এখন বেতার-যোগাযোগ ব্যবস্থার অগ্রগতি ও বিকাশের এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি, যেখানে প্রায় প্রত্যেকের হাতের মুঠোয় রয়েছে চলমান-দূরভাষ। স্মার্টফোন। ভিডিও কল থেকে কনফারেন্স কল, জুম বা গুগল মিট ইত্যাদির সংযোগ। আজ থেকে দু-দশক আগেও সংযোগের এমন উন্নতির কথা সম্ভবত কল্পনাতেও ছিল না কারও। এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের বাল্য-কৈশোর বা তরুণ বয়সে দেখা আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে ডায়াল করা বিএসএনএল-এর কালো রঙের সেই ল্যান্ড-লাইন টেলিফোন যন্ত্রটির কথা ভুলতে বসেছি বলা বাহুল্য। যা ছিল প্রত্যেক অফিসে এবং অনেক বাড়িতে।
টেলিফোন বা দূরভাষ যে অতীব প্রয়োজনের একটি জিনিস, তা আর নতুন করে কাউকেই বলার দরকার নেই। ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি…’ গানের কথায় এক এক সময় মনে হয়, কবি কি তাহলে ‘টেলিফোন’-এ প্রিয়জনের কথা শুনে মনে মনে ‘ফাল্গুনী’ রচনার কথা বলতে চেয়েছিলেন?
সে যাই হোক। টেলিফোনের প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল ২০০৩ সালে লেখা ‘তারবার্তা’ নামের একটি কবিতার কথা। লেখক কবি যশোধরা রায়চৌধুরি। সেই কবিতা থেকে কয়েকটি লাইন পড়তে ইচ্ছে করছে। শুনুন।
‘চারিদিকে ধসে পড়ছে আগে যা নিশ্চিত ছিল, আশ্বাসের ছিল
যাবতীয় ট্যারিফ স্ট্রাকচার
মোবাইল দখল নিচ্ছে সমস্ত প্রেমের এলাকায়’
শেষ তিনটি লাইন পড়ি—
‘টেলিফোন ক্লান্ত হাসে, কারণ সে জানে, তবু তার আছে বলে
যোগাযোগ আছে,
তার ছিন্ন হয়ে গেলে হৃদয় আর কথাই বলে না’।
বলা নিষ্প্রয়োজন যে, কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে একটি সময়ের কথা। সময় সন্ধিক্ষণের কথা। যে সময়ে মোবাইল ফোন বা সেল ফোন— ল্যান্ড লাইন টেলিফোনের ‘পাশ ঘেষে ঢুকে যাচ্ছে মহব্বৎ-ওয়ালাদের পকেটে পকেটে’! এই যে ট্রাঞ্জিশন এটি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে কবিতাটিতে।
এরই পাশাপাশি প্রায় একশো সাতচল্লিশ বছর আগের অন্য একটি যুগ সন্ধিক্ষণ ফিরে দেখব আমরা, এই লেখায়। এ ছিল সেই সময়, যখন ‘শব্দশক্তি’-কে ‘বিদ্যুৎ শক্তি’-তে পরিণত করে তারের মধ্যে দিয়ে এক জায়গার কথা দূরবর্তী জায়গায় পাঠানোর মূল নীতি আবিষ্কার হয়েছিল। যার যুগান্তকারী আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল (Alexander Graham Bell, ১৮৪৭-১৯২২)। ‘বিদ্যুৎ’ আবিষ্কারের পরে ‘টেলিফোন’ আবিষ্কার, যোগাযোগ ব্যবস্থায় যা ছিল এক বৈপ্লবিক উদ্ভাবন।
টেলিফোন আবিষ্কারের মাত্র বছর দশেক আগে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। সে সময়ের কথা পড়লে জানা যায় যে, তার আগে জরুরি ডাক ও সরকারি চিঠিপত্র মানুষ পিঠে করে বয়ে নিয়ে যেত বা ঘোড়ার মাধ্যমে পাঠানো হত বা জলপথে জাহাজে করে পাঠানো হত।
১৮৪৭ সালের আজকের দিনে, তেসরা মার্চ, স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় জন্ম হয়েছিল আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের। বাবা এবং দাদু সকলেরই নাম— আলেকজান্ডার বেল। প্রথমে তাঁর কোনও মধ্য (মিডল) নাম ছিল না। এগারো বছর বয়সের জন্মদিনে বাবার কাছে আবদার করলেন, ‘একটি মধ্যনাম চাই’। আর এইভাবে তিনি হলেন ‘আলেজান্ডার গ্রাহাম বেল’।
গ্রাহামের তখন বারো বছর বয়স। মায়ের একটি কঠিন রোগ হল, যার ফলে তাঁর কানে শোনার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকল। ‘মা একেবারে কানে কালা হয়ে যাবেন!’— এই নিদারুণ যন্ত্রণা গ্রাহামের মনে গভীর রেখাপাত করল। মাকে কখনও গান শোনান কখনও পিয়ানো বাজিয়ে শোনান গ্রাহাম। বুঝতে পারেন যে, মা সবকিছু শুনতে পাচ্ছেন না। কিন্তু ছেলে দুঃখ পাবে এই কথা ভেবে, ছেলের সব কথা শুনতে পাচ্ছেন, এমন ভান করছেন। এ সময় গ্রাহাম মনের কথা মাকে বোঝানোর জন্যে হাতের আঙুলের সংকেতের মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে কথা বলার কৌশল আবিষ্কার করলেন। এইভাবে মায়ের কপালে হাত রেখে সুর ও শব্দ সংকেত বোঝাতে সক্ষম হলেন গ্রাহাম।
এখান থেকেই গ্রাহামের শ্রুতিবিদ্যা শেখায় আগ্রহী হয়ে ওঠা। শ্রুতিবিদ্যা, স্পিচ-থেরাপি, দৃশ্য-কথা বিদ্যায় শিক্ষকতা করেছেন তিনি। গ্রাহামের বাবা এবং দাদা দুজনেই মূক ও বধিরদের কথা বলা শেখানো, ইশারায় সংকেতের সাহায্যে মনের কথা বোঝানোর বিদ্যা এবং কৌশলে পারদর্শী ছিলেন। বাবার ইচ্ছেমাফিক গ্রাহামও এই পদ্ধতি শিখে যান এবং এ বিষয়ে আরও পড়াশোনা করে উৎসাহী ও পারদর্শী হয়ে ওঠেন। অধ্যাপনাতেও সফলতা পেয়েছেন গ্রাহাম।
স্কটল্যান্ড এবং লন্ডনে স্কুল পাশ করে তেইশ বছর বয়সে বাবা মায়ের সঙ্গে কানাডাতে অভিবাসী হয়ে এলেন গ্রাহাম। পরে আমেরিকায় ‘বোস্টন স্কুল ফর দ্য ডিফ’-এ শিক্ষকতার কাজ করেন। টেলিফোন আবিষ্কার পরবর্তী খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরে আমেরিকার নাগরিক হন তিনি।
ছাব্বিশ বছর বয়সে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভোকাল-ফিজিয়োলজি’ বিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন গ্রাহাম। এখানেই তাঁর ফোনোগ্রাফ নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করলেন তিনি। উনত্রিশ বছর বয়সে গ্রাহামের টেলিফোনের ‘ইউএস পেটেন্ট’ গ্রান্টেড হল।
মাত্র উনিশ মাস বয়সে সম্ভবত স্কারলেট অসুখে আক্রান্ত হয়ে হেলেন কেলারের চোখের দৃষ্টি ও কানে শোনার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছিল। ছ-বছরের শিশুকন্যা হেলেনকে সঙ্গে নিয়ে গ্রাহামের কাছে সাহায্যের জন্যে এলেন হেলেনের বাবা। তখন টেলিফোনের আবিষ্কর্তা হিসেবে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন গ্রাহাম। তবু হেলেন কেলারের অসহায় বাবার অনুরোধ গভীর মমতার সঙ্গে শুনেছেন গ্রাহাম এবং তাঁরই হস্তক্ষেপে বোস্টনের ‘পারকিন্স স্কুল অফ ব্লাইন্ডস’-এ ভর্তি হন হেলেন কেলার। সেখানে হেলেন ব্রেল পদ্ধতিতে লিখতে, বলতে এবং পড়তে শেখেন। হেলেন কেলার তাঁর আত্মজীবনী গ্রাহাম বেলকে উৎসর্গ করে লেখেন— ‘…door through which I should pass from darkness into light.’ গ্রাহাম বেল আজীবন হেলেন কেলারের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিলেন।
গ্রাহাম বেলের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে, ওয়ারলেস আলোক-টেলিফোন (দ্য বেল ফোটো-ফোন)। সেলফোন আবিষ্কারের একশো বছর আগে, আলোক রশ্মিগুচ্ছের সাহায্যে সংকেত, শব্দ এবং ধ্বনি পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন গ্রাহাম। যুগান্তকারী এই আবিষ্কার। বলা বাহুল্য, যা টেলিফোনের চেয়েও অনেক বড় আবিষ্কার।
ধ্বনি ও শব্দবিজ্ঞানে অবদানের জন্যে গ্রাহামের মৃত্যুর পরে তাঁর সম্মানে শব্দ (সাউন্ড)-এর একক হয় ‘বেল’। আর ‘বেল’-এর এক দশমাংশ মাত্রাকে বলা হয়ে থাকে ‘ডেসিবেল’। ‘নয়েজ’-এর মাত্রা হিসেবে এই ‘ডেসিবেল’ একক আমাদের সকলের কাছে পরিচিত। মৃত্যুর দুদিন পরে যেদিন তাঁর দেহ শায়িত করা হয়েছিল মাটির মধ্যে, সেদিন উত্তর আমেরিকা ও কানাডার সমস্ত টেলিফোন এক মিনিটের জন্যে বন্ধ করে রাখা হয় গ্রাহামের সম্মানে। ষাট হাজার টেলিফোন অপারেটর কাজের জায়গায় কোনও ফোন সংযোগের কাজ না করে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী গ্রাহাম বেল নাম যশ প্রতিপত্তি— এসব বিষয়ে ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন। ব্যবসায়িক ও সাংসারিক বিষয়েও তিনি ছিলেন নিরাসক্ত। সারা জীবন তিনি বিজ্ঞান আবিষ্কারের ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকতেন। তাই নানান বিড়ম্বনা ও প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। টেলিফোন উদ্ভাবনের কৃতিত্ব কার, তা নিয়েও একদা হয়েছে তুমুল বিতর্ক, এমনকি মামলা-মোকদ্দমাও। দীর্ঘ কুড়ি বছর চলেছিল এই মামলা। সংবাদপত্রে ব্যঙ্গচিত্র ছাপা হয়েছে। গ্রাহাম বেলের যোগ্যতা সম্পর্কে নানান প্রশ্ন উঠেছে, তিনি বিদ্যুৎ বিজ্ঞান নিয়ে কিছু না-জেনেই টেলিফোন উদ্ভাবন করেছেন ইত্যাদি। একসময় নানান অপপ্রচার আর কুৎসায় জর্জরিত এবং হতাশ হয়ে পড়েন গ্রাহাম। কানাডার মন্ট্রিয়লে একবার বসন্ত রোগ ছড়িয়ে পড়ল, সেখানে অপপ্রচার চলল যে, টেলিফোনের তারের মধ্যে দিয়েই এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। ঘেরাও করা হল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। টেলিফোন কর্মীদের ওপর চড়াও হলেন সাধারণ মানুষ। এইসব নানা কারণে গ্রাহামের কাছে টেলিফোন একসময় অসহ্য হয়ে উঠেছিল। দারুণ মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে জীবন কেটেছে।
টেলিফোন আবিষ্কারের জন্যে বিশ্বজুড়ে নাম যশ প্রতিপত্তি সত্ত্বেও মূক ও বধির মানুষদের প্রতি তিনি তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা কখনওই ভোলেননি। মূক-বধিরদের লেখাপড়া শেখানোর জন্যে একাধিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং নিজে সেখানে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছেন। বিজ্ঞানের কথা বাদ দিলেও কেবল অধ্যাপক হিসেবে মূক ও বধির মানুষদের জন্যে তাঁর যা অবদান, তার জন্যেই তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
আজ ৩ মার্চ। উদ্ভাবক, ইঞ্জিনিয়ার এবং আমেরিকান টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ কোম্পানির যুগ্ম প্রতিস্থাপক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গঙ্গাজলে এই গঙ্গাপুজো।
অনেক ইন্টারেস্টিং ব্যাপার জানতে পারি এই লেখাগুলো থেকে। কৃতজ্ঞতা।
ভালো লাগলো মন্তব্য পড়ে
খুব খুব ভাল লাগল এই লেখাটি। কিছু জানা ছিল আগেই। কিন্তু হেলেন কেলারের সাথে তার বন্ধুত্ব, টেলিফোনের তার দিয়ে রোগের জীবানু ছড়িয়ে পড়ার গুজব, ওয়ারলেস আলোক-টেলিফোন – এসব জানা ছিল না। মায়ের না বুঝেও বুঝতে পারার অভিনয়ের জায়গাটা খুব মোচড় দিয়ে গেল। ..লেখক কে কৃতজ্ঞতা জানাই এত সুন্দর লেখাটির জন্য।
আপনার সহৃদয় মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ জানাই