বাঁকুড়া জেলার লৌকিক সংস্কৃতিতে মাতৃরূপিণী মনসা ও সর্বজন পরিচিত লোকদেবতা ধর্মঠাকুর হলেন একান্ত আপন। কারণ এই দুই দেব- দেবীর লীলা ও মাহাত্ম্যর সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের সংস্কৃতি জড়িত। বাঁকুড়ার সহজ-সরল শান্ত গ্রামের মানুষেরা এই মনসাদেবীকে আপন মাতার মত স্নেহ ও ভক্তি করে থাকেন। এই পরবের উপাসক মূলত সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষজন, বাউড়ি, বাগদি, হাড়ি, শুঁড়ি, মাঝি, লোহার প্রমুখ।
মনসা কেবল সর্পদেবী নন, কৃষি-সমৃদ্ধির দেবীও বটে। কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িয়েই শ্রাবণসংক্রান্তির মনসা পুজোর চল। জঙ্গলমহলের শহর, গাঁ-গঞ্জ জুড়েই তৈরি হয় মনসা পুজো ঘিরে উদ্দীপনা।
ফসলে সবুজ মাঠ। বর্ষণের দরুন নদী, খাল-বিল জলপূর্ণ। অর্থাৎ ভরন্ত এই সময়ে মনসা পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভাল ফসলের আকাঙ্ক্ষা। কয়েকশো বছর ধরেই এই পুজোর চল। শুরুতে প্রধানত সরীসৃপ ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার লক্ষে মনসা পুজো করা হত বলে গবেষকদের একাংশের মত। ক্রমে বিপদনাশের পাশাপাশি, কৃষির সমৃদ্ধি-প্রার্থনায় গৃহস্থ বাড়িতে ঘটা করে বিষহরির আরাধনা শুরু হয়। বাড়ির উঠোনে ‘সিজ’ (ফণিমনসা জাতীয় ক্যাকটাস) পুঁতে সেই গাছের তলায় মনসা-থানে পোড়া মাটির হাতি ও ঘোড়া রেখে পুজো হয়।
সর্প পূজা একটি প্রাচীন অনুষ্ঠান। মনসা সাপের দেবী। তিনি মূলত লৌকিক দেবী। পরবর্তীকালে পৌরাণিক দেবীরূপে স্বীকৃত হন। শ্রাবণ মাসের শেষদিনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতিটি ঘরে ঘরে মনসা দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
চৈতন্যদেবের সময় বাংলাদেশে মাটির প্রতিমা গড়ে ঘটা করে মনসা পূজা হত। মনসা পূজা দুভাবে হয়ে থাকে— কোনও কোনও পূজায় পাঁঠা বলি দিয়ে হয়। আবার পাঁঠাবলি ছাড়াও পূজা হয়। আইনি জটিলতার কারণে এখন আর বলি প্রথার চল বিশেষ নেই।
মনসা পূজার প্রতিমাতেও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কেউ কেউ মনসা প্রতিমা বানিয়ে পূজা করে থাকেন। আবার কেউ কেউ পঞ্চ সর্পের ফণা যুক্ত প্রতিমার পূজা করেন। গোত্র ও অঞ্চলভেদে প্রথার ওপর ভিত্তি করে মনসা দেবী বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে তাঁর ভক্তদের দ্বারা পূজিতা হয়ে থাকেন।
‘মনসা’ শব্দের উত্তর স্ত্রীলিঙ্গের আপ প্রত্যয় করে ‘মনসা’ শব্দের উৎপত্তি। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে মনসা মনের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। দেবী ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, সর্পভয় থেকে মনুষ্যগণকে পরিত্রাণের জন্য ব্রহ্মা কশ্যপ মুনিকে মন্ত্র বা বিদ্যাবিশেষ আবিষ্কারের জন্য আদেশ করেন। ব্রহ্মার আদেশে কশ্যপ যখন মনে মনে এ বিষয়ে চিন্তা করছিলেন তখন তাঁর মননক্রিয়ার সাকার রূপ পরিগ্রহ করে এক মহাদেবী দীপ্যমান হন। তিনটি কারণে এই মহাদেবীর নাম হয় মনসা। প্রথমত তিনি কশ্যপ মুনির মানসকন্যা, দ্বিতীয়ত মনুষ্যগণের মনই তাঁর ক্রীড়াক্ষেত্র, তৃতীয়ত তিনি নিজেও মনে মনে বা যোগবলে পরমাত্মার ধ্যান করেন। মনসার দ্বাদশটি নাম আছে। জরৎকারু, জগদ্গৌরি, মনসা, সিদ্ধ যোগিনী, বৈষ্ণবী, নাগ ভগিনী, শৈবী, নাগেশ্বরী, জরৎকারু-প্রিয়া, আস্তিক-মাতা, বিষহরী, মহাজ্ঞানযুতা।
মনসা শব্দটির বিশ্লেষণ করলে অর্থ দাঁড়ায় মনে চিন্তন। কিন্তু দেবীরূপে মনসা কি চিন্তনের কোনও বিষয়? মনের মধ্যে বিষ থাকতে পারে, সেই বিষ অবশ্যই মনকে বিষাক্ত করে এবং চিন্তার খোরাক যোগায়, মননকে সুখশ্রাবী করার জন্য মন্ত্রের উদ্ভব। মন্ত্রই মনকে ঊর্ধ্বগামী করে। সেই মন যদি বিষক্রিয়ায় জর্জরিত হয় তবে তো সমগ্র দেহই বিষাক্ত হয়ে যাবে। তাই মনসার উৎপত্তি যেমন আর্য ঋষিগণ দেখিয়েছেন বিষহরি দেবীরূপে সেরূপ বিষহরণ করে মনকে বিষযুক্ত করারও ব্যবস্থা তার হাতে। সাপের দাঁতে বিষ আছে কিন্তু নিজে যখন খায় তাতে বিষ লাগে না। কিন্তু হিংসায় বা আত্মরক্ষায় যখন দংশন করে তখন দংশিত স্থানে বিষ ছড়ায়। তাই মনে বিষ হল হিংসা, ক্রোধ, লোভ— এগুলো দূর করার দেবী মনসা। চিন্তা থেকে আমাদের মুক্তি নেই তবু চিন্তা যাতে যুক্ত হতে পারে, চিন্তা যাতে রিপুর বশ না হয় তার চেষ্টাই আমাদের করতে হবে— এই শিক্ষাই দিচ্ছে মনসা-সংস্কৃতি।
সরস্বতীর মত দেবী মনসার বাহনও হংস। বাহনকে দেখেই আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে মনসাও জ্ঞানযুতা, জ্ঞানলক্ষণা। দেবী মনসার জ্ঞানশক্তি মনোময়। শুদ্ধযোগ ও আধ্যত্মজ্ঞানের সাধনসিদ্ধি দেবী মনসার দান।
দীর্ঘকাল ধরে ঘটপূজার মাধ্যমে মনসা শ্রাবণসংক্রান্তিতে এখানে ঘরে-ঘরে পূজিত হয়। মনসাঘটের আকৃতি খানিকটা লম্বাটে। ঘটের গায়ে উৎকীর্ণ চিত্রও বেশ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। কুম্ভকারদের তৈরি এই ঘটের উপর শিল্পীরা মনসার মূর্তি চিত্রণ করেন গঠনভঙ্গিমার সঙ্গে মিলিয়ে। উপরে ঘটের মুখের প্রসারিত কানা অংশটি হয়ে ওঠে দেবীর এক শিরোভূষণ। মনসার দুটি হাতের মুঠিতে ধরা থাকে একটি করে সাপ। একটানে দ্রুত রেখা টেনে আঁকা হয় ঠোঁট ও চিবুকের ভাঁজ, নাকে নথ, চোখের ভ্রূ, ত্রিনয়ন এবং হাতের আঙুল। দেবীর গয়না হিসেবে উৎকীর্ণ করা হয় সাপ ও সাপের ফণার নকশা। দেবীর গায়ের রং হয় হলুদ এবং ঠোঁট আঁকা হয় সিঁদুরের বর্ণে। তবে দেবীর পরিধেয় বস্ত্রের রং কোনও কোনও ঘটে দেখা যায় সবুজ, বেশিরভাগই লাল। অক্ষিগোলকসহ দেবীর চোখদুটি বিস্ফারিত এবং হাতের উপর কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা যায় বৃশ্চিকসদৃশ উল্কিরেখা। ঘটের নিচের অংশে অনেক সময় চিত্রিত হয় পদ্ম ফুলের অলংকরণ, যার উপরে থাকে দেবীর অধিষ্ঠান। এসব মিলিয়ে মনসার ঘটটি বেশ অর্থবহ ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক লোকচিত্রকলার উদাহরণ। ঘটে দেবী মনসাকে পাওয়া যায় গর্ভবতী নারীরূপে।
মনসাঘটের মতই আরেক ধরনের চিত্রিত ঘট আছে যা ‘নাগঘট’ নামে পরিচিত। নাগঘটে এক বা একাধিক ফণাযুক্ত সাপের উপস্থিতি দেখা যায়। ফণার সংখ্যার ওপরে ঘটের নামকরণ আলাদা হয়, যেমন— পাঁচটি নাগের ফণাযুক্ত ঘট ‘পঞ্চনাগঘট’ বা আট সাপের ফণাযুক্ত ঘটকে বলা হয় ‘অষ্টনাগঘট’। নাগঘটে শিল্পী নিপুণভাবে সাপের ফণা যুক্ত করেন এবং ঘটকে রঙিন করে তোলেন। নাগমূর্তিকে ত্রিমাত্রিকভাবে মাটি দিয়ে তৈরি করে ঘটের গায়ে জুড়ে দেওয়া হয়। তারপর খড়িমাটির সাদা অথবা হলুদ রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়। এই ঘটে কোনও আকৃতিই শুধু রং দিয়ে আঁকা হয় না। কালোর ওপর লাল ও সাদা রঙের রেখা দিয়ে সাপের দেহকাণ্ড ও ফণাযুক্ত মাথা চিত্রিত করা হয়। ঘটের মাঝ বরাবর পরস্পর সম্পৃক্ত পদ্মদল এমনভাবে আঁকা হয় যেন ঘটের মুখটি প্রস্ফুটিত পদ্ম থেকে উদ্গত এবং ভেতর থেকেই নাগরাজ বেরিয়ে আসছে— এমনটা মনে হয়। নাগঘট বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গাছের তলায় স্থাপিত থাকে, একে বিসর্জন দেওয়া হয় না।
শ্রাবণসংক্রান্তির দিন পুকুর বা জলাশয় থেকে ঘট ভরে জল আনতে যান ‘দেহুরি’ বা পুরোহিত। অনেক পরিবারে গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীই ‘দেহুরি’ হন। দলবেঁধে গ্রামবাসীরা দেহুরির সঙ্গে জলাশয়ে যান। ফেরার পথে ‘সাখি’ গাইবেন দেহুরি। দেবী মনসাকে নিয়ে বাঁধা এ-সব গানে থাকে নানা ধাঁধা। পাল্টা গানে দেহুরির ধাঁধার জবাব দেন গ্রামবাসীরা। এর পর শালুক ফুল, চিঁড়ে-কলা-দুধ ও কালিয়াকড়া নামের একটি বিষফল দিয়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে দেবীর পুজো হয়। ১৬ প্রহরে ১৬ বার পুজোর সঙ্গে চলে জগৎগৌরীর (মনসার অপর নাম) বন্দনা-গান। যে পুজোয় বলি হয়, সেটি আমিষ পুজো। এমন পুজোয় পায়রা, হাঁস, ভেড়া, পাঁঠা বলি দেওয়ার রেওয়াজও রয়েছে। শ্রাবণসংক্রান্তির বিকেলে ঝাঁপান উৎসব হয়। সর্প-উপাসকরা গায়ে সাপ জড়িয়ে নানা ধরনের কসরত দেখান। তবে এখন বন্যপ্রাণ রক্ষা আইনের কারণে ঝাঁপান উৎসবের জাঁকজমক ততটা চোখে পড়ে না।