আ ব দু ল্লা হ আ ল আ মি ন
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আক্রান্ত হবার ভয়ে ও ‘বিশৃঙ্খলার আশংকায়’ গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে আমাদের পরিবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে চলে আসে। নদীয়ার বিভিন্ন গ্রামে হিন্দু ও মুসলমান রায়ট বেধে গেলে নদীয়া জেলার বিপুল সংখ্যক মুসলমান ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পাকিস্তানভুক্ত কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা এলাকায় চলে আসতে শুরু করলে আমাদের পরিবারের সদস্যরাও চলে আসতে বাধ্য হন। আমি রিফ্যুজি নই, কিন্তু রিফ্যুজি পরিবারে জন্ম নেয়ার সুবাদে রিফ্যুজি পরিবারের স্মৃতি, নস্টালজিয়া ও যন্ত্রণার সঙ্গে পরিচিত। আমার শৈশবস্মৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে আমার পিতামহের দেশ-হারানোর কাহিনি এবং ‘দেশভাগ’, ‘ওঠাওঠি’, ‘জমিজমা বিনিময়’ এবং ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’ ইত্যাদি ভীতিপ্রদ শব্দগুলি। খুব শৈশবে শুনেছি, ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর রোমহর্ষক গল্প। নিম্ন শ্রেণির ডোমদের দিয়ে দাঙ্গায় নিহত তিন সহস্রাধিক মৃতদেহ কীভাবে পোড়ানো ও গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে তার মর্মস্পর্শী বিবরণ। শুনেছি নদীয়া ও মুর্শিদাবাদের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলনের ইতিহাস।
১৯৫১ সালের প্রথম দিকে আমার দাদা সপরিবার রিফ্যুজি হয়ে পূর্ববাংলার কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুরে চলে আসেন, পরে মেহেরপুরে স্থিত হন। পেশায় তিনি শিক্ষক ছিলেন। নিজ এলাকায় তাঁর প্রভাব-পরিচিতি ছিল, সচ্ছলভাবে চলার জন্য উত্তরাধিকারসূত্রে জমিজমাও পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭-এর দেশভাগোত্তর রাষ্ট্রীয় বিরূপতা, প্রতিবেশী ও উদ্বাস্তু হিন্দুদের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হয়ে দেশত্যাগ করেন। দেশত্যাগের বেদনা, নিজের ঘরবাড়ি-জমিজিরাত হারিয়ে ফেলার কষ্ট তিনি আমৃত্যু ভুলতে পারেননি। তদুপরি এক নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়ে দেশভাগ মেনে নিয়ে দেশত্যাগ করেছিলেন। দেশভাগের অর্জন-প্রাপ্তি এবং এর নানা দিকগুলো নিয়েও তিনি অকপটে আলোচনা করতেন। তিনি বলতেন, দেশভাগের কাউন্টার-থিসিস হিসেবেই পূর্ব বাংলার বাঙালিদের ভাষা আন্দোলন ও পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের জনগণের লড়াই, সেই পথ বেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। তিনি বলতেন, ‘দেশভাগের ফলে আমরা (বাঙালি মুসলমান) লাভবান হয়েছি। দেশভাগ না হলে আমার ছেলে ডাক্তার হতে পারত না, রহমতপুরের সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে জওহরের পক্ষে কর্নেল হওয়া ও আবদুল মজিদের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চিফ সায়েন্টিস্টের পদ দখল কোনওভাবেই সম্ভব ছিল না। উচ্চবর্গীয় সমাজ কাঠামোয় মুসলমান সমাজের জায়গা সামনের সারিতে থাকত বলে মনে হয় না। দেশভাগ হয়েছিল বলেই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে।’ বাংলাদেশে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে সেটা দেশভাগের ফলেই সম্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করতেন।
আমার দাদার মতো অনেকে মনে করেন, দেশভাগের কারণে মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির পক্ষে সহজ হয়েছে প্রকৌশলী, চিকিৎসক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনপেশা, সিভিল সার্ভিসের বড় বড় পদ দখল করা। ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘—একচুয়ালি যদি পার্টিশন না হতো, তাহলে কী হতো? তাহলে এই যে পাকিস্তান আমলে কালচারাল এক্টিভিটিস, ফিল্মে, সংগীতে, পড়াশোনায় যে নতুন উদ্যম বাঙালি মুসলমান যে কাজ করেছে, অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে, সৃষ্টি করেছে— এটা হয়তো হতো না।’১ স্বীকার করতেই হয়, দেশভাগের যন্ত্রণা যেমন আছে, তেমনই এর অর্জনটাও একেবারে মিথ্যে নয়। তারপরও বাঙালি মুসলমান সমাজের একটি অংশ দেশভাগের ফলে সৃষ্ট উদ্বাস্তু জীবনের স্মৃতিকাতরতা ও বেদনা ভুলতে পারেন না। বহু প্রাপ্তির মধ্যেও তারা কেউ কেউ সারাজীবন অন্তরে চিরপ্রবাসীই রয়ে গেছেন, এটা যেমন পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে আসা বাঙালি মুসলমানের জন্য প্রযোজ্য, তেমনই পূর্ববঙ্গ থেকে দেশান্তরী হওয়া বাঙালি হিন্দুদের জন্যও প্রযোজ্য। আমরা যারা রিফ্যুজি পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম, তাদের ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে’ দেশভাগ ও দেশত্যাগী মানুষের বেদনার্ত চিত্তের হাহাকার ও রক্তক্ষরণ। এই বেদনা, এই হাহাকার পৌনে একশো বছরেও কাটতে চায় না। এই হাহাকারে মূহ্যমান থাকেন অমর্ত্য সেনের মতো একজন নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ, ঋত্বিক ঘটকের মতো বরেণ্য চলচ্চিত্রকার, রণজিৎ গুহ, তপন রায়চৌধুরী ও দীপেশ চক্রবর্তীর মতো ইতিহাসবিদরা। দেশত্যাগের বেদনার রং দিয়ে ঔপন্যাসিক দেবেশ রায় রচনা করতে পারেন ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ নামে এক হাজার পৃষ্ঠার এক বৃহৎ আকারের উপন্যাস।
পূর্ববঙ্গের নদী মাঠ, জল জঙ্গলের স্মৃতিময় স্বপ্নে ঋত্বিক ঘটকের মন কতটা ভারাতুর ছিল তা তাঁর একটি বর্ণনা থেকে বোঝা যায়: ‘আমার শৈশব কৈশোর এবং প্রথম যৌবন পূর্ববাংলায় কেটেছে। সেই জীবন, সেই স্মৃতি, সেই নস্টালজিয়া আমাকে উন্মাদের মতো টেনে নিয়ে যায় তিতাসে, তিতাস নিয়ে ছবি করতে।—তিতাস একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি গোছের সেই ফেলে আসা জীবনস্মৃতির উদ্দেশ্যে।— একুশে ফেব্রুয়ারি ওরা আমাকে, সত্যজিৎবাবু এবং আরো কয়েকজনকে স্টেট গেস্ট করে নিয়ে গিয়েছিল ঢাকায়। প্লেনে করে যাচ্ছিলাম, পাশে সত্যজিৎবাবু বসে, যখন পদ্মা ক্রস করছি তখন আমি হাউ হাউ কেঁদে ফেললাম।’২ মেট্রোপলিটন মানসিকতার সত্যজিৎ রায় সেদিন নির্বিকার থাকলেও ঋত্বিক তাঁর হৃদয়-উদ্বেলতা সংবরণ করতে পারেননি। তিনি খুব ভালভাবে বুঝেছিলেন, ‘অতীতের ছিটেফোঁটাও আর নেই, থাকতে পারে না। ইতিহাস ভয়ংকর নিষ্ঠুর, সব হারিয়ে গেছে’। দেশভাগের কারণে নিজদেশে তিনি পরবাসী হন, বঞ্চিত হন নাগরিকত্বের সহজাত অধিকার থেকেও। ঋত্বিকের অধিকাংশ ছবি দেশভাগ ও দেশত্যাগ নিয়ে, বাংলা ভাগকে তিনি মেনে নিতে পারেননি।
আসলে, উদ্বাস্তু সমস্যা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। হাল আমলের সোমালিয়ান কথাসাহিত্যিক নুরুদ্দিন ফারাহকেও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ফেলে আসা জন্মভূমির স্মৃতিকারতা, কারণ তিনিও রিফ্যুজি। লেখালেখির জন্য তিনিও মাতৃভূমি সোমালিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থিতু হয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত ২০২২ সালের ঢাকা লিট ফেস্টে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘টর্ন অ্যাপার্ট’ একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক শব্দ। নিজের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানে নিজের অস্তিত্বের কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়া। এ বিচ্ছেদকে মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা যায়।—ভারত বিভক্তির সময় বিপুলসংখ্যক মানুষ তাদের ঠিকানা পরিবর্তন করে দেশান্তরী হয়েছিলেন। তাদের সম্পদ ও জীবনমানের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইউরোপেও উনবিংশ শতকে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। উপমহাদেশের ভাগ থেকে শুরু করে আফ্রিকা কিংবা ইউরোপ ভাগ পৃথিবীর মানুষের কাছে যে দাগ ফেলেছে, তা মানুষের স্মৃতিতে কিংবা আচরণে এখনো বয়ে চলেছে।’৩
বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনও দেশভাগের স্মৃতির উত্তরাধিকার বয়ে চলেছেন তিন প্রজন্ম ধরে। বিস্মৃতপ্রবণ মানুষ বোধহয় অনেক কিছুই ভুলতে পারে, কেবল ভুলতে পারে না তার পূর্বপুরুষদের রক্তের দাগ লাগা স্মৃতি আর মুছতে পারে না জন্মভূমির মাটি-জল-হাওয়ার ছাপ। একজন স্মৃতিকাতর চিন্তাশীল মানুষ নানাভাবেই অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সম্পর্ক তৈরির অন্তর্গত তাগিদ অনুভব করেন। ২০০১ সালে প্রকাশিত স্বেতলানা বয়েম তাঁর ‘The Future of Nostalgia’ শীর্ষক অসামান্য গ্রন্থে কেন একজন আধুনিক মানুষ স্মৃতিকারতা বা নস্টালজিয়া নামক অসুখে ভোগে তার পথরেখাটি দেখিয়েছেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে বহুল ব্যবহৃত স্মৃতিকারতা বা Nostalgia শব্দটি এসেছে চিকিৎসাশাস্ত্রের এলাকা থেকে। সুইস গবেষক জোহানেস হোফার চিকিৎসাবিদ্যার গবেষণাপত্রে একধরনের অসুখের লক্ষণ হিসেবে প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন ১৬৮৮ সালে। এটাকে আধুনিক মানুষের অসুখ-বিসুখ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, এই রোগের জন্ম হয় গৃহহারা বেদনাবোধ কিংবা ঘরে ফেরার তাগিদ থেকে। এই বেদনাবোধ ও তাগিদ থেকেই একজন অমিতাভ ঘোষ রচনা করেন ‘দ্য শ্যাডো লাইন্স’। একজন জ্যোতি বসু হয়ে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী কিংবা পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আগত লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর প্রাণের মানুষ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সাতচল্লিশ-উত্তর পূর্ব পাকিস্তানে কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি, সাহিত্যে কিংবা ইতিহাসচর্চায় দেশভাগ ও দেশত্যাগের বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি। ‘একটা স্বাধীনতা, একটা দেশভাগ, এত বিশাল একটা বাস্তুচ্যুতি, দুটো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অবিশ্বাস্য সংঘর্ষ, হানাহানি-খুন-ধর্ষণ, একটা ডিসটোপিয়ার মধ্য দিয়ে একটা জাতির যাত্রা, ভূতগ্রস্তের মতো লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু মানুষ আর তাঁদের ‘নাই, নাই’, দিন ও রাত্রির অকল্পনীয় সংগ্রাম, যে-সংগ্রামের আগপাশতলা ক্লেশিত, যে-ইতিহাস গণ-অবমাননার এবং এর ফলে যে অবসাদ, আর তার যে-বিষাদ বিষের মতো তীব্র ও কটু— বাঙালির সেই ইতিহাস মহাকাব্যিক যন্ত্রণা হয়ে বিশ্বসাহিত্যকে স্তম্ভিত, বিমূঢ় করে দেওয়ার মতো কোনো লেখা হয়ে উঠল না।’৪
এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। দেশভাগ নিয়ে গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস, আত্মজীবনী রচিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলো বিশ্বসাহিত্য সমুদ্রে তেমন তরঙ্গ-বিভঙ্গ সৃষ্টি করতে পারেনি। অথচ এই স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে বিশ্বসাহিত্যে একটি অভিঘাত সৃষ্টি করা যেত। এই হৃদয়বিদীর্ণ করা কাহিনি তথা ইতিহাস বাঙালি সাহিত্যিকরা বিশ্বসভায় মর্মশিল্প হিসেবে তুলে ধরতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম নিয়েও উল্লেখ করার তেমন কিছু সৃষ্টি হয়নি। বাঙালি তো অসৃজনশীল বন্ধ্যা জাতি নয়! তাহলে কেন পারল না? খুব সম্ভবত সমসাময়িক ও চলমান কাজের প্রতি অনীহা, নিষ্ক্রিয়তা, অতীত-মগ্নতাই বাঙালিকে আন্তর্জাতিক সৃষ্টিশীলতার জগত থেকে পিছিয়ে দিয়েছে বলে আমার ধারণা। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের সৃষ্টিশীলরা এখনও রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র যুগের বৃত্তে আটকে আছেন। রবীন্দ্রনাথ যত বড়ই মহাসমুদ্র কিংবা বনভূমি হোন না কেন, আমাদের সৃষ্টিশীলদের মনে রাখতে হবে, সময় কিন্তু রবীন্দ্র যুগে থেমে নেই। অশ্রুনদী, রক্ত-সমুদ্র পার হয়ে, বিশাল বিশাল সমস্যা-সংকট মোকাবিলা করে সময় এগিয়ে চলেছে। আমাদের বুঝতে হবে, চলমান রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ এবং যাপিত জীবন ও তার যন্ত্রণাকে অগ্রাহ্য করে বিশ্বমানের শিল্প নির্মাণ করা সম্ভব নয়।
আমাদের দেশের ঠুসিপরা ফরমায়েসি লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা স্বাধীনতযুদ্ধ এমনকি পলাশীযুদ্ধ নিয়ে মাতামাতি করলেও নিজ ভূখণ্ডের চলমান ও নিকট-অতীতের ইতিহাসলগ্ন রাজনৈতিক বিষয় এড়িয়ে যেতে চান। এক অদৃশ্য বাধার কারণে দেশভাগের মতো সেনসিটিভ ইস্যুটি নিয়ে তারা তেমন ঘাঁটাঘাঁটি করতে চান না। অথচ দেশভাগ ও দেশত্যাগের কাহিনিগুলো যে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নবায়ন এবং একুশ শতকের উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক বাস্তবতার পুনর্ব্যাখ্যার জন্য খুব দরকারি, কিন্তু এঁরা সেটা ভাবতেই পারেননি বা পারেন না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যে ‘দেশভাগ’-এর বিষয়টি কেবলই শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসের পরিভাষা ব্যবহার করে আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে ঘুরেফিরে এসেছে গান্ধী-নেহরু-জিন্নাহ, সভারকার, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, শেরে বাংলা, আবুল হাশিম, সোহরাওয়ার্দির নাম এবং ক্রিপস মিশন, ক্যাবিনেট মিশন, ভারত স্বাধীনতা আইনের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। ১৯৪৭ সালের ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করা হয়েছে কংগ্রেস-লীগের নেতাদের মধ্যকার সমঝোতা-বিরোধিতা এবং তর্ক-প্রতর্ক ও ক্রমবর্ধমান বিভাজন প্রভৃতির ঘেরটোপে সীমিত রেখে। দু’বাংলার লাখ লাখ ছিন্নমূল রিফ্যুজিদের মানবিক বিপর্যয়, যন্ত্রণা এবং তাদের ঘর-গৃহস্থালি, পরিবার, জোতজমি হারানোর বিষয়টি একেবারেই আমলে নেয়া হয়নি। ফলে দেশভাগ নিয়ে যে সাতখণ্ড রামায়ণ রচিত হয়েছে সেগুলোকে অর্ধসত্য চটি বই ছাড়া কী-ই বা বলা যায়! এমন অর্ধসত্য ইতিহাস পাঠ করে দেশভাগ বা বাংলা ভাগ সম্পর্কিত প্রকৃত ঘটনার হদিস পাওয়া কি সম্ভব? আমরা যারা সত্তর দশকের প্রথমদিকে জন্মগ্রহণ করেছি, তাদের পক্ষে ১৯৪৭ সালের দেশভাগজনিত হাহাকার, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা কিংবা রিফ্যুজি জীবনের দোমড়ানো মোচড়ানো দহনকথা অনুধাবন করা খুবই কঠিন। পৌনে একশো বছরের পরিক্রমায় লোকমুখে প্রচলিত ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানকৃত গল্প ও স্মৃতিগুলি কাগজ-কলমে লিপিবদ্ধ না থাকায় সেগুলির অধিকাংশই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে।
দুই
দেশভাগ নিয়ে নানাজনের নানা রকমের মত ও ব্যাখ্যা, পাকিস্তান দাবির সমর্থক একজন অভিজাত মুসলমানের দেশভাগ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা এক রকম, পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গ অভিমুখী দলিত হিন্দুদের ব্যাখ্যা আরেক রকম। মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর ওয়াসেফ আলি মির্জা ও ইস্কান্দার মির্জা (পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট) একই পরিবারের উত্তরসূরি হওয়া সত্ত্বেও দেশভাগ প্রশ্নে একমত ছিলেন না। ইস্কান্দার মির্জা মুর্শিদাবাদ ছেড়ে ‘স্বপ্নের দেশ’ পাকিস্তানে চিরস্থায়ী আসর গাঁড়লেও নবাব বাহাদুর ওয়াসেফ আলি মির্জা মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করেননি। দেশভাগ নিয়ে বরিশাল-ফরিদপুর-খুলনার দলিত হিন্দুদের সঙ্গে বিক্রমপুর কিংবা মানিকগঞ্জের উচ্চবর্গীয় হিন্দুদের মত মিলবে না। অভিজাত র্বণহিন্দুরা দেশভাগ চাইলেও দলিত হিন্দুরা যে দেশভাগ চাননি তা মনোরঞ্জন ব্যাপারীর ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’ পড়লে একটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। তাই দেশভাগ কারও কাছে জোতজমি, ঘরবাড়ি, স্বজন হারানোর বিষাদময় উপাখ্যান, কারও কাছে দেশভাগের পূর্বাপর সময়টি ছিল মুসলমান সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে উত্থানের এক ঘোরলাগা কালপর্ব। তাহলে কি বাঙালি জাতির আত্মসত্তা নির্মাণ যথেষ্ট ছিল না? কোনও গলদ ছিল? ধর্মের কারণে হিন্দু মুসলমান কী মানসিকভাবে আলাদা হয়েই ছিল?
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দিবসটি পূর্ব বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী অভিজাত মুসলমানরা উদযাপন করেছিল ‘পাকিস্তান’ তথা স্বাধীন ও স্বশাসিত মাতৃভূমি অর্জনের বিজয়ের দিন হিসেবে। তাঁদের কাছে হিন্দু জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশার গল্পগুলির কোনও মূল্য ছিল না। বরং তৎকালীন ঘটনাবলির পূর্বাপর বিবরণ সরকারি নথিপত্র থেকে মুছে ফেলতে সচেষ্ট হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিরা। পাকিস্তানের এলিট ও অভিজাত মুসলমানরা দেশভাগ প্রশ্নে পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শনের কারণে সাতচল্লিশোত্তর বাংলাদেশের সাহিত্যে দেশভাগ-বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি। শওকত ওসমানের ‘আলিম মুয়াজ্জিন’, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ-র ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’, আবু রুশদের ‘হাড়’, সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা’, হাসান আজিজুল হকের ‘আগুন পাখি’-র মতো কয়েকটি ব্যতিক্রমী লেখা বাদ দিলে বাংলাদেশের কবিতায়-গল্প-গানে দেশবিভাগের তেমন ছাপ নেই। কলকাতায় স্থায়ীভাবে অবস্থানের কারণে পূর্ববাংলায় জন্ম নেয়া নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সমরেশ বসুর মতো প্রতিভাবান লেখকরাও দেশান্তরী মানুষের হাহাকার, ছিন্নমূলদের আর্তি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন তেমন আঁচ করতে পারেননি। তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব পশ্চিম’ উপন্যাসে দেশভাগের মহাকাব্যিক বিবরণ রয়েছে।
পাঞ্জাবেও দেশভাগের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ, মর্মন্তুদ ও হৃদয়বিদারক। দেশান্তরী ও শেকড়চ্যুত মানুষের রক্তক্ষয়ী ও মর্মভেদী প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতেই সাদাত হাসান মান্টো, কৃষণ চন্দর, ভীষ্ম সাহনী নির্মাণ করেন কথাসাহিত্যের এক বিশাল ভাণ্ডার। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দেশভাগ-দেশত্যাগ নিয়ে বাংলাদেশে তেমন চর্চা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের পাকিস্তানমুখী হওয়া কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের ভারতমুখী হওয়ার বিষয়টি দেশভাগ-পরবর্তী বাংলাদেশের তৃতীয় প্রজন্মের অনুভূতিকে সেইভাবে নাড়া দিতে পারেনি। তাদের আগ্রহের বিষয় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, কাঁটাতারের বেড়া, সীমান্ত হত্যা, ফরাক্কা বাঁধ, গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি, আসামের নাগরিকপঞ্জি, বাংলাদেশের ভাষা-সাহিত্যের ওপর পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ইত্যাদি। তবে ইদানীং আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে দেশভাগ-দেশত্যাগের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হচ্ছে। সাতচল্লিশের দেশভাগ যে উপমহাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা, বৃহত্তম ট্র্যাজেডি সেটা নতুন করে আলোচনায় ফিরে আসছে। গবেষণায় উঠে আসছে, দেশভাগের কারণে ‘…সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায় মোট ছ-লাখ লোক মারা যায়। গৃহহারা হয় এক কোটি চল্লিশ লাখ মানুষ। ধর্ষিত ও ধর্মান্তরিত হয় এক লাখ নারী। এদের মধ্যে অনেককে নিলামে বিক্রি করা হয়েছিল।’৫
অথচ র্যাডক্লিফের তীক্ষ্ম ছুরির আঁচড়ে ফালি ফালি হয় জল-জঙ্গল-জমিজমা-ঘরবাড়ি— তছনছ হয়ে যায় একান্নবর্তী পরিবার-সুপ্রাচীন বিশ্বাস-চিরায়ত মূল্যবোধ, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি-আত্মীয়তা-বন্ধুত্বের গাঢ় বন্ধন। রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির কারণে দুভাগ হয় বর্ধিষ্ণু গ্রাম, গৃহস্থ বাড়ির উঠোন, রথতলা-চণ্ডীমণ্ডপ, মসজিদ-মাজার-শ্মশান, খালবিল, ফসলের মাঠ। ভিটেমাটি ফেলে দেশান্তরিত হয় হাজার হাজার মানুষ। আমার পূর্বপুরুষরাও দেশভাগের কারণে রাতারাতি নিজ বাসভূমে পরবাসী হয়ে পড়েন যা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এক অজানা আতঙ্কে আমার দাদা এবং তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা জোতজমি, পুকুর-ঘাট, ইশকুল-ঘর ফেলে রাতের আঁধারে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। তখন আমার বাবা ১০ বছরের শিশু, ফুপু আরও ছোট। সঙ্গে ছিলেন আমার দাদি, দাদার বৃদ্ধ মা এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন। উদ্বাস্তু হয়ে বৃহত্তর কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছেন আশ্রয়ের জন্য, তিন বছর পর ঠাঁই মেলে মেহেরপুরের সাহারবাটী গ্রামে। দাদা-দাদি ও আব্বার মুখে দেশভাগ-দেশত্যাগ, রিফ্যুজি জীবনের কষ্টের কথা, অভাব-আকালের কথা কত যে শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই। আমার নানাও উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। দেশভাগ ছিল আমার দাদার জীবনের একটি দগদগে ক্ষত, সেই ক্ষতের যন্ত্রণা তিনি সারাজীবন বহন করেছেন। শিক্ষকতা থেকে রিটায়ারমেন্টের পর পেনশন ও গ্র্যাচুয়িটি পেতেও বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। অনেক কষ্ট ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে তিনি (মৃত্যু: ১৯৮৬) পরপারে চলে গেছেন। আমাদের পরিবারের যারা দেশভাগের কারণে ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা অধিকাংশই মারা গেছেন, যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের স্মৃতি থেকে দেশত্যাগের ছবিগুলো হয়তো এতদিনে মুছে গেছে অথবা মুছে ফেলেছেন। কিন্তু আমার মনের ভেতর থেকে একটি সহজাত প্রশ্ন বারবার জেগে ওঠে, আমার দাদা বানী আমিন মাস্টার ও তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা কেন দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন? এই জিজ্ঞাসা বোধহয় আমার একার নয়, সব ইতিহাসমনস্ক ও দেশান্তরী মানুষের উত্তরাধিকার বয়ে বেড়ানো তৃতীয় প্রজন্মের জিজ্ঞাসা।
ভারতীয় জনগণের তীব্র চাপ ও উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনা করে ব্রিটিশরা ভারতবাসীকে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছিলেন, খুব ভাল কথা। দেশভাগ এত জরুরি হল কেন? আর কেন-ই বা লাখ লাখ নিরাপরাধ মানুষকে মাতৃভূমি ত্যাগ করে পালিয়ে আসতে হল? কেন স্বাধীনতা ও দেশভাগের নামে সারা দু’বাংলার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা ও তামাশা করা হল? বর্ধমানের যবগ্রামে জন্ম নেয়া দেশভাগের যন্ত্রণায় কাতর কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকেরও এই একই জিজ্ঞাসা: ‘বাংলার শ্রমিক, কৃষক, জেলে, তাঁতি, কামার, কুমোর যে কোন সাধারণ মানুষ অসহ্য তালুজ্বালা ক্রোধে জিজ্ঞাসা করতে পারে কেন দেশভাগ? জিন্নাহ সাহেবের মুসলীম লীগের জমিদার সামন্ত আয়মাদার আশরাফদের প্রয়োজন হতে পারে, প্যাটেল সাহেবদের হিন্দুরাজের প্রয়োজন হতে পারে, তার জন্য পাঞ্জাব কাটা, বাংলা ভাঙা জরুরি হতে পারে— কিন্তু রাঢ়ের কোন মুসলমান কেন পাকিস্তানে যাবে, হাজার হাজার লাখ লাখ হিন্দু কেন ছেড়ে আসবে বাংলাদেশ?’ কেন করিমপুর-তেহট্ট-চাপড়া-কৃষ্ণগঞ্জের হাজার হাজার মুসলমানকে পূর্ব পাকিস্তান অভিমুখে যাত্রা করতে হল? কেন নদীয়া-দিনাজপুরকে ভেঙে দুটুকরো করতে হল? রংপুর-দিনাজপুরের রাজবংশী এবং খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, যশোরের নমঃশূদ্রদের কেন দেশ ছাড়তে হল? তারা তো দেশভাগ-দেশত্যাগ কোনওটাই চাননি, কিন্তু অপমান, উৎপীড়ন, ধর্ষণ ও ধর্মান্তকরণের ভয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
কংগ্রেস নেতা কিরণশঙ্কর রায়ের প্রচুর জমিজমা ছিল ঢাকার মানিকগঞ্জে, সঙ্গত কারণেই তিনিও দেশ ছাড়তে চাননি। বঙ্গীয় আইন পরিষদের বিরোধী দলীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও দেশভাগের পর ছয় মাসের বেশি তিনি দেশে অবস্থান করতে পারেননি। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে যুক্তবাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা কিরণশঙ্কর রায় বাধ্য হন দেশত্যাগে। ধর্মের ভিত্তিতে বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত হলেও দলিত-তফসিলি সম্প্রদায়ের অবিসংবাদিত নেতা বাখেরগঞ্জের যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বরিশালেই থাকতে চেয়েছিলেন। তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, কিন্তু বর্ণহিন্দুদের প্রভাবাধীন কংগ্রেস সমর্থন করতেন না, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির হিন্দু মহাসভার দিকেও ঝোঁকেননি। বরং ‘বাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে নমঃশূদ্রদের স্বার্থের মিল’ খুঁজে পেয়ে পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন। বিভাগপূর্ব ও বিভাগোত্তর বাংলায় খাজা নাজিমুদ্দিন ও সোহরাওয়ার্দির মন্ত্রিসভায় মন্ত্রিত্ব করেছেন, তারপরও তিনি পাকিস্তানে থাকতে পারেননি। ১৯৫০-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর হতাশ হয়ে পাকিস্তান ত্যাগ করেন। তেমনিভাবে ১৯৫০-এর হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার প্রেক্ষিতে নদীয়ার করিমপুরের রহমতপুর, কিশোরপুর, ফাজিলনগর, পাটিকাবাড়ি, রামনগর, খানপুর এবং তেহট্টের হাঁসপুকুর, গন্ধরাজপুর, কড়ুইগাছি, খাসপুর, রাধানগরসহ বিভিন্ন গ্রামের মুসলমানরা ভিটেমাটি ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। বৃহত্তর কুষ্টিয়া, রাজশাহী জেলার বিভিন্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। ভারতীয় লোকসভার সদস্য মইনুল হাসান লিখেছেন: ‘এক সময় আমার খুবই যাতায়াত ছিল করিমপুর এলাকায়। একটি গ্রামের নাম রহমতপুর। সেখানে একজনও মুসলমানের বাস নেই। সবাই ঝাঁক বেঁধে একদিন রাত পুঁইয়ে চলে গেছে পূর্ব পাকিস্তানে। বেশি দূরে নয়। মাত্র ১৫/২০ কিমি দূর কুষ্টিয়া। ফিতের মাপে ১৫/২০ কিমি। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সেটা লক্ষ মাইল দূর— বিদেশ।’৬
নদীয়ার করিমপুর থানার রহমতপুর-গোয়াস গ্রামে আমার পূর্বপুরুষদের বসবাস ছিল। যে-শরণার্থী দলটি পঞ্চাশের দশকে অপমান-উৎপীড়ন ও দাঙ্গার ভয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে কুষ্টিয়ার পথে পা বাড়িয়েছিলেন সেই দলে আমার দাদা, দাদি, আব্বা, ফুপুরাও ছিলেন, ছিলেন আমার নিকটাত্মীয়রা। রহমতপুরে আমাদের যে-পরিবারটি ছিল সেটি বেশ সম্পন্ন ও সম্ভ্রান্ত পরিবার। তাদের জোতজমি-টাকাপয়সা ছিল, তেমনই ছিল শিক্ষাদীক্ষা বিদ্যাবুদ্ধি। আমার প্রপিতামহ গোলাম সোবহান কলকাতায় চাকরি করতেন, ছেলেকে (আমার দাদা) জামসেরপুর হাইস্কুলের হোস্টেলে রেখে পড়াশোনা করিয়েছিলেন। দাদার ভাইদেরও বেশ প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল, তারাও লেখাপড়া জানতেন। আমার দাদির বাবা গোলাম রাব্বানি জোতদার ছিলেন, তিন দশক ধরে রহমতপুর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু সব ফেলে চলে আসতে হল পূর্ব পাকিস্তানে। আমরা যে-গ্রামে বসবাস করছি সেই গ্রামের অবনীমোহন বিশ্বাস, শ্যামাপদ বিশ্বাস, ক্ষিতীশ ঠাকুর, কুঞ্জবিহারী বিশ্বাস, পাশের গ্রামের মণি সান্যাল, শিবকালী লাহিড়ী, গোভীপুরের মাধব মোহান্ত (পশ্চিমবঙ্গের সাবেক বিধায়ক), বিনয় তরফদার প্রমুখও দেশত্যাগ করেন। তাদের চণ্ডীতলা, ইশকুল ঘর, পুজোর ঘর, শখের থিয়েটার— সব এখানে পড়ে থাকল। আমার দাদা যাঁদের সঙ্গে সম্পত্তি বিনিময় করেছেন তাদের রেখে যাওয়া বাড়িঘর সংস্কার করে আজও আমরা বসবাস করছি। ১৯৫০ সালে দাঙ্গার পর করিমপুর-তেহট্টের মুসলমানরা মেহেরপুরের হিন্দুদের সঙ্গে সম্পত্তি বিনিময় করে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ‘১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফুলনাপুরের একজন মুসলিম একজন হিন্দুর সঙ্গে কিছু সম্পত্তি বিনিময় করে পাকিস্তানে চলে যায়। এপ্রিল মাসে কোচবিহার জেলার সিতালকুচির বড়মারিচার একজন মুসলিম একজন হিন্দু উদ্বাস্তুর কাছে তার পাটচাষের আধিকার দিয়ে পাকিস্তানে চলে যায়। এ ধরনের অনেক ঘটনা উল্লেখ করা যায়।৭
বিভিন্ন ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে জানা যায়, কেবল ধর্মের কারণে দেশভাগ হয়নি। জাতীয় নেতৃত্বের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ের এলিটদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণেও দেশভাগ, জেলা ভাগ, থানা ভাগ, এমনকি গ্রাম ভাগ হয়েছে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণেই দেশভাগ ও ওঠাওঠি হয়েছে। এই রাজনীতির হাত এত লম্বা ছিল যে এর কবল থেকে রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, নৈতিকতা— কোনওকিছুই রেহাই পায়নি। ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতির কুশীলবরাই নির্ধারণ করে দেন কারা পূর্ব বাংলায় থাকবে, আর কারা পশ্চিমবঙ্গে থাকবে। দ্বিখণ্ডিত বাংলার মানচিত্র রদবদল করতে জাতীয় নেতাদের পাশাপাশি স্থানীয় প্রভাবশালীরাও হস্তক্ষেপ করেছেন, এক্ষেত্রে কেবল রাডক্লিফকে দায়ী করলে চলবে না। কৃষ্ণনগরের রাজপরিবার ও রানাঘাটের পালচৌধুরীদের নদীয়া বিভক্তির জন্য দায়ী করা হয়, হিন্দু এলিট ও উদ্বাস্তুদের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ভারতভুক্ত নদীয়া জেলার মুসলমানরা ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হন। দেশভাগের প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতবিক্ষত হয় অবিভক্ত বাংলার কয়েকশত বছরের গৌরবময় ঐতিহ্য। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অসংখ্য গ্রাম এখনও দেশভাগের করুণ স্মৃতি বহন করে চলেছে। চুয়াডাঙ্গার নাটুদহের ‘হাজার দুয়ারি’ বহন করে চলেছে দেশভাগ-পূর্ব জমিদার নফর পালচৌধুরীর পরিবারের ঐতিহ্য, স্মৃতিচিহ্ন ও বেদনা। নদীয়া জেলার করিমপুর থানার মুসলমান অধ্যুষিত গ্রাম রহমতপুরে মুঘল আমলে একটি মসজিদ নির্মিত হয়, দেশভাগের আগে সেখানে নিয়মিত নামাজ পড়ার চল ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষরা সেখানে নামাজ আদায় করতেন, দেশত্যাগের পর সেই মসজিদে আর আজান ধ্বনিত হয় না, জুম্মাবারেও কোনও নামাজির সাক্ষাত মেলে না। দেশভাগের ক্ষত ও স্মৃতিচিহ্ন বুকে নিয়ে কালের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বটের ঝুড়ি-নামা সেই ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি আর তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে রাতের আঁধারে ঘর-গৃহস্থালি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া মানুষগুলির অলৌকিক দীর্ঘশ্বাস।
তিন
ইতিহাস ও সাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করে জানা যায়, অবিভক্ত বঙ্গদেশে সব যুগেই সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ও রেষারেষির উপদ্রব পরিলক্ষিত হয়েছে। এই উপদ্রবের মধ্যেও কেউ কেউ সম্প্রীতির বাণী ফেরি করেছেন নিজ এলাকায়। এঁদের মধ্যে অন্যতম মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর ওয়াসিফ আলি মির্জা। তিনি চেয়েছিলেন দুই সম্প্রদায় মিলেমিশে স্বাধীন অখণ্ড ভারতবর্ষ গড়ে তুলুক। ১৯৩৭ সালে তিনি হিন্দু মুসলমান ইউনিটি এসোসিয়েশন নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। ১৯৩৮ সালে তাঁর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় হিন্দু-মুসলমান ঐক্য সম্মেলন। মুর্শিদাবাদেও ‘হাজারদুয়ারি প্রাসাদের মাঠে প্রকাশ্য সম্মেলনে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। কংগ্রেসের হুমায়ূন কবীর, ডা. আর আহমদ ও তুলসী গোস্বামী, কমিউনিস্ট লিগের সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা শামসুল হুদা প্রমুখ নেতৃত্ববৃন্দ এই সম্মেলনকে সাফল্যমণ্ডিত করার উদ্দেশ্যে হাত মেলান।’৮
ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে বাংলার বিভিন্ন জেলায় ছোটখাটো দাঙ্গা হয়েছে, তবে নবাব বাহাদুর এবং কংগ্রেস, কমিউনিস্ট লিগ, অনুশীলন সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টিসহ প্রগতিশীল চিন্তার নেতা-কর্মীদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মুর্শিদাবাদের মাটিকে স্পর্শ করতে পারেনি। নবাব বাহাদুরের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী প্রচারণার ফলে মুসলিমপ্রধান জেলা হওয়া সত্ত্বেও মুর্শিদাবাদের পাকিস্তানভুক্তি সম্ভব হয়নি। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার মতো তিনিও মুর্শিদাবাদ জেলাকে ভারতে রাখার দাবি জানান। যদিও তাঁর পুত্র মুসলিম লীগ নেতা কাজেম আলি মির্জা এই প্রস্তাবনার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৪ই আগস্ট মুর্শিদাবাদকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হলে ১৫ই আগস্ট বহরমপুরের ব্যারাক স্কোয়ারে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালীন মুর্শিদাবাদের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আই আর খান। মঞ্চে উপস্থিত হন নবাবপুত্র কাজেম আলি মির্জা, সনৎ রাহা, নিতাই গুপ্তসহ বিশিষ্টজনেরা। মঞ্চে গান গাইছেন সংগীতশিল্পী ও কমিউনিস্ট নেতা সুধীন সেন। তিনি ও তাঁর সহশিল্পীরা গাইছেন, ‘সোনার দেশ গড়বো মোরা সোনার পাকিস্তান, সুখ-শান্তি আনব মিলে হিন্দু-মুসলমান।’৯ বহরমপুরের সরকারি অফিস, বাসভবনে তখন পাকিস্তানের পতাকা উড়তে থাকে। কিন্তু নবাব বাহাদুর ওয়াসেফ আলি মির্জা মুর্শিদাবাদ জেলাকে ভারতভুক্তির দাবিতে প্রবল জনমত গড়ে তোলেন। জেলার অনেক জমিদার বিশেষত লালগোলার রাজা, কাশিমবাজারের রাজপরিবার, খোদা বকশো এমএলএ-এর মতো অনেক বিশিষ্টজন এর বিরোধিতা করেন। নবাব বাহাদুর ওয়াসেফ আলি মির্জার প্রচেষ্টায় অবশেষে ১৭ আগস্ট মুর্শিদাবাদের ভারতভুক্তির ঘোষণা আসে। ১৮ আগস্ট আবার সেই ব্যারাক স্কোয়ারে উত্তোলন করা হয় ভারতের তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা, সুধীন সেন মহানন্দে গেয়ে ওঠেন, ‘সোনার দেশ গড়বো মোরা সোনার হিন্দুস্থান, সুখ-শান্তি আনব মিলে হিন্দু মুসলমান’।
দেশভাগ ও মুর্শিদাবাদের ভারতভুক্তি মুসলমান জনমনে কী ধরনের প্রভাব বিস্তার করেছিল, এ নিয়ে তেমন গবেষণা হয়নি। তবে মুর্শিদাবাদ তথা পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা যেন নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ না করে সেজন্য জননেতা সৈয়দ বদরুদ্দোজা, রেজাউল করিমের মতো নেতারা সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মুর্শিদাবাদের মুসলমানদের বেঝাতে চেষ্টা করেন যে, তাদের দেশত্যাগের দরকার নেই। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতই তাদের জন্য নিরাপদস্থল। তারপরও কেউ কেউ পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন, আবার অনেকেই সুবিধা করতে না পেরে মুর্শিদাবাদে ফিরে যান। ‘মুর্শিদাবাদ চরিধাভিধানে’ পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের (১৯২৯-২০১২) বাবা সৈয়দ আব্দুর রহমান ফেরদৌসী (১৯০৪-২০০৬) সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীনতার পর তিনি বর্ধমান থেকে মুর্শিদাবাদে ফেরেন। এরপর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান। কিছুদিন সেখানে থাকার পর তিনি ফের এদেশে ফিরে আসেন।’ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অনেকেই ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন, কিন্তু তারা বিষয়টি প্রচার করতে চাননি।
মুর্শিদাবাদের অধিকাংশ মুসলমান দেশের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকলেও দেশভাগ নামক ট্র্যাজেডি পদ্মাপাড়ের ভ্রাতৃপ্রতিম দুই জেলা রাজশাহী ও মুর্শিদাবাদকে চিরদিনের জন্য আলাদা করে দেয়। ‘আমার মন কান্দে পদ্মা চরের লাইগ্যা’— ঋত্বিক ঘটকের মতো অনেকের প্রাণ কেঁদেছে ওপারে চলে গিয়েও। পদ্মার এপারে রাজশাহীর গোদাগাড়ি এবং ওপারে লালগোলার মানুষের সঙ্গে ছিল নিবিড় আত্মীয়তার সম্পর্ক। কাছাকাছি ভগবানগোলা, ডোমকল, জলঙ্গি, কাহারপাড়া এবং কাহারপাড়ার উল্টোদিকে রাজশাহীর মানুষের জীবন ছিল এক সুতোয় গাঁথা। অবিভক্ত বাংলায় এ অঞ্চলের শিক্ষাদীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হত রাজশাহী শহরকে ঘিরে। দেশভাগের পূর্বে রাজশাহী কলেজেই পড়াশোনা করতেন ডোমকলের সচ্ছল ঘরের ছেলেরা। ১৯৫২ সালে দুদেশের মধ্যে পাসপোর্ট চালু হওয়ায় রাজশাহীর সঙ্গে ওপার বাংলার তথা মুর্শিদাবাদের মানুষের সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। মুর্শিদাবাদের মানুষের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মূলকেন্দ্র এখন বহরমপুর। দেশভাগের পর বিচারপতি হাবিবুর রহমান (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা) ও বিচারপতি মাহবুব মুর্শেদদের পরিবার নতুন স্বপ্নে বুক বেঁধে মুর্শিদাবাদের পাট চুকিয়ে দিয়ে পদ্মার এপারে চলে আসেন। তারপরও ডোমকল, ইসলামপুর, জলঙ্গি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা, বড় বড় মসজিদ আছে। রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে মুসলমানরা। এসব এলাকার মুসলমানরা পূর্ব পাকিস্তানে আসেননি, যোগ দেননি পূর্ব পাকিস্তানের বিজয়-উৎসবে। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই খুদা, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার বীরভূম থেকে ঢাকায় এবং শহীদ ড. শামসুজ্জোহাদের পরিবার বীরভূম থেকে রাজশাহীতে চলে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. ওয়াকিল আহমেদ মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে ষাটের দশকে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন চুয়াডাঙ্গার ভারপ্রাপ্ত এসডিও হাবিবুর রসুলও ছিলেন বীরভূমের বাসিন্দা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গ্র্যাজুয়েট মি. রসুল চাকুরিপ্রাপ্তির আশায় বাবা-মা, ভাইবোনদের পশ্চিমবঙ্গে রেখে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন এবং সস্ত্রীক থিতু হয়ে যান। হাবিবুর রসুলের মতো হাজার হাজার শিক্ষিত উজ্জীবিত তরুণ চাকরির প্রত্যাশায় ঢাকা-রাজশাহী-খুলনার মতো শহরগুলোয় ভিড় জমায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান থেকে জানা যায়, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের ভোর থেকেই ঢাকা-রাজশাহীর মতো মুসলিম অধ্যুষিত শহরগুলির অভিজাত ও উচ্চবর্গীয় মুসলমানরা বাঁধভাঙা আনন্দে মেতে ওঠে। কংগ্রেস নেতা প্রভাষ লাহিড়ীর বক্তব্য থেকে জানা যায়, ‘রাজশাহীতে আগত অগণন মানুষের প্রতিটি মুখ উদ্ভাসিত ছিল বহু আকাঙ্ক্ষিত বিজয়ানন্দে।’ ঢাকা শহরও স্বাধীনতার আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে— চল্লিশের দশকের মুসলিম জাতীয়তাবাদী তরুণ তাজউদ্দীনের দিনলিপির পাতা থেকে জানা যায়। কেউ কণ্ঠ ফুলিয়ে বলেছেন, ‘আজকের মধ্যরাতই ব্রিটিশ শাসনের শেষ রজনী এবং ভারতের স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র সরকার ও শাসনামলের সূচনা।’ এক মুসলমান কবি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পাকিস্তানকে ‘চির ঈদের দেশ’ হিসেবে অভিহিত করেন। নতুন রাষ্ট্রের জন্ম ঘিরে আনন্দোৎসব পালন, তোরণ নির্মাণ ও সাজসজ্জার হিড়িক পড়ে যায়। অন্যদিকে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ববঙ্গের উচ্চবর্গীয় ও বর্ণহিন্দুদের মধ্যে নেমে আসে হতাশা, ক্ষোভ ও ভীতিপ্রদ পরিস্থিতি। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের মৌল চেতনার সঙ্গে কোনওভাবেই তারা একাত্ম হতে পারেন না। এক হিন্দু নেতা খুব স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেন, ‘হিন্দুরা কখনওই পাকিস্তানের জন্ম চায়নি। তাদের অনিচ্ছুক মাথার ওপর পাকিস্তানকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
হিন্দুদের কাছে পাকিস্তান কখনওই গ্রহণযোগ্য ছিল না। দেশভাগের পরপরই চুয়াডাঙ্গার পালচৌধুরী, মেহেরপুরের মুখার্জি ও মল্লিক পরিবারের সদস্যরা দেশত্যাগ করেন। চুয়াডাঙ্গার নাটুদহের জমিদার নফরচন্দ্র পালচৌধুরী ও বিপ্রদাস পালচৌধুরী ছিলেন বিশাল এস্টেটের মালিক। জমিদার হলেও তারা ছিলেন প্রজাপ্রেমী, শিক্ষানুরাগী ও জনহিতৈষী ব্যক্তিত্ব। নফর পাল নাটুদহ গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। ‘লাঠিয়াল ও কর্মচারীদের সাহায্যে পারিবারিক এস্টেটের কার্যনির্বাহ, কাছারিতে বিচারকার্য সম্পাদন করতেন, পারিবারিক দেব-দেবীর পূজাঅর্চনা ও একটি শ্রেণি সমিতি পরিচালনা করেন। অন্যদিকে তাঁর ভাই বিপ্রদাস কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করে ইংল্যান্ডে যান। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পর তিনি পাশ্চাত্য জীবনধারা অনুসরণ করেন। কোলকাতায় থিতু না হয়ে স্থায়ীভাবে নদীয়ায় বসবাস করেন, কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং দুদশক ধরে নদীয়া জেলা বোর্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন।১০ নফরচন্দ্র পাল মফস্বলে বসবাস করেও প্রেসিডেন্সি কলেজের একাডেমিক ভবন নির্মাণে পাঁচ হাজার টাকা দান করেন। শিক্ষাবিস্তারে বিস্তর ব্যয় করেছেন। নাটুদহে নির্মাণ করেন হাজার-দুয়ারি অট্টালিকা। তার ভাই বিপ্রদাস পালচৌধুরী বিলেত থেকে ফিরে তিনি স্বাধীন ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা স্থাপনে উদ্যোগী হন। জলঙ্গী নদী তীরবর্তী পল্লী মহেশগঞ্জে বাবা মহেশ পালচৌধুরীর নামে সুরম্য অট্টালিকা, বাসনের ফ্যাক্টরি ও ‘নদীয়া ট্যানারি’ নামে জুতার কারখানা স্থাপন করেন। এত বড় জমিদার ও উদ্যোগপতি হয়েও তারা দুভাই নিজ এলাকার রায়ত-প্রজা ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ও সম্পর্ক রেখেছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে তাদের উত্তরসূরিরা বাধ্য হয়ে নাটুদহের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। নাটুদহের জমিদারি, অট্টালিকা, পুকুরঘাট ফেলে কলকাতায় স্থায়ীভাবে থিতু হন। মেহেরপুরের দাপুটে জমিদার মুখার্জি ও মল্লিক জমিদারদের পরিবারবর্গও দেশত্যাগ করেন। মুখার্জি জমিদাররা জাঁকজমকের সাথে দুর্গোৎসব উদযাপন করতেন, পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতেন শিল্পসাহিত্য, গানবাজনায়। মল্লিক পরিবারের রমণীমোহন মল্লিক ছিলেন বৈষ্ণব সাহিত্যে পণ্ডিত। শ্রীকৃষ্ণ মল্লিক ছিলেন আমোদ প্রিয়, মজলিসি স্বভাবের মানুষ। তাঁর উদ্যোগে গড়পুকুর প্রাঙ্গণে মহাসমারোহে বসত বাসন্তী মেলা। দেশভাগের পর মল্লিক বংশের সর্বশেষ জমিদার ললিতমোহন মল্লিক ভিটেমাটি ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। ললিতমোহন মল্লিকের বাসভবন ও গুপ্তিবাড়ির মন্দির দেশভাগের স্মৃতি বহন করে চলেছে। দেশভাগ এবং পরবর্তী বৈরী রাজনীতির প্রতিক্রিয়ায় মেহেরপুরের কয়েকশত বছরের গৌরবময় ঐতিহ্য এলোমেলো হয়ে যায়।
এত কিছুর পরও মেহেরপুরের বসু পরিবার দেশত্যাগ করেননি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহ্যবাসী বসু পরিবারের অবদান অপরিসীম, এই পরিবারের সন্তান প্রসেনজিৎ বসু বাবুয়া ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীন বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘জল্লাদের দরবারে’ নাটকে তিনি লারকানার নবাব চরিত্রে অভিনয় করেন শব্দসৈনিক হিসেবে। টঙ্ক বিদ্রোহের নায়ক মণি সিং, কমিউনিস্ট নেতা অমল সেন, তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রও দেশত্যাগ করেননি। তবে পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কারণে ইলা মিত্র দেশত্যাগে বাধ্য হন। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের সংগঠক চট্টগ্রামের পুলিন দে, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা দেশত্যাগ করেননি, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য নিপীড়ন সয়েছেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দুজনই শহীদ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দার্শনিক গোবিন্দচন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমরেন্দ্রনাথ পোদ্দার মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে জীবনদান করেন। সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত এমন বহু উচ্চবর্ণের হিন্দু দেশভাগের পরও পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয়তা অব্যাহত রাখেন। র্যাডিক্যালপন্থী রাজনৈতিক কর্মী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন: ‘আমি দেশ ছাড়বো না। আমি পাকিস্তানেই রয়ে যাব। পাকিস্তানের জনগণের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে থেকে যাব। এই দেশ, এই পূর্ব বাংলা তো আমারই দেশ— কেন আমি এই দেশ ত্যাগ করব?’১১ ত্রৈলোক্যনাথের মতো বহু রাজনৈতিক কর্মী পাকিস্তানে থেকে যান। এই মনোভাবের জন্য পরবর্তীতে তাঁদের ওপর নেমে আসে নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় খড়গ ও নিপীড়ন, অনেককেই পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন কারাগারে দীর্ঘ ও দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, অনেকেই দেশত্যাগ করেন, অনেকেই কারাগারে মৃত্যুমুখে পতিত হন।
চার
পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের দেশত্যাগ, তাদের দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে প্রচুর গল্প-কবিতা-উপন্যাস রচিত হয়েছে, সেই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের দেশত্যাগ নিয়ে উল্লেখ করার মতো তেমন লেখালেখি হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের স্বপ্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীরাও এ বিষয়ে আগ্রহী হননি। এজন্য শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নিম্নবর্গের ইতিহাস-রচয়িতা দীপেশ চক্রবর্তী আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘পৃথিবীর বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ মুসলমান। কিন্তু বাঙালির ইতিহাস-গবেষণার গরিষ্ঠ অংশ বাঙালি হিন্দু ইতিহাসবিদদের হাতে রচিত হয়েছে। সে ইতিহাসে বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর নিজস্ব জীবনাচরণ, সংস্কৃতি ও আকাঙ্ক্ষার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বেশি জায়গা পায়নি।’১২ দেশবিভাগের ফলে বাঙালি মুসলমান বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব বাংলায় আগত ‘রিফ্যুজি মুসলমান’-দের যৌথ স্মৃতি, মনস্তত্ত্ব, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কোনও গবেষণা হয়নি। আহমদ ছফা ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ নামে একটি অসাধারণ গ্রন্থ রচনা করেছেন, কিন্তু সেখানে ঐতিহাসিক ঘটনাবলির নিরিখে বাঙালি মুসলমানের মন ও মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা হয়নি বা করতে পারেননি। নানা সূত্র থেকে জানা যায়, কলকাতা, হুগলি, বর্ধমান, বাঁকুড়া, মেদিনীপুরের বর্ণহিন্দুরা বাংলাকে ভাগ করতে চেয়েছিলেন। আমার প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা কি বাংলা ভাগ চেয়েছিলেন? ‘বাংলা ভাগের জন্য তারা কতটুকু দায়ী? এটা নিয়ে উল্লেখ করার মতো কোনো গবেষণা হয়নি। অথচ দেশভাগের জন্য মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে দায়ী করা হয়। দেশভাগ তথা বাংলা ভাগের জন্য বাঙালি মুসলমানরা কী সত্যিই দায়ী? জয়া চ্যাটার্জির ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’ গ্রন্থে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের জন্য ‘দুই সম্প্রদায়ের কোন অংশকেই দায়ী করা হয়নি।’ তবে ‘ভারত বা বাংলার বিভক্তি মুসলমানদের কাজ— হিন্দুরা তাদের মাতৃভূমির অখণ্ডতাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করতে কোনো কিছুই করেনি’— এই প্রচলিত ধারণাকে খারিজ করে দিয়েছেন।১৩ তিনি তাঁর গবেষণায়, বাংলা বিভাগের জন্য অভিজাত মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি এবং বর্ণহিন্দুদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও তৎপরতাকে সমানভাবে দায়ী করেছেন। বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত বাবু তথা ভদ্রলোকদের প্রতিনিধিত্বকারী কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভাকে তিনি ইতিহাসের কাঠগড়ায় আসামি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। এ কথা অতিশায়িত হবে না যে, বাংলায় হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা তথা হিন্দুত্ববাদের অ্যান্টি থিসিস হিসেবে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার উত্থান ঘটে। হিন্দুত্ববাদীদের উসকানিতে দেশভাগ হয়। দেশভাগ ও পাকিস্তান সৃষ্টি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে বয়ান থেকেও এ যুক্তির পক্ষে সমর্থন মেলে। ১৯৬৬ সালে ২ জুলাই কারাগারে বসে তিনি যে কথা বলেছেন তাতে ভিন্ন রকমের ইতিহাসের গন্ধ পাওয়া যায়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে কংগ্রেসের ভূমিকা ও মনোভাব ব্যাখ্যা করে তিনি বলতে চেয়েছেন, দেশভাগের জন্য মুসলিম লীগ ও জিন্নাহ’র চেয়ে বর্ণহিন্দু পরিচালিত কংগ্রেস বেশি দায়ী। তিনি বলেছেন, ‘‘ভারতের মুসলমানরা যখনই তাদের অধিকারের জন্য দাবি করেছে তখন বর্ণহিন্দু পরিচালিত কংগ্রেস তার বিরুদ্ধাচারণ করে বলেছে, ‘মুসলমানরা স্বাধীনতা চায় না।’ মুসলমানরা ফেডারেল ফর্মের সরকার দাবি করেছিল, কিন্তু কংগ্রেস এককেন্দ্রিক সরকার গঠনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগল।— যার ফলে ভারতবর্ষ দুই দেশে ভাগ হয়েছে।’’১৪
দেশভাগের পর মুসলমান সম্প্রদায়ের একটি অংশকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসতে হয়, তবে এর চেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলমান পশ্চিমবঙ্গে থেকে যান। ‘১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপরই মোট ৫০ লাখ মুসলমান জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মুসলিম পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করে, তাহলে দেখা যায়, একজন মুসলিম দেশত্যাগ করলে চারজনের বেশি মুসলিম থেকে যায়।’১৫ ১৯৬১ সালের পাকিস্তানের আদমসুমারিতে দেখা যায়, পূর্ববঙ্গে ৮ লাখ ৫০ হাজার লোক ছিল ভারত থেকে আগত অ-পাকিস্তানি। দেশভাগের পর প্রায় দুদশক ধরে দেশত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। এই দুই দশকে ‘কম করে হিসাব করা হলেও দেখা যায়, সম্ভবত ১৫ লাখ মুসলিম পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে চলে আসে।’১৬ অপরদিকে পূর্ববঙ্গের লাখ লাখ হিন্দু ভিটেমাটি ছেড়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ এবং দণ্ডকারণ্যে পাড়ি জমায়। পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের দেশত্যাগ আর পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের সীমান্ত অতিক্রম কোনওভাবেই আলাদা ঘটনা হিসেবে আলোচনা করার সুযোগ নেই। তবে পশ্চিমবঙ্গের যে মুসলমানরা দেশত্যাগ করেন তারা আড়াই দশক ধরে করেছেন, কখনও স্বল্প সংখ্যায়, কখনও অধিক সংখ্যায়। তৎকালীন বৈরী ও বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে যে সকল মুসলমান টিকতে পারেননি কিংবা যারা ভারতের মূলধারার রাজনীতি তথা জাতীয় কংগ্রেস কিংবা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলের রাজনীতির সঙ্গে একাত্ম হতে পারেননি তাদেরই দেশত্যাগ করতে হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলমান দেশান্তরী হয় নদীয়া ও কলকাতা থেকে।
১৯৫৬ সালে ‘পয়গাম’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ‘নদীয়া জেলার ৬০ হাজার মুসলিম পরিবারকে জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতি পরিবারে ৪ জন সদস্য ধরা হলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৪০ হাজার।’১৭ কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের রসায়নের অধ্যাপক আতিয়ার রহমান, মেহেরপুর সরকারি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক কমরুদ্দীন খান, চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, সত্তর দশকে নদীয়া থেকে তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের কুষ্টিয়া জেলায় চলে আসেন চাকুরির আশায়। মেহেরপুর সরকারি কলেজের শিক্ষক আলতাব আলি মল্লিক ও মোয়াজ্জেম হোসেন ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়াশোনা করেন নদীয়া জেলার বিভিন্ন কলেজে।’১৮ সীমান্তবর্তী জেলা দিনাজপুর, মালদা, জলপাইগুড়ি, ২৪ পরগনা, কোচবিহার থেকেও বিপুল সংখ্যক মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদদের পরিবার কোচবিহার থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। মো. মাহবুবুর রহমান ও উইলেম ভ্যান সান্ডেল দেখিয়েছেন, ‘অনেক মুসলিম তাদের পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে জীবনে উন্নতি করার জন্য চলে যাওয়া বলে মনে করে, তবে তারা উদ্বাস্তু মর্যাদা গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে।’১৯ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল মুর্শিদাবাদ জেলা। মুর্শিদাবাদের মুসলমান সম্প্রদায় দেশে থাকার প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। কিন্তু নদীয়া জেলা থেকে বিপুলসংখ্যক মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে পালিয়ে আসেন। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা, আইন ব্যবসা করতেন কলকাতায়। কৃষ্ণনগরের এই সম্ভ্রান্ত পরিবারটি দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ডা. বিধানচন্দ্র রায় ও অতুল্য ঘোষের আহ্বানে মালদা মুর্শিদাবাদ দিনাজপুরের সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলমানরা দলে দলে কংগ্রেসে যোগদান করে। কিন্তু নদীয়ায় সেই ধরনের পরিস্থিতি ছিল না, কংগ্রেসের পুরনো হিন্দু সদস্যরা মুসলমানদের কংগ্রেসে সহযোদ্ধা হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। কারণ নদীয়ার অধিকাংশ মুসলমান ছিলেন মুসলিম লীগের সমর্থক, কংগ্রেস ঘেঁষা ‘জাতীয়তাবাদী মুসলমানের’ সংখ্যা ছিল খুবই কম। ১৯৪৬ সালের বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচনে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গার মুসলমানরা মুসলিম লীগকে ভোট দেয় এবং জয়লাভ করেন মুসলিম লীগের প্রার্থী শামসউদ্দিন আহমদ, ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক, অ্যাডভোকেট আবদুল হান্নান। ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় আইনসভার নির্বাচনেও অধিকাংশ আসনে মুসলিম লীগ প্রার্থীরা জয়ী হন, মেহেরপুর আসন থেকে জয়লাভ করেন মুসলিম লীগের মহসিন উকিল। তিনি ছিলেন নদীয়ার তেহট্ট থানার অধিবাসী, দেশভাগের পর সপরিবার মেহেরপুরে চলে আসেন। মেহেরপুরের তিন সাবেক সংসদ সদস্য মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছহিউদ্দীন বিশ্বাস, ভাষাসংগ্রামী আহাম্মদ আলী ও প্রফেসর আবদুল মান্নান ছিলেন নদীয়ার অধিবাসী। দেশভাগের পর এঁরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মেহেরপুরে চলে আসেন। সাম্প্রদায়িক কারণ ছাড়াও চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতিতে সাফল্য অর্জন, আত্মীয়-স্বজনদের অনুরোধ-উপরোধেও এঁরা দেশত্যাগ করেন।
পাঁচ
দেশভাগ-দেশত্যাগের ঘটনাবলিকে অনেকে সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগ দিয়ে বিশ্লেষণ করতে চান, এতে করে সত্যের অপলাপ হয়। বাংলার সামাজিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এখানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের যেমন উদাহরণ আছে, তেমনই হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থানের ঐতিহ্যও রয়েছে ভূরিভূরি। খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সুমিত সরকার তাঁর ‘মডার্ন ইন্ডিয়া: ১৮৮৫-১৯৪৭’-এ বলেছেন, খিলাফত আন্দোলনের সময় ‘মুসলিম নেতারা গো-কুরবানি বন্ধ করার জন্য মুসলমান সমাজের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। ফলে গো-কুরবানি বন্ধ হয়েছিল সেই সময়।’ মীর মশাররফ হোসেন গো-কুরবানি চাইতেন না। বিরূপ বৈরী পরিবেশে সে ঐতিহ্য অমলিন রাখতে চেষ্টা করেছেন মুসলমান সমাজের বিরাট একটি অংশ। দ্বন্দ্ব-দাঙ্গা, সংঘাত-ক্ষুব্ধতা ও টানাপোড়েনের মধ্যেও মানুষ একসঙ্গে থাকতে চেয়েছে, আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। মুসলমানদের অনেকেই পাকিস্তান চাননি, পাকিস্তান-প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। জিন্নাহ পাকিস্তান চাইলেও মওলানা আবুল কালাম আজাদ পাকিস্তান চাননি। তিনি পাকিস্তান প্রস্তাবের পূর্ণ বিরোধিতা করেন, এমনকি বাংলা বিভাগের বিরোধিতা করেছেন। বাংলার মুসলমান সমাজের আপসহীন নেতা কলকাতার সাবেক মেয়র সৈয়দ বদরুদ্দোজা দেশভাগের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দি, আবুল হাশিমসহ (এমনকি স্বীয় কন্যা ব্যারিস্টার রাজিয়া ফয়েজ) প্রথিতযশা মুসলিম নেতারা কলকাতা ছেড়ে পাকিস্তানে পাড়ি চলে জমালেও তিনি পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করেননি। পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নিজ দেশে স্থায়ীভাবে থিতু হয়ে যান। মুর্শিদাবাদে জন্ম নেয়া এই নেতা একাধিকবার লোকসভা ও বিধানসভার সদস্য ছিলেন। এমন ভূরিভূরি উদাহরণ দেয়া যাবে যাঁরা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেশত্যাগ করেননি। মালদার প্রভাবশালী জমিদার খান বাহাদুর আবু হায়াত বি. খান চৌধুরী নিজ এলাকা ত্যাগ করেননি। তাঁর ছেলে আবু বরকত গণি খান চৌধুরী ছিলেন কংগ্রেসের সাংসদ এবং রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য। গণি খান চৌধুরীর ভাই আবু হাশেম খান চৌধুরী, আবু নাসের খান চৌধুরী, বোন রুবি নূর-ও লোকসভা ও বিধানসভার সদস্য ছিলেন। যেসব মুসলমান নেতা দেশভাগের বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে কংগ্রেস নেতা আব্দুস সাত্তার অন্যতম। তিনি বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রিসভার শ্রমমন্ত্রী ছিলেন, তিনি দেশত্যাগ করেননি। তারপরও সুরক্ষার অভাব ও আতঙ্কে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ শিক্ষিত, সম্পন্ন ও সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবার দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ওপারে থেকে যান মুসলমান সমাজের সেই অংশটি যারা ছিলেন নিরক্ষর গরিব কৃষক। এরা অধিকাংশই গ্রামে বসবাস করেন। আর্থিক নিরাপত্তা, রুটি-রুজির কথা চিন্তা করে এরা মাতৃভূমি ত্যাগ করেনি। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গের উঁচু জাতের ব্রাহ্মণ-কায়স্থসহ বর্ণহিন্দুরা দেশত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গ অভিমুখী হলেও দলিত-তফসিলিরা দেশত্যাগ করতে চাননি পঞ্চাশ সাল নাগাদ। আসলে ১৯৪৭ সালের পূর্বাপর ঘটনাবলিকে সাম্প্রদায়িকতার বিকট দুর্গন্ধে ভরা ‘হিন্দু বনাম মুসলমান’ দৃশ্যপটরূপে অতিসরলীকৃত করলে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুধাবনে বিভ্রান্তি বাড়বে। মুসলিম লীগ নেতা পশ্চিমবঙ্গ আইনসভার বিরোধী দলীয় নেতা আবুল হাশিম বর্ধমান ছাড়তে চাননি, অপরপক্ষে কংগ্রেস নেতা কিরণশঙ্কর রায় দেশভাগের পর ছয় মাস পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন। অস্বাভাবিক সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৫১ সালে আবুল হাশিম পশ্চিমবঙ্গের আইনসভার সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দেন। তাঁর ছেলে লেখক-রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর বাবার দেশত্যাগের সিদ্ধান্তকে ভুল হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন এক সাক্ষাৎকারে। দেশভাগের নিয়ে তথাকথিত উচ্চগর্বী মুসলমান ও সংকীর্ণতাবাদী বর্ণহিন্দুদের মধ্যে যতটা মাতামাতি ও উচ্ছ্বাস ছিল, ততটা ছিল না আমজনতার মধ্যে। নিম্নবর্গীয় মানুষ দেশভাগ নিয়ে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেননি এবং এ প্রক্রিয়ার সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন না, যদিও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দরিদ্র মুসলমানের মতো দলিত হিন্দুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মালদার গ্রামাঞ্চলের নিরক্ষর মুসলমানরা আজও দেশভাগ সম্পর্কে কিছুই জানেন না, অপরদিকে বাংলাদেশের দলিত শ্রেণিও ভারতের প্রতি তেমন আগ্রহ অনুভব করেন না। বাংলার ইতিহাসের দিকে তাকালে বোঝা যায়, মর্যাদাচ্যুত অস্পৃশ্যরা কখনওই উঁচুজাতের হিন্দুদের কাছে ঘেঁষতে পারেনি, বরং দরিদ্র মুসলমানদেরই তারা আপন ভেবেছে। অস্পৃশ্য বিশেষ করে, নমঃশূদ্ররা মনে করতেন, দরিদ্র মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে অস্পৃশ্য হিন্দুদের অর্থনৈতিক স্বার্থের মিল রয়েছে। কারণ গরিব কৃষক মুসলমানদের মতো তারাও চাষকাজ করেন, জনখেটে, মাছ ধরে, জাল বুনে জীবিকা নির্বাহ করেন।
১৯০৫ সালে উচ্চ ও মধ্যশ্রেণির হিন্দুদের নেতৃত্বে যে স্বদেশি আন্দোলন সংগঠিত হয়, সেই আন্দোলনে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের মতো দলিত হিন্দুরা শরিক হননি। ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্গীয় হিন্দুদের নেতৃত্বে পরিচালিত বঙ্গভঙ্গবিরোধী তথা উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে যখন বিলেতি পণ্য বর্জন এবং স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণের আহবান জানানো হয় তখন দলিত ও মুসলমানরা তাতে সাড়া দেননি। উচ্চবর্গের ‘হেজিমনি’ তারা মেনে নেননি বরং ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক নীতি অনুসরণ করে পাল্টা-সংস্কৃতি বা হেজিমনি নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতা ব্রজেন্দ্রনাথ মণ্ডল বঙ্গভঙ্গের জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। ১৯০৮ সালের মার্চে, খুলনায় সভা ডেকে নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ভয়মুক্তভাবে ব্রিটিশ পণ্য কেনার অধিকার চেয়েছে। স্পষ্টতই এসব ছিল ‘স্বদেশি চেতনা’-র প্রত্যাখ্যান।২০ তাদের কাছে এরূপ আন্দোলনের কোনও প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। দেশভাগের প্রশ্নেও তারা আগ্রহ দেখাননি, বরং বিরোধিতা করেছেন। অথচ দেশভাগ-পরবর্তী কালে নিম্নবর্গের হিন্দুরাই দুর্দশা ও নিগ্রহের শিকার হয়েছেন ভয়ানকভাবে।
বরিশাল নিবাসী লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী তাঁর ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’ বইয়ে লিখেছেন, ‘‘আমার বাবার মোটেই দেশত্যাগ করে আসবার ইচ্ছা ছিল না। মায়ের মুখে শুনেছি মুসলমানদের সাথে তার বেশ সুসম্পর্কই ছিল। তারা বাবাকে দেশে থেকে যেতে অনুরোধ করেছিল, ‘থাহো তুমি, দেহি কোন হালায় তোমার কী ছেড়ে।’ কিন্তু বাবা তাদের অনুরোধ রাখতে পারেননি।”২১ উচ্চবর্গীয় ও কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হিন্দু পরিবার দেশত্যাগ করলেও বাংলার বৃহত্তর কৃষিজীবী নিম্নবর্গীয় হিন্দুরা দেশ ছাড়তে চাননি। মুসলিম ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের কাঠামোকে প্রত্যাখ্যান করে দলিত নেতা যোগেন মণ্ডল পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ‘দাঙ্গার দিনগুলিতে তিনি বাংলার নিম্নবর্গীয় মানুষদের দাঙ্গা থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করেছিলেন এই বলে যে, এই সংঘাত হল পুরোদস্তুর শাসক এলিটদের শক্তি দুষ্টফল, এতে অংশ নিয়ে নিম্নবর্গের কোনো লাভ নেই।’২২ মুসলিম লীগের চার নেতাসহ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, রসিকলাল বিশ্বাস, ভোলানাথ বিশ্বাস ও দ্বারিকানাথ বারুই স্বাক্ষরিত একটি দাঙ্গাবিরোধী লিফলেটও বিতরণ করা হয়। তাতে যে বার্তা দেওয়া হয় তার মূল সুর হল:
‘শূদ্রের স্বাভাবিক আত্মীয়তা মুসলমানদের সঙ্গে। শূদ্র ও মুসলমানদের দুঃখ-কষ্ট, আয়-ব্যয়, চাষ-আবাদ, মাছ ধরা, নৌকা চালানো, সুখ-অসুখ, চেঁচামেচি, ডাকাডাকি, অসুখ-বিসুখ, টোটকা-টুটকি— সবই এক রকম। তাহলে কোথাও হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাঁধলেই শূদ্ররা গিয়ে, বামুন-কায়েতদের লেঠেল হবে কেন?’২৩ যোগেন মণ্ডলের আহ্বান সত্ত্বেও কলকাতার দাঙ্গায় দলিত-নমঃশূদ্ররা অংশ নিয়ে মুসলমানদের মতোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যোগেন মণ্ডলদের আহ্বান সেদিন পরাস্ত হয়েছিল দাঙ্গাবাজদের রাজনৈতিক উন্মত্ততার কাছে। জয়ী হয় বিভাজনমূলক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধ্বজাধারীরা। ১৯৪৭ সালে সিলেট গণভোটের মাধ্যমে সিলেটকে যখন পাকিস্তানভুক্ত করা হয়, তাতে যোগেন মণ্ডলের প্রচারণা বিশেষ ভূমিকা রাখে। এই প্রচারণায় সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রসূন কান্তি-বরুণ রায়, নিকুঞ্জ বিহারী গোস্বামী প্রমুখ। সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন। রণদাপ্রসাদ সাহাও মুসলিম লীগের কুড়াল মার্কার পক্ষে সহায়তা প্রদান করেন। ইতিহাসের কৌতুক এই যে, যোগেন মণ্ডলরা যখন সিলেটকে পাকিস্তানভুক্তির পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন তখন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ নেতা মওলানা হোসেন আহমদ মাদানিসহ বেশকিছু মওলানা সিলেটকে ভারতভুক্তির পক্ষে প্রচার চালান। এই গণভোটে মুসলিম লীগের কুড়াল জয়ী হয়, হেরে যায় কংগ্রেসের কুঁড়েঘর। কুড়ালের পক্ষে স্থানীয় তফসিলিরা ভোট দিয়েছিল, লক্ষণীয় বিষয় হল ১৯৪৭-এর জুলাইয়ের গণভোট শেষে কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর অনেক হিন্দু পরিবার দেশত্যাগ করেছিল, ‘কিন্তু এমন উদাহরণও বিপুল যে প্রগতিশীল হিন্দুধর্মাবলম্বীরা অনেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও মাতৃভূমিতে থেকে যাওয়ার প্রশ্নে দৃঢ় ছিলেন এবং এ বিষয়ে সিলেটজুড়ে প্রচার চালিয়েছিলেন।’২৪ সিলেটে গণভোট ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বিপুল অবদান রাখা সত্ত্বেও একদল দক্ষিণপন্থী আমলা যোগেন মণ্ডলসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন নমঃশূদ্রদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। হতাশাজনক ও বেদনাময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে তৎকালীন আইনমন্ত্রী যোগেন মণ্ডল দেশত্যাগ করেন। দেশত্যাগের পূর্বমুহূর্তে আবেগতাড়িত হয়ে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান, হিন্দুদের জন্য অভিশাপ।’
তবে ভিন্ন কথা বলেছিলেন, নোয়াখালীর গান্ধীবাদী নেতা সতীশ দাশগুপ্ত। তিনি দিল্লিতে এসে ভারত সরকারকে বলেছিলেন, হিন্দুদের দেশত্যাগের কোনও সঙ্গত কারণ নেই। কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলমানের সদ্ভাব নষ্ট হয়নি। বেশিরভাগই ভয়ে দেশ ছেড়েছেন।২৫ গান্ধীবাদী সতীশবাবুরা যাই বলুন কেন, বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের যে মারাত্মক অবনতি ঘটে তা বলাই বাহুল্য। সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের অবনতি ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ‘১৯৪৭ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে কমপক্ষে ষাট লাখ হিন্দু উদ্বাস্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে।— উদ্বাস্তু আগমনের ফলে পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ভেঙে পড়েছিল।’ পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের গমন ছিল ব্যাপক। সেই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে বেশ কম। চার ভাগের তিন ভাগ মুসলমানই পশ্চিমবঙ্গে থেকে যায়।২৬
তবুও মর্যদাহানির আশঙ্কা, নিরাপত্তা ও সংখ্যালঘু হবার ভয়ে কলকাতা, নদীয়া থেকে বিপুল সংখ্যক মুসলমান দেশত্যাগ করেন।
ছয়
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা কেন দেশ ছেড়েছিলেন, দেশত্যাগীরা পূর্ব পাকিস্তানের সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে কেমন প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, এ নিয়ে তেমন কোনও গবেষণা হয়নি। ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত মুসলমানদের ভূমিকা কেমন ছিল, এ নিয়ে তেমন কোনও সৃজনশীল বা মননশীল ধারার লেখাজোকা হয়নি। দেশভাগ নিয়ে প্রচলিত আখ্যানের বাইরেও যে হাজারো আখ্যান থাকতে পারে সেটা দেশভাগের পৌনে একশো বছর পরেও আমলে নেয়া হয়নি, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তানগামী মুসলমানদের বিষয়টি একেবারেই চিন্তা করা হয় না। স্বল্পসংখ্যক মুসলমান সাহিত্যিক দেশভাগ সম্পর্কে কলম ধরেছেন বা ধরতে চান। সাধারণ রিফ্যুজিরা নিজের আদি গ্রাম বা জেলা সম্পর্কে মুখ খুললেও পূর্ব পাকিস্তানে আগত মুসলমান লেখকরা ভারতে তাঁদের নিজ ‘দেশ’ সম্পর্কে মুখ খুলতে দ্বিধাবোধ করেন। এক্ষেত্রে বদরুদ্দীন উমর ব্যতিক্রমী, তিনি তাঁর ‘আমার জীবন’ গ্রন্থে অকপটে স্বীকার করেছেন বর্ধমান জীবনের স্মৃতি, যেসব আত্মীয়-স্বজন দেশভাগের পর পাকিস্তানে আসেননি, পশ্চিমবঙ্গীয় রাজনীতিতে তাঁদের অবস্থান সম্পর্কেও খোলামেলা আলোচনা করেছেন। কিন্তু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান, কথাশিল্পী শওকত ওসমান, শিল্পী আব্বাসউদ্দীন, আনিসুজ্জামান, জাহানারা ইমামদের মতো খ্যাতিমানরা পশ্চিমবঙ্গে ফেলে আসা জীবনের কথা সাক্ষাৎকারে বা স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। তবে শওকত ওসমান, হাসান আজিজুল হক, বুলবন ওসমান, হাসান ইমামের লেখা ও স্মৃতিচারণায় এবং সাক্ষাৎকারে পশ্চিমবঙ্গীয় জীবনের গন্ধ তীব্রভাবে অনুভব করা যায়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান উপদেষ্টা, গবেষক, লেখক, সংস্কৃতিসেবীদের মধ্যে অনেকের জন্ম, শৈশব কৈশোর জীবন ও প্রথম যৌবন কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে, পড়াশোনা করেছেন কলকাতায় কিংবা পেশাগত সূত্রে অবস্থান করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শহরে, অথচ ভারতে তাঁদের নিজ এলাকা সম্পর্কে মুখ খোলেননি। পাকিস্তানি জমানায় ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি আত্মপরিচয় বিনির্মাণের সংগ্রামেও এঁরা সাহসী ভূমিকা পালন করেন। এক্ষেত্রে ড. মহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কুদরত ই খুদা, মাহবুব মুর্শেদ-এর নাম অগ্রগণ্য। তানভীর মোকাম্মেল দেশত্যাগী হিন্দু ও বিহারি মুসলমানদের নিয়ে ছবি বানিয়েছেন, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত মুসলমানদের জীবনযাপন, রুচি মূল্যবোধ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কোনও ছবি বানাননি বা বানাতে পারেননি। কেন পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা ভিটেমাটি, জমিজিরাত, গোরু-বাছুর ফেলে গণপ্রব্রাজনের মিছিলে সামিলে হলেন? ম্যালেরিয়া-কলেরা-মহামারী-রাষ্ট্রীয় রোষানলের শিকার কী শুধু পূর্ববঙ্গের হিন্দুরাই হয়েছিলেন? পূর্ব পাকিস্তানগামী মুসলমানরাও কী নিপীড়নের শিকার হননি? এসব বিষয় নিয়ে উল্লেখ করার মতো সাহিত্য বা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। ফলে মুসমানদের উদ্বাস্তু জীবনের কাহিনিটা একেবারেই অজানা রয়ে গেছে।
তবে টেটসুয়া নাকাতানির ‘দ্য স্ট্র্যাটেজি অব মুভমেন্ট আ্যান্ড সেটেলমেন্ট অব রিফিউজিস ফ্রম ইস্ট পাকিস্তান টু ওয়েস্ট বেঙ্গল’ বইয়ের সূত্র ধরে বলা যায়, নিকট ও দূর সম্পর্কীয়দের আশ্রয়-সহযোগিতা, স্ব-ধর্মীদের সান্নিধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রাপ্তির স্বপ্ন, চাকরি বা বাণিজ্যের আশায় পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা পূর্ববঙ্গে চলে আসে। আমাদের পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আক্রান্ত হবার ভয়ে, যদিও তারা আক্রান্ত হননি। সামাজিক প্রতিষ্ঠা, চাকরি-বাকরি, সম্পত্তি বিনিময় ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের শিক্ষার ভাবনাটা তাদের মাথায় কাজ করেছে বাসভূমি হিসেবে পাকিস্তানকে বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে। ভীতিমূলক ও সাম্প্রদায়িক প্রচারণার শিকার হয়ে অবিভক্ত বাংলার ১৯ জন মুসলিম আইসিএস অফিসারের মধ্যে একজন বাদে সবাই পাকিস্তানে চলে আসেন। গুজবের ফাঁদে পড়ে অফিসারদের অনুসরণ করে সাধারণ কর্মচারী বিশেষ করে, আরদালি, পিয়ন, কেরানি, প্রহরী ও পুলিশ কনস্টেবলরাও দেশত্যাগ করেন বা করতে বাধ্য হন।২৭ অনেকে ‘মুসলিম আত্মপরিচয়’-এর ঠিকানা সন্ধান করতে গিয়ে দেশে ছেড়ে ‘ইসলামি স্বদেশ পাকিস্তান’-এর পথে পা বাড়ান। বিহারি মুসলমানরা পাকিস্তানে আসে প্রলোভনে পড়ে এবং মুসলমান হিসেবে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির আশায়। কলকাতার অভিজাত মুসলমানদের অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাঁরা দেশত্যাগ করেন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিকে সহায়তা করার জন্য।
অবশ্য এক সাক্ষাৎকারে পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ দেশভাগের ইতিবাচক দিকটাই বেশি করে তুলে ধরেছেন, ‘ওপারের পুঁজি, মেধা এলো এপারে। পূর্ববঙ্গীয় হিন্দুরা খুবই গতিশীল। এখানকার ঘটিদের মধ্যকার জাড্য কাটলো। পূর্ববঙ্গীয়রা এখানে অনেক স্কুল খুললেন। মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে জোর দিলেন। যাত্রা, থিয়েটারে মেয়েদের বেশি করে পাওয়া যেতে লাগল।— এবং এপারের মুসলমানরা ওপারের মুসলমান সমাজকে সমৃদ্ধ করলো। বড়ো বড়ো খবরের কাগজের ব্যবসা সবই তো চলে গেল। তবে এটা সত্যি, এপারের মুসলমান সমাজ বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। একইভাবে ওপারের হিন্দুরা।’২৮ সত্যি বলতে কী, দেশভাগের পর রিফ্যুজি মুসলমানদের মাধ্যমেই পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা সংস্কৃতি ক্ষেত্রে জোয়ার আসে। রবীন্দ্রচর্চা, বাঙালি সংস্কৃতির প্রগতিশীল বিকাশ ও উজ্জীবনে তাঁদের অবদান অপরিসীম। হাইস্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা থেকে আগত মুসলমান লেখক ও সাংবাদিকদের মাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে নানা ধরনের পত্র-পত্রিকা। এতে করে বাঙালি মুসলমান সমাজে একটি শক্তিশালী লেখকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এঁদের প্রেরণা-পৃষ্ঠপোষকতায় পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব বাংলার বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি খুঁজে পায় আপন ঠিকানা।
অনেকেই মনে করেন, দেশভাগ বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাবালকত্বের জন্য প্রয়োজন ছিল। দেশভাগের ফলেই বাঙালি মুসলমান সমাজ শিক্ষাদীক্ষায়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, সত্যিই এই রক্তাক্ত দেশভাগ প্রয়োজন ছিল নাকি ছিল না? এ নিয়ে হয়তো হাজার পৃষ্ঠার উপন্যাস কিংবা গবেষণাপত্র রচনা করা যেতে পারে, তবুও তর্কের শেষ হবে না। তারপরও বলব, ইতিহাসের এক অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দেশভাগ হয়েছে। অনেক রক্তপাত, খুনোখুনি, অবিশ্বাস, একে অপরের প্রতি দোষারোপের মধ্য দিয়ে দুই বাংলা বিভক্ত হয়েছে। অবিভক্ত বঙ্গদেশের পূর্বাংশের মানুষ বাঙালি সত্তা নিয়ে বাঁচার জন্য মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ এখন দুটি ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিক, এটাই বাস্তব। তারপরও আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাইনি, ‘গঙ্গার জল পদ্মায় যায়, এপার থেকে ওপার ভাসায়/ মাটির দাগে ভিন্ন হলেও আমরা যে বাংলা ভাষায়।’ এখনও আমরা সভ্যতার, শিষ্টতার মান খুঁজতে বাঙালি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হই, আবেগমথিত হই লালন ও নজরুলের গানে। এখনও দুই বাংলার চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বরা জাতি-রাষ্ট্রের রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় আইনের কঠিন বাধ্যবাধকতা ও বাস্তবতা মেনে নিয়েই বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে সৌহার্দ্যসম্প্রীতির পরিসর সৃষ্টি করতে একসঙ্গে মিলিত হন কখনও প্রবাসে, কখনও ঢাকা-কলকাতার বইমেলায় অথবা সাংস্কৃতিক পার্বণে।
তথ্যসূত্র:
১. সাইমন জাকারিয়াকে দেয়া দীপেশ চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার, ভাবনগর, জুন ২০২২
২. উদ্ধৃত: সুধীর চক্রবর্তী, বাংলা ফিল্মের গান, রচনাবলি ৩। কলকাতা, মাঘ ১৪২০। পৃ: ৪৫৩
৩. প্রথম আলো, ৬ জানুয়ারি ২০২২
৪. সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: ‘তাল কেটে গেছে’, দেশ, ১৭ জুন ২০২২
৫. লিওনার্ড মোসলে: The Last Days of British Raj, P. 244-246
৬. বুদ্ধদেব ঘোষ ও দেবব্রত বিশ্বাস সম্পাদিত সাতচল্লিশের দেশভাগ। মইনুল হাসান: ‘দেশভাগ: আমরা-ওরা’। ঢাকা, জানুয়ারি ২০২১। পৃ. ৪৭৫
৭. ফোর্টনাইটলি রিপোর্টস অফ বর্ডার ইনসিডেন্ট ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল, ১৯৫০, ফাইল নং-১২৩৮, ৯-৪৭
৮. জাহিরুল হাসান: ‘সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ও বাঙালি সমাজ’। কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৮, পৃষ্ঠা: ১১৬
৯. সুধীন সেন: ‘আমাদের অভিজ্ঞতায় মুর্শিদাবাদ জেলায় কমিউনিস্ট আন্দোলন।’ ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, ২০০২। পৃ. ১১২
১০. রত্নলেখা রায়: দ্য চেঞ্জিং ফরচুনস অব দ্য বেঙ্গলি জেন্ট্রি আন্ডার কলোনিয়াল রুল— পালচৌধুরী অব মহেশগঞ্জ। মডার্ন এশিয়ান স্টাডিজ, খণ্ড ২১, ১৯৮৭। পৃ. ৫১৩-৫১৪
১১. উদ্ধৃত: আহমেদ কামাল: ‘দেশবিভাগের অভিজ্ঞতা ও জাতীয় ইতিহাস রচনার সমস্যা।’ প্রতিচিন্তা ৩ এপ্রিল ২০১৭
১২. প্রথম আলো, ৩ মার্চ ২০২৩
১৩. জয়া চ্যাটার্জি: ‘বাংলা ভাগ হল: হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও দেশভাগ’। ইউপিএল, ২০০৩। পৃষ্ঠা: মুখবন্ধ-১০
১৪. শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা: ১৪০-১৪২
১৫. জয়া চ্যাটার্জি: ‘দেশভাগের অর্জন: বাংলা ও ভারত ১৯৪৭-১৯৬৭।’ ঢাকা, মে ২০২২, পৃ. ২২৯
১৬. জয়া চ্যাটার্জি: প্রাগুক্ত
১৭. পয়গাম, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬
১৮. নিজের উদ্যোগে পরিচালিত সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত
১৯. রিথিংকিং পার্টিশন মাইগ্রেশন, মডার্ন এশিয়ান স্টাডিজ, ৩৭, ৩ (২০০৩)
২০. Caste System, Untouchability and the Depressed, edited H Monohor Kotani, New Delhi, 1997, P. 231-2
২১. মনোরঞ্জন ব্যাপারী: ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডল জীবন’। কলকাতা, বৈশাখ ১৪২৩, পৃ: ২৬
২২. আলতাফ পারভেজ: ‘যোগেন মণ্ডলের বহুজনবাদ ও দেশভাগ।’ প্রথমা প্রকাশন, জানুয়ারি, ২০১৯। পৃ: ৩৭
২৩. দেবেশ রায়: ‘১৬ আগস্টের জুয়ো, কে কার পার্টনার?’, বরিশালের যোগেন মণ্ডল। দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃ: ১০৩০
২৫. জহিরুল হাসান, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ও বাঙালি সমাজ। কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৮, পৃ. ১৪২
২৬. জয়া চ্যাটার্জি, দেশভাগের অর্জন: বাংলা ও ভারত ১৯৪৭-১৯৬৭। পৃ: ভূমিকা
২৭. জয়া চ্যাটার্জি, দেশভাগের অর্জন: বাংলা ও ভারত ১৯৪৭-১৯৬৭। পৃ: ২২০
২৮. সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, সাক্ষাৎকার, অক্টোবর- ডিসেম্বর ২০১১, পৃ. ১২৯