স্ব প ন না গ
‘ত’ আর ‘ল’ বর্ণদুটোকে জুড়লে যে-শব্দ তৈরি হয়, জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে তার হদিস পেতে অনেকের ক্ষেত্রেই একটা জীবন কম পড়ে যায়। আ-কার, ই-কার, এ-কার বা উ-কার এসে তাকে যখন তাল তেল তিল তালি তালু বানিয়ে ছাড়ে। শব্দনির্মাণের ইতিহাস নিয়ে ভাবতে বসেও তার তল পাওয়া বেশ দুরূহ হয়ে ওঠে। এ যেন অতল জলের আহ্বান।
তবে তল নয়, কথা হচ্ছে তাল নিয়ে। এই তালরহস্যের তল পাওয়াও চাট্টিখানি কথা নয়। অফিসের বসই হোক কিংবা ঘরের গিন্নি— জীবনকে স্মুথ রাখার তাগিদে কত তালই না ঠুকে চলতে হয় মানুষকে। সবকিছু তালে বাজলে ঠিক আছে, আর তা না-হলেই ঘরে বাইরে অনিবার্য সংঘাত। বাপের বাড়ি চলে যাবার হুমকি অথবা ইনক্রিমেন্ট স্টপের শাসানি। এ-সব নিয়েই তবু মধ্যবিত্তের গেরস্থ জীবন। বেতাল পঞ্চবিংশতির মতো তিল-কে তাল বানানোর ক্ষমতা আমাদের মতো ছাপোষা মানুষদের আর ক’জনেরই বা থাকে! প্রতি মুহূর্তে ছিঁড়ে পড়ার সম্ভাবনা নিয়ে ঝুলতে-থাকা দিনগুলোতেও যখন টিভির পর্দায় লাস্যময়ী ভঙ্গিতে ঐশ্বরিয়া রাই নেচেন ওঠে ‘তাল সে তাল মিলা’ বলে, তখন অস্থির মনে খানিক শান্তির ঢেউ ওঠে বৈকী! সুখপাখিকে ধরে রাখতে তাই বেতাল কিছু ভাবতে নেই, বেতাল কথা কইতে নেই।
তালগাছ নিয়ে আমার এক বন্ধু চমৎকার একটা ক্যাপশনের কথা বলেছিল, আমাদের কোনও শাখা নেই। সত্যিই তো, ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে। মনে সাধ কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়— একেবারে উড়ে যায়— কোথা পাবে পাখা সে?’ এ এমন একটি গাছ, ফল গুঁড়ি পাতা কোনওটাই তার ফেলনা নয়। পাতা থেকে তৈরি চাটাই কিংবা হাতপাখা আজও গ্রামবাংলার অনেক ঘরেই অপরিহার্য এক সামগ্রী। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মাথায় তালপাতার ‘পেখে’ চাপিয়ে তাল কুড়নোর মজা গ্রাম ছাড়া আর কোথায়? এমনকি কোলকাতার তালতলাতেও নয়। ছেলেবেলায় শুনেছি তাল নাকি কানা। তাল কুড়োতে এসে কারওর মাথায় তাল পড়েছে এমন কাণ্ড আজ অব্দি ঘটেনি। ফলে মাথায় তাল পড়ে মৃত্যু, নিদেনপক্ষে সামান্য আহত হওয়ার ঘটনার উদাহরণ এ পৃথিবীতে নেই। তালকানা শব্দের জন্মও নাকি তা থেকে। সত্যিমিথ্যে জানি না, তবে দৈনন্দিন কাজে আমার অহরহ ভুলগুলো দেখে তো আমার বউ কথায় কথায় আমাকে তালকানা বলতে ছাড়ে না।
যা দেখা যাচ্ছে, তা হল তাল বা তালগাছের যত সম্পর্ক— সব গ্রামের সঙ্গে। খুব কাছ থেকে গ্রাম দেখেনি যে, সে কী বুঝবে তালমাহাত্ম্য! কী জানে তালনবমীর? গ্রীষ্মশেষে আম জাম লিচুর রমরমার পড়তি শুরু হলেই বাজারে হাজির তাল। সারা বর্ষা জুড়েই তালের দাদাগিরি। বাজারে এলেও তাল কিন্তু এখনও সেভাবে গ্ল্যামারে উঠতে পারেনি। ঠাঁই হয়নি মল-এর শো-কেসে। এখনও বাজারের প্রান্তে মাসির আগলানো আওতায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকে ক্রেতার অপেক্ষায় নিঃশব্দে নির্জনে। অথচ বাজারে আসার আগেও তাল কতই না সার্ভিস দিয়েছে আপামর গ্রামবাসীকে। সকাল সকাল গ্লাস দুই তালের রস যদি উদরস্থ হয়, তার অনুভূতি ভুক্তভোগীরাই জানে। বেলা বাড়লে গেঁজিয়ে যাওয়া রস মানে তাড়ির মাহাত্ম্যর তো কথাই নেই। ঢুলুঢুলু চোখে টলোমলো পদচারণায় বিন্দাস ঢোলারহাটের নাজিম কিংবা গড়ভবানীপুরের বেচারামকে দেখলেও সে স্বর্গীয় আনন্দকে আন্দাজ করা কঠিন নয়।
মা মাটি মানুষকে চিনুক এই অহংকারে একবার আমার বছর আটেকের নাতিকে খাইয়েছিলাম তালশাঁস। সে জানিয়েছিল, এর চেয়ে ভাল সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের জলভরা সন্দেশ। তালপাতার সেপাই আমার রোগে-ভোগা নাতি এর পরেই এই সব উল্টোপাল্টা জিনিস খাওয়ার অপকার নিয়ে লেকচার দিতে ব্যাগ্র হয়ে ওঠে। লোকেরা বোধহয় একেই বলে জেনারেশন গ্যাপ। ‘হায় তাল বাদামি রঙের তাল’ বলে গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করে শোকসঙ্গীত তখন। অথচ এই তালগাছই তাকে ড্রইংয়ের পরীক্ষায় কতবার উতরে দিয়েছে। ডুবন্ত সূর্যের গায়ে কালো রঙে দাগ টেনে মাথায় একঝাঁক চুলের মতো ইকরিমিকরি করে দিলেই কেল্লাফতে। আমি অপটু সেই সব দাগেও দেখতে পাই দিঘার তালসারির অপরূপ দৃশ্য, যেখানে সারি সারি তালগাছগুলো না থাকলে ছবিটি কিছুতেই যেন পূর্ণতা পায় না।
আমাদের গ্রামের মাটির দোতলা বাড়িটির ওপরতলার ভার ধরে রেখেছিল তালসাঁড়া। এমনকি তার ওপরের টিনের আচ্ছাদনটিও রাখা ছিল যে স্ট্রাকচারের ওপর তাও তৈরি তালসাঁড়া দিয়ে। লম্বালম্বি কেটে রোদজল খাইয়ে সিজ়নড্ করে আলকাতরার পোছে সেই সব তালসাঁড়ার শক্তি অনুমান করা যেতে পারে এটা জেনে যে, গ্রামের সেই বাড়ি টিকেছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর। সেই গ্রাম আর নেই। বাড়িটিও নেই। তালগাছের গুঁড়ি ধাপে ধাপে সাজিয়ে সিঁড়ি— বাড়ির পেছনের পুকুরের সেই সিঁড়ি ভেঙে নেমে জলে ডুব দেওয়ার দিনও আজ অতীত। তবে গ্রাম ছেড়ে খুব সহজেই শহরে পাড়ি দিতে পেরেছে যে বস্তুটি, তা হল তালপাটালি। এবং তালমিছরি। যতই ঝগড়া থাকুক সই দেখে নেবার সতর্কবার্তা কিংবা সই দেখে প্রতারিত না হবার সাবধানবাণী, এই তালমিছরিই সম্ভবত বলবার মতো তালের একমাত্র শহুরে প্রতিনিধি।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জনগণের সেবায় নিয়োজিত এমন গাছ আর কোথায়? বর্ষা এল, বাজারের অখ্যাত কোনও এক কোণে হাজিরাও দিল, তাকে থলেয় ভরে বছরের একটা দিনও অন্তত তালের বড়ার স্বাদ নেব না, এমন নিস্পৃহ মানুষ আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। তা সে ছাপোষা মধ্যবিত্তই হোক বা কোন তালেবর। তাল আসলে নিতান্ত নিরহংকারী আত্মবলিদানকারী যেন অলৌকিক এক ফল। তালের পায়েস (তালক্ষীর) তালের পিঠে তালের বড়া… স্বাদের রসটুকু নিঙড়ে ফেলে দিয়েও নিস্তার কই! তালের আঁটি! অযত্নে অবহেলায় পড়ে থেকেও তার ভেতর বেড়ে উঠছে ফোঁপরা। তা না হলে যে লক্ষ্মীপুজোর নৈবেদ্যও অসম্পূর্ণ। বরিশালের লক্ষ্মীপুজোয় এই ফোঁপরা অপরিহার্য এক উপকরণ, বলেছিল আমার এক বরিশালী বন্ধুপত্নী।
আরও কি রইল কিছু! যেটুক থাকল, রেখে দাও, রোদে শুকোক। জ্বালানির কাজে লেগে যাবে।