নাদিন গর্ডিমার
অনুবাদ: মানব সাধন বিশ্বাস
আমরা যখন শুনলাম সে মুক্তি পেয়েছে, আমি খামারের সর্বত্র পাগলপারা ছুটোছুটি শুরু করে দিলাম। বেড়ার ফাঁক দিয়ে জনে জনে সব্বাইকে ডেকে ডেকে খবরটা জানিয়ে দিলাম। খানিক পরেই দেখি তারের খোঁচায় আমার জামাটা ফেঁসে গেছে, কাঁধের দিকটায় রক্তের ছোপ।
আট বছর আগে সে আমাদের এই এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল। শহরের এক জায়গায় তার কাজ জুটল— যাকে ওরা কন্সট্রাকশন কোম্পানি বলে— সেখানে। সেখানে তারা আকাশছোঁয়া উঁচু উঁচু সব কাচের দেয়াল বানাত। প্রথম দুটো বছর ফি-মাসে একবার করে উইক-এন্ড আর ক্রিসমাসে দু-সপ্তাহের ছুটিতে আসত। ওই সময়েই সে আমাদের বিয়ের জন্যে বাবার কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল। তারপর থেকে সে টাকাপয়সা পাঠানো শুরু করল। আমরা দুজন ভেবেছিলাম, বছর-তিনেকের মধ্যে বিয়ের জন্যে প্রয়োজনীয় পয়সাকড়ি যোগাড় হয়ে যাবে। কিন্তু এরপর থেকেই সে টি-শার্ট গায়ে চড়াতে শুরু করল। এবার সে আমাদের জানাল— ইউনিয়নে নাম লিখিয়েছে। প্রায়ই স্ট্রাইক নিয়ে কথা বলত। ওদের কোম্পানির কিছু লোককে কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যারা কথাবার্তা চালাতে যায়, এখন সে তাদের একজন। সবসময়ই সে ভাল বলিয়ে-কইয়ে— ইংরেজিটাও দিব্বি আসে। এই কারণেই তাকে এসব করতে হল। আমাদের খামার স্কুলে সে সেরা ছাত্র ছিল। ইন্ডিয়ান দোকানের লোকেরা চিনি সাবান ইত্যাদি জিনিসপত্র কেনার সময় খবরের কাগজ দিয়ে মুড়ে দিত। মোড়কের সেই কাগজ সে পড়ে ফেলত।
শহরে যে হস্টেলের ঘরে সে শুত, একদিন সেখানে ভাড়া মেটানো নিয়ে তুমুল একচোট হাতাহাতি হয়ে গেল। সে আমাকে বলেছিল, ব্যাপারটা সে শুধু আমাকেই বলল, বয়স্কদের কাউকে কিছু জানায়নি। যে ব্যবহার ওরা আমাদের সঙ্গে করে থাকে, তার বিরুদ্ধে। সে খামারে হোক বা শহরে— সেখানেই তারা রুখে দাঁড়ায়। সে তাদের সঙ্গে থাকে, তাদের সঙ্গে একজোটে হাঁটে, বক্তৃতা করে। তৃতীয় বছরে আমরা জানতে পারলাম, বিয়েটা হচ্ছে না; সে জেলে গেল। বিচার শুরুর আগে পর্যন্ত বুঝতে পারিনি ঠিক কোথায় তার খোঁজ মিলবে। শহর থেকে অনেক দূরের এক জায়গায় মামলা শোনা হচ্ছিল। আমি তখন সদ্য আট ক্লাস পাশ করে খামারের স্কুলে কাজ শুরু করেছি। তাই যখন-তখন কোর্টে ছুটব, এমনটি হবার নয়। আর আমার বাবা-মায়ের পয়সার টানাটানি তো ছিলই। ভাইদের মধ্যে দুজন কাজের জন্যে শহরে চলে গেছে, তারাও বাড়িতে কিছু পাঠায় না। আমার মনে হচ্ছিল, হয়তো ওদের মেয়েবন্ধু জুটে গেছে, ওদের পেছনেই সব পয়সা ফুরিয়ে যায়। বাবা আর আর-এক ভাই আমাদের এখানকার এই বোওয়াদেরই চাষ-খামারে কাজ করে। তাদের আয় বড় কম। আমাদের দুটো ছাগল আছে, শুধু গোনাগুনতি কয়েকটা গোরু চরাতে পারি; আর-এক চিলতে জমিতে মা সবজি ফলায়— এর জন্যে কোনও পয়সা পায় না।
একদিন কোর্টে তাকে দেখতে পেলাম। পরনের নীল স্যুট, ডোরাকাটা জামা, বাদামি টাইয়ে তাকে বেশ লাগছিল। সে যাদের কমরেড বলেছিল, সেই অভিযুক্তরাও বেশ পরিপাটি পোশাকে এসেছিল। ইউনিয়ন তাদের ওই পোশাকের খরচ যুগিয়েছিল। জজসাহেব ও বিবাদিপক্ষের উকিলেরা পাছে ভেবে না বসে এই মক্কেলরা আকাট মূর্খ যো-হুজুরমার্কা পাতি কালা-আদমি— যারা তাদের অধিকারের বিন্দুবিসর্গও জানে না। তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পেয়ে যখন জেলে আসতাম, সে এই সমস্ত ব্যাপারস্যাপার এবং মামলার খুঁটিনাটি নিয়ে সবই আমাকে বুঝিয়ে দিত। মামলা যখন চলছে, তখনই আমাদের ছোট্ট মেয়েটার জন্ম। সেই প্রথমবার মেয়েকে কোলে নিয়ে কোর্টে হাজির হয়েছিলাম তাকে দেখানোর জন্যে। আসামির কাঠগড়ার বেড়ার ওপাশ থেকে তার সাথিরা বাচ্চাকে খুব আদর করল; তারপর আমাকেও। ওরা চাঁদা তুলে যোগাড় করা কিছু টাকাপয়সা এককাট্টা করে বাচ্চার উপহার হিসেবে আমার হাতে তুলে দিল। সে তার জন্যে নামও ঠিক করে রেখেছিল: ইংকুলুলেকো বা আজাদি।
তারপর মামলা একদিন শেষ হল। তার জেল হল ছ’বছর। তাকে দ্বীপান্তরে পাঠানো হল। ওই দ্বীপটার নাম আমরা আগেও শুনেছি। এতদিন শুনেছি, আমাদের নেতাদের ওখানেই চালান করা হত। স্কুলে থাকতে সমুদ্রকে নীল রং করতে হত। এ-বাদে আমি আগে কোনওদিন সমুদ্র চোখে দেখিনি; আর সেটা যে একখণ্ড জমিকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখে, তা কখনও ভাবিনি। আসলে তখন মাথায় ঘুরত বড়জোর চলমান গোরুমোষের তাজা একতাল গোবরের কথা যেটা বৃষ্টির জমা জলের ওপর দিয়ে ভাসতে থাকত। আরশির কাচের মত সেই জলে সেই নীল রঙা আকাশ দেখতে পেতাম। ভাবতে ভাবতে লজ্জাও পেতাম। সেই আমায় বলেছিল, কাচও নীল হয় কেমন করে। সে বলত, সচল ক্রেন তাদের নিয়ে ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে আকাশমুখী করে বাড়ির ছাদের মাথায় তোলার সময় কীভাবে তাদের কাচের দেওয়াল সামনের রাস্তাঘাট, গাছগাছালি আশপাশের বাড়িঘর গাড়ির হরেক রং আর ওই আকাশের মেঘ দেখিয়ে দেয়।
ফি-মাসে একটির বেশি চিঠি লেখার মঞ্জুরি ছিল না। আর সেই একটিমাত্র চিঠিটা লিখতাম আমিই। তার বাবা-মা লিখতে পারত না। অন্য আর-একটা খামারে ওরা যখন কাজ করত, সেখানে সোজা চলে যেতাম, জানতে চাইতাম তার জন্যে কোনও খবর দেওয়ার আছে কিনা। সারা সময়টা জুড়েই ওর মা শুধু কাঁদত। মাথার ওপর হাত রেখে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত, কিচ্ছু বলত না। আর বুড়োমানুষটা তাদের প্রতি রবিবার গাছপালাহীন নেড়া ঘাসজমির মাঠের প্রার্থনার জমায়েতে নিয়ে যেত। সেমানুষটা আমাকে বলল, আমার ছেলেকে বলে দিয়ো— প্রভু যা করছে, ওর মঙ্গলের জন্যেই করছে— সব ঠিক হয়ে যাবে। এর জবাবে সে লেখে— সমস্যা তো ওখানেই। খেতেখামারে আমরা যারা দিনরাত খাটুনি করে মরছি, আর তাদের বোঝানো হচ্ছে, ‘যা করার তা প্রভুই করবে।’ এমনভাবে বোঝানো হলে জীবনটা বদলানোর মত দরকারি শক্তির খোঁজ তারা কোনওদিনই পাবে না।
এর দু-বছর পরে কেপটাউনে তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার মত টাকাপয়সা আমি আর আমার বাবা-মা শেষ পর্যন্ত জমাতে পারলাম। আমরা ট্রেনে গেলাম— স্টেশনের মেঝেয় শুয়েছিলাম। একে-ওকে তাকে জিজ্ঞেস করে খেয়ানৌকোর খোঁজ করছিলাম। এখানকার লোকেদের প্রাণে দয়ামায়া আছে বলতে হবে। কেউ খেয়ানৌকোর খোঁজ করলে তারা বেশ বুঝে নেয় ওই দ্বীপটায় তাদের কোনও আপনজন পড়ে আছে।
সেখানে অন্য নৌকো যে ছিল না তেমন নয়, বিশাল বাড়ির সাইজের জাহাজও ছিল; সেগুলো অন্য সব জায়গায়— সারা দুনিয়ায় যেত। তবে খেয়ানৌকো ছিল শুধুই সেই দ্বীপটায় যাওয়ার জন্যে— দুনিয়ার আর কোথাও যাওয়ার জন্যে নয়। যারা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকত তাদের সবারই গন্তব্য সেই দ্বীপ। সুতরাং ভুল হওয়ার প্রশ্ন নেই। আমাদের সঙ্গে ছিল কিছু বিস্কুট আর মিষ্টি, আর তার জন্যে প্যান্ট, গরম কোট। (আমাদের পাশে যে মহিলাটি দাঁড়িয়ে ছিল, সে বলল— কোনওরকম কাপড়জামা দেওয়া যাবে না।) আর আমিও তখন ওরকম গরম কিছু আর পরে নেই। আমার মাথায় চাপানো পুরনো পাতলা সেপাইটুপি— যেটা খামারের মেয়েরাই পরে। পেশির ব্যথানাশক ক্রিম কিনেছিলাম ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে— ওরা কাঠের বাক্স সাইকেলে চাপিয়ে আমাদের খামার এলাকায় ঘুরে ঘুরে যেগুলো ফেরি করে বেড়ায়। আমার ঘন চুল ভাল করে আঁচড়ানো; ফুল ফুল নকশাকরা স্কার্ফ মাথায় বেঁধেছি, তবে সেটায় কান পুরোপুরি ঢাকেনি, সোনালি রঙের রিং-টা দেখা যাচ্ছিল। তার মায়ের জামার ওপর দিয়ে কম্বল কোমরে জড়ানো— খামারের মহিলা হলেও, তাকে অন্যসব স্থানীয় মানুষদের মতই লাগছিল। এবার নৌকো যখন তৈরি হয়ে আমাদের তুলে নিতে সামনে এগিয়ে এল, আমরা একেবারে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে পাড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম— ঠিক যেন শান্ত নিরীহ একপাল গোরু-ছাগল চাপাচাপি করে দাঁড়িয়ে গেট খোলার অপেক্ষায় একেবারে মুখিয়ে আছে। একটি লোক তার চিবুক তুলে-নামিয়ে সংখ্যাটা গুনে নিচ্ছিল। তার নিশ্চয়ই খুব ভয় হচ্ছিল, কেননা লোক বেশি হলে সে নিজেও হয়তো বাদ যেতে পারে। আমরা দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশকর্মীর দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের আগে যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা একে একে নৌকোয় গিয়ে উঠল। এবার আমাদের পালা আসতেই দেখি পুলিশের লোকটি তার একটি হাত বাড়িয়ে দিল— সে কিছু চাইছে। বুঝতে পারলাম না সে কী চাইছে।
আমাদের কাছে পারমিট ছিল না। কেপটাউনে আসার আগে কয়েদিদের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে দ্বীপে যাওয়ার খেয়ানৌকো ধরার জন্যে পুলিশ পারমিট লাগে, এসব আমরা জানতাম না। আমি মোলায়েম করে জিজ্ঞেস করলাম কী করতে হবে। তখন আমার মুখ শুকিয়ে গেছে।
আমাদের ফিরতেই হল। নৌকোটা দুলছিল। ডাঙার যে কিনারায় আমরা দাঁড়িয়েছিলাম, সেখানে ধাক্কা খেয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করে ধীরে ধীরে ছোট হতে হতে নৌকোটা এমনভাবে মিলিয়ে গেল যেন মনে হল এই কিছু আগে পর্যন্ত আদপেই কি আমরা নৌকোটাকে দেখেছি, নাকি চোখের ভুলে জলের ওপরে উড়তে থাকা কালো পাখির দলের কোনও একটাকে দেখেছি— যে বারবার ডুব দিচ্ছিল।
সেদিন কমসেকম একটা মন্দের ভাল ব্যাপার হয়েছিল— যাত্রীদের একজন নিজে থেকেই আমাদের বিস্কুট আর মিষ্টি তার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে এগিয়ে এসেছিল। চিঠিতে প্রাপ্তি-সংবাদও পেয়েছিলাম। কিন্তু সে-চিঠি পড়ে আমার মোটেও ভাল লাগেনি— একেবারেই না। দেখলাম সে আমার ওপর বিরক্ত। পারমিটের বিষয়টা ভাল করে খোঁজখবর করে আগাম জেনে রাখা উচিত ছিল। এক অর্থে সে অবশ্য ভুল কিছু বলেনি— টিকিট কাটলাম, নৌকোর খোঁজখবর যোগাড় করলাম, সেই সঙ্গে পারমিটের ব্যাপারটাও তো জেনে রাখা উচিত ছিল। সে আরও লিখল, আমি আট ক্লাস পাশ করেছি; শহরে খবরটা জানানোর অফিস আছে— ওটা গির্জাগুলো চালায়, সেটা অন্তত জানা উচিত ছিল। কিন্তু মুস্কিল হল, খামার থেকে শহর অনেক দূরে— ওসব জানব কী করে। সে মনে করিয়ে দিয়েছিল— অজ্ঞতাই আমাদের পিছিয়ে থাকার মূল কারণ। এই অজ্ঞতাকে আমাদের তাড়াতে হবে।
তো সেই যে ফিরতি ট্রেনে চড়ে বসলাম, দ্বিতীয়বার ওই দ্বীপমুখো হইনি। তারপরে সে সেখানে কাটাল আরও তিনটে বছর, আমি ট্রেনের টিকিটের পয়সা যোগাড় করতে পারিনি। এর মধ্যে তার বাবাও মারা গেল। আমার মাইনের টাকা থেকে তার মাকে যথাসাধ্য সাহায্য করছিলাম। আমি লিখলাম, সারাক্ষণ আমাদের সবার ওই এক দুশ্চিন্তা— টাকাপয়সার বড় টানাটানি। কবে আর এই অভাব ঘুচবে? এবার সে একটা ভাল চিঠি লিখে তার জবাব দিল। এতসবের জন্যেই তো তোমাদের ছেড়ে আমি এই দূর দ্বীপে দিনের পর দিন পড়ে আছি। একদিন নিশ্চয়ই আমরা সবকিছু পাব— যেমনটি আমরা চাই— জমি, খাদ্য— সব; অজ্ঞতাকে সমূলে দূর করতে পারব। সেখানে আরও একটা জিনিস হয়তো বাকি ছিল— ভয় পাচ্ছিলাম, জেলের কর্তারা ‘ক্ষমতা’ শব্দটা হয়তো গায়েব করেছিল। তার সব চিঠিই একেবারে আমার জন্যে— এমন তো নয়; আমি পড়তে পারার আগে জেলের অফিসার প্রত্যেকটা চিঠি খুঁটিয়ে পড়ে নিত।
***
মাত্র পাঁচটা বছর পর সে তাহলে ঘরে ফিরছে।
যখন খবরটা শুনলাম, তেমনটাই মনে হচ্ছিল। পাঁচটা বছর কিচ্ছু না! হঠাৎ কেমন করে নিমেষে ফুরিয়ে গেল। এবার আরও একটা বছরের অপেক্ষা আর নয়, তার আগেই সে আসছে! আমাদের ছোট্ট মেয়েটাকে আবার তার ফটোটা দেখালাম। এটা তোর পাপা! —আসছে। এবার দেখতে পাবি। সে স্কুলের বন্ধুদের কাছে খবরটা দিয়ে দিল। এবার আমার একটা পাপা হয়েছে! মনে হল, ঠিক যেন বাড়ির ছাগলছানার মতই কিছু একটা শিগগিরই সে পেতে চলেছে।
আমরা চাইছিলাম, আর দেরি কেন, সে এখনি চলে আসুক। সেই সঙ্গে এও ভাবছিলাম, ঠিকঠাক প্রস্তুতিরও তো একটু সময় চাই। তার মা তার এক কাকার কাছে থাকত। তার বাবা মারা যাওয়ার পর এখানে তাদের সেই ঘরটাও আর নেই। বিয়ের পরে আমরা থাকব কোথায়? হাতে কিছু সময় পেলে আমার বাবা দিব্বি খুঁটি কেটে দিত, আমি আর মা হাত লাগিয়ে ক’টা ইট খড় দিয়ে তার আমার আর আমাদের বাচ্চার থাকার জন্যে একটা আস্তানা দিব্বি বানিয়ে ফেলতে পারতাম।
আসলে সে ঠিক কবে আসবে, আমরা তা নিয়ে তেমন নিশ্চিত ছিলাম না। শুধু রেডিওয় শুনেছি, তাকে আর অন্যান্য কয়েকজনকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পরে একদিন ইন্ডিয়ানদের দোকানে কালো-লোকদের ‘দ্য নেশন’ কাগজে খবরটা দেখলাম। সেখানে একটা ছবি ছাপা হয়েছে— বহু লোক দল বেঁধে খুশিতে নাচছে, হাত নাড়ছে। দেখেই বুঝলাম, ওটা সেই ফেরিঘাটের ছবি। তারা খুশির উচ্ছ্বাসে কিছু লোককে পাঁজাকোলা করে বাকিদের কাঁধে তুলে দিচ্ছে। ওই দলের মধ্যে তাকে আলাদা করে চিনতেই পারিনি। আমরা উদগ্রীব অপেক্ষায় রইলাম। খেয়ানৌকোটা তাকে দ্বীপ থেকে ফিরিয়ে এনেছে, কিন্তু কেপটাউনের কথাও আমাদের বেশ মনে আছে; সেও তো এখান থেকে বহু দূর। এবার শেষ পর্যন্ত সে এসে পৌঁছল। সেটা ছিল এক শনিবার। আমার স্কুল নেই, মায়ের সঙ্গে নিড়ানি দিয়ে কুমড়ো ভুট্টা-র গাছগুলোর গোড়ার আগাছা সাফাইয়ের কাজ করছিলাম। আমার চুল খোঁপা বেঁধে সবসময় পরিপাটি রাখার চেষ্টা করি, কিন্তু সেদিন পুরনো একটামাত্র ক্লিপ দিয়ে চুল বেঁধেছিলাম। এক সময় দেখি, ঘাসজমির দিক থেকে একটা কমবি গাড়ি আমাদের কাছাকাছি এসে থেমে গেল। কমরেডরা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এল। আমি ছুটে গিয়ে হাত ধুয়ে নিতে এগোতেই দেখি, সে পা বাড়িয়ে একবারে আমার সামনে— মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সে বলে উঠল, আরে আরে হল কী! কমরেডরা ততক্ষণে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেছে। আমার মা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পুরনো দস্তুরে চিৎকার করে উঠল— ‘বাছা রে, আয় আয়!’ আমার বাবা হাতে তালি দিচ্ছিল, পায়ে থপ থপ শব্দ করতে করতে এগিয়ে আসতেই আমাদের সবার দিকে সে দুহাত বাড়িয়ে দিল। বড়সড় চেহারার মানুষটা এসেছে পাক্কা শহুরে পোশাকে, পায়ে পালিশকরা চকচকে জুতো। সে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ধরল, অগত্যা কাদা-জলে নোংরা হাত তার পিঠের দিকে সরিয়ে রেখেছিলাম। তার ঠোঁট ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসা দাঁতের ঘায়ে আমার বেশ চোট লেগেছিল। মনে হচ্ছিল এবার বোধহয় সবাই একসঙ্গে হুড়মুড় করে পড়ব! তারপর সবাই একেবারে চুপ। বাচ্চা আমার মায়ের পেছনে গিয়ে লুকিয়েছিল। সে মেয়েকে কোলে তুলে নিল, মেয়ে কিন্তু তার দিকে একেবারেই তাকাল না, মাথাটা ঘুরিয়ে কাঁধের দিকে চেয়ে রইল। মেয়ের কতই বা বয়েস তখন— ছ-বছরও পুরো হয়নি! তাকে বললাম, ছেলেমানুষি কোরো না। মা বলল, ‘না, এ তো সে-মানুষ লাগছে না।’
কমরেডরা সবাই হো হো করে হাসতে লাগল, আমিও হাসছিলাম। মেয়ে ছুটে পালাল। সে বলল, ধাতস্থ হতে খানিকটা সময় তো লাগবেই।
দেখলাম তার ওজনও অনেকটাই বেড়েছে। সত্যিই অবিশ্বাস্য লাগছিল। একসময় সে এত রোগা ছিল যে তার পা-দুটোকে শরীরের তুলনায় অনেক বড় লাগত। এখন রাতে বিছানায় শুয়ে দিব্বি মালুম হয়, ওজনে সে কত ভারি হয়েছে। এমনটা আগে লাগত কিনা মনে পড়ে না। মাঝে অনেকটা সময় চলে গেছে। এতদিন জেলে কাটিয়েও তার গায়ের জোর আরও বেড়ে গেছে দেখে সত্যিই অবাক হলাম। সবাই বলতে লাগল— হ্যাঁ, এবার জবরদস্ত মরদের মত চেহারা হয়েছে বটে। বুক বাজিয়ে তাকত জাহির করে সে হো হো করে হাসত। জেলের কুঠুরিতে থাকাকালীন তারা নাকি নিয়মিত শরীরচর্চা করত। জেলের ওসব ছোট্ট কুঠুরিতে পায়চারি করে তারা নাকি রোজ তিন মাইল সমান হাঁটত। রাতে আমরা যখন একসঙ্গে হতাম, তখন নিজেদের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে ফিসফিস করে কথা বলতাম। কিন্তু আজকাল লক্ষ করছি, সে এমন কিছু নিয়ে ভাবনায় ডুবে থাকে, যা বোঝা আমার নাগালের বাইরে। সুতরাং অযথা বাড়তি কথা বলে তাকে আর বিব্রত করতে চাইনি। তাছাড়া কী বলব সেটা সত্যিই আমার মাথায় আসতও না। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করত, পাঁচটা বছর ওরকম আটকে থাকতে তার কেমন লাগত। আমি স্কুল সম্পর্কে বা বাচ্চাকে নিয়েও তার সঙ্গে কথা বলতে চাইতাম। এখানে তাহলে হলটা কী শেষ অবধি? —কিচ্ছু না। শেষ পর্যন্ত তাহলে কি শুধু অপেক্ষাই সার হল।
দিনের বেলায় কখনও কখনও তাকে বলার চেষ্টা করেছি, আমার দিনগুলো কীভাবে কেটেছে এই পাঁচটা বছর— এই খামারবাড়িতে। সে আগ্রহ নিয়ে কথাগুলো শোনে— ঠিক যেমনভাবে সে অন্য সব খামারের লোকজনদের কথা শোনে। তারা তার কাছে এসে তাদের দুরবস্থার কথা বলতে আসে। তার দ্বীপান্তরে থাকার এই পাঁচ বছরে তাদের অবস্থার প্রায় কোনও উন্নতিই হয়নি। সে হাল্কা হাসত আর সমঝদারির মাথা দোলাত, দুয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করত, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙত। তখন তাকে দেখে মনে হত, তার যথেষ্ট শোনা হয়ে গেছে। তারা আসার আগে যে ব্যাপার নিয়ে সে ব্যস্ত ছিল, তার মন আবার সেখানেই ফিরে যেত। আর একথা তো মানতেই হবে, আমরা— এই খামারের লোকজন খুবই ধীরগতি— জড়ভরতের মত। আমরা বড় বেশি ইনিয়েবিনিয়ে ধীরে ধীরে কথা বলি— আর তারও এসব গা-সওয়া হয়ে গেছে।
এখনও সে অন্য কোনও কাজ নেয়নি। কিন্তু তার তো এভাবে এখানে আমাদের সঙ্গে পড়ে থাকলেও চলে না। আমরা ভেবেছিলাম, ওই সবুজ-নীল রঙা সমুদ্রের মাঝে পাঁচ-পাঁচটা বছর একা কাটিয়েছে সে। আপাতত অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও আমাদের সঙ্গে থেকে একটু জিরিয়ে নেবে। কিন্তু সেই একভাবে কমবি বা অন্য কোওন গাড়ি এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। সে শুধু বলে, চিন্তা কোরো না; জানি এবার কবে ফিরব। প্রথমে আমি জিজ্ঞেস করতাম, ফিরবে কবে? এসপ্তাহে, নাকি পরের সপ্তাহে? সে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করত। এই আন্দোলনটা আসলে ঠিক ইউনিয়ন করার মত নয়। ইউনিয়ন করার সময় রোজ ডিউটিতে আসতে হয়, মিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় ডিউটির পর। আন্দোলনটা যে চাকরির মত নিয়মিত বাঁধা-মজুরির কাজ নয়, সেটা আমি জানি— এসব তার বলার দরকার ছিল না। মনে হল, জিনিসটা সেই দ্বীপে নির্বাসনে যাওয়ার মত ব্যাপার। আমাদের সমস্ত লোকজনের জন্যে একাজ আমাদের করতেই হবে, কেননা আমাদের পয়সা নেই, জমি নেই। সে আমার বাবা-মায়ের বাড়ি— যে বাড়ি আমি সে আর তার বাচ্চার জন্যে অপেক্ষা করছে— সেটা দেখিয়ে বলল, দেখো, এই বাড়ির জমির মালিক একজন সাদাচামড়ার সায়েব। আর এখানে এই মাটির দেয়াল টিনের চালের ঘরে ততদিনই থাকতে পারবে যতদিন তোমরা তার খামারের কাজে আছ। বাবা আর তোমার ভাই চাষের কাজে, মা সায়েবের ঘরদোর পরিষ্কার করছে, আর তুমি কাজ করছ স্কুলে— আর সেটাও তালিমহীন মাস্টারনির কাজ। খামারমালিক বলে, সে আমাদের মালিক। আমি জানতাম আসলে আমাদের বাড়ি নেই এই জন্যে যে, দ্বীপান্তর থেকে তার ফেরত আসার আগে বাড়ি বানাবার মত যথেষ্ট সময় আমাদের হাতে ছিল না। এবার বুঝলাম, সত্যিই তো, আমাদের আদৌ কোনও বাড়ি নেই।
বোকাবুদ্ধু আমি নই। কমবি চড়ে কমরেডরা যখন তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে আসে, তাদের জন্যে চা দিতে হয়। উইকেন্ড হলে বিয়ার। এরপর আমি মাকে নিয়ে কিন্তু কোথাও চলে যাই না। তারা মায়ের বিয়ার পছন্দ করত, আমাদের জীবনধারা নিয়েও কথা বলত। তাদের মধ্যে একজন ছিল, সে মাকে আদর করে জড়িয়ে ধরত— তাকে তাদের সবার মা— এমনকি তামাম আফ্রিকার মা বলত। ওই দ্বীপটা নিয়ে তারা যে গান বেঁধেছিল, এবং যে গানগুলোকে আমরা দাদু-দিদাদের আমলের পুরনো দিনের গান হিসেবেই জানতাম, সেগুলো শুনিয়ে তারা মাকে বেশ খোশমেজাজে রাখত। এরপর তারা গুরুগম্ভীর গলায় তাদের নিজেদের আলোচনায় বসে যেত। ওদের এসব কথাবার্তা তাদের ঘাসজমির উপত্যকার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে যাক, তা আমার বাবা পছন্দ করত না। বাবার কেবলই ভয় হত, বোওয়ার সায়েবরা যদি ঘুণাক্ষরে জেনে যায় যে তার মুনিষেরা রাজনীতি-করা লোক— দ্বীপ-ফেরতা— আর সে বোওয়ারদের জমি নিয়ে নিয়মিত মিটিং বসায়, তাহলেই সর্বনাশ— নির্ঘাত গোটা পরিবারসমেত তাকে পত্রপাঠ তাড়িয়ে দেবে। তবে আমার ভাই বলল, বোওয়ার জিজ্ঞেস করলে সেটাকে প্রার্থনার জমায়েত বলে চালিয়ে দিলেই হবে। গান শেষ করার পর মা জানত, নিয়মমাফিক তাকে ঘরের ভেতরে চলে যেতে হবে।
আমি কিন্তু সেখানে থেকে যাই, ওদের কথাবার্তা শুনি। তবু সে ভুলে যায় যে, আমিও সেখানে আছি। সে কথা বলে, কোনও একটি বিষয় নিয়ে যুক্তি সাজিয়ে তার বক্তব্য পেশ করে। দেখলাম তার বক্তব্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ— আমরা যা নিয়ে আগে কখনও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করিনি। কিন্তু প্রায়ই দেখি, যখন বাকি কমরেডদের মধ্যে কেউ কথা বলার সময় একপলক আমার দিকে তাকায়— ঠিক যেমন করে আমি স্কুলে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রদের পড়া বুঝতে উৎসাহ দিই। তবে ওরা কিন্তু কেউ আমার সঙ্গে কথা বলে না, আমিও বলি না। ওদের আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে একটা হল খামারগুলোর মানুষজনকে— যেমন আমার বাবা, ভাই, বা তার বাবা-মায়ের মত কর্মীদের এবার সংগঠিত করতে হবে। আমি জানলাম সেই বিষয়গুলো কী কী: ন্যূনতম মজুরি, কাজের সময় সীমিতকরণ, ধর্মঘটের অধিকার, বার্ষিক অর্জিত ছুটি, দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ, পেনশন, অসুস্থতাজনিত ছুটি, এমনকি মাতৃত্বকালীন ছুটি ইত্যাদি। আমি এখন অন্তঃসত্ত্বা— অবশেষে আরও একটি সন্তান ধারণ করছি। এটা অবশ্য একান্তই মেয়েদের ব্যক্তিগত বিষয়। ওরা বড় মানুষ বুড়ো মানুষের কথা বলে, এখন আমি জানি এরা কারা: আমাদের নেতারা, যারা জেল থেকে সম্প্রতি মুক্তিও পেয়েছে। আমি তাকে আমাদের নতুন শিশুর আগমনের খবর জানিয়েছি। সে বলে, এই সন্তান হয়ে উঠবে এক নতুন দেশের মানুষ। সে হবে স্বাধীনতার কারিগর— যে স্বাধীনতার জন্যে আমরা লড়াই করছি! আমি জানি সে বিয়েটা সেরে নিতে চায়, কিন্তু এখন হাতে এক মুহূর্ত সময় নেই। সন্তানের দেখভালের জন্যেও তার সময় নেই। রোজকার খাবার আর পরিষ্কার পোশাকের জন্যেই তার কাছে আসা। বাচ্চা মেয়েটাকে ওপরে তুলে নিয়ে চ্যাংদোলা করে কয়েক পাক ঘোরাতে থাকে— ব্যস, ওইটুকুই। সে এখন কমবিতে বসে পড়েছে। কমরেডের দিকে ফিরতেই পরিষ্কার হল, তার মাথায় কী চলছে। চোখদুটো দ্রুত নড়াচড়া করতে লাগল, মনে হল সে এমন কিছুর দিকে ধাওয়া করছে যা কেউ দেখতে পায় না। মানুষটার ভাবগতিকে সড়গড় হওয়ার মত সময় ছোট্ট মেয়েটিরও নেই। তবে আমি জানি, একদিন ওই মানুষটিকে নিয়ে তার গর্ব হবে।
ছয় বছরের বাচ্চাকে এসব কী করে বোঝানো যায়? আমি কিন্তু তাকে সেই বড় মানুষ বুড়ো মানুষ আর আমাদের নেতাদের কথা বলেছি। বলেছি এইজন্যে যে, ওই দ্বীপান্তরে তাদের সঙ্গে তার বাবাও ছিল— সেটা ও জানুক। এই মানুষটাও একজন বিরাট পুরুষ।
শনিবার স্কুল থাকে না; মায়ের সঙ্গে গাছের চারা বুনি আর আগাছা পরিষ্কার করি। মা গান করে, আমি গাই না— আসলে ওটা আসে না। শুধু খামারমালিকের রাস্তার গাছের নিচে প্রার্থনার জমায়েতে যাওয়া ছাড়া রবিবারে আর কোনও কাজ থাকে না। টিনের চালের মাটির ঘরে বিয়ার পানের আয়োজন থাকে; ওদের সেই জমিতে আমাদের বসার অনুমতিও থাকে। ছোটবেলায় যেমন করতাম, এখনও তেমনি করে সময় বুঝে ওখান থেকে একসময় উধাও হয়ে যাই— নিজের খেলার জন্যে, নিজের সঙ্গে কথা বলার জন্যে। পালাই এমন এক জায়গায়— যেখানে আমার কথা আর কেউ শুনতে পাবে না, কেউ আমাকে খুঁজতেও আসবে না। গোটা উপত্যকা অঞ্চলটাই উঁচুনিচু পাহাড়গুলোর মাঝে একমাত্র রাস্তার মত সমতল। সেই রাস্তা থেকে আমার পা সরে গিয়ে চলে যেত পাহাড়ের একটা উঁচু উষ্ণ পাথরখণ্ডের দিকে। পড়ন্ত বিকেলে একা সেখানে গিয়ে বসে পড়তাম। এ-জায়গাটা বোওয়াদের খামারের মধ্যে পড়লেও আসলে ঠিক তা নয়, কেউ এর মালিক নয়। কেউ নিজেকে গরু বা ছাগলের মালিক বললেও ওই পশুর কাছে তার কোনও অর্থ নেই। ভেড়াগুলো যেন ধূসর রঙের কতকগুলো পাথরের মত— তারপর ওরা কখন হয়ে ওঠে ধূসর রঙের চলন্ত মোটা সাপ— ওরা জানে না। নিচে দূরে— আমাদের ছোট ছোট আস্তানাগুলো, বুড়ো মালবেরি গাছ আর গতকাল বাদামি মাদুরের মত করে মায়ের কোপানো একচিলতে জমি; ওপরে উঁচু উঁচু চিমনি আর খামারবাড়ির ঝকঝকে টেলিভিশনের মাস্তুল ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগাছালি। এখন এগুলো আমার কাছে অর্থহীন, তুচ্ছ— সব যেন অন্য পারের পৃথিবী। একটানে সবকিছুকে দূরে সরিয়ে দিলাম— ঠিক কুকুর যেমন করে মাছিকে ঊড়িয়ে দেয়।
আমি এখন মেঘেদের সঙ্গে। আমার পেছনের সূর্য বারবার আকাশের রং পাল্টে দিচ্ছে। মেঘের দলও ধীরে ধীরে নিজেদের পাল্টে ফেলছে। তার কিছু কিছু সাদা— বুদবুদের মত আকাশের গায়ে ফুটে উঠছে। তার নিচে ভেসে আছে ধূসর রঙা একটা পটি— এখনি বৃষ্টি নামানোর অবস্থায় আসেনি। সেটা দৈর্ঘ্যে ক্রমশ আরও লম্বা আর গাঢ় হয়ে আসছে। বাকিরা গোলাপি মেঘের দল। এরপর সেই ধূসর মেঘের একটা শুঁড় তৈরি হল, তার শরীরটা আরও লম্বা হয়ে শেষপ্রান্তে তৈরি হল একটা লেজ। এবার সারা আকাশ জুড়ে ধাবমান এক বিশাল ইঁদুর— সে গোটা আকাশটাকেই গিলে ফেলতে চলেছে।
বাচ্চাটার সেই ফোটোটার কথা মনে পড়ে। সে বলে, ওটা পাপা’র ছবি নয়। আমি যেখানে বসে আছি— এখানে আগে প্রায়ই আসতাম— যখন সে দ্বীপবাসী ছিল। অন্যদের থেকে একটু আলাদা হয়ে নিরালায় কিছুক্ষণ কাটাতে আসতাম, শুধু নিজে একান্তে অপেক্ষায় থাকব বলে।
আমি ইঁদুরটাকে একভাবে দেখছিলাম— সে ধীরে ধীরে নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলে এবার পুরো আকাশটাকেই গিলে ফেলছে, আমি অপেক্ষায় বসে আছি। বসে আছি তার ফিরে আসার অপেক্ষায়।
অপেক্ষা করছি। এখনও তার ঘরে ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনে চলেছি।
চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
***
লেখক পরিচিতি
নাদিন গর্ডিমার (১৯২৩-২০১৪) বিশ্ববরেণ্য লেখিকা, তাঁর জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রান্সভালের স্প্রিংসের এক বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত পরিবারে। নয় বছর বয়েসে তাঁর লেখাপড়া শুরু হয়। মাত্র পনেরো বছর বয়েসে তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। ছেলেবেলা থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনালব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই তাঁর অনন্য সাহিত্যসৃষ্টি। পৃথিবীর দিকে দিকে, বিশেষত আফ্রিকার অবহেলিত বঞ্চিত নির্যাতিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা হতাশায় তাঁর বিচলিত ও প্রতিবাদী কণ্ঠ তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয় তাঁর প্রায় সমস্ত সাহিত্যকর্মে। সক্রিয় সমাজকর্মী ও সংগঠক হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন— যেকোনও সামজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশ নেন। আন্তর্জাতিক লেখক সমিতি (পেন)-র সহ-সভাপতি হিসেবেও তিনি কাজ করেন। ১৯৭৪ সালে বুকার পুরস্কার পান। ১৯৯১ সালে তিনি নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন। তিনি সমগ্র আফ্রিকার প্রথম নোবেল বিজয়িনী। নোবেল কমিটির অভিজ্ঞানপত্রে বলা হয়, ‘আলফ্রেড নোবেলের উক্তি অনুযায়ী তিনি তাঁর অপূর্ব মহাকাব্যিক রচনার মাধ্যমে, মানবতার প্রতি অত্যন্ত কল্যাণকর অবদান যুগিয়েছেন।’
২০১৪ সালের ১৩ জুলাই ৯০ বছর বয়েসে জোহানেসবার্গ শহরে প্রয়াত হন নাদিন গর্ডিমার। তাঁর গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘দ্য লাইং ডেইজ’ (১৯৫৮), ‘আ ওয়ার্ল্ড অফ স্ট্রেইঞ্জারস’ (১৯৫৮), ‘অকেশন অফ লাভিং’ (১৯৬৩), ‘দ্য লেইট বুর্জোয়া ওয়ার্ল্ড’ (১৯৬৬), ‘আ গেস্ট অফ অনার’ (১৯৭০), ‘দ্য কনজার্ভেশনিস্ট’, (১৯৭৪), ‘বার্জার্’স, ডটার’ (১৯৭৯), ‘জুলাই’স্ পিপলস্’ (১৯৮১), ‘আ স্পোর্ট অফ নেইচার’ (১৯৮৭), ‘মাই সন্’স স্টোরি’ (১৯৯০), ‘নান্ টু অ্যা কম্পানি মি’ (১৯৯৪), ‘দ্য হাউস গান্’ (১৯৯৮), ‘দ্য পিক আপ’ (২০০১), ‘গেট আ লাইফ’ (২০০৫), ‘নো টাইম লাইক দ্য প্রেজেন্ট’ (২০১২) প্রভৃতি উপন্যাস এবং ‘ফেইস টু ফেইস’ (১৯৪৯), ‘দ্য সফ্ট অফ দ্য সারপেন্ট’ (১৯৫২), ‘সিক্স ফিট অফ দ্য কান্ট্রি’ (১৯৫৬), ‘হুইচ নিউ এরা উড দ্যাট বি’ (১৯৫৬), ‘ফ্রাইডে’স ফুটপ্রিন্ট’ (১৯৬০), ‘নট ফর পাব্লিকেশন’ (১৯৬৫), ‘লিভিংস্টোন’স কম্প্যানিয়ন’স’ (১৯৭০), ‘সিলেক্টেড স্টোরিজ’ (১৯৭৫), ‘সাম মান্ডে ফর স্যুওর’ (১৯৭৬), ‘নো প্লেস লাইক সিলেক্টেড স্টোরিজ’ (১৯৭৮), ‘আ সোলজার’স এম্ব্রেস’ (১৯৮০), ‘টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি লাভার্স’ (১৯৮২), ‘সামথিং আউট দেয়ার’ (১৯৮৪), ‘করেস্পন্ডেন্স কোর্স অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ (১৯৮৪), ‘দ্য মোমেন্ট বিফোর দ্য গান ওয়েন্ট অফ’ (১৯৮৮), ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম’ (১৯৮৯), ‘ক্রাইমস অফ কন্সায়েন্স’ (১৯৯১), ‘জাম্প অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ (১৯৯১), ‘হোওয়াই হাভন্ট ইউ রিটন: ‘সিলেক্টেড স্টোরিজ’ (১৯৯২), ‘সামথিং ফর দ্য টাইম বিইং’ (১৯৯২), ‘লুট অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ম’ (২০০৩), ‘বিঠোভেন ওআজ ওয়ান-সিক্সটিন্থ ব্ল্যাক’ (২০০৭), ‘আ বেনিফিসিয়ারি’ (২০০৭), ‘লাইফ্টাইমস্: স্টোরিজ’ (২০১১) প্রভৃতি গল্প সংকলনগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।
অসাধারণ গল্প। অসাধারণ অনুবাদ। সূর্য রং পাল্টাচ্ছে আর পুরো আকাশটাই গিলে ফেলছে মেঘেদের তৈরি শুঁড়, লেজ তৈরী হয়ে ইদুর হল। অথচ এক সময় মাথায় থাকত এক তাল গোবর, যা বৃষ্টির জলে ভাসতো আর আরশির কাঁচের মত তার মধ্য দিয়ে দেখা যেত নীল আকাশ।
গল্পের পরিপার্শ্ব তার অচেনা ভুগোল ও ইতিহাস এখানে বাধা হয়ে ওঠে না। ক্ষমতা ও ক্ষমতাহীনতার লড়াই সবসময় এক। ক্ষমতা প্রিয় সম্পর্কের সমীকরণ পর্যন্ত পালটে দেয়।