Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ছোটগল্প: সরেজমিন

সাধনদা শেষ এসেছে গত চার তারিখে। একটি মাস হতে চলল। তমালের চোখের সামনে ভাসছে একটা নিরীহ মুখ। ময়লা পুরনো প্যান্ট আর বুশ শার্ট পরা রোগামতন একটা লোক। বয়স কত চেহারা দেখে আঁচ করা অসম্ভব। সারা শরীর জুড়ে একটা অদ্ভুত লজ্জা আর বিনয় যেন মিলেমিশে থাকে। তমাল যেটুকু জেনেছে, সাধনদা খুব গরিব। পেটের ধান্দায় নার্সারি থেকে কাজ ধরে। লোকটা উবে গেল কেন?
তমাল আর কুশল বকবক করছিল। কুশলই প্রশ্নটা করল,

—তুই জানিস আজ বৃষ্টি হবে?

—জানি। গুগল ওয়েদার দেখলাম। দেখাচ্ছে থান্ডার স্টর্ম। ৮০ কিলোমিটার বেগে হাওয়া বইবে। ওঃ! ভাবতেই শিহরণ। জমে যাবে পুরো। স্রেফ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকব। হাওয়ায় ভেসে যাব।

—হুঁ। ভেসেই যাবি। প্রথমে হাওয়ায়। তারপর জলে। তারপরই তো বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামবে, তাই না? গুগল কী বলছে? কুশলের গলায় রাগ। তমালের পাল্লায় পড়ে বড় মুশকিল হয়েছে। এই বিচ্ছিরি গরমে এই পচা জায়গাটায় আসা বড় ভুল হয়েছে।

—বললাম তো। প্রচুর বৃষ্টি। খুব ভাল লাগছে জানিস। তমাল বলল।

ঘরের একটিমাত্র জানলার পর্দা সরানো যাচ্ছে না এত রোদ্দুর। এই সময় এধরনের রঙ্গতামাশা কুশলের একটুও ভাল লাগছিল না। তমালের চোখের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল— তোর পাল্লায় পড়ে এখন ফট করে চলে না এলেই ভাল হত। এটা বর্ষাকাল? চাঁদি ফেটে যাবে মনে হচ্ছে। শ্রাবণের বারিধারা! শালা। কথায় কথায় গুগল দেখাস না।

ওরা হেরিয়াবাজারের কাছে একটা লজে উঠেছে। তমালের বাবা বলেছিল, আর একটু গেলেই দীঘা। তা, দীঘা যাওয়া হবে নাকি? তমাল মাথা নেড়েছিল। পয়সা নেই। এটা মা স্পন্সর করছে। সাধনদাকে দেখে আসতে যাচ্ছি। অসুখবিসুখ করে পড়ে থাকলে…। তমালের বাবা আবার বললেন— সোজা বাড়ি নিয়ে আসবে ভাবছ? অসুখবিসুখ হলে? চিকিৎসা করানোর দায়িত্ব। তমাল জানে বাবার ওই চিমটি কাটা কথার মানে। এগুলো সব মায়ের উদ্দেশে। কানে না নেওয়াই ভাল। একটু বাইরে যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া না করাই ঠিক।

সাধন কলকাতার শহরতলিতে ফ্ল্যাটবাড়ির একচিলতে বাগান দেখাশুনো করে। ওর অনেকগুলো ঘর বাঁধা। ঠিকে মালি বলা চলে। তমালদেরও পূর্ব শহরতলির ফ্ল্যাটবাড়িতে গোটা সাতেক টব ও দেখাশুনো করে। তমালের মায়ের স্কুলের চাকরি। সময় নেই, কিন্তু এখন পরিবেশবান্ধব হওয়ার যে বিপুল চাপ! স্কুলের বান্ধবীদের দেখে দেখে তিনিও কিছু টবের গাছ কিনেছেন। যে নার্সারি থেকে কিনেছেন তারাই সাধনকে পাঠিয়েছে। এক-দুঘর হতে হতে এই চত্বরে সাধন এখন কম করে পঞ্চাশ ঘর টবের বাগান দেখাশুনো করে। সপ্তাহে একদিন আসে। গোড়া খুঁচিয়ে দুটো চারটে দানা গোল গোল কী ওষুধ দেয়। গাছে স্প্রে করে। আর টবগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেয়। তমালের মা মাঝে মাঝে একটা দুটো ফুল ফুটলে আহ্লাদে আটখানা। বটানির জ্ঞান নেই। কী গাছ, কী ফুল এসব জানেন না। ছবি তুলে অ্যাপে দিয়ে ফুলের একটা মারকাটারি সায়েন্টিফিক নাম বার করে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করেন। এই আনন্দের দাম ওই স্প্রে আর ওষুধের দানা নিয়ে মাসে হাজার টাকা। তমালের বাবা এসব বোঝেন না। তিনি দু-একবার বলেছেন— এর চেয়ে দুটো জুঁইয়ের মালা এনে ভিজিয়ে রাখলে ঘরটা গন্ধে ভরে যেত। তমালের মা শিক্ষিকাসুলভ মেজাজে উত্তর দিয়েছেন— বাজারের কেনা ফুলের চেয়ে নিজের টবে একটা ছোট্ট ফুল ফোটার আনন্দ বেশি। তমালের বাবা খুবই নির্বিবাদী। তিনি ঝামেলায় যেতে চান না। কিন্তু তমালের কেমন মনে হয় অত নরম সুরের মধ্যে একটা চিমটি লুকিয়ে থাকে। এর পরেই তিনি বলে ওঠেন— সাধনের কারবারে ফুল ফুটছে। তোমার হাতের জাদুতে নয় মনে হয়।

এরপর সেদিন যে সন্ধেতে তমাল নিজের ঘরেও টিকতে পারবে না এটা জানার জন্য জ্যোতিষী, গুগল কাউকে দরকার নেই।

এহেন সাধনদা হঠাৎ একটি মাস ঘাপটি। মানুষটা ভীষণ গোবেচারা। কথা বলে কম। তমালের মা নানা কথা বলতেন। অল্প কথায় উত্তর দিত। আপাতত সাধনদা কোনও খবর না দিয়ে বেপাত্তা। তাই তমালের মা প্রথমে বিরক্ত। মাঝে মাঝে জল দেওয়া ছাড়া গাছের যত্ন তিনি জানেন না। আর করবেনই বা কখন? সন্ধেবেলা জলটুকু দিতে দিতে সমানে তমালকে বলতে থাকেন— এক একবার তো জলটা তুইও দিতে পারিস, নাকি? তমাল হাঁ করে শোনে। কোনও মানে আছে? বার তিনেক সরকারি পরীক্ষা দিয়ে সে চাকরির সুবিধে করতে পারেনি। এখন তাই বেসরকারি কাজের চেষ্টা করছে। হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। কুশল একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে। ও বলেছে, ব্যাপারটা খুব সোজা, বুঝলি। ওই ছ’মাস অন্তর অন্তর এ ব্যাংক থেকে ও ব্যাংক শাটল করবি। ওপরঅলা টার্গেট দেবে। যেই দেখবি ঝামেলা ওমনি অন্য ব্যাংকে এপ্লাই। এভাবেই চলে। তমাল শান্তি পেয়েছে। বাবা বলেছিল— সরকারি চাকরি পরীক্ষা দিয়ে আর পাবি বলে মনে হচ্ছে না। ওটার রিক্রুটমেন্ট পলিসি চেঞ্জ করে গেছে। এখনকার পলিসি অনুসারে ও চাকরির যোগ্যতাই নেই তোর।

এই সময় মায়ের খিটিমিটি বাড়ছে। ঘরে বসে আছে তমাল। এসি পুড়িয়ে সুইগি করে বাপমায়ের টাকার ছেরাদ্দ করছে। কবে চাকরি পাবে কে জানে! যদিও তমাল জানে, এই পারিবারিক গলতা থেকে বেরিয়ে যেতে পারলে ওর কাজের অসুবিধে একেবারেই নেই। ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট। অন্য রাজ্যে চলে গেলেই সমস্যা শেষ। আপাতত আর ক’টা দিন কুঁড়েমি করে কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।

সেদিন সকালে মা-বাবা বেরিয়ে যাবার পর তমাল একবার বারান্দায় গেল। ইশ! গাছগুলো শুকিয়ে মুড়ে যাচ্ছে। অথচ মাটি তো ভিজে! রান্নাঘর থেকে খুন্তিটা এনে ও মাটি খুঁচিয়ে দিতেই দেখা গেল নীচে জল যাচ্ছে না। বেশ মন দিয়ে গাছ ক’টা খুঁচিয়ে জল দিল। বিকেলের দিকে মনে হল, গাছগুলো যেন একটু চোখ মেলেছে।

রাতে খেতে বসেছে। বাবা আড়চোখে চাইলেন। —কী খবর? আজ খাবার এল না? তমাল বুঝতে পারেনি। —কীসের খাবার? —সুইগির? —না। —একসঙ্গে টেবিলে বসেছ, আজ কিছু স্পেশাল রান্না করেছে নাকি গীতাদি?

বাবার সেই চিমটি। উঠে গেলেই ভাল। কিন্তু তমাল উঠল না। মাকে ডাকল— আজ গাছের গোড়া খুঁচিয়ে জল দিয়েছি। দেখেছ? বাবা আবার বললেন— পাতাটাতা আছে না মরে গেছে? আশ্চর্য লোক কিন্তু! ঘর থেকে এক পা গেলে বারান্দা। দেখে এলেই মেটে! তমাল দেখল মা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ক’দিন মনমরা হয়ে আছে। নতুন পোস্ট নেই। মা বললেন— সাধন নাকি কিছু না বলে চলে গেছে। অনেকেই খোঁজ করেছে। কিন্তু ওদের কাছে খবর নেই। তবে নার্সারির লোকটা ভাল। ওই দানাগুলো দিয়েছে। মাত্র পঁয়ত্রিশ টাকা একশো। স্প্রে করার ওষুধও দিয়েছে। পঞ্চাশ টাকা একটা শ্যাসে। একটু সময় দিতে পারলেই গাছগুলো বেঁচে থাকবে। এগুলোর জন্য সাধন কত নিত কে জানে।

তমাল প্রমাদ গুনল। এই দায়িত্বটা কি তার ঘাড়ে আসতে চলেছে? সে জিজ্ঞেস করল— নার্সারির লোকটা সাধনদার সম্পর্কে কিছু জানে না? গেল কোথায় লোকটা? মা বললেন— গরিব মানুষের আবার ঠিকানা। খুব কষ্টের জীবন। লোকটা বলছিল। আমার অবশ্য মাথায় আসেনি। কাল জিজ্ঞেস করব। কোথায় থাকে জেনে আসব। তুই একবার খোঁজ নিবি?

বিরক্ত লাগছিল। বড্ড গরম এবার। বৃষ্টির দেখা নেই। তবু তমাল ঘাড় নাড়ল। সাধনদাকে পাওয়া গেলে গাছের দায়িত্ব থেকে মুক্তি।

—ঠিকানাটা এনো। দেখব।

সেই আসা। হেরিয়াবাজারের লজে উঠে ওরা পরের গোটা দিনটা শুয়ে-বসেই কাটাল। নীচেই চপের দোকান। ভাতের হোটেল। দীঘা-কলকাতা বাসেদের চলাচল। প্রচুর গাড়ি। দুটো বাড়ি পাশেই একটা বেসরকারি নার্সিংহোম। কিন্তু সাধনদার বাড়ি এখানে না। বাঁ হাতি রাস্তায় তিন কিলোমিটার যেতে হবে। তাই মানসিক প্রস্তুতি চাই। গরমে বড় কষ্ট হয়েছে। কে জানে কত সময় লাগবে। আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা।

আজ দুজনে বেরিয়ে পড়েছে। একটা ভ্যানরিকশা ভাড়া করে ওরা চলেছে লাখি। সাধন জানার গাঁ। রিকশাওলা দেখা গেল বেশ ওয়াকিবহাল। গ্রামের সবুজ চিহ্ন হেরিয়াবাজারের কাছে একটুও ছিল না। বরং খানিক ময়লা, অগোছালো একটা এলাকা। কিন্তু ভ্যান কিছুদূর যাবার পর ধীরে ধীরে সবুজ জেগে উঠতে থাকল। তমালের মনে হচ্ছিল, এই এত সবুজ! সাধনদাদের চেয়ে কে বেশি পারবে ফুল ফোটাতে? ওরা গাছের সঙ্গে কথা বলে। একটা মোহন ভাব এসে মন ছেয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ রিকশাটা থামতে ওর হুঁশ ফিরল। একটা পাড়া যেন। পথটা পিচঢালা, তবে খানাখন্দে ভরা। দুদিকে জমির মধ্যে মধ্যে বাড়িঘর। মাটির বাড়িগুলো যেমন আছে তেমনি এক একটা পাকাবাড়িও দেখা যাচ্ছে। তমাল কুশলের দিকে চাইল— চল লোকজনকে জিজ্ঞেস করি। এখানেই কোথাও থাকে বলেছে। গ্রাম আর কত বড় হবে। রিকশাওলা আড়চোখে ওদের দেখে ভাড়া নিয়ে চলে যেতে চাইছিল, কিন্তু কুশল থামাল। ‘দাঁড়াও। আমরা ফিরব তো।’ ‘আপনাদের দেরি হবে।’ তমাল হাত নেড়ে ওর কথা উড়িয়ে দিল— না না। আমরা চলে যাব। একটু দেখে নিই।

সামনে রাস্তার পাশে একটা মেটে একতলা বাড়ির পেছনে পাঁচিল ঢাকা গোলাপি রঙের পাকা দোতলা। তমাল রিকশাওলাকেই জিজ্ঞেস করল— গ্রামপ্রধানের বাড়ি নাকি গো? রিকশাওলা ওদের চমকে দিয়ে বলল, ওটা সাধন জানার বাড়ি।

সাধন জানার বাড়ি? তমাল কুশলের দিকে চাইল। এ কী অসম্ভব কথা! একটা গরিব লোক, তাদের ফ্ল্যাটবাড়ির দোরে দোরে ঘুরে গাছ দেখাশুনো করে, তার এত বড় বাড়ি?

তমাল একটু একটু করে বাড়িটার দিকে এগোয়। পাঁচিলের মাঝে বেশ ফাঁকা জায়গা। সেইখান দিয়ে ভেতরে চোখ ফেলতে পরিপাটি বাড়িটা ভেসে উঠল।

পুকুরধারে বসেছিল কুশল আর তমাল। সাধনদা তমালকে দেখে একটু ঝামেলায় পড়েছিল। কী বলবে বুঝতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত যা জানা গেল, কলকাতায় তার আর যাওয়ার দরকার পড়ছে না। এখন নিজের পুকুরের ধারে ওদের বসিয়েছে, —মাছ ধরো। গাছের ডাব খাইয়েছে। যত্ন করে দুপুরে ভাত খাইয়েছে। তমাল কুশলের দিকে চাইল।

—খুব অতিথিপরায়ণ কিন্তু, যাই বল।

কুশল ভুরু কপালে তুলল। —অতিথিপরায়ণ! ধুর! তোকে গ্যাটিস দিচ্ছে। যাতে বাড়ি ফিরে কাকিমাকে এসব বিন্দুবিসর্গ না বলিস।

—কেন? বললে কী হবে? এত কষ্ট করে একটা গরিব লোক গাঁয়ে ঘরদোর করেছে, মায়ের ভালই লাগবে। আর ও তো ফিরেও যাচ্ছে না।

—মুণ্ডু তোর। জানিস লোকটার কত টাকা? এমন বাড়ি, এত জমি, পুকুর। রীতিমত পয়সাওলা লোক। কাকিমাকে আর ওরকম কত কত লোককে ভোগা দিয়ে বড়লোক। শুধু কি কলকাতাতেই জালিয়াত থাকে রে?

তমাল মাথা ঝাঁকায়। —না না। তা নয়। অনেক কষ্ট করেই ও রোজগার করে। সেই পয়সা জমিয়েই হয়তো এতটা করেছে। তুই খারাপ ভাবছিস।

কুশল প্যান্টের পেছনে হাত দিয়ে ঝেড়ে উঠে পড়ে। —চল, সন্ধের বাসটা পেয়ে গেলে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাব।

ওরা চলে আসবে। রিকশাওলাও খেয়েদেয়ে তৈরি। সাধন কাঁচুমাচু মুখে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর সামনে দুটো কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে। মাথায় হাল ফ্যাশনের চুল। বেশভূষা চাষাভুষোর মত মোটেই নয়। ওরই ছেলে মনে হয়। ওদের দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠল সাধন— যা এখান থেকে। ভেতরে বলে দে, ফিরতে দেরি হবে। ছেলেদুটো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

ভ্যান এগিয়ে যেতে থাকল। ছেলে দুটো ক্রমে দূরে সরতে লাগল।

হেরিয়াবাজারে পৌঁছে সাধন ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কোথা থেকে সে একটা গাড়ি যোগাড় করেছে। হাত দুটো জোড় করে সে তমালের সামনে এসে দাঁড়াল।

—তমালদাদা, এই গাড়িতে চলি যাও। বাসে কষ্ট হবে। পয়সা দিতি হবে না। আমাদের চেনা লোক। যাও দাদারা। তোমাদের জন্যি কিছু করলে মনটা বড় আনন্দ পায়।

সারা রাস্তা আসতে আসতে তমাল ভাবছিল। সাধনদার একটা গোটা বাড়ি আছে। পুকুর জমি সব আছে। তাদের আছে আকাশে ভাসা একটা ফ্ল্যাট। সেখানে সাধনদা টবের গাছ দেখাশুনো করে। মায়ের কথা অনুসারে ফক্কি দিয়ে সার-ওষুধ বেচে। এরকম অনেকগুলো ফ্ল্যাটে অনেকগুলো টব দেখে ও মাসে কত রোজগার করে? নার্সারির লোকটা মাকে বলেছিল, সাধনের শহরে থাকার ঘর নেই। ও হাঘরে। ওরা ধরে নিয়েছিল সাধনদা একেবারে নিঃস্ব। কেন ধরেছিল ওরা? তমাল খুব ভাবে। অথচ সাধনদা নিজের মুখে তো কিছু বলেনি। তার চেহারাতেই কি এই গরিবি ফুটে উঠত?

চলার মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো শব্দ কানে আসছিল। কুশল কথা বলছে গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে।

—কতদিন গাড়ি চালাও?

—আজ্ঞে বাবু, পনেরো বচ্ছর।

—এইখানেই থাকো?

—এইখানে দেশ।

—থাকো কোথায়?

—আজ্ঞে, কলকাতায় বেশি। মাঝে মাঝে দেশে আসি।

—সাধনদাকে খুব মানো দেখছি। কতদিন চেনো?

—অনেকদিন।

—এক গাঁয়ের লোক?

—না। কুটুম।

—কুটুম? কে হয়?

—আমার সম্বন্ধী।

লোকটার কথায় বার্তায় বিনয় ফুটে উঠছিল। গরিব মানুষ যেমন হয় আর কী।

লোকটা মাঝে গাড়ি দাঁড় করিয়ে কতগুলো প্যাকেট তুলল। কুশল জিজ্ঞেস করল— কীসের মাল? লোকটা বিরক্ত হল কিনা বোঝা গেল না। বলল— সার, বিষ, এইসব।

তমাল চমকে তাকাল— তোমার নার্সারি আছে?

লোকটা ঘুরে তমালকে দেখে, আর একটি কথাও না বলে গাড়িতে স্পিড তোলে।

হতভম্ব তমাল নার্সারির গরিব লোকটার অলটোতে চড়ে কলকাতা ফিরতে ফিরতে ভাবে, সাধনদা, ওর ভগ্নীপতি সকলে কী ভীষণ গরিব!
বাড়ি ফিরে তমাল টবগুলোর কাছে গেল। অন্ধকারে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গাছগুলোর দিকে চেয়ে মনে মনে বলল, এবার আমিই দেখব তোমাদের।

মা তখন জেনেছেন, সাধন জানার বড্ড অসুখ। ও এখন আসতে পারবে না। তমাল ততদিন না হয় গাছ ক’টা দেখাশুনো করবে।
কুশল সোজা বাড়ি চলে গেছে। ভীষণ গরম। যাবার সময় তমালকে শাসিয়েছে— আজ যদি বৃষ্টি না পড়ে তো তোর একদিন কী আমার একদিন। কাকিমাকে বলে দেব সাধন জানা লোকটা একটা জোচ্চোর। তমাল ভুরু কোঁচকায়। জোচ্চোর কেন?

খেতে খেতে বাবা একবার আড়চোখে তাকালেন, —দীঘা মিস? তমাল চোখে হাসল। বাবা ঠিক জানে, তমাল সব বলেনি।

বাইরে তখন বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
Advertisement
3.5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

ভূতের একটি বাজে গল্প

দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিতেই প্রথমে যেটি চোখে পড়ল, সেটি সেই লাল-হলুদ মাফলার, খাটের পাশে ঝোলানো। তাহলে সিড়িঙ্গেবাবু নিশ্চয়ই এই ঘরেই অধিষ্ঠান করেন, তালা দিয়ে কোথাও বেরিয়েছেন। হঠাৎ আমি ভূতগ্রস্তের মত করিডর ধরে হাঁটছি আর এক-একটা করে ঘরের দরজা ঠেলে ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছি। কী আশ্চর্য, প্রতিটি ঘরেই কোথাও না কোথাও দেখছি একটা করে ওই লাল-হলুদ মাফলার ঝুলছে। যত দ্রুত পারি দোতলায় ঘরগুলোর দরজা ঠেলে উঁকি দিলাম। সবখানেই এক ছবি।

Read More »
সুজিত বসু

কবিতা: জীবনের নানা দিক

ট্রেনের জানালা থেকে চোখে পড়ে ঘাসের গালিচা/ কোমল রোদের স্নেহে ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চল শান্তির নিদ্রায়/ সমুদ্রে দ্বীপের মতো ছোট ছোট বাড়িগুলি ঘাসের শয্যায়/ অতি দ্রুত বদলে যায় দৃশ্যাবলি, ট্রেন থামে ব্রাসেলস স্টেশনে/ বেলজিয়ামের মোহ দূরে রেখে ট্রেন চলে স্থির নিশানায়/ অভ্রান্ত লক্ষ্যের দিকে, আমস্টারডাম ডাকে কুহকী মায়ায়/ নগরে পৌঁছেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য, সুন্দরী ট্রামেরা/ হাতছানি দিয়ে ডাকে, বহু বহুদিন পরে প্রিয় বাহনের/ ডাকে সাড়া দিয়ে আমি পৌঁছে যাই মহার্ঘ নিবাসে

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব

আমাদের খেলা করা দরকার, তাই আমাদের কয়েকজন ছেলে মিলে ক্লাব তৈরি করতে হবে। কোথায় করা যায়? — অমুক জায়গায় — ওই জায়গাটা পড়ে আছে, তা যাদের জায়গা তারা বললেন, “ওই তো ওখানে জঙ্গল হয়ে আছে, তা যদি তোমরা জঙ্গল-টঙ্গল পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে ক্লাব তৈরি করতে পার তো করো।” আমাদের আর পায় কে — আমরা মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলে। উদ্ধার করলাম। উদ্ধার-টুদ্ধার করে এর বাড়ি থকে চারটে বাঁশ, ওর বাড়ি থেকে তিনটে হোগলা এভাবে যোগাড়-যন্ত্র করে-টরে একটা চালাঘর তৈরি করা হলো। সেই চালাঘরকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে আমাদের নতুন লাইব্রেরী তৈরি হলো। ক্লাবের নাম হলো ‘সেনহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাব’।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো! সেই থেকেই ‘বাগনান’!

ছোট্ট ওই ভূখণ্ডটি বাঘের উপস্থিতির জন্যই তখন ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয় বলে প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরার অভিমত। এই বিষয়ে তিনি আরও জানান, আরবি ভাষা অনুযায়ী ‘নান’ কথার অর্থ হল ‘চরভূমি’। ‘নান’ শব্দের আরও একটি অর্থ হল ‘ছাউনি’। তখন কাছারিপাড়া ছাড়াও নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় ইংরেজ সেনাদের ছাউনি ছিল বলে জানা যায়। যার মধ্যে খাদিনান, পাতিনান, খাজুরনান, বাইনান, চিৎনান, মাছিনান ইত্যাদি জনপদগুলি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু নদীর চরে বাঘেশ্বরী দেবীর পুজো হত, সেই জন্য প্রাথমিকভাবে এলাকাটি ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ‘বাঘনান’ অপভ্রংশ হয়ে ‘বাগনান’-এ পরিণত হয়েছে।

Read More »
আবদুল্লাহ আল আমিন

কবিগান: সমাজবাস্তবতা, বিষয়বৈভব ও রূপবৈচিত্র্য

এমন লোকপ্রিয় বিষয় বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা ভাষা, সঙ্গীত ও সাহিত্যে কবিগান ও কবিয়ালদের অবদানের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগান সংগ্রহ এবং এ বিষয় পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে কবিয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কিংবা কবিগানকে সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক এ গানকে সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই গানের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে লোকায়ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক যার অধিকাংশই অনালোচিত ও অনালোকিত রয়েছে অদ্যাবধি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »