শিবরাত্রি হিন্দু শৈব সম্প্রদায়ের কাছে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান যা ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে পালিত হয়। এই চতুর্দশীটিকে বছরের সবচেয়ে অন্ধকার রাত্রি বলা হয় এবং মহাশিবরাত্রি অজ্ঞতা দূর করবার জন্যে পালিত হয়। প্রজাপতি দক্ষের শিবকে অপমান করবার পরে সতীর দেহত্যাগ ও তৎপরবর্তীকালে শিবের রেগে যাওয়ার কাহিনি আমরা জানি। এরপর বিষ্ণু কর্তৃক সতীর অঙ্গচ্ছেদের পর শিবের রাগ কমার ঘটনার কথা আমরা প্রায় সব কিছুই সেই ছোট বয়স থেকেই জেনে আসছি। উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপ্রয়াগ জেলার মন্দাকিনী ও শোন নদীর সংযোগস্থলে ত্রিযুগীনারায়ণ গ্রামের আশেপাশের জায়গাটি হিমালয় রাজার রাজধানী ছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু এরপরেও কিছু নতুন বিষয় আছে। যেমন সতীর দেহ বিভিন্ন জায়গায় পড়ে যাওয়ার পর শিবের মধ্যে এক চরম ঔদাসীন্য ও বৈরাগ্য জেগে ওঠে। শিব ঠিক করেন আর কোনও নারীর সঙ্গে সম্পর্ক নয়। অন্যদিকে তারকাসুরের অত্যাচারে সেই সময় তিন ভুবন প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। সেই সময় দেবতারা ব্রহ্মার কাছে গেলে তিনি জানান, হর-পার্বতীর মিলনে জন্ম নেওয়া কার্তিকের হাতেই তারকাসুরের বধ হবে। কিন্তু পার্বতী শিবের প্রেমে আকুল হলেও শিব তো তখন এইসব সম্পর্ক থেকে অনেক দূরে। সেই সময় শিবের মধ্যে কামের সঞ্চার করতেই ডাক পড়ে রতি ও কামদেবের। এরপরে শিবের রোষানলে কামদেবের ভষ্ম হয়ে যাওয়া এইসব কাহিনিও আমরা জানি। তবে সেখানেও শিব-পার্বতীর মিলনে কার্তিকের জন্ম হয় ও তারকাসুরের বিনাশ হয়। এই শিবরাত্রি শিব-পার্বতীর সেই বিয়ের দিন বলে মনে করা হয়। শিবের গাজনও শিবের বিয়ে বলেই মনে করা হয়। সন্ন্যাসীরা সেখানে বরযাত্রী।
শিবরাত্রির সঙ্গে আর-একটি কাহিনি জড়িয়ে আছে। বহু বছর আগে কাশী বা বারাণসীতে এক ব্যাধ থাকত, যার প্রধান কাজ ছিল পশুশিকার। একদিন শিকার করবার সময় অন্ধকার ঘনিয়ে রাত্রি এসে যায়। ব্যাধ সেই রাতে আর বাড়ি না ফিরে জঙ্গলের মধ্যে একটি বিরাট গাছের ওপর চেপে বসে। সেই গাছটি ছিল বেলগাছ, তার নিচে একটি শিবলিঙ্গ ছিল। গাছের উপরে ওঠার সময় দু-একটি শিশির ভেজা পাতা শিবলিঙ্গের ওপর পড়ে। ব্যাধ নিজেও সেই রাতে উপোস করে ছিল এবং ঘটনাচক্রে সেটি ছিল শিবরাত্রি। পরের দিন সকালে ব্যাধ তার বাড়িতে ফেরে। খেতে বসবার সময় এক আগন্তুক এসে উপস্থিত হলে ব্যাধ নিজে না খেয়ে সেই খাবার আগন্তুককে খেতে দেয়। এইভাবেই ব্যাধ শিবরাত্রি ব্রত পালনের পুণ্য লাভ করে এবং এই জগতে শিবরাত্রি পূজা আরম্ভ হয়।
আসলে, প্রায় প্রতিটা জাতির মধ্যে প্রেম-ভালবাসা ও যৌনতাকে স্বীকৃতি দেবার জন্য বিভিন্ন রকমের লোক উৎসব বা প্রথার প্রচলন আছে। হয়তো সময়ের সঙ্গে সেই সব প্রথা অনেকাংশে শালীন হয়েছে কিন্তু মূল বিষয় বদলে যায়নি। যেমন প্রাচীন রোমানদের মধ্যে ‘লুপারকালিয়া’ নামে একটি উৎসব হত। এই উৎসবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যৌন স্বাধীনতা উপভোগ করত। কিন্তু অবাধ মেলামেশা সেই সময়কার ধর্মীয় মাতব্বর বিশেষ করে চার্চের চোখে অনৈতিক বলে মনে হয়। আসলে, প্রেম-ভালবাসার প্রথা বা উৎসব সারা বিশ্বেই পালিত হয়ে আসছে। নীতিবাগীশদের চোখে কখনও এই উৎসব যৌন উত্তেজনামূলক বলে মনে হত। কিন্তু আমরা কীভাবে ভুলে যাব ইরোস, কিউপিড ও প্রায়াপুস ও ভারতের কাম ও রতি একই সমীকরণের অংশ, এই কামদেবের জন্যেই মিলন হয় শিব-পার্বতীর, থেমে যাওয়া শক্তি তরঙ্গ আবার চলতে শুরু করে, জন্ম হয় কার্তিকের, বিনাশ হয় তারকাসুরের। কিন্তু এই মহামিলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কামদেব, শিবের ক্রোধে এক্কেবারে ভষ্ম হয়ে যায়। যদিও রতির প্রার্থনাতে আবার পুনরুজ্জীবিত হয় ও কায়াহীন হয়ে ঘুরে বেড়ায়, সেটা অন্য প্রসঙ্গ, কিন্তু এই ঘটনা থেকে শিবের সম্পর্কে ভুল ধারণা গড়ে ওঠে।
ভারত তথা এই বাংলাতে শিব খুবই জনপ্রিয় দেবতা। শুধু জনপ্রিয় বললে অবশ্য ভুল হবে। বহু প্রাচীনকাল থেকে শিবকে লিঙ্গরূপে পুজো করা হচ্ছে। প্রাক আর্যযুগে শিব প্রজনন ও উর্বরতার দেবতা হিসাবে পূজিত হতেন। হরপ্পা থেকে প্রাপ্ত একটি পুরুষ মূর্তি দেখে ঐতিহাসিক ব্যাসাম তাকে পশুপতি শিবের মূর্তি বলে মনে করেন। বৈদিক যুগের প্রথমে আমরা শিবকে অবশ্য দেবতা হিসাবে পাই না, বরং রুদ্রকে ঋগ্বেদে পাই, অথর্ব বেদে শিবের সাতটি নাম পাবার পাশাপাশি শ্বেতাশ্বর উপনিষদে তাঁর নাম পাই মহেশ্বর। অন্যদিকে পতজ্ঞলী ও পাণিনির লেখাতে বিশাখা ও স্কন্ধের সঙ্গে শিবের নাম পাই। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল, বৌদ্ধ সাহিত্যে শিবের উল্লেখ আছে। আলেকজান্ডারের ভারতে আসার সময় শিব পূজার উল্লেখের সঙ্গে শিবি নামে এক জাতির কথাও পাই। রামায়ণ মহাভারতেও শিবের উল্লেখ আছে। আর্য সংস্কৃতিতে শিবকে বলা হয় প্রাগার্য সংস্কৃতির দেবতা। আর্যদের প্রথম দিকে শিব ও রুদ্র আলাদা ছিল। রুদ্র ছিলেন ঝড়ঝঞ্জার দেবতা এবং শিব ছিলেন কৃষির দেবতা। পরবর্তীকালে শিব ও রুদ্র মিলে মিশে যায়। এই লিঙ্গরূপের মধ্যেই এক আদিম ইতিহাস তথা প্রথা এখনও পালন করা হচ্ছে।
শিব একদিকে যেমন শক্তি ভিত্তিক কৃষি দেবতা অন্যদিকে প্রজনন তথা সৃজনের দেবতা। আবার অন্যদিকে দেখতে গেলে দেবতাদের মধ্যে শিব কামুক নন, মহাযোগী, এবং বাংলার শিব সংসারী। বলা হয়, প্রাচীন কালের মানুষের সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া জানা ছিল। তাদের জীবনযাপন হত গাছের ফলমূল খেয়ে বা পশু শিকার করে। কালক্রমে তারা জানতে ও বুঝতে পারে যেভাবে নারীরূপ ভূমিকে কর্ষণ করে পুরুষ সন্তান উৎপাদন করে ঠিক সেভাবেই এই পৃথিবীকে কর্ষণ করে শস্য উৎপাদন সম্ভব। আরম্ভ হয় পুরুষের লিঙ্গস্বরূপ এক দণ্ড বানিয়ে ভূমি কর্ষণ আরম্ভ হয়। জানা গিয়েছে ‘লিঙ্গ’, ‘লাঙ্গুল’ ও ‘লাঙ্গল’ এই তিন শব্দ একই ধাতুরূপ থেকে সৃষ্টি। এরপর ফসল তোলার সময় নবান্ন উৎসব থেকে জন্ম নিল লিঙ্গ ও পৃথিবীর পূজা, শিবকে তাই প্রজননের দেবতাও বলা হয়। প্রজনন একটি জৈবিক প্রক্রিয়া, এরই প্রতীক হিসাবে গৌরীপষ্ট্রের মধ্যে স্থাপিত শিবলিঙ্গ, যা আদপে একটি বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রকাশ। তাই শিবের ধারণা আমাদের অখণ্ড ভারতবর্ষে আর্যরা আসবার অনেক আগেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু আর্যরা ভারতে আসার পর এই ধারণা তাদের পরিমণ্ডলে প্রবেশ করে। মনে করা হয় এই শিব থেকেই আর্যরা রুদ্রের কল্পনা করে। সংস্কৃতে রুদ্র শব্দের মানে যেমন রক্তবর্ণ, তেমনিই দ্রাবিড় ভাষাতে শিব শব্দের মানেও রুক্তবর্ণ।
বাংলাতে শিব মন্দিরের সংখ্যা অনেক। মনে করা হয়, এই বঙ্গায়ণ বর্গী আক্রমণের পরে হয়। যদিও এর আগে শিবকে বাঙালি ঘরের মানুষ করে নিয়েছিল, বাঙালি তাই ‘ধান ভানতেও শিবের গীত’ গায়। বাঙালি শিবকে ঘরের জামাই করবার পাশে কৃষক হিসাবেও পূজা করে। বাঙালি শিব ঠাকুরকে নিয়ে বিশেষভাবে কাব্য ও গান রচনা করেছে, যাকে ‘শিবায়ন’ বা শিব-সংকীর্তন’ বলা হয়।
আর্যদের ভারতে আসার আগে শিব পূজার প্রচলন ছিল, তা জানা গিয়েছে। তাই শিব যতই কৃষি বা প্রজননের দেবতা হোন তার আর্যায়ণ ভারতীয় সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের এক দলিল, যার জন্যেই শিব হিন্দু তথা সনাতন ধর্মের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেবতা হিসাবে আজও পুজো পেয়ে আসছেন।
লিঙ্গ, লাঙ্গুল, আর লাঙ্গল – যে এক সুতোয় গাঁথা, জানা ছিল না। শিব লিঙ্গের সাথে জড়িয়ে আছে নারীস্বরূপ ভূমি কর্ষণ করে পুরুষস্বরূপ ফসল পাওয়ার বিশ্বাস। খুব ইন্টারেস্টিং। ভাল লাগল লেখাটি। বৌদ্ধ ধর্মেও শিব ছিলেন তাহলে? আর অবাধ যৌনতার আচারটিও খুব কৌতূহল জাগাল।