ করেন সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার। তাঁর সমগ্র রচনাবলির কেন্দ্রে রেখে গ্রন্থটির বিচার করা যায়, কেন-না এ উপন্যাসে সংহত হয়ে রয়েছে লেখকের বাস্তব অন্বেষা, সাহিত্যাদর্শ, নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা, অনন্য ভাষাশৈলী আর বিষয়বস্তুর চমৎকারিত্ব।

ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে শোষণের বর্ণালী নিয়ে বিদেশি সরকার বছরের পর বছর ধরে যে গেন্ডুয়া খেলেছে, তার বিধুর ইতিহাস পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে অসংখ্য ঐতিহাসিকের লেখায়। এর পাশাপাশি ঔপনিবেশিক অত্যাচারের প্রতিবাদও দেশের নানাস্থানে গর্জে উঠেছিল। সে-সব বিদ্রোহের দলিল রয়ে গেছে বহু লেখকের রচনায়, সৃজন সাহিত্যে। আমাদের মনে পড়বে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরানী’ এবং ‘আনন্দমঠ’, মীর মশাররফ হোসেনের ‘জমীদারদর্পণ’, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’, জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’, মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’, শওকত ওসমানের ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ বিধৃত হয়ে আছে। আরও বহুতর লেখার নাম উহ্য রাখতে হল বাহুল্যবোধে। কিন্তু মহাশ্বেতা দেবীর দায়বদ্ধতা ও মহাকাব্যিক বোধ এই উপন্যাসটিকে উল্লেখিত আর সব রচনা থেকে আলাদা করেছে। আমরা অতঃপর এ উপন্যাসটির বিশ্লেষণে গিয়ে দেখব, এ লেখার অনন্যতা কতখানি এবং কোথায়।

১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫, পলাশীর যুদ্ধ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভ। ১৭৯৩, লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এসব জাঁতাকলে পড়ে ভারতবর্ষের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অর্থাৎ কৃষকশ্রেণির ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সখারাম গণেশ দেউক্ষরের ‘দেশের কথা’, রমেশচন্দ্র দত্তের ‘Economic History of India’, দাদাভাই নওরোজির ‘Poverty and Un-British Rule in India’ গ্রন্থে ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনৈতিক শোষণের চিত্র ধরা আছে। জন শোর লিখে গেছেন, ইংরেজের এদেশে রাজ্য শাসনের মূল নীতিই ছিল নিজেদের স্বার্থের বিনিময়ে সমগ্র ভারতীয় জাতিকে সর্ব প্রকারে গোলামে পরিণত করা। এজন্যই দেখা যায়, ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষে (বাংলা ১১৭৬, যা ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত) বাংলায় মৃত্যু হয়েছিল মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ এক কোটি মানুষের; তথাপি কোম্পানির রাজস্ব আদায় হয়েছিল আগের বছরের চেয়ে বেশি। ১৭৬৬ থেকে ৬৮, এই তিন বছরে, বাংলার গভর্নর হ্যারি ভেরেলস্ট দেখাচ্ছেন, ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আমদানি হয়েছে ৬০ লক্ষ টাকা আর রপ্তানি হয়েছে সাড়ে ছ’কোটি টাকা; মার্কসবাদী ঐতিহাসিক রজনীপাম দত্ত একে তাঁর ‘India Today’ গ্রন্থে ‘প্রত্যক্ষ লুণ্ঠনের যুগ’ নামে আখ্যায়িত করেছেন, যার সময়কাল ছিল ১৭৫৭ থেকে ১৮১৩ পর্যন্ত। ১৮১৩ থেকে ১৮৫৮ সময়কে ‘বাণিজ্যের যুগ’ বলেছেন তিনি, যখন ইংল্যান্ডে প্রস্তুত বস্ত্র ভারতে রপ্তানি করা এবং ব্রিটেনের কলকারখানার জন্য ভারতে ব্রিটিশ পুঁজির আমদানি শুরু হয়। এই সময়কালে একদিকে দেশীয় কুটিরশিল্পকে ধ্বংস করে ফেলে ইংরেজ, অন্যদিকে ভারত পরিণত হয় ব্রিটেনের কৃষিখামারে। এর পরবর্তী পর্যায় অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের যুগ, যা চিহ্নিত হয়ে আছে ব্যাঙ্ক, ইন্সিওরেন্স প্রতিষ্ঠান ও সওদাগর প্রতিষ্ঠানের প্রাদুর্ভাবে। এইভাবে অর্থনৈতিকভাবে ভারতকে নিঃস্ব করতে থাকে শাসক শক্তি, ইতিহাসে যাকে Drainage of Wealth বলা হচ্ছে। ভারতে সঞ্জাত বিপ্লব-বিদ্রোহ এগুলোর অবধারিত প্রতিক্রিয়া। মুন্ডা বিদ্রোহকে এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার করতে হবে এবং এ বিদ্রোহের হোতা ও নায়ক বীরসা মুন্ডাকে নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘অরণ্যের অধিকার’-কে অনুধাবন করতে গেলে উপরোক্ত প্রেক্ষাপট আমাদের আলোচনার সহায়ক হবে।

উপনিবেশের পক্ষবিস্তার আর শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষায় বিদ্রোহ, ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া, ফরাজি-ওয়াহাবি, নীল বিদ্রোহ, রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩), কোল বিদ্রোহ (১৮৩২), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫), মহাবিদ্রোহ (১৮৫৭), দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ (১৮৭৫), এমন আরও অজস্র। ১৯০০-তে এই পর্যায়ে মুন্ডাদের বিদ্রোহ, যাতে শহিদ হয়েছিলেন মাত্রই ২৫ বছরের বীরসা।

অন্যবর্গীয় ভারতবাসীর চেয়ে আদিবাসীদের জীবনধারা যেহেতু স্বতন্ত্র এবং প্রধানত অরণ্যনির্ভর, সেখানকার মানুষের প্রতি ইংরেজদের শোষণের মাত্রা ছিল বহুস্তরীয়। যেহেতু তাদের মধ্যে শিক্ষা পৌঁছয়নি এবং তাদের জীবনধারণ ছিল সরলতাময় তাই মহাজনদের হাতে তাদের প্রাথমিকভাবে অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হতে হত। এরপর শিক্ষার উদার আহ্বান জানিয়ে আবির্ভূত হলেন মিশনারিকুল, সঙ্গে অনুদার ধর্মান্তরকরণের মতলব নিয়ে। এ কাজে অভাবিত সাফল্য লাভ ঘটেছিল কী অ্যাংলিকান, আর কী লুথারান মিশনারিদের। ধর্মের মাধ্যমে তৈরি হল এক বশ্য সম্প্রদায় আদিবাসীদের মধ্য থেকে, যে ধর্মান্তরিতরা প্রভু-সান্নিধ্য পেত তাদের গৃহের ঝি চাকর রাঁধুনি তথা পরিচর্যাকারী রূপে। বীরসাও ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন— যদিও পরে তিনি ছিঁড়ে ফেলেন তাঁর সেই ধর্মতন্তুজাল, ঘোষণা করেন নিজেকে ‘ধরতি আবা’ (ধরণীর পিতা) বলে।

মহাশ্বেতা তাঁর উপন্যাসে বীরসার এই ঐশী মনস্তত্ত্বকে গুরুত্বের সঙ্গে স্থাপন করে তাঁকে যোজিত-সম্প্রসারিত করেছেন স্ব-সম্প্রদায়ের মনে। নেতার মধ্যে এই যে ঐশী ক্ষমতাকে জারিত করা, এতে অনুসারীদের মধ্যে তৈরি হয় আস্থা, অনুরাগ, ইতিবাচকতা এবং চূড়ান্ত আশাবাদ। জোয়ান অফ আর্কের মধ্যে এই বোধ ক্রিয়াশীল ছিল যে তিনি দৈবাদেশ প্রাপ্ত। তিতু মীর ও তাঁর অনুসারীদের বিশ্বাস ছিল, ইংরেজের গুলি তিতু মীরের কোনও ক্ষতি করবে না, গুলি খেয়ে নেবেন তিনি। গীতায় অর্জুন তথা সর্বকালের যোদ্ধাকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, যুদ্ধে জয়ী হলে ‘জিত্বাতু ভোক্ষসে মহীম’— পৃথিবী ভোগ করবে (বাস্তবে অর্জুন বা যুদ্ধজয়ী যে-কোনও সৈনিক মহীর কতটুকু পায়!)। তা ছাড়া মৃত্যু হলে স্বর্গসুখ তো বাঁধা! ইসলামেও গাজি ও শহিদ হবার অনুরূপ পরামর্শ ও আহ্বান। এর অনুকূলে কালিদাস তাঁর অমর কাব্য ‘রঘুবংশম’-এ চমৎকার এক ছবি এঁকেছেন যুদ্ধে নিহত সৈনিকের, চমৎকার ও একইসঙ্গে প্রলুব্ধকারী। স্বয়ম্বরে ইন্দুমতীকে লাভ করে অজ অযোধ্যায় ফেরার সময় ব্যর্থ রাজারা আক্রমণ করছে অজকে আর অজ হত্যা করছেন তাদের। শত্রুর খড়্গাঘাতে ছিন্নমুক্ত অতএব সে-মুহূর্তেই সে স্বর্গে এবং সুরললনাদের একেবারে জড়িয়ে ধরে (তাৎক্ষণিক ফলপ্রাপ্তি!), অন্যদিকে নীচে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে সে তার কবন্ধটিকে দেখতে পাচ্ছে। সে মূর্তি তখন নৃত্যপর। আসলে মুণ্ডহীন ধড় তো, বেসামাল!

মহাশ্বেতার বীরসা ইতিহাসের বীরসা নন, লেখকের সৃজনশীলতার অভিজ্ঞান ও নির্যাস যেমন হাওয়ার্ড ফাস্টের স্পার্টাকাস, বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানী, মীর মশাররফের হাসান জয়নাব এজিদ মোয়াবিয়া বা সমারসেট মমের ভ্যানগগ। প্রকৃতির সঙ্গে বীরসার নিবিড় লগ্নতা এর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো, তাই ক্রন্দনরতা অরণ্যকে জননী ভেবে বীরসার কথোপকথন নিরুপম সেই অরণ্যমানবী, বনমাতা, বনদেবীর সঙ্গে। বীরসা তার কাছে তার অবস্থান জানতে চাইলে সেই অরণ্যমাতা উত্তর দেয়, ‘তোর বুকে তোর রক্তে।’ এই কথাটির মধ্যে আরণ্যক মানুষের সঙ্গে অরণ্যের নাড়ির যোগটি সর্বব্যাপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্কিমচন্দ্রে আমরা পেয়েছি, মা কী ছিলেন ও কী হইয়াছেন। মহাশ্বেতা আরও কঠিন ক্লোজ-আপে দেখালেন, অরণ্যমাতা আজ লেংটা! ‘কে তোমাকে লেংটা করেছে মা? আমি… তোমার লাজ ঢেকে দিব।’

প্রয়াস ছিল বীরসার, সঙ্কল্প ছিল, পারেননি, উপনিবেশের অসীম ডানা বিস্তার তার বিপরীতে! বিভূতিভূষণ ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে একদিকে প্রান্তিক জনজীবনকে ধরেছিলেন, অন্যদিকে অরণ্য ধ্বংস করে তথাকথিত সভ্যতা বিস্তারের কথা লিখে গেছেন, ব্যঙ্গচ্ছলে যে উপনিবেশের নাম তিনি ‘নয়া লবটুলিয়া’ দিয়েছেন। অরণ্যনিধনের কারিগর হিসেবে সত্যচরণ আসলে যিনি লেখক-ই স্বয়ং দোষী সাব্যস্ত করে নিজের সত্য উচ্চারণের মাধ্যমে অন্তত পাঠকের করুণা লাভ করেছে। মহাশ্বেতা তাঁর এ-উপন্যাসে আরও কঠিন বাস্তবতা এনে দেখিয়েছেন, স্বার্থে স্বার্থে সংঘাত বাধলে প্রতিপক্ষকে একচুল রেয়াত করে না ঔপনিবেশিক শাসক। সেখানে বীরসা তিতু মীর সিধো কানোর সঙ্গে মাস্টারদা ভগৎ সিং অভিন্ন।

উপন্যাসটি পাঠক ও সমালোচক মহলে বহু আলোচিত হলেও মহাশ্বেতা কিন্তু তাঁর প্রিয়তম লেখার মধ্যে বইটিকে স্থান দেননি। তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তিনি তাঁর উল্লেখযোগ্য লেখাগুলোর মধ্যে বিবেচনা করেন ‘কবি বন্দ্যঘটী গাঞীর জীবন ও মৃত্যু’, ‘ছোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর’, ‘অপারেশন বসাই টুডু’। তা ছাড়া ‘অমৃত সঞ্চয়’, ‘আঁধার মানিক’। ‘অমৃত সঞ্চয়’ সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে লেখা।

চার

পেশাদার লেখক হিসেবে মহাশ্বেতা দেবী প্রচুর লিখেছেন। ছাত্রজীবনে তিনি একবার নাকি রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি এত লিখেছ কেন?’ সেই মহাশ্বেতা দেবীর রচনাবলি এ পর্যন্ত চোদ্দ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। রচনাবলির সম্পাদক অভয় গুপ্ত জানিয়েছেন, মোটামুটি তিরিশ খণ্ডে সমাপ্ত হবে তাঁর যাবতীয় রচনা। কেবল দেড়শো উপন্যাস এবং আনুমানিক সাড়ে তিনশোর মত গল্প-ই তো লিখে গেছেন তিনি। তাছাড়া অসংখ্য বিষয়ে ছোট-বড় বারো-চোদ্দশো প্রতিবেদন, প্রবন্ধ, সামাজিক কৃত্য বলে যা তিনি মনে করতেন। ‘এক জীবন’ নাম দিয়ে আত্মজীবনীও লিখেছিলেন ধারাবাহিকভাবে কোন এক পত্রিকায়, গ্রন্থাকারে যা এখনও প্রকাশিত হয়নি। তাছাড়া দেশে-বিদেশে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে ছিল তাঁর পত্র বিনিময়। সেসব সংগৃহীত হয়ে প্রকাশিত হলে আমরা অন্তরঙ্গ ও অন্য মহাশ্বেতার পরিচয় পেতে পারব। সুদীর্ঘ জীবনে সাক্ষাৎকার-ই তো দিয়েছেন একশোর ওপর— সৃষ্টিশীল এই লেখককে জানতে যার মূল্য অপরিসীম। তাঁকে নিয়ে একাধিক তথ্যচিত্র তুলেছেন অনেকে। তাঁদের মধ্যে মালয়ালমভাষী জোসি যোসেফ তো তাঁকে নিয়ে ১৪০ ঘণ্টা ধরে রেখেছেন সেলুলয়েডে। তার থেকে দুটো তথ্যচিত্র ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছে ‘Journey with Mahasweta Devi’ এবং ‘Mahasweta Devi: Close-up’ নামে। এই তথ্যচিত্রদুটিতে মহাশ্বেতার আধুনিক বিশ্ব সম্পর্কে আগ্রহ ও কৌতূহলের নানা প্রমাণের মধ্যে একটি হল, এক জায়গায় তিনি প্রয়াত বিখ্যাত ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক আব্বাস কিয়াবোস্তামির ‘Five’ ছবিটি দেখছেন। মহাশ্বেতাকে নিয়ে আরও একটি তথ্যচিত্র রয়েছে যোসেফের ‘Serentidiby Cinema’ নামে। এই যে এত এত লেখা, তার বিষয়বস্তুও ছিল বিচিত্র। আদিবাসী সমাজ-ই কিন্তু তাঁর একমাত্র বিচরণক্ষেত্র ছিল না। ‘ঝাঁসীর রাণী’-র মত একাধিক ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস রয়েছে তাঁর। সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে উপন্যাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তেমনি তিতু মীরকে নিয়ে উপন্যাস রয়েছে তাঁর। কৈবর্ত বিদ্রোহ নিয়ে রয়েছে যেমন ‘কৈবর্তখণ্ড’, ঠিক তেমন-ই ‘আঁধার মানিক’ বাংলায় বর্গী আক্রমণ নিয়ে লেখা। ‘নটী’ আর-এক সিপাহী বিদ্রোহকেন্দ্রিক উপন্যাস। প্রাক-চৈতন্যদেবের বাংলা যেমন ধরা পড়েছে তাঁর ‘বেনে বউ’ উপন্যাসে, অন্য এক উপন্যাস ‘বিবেক বিদায় পালা’-তে তিনি ধরেছেন শ্রীচৈতন্য ও তাঁর সমসময়কে। এ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড লেখার ইচ্ছে ছিল তাঁর। দুর্ভাগ্য, নানান উপকরণ সংগৃহীত হলেও শেষ পর্যন্ত লেখা হয়ে ওঠেনি এ-উপন্যাসের খণ্ডটি।

ইতিহাস ছাড়াও তাঁর আগ্রহ ছিল মনুষ্য-মনস্তত্ত্বে, নারীদের একান্ত নিজস্ব জগৎ নিয়ে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থানের প্রশ্নটি নিয়ত ভাবাত তাঁকে। ‘মূর্তি’ উপন্যাসে তাই দেখি বালবিধবা দুলালীর ভাসমান অনিশ্চিত অসহায় জীবনযাপন, ‘সতী’-তে অমার একে কন্যা, তায় কালো সন্তান জন্মালে শ্বশুরকুলের কেউ দেখতেই এল না নার্সিং হোমে। নারীবাদের আবহ তৈরিতে নয়, এ-লেখা মহাশ্বেতা কিন্তু লেখেন মানবিকতাবোধ থেকে উৎসারিত তাঁর মহনীয়তা থেকে। তাঁর বেশ কিছু ছোটগল্পে নারী নির্যাতনের যে ভয়ংকরতা, তা পড়লে শিউরে উঠে মানুষকে সবার উপরে সত্য বলতে দ্বিধা হবে আমাদের। পণের দায়ে কন্যার স্ত্রী-অঙ্গকে অ্যাসিড ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘স্তনদায়িনী’-র মত গল্প তো বিশ্বসাহিত্যেই পরমরত্ন বলে গণ্য হবার যোগ্য। এছাড়াও ‘সাত নম্বর আত্মহত্যা’, ‘দ্রৌপদী’, ‘প্রতি চুয়ান্ন মিনিটে’, ‘বৈসুচনের সেনা’ ইত্যাদি গল্পে নারীর প্রতি অবমাননা, ধর্ষণ, নারী হত্যার মত নৃশংসতাও উপস্থিত। গল্পগুলি এ-যুগের ভোগবাদী সমাজে নারীর প্রতি পুরুষের যেন খাদ্য-খাদক সম্পর্ক, এমন প্রতীতি জন্মে।

সমাজে নানা অবস্থানের নারী-পুরুষই তাঁর লেখায় উঠে আসে বাস্তবতার প্রামাণ্য দলিল হয়ে। কৃষক, ব্যবসায়ী, ভিক্ষুক, সেলসম্যান থেকে রাজনৈতিক কর্মী, অধ্যাপক, সাহিত্যিক, জমিদার, আমলা— এক বিস্তৃত ব্যাপক জগৎ ছড়িয়ে আছে তাঁর কথাসাহিত্যে। বিচিত্র পেশাজীবী মানুষ— যারা সাপ ধরে সংসার চালায়, পাখি ধরে যারা, মর্গের ডোম, কবরের দেখভাল করা মানুষ, হাতির মাহুত যারা, এদেরও তাঁর লেখায় নিয়ে এসেছেন তিনি। বিষয়বস্তু যেমন, নিজের ভাষাকে তেমনি তিনি শাণিত করে তুলেছিলেন। এইদিক থেকে দেখতে গেলে তিনি স্বতন্ত্র এক ভাষাশৈলীরও নির্মাতা। সামান্য একটু উদাহরণ দেওয়া যাক তাঁর অতি বিখ্যাত গল্প ‘স্তনদায়িনী’ থেকে, যেটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘এক্ষণ’ পত্রিকায়, ১৯৭৭-এ— ‘হালদারকর্তা পাত্র না দেখে দয়া করেন না। তিনি স্বাধীন ভারতের বাসিন্দা, যে ভারত মানুষে মানুষে, রাজ্যে রাজ্যে, ভাষায় ভাষায়, রাঢ়ী-বারেন্দ্র-বৈদিকে, উত্তররাঢ়ী কায়স্থ ও দক্ষিণরাঢ়ী কায়স্থে, কাপ-কুলীনে প্রভেদ করে না। কিন্তু তিনি পয়সা করেছেন ব্রিটিশ আমলে, যখন ডিভাইড অ্যান্ড রুল ছিল। হালদারকর্তার মানসিকতা তখনই গঠিত হয়ে গেছে। ফলে তিনি পাঞ্জাবি, ওড়িয়া, বিহারি, গুজরাটি, মারাঠি, মুসলমান, কারুকে বিশ্বাস করেন না এবং দুর্গত বিহারি শিশু বা অনাহারে কাতর ওড়িয়া ভিখারি দেখলে তার বিয়াল্লিশ ইঞ্চি গোপাল গেঞ্জির নিচে অবস্থিত চর্বিতে সুরক্ষিত হৃৎপিণ্ডে করুণার ঘামাচি আদপে চুলকায় না।’ নির্মম পরিহাস ও ব্যঙ্গের ভাষা। এমন রচনায় মহাশ্বেতা সিদ্ধহস্ত। তাই মহাশ্বেতার যে-কোনও রচনাই আস্বাদ্য।

পাঁচ

মহাশ্বেতাকে শান্তিনিকেতনে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়ে কাঠবেড়ালি চিনিয়েছিলেন তাঁর পিতা মণীশ ঘটক। দিনাজপুরে থাকতে পিতা নাকি বাঘ শিকারও করেছিলেন। অন্যদিকে তাঁর মা পরিচিত হয়েছিলেন বিখ্যাত মার্কিন লেখিকা, নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত পার্ল এস বাক-এর সঙ্গে, বাক যে-বার মুম্বইতে আসেন। মহাশ্বেতার স্বামী ছিলেন আদর্শগতভাবে এক কমিউনিস্ট নাট্যকার অভিনেতা নাট্য পরিচালক যাঁর ‘নবান্ন’ নাটক বাংলা নাটকের ইতিহাসে যুগান্তর এনেছিল। কাকা ঋত্বিক ছিলেন অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র স্রষ্টা। কেবল তা-ই নয়, নাট্যকার-অভিনেতারূপেও ঋত্বিক এক অত্যন্ত প্রতিভাধর পুরুষ। তাঁর জীবনে ঘটেছে ঈর্ষণীয় গুণীজন সান্নিধ্য, যার কেন্দ্রে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যার মধুর ভাষণ শুনেছেন তিনি শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক-পর্বে। স্নেহ লাভ করেছেন কবির পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন উপাচার্য, ১৯৪৫-এ, মহাশ্বেতার দ্বিতীয় পর্বে শান্তিনিকেতন বাসের সময়। সে-সময়কার এক অনন্য অবনীন্দ্রনাথের ছবি ধরা ছিল মহাশ্বেতার স্মৃতিতে, রাহুল দাশগুপ্তকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে জানাচ্ছেন তিনি, ‘আমরা গিয়েছি ওঁর কাছে, দেখি হলুদ পলাশ ফুল সামনে রেখে মুগ্ধ চোখে দেখছেন।’ এরপরই মহাশ্বেতার স্বীকারোক্তি, শান্তিনিকেতন প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করতে, ভালবাসতে শিখিয়েছিল। এজন্যই তো তিনি ওখানে বৃক্ষনিধন ও প্রকৃতিকে ধ্বংস করে ইট কাঠ পাথরের বহুতল গড়ে তোলার বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হন, সিঙ্গুরে ভূমিহারা কৃষকদের পাশে এসেও দাঁড়াতে দেখি তাঁকে। শান্তিনিকেতনে তাঁর মামা শঙ্খ চৌধুরী যেমন, তেমনি বিনোদবিহারী রামকিঙ্করদের নিয়ত দেখেছেন। দ্বিতীয়পর্বে সহপাঠী ছিলেন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, বিদ্যাবত্তায় যাঁর জুড়ি ছিল না বলে তাঁর নাম ‘মুখোজ্জ্বল হায়দার’-এ পরিণত হয়েছিল। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের দুই বিখ্যাত লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে তাঁর সখ্য সুবিদিত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে এ সমস্তই নির্মিতি দিয়েছে তাঁকে। দেশ-বিদেশে বহুবার ভ্রমণ করে তাঁর অভিজ্ঞতাকে ঋদ্ধ করেছেন তিনি। এক প্রদীপ শিখা থেকে অন্য দীপ জ্বলে ওঠে যেমন, তেমনি তাঁর একমাত্র পুত্র নবারুণ, বাংলাসাহিত্যে এক প্রবল শক্তিধর লেখক। নবারুণ ২০১৪ সালের ৩১ জুলাই ৬৬ বছর বয়সে কলকাতায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর কবিতার একটি স্মরণীয় লাইন: ‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না…।’

মহাশ্বেতা লেখক, ‘বর্তিকা’ নামে পত্রিকার সম্পাদক, সোস্যাল অ্যাক্টিভিস্ট, অধ্যাপক, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির একদা সভাপতি। সাহিত্য আকাদেমি (দিল্লি) সহ জ্ঞানপীঠ, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম, ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত। পেয়েছেন ম্যাগসেসাই পুরস্কার। বহু বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছে তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি। বেড়িয়েছেন বাংলাদেশে, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকা, সুইৎজারল্যান্ড ও আরও বহু দেশ। তাঁর রচনা অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায়— হিন্দি, তামিল, কন্নড়, মারাঠি, মালয়ালম, অসমীয়, তেলুগু, ওড়িয়া, হো, গুজরাতিতে। তিনি নিজেও অনুবাদ করেছেন বহু গ্রন্থ। লিখেছেন শিশু-সাহিত্য, পাঠ্যবই। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মানি, সুইডিশ, ইতালি প্রভৃতি বিদেশি ভাষাতেও তিনি বহুল অনূদিত। একাধিকবার তাঁর নাম উঠেছিল নোবেল লিস্টে, যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি পাননি। তাঁকে নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ.ডি করেছেন দু-তিনজন, গ্রন্থ লিখেছেন বেশ কয়েকজন, আর তাঁকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধের তো গোনাগুনতি নেই।

আটাশে জুলাই ২০১৬ বৃহস্পতিবার দুপুর তিনটে নাগাদ মহাশ্বেতা দেবী প্রয়াত হন। ১৯২৬-এ জন্ম তাঁর। সেই হিসেবে অকাল প্রয়াণ বলা যাবে না অবশ্যই। তবে আমাদের এই উপমহাদেশে তাঁর মত এক বরেণ্য লেখকের মৃত্যু নিঃসন্দেহে বেদনার। বাংলা সাহিত্য তাঁর অভাব বোধ করবে। তাঁর জীবনাবসান সত্যিই একটি যুগের অবসান। তাঁর লেখা পাঠ করে যাতে সমৃদ্ধ হতে পারি, সেই প্রয়াসই হবে তাঁর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।

চিত্র: গুগল
4 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপুজো: অতীত দিনের স্মৃতি

মহালয়া দিয়ে হত পুজোর প্রকৃত সূচনা। শরতের ভোররাতে আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত এই অনুষ্ঠানটির শ্রোতা অন্তহীন, এবং এখনও তা সমান জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও অনুষ্ঠানটির শ্রোতা অগণিত। আমাদের শৈশবে বাড়ি বাড়ি রেডিও ছিল না, টিভি তো আসেইনি। বাড়ির পাশে মাঠে মাইক থাকত, আর প্রায় তিনশো গজ দূরের এক বাড়িতে মাউথপিস রাখা থাকত। সেখান থেকে ভেসে আসত মহালয়ার গান, ভাষ্য।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপূজা, মূর্তিপূজা: দেশে দেশে

আসলে বাঙালি নিরন্তর এক অনুসন্ধানী, ব্যতিক্রমী, অভিনব-চিন্তক, ক্রমবিকাশপ্রিয় ও অন্তিমে রহস্যময় জাতি। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমান আস্তিক নাস্তিকে মিলিত এই জাতি সঙ্ঘারাম আর মিনার, ধ্বজা ও ওংকার, জগমোহন-মিরহাব-স্তূপ-ভস্মাচ্ছাদিত এক জাতি, নিজ মুদ্রাদোষে নয়, মু্দ্রাগুণে আলাদা।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শারদোৎসব: বাংলাদেশে

দুর্গাপুজো কেবল ভক্তের জন্য-ই নয়, ভাল লাগাদের জন্যও। যে ভাল লাগা থেকে ভাই গিরীশচন্দ্র সেন কোরানশরীফ বাংলায় অনুবাদ করেন, অদ্বৈত আচার্য যবন হরিদাসের উচ্ছিষ্ট নিজহাতে পরিষ্কার করেন, স্বামী বিবেকানন্দ মুসলিম-তনয়াকে কুমারীপুজো করেন! দুর্গা বাঙালির কাছে, ধর্মনির্বিশেষে আগ্রহের, যেহেতু এই দেবী পরিবারসহ আসেন, আর সঙ্গে নিয়ে আসেন কাশফুল আর শিউলি। তাই তো সনাতন রামপ্রসাদ, খ্রিস্টান মাইকেল, ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ এবং মুসলমান কাজী নজরুল দুর্গাকে নিয়ে কলম না ধরে পারেননি!

Read More »
কাজী তানভীর হোসেন

ধানমন্ডিতে পলাশী, ৫-ই আগস্ট ২০২৪

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে কয়েকদিন ধরে যা ঘটেছিল, তা শুরু থেকেই গণআন্দোলনের চরিত্র হারিয়ে একটা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে পরিণত হয়েছিল। আজ আমরা কার্যক্রম দেখেই চিনে যাই ঘটনাটি কারা ঘটাচ্ছে। আগুন আর অস্ত্র নিয়ে রাজনীতি করার স্বভাব রয়েছে বিএনপি-জামাত ও রোহিঙ্গাদের। তারা যুক্তিবুদ্ধির তোয়াক্কা করে না।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য: কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

আমরা বিধানচন্দ্র রায়ের মতো মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছিলাম, যাঁকে খুব সঙ্গত কারণেই ‘পশ্চিমবঙ্গের রূপকার’ বলা হয়। পেয়েছি প্রফুল্লচন্দ্র সেন ও অজয় মুখোপাধ্যায়ের মতো স্বার্থত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী। এবং জ্যোতি বসুর মতো সম্ভ্রান্ত, বিজ্ঞ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখর কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ। কিন্তু তাঁদের সকলের চেয়ে অধিক ছিলেন বুদ্ধদেব। কেননা তাঁর মতো সংস্কৃতিমনা, দেশবিদেশের শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্র নাটক সম্পর্কে সর্বদা অবহিত, এককথায় এক আধুনিক বিশ্বনাগরিক মানুষ পাইনি। এখানেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অনন্যতা।

Read More »