Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

শতং বদ মা লিখ

ভেবেছি, মেয়ে হলে গুনগুন বলে ডাকব। শব্দটা মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। কোনও ব্যাখ্যা যেমন উদাহরণ দিয়ে বোঝালে তা বুঝতে সুবিধা হয়, এই শব্দটাও তেমন। মানে, কাকে গুনগুন বলে, শব্দটার ভার কী, এসবই বুঝতে শিখেছি উদাহরণের মাধ্যমে। তারপর আমার জন্ম চলেছে… হেঁটেছে… ওগো দেবতা আমার, জন্মের পরে মানুষ পরাধীন নয়, অধীন হয়।

বাংলা ভাষাকে আমি মন্ত্রভাষা বলে মানি। সেখানে ছায়া আছে, পাখি আছে, মায়ের থানকাপড়ের গন্ধ আছে, দাদুর নারকেল দড়ির খাটিয়া আছে, ঠাকুরদেব্‌তার গল্প আছে, তেলমালিশ, ভোরের গান, সাঁঝের গান… তুলসীতলার নিবিড় স্নান— সবই আছে। আর আছে শ্রাবণ মাস, যে মাসে জন্ম আমার। তখন মশারিটা উড়তে চেষ্টা করছিল। মশারিতে খেলছিল আমি নামের ছেলেটা। তার মা তাকে গান শোনাচ্ছিল, ‘এই আসনে তুমি করো আগমন/ বলো কোথায় তুমি/ ওগো নারায়ণ…’। শিশু নারায়ণ; যার দু’টি কান, একটি নাক আর একটিমাত্র মুখ আছে। প্রতিটি অঙ্গই ছিদ্রময়, তেজি এবং প্রখরও বটে। তার বেড়ে ওঠার জন্য তখন ছিদ্রই মুখ্য। হাওয়া-বাতাস, ধূলি-বালি, শব্দ-অক্ষর, গাল-গান, খুসবু-বদবু, স্বরব্যঞ্জনবর্ণ, বর্ণাতীত শব্দ যা কিছু শিশুটির চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে, ওই ছিদ্রগুলির কাছে তাৎপর্য আছে তাদের। এগুলি প্রতিদিন প্রবাহিত, যা চেতনা গড়ার কারিগর। শিশুর সামনে গঞ্জনা করলেও সে তোতাপাখির মত হরবোলা, আবার গুঞ্জন করলেও তা-ই; সহজ অবস্থান।

আমার দিদা একটা ছড়া শোনাত আমায়—
‘যমুনাবতী সরস্বতী, কাল যমুনার বিয়ে।
যমুনা যাবেন শ্বশুরবাড়ি কাজিতলা দিয়ে॥
কাজিফুল কুড়োতে পেয়ে গেলুম মালা।
হাত-ঝুম্‌-ঝুম্‌ পা-ঝুম্‌-ঝুম্‌ সীতারামের খেলা॥
নাচো তো সীতারাম কাঁকাল বেঁকিয়ে।
আলোচাল দেব টাপাল ভরিয়ে॥
আলোচাল খেতে খেতে গলা হল কাঠ।
হেথায় তো জল নেই, ত্রিপূর্ণির ঘাট॥
ত্রিপূর্ণির ঘাটে দুটো মাছ ভেসেছে।
একটি নিলেন গুরুঠাকুর, একটি নিলেন কে।
তার বোনকে বিয়ে করি ওড়ফুল দিয়ে॥
ওড়ফুল কুড়োতে হয়ে গেল বেলা।
তার বোনকে বিয়ে করি ঠিক-দুক্ষুর বেলা॥’

পরে আবিষ্কার করেছি, এই ছড়ার সংগ্রাহক রবি ঠাকুর। দিদা রবীন্দ্রনাথ পড়েনি। সে সুর করে পাঠ করত এই ছড়া। ত্রিপূর্ণির ঘাট কী জানতে চাইলে বলত আগ্রার যমুনা নদীর কথা। তাজমহলের কথা। তাজমহলের পাশ ঘেঁষে যমুনা বয়ে গেছে। নদীর ধারে শ্মশান ছিল। ওখানে দিদার মাকে দাহ করা হয়েছিল। সীতারামের খেলার কথা জিজ্ঞেস করলে আমায় নিয়ে যেত পাশের বস্তির শিবমন্দিরের কাছে। শ্রাবণে ওখানে কাঠের ঘোড়া করে একজন কোমর দুলিয়ে বেমালুম নাচত, লোকে পয়সা দিত। স্বপ্নের মত লাগত সেইসব। বোম শিব… বাবা তারকনাথের চরণের সেবালাগে… তারকেশ্বর থেকে আসা গামছা গায়ে জড়ানো ভিখারিনী… সবই তো সুর। এমন সুর ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে মামার বাড়ির বেড়ার ঘরে যাবার স্বপ্ন দেখতাম।

মা বলে, আমি যখন মাত্র দেড় বছর, দাদু আমায় চিড়িয়া মোড় থেকে বিরাটি নিয়ে যেত সাইকেলরিকশা করে। আমি নাকি রিকশা দেখলেই আঙুল বাড়াতাম। তাই ‘বেয়ু বেয়ু’ চরৈবেতি… রিকশাওলা প্যাডেলে পা দিতেই প্যাঁচপুঁচ শব্দ, তারপর হাঁসের ডাকের মত সুর করে ডাকতে ডাকতে রিকশা ছুটত। সাঁইত্রিশে এইসব মনে পড়ে। লেখার শুরুতে বলেছিলাম দাদুর নারকেল দড়ির খাটিয়ার কথা। ওখানে আমায় শুইয়ে তেলমালিশ করানো হত। কাঁথা মুড়ে দিয়ে যে বালিশ তৈরি করা হত, সেখানে মাথা দিতাম। তারপর শুরু হত মালিশ আর হরগৌরীর কথা। দিদা পাশ থেকে টিটকিরি কেটে বলে যেত, ‘দেখো, আবার নাতিকে শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর তৈরি কোরো না’।

এভাবেই শুনেছিলাম একান্ন খণ্ড সতীর কথা, গণেশের হাতিমুখো হয়ে যাবার গল্প, সমুদ্রমন্থনের কথা আরও কত কী… আর মা যখন খাওয়াতে বসত, তখন ফন্দিফিকির করে গান গেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বাবাবাছা করে অনেক চেষ্টা করেও সফল হত না যখন, বলত— শেয়ানা ঘুঘুর ছা, ফাঁদে দেয় না পা… হা হা হা… এখন নিজেকে শিকলকাটা টিয়া মনে হয়, যে পোষ মানে না। শিকল ভেঙে গেছে আমার দিদা মরে যাবার পর থেকে। যখন তাজমহল গিয়েছিলাম, শুক্রবার ছিল, মাত্র বারো বছর বয়স। একদল গোল হয়ে বসে অচেনা ভাষায় গান গাইছিল… সুফি… যমুনা পাড়ের শ্মশানের কথা মনে পড়েছিল সেদিন।

দিদা একদিন বলেছিল, ‘আমি মরে গেলে রতনবাবুর ঘাটে পোড়াস, কীর্তন আনিস…।’ সবটাই মহি-মা-র সুর… শতং বদ মা লিখ…

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »