Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

দেশের ভেতর দ্বেষ

দেশ। শুধুই কি এক ভৌগোলিক ভূখণ্ড? একটুকরো জমির অধিকার? কখনওই তা হতে পারে না। দেশ মানে সেই ভূখণ্ডে বসবাসকারী মানুষ, তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ওঠাপড়া, প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই, সমগ্র ভূখণ্ডের প্রতি এক প্রবল আবেগ এবং আনুগত্যের মিলিত প্রয়াসই গড়ে তোলে ‘দেশ’। সেই দেশে যেমন থাকে ভালবাসা, পাশে থাকার অঙ্গীকার তেমনই থাকে দ্বেষ, পরস্পরের লড়াই।

সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারের পরে, সিন্ধুর বুক দিয়ে বয়ে গেছে অনেক স্রোত। আর্য এবং ভূমিপুত্রদের দ্বন্দ্ব দিয়ে যে লড়াইয়ের শুরু, অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে সেখানে ক্রমশ এসেছে বৈদিক যুগ, তারপর রাজতন্ত্রের এক লম্বা ইতিহাস পার করে এসেছে সুলতানী সাম্রাজ্য, মুঘল রাজত্ব। তারও পরে ব্রিটিশ শাসন। ব্রিটিশরাজের সঙ্গে লড়াইয়ের শেষে জন্ম নিয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র। সংবিধান অনুযায়ী সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষ।

প্রাচীন ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখতে পাই, চিরদিনই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সাধনা করে এসেছে এই দেশ। যে দেশ রাজচক্রবর্তীত্বের ধারণাকে পোষণ করেছে, সেই দেশেই আবার ছোট ছোট প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রও বহাল তবিয়তে সুরক্ষিত ছিল। দোর্দণ্ডপ্রতাপ মৌর্য শাসন থেকে শুরু করে গুপ্তযুগ, পরবর্তী কালে সুলতানী ও মুঘল আমলে, এমনকি ইংরেজ শাসনকালের কিছু সময়ও রাজনৈতিক কাঠামোয় এই বহুত্ববাদ সমানভাবেই বজায় ছিল। কিন্তু সমস্যার শুরু তারপর থেকেই। ইংরেজদের হাত ধরেই এদেশে প্রবেশ করে জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রথম প্রয়াস।

রাষ্ট্রতন্ত্রের একটি প্রধান স্তম্ভই হল জাতীয়তাবোধ। যদিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ অনেক চিন্তাবিদই জাতীয়তাবাদকেই দায়ী করেছেন এবং এর নেতিবাচক দিকগুলিও তুলে ধরেছেন, তবু একথা অনস্বীকার্য যে প্রবল জাতীয়তাবোধের বিস্ফোরণই ইংরেজ শাসনের পতন ঘটিয়ে জন্ম দিয়েছিল স্বাধীন ভারতের।

অবশ্য একথাও উল্লেখ্য যে, দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদ সম্পূর্ণ দুটো আলাদা শব্দ, আলাদা বোধ। দেশপ্রেম নিজের দেশকে যেমন ভালবাসতে শেখায় তেমনই অন্যের প্রতি বিরূপতা শেখায় না, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণতার পরিচায়ক। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে অন্যকে অবজ্ঞা করতে শেখায়, জন্ম নেয় হিংসা, দ্বেষ।

অন্ধ, সংকীর্ণ, উগ্র জাতীয়তা যুগে যুগে যুগে মানব সভ্যতাকে কালিমালিপ্ত করেছে, কেড়ে নিয়েছে অসংখ্য প্রাণ, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিপুল সম্পদ। হিটলার জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে গিয়ে, জার্মান জাতিকে শুদ্ধ রাখার মরিয়া চেষ্টায় লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন। এভাবেই উগ্রজাতীয়তাবাদের এক কলঙ্কময় নিদর্শন তৈরি করে গেছেন তিনি। ‘৪৭-এর পরে পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্র চেয়েছিল নিজেদের জাতীয়তাবাদ, সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বকে পূর্ব-পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে দিতে। যার পরিণতি ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, যা পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বোচ্চ রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার সংগ্রাম।

ক্ষমতার বাঁটোয়ারা, সিংহাসনের লোভ দেশভাগের একটা বড় কারণ হলেও, উগ্র জাতীয়তাবাদের তত্ত্বকেও অস্বীকার করা যায় না। ‘৪৭-এ ভারত ছাড়ার আগে ব্রিটিশরাজ মূলত দ্বিজাতিতত্ত্বের আগুন উস্কে দিয়েই নেহরু, জিন্নাদের সঙ্গে রাজনৈতিক আঁতাত সম্পূর্ণ করে। তখনকার উস্কে দেওয়া আঁচই আজও মাঝে মাঝেই তার অস্তিত্বের জানান দেয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন উগ্র জাতীয়তাবাদকে প্রকট করেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম—

‘৪৭-এ ‘ইন্সট্রুমেন্ট অফ এক্সেশন’-এর মাধ্যমে কাশ্মীর যুক্ত হয় ভারতের সঙ্গে। পরবর্তীকালে পাকিস্তান ও চিন কাশ্মীরের কিছু অংশে ঢুকে পড়ে নিজেদের বলে দাবি করে। অন্যদিকে যে চুক্তি অনুযায়ী কাশ্মীরের ভারত অন্তর্ভুক্তিকরণ, দিল্লি তার সঠিক মর্যাদা না দেওয়ায় সেখানে সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি হয়। ভারত আর পাকিস্তানের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ, গোটা ভূস্বর্গ জুড়ে বন্দিদশা দেখতে দেখতে এই প্রজন্ম ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। মূলত এরাই জন্মভূমির মুক্তির দাবিতে লড়াইয়ে সামিল, হাতে তুলে নিয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন। মদত দিচ্ছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জঙ্গিহামলায়। মূলত ১৯৮৯-৯০ সাল থেকে এর সূত্রপাত। এমতাবস্থায়, সংবিধানের যে ৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর বিশেষ রাজ্য হিসেবে কিছু বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা পেত, বাতিল করা হয়েছে সেই অনুচ্ছেদ, শুধু তাই নয়, জম্মু ও কাশ্মীর দুই পৃথক রাজ্যের সৃষ্টি করা হয়েছে। গত ৫ আগস্ট ২০১৯ এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই এর বিরুদ্ধে ক্ষোভে, প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে গোটা উপত্যকা। পরিস্থিতি সামাল দিতে কারফিউ জারি করতে হয়েছে। পুরো বিশ্বের থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে ভারতের সুইজারল্যান্ডকে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপ কি আদৌ ভূস্বর্গের এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে চিরতরে নির্মূল করে শান্তি ফেরাতে পারবে, নাকি আরও জোরদার হয়ে উঠবে আজাদির লড়াই? সমগ্র বিশ্ব এখন সেই উত্তরের অপেক্ষায়।

ভারতবর্ষে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে যে জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলে আসছে তা হল ‘নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন’। উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগা জনজাতি অধ্যুষিত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে গ্রেটার নাগাল্যান্ড বা নাগালিম নামক পৃথক সার্বভৌম দেশ গড়ার দাবি বহুদিনের পুরোনো এবং এই দাবিতে সহিংস আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন NSCN (IM)। ১৯৪৭-এ আঙ্গামি ফিজোর নেতৃত্বে নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিল প্রথম এই দাবি তোলে। পরে NSCN দুই গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে গেলে ভারত সরকারের সঙ্গে তারা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে, নাগা আন্দোলন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে ২০১৯-এর ১৪ আগস্ট নাগাল্যান্ডে পৃথক জাতীয় পতাকা উঠতে দেখা যায় এবং নাগারা তাদের ‘স্বাধীনতা দিবস’ পালন করে। অন্যদিকে অক্টোবরে নাগাল্যান্ডের জন্য পৃথক পতাকা এবং সংবিধানের দাবিতে সরব হয় প্রধান বিরোধী দল NPF, যার ফলে ফলে আবারও ক্রমশ পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে।

দার্জিলিং পাহাড় এবং ডুয়ার্সের গোর্খা জনজাতিও পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করছে। GTA গঠন করে গোর্খাদের আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনিক অধিকার প্রদান করে এই আন্দোলনকে স্তিমিত করা হলেও বর্তমানে ৩৭০ ধারা বিলোপের পরবর্তী পরিস্থিতি গোর্খাল্যান্ডের ইস্যুতে কিছুটা ইন্ধন যুগিয়েছে।

দক্ষিণ ভারতেও দীর্ঘদিনের তেলেঙ্গানা আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে ১০টি জেলা নিয়ে তৈরি হয় পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য।

উগ্র দেশপ্রেম, উগ্র জাতীয়তাবাদের মতই বা তার থেকেও ভয়ংকর আর-একটি সমস্যা হল উগ্র ধর্মান্ধবাদ, যার ফলশ্রুতিতেই জন্ম নিয়েছে ধর্মীয় বিদ্বেষ, পরস্পরে হানাহানি। পৃথিবীর ইতিহাসকে বারবার কলঙ্কিত করেছে রক্তের দাগ।

উনিশ শতকের পূর্বে ইহুদি বিদ্বেষের মূল কারণ ছিল ধর্মভিত্তিক। নাৎসি বন্দি শিবিরে প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হয়, যা ‘Holocaust’ নামে পরিচিত। ২০০১ সালে world Trade center-এ জঙ্গি হানার পরবর্তী সময়ে পশ্চিমের দেশগুলিতে মুসলিম বিদ্বেষ চরম আকার ধারণ করে। ২০১৬-১৭ সালে মায়ানমারের ‘রাখাইন’ রাজ্যে সশস্ত্রবাহিনী এবং পুলিশ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সামরিক অভিযান চালায়। নির্বিচারে হত্যা, গণধর্ষণ, শিশুহত্যা করা হয়। লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা বাধ্য হয় দেশ ছাড়তে। সামরিক বাহিনীর উপর অজ্ঞাত বাহিনীর হামলাকে কারণ বলে প্রচার করা হলেও মুসলিমদের ওপর বৌদ্ধদের ধর্মীয় বিদ্বেষকেই এর কারণ বলে মনে করা হয়।

২০০১ সালে আফগানিস্তানে তালিবানদের হাতে ধ্বংস হয় দেড় হাজার বছরের পুরনো ঐতিহাসিক বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি, যা পৃথিবীর বৃহত্তম বুদ্ধমূর্তিগুলোর একটি।

আমাদের দেশেও বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় বিদ্বেষ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তার ফলশ্রুতিতে ঘটে গেছে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।

১৯৪৭-এ ভারত ছাড়ার আগে ইংরেজ সরকারও এই ধর্মবিভাজনকেই হাতিয়ার করেছিল। সম্পূর্ণ ধর্মের ভিত্তিতে ভারতভাগের সিদ্ধান্ত কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করলে মুসলিম লীগ হরতাল ডাকে। ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট এই প্রতিবাদ আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই কলকাতায় ঘটে যায় ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মাত্র ৭২ ঘণ্টায় ৪,০০০-এরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান। দ্রুত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালি, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাবে। শুধু নোয়াখালিতেই নিহত হন ৫০,০০০-১,০০,০০০ মানুষ। ধর্মান্তর, লুটপাট, অপহরণ, ধর্ষণ, অগ্নি-সংযোগ ঘটে নির্বিচারে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সংবিধানে ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ, সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সমস্ত মানুষের সাংবিধানিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকলেও, মাঝে মধ্যেই দেশের কোথাও কোথাও বিঘ্নিত হয়েছে শান্তি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েছে পরস্পরের সঙ্গে।

সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে কালো সময় গুজরাত দাঙ্গা। ২০০২-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি গোধরা স্টেশনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় সবরমতী এক্সপ্রেসে, মারা যান ৫৪ জন করসেবক। কোনও তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই মুসলমানদের ওপর ঘটনার দায় চাপিয়ে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। নির্বিচারে গণহত্যা, গণধর্ষণ, মুসলিমদের দোকানপাট, ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। পৈশাচিকতা সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করে গর্ভবতী মায়ের পেট চিরে গর্ভস্থ সন্তানকে বের করে ছুড়ে দেওয়া হয় আগুনে।

অফিসিয়াল রিপোর্ট অনুযায়ী, ১,০৪৪ জন মৃত, ২২৩ জন নিখোঁজ, ২,৫০০ জন আহত— যাদের মধ্যে ৭৯০ জন মুসলিম এবং ২৫৮ জন হিন্দু। অন্যান্য সূত্রের খবর যদিও অন্য কথাই বলে। মৃতের পরিমাণ ২,০০০-এরও বেশি এবং লক্ষ লক্ষ মুসলমান ঘরছাড়া হয়েছিলেন। যদিও পরে প্রমাণিত হয়, ট্রেনে আগুন লাগানোর ঘটনা ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং এর পেছনে ছিল গভীর ষড়যন্ত্র।

ভারত সরকারের এক তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ৪২২টি সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে, মারা গিয়েছেন ১১১ জন, ২,৩৪৮ জন আহত। শুধুমাত্র উত্তরপ্রদেশেই ঘটেছে ১৯৫টি ঘটনা। NCRB-র মতে, গত কয়েক বছরে সাম্প্রদায়িক ভায়োলেন্স বেড়েছে প্রায় ৪১ শতাংশ। সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গও সাক্ষী হয়েছে এরকম ঘটনার। ধুলাগড়, বাদুড়িয়া, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় রক্ত ঝরেছে ধর্মীয় সংঘাতে।

শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মের মধ্যেই বিদ্বেষ নয়, বর্ণবৈষম্যের লজ্জাহীন থাবাও রীতিমত ভয়ংকরভাবে চেপে বসে আছে সমাজের বুকে। স্বাধীনতার পরে সাড়ে সাত দশক কেটে গেলেও জাতপাতের দ্বন্দ্ব বহাল তবিয়তে বিরাজমান। বিহার, গুজরাত, রাজস্থান, তামিলনাড়ু কেউই পিছিয়ে নেই। দলিত নির্যাতন নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটে চলেছে এবং আমরা বাইরে যত আধুনিক হচ্ছি, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন আমরা ফিরে যাচ্ছি পেছনে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও গত ২০ জুলাই ইন্দ্র মেঘওয়াল নামের দলিত ছাত্রটি বড়জাতের জন্য নির্দিষ্ট জলের পাত্র ছুঁয়ে দেওয়ায় শিক্ষকের কাছে মার খায় এবং ২৪ দিন হাসপাতালে লড়াই করার পরে মারা যায়। রাজস্থানের জালোর জেলার এই ঘটনা স্থান পায় সমস্ত সংবাদপত্রের শিরোনামে। ২০১৬-তে হায়দ্রাবাদে রোহিত ভেমুলা, ২০১৭-তে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক-ছাত্র মুথুকৃষ্ণন জীবনান্দম, ২০১৯-এ মুম্বইয়ের এক বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তার পায়েল তদভী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন বর্ণবৈষম্য এবং জাতপাতের সংকীর্ণতার চাপে পড়ে। এমনকি ২০১৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে পুরীর মন্দির দর্শন করার সময় একদল পাণ্ডা মন্দিরে ঢুকতে বাধা দেন, নিচু জাত বলে অসম্মান করেন। এসব এক-একটি ঘটনা আসলে হিমশৈলের চূড়ামাত্র।

আবারও আমাদের রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমরা পেয়েছি আর-একজন আদি জনজাতির প্রতিনিধি দ্রৌপদী মুর্মুকে। তবে কি এবার জাতপাতের এই কালো অন্ধকার কাটবে! এমন দিন আসবে যেদিন সিডিউল কাস্ট, সিডিউল ট্রাইব, ওবিসি সংরক্ষণের দরকার পড়বে না। সবাই শুধুমাত্র তার নাগরিক অধিকার, তার যোগ্যতার ভিত্তিতেই পড়াশোনা, চাকরি-বাকরি, সামাজিক মর্যাদা সুরক্ষিত করতে পারবে!

একদিকে যেমন ধর্মান্ধরা উঠে পড়ে লেগেছে ধর্মরাজ্য তৈরির জন্য, তেমনই কিছু মানুষ সেসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন, নিরপেক্ষতার মুখ তুলে ধরছেন এটাই আশা জাগায়। আজ যদিও তাঁরা সংখ্যায় কম তবুও নিশ্চয়ই সব ষড়যন্ত্রের নিরসন হবে এই স্বপ্ন দেখছেন বহু মানুষ। টুকরো টুকরো জাতিসত্তা নয়, এক বিরাট বিপুল ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরে এই দেশ আবার জগৎসভায় তার শ্রেষ্ঠ আসনটি পাকা করবে। একজন স্বাধীন ভারতবাসী হিসেবে এর চেয়ে বড় স্বপ্ন আর কী দেখতে পারি!

চিত্র: গুগল
Advertisement
3 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সোমেন চন্দ: এক বহ্নিময় কথাকার

মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন, যদিও তা অসমাপ্ত থাকে। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘বন্যা’। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি অসমাপ্ত-ই থেকে যায়। আরও দুঃখের বিষয়, এর বৃহদংশ হারিয়েও গেছে। আজ যে সোমেন চন্দের লেখককৃতির জন্য আমরা তাঁকে স্মরণ করি, তা হল তাঁর বেশ কিছু অসামান্য ছোটগল্প। সংখ্যায় খুব বেশি নয়, মাত্র চব্বিশটি। আরও কিছু গল্প লিখলেও তা কালের ধুলোয় হারিয়ে গেছে। গল্পের সংখ্যা সামান্য, তবে অসামান্যতা রয়েছে সেগুলির রচনার পারিপাট্যে, বিষয়বস্তু চয়নে, শিল্পিত প্রকাশে ও লেখনীর মুনশিয়ানায়। এছাড়া তিনি দুটি নাটিকাও লেখেন, ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রস্তাবনা’। লেখেন কিছু প্রবন্ধ। তাঁর ছোটগল্পগুলি এতটাই শিল্পোত্তীর্ণ ছিল যে, তাঁর জীবিতকালেই একাধিক ভাষায় তা অনূদিত হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »